শিল্পী: যামিনী রায়। টেম্পেরা অন বোর্ড। আনুমানিক ১৯১০
রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ আবার পড়লাম। কালজয়ী সাহিত্যের অন্যতম লক্ষণ এই যে, ইতিহাসের নানা পর্যায়, নানা সংকট, নানা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে পাঠক সে সাহিত্যের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পান। আজ দেশজুড়ে মনুবাদী হিন্দুত্ববাদ যখন রাবীন্দ্রিক ‘সত্য ভারতবর্ষের’ অন্তরাত্মার ওপরেই আক্রমণ শানাচ্ছে, হঠাৎই মনে হল, এই মুহূর্তে ‘গোরা’ পড়া, ফিরে ফিরে পড়া, কত জরুরি।
মোট পাঁচটি যুগান্তকারী উপন্যাস লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ—চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, চতুরঙ্গ এবং যোগাযোগ। এই উপন্যাসগুলিতে ভারতবর্ষের জাতীয় জীবনের এক সন্ধিক্ষণের ছবি তুলে ধরেছেন তিনি।
‘গোরা' উপন্যাসের সূচনাতেই কেন্দ্রীয় চরিত্র গোরার আশৈশব বন্ধু বিনয় তাকে বলে, “তুমি মনে করো যত শক্তি ঈশ্বর একলা তোমাকেই দিয়েছেন, আর আমরা সবাই দুর্বল প্রাণী।’” উপন্যাসের গোড়া থেকেই রবীন্দ্রনাথ যেন গোরাকে তার পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইছেন। এই বিচ্ছিন্নতা কেবল তার ব্যক্তিত্বে নয়, চেহারাতেও ফুটে উঠেছে। গোরা আলাদা। প্রশ্ন হল, গোরা কীসের থেকে আলাদা? কোথায়ই বা আলাদা? কেনই বা আলাদা? এত সচেতনভাবে তাকে আলাদা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনই বা কী?
এখানেই আরও একটি প্রশ্ন এসে যায়—গোরা কী সত্যই কোনো রক্তমাংসের মানুষ? নাকি স্রেফ একটা আইডিয়া? গোরার কথা শুনলে সুচরিতার মনে হয়, তার কথার আকৃতি আছে, গতি আছে, প্রাণ আছে, সে যেন সম্পূর্ণ মানুষ। অর্থাৎ গোরার কথা ও সেই সম্পূর্ণ মানুষটি এক ও অভিন্ন। গোরা যেন একটা কথা বা ভাবনা, যা মানুষের অবয়ব ধারণ করে রয়েছে। সে যেন একটি অসম্পূর্ণতা ও সন্ধান, প্রশ্ন ও উত্তরের যোগফল। আমাদের মনে পড়তে পারে, দস্তয়েভস্কি ও তলস্তয়ের তুলনা করতে গিয়ে জর্জ স্টেইনার লিখেছেন, তলস্তয়ের চরিত্ররা রক্তমাংসের অর্থাৎ ‘ক্যারেকটার্স অব ফ্লেশ’। কিন্তু দস্তয়েভস্কির চরিত্ররা আইডিয়া দিয়ে তৈরি অর্থাৎ ‘ক্যারেকটার্স অব আইডিয়া’। ভার্জিনিয়া উলফের মনে হয়েছিল, দস্তয়েভস্কির চরিত্ররা সব ‘আত্মার সারাৎসার’ দিয়ে তৈরি। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস সম্পর্কেও ঠিক এই কথাগুলিই খাটে। তাঁর উপন্যাসের চরিত্রেরাও রক্তমাংসকে অতিক্রম করে এক-একটি আইডিয়া হয়ে ওঠে। সন্দীপ, নিখিলেশ, গোরা, বিনয় এরা সকলেই এক একটা আইডিয়া। আর এই আইডিয়াগুলি সর্বদাই ‘আত্মার সারাৎসার’ দিয়ে তৈরি। ‘আইডিয়া’ বলেই গোরা উপন্যাসের রক্তমাংসের চরিত্রদের থেকে আলাদা, বিরাট, প্রতীকী।
শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ। ১৯৩৭। ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য
এখানেই প্রশ্ন আসে, ‘গোরা’ চরিত্রের মধ্য দিয়ে কোন্ আইডিয়া মূর্ত হয়ে উঠেছে? অর্থাৎ, ‘গোরা’ কে? ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের ‘ব্রাহ্মসমাজের সার্থকতা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “সত্যের আঘাত কেবল সত্যই গ্রহণ করতে পারে। এইজন্য প্রবল আঘাতের মুখে প্রত্যেক জাতি হয় আপনার শ্রেষ্ঠ সত্যকে সমুজ্জ্বল করে প্রকাশ করে, নয় আপনার মিথ্যা সম্বলকে উড়িয়ে দিয়ে দেউলে হয়ে যায়। ভারতবর্ষেরও যখন আত্মরক্ষার দিন উপস্থিত হয়েছিল, তখন সাধকের পর সাধক এসে ভারতবর্ষের চিরসত্যকে প্রকাশ করে ধরেছিলেন।” রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাসগুলিতে এই সাধককেই চিত্রিত করতে চেয়েছেন, যিনি ভারতবর্ষের চিরসত্যকে প্রকাশ করবেন। গোরা, নিখিলেশ, শচীশ এরা সবাই সেই প্রয়াসেরই বিভিন্ন পর্যায়।
শিল্পী চিত্তপ্রসাদ। ১৯৪০। লাইনো কাট
ইভান তুর্গেনেভের ‘পূর্বক্ষণ’ উপন্যাসে পাভেল শুবিন প্রশ্ন তুলেছিলেন, “কখন আসবে আমাদের সময়? কখন এদেশে জন্মাবে আসল মানুষ?” ‘গোরা' উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ এই ‘আমাদের সময়’ এবং ‘আসল মানুষ’-এরই সন্ধান করেছেন। কিন্তু চিরসত্যের সন্ধান কোনো সহজ ব্যাপার নয়। এই সত্যকে জানতে গিয়ে কত নিপীড়নই না সইতে হয়েছিল খ্রিস্ট বা দন কিহতোকে। রোদিয়ন রাসকলনিকভ তো খুনই করে বসেছিল, অপরাধের পর অপরাধে জড়িয়ে গেছিল জঁ ভলজা, সাইবেরিয়ায় ছুটতে হয়েছিল নেখলিউদফকে। সন্দীপকে ‘আসল মানুষ’ ভেবে কী সর্বনাশটাই না হয়েছিল বিমলার! গোরাও শুরু থেকেই একের পর এক ভুলের ফাঁদে জড়িয়ে গেল। ‘সিপাহি বিদ্রোহে’র কালে অর্থাৎ প্রথম সর্বভারতীয় উপনিবেশ-বিরোধী বিদ্রোহের সময়কালে গোরার জন্ম। তার বয়স যখন ২৫ বছর, অর্থাৎ ১৮৮২-৮২ সালে ঘটনার সূত্রপাত। শুরু থেকেই গোরা উগ্র হিন্দুত্বের প্রতিনিধি। সে ‘হিন্দুহিতৈষী’ সভার সভাপতি। বেদান্ত দর্শন, শ্রুতি-স্মৃতি ঘেঁটে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণে ‘হিন্দুয়িজম’ নামে ইংরেজিতে একটি বই লিখছে। সারা পৃথিবী যে জাতিভেদের, কুসংস্কারের, পৌত্তলিক ভারতবর্ষকে