গত বছর মে মাসে চল্লিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পুড়ে যাচ্ছিল আমার শহর একদিন। আর সেদিনই আমাকে বেরোতে হল দুপুরে। ছাতা নিয়েছিলাম। টাকা তুলতে পাড়ার এটি এম এ ঢুকলাম। সেটা খারাপ।আমার না এমনই হয় জানেন। কাল সন্ধেবেলা গেলাম বাগবাজারে একটি দোকানে চা আনতে।এমনিতে খরিদ্দারে ভর্তি থাকে দোকানটি। মোটামুটি এক লিটার ঘাম তখনই বেরিয়ে গেছে আমার শরীর থেকে। তখন একটাও খরিদ্দার নেই দোকানে। আমি পৌঁছতেই ওদের পুজো শুরু হল। সবকটা ঠাকুরের গলায় মালা পরানো,প্রত্যেক ঠাকুরের সামনে অন্তত তিন মিনিট করে ধুপ গোল গোল করে ঘোরানো। এবং মোস্ট ইম্পর্টেন্টলি দুটো দু হাজার টাকার নোটও সব ঠাকুরকে দেখানো। তারপর ওরা নিজেরা চা খেয়ে আবার চালু হল দোকান। ততক্ষনে আমার আরো দেড়শো গ্রাম ঘাম ঝরেছে ।
বলছিলাম এ টি এম এর কথা। পাড়ারটা খারাপ মানে যেতে হবে দত্তবাগান মোড়ে। দেখি সেটারও ঝাঁপ বন্ধ। এখানে একটি চমৎকার ছেলে পাহারাদার। আমায় বললো - কাকু, দাঁড়িয়ে যান। টাকা ভরা হচ্ছে।
দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রবল গরম। ছাতা বন্ধ করতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা ঘেলাম ছাতার কাপড়ে। দাঁড়িয়ে আছি। দেখি এক ভদ্রলোক বেরোলেন পেট্রল পাম্পএর অফিস থেকে। এই পাম্পেই এ টি এম টা। কানে মোবাইল - বলছিলেন - ম্যায় ভুট্টো বোল রাহা হুঁ। বুঝলাম ইনি বাঙালি নন।
ফোন শেষ করে তিনিও দাঁড়ালেন ছায়ায় আমাদের সংগে। এবার বাংলায় কথা বলতে লাগলেন।
দুজন কর্মচারীতেল ভরছিল গাড়িতে। দুজনেই দেখলাম প্লাস্টিকের গেলাসে ঠান্ডা জল খাচ্ছেন। আমার না তাই দেখে ভীষন তেষ্টা পেল। টাকা তুলে অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে বললাম - একটু খাবার জল পাওয়া যাবে?? সংগে সংগে সেই ভুট্টোবাবু বললেন - নিশ্চয়ই। এই, কাকুকে জল দে। সামনেই দেখলাম ব্লু স্টার এর একটা ওয়াটার কুলার। তেষ্টাটা বেড়ে গেল। দেখলাম যাকে জল দিতে বলা হল সে একটা ব্যবহৃত স্প্রাইটের বোতল নিয়ে আমাকে টপকে বাইরে এল। আমিও তার পেছনে পেছনে এলাম দেখি একটা রাস্তার কলে তিন চারবার চাপড় মেরে জল ভরছে সে বোতলে । আমি বললাম ভাই একটু হলেই চলবে। এক ঢোঁক খেয়ে চলে এলাম। ভয়ংকর ইচ্ছে করছিল ঠান্ডা জল খাবার। বাড়ি এসে খেলাম।।
আমরা, পাড়ার বন্ধুরা বেনারস গিয়েছিলাম চুয়াত্তর সালে। প্রায় এগারোজন। ফেরার সময় টাকাপয়সা শেষ। মোগলসরাই থেকে হাওড়া - দিল্লি জনতা এক্সপ্রেসের জেনারেল কামরায় ফিরছি। মোগলসরাই পেরিয়েই এক মোষ কাটা পড়লো ট্রেনে। ট্রেন আর চলেই না। জল ফুরিয়ে গেছে। প্রচন্ড গরম। কামরাটা ফুটছে গরমে। গার্ডসাহেব বললেন ঘন্টা দুয়েকের আগে ছাড়বেনা ট্রেন। আমাদের বললেন - মাঠ পেরিয়ে সামনের গ্রামে চলে যান। জল পেয়ে যাবেন। গাড়ি ছাড়বেনা। নিশ্চিন্তে যান।আমরা তো চললামই। আমাদের সংগে আরো জনা পঞ্চাশ লোক। সবার হাতে ওয়াটার বটল।
