আঠারো সালের স্বাধীনতা দিবসে গিয়েছিলাম বেলঘরিয়া ব্যক্তিগত কাজে। তৃণমুল সরকারে আসার পর স্বাধীনতা দিবস পালন করার "উৎসব" বেড়ে গেছে। প্রতিটি রাস্তায় ফ্লাগ তোলা হচ্ছে। মাইকে গান বাজছে। দেশাত্মবোধক গান। এই একটা দিনই মহেন্দ্র কাপুরের কণ্ঠ শোনা যায়। মেরে দেশ কি ধরতী সোনা উগলে, উগলে হীরে মোতি। তবে একটা গান কমন সব প্যান্ডেলে। অ্যায় মেরে বতন কে লোগোঁ। কি সুন্দর কণ্ঠস্বর ছিল লতাজীর!!
আচ্ছা,এই অমর, কালজয়ী গানটির গীতিকার, সুরকার কারা জানেন? অনেকেই জানেন, যাঁরা জানেন না তাঁদের জন্যে। এই গানের গীতিকার হলেন প্রদীপ। আসল নাম প্রদীপ নয়। রামচন্দ্র নারায়নজী দ্বিবেদী। সেইদিন লিখেছিলাম কিশোরকুমার প্রথম সিনেমার জন্যে মাইকের সামনে সিনেমার গান করেন কোরাসে ১৯৪০ সালে বন্ধন ছবিতে। সেই গানের গীতিকার ছিলেন প্রদীপ।গানটি ছিল -' চল চল রে নওজোয়ান। দেশাত্মবোধক গান প্রায় সবই প্রদীপের লেখা। - আও বাচ্ছো তুমহে দিখায়ে, দে দি মুঝে আজাদী বিনা খর্গ বিনা ঢাল। কিসমত ছবিতে তেতাল্লিশ সালে একটি গান লেখেন - আজ হিমালয় কি চোটি সে ফির হামনে লালকারা হ্যায়/ দুর হটো অ্যায় দুনিয়াবালো হিন্দুস্তাঁ হামারা হ্যায়। কিসমত ছবি মুক্তি পাওয়ার পরই প্রদীপ স্যারকে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হয়। বৃটিশ সরকারের কোপে পড়েন তিনি। অ্যায় মেরে বতনকে লোগোঁ গানটির গীতিকারও সেই প্রদীপ।
রামচন্দ্র নরহর চিতলকর। গান গাইতেন চিতলকর নামে। সুর দিতেন সি রামচন্দ্র নামে। অ্যায়ে মেরে বতন কে লোগো, গানটির সুরকার সি রামচন্দ্র। এক সময়কার হিন্দী ছবির প্রথমসারির সঙ্গীতকার ছিলেন সি রামচন্দ্র। আনারকলি ছবির লতাজীর গাওয়া " ইয়ে জিন্দেগী উসিকি হ্যায়"। হিন্দী সিনেমার অমর গান। সি রামচন্দ্র সাহেবের সুর।। - " মেরে পিয়া গয়ে রেঙ্গুন, শাম ঢলে খিড়কি তলে তুম সিটি বাজানা ছোড় দো, পরছাইয়াঁ ছবিতে লতাজীকে দিয়ে একটি গান করিয়েছিলেন "কাটতে হ্যায় দুখমেঁ ইয়ে দিন" শুনে দেখুন। কেন লিখলাম বুঝতে পারবেন। আমরা বলি যে লতাজিকে সবচেয়ে ভাল ব্যবহার করেছিলেন মদনমোহনজী(আমি ইনক্লুডেড)। কিন্তু তার আগেও সি রামচন্দ্র সাহেব অনবদ্য কিছু গান করিয়েছিলেন লতাজীকে দিয়ে। মদনমোহনজী প্রথম জীবনে সি রামচন্দ্রের সহকারীও ছিলেন।
"আশা" ছবিতে কিশোরকুমার আর আশা ভোঁসলে কে দিয়ে গাইয়েছিলেন " ইনা মিনা ডিকা"!! আজও সমান জনপ্রিয় সেই গান। শুধু সুরকার, গীতিকার কারা? সে না জানলেও চলে। এই গানটি লিখেছিলেন সম্ভবত রাজেন্দ্রকিষাণ।দেব আনন্দের লিপে কিছু গান করেছিলেন নিজের সুরে। একটা মখমলি টাচ ছিল গলায়। বারিষ ছবিতে -' দানে দানে পে লিখখা হ্যায় খানেওয়ালে কা নাম' শুনে দেখুন আজই একবার।
কাল প্রায় সব প্যান্ডেলে শুনলাম অ্যায় মেরে বতন কে লোগো। তুম খুব লাগালো নারা। লতাজীর গান। সবাই জানেন। কিন্তু প্রদীপজী না লিখলে, সি রামচন্দ্র সাহেব সুর না করলে হতো এই গান?
