

আমাদের বাবারা তাঁকে বলতেন বড়বাবু৷ এমনই ছিল তাঁর প্রভাব যে বিধায়ক ভট্টাচার্য বা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সন্তানেরাও এখনো বলতে গেলে তাঁকে বলেন বড়বাবু।
তিনি নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ি।
উনিশশো সাতান্ন সালে আমরা বিশ্বরূপা থিয়েটারের পেছনে একটি পুরো বাড়িতে উঠে আসি। সেই বাড়িতেই আমাদের আগে থাকতেন নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী। আমার বয়েস তখন প্রায় আট। সেই বাড়িতে ছটি ঘর ছিল। বাবা বাড়িতে ঢুকেই বলেছিলেন একটি ঘর দেখিয়ে যে ওই ঘরটিতে( বিশাল ছিল সেই ঘরটি) কেউ থাকবে না। সেটি আমাদের ঠাকুর ঘর হবে। একটি পরিতক্ত ইজি চেয়ার দেখিয়ে বলেছিলেন - এই চেয়ারে কেউ কোনদিন বসবে না। কেন? জিজ্ঞাসা করেছিলেন মা, দাদা দিদিরা। বাবা বলেছিলেন ওই ঘরে থাকতেন বাবাদের " বড়বাবু", সয়ং শিশিরকুমার। ওই ঘরে বসেই প্রায় দু ঘণ্টা ধরে বাবা শুনিয়েছিলেন তাঁকে শরৎচন্দ্রের " বিপ্রদাস" এর নাট্যরূপ। অসুস্থ ছিলেন শিশির কুমার তখন। বিপ্রদাস করেছিলেন তার অনুজ, আর এক দিকপাল অভিনেতা বিশ্বনাথ ভাদুড়ী।। সেই আমি প্রথম শুনি শিশির ভাদুড়ীর নাম।
বিশ্বরূপা থিয়েটারের সেই বাড়ি জুড়ে ছিল শিশিরকুমারের স্মৃতি। আমি দেখেছি কী অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন অভিনেতারা, কলাকুশলীরা শিশিরকুমারকে। শিশিরকুমারের দুই খাস অনুচরকে আমি দেখেছি। একজন তাঁর খাস চাকর রামচরণ। আমরা বলতাম রামচরণদা আর একজন তাঁর খাস ড্রেসার গোবিন্দ অধিকারী। আমাদের গোবিন্দ কাকা। এমনই প্রভাব ছিল শিশিরকুমারের যে বিশ্বরূপার তদানীন্তন মালিকদের দুজন, দক্ষিণেশ্বর সরকার এবং রাসবিহারী সরকারকে সকলে বলতেন মেজবাবু আর ছোটবাবু। বড়বাবু? নৈব নৈব চ। সেটা একমাত্র শিশিরকুমারের প্রাপ্য। প্রত্যেকদিন, কেউ না কেউ একবার শিশিরকুমাররের নাম নিতেনই। একটা শ্রদ্ধার জায়গা, সেই সময়েই আমার মনে ঢুকে গেছিল সে সব শুনে।
দ্বিতীয়বার তাঁর কথা নিয়ে চর্চা হল উনিশশো ঊনষাট সালে। সকালে কাগজ পড়ে বাবা বললেন - এই হলেন বড়বাবু। দেখেছিস, পদ্মভূষণ ফিরিয়ে দিল। ভাবা যায়! বাবার অনেক আগে কাগজ পড়তাম আমরা ছোট তিন ভাই। খবরটা দেখেছিলান কিন্তু গুরুত্ব বুঝিনি।কেন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আজ আর মনে নেই তা। শিশিরকুমারের আর্থিক অবস্থা তখন ভাল নয়। তবু আত্মসম্মান মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা শিশির কুমারের মধ্যেই আমি প্রথম দেখেছিলাম। সারাদিন অনেক অভিনেতা, অভিনেত্রী, থিয়েটারের লোকজন সেদিন এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। সবাই আলোচনা করছিলেন এই প্রচণ্ড কঠিন আর্থিক সময়ে কোন শক্তিতে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করার শক্তি পেলেন বড়বাবু। শেষে সবাই মেনে নিলেন একমাত্র 'বড়বাবু'ই করতে পারেন এমন কাজ।
আমি শিশিরকুমারকে কোনদিন দেখি নি। অভিনয় দেখা তো দুরের কথা। কিন্তু বাবা, থিয়েটারের কাকা, জ্যাঠা, পিসিদের কাছ থেকে শুনে শুনে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল মনে। সেই ধারণার মানুষটির সমগোত্রীয় সম্মানীয় মানুষ থিয়েটারে আর দেখি নি আমি। কাছাকাছি, আমার মতে, আসতে পারেন অজিতেশ।
আজকাল অনেক পুরস্কার ফেরতের কথা শোনা যায় আমাদের দেশে/ শহরে। কেউ দশ বছর আগে পাওয়া পুরস্কারও ফেরত দিচ্ছেন আর আমার দেখা সেই প্রথম মানুষটিকে মনে পড়বেনা যিনি নিজের আত্মসম্মান রাখতে প্রচণ্ড আর্থিক সমস্যা নিয়েও 'পদ্মভূষণ' প্রত্যাখ্যান করার সাহস দেখিয়েছিলেন সেই উনিশ শো উনষাট সালে, যখন এরকম কোন চল ছিলনা বললেই চলে ? গত মাসে তাঁর জন্মদিন চলে গেল। এসব কথা কেউই বলেননি। তাঁকে নিয়ে বিশেষ কথাবার্তাও দেখিনি।
santosh banerjee | ১৮ নভেম্বর ২০২০ ২০:০৫100456ওই বলেনা ?""দেহ পট সনে নট সকলি হারায় """????তাই হয়েছে ! আমাদের দেশে ।.বিশেষ করে এই পোড়া বাংলায় কোনো শিল্পী তার যোগ্য সন্মান পান নি !! কেউ মনে রাখেও নি ! শিশির ভাদুড়ী ।..গিরিশ বাবু ..থেকে একালের উৎপল দত্ত বা শম্ভূ মিত্র পর্যন্ত সবাই অবহেলিত ।..উপেক্ষিত ! একটু কয়েক দিন নাচা নাচি ..ফুলের মালা ..সেমিনার ....শতবর্ষ বা সার্ধ শতবর্ষ পালন .... ইত্যাদি ।..ব্যাস !!এর পর সব স্ট্যাচু ।.নাহলে হলের নাম বা রাস্তার নাম ।..এই সব !! মূএ আগুন !!!
aranya | 162.115.***.*** | ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০৮:৫০100981শিশির ভাদুড়ীর কথা মনে করালেন, খুবই ভাল লাগল।
সম্বিৎ | ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ ১১:০২100985বিমোচনদা, অহীন চৌধুরীর আত্মজীবনী পড়ছি। শিশিরবাবু তো আছেনই, মাঝে মাঝেই আপনার বাবার কথা আসছে।