গ্রামে ঢুকতেই প্রথমে দেখলাম বিশাল বড় কুয়ো। একটা কপিকল এর মত করা। তার একটা ধারে একটা মাঝারি সাইজের পাথর বাঁধা দড়ি দিয়ে, আর এক দিকে একটা বড় বালতি বাঁধা। দড়িটা ধরে বালতিটা আসতে আসতে নীচে নামালে পাথরটা ওপরে উঠে যাচ্ছে। আবার বালতিতে জল ভরা হয়ে গেলে পাথর নীচে নেমে আসছে। চমৎকৃৎ হয়েছিলাম সেই কপিকল দেখে।
গ্রামের লোকেরা আগে থাকতেই দেখতে পেয়েছিলেন আমাদের। একটা লম্বা বাঁশ আধখানা চেরা সমান করে লাগানো ছিল কুয়োর পাশে। একজন বসে জল ঢালছিলেন বাঁশের একদিকে। আর আমরা আঁজলা পেতে বাঁশের আর একদিকে পান করছিলাম সেই জল। ঠান্ডা, মিষ্টি জল। শুধু জল নয়। সংগে প্রত্যেককে এক মুঠো ভিজে ছোলা আর এক টুকরো গুড়। সবার ওয়াটার বটলে জলও ভরে দিলেন সেই গ্রামবাসীরা।
আমরা জানতে চাই নি, ওরাও বলেন নি ওরা কি জাত? হিন্দু না মুসলিম না দলিত। শুধু বুঝতে পেরেছিলাম ওরা ভারতবাসী। এরা প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দুবার ভাবেন না
অফিসে ওয়াটার কুলার রেখে এক তৃষ্ণার্ত বৃদ্ধকে একটা নোংরা বোতলে রাস্তার কলের জল দিচ্ছে শহরের মানুষ। অথচ, আমাদের ছোটবেলাতেও গরম পড়তো জানেন। বাড়ির দরজায় এসে কেউ এই সময় জল চাইলে আমাদের মা কাকিমারা তাদের জলের সংগে বাতাসা দিতেন।
পাড়ায় পাড়ায় নির্দিষ্ট জায়গায় বড় মাটির জালাতে জলের সাথে ভেজা ছোলা আর গুড় রাখা থাকতো। আমি দেখেছি।
আমাদের পাড়াতেও আমাদের কাউন্সিলর একটা বড় ওয়াটার কুলার বসিয়ে দিয়েছেন। মানুষজন জলও খাচ্ছেন পরম তৃপ্তিতে সেই মেশিন থেকে। তবু মেসিনের জলে সেই কি সেই আন্তরিকতা আছে??
সেদিনের পাম্পের অভিজ্ঞতা সহসা মনে করালো বিহারের এক অখ্যাত গ্রামের সেই আন্তরিক মানুষজনকে।মাকে তো মনে পড়ে নিত্যদিন।
আমার সেই "এক টুকরো" ভারতবর্ষ কে মনে করানোর জন্যে ধন্যবাদ ভুট্টোবাবু।
~~~~
আজ আমার জীবনে দেখা বীভৎসতম ঘটনার কথা লিখতে যাচ্ছি। আগেও অনেকবার ভেবেছি লিখবো।কিন্তু লিখিনি।
এটা দেখেছিলাম দু'হাজার ন সালের সাতাশে মে। বুধবার ছিল সেদিন। ডাইরি লেখার অভ্যেস ছিল আমার তাই এত ডিটেলে লিখতে পারলাম। সল্টলেক ব্রাঞ্চে আমি তখন। রোজ বাড়ি থেকে হেঁটে উল্টোডাঙা, তারপর সেখান থেকে অটোতে ব্যাঙ্ক। এই ছিল আমার রুটিন। ফেরার সময়ও তাই। আমাদের এ দিক থেকে শর্টকাট রাস্তা ধরে উল্টোডাঙা স্টেশন এর প্লাটফর্ম দিয়ে গিয়ে নেমে যেতাম আমরা।
তো সেইদিন ফেরার সময়। গরমকাল। পরিস্কার দিনের আলো। প্লাটফর্ম থেকে নামলেই খালের ওপর ব্রীজটা। মোট চারটে লাইন এখানে। দুটো আপ আর দুটো ডাউন।