বাড়ি ফিরেছি একটু রাতে। বেরিয়েছিলাম আবার আড্ডা মারতে। ফিরছি যখন তখন দেখি লকাই সব ছোট ফ্লাগগুলো এক জায়গায় জড় করছে। ওপর থেকে ছিঁড়ে পড়েছে যেগুলো। বাকীগুলো ছিঁড়ে নামাচ্ছে। কেউ দেখছে না। আলো ঝলমল আমাদের পাড়ায় একটু দুরেই হুল্লোড় করছে কিছু ছেলে। আমি লকাইকে বললুম - কেন জড় করছিস এগুলো? কাল বেচে দিবি বলে? লকাই ফুল লোডেড থাকে সব সময়। কালও ছিল। কেঁদে ফেললো লকাই। বললো - কাকু, কাল এগুলো পা দিয়ে পাড়িয়েই সবাই যাবে। আমার দেশের ফেলাগের একটা দাম নেই। লকাই থাকতে দেশের ফেলাগের অপমান হতে দেবে না। কাকু, দেখে নেবেন, কভভি নেহি।
আমার তখন লকাইকে লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীদের চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক মনে হচ্ছিল ।
আমার চেয়ে তো বটেই।
মাইরি বলছি.....।
আমাদের পাড়ায় এক দাদা বৌদি থাকতেন। খুবই ভাল মানুষ ছিলেন দুজন৷ হঠাৎ এক রাত্রে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক করে দাদা মারা গেলেন৷ হাসিখুশি বৌদি হয়ে গেলেন এক বিষাদ মুর্তি। কাল দেখা হল ব্যাঙ্কের সামনে৷ বয়েস বেড়ে গেছে অনেক৷ আমার চেয়ে বয়েসে কিছু ছোট কিন্তু আমি বৌদিই বলতাম। বললেন - তুমি তো জানো তোমার দাদা সবাইকে বিশ্বাস করতেন। কত মানুষকে যে টাকা ধার দিয়েছেন তার কোন হিসেব নেই৷ চলে যাবার পর ওর ডাইরি পড়ছিলাম। তোমার তো সমরদাকে মনে আছে? আমাদের পাড়ার সবচেয়ে উইটি মানুষ ছিলেন। তোমার দাদার খুব বন্ধুও ছিলেন তাও তো তুমি জানো৷ ওর ডাইরিতে দেখলাম যে সমরদা নিজের অসুখের সময় ওর কাছে দু বারে দশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল৷ দ্বিতীয়বার চার হাজার ধার নেবার দুদিন পর সমরদা মারা যায়৷ ও লিখছে - সমর মারা যাবার পর ওই টাকা পাবই না জানতাম। আমি আর সমর ছাড়া তো কেউই জানতো না ব্যাপারটা। সমর মারা যাবার পর প্রায় এক বছর পর সোমার( ওঁদের মেয়ে) বিয়ে স্থির হল৷ বিয়ের জোগাড় যন্তর করছি। একদিন কলিং বেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেখি ওর ছোটভাই অমর। আমার পাশে বসে ঠিক দশ হাজার টাকা পকেট থেকে বের করে বললো - মেজদা মারা যাবার আগে তোমার কাছে তোমার কাছে দশ হাজার টাকা ধার নিয়েছিল চিকিৎসার জন্যে৷ এতদিন জোগাড় করতে পারি নি। এখন তোমার মেয়ের বিয়ে। টাকাটা নাও৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম - আর কারুর থেকে ধার করে আমায় দিচ্ছিস না তো? ও হেসে বললো না - মেজদা, বলেছিল পারলে ওর টাকাটা দিয়ে দিস৷ আমি মনে হয় আর সময় পাবো না৷ এতদিন পারি নি। আজ পারলাম। ও চলে যাবার পর অনেকদিন পর কেঁদে ফেলেছিলাম আমি।সমরকে
হিংসেও করছিলাম। এমন ভাই সবাই পায় না।
বৌদি থামলে অমরদার মুখটা মনে পড়লো আমার। কালার দোকানে চা খাচ্ছিল কাল। কথাও বলছিল আমার সাথে।
এ সময়টা এমনিতেই বিষন্নকাল। তবু রোদ্দুরের তেজ কমেছে৷ বৌদি চলে গেলেন। আমি ব্যাঙ্কে ঢুকলাম।