অপমান করেছে, গোরা সেই অপমানের আসনেই বসতে চায়। অর্থাৎ গোরা ভারতবর্ষের যা কিছু রীতি-নীতি, আচার-প্রথা, এসবই আত্মস্থ করতে চায়। সেগুলি সত্য না অসত্য, ঠিক না ভুল—তার বিচার তার আয়ত্তে নেই। ওসব নিয়ে সে ভাবেও না। স্বদেশপ্রেম নামক এক দানবীয় আবেগ তাকে শুধু ঠেলে নিয়ে যায়। কোন্ দিকে, তা সে নিজেও জানে না, জানতেও চায় না।
ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড়ো বাস্তব, সে পরাধীন। ঔপনিবেশিক শক্তি শতকের পর শতক ধরে তাকে দলিত-মথিত করেছে, তার সর্বস্ব হরণ করেছে। এই শক্তিকে গোরা ঘৃণা করে। এই শক্তি যে ভারতবর্ষের আত্মোপলব্ধির পথে অন্তরায়, সে তা অনুভব করে। ইংরেজদের সঙ্গে মারামারি করতে পারলে সে জীবন ধন্য মনে করে, কথায় কথায় তাদের ভারত-সমুদ্রের অর্ধেক পার করে দেয়। গোরা জানে, ‘একটি সত্য ভারতবর্ষ’ আছে—পরিপূর্ণ ভারতবর্ষ। এই নিম্নস্তরের হিন্দুসমাজের দুটি স্তরই এক মিথ্যা ভারতবর্ষের অংশ হয়ে পড়েছে। এই সর্বব্যাপী মিথ্যা, মিথ্যায় ডুবে থাকা গোরাকে ব্যথিত করে, তার বুক ফেটে যায়।
গোরা টের পায়, দেশের সম্বন্ধে লজ্জা করে করে আমরা নিজের মনকে দাসত্বের বিষে দুর্বল করে ফেলেছি। দাসত্বের এই দুর্বলতা থেকেই মুক্তি চায় গোরা। কিন্তু দাসত্বের দুর্বলতা থেকে মুক্তি পেতে গিয়ে গোরা এক নতুন ভুলের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে। দেশের একদল লোক যেহেতু দেশের সমস্তই মন্দ দেখে, গোরা তাই স্বদেশের সমস্তকেই ভাবের আবরণে ঢেকে ভালো বলে প্রমাণ করতে চায়। এই প্রমাণ করার কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথম ধাপে রয়েছে ‘বাধা দেওয়া’। বিনয় এর ব্যাখ্যা দিয়েছে, “অশ্রদ্ধাবশত দেশের সমস্ত প্রথাকে অবজ্ঞা করতে বসেছিলাম। তাই গোরা এই প্রলয়কার্যে বাধা দিতে এসেছে।” দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে, “জাগিয়া তোলা।” সুচরিতার মনে হয়, এসব আচরণে যত না ভক্তি-বিশ্বাস, তার চেয়ে ঢের বেশি আঘাত করার, অন্যকে জাগিয়ে দেওয়ার বাসনা। আর এই দ্বিতীয় পর্যায়ে গিয়েই গোরার ভুল। তার ধারণা, হিন্দুয়ানির সামান্য কথাটা অস্বীকার করলে পাছে বড়ো জিনিসেরও অসম্মান ঘটে। সে তাই গায়ের জোরেই ওসব বলে। হাতে বাঁশের লাঠি, মাথায় পাগড়ি সহ গোরা ম্যাজিস্ট্রেট ব্রাউনলোর সঙ্গে দেখা করতে যায়। সত্যকে জোর করে রক্ষা করতে গিয়ে গোরা তার অনুসারীদের কাছেও দুর্বোধ্য ও অতিমানব হয়ে ওঠে। তারা ক্রমেই মিথ্যা ভারতবর্ষের চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকে, গোরা একে ঠেকাতে পারে না।
নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে মুসলমান কৃষকদের বিদ্রোহ দেখে রমাপতির মনে হয়, এটা গোঁয়ার মুসলমানের স্পর্ধা ও নির্বুদ্ধিতা। অবিনাশের কাছে গোরা নেহাতই ‘মূর্তিমান শাস্ত্রের বচন’—হিন্দুধর্মকে উদ্ধার করার জন্য অবতার। সেখানেও ভারতবর্ষের কোনো স্থান নেই। মহিমের মেয়ে শশিমুখীকে বিয়ে করার জন্য অবিনাশের বাবা যখন প্রচুর পণ চায়, সে তখন পিতৃভক্তের মতোই আচরণ করে। মিথ্যা ভারতবর্ষের অবশ্য এখানেই শেষ নয়। এ ছাড়াও রয়েছে পাশ্চাত্যমুখী কেতাদুরস্ত সমাজ। বরদাসুন্দরী মেয়েদের ইংরেজি হস্তলিপি ও শিল্পকাজ দেখিয়ে, ইংরেজিতে তাদের আবৃত্তি শুনিয়ে গর্বিত হন। দেশের কথা ভাবলে হারানবাবুর লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। এ উপন্যাসে সামগ্রিকভাবে মেয়েদের অবস্থা সম্পর্কে যে চিত্র পাওয়া যায়, তাও মোটেই আশানুরূপ নয়। গোরা নিজেই ছিল নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে। মাত্র আট বছর বয়স থেকে হরিমোহিনীকে রান্না করতে হত। একবার একটি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় বিনয় দেখতে পায়, সাহেবি কাপড় পড়া জনৈক শিক্ষিত বাঙালি ছাতা মাথায় দিয়ে হাঁকডাক করছে, আর তার পাশেই তার স্ত্রী কোলের শিশুকে মোটা চাদরে জড়িয়ে শীতে, বৃষ্টিতে, লজ্জায় ভিজছে আর কাঁপছে।
শিল্পী সোমনাথ হোর। ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য
কিন্তু এসবই তো গেল মিথ্যা ভারতবর্ষের কথা। এ আছে বাইরে। সত্য ভারতবর্ষ আছে গোরার ভিতরে। এই সত্য ভারতবর্ষকেই গোরা পরতে পরতে খুলে দেখতে চায়। সে জানে, ভারতবর্ষের একটা বিশেষ প্রকৃতি, সত্য ও শক্তি আছে। এই সত্য কোনোদিনই অতীত হতে পারে না। এই ভারতবর্ষ দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, কষ্ট আর অপমানের মাঝে অধিষ্ঠিত। সেখানে প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে পুজো করতে হবে। বিনয় তাই বলে, “গোরা ভারতবর্ষের সেই আত্মবোধের প্রকাশরূপে আবির্ভূত হয়েছে।” সকলের মন যখন তুচ্ছ আকর্ষণে, নূতনের প্রলোভনে জড়িয়ে পড়ছে, এই একটিমাত্র লোক, যে বলছে, ‘আত্মানং বিদ্ধি’ অর্থাৎ নিজেকে জানো। গোরার জীবনে এই ‘সত্য ভারতবর্ষ’রই প্রতিনিধি হয়ে আসে আনন্দময়ী, পরেশবাবু, ললিতা, বিনয়। আনন্দময়ীই রবীন্দ্রনাথের ধ্যানলব্ধ ভারতবর্ষ। বিনয়ের কল্পনায় তিনি মাতৃভূমির প্রতিমাস্বরূপ। এ উপন্যাসে পরেশবাবু এক মহান শিক্ষক। ভিকতর উগোর ‘দীন-দুঃখীরা’ উপন্যাসে জঁ ভলজার জীবনে কসেত্তে যেমন, পরেশবাবুর জীবনেও সুচরিতা তার কন্যা, তার শিষ্যা, তার সুহৃদ, এমনকি তার ঈশ্বরোপসনার সঙ্গে জড়িত।