হঠাৎ শুনি প্রচুর মানুষ চেঁচাচ্ছে। সরে যান, সরে যান, ট্রেন আসছে। দেখি ব্রীজের একটু আগে একটি লোক লাইনের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে। আর পেছনে শেয়ালদার দিকে যাবার ডাউন ট্রেন আসছে। অনেকেই জানেন মনে হয় ইলেকট্রিক ট্রেন খুব নিঃশব্দে আসে। লোকটি কে মনে হচ্ছে ভূতে পেয়েছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন কিন্তু এত লোকের চিৎকার ওর কানে যাচ্ছে না। ট্রেনের চালক ঘন ঘন হর্ণ বাজাচ্ছিলেন। স্পিডও কমিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাও আমার এবং আরো অনেকের চোখের সামনে ট্রেনটা ধাক্কা মারলো লোকটিকে।
লোকটির দেহটা অন্ততঃ পাঁচ ফুট ওপরে উঠে ধাক্কা মারলো ব্রীজটাতে। তারপর পড়ে গেল নীচে খালের ধারে।
পিল পিল করে লোকজন, নারী পুরুষ শিশু ছুটে আসতে লাগলো। আমি চাইলেও চলে আসতে পারছিলাম না এত লোক আসতে শুরু করলো।ফলে আটকে পড়লাম ওইখানে।
তারপর যা দেখলাম তা মনে করলে এখনো শিউরে উঠি আমি। দশ পনেরো জনের একটা ছেলের দল মুহূর্তে পৌছে গেল দেহটির কাছে এবং দেহটির পকেট হাতড়ে যা পেল নিয়ে নিল। কয়েকজনের মধ্যে মারপিটও লেগে গেল তাই নিয়ে। হাতঘড়িটা খুলে নিল একজন। কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই প্রচণ্ড ভীড়ের মধ্যে একা পড়ে থাকলো সেই মানুষটার মৃতদেহ। কেউ একজন উলটে দিল তাকে।
আমার পাশের ভীড়টা পাতলা হয়েছে তখন। সাধারনত আমি আর একটু হেঁটে এসে নীচে নামতাম। সেদিন সামনের সিঁড়িটা দিয়ে নীচে নেমে পড়লাম। প্রচণ্ড গা গুলোচ্ছিল। একটা নর্দমার সামনে বমি করলাম। নীচে নেমেই মানুষের মানবিক মুখ দেখলাম। তিন চারজন আমায় ধরে নিয়ে গিয়ে একটা চায়ের দোকানে বসালেন। মুখে চোখে দেবার জল দিলেন। ভাঁড়ে চা দিলেন এক কাপ। খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করাতে বললেন - সংগে কাউকে পাঠাবেন কিনা চায়ের দাম দিতে গেলে নিলেন না। আমাকে ঘিরেও তখন অনেক মানুষ।
ফেরার পথে এবং পরে অনেকদিন মাঝেমাঝেই মনে পড়তো সেই মানুষটির বিহ্বল মুখ।এত মানুষের চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলেন না সেই মানুষটি। লোকটি কি আত্মহত্যা করেছিলেন সেদিন? কি জানি!ফিরে ফিরে আসে সেই ছেলেগুলোর কাটা ঘুড়ি ধরার মত মৃৎ লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য ।যতবার ওখন দিয়ে গেছি তারপর।
সরোজ দত্তর একটি কবিতার শেষ লাইন মনে পড়তো প্রতিবার
- 'বলিহারি মৃতের সম্মান'.......।
“আমরা জানতে চাই নি, ওরাও বলেন নি ওরা কি জাত? হিন্দু না মুসলিম না দলিত। শুধু বুঝতে পেরেছিলাম ওরা ভারতবাসী। এরা প্রয়োজনে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দুবার ভাবেন না”
এমন জনপদই তো দেশে দেশে কাম্য।
এপারেও একই মানুষের বিপরীত চরিত্র দেখেছি অনেক। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদের ঘড়ি, আংটি, মোবাইল, মানিব্যাগ কেড়ে নেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি করছে যে আম জনতা, সেই একই জনতা আহতদের হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছে, প্রয়োজনে রক্ত দিচ্ছে, ডাক্তার-নার্স ইত্যাদিতে ছুটোছুটি করছে।
এ কোন মনোস্তত্বত্ত্ব?
লেখাটি খুব ভাল। আরো লিখুন