শতঞ্জীব রাহা তাঁর ‘অবিকল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়’ গ্রন্থে বহুমাত্রিক ভাবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধরার চেষ্টা করেছেন। চারশো পৃষ্ঠারও বেশি রয়াল সাইজের এই বইতে আছে বিপুল পরিশ্রমের ছাপ। এ প্রসঙ্গে ‘কথামুখ ও কৈফিয়ৎ’ অংশে লেখক লিখেছেন, “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা খুব নিশ্ছিদ্র আরামে পাঠ করা অসম্ভব বললে কম বলা হয়। বস্তুত লেখকের পরিশ্রমের অংশীদার না হলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাঠকরা একেবারেই কঠিন কাজ।” বইটির প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে রয়েছে সূত্র–পরিচয়ের সযত্ন ও বিস্তারিত উল্লেখ, যা এই বইটিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮–১৯৫৬)
এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়, ‘সময়ের মুদ্রা, মানিক ও সাহিত্যের জন্ম’। এই অধ্যায়ে রয়েছে মানিক এবং সময়–চেতনার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা। বাখতিন থেকে ভার্জিনিয়া উলফ, বিশ্বসাহিত্যের নানা অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছেন লেখক। রয়েছে মানিকের ব্যক্তিগত জীবনের কথাও। বৈজ্ঞানিক বিশ্ববীক্ষার সাহায্যে সাহিত্য ও সমাজকে দেখার কথা। ‘তাকে একবার হাতে পেলে’ শিরোনামের পরবর্তী অধ্যায়ে এসেছে ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ নিয়ে আলোচনা, যেখানে পুতুলের অনুষঙ্গ গোটা উপন্যাস জুড়ে নানা সূত্রে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে দেখা দিয়েছে। মানিকের বিভিন্ন উপন্যাস বিশ্লেষণ করে লেখক দেখিয়েছেন—মানিকের অনুসন্ধানের একটা মূল বিষয় ছিল, এই বিষমবাহু সমাজের আসল নিয়ন্ত্রক কারা, কারা আড়ালে বসে মানুষকে লোভ আর লালসার পথে ঠেলে দিচ্ছে?
‘সর্ববিরোধ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনা’ অধ্যায়ে লেখক দেখিয়েছেন, মানিকের রচনায় প্রকৃতি থাকে অনুচ্ছ্বসিত উল্লেখে। রেখাচিত্রের মতোই ফুটিয়ে তোলা হয় তাকে। আর মানিকের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে, অস্তিত্বরক্ষার অবিরত সংগ্রামের একটা ছবি। আসে মানুষের অন্তর্বিরোধ, যার একদিকে রয়েছে আত্মচিন্তার দোলাচল, অন্যদিকে আছে স্বপ্নভুবনের প্রত্যাশা। ‘জননী’ উপন্যাসে মূল ভূমিকা নেয় টাকা, যা ওই সময়কে চিনতে সাহায্য করে। শতঞ্জীব দেখিয়েছেন, টাকার গুরুত্বের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ ও মানবিক সম্পর্কসমূহ কীভাবে নতুন মাত্রা পেতে থাকে। মানিকের বিভিন্ন রচনায় অর্থনীতি এবং অর্থ–সম্পর্ক নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন লেখক, যার সঙ্গে দেখাতে চেয়েছেন সমাজ ও মানুষের ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়াকে। এর পাশাপাশি টেনে এনেছেন শহর ও গ্রামের সংযোগ ও বিচ্ছিন্নতার প্রসঙ্গটিও, যার ফলশ্রুতিতে তাঁর চরিত্রেরা সকলেই কমবেশি সংশয়, ভ্রান্তি, দোলাচল ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে।
প্রতিটি চরিত্রের যুগ্ম–অস্তিত্বের ভ্রান্তিময় প্রহর–যাপন নিয়ে আলোচনা রয়েছে ‘যুগ্মতা–দ্বৈততা: শশী–কুসুম আর মতি ও অন্যান্য’ অধ্যায়ে। অনেক সময় নিজের বক্তব্যকে পরিষ্কার করতে তিনি চার্টের ব্যবহারও করেছেন। মানিকের চরিত্রেরা মূলত ইন্টেলেকচুয়াল। তারা স্বপ্ন ও বাস্তবের দ্বন্দ্বে দীর্ণ। এরপরের অধ্যায়ের সূচনাতেই শতঞ্জীব লিখেছেন, ‘মানুষের সত্ত্বার বিচ্ছিন্নতার কারণ বুঝবার জন্য মানিক লক্ষণীয় মাত্রায় ফ্রয়েড–কথিত মানুষের নানাস্তরের অস্তিত্বকে ব্যবহার করেছেন।’ মানিকের রচনায় দেহ ও ইন্দ্রিয়চেতনা কীভাবে এসেছে, তাই–ই এই অধ্যায়ে দেখিয়েছেন তিনি। ফ্রয়েড সহ আধুনিক কালের অপরাপর ব্যাখ্যাতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, মানুষের জৈবিক অস্তিত্ব ও তার ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ করেছেন মানিক। ব্যবহার করতে চেয়েছেন ফ্রয়েডের তাত্ত্বিক ভূমিকাটিকে। আলোচনায় এসেছে নিও–ফ্রয়েডিয়ানদের প্রসঙ্গও। যৌন সম্পর্কের রহস্যময়তার মধ্য দিয়ে আত্মনিরীক্ষা করতে চেয়েছেন, রোমান্টিকতাকে আক্রমণ করে পৌঁছোতে চেয়েছেন নিজস্ব দার্শনিক মননভূমিতে।
‘কবিও পেয়ে গেছে নতুন যুগ’ অধ্যায়ে তিনি দেখিয়েছেন মানিকের রচনায় ইতিহাস–চেতনাকে। আলোচকের মতে, ‘ঔপন্যাসিকের আখ্যানবিধৃত ভাষ্যে যতটুকু ইতিহাসের উপাদান থাকে তা–ও আসলে উপন্যাসের অভ্যন্তরে অবিভাজ্যতাপ্রাপ্ত হয়।’ তিনি দেখিয়েছেন, সময়ের যাবতীয় অসুখের জীবন্ত ইতিহাসকেই মানিক দলিলীকৃত করেছেন তাঁর রচনায়। ইতিহাসকে তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন পক্ষপাতশূন্য ভাবে। মানিক প্রথম থেকেই কলোনি-শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। মধ্যবিত্ত ভাবালুতা থেকেও তিনি দূরে থাকতে চেয়েছেন। সমকালীন সাহিত্যের নিরাপদ ছাঁচগুলিকে তিনি এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। শতঞ্জীব সমকালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এবং মানিকের জীবন–অভিজ্ঞতার সাপেক্ষে তাঁর গল্প ও উপন্যাসগুলিকে বিচার করতে চেয়েছেন।
মানিকের লেখায় এসেছে, শ্রমিক-ধর্মঘট, লক–আউট, কারখানার ডিউটি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, কৃষক আন্দোলন, স্বাধীনতার তীব্র অভিঘাত সাধারণ শহুরে ও গ্রাম্য মানুষের জীবনে, উদ্বাস্তুজীবনের বিপন্নতা। চারপাশে যত্নের অভাব ও ঔদাসীন্য সত্ত্বেও অসুস্থতা নিয়েও অনবরত লিখে গেছেন তিনি। তিনি শ্রমিকবস্তিতে যেতেন, ভারতীয় গণনাট্য সংঘের টিমের সঙ্গে যেতেন কলকাতার নিকটবর্তী গ্রামে–গঞ্জে। জীবনের সেইসব বিচিত্র অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হত তাঁর লেখায়। ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: অনন্যতার দ্বিতীয় মাত্রা’ শীর্ষক অধ্যায়ে শতঞ্জীব দেখিয়েছেন, মানিক কেন একজন অনন্য এবং অবিকল্প লেখক। তাঁর রচনায় গল্প বলে যাওয়ার রীতি অনুসৃত হয়নি। তাঁর উপন্যাসে বহু ক্ষেত্রে কিছুটা অনিয়ন্ত্রিত উপাখ্যানসমূহের সমাবেশ ঘটে। প্লট নিয়ে গল্পপিপাসু পাঠকের প্রত্যাশার বিপরীতে তাঁর আখ্যানগুলির নির্মাণগত অবস্থান। সেখানে অনেক সময় আখ্যান–বয়নের এমন সব রীতির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যার সঙ্গে চলচ্চিত্রের সাদৃশ্য রয়েছে।
শতঞ্জীবের মতে, উপন্যাসে প্লটের গঠন, আখ্যানের বর্ণনা কিংবা চরিত্রের ব্যাখ্যান–বিষয়ে মানিকের যেন এক ‘তৃতীয় নয়ন’ রয়েছে। মানিকের উপন্যাসে লেখকের বর্ণনা ও বিবৃতির সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে মিশে থাকে চরিত্রের চিন্তা–প্রবাহের নিবিড়তা। মানিকের হাতে-ধরা ক্যামেরায় যেন থাকে একটি অতিরিক্ত এক্স–রে লেন্স। তিনি শব্দের প্রচলিত অর্থের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন, প্রচলিত অর্থকে লঙ্ঘন করে অপ্রচলিত অর্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন, আভিধানিক অর্থের ঘটিয়েছেন বিস্তার। বাক্যে একই সঙ্গে ছুঁৎমার্গহীন শব্দ–ব্যবহারে মানিক বরাবর সাহস দেখিয়েছেন। রূপক–সংকেতে নিহিত তাৎপর্যে মানিকের কলমে ঝিলিক দিয়ে ওঠে অন্য এক অনুভবগম্য জগৎ। শতঞ্জীবের ভাষায়, ‘মানিক তাঁর রচনায় এইসময় ও সময়ের মধ্যে থাকা মানুষকে অতিক্রমণের চলমানতার মধ্যে আবিষ্কার করতে চান।’ লুকাচ যাকে বলেছেন, ‘লার্জার প্রজেক্ট অব হিস্ট্রি।’
এই বইয়ের শেষে রয়েছে একটি নির্বাচিত শব্দনির্দেশ। ব্যক্তি, লেখক, সম্পাদক—তাঁদের নামের এক দীর্ঘ পরিচিতি। এই বই পাঠ করতে করতে মানিক–সাহিত্যের ভিতর তলিয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয়। গোটা বইটিতে রয়েছে অনেকগুলো স্তর। বিশ্বসাহিত্য, দর্শন ও তত্ত্বের নানা অনুষঙ্গ এনে মানিককে বুঝতে চেয়েছেন আলোচক। মানিকরচনাকে তিনি সামগ্রিক ভাবে কিন্তু বহুমাত্রিকতায় ধরতে চেয়েছেন। ফলে প্রাসঙ্গিক ভাবেই এসেছে মানিকের ব্যক্তিগত জীবন, সমকালীন ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ। এই বই তথ্য, বিশ্লেষণ এবং অনুভবের এক অনবদ্য সমাহার। প্রায় বৈজ্ঞানিকের মতোই কাটাছেঁড়া করে মানিকের অনন্যতাকে বুঝে নিতে চেয়েছেন শতঞ্জীব। তাঁর রচনা–কৌশলও অনন্য ও জটিল। বিশেষ করে, তিনি যেভাবে চার্ট ও রেখাচিত্র ব্যবহার করেছেন, তা বাংলা আলোচনা–গ্রন্থে ব্যতিক্রমী। নিঃসন্দেহে, এ এক বিপুল পরিশ্রমসাধ্য কাজ, যা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে গভীর ভাবে বুঝতে আমাদের সাহায্য করে, যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।
বইটা পড়িনি। বর্তমান প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে শ্রীদাশগুপ্ত তাঁর কুশলী বীক্ষায় "অবিকল্প মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়" এর সমস্ত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়েছেন।
কিন্তু আমার বেয়াড়া মনের খুঁতখুঁতুনি যায়না।
শতঞ্জীব রাহার বইটিতে যেভাবে মানিকের কথাসাহিত্যের "বৈজ্ঞানিক " কাটাছেঁড়া এবং বাখতিনের তত্ত্ব ,গ্রাফ ও চার্টের সাহায্য নিয়ে ব্যাখ্যা ইত্যাদি করা হয়েছে তাতে আমার মত অজ্ঞ পাঠকের ভয় আঙুলের ফাঁক দিয়ে রস গড়িয়ে পড়ে হাতে খালি শুকনো আঁটি ধরা থাকবে না তো?