গোরার সঙ্গে প্রথম আলাপে মূলত দুটি কারণে সুচরিতা আকৃষ্ট হয়। প্রথমত, আদর্শগত কারণে। গোরার মতোই তার মধ্যেও ছিল স্বদেশের প্রতি মমত্ব, স্বজাতির জন্য বেদনা। দ্বিতীয় কারণটা মনস্তাত্ত্বিক। গোরা তাকে পরিপূর্ণ উপেক্ষা করে গেছে। অথচ নিজের ব্যবহারে গোরা সম্পূর্ণ সংকোচহীন। গোরার এই স্বাতন্ত্র্যে সুচরিতা আকৃষ্ট হয়। তৃতীয় যে কারণে তারা পরস্পরের কাছে আসে, তা শারীরিক। সুচরিতার মুখের ডৌল, ঠোঁট, টেবিলের ওপর রাখা হাত, তার কণ্ঠ, গৃহসজ্জা, যুগলের ওপর ললাট, কপালের ভ্রষ্ট কেশ, শাড়ি পড়ার ভঙ্গি—সবকিছুর মধ্যেই সে সজীব সত্তা টের পায়। অন্যদিকে সুচরিতা দেখে গোরার বলিষ্ঠ দুই বাহু, শুভ্র ললাট, দ্বিধা-দুর্বলতা-আকস্মিকতাহীন কথাবার্তায় আত্মমর্যাদার গৌরব, যা তার সমস্ত শরীরে ফুটে বেরোচ্ছে। এভাবেই স্বপ্ন ও আদর্শ, অসম্পূর্ণতা ও পূর্ণতার সম্ভাবনার সঙ্গে মিশে যায় সূক্ষ্ম যৌনতা। জেল থেকে বেরিয়ে আনন্দময়ীর সঙ্গে সুচরিতাকে দেখে গোরার মনে হয়, “দেশ বলিতেই ইনি। আমরা এরই সেবক।” সে উপলব্ধি করে, নারীকে অনুভব করেনি বলেই ভারতবর্ষের পৌরুষ লজ্জিত, তার জানার উপলব্ধি অসম্পূর্ণ, তার প্রকাশ অপূর্ণ। নারীকে নির্বাসিত করে যজ্ঞ সম্পূর্ণ হবে না। কেবল পুরুষের দৃষ্টিতে ভারতবর্ষ সম্পূর্ণ প্রত্যক্ষ হবে না। সুচরিতার সঙ্গে গোরার মিলন সেই সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ, সেই পূর্ণতাবোধের সঙ্গেই গোরার মিলনকে ইঙ্গিত করে, যে ভারতবর্ষকে নারী ও পুরুষ যৌথভাবে গড়ে তুলবে। উপন্যাসের শেষে এসে গোরা এই সত্য ভারতবর্ষের সন্ধান পায়।
প্রাথমিকভাবে গোরা হিন্দু আচারবিচারের খুব ভক্ত ছিল না। কেশবচন্দ্র সেনের বক্তৃতা শুনে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল একসময়। হিন্দুসমাজের দুর্বলতা ও দাসত্বের মনোভাব দেখে, গোরার সব উদারতা লোপ পায়। দেশের সত্যকে প্রকাশ করার নেশায়, দেশের বিকৃতিকেও সে হারাতে রাজি নয়। সবটুকু নিয়েই জোর করে দেশের সত্যকে সে রক্ষা করতে চায়। সে জানতেই পারে না, কখন সেই সত্য তার অর্গলের ফাঁক গলে মুক্ত আকাশের নীচে ঠাঁই করে নিয়েছে। যাতায়াতের পথে হামেশাই গোরার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সেই সত্যের। গোরা তাকে চিনতেই পারে না। তাই অপমানিত বৃদ্ধ মুসলমানকে সে অর্থ দিয়ে সাহায্য করে, মুসলমান তমিজের আশ্রয়দাতা নিম্ন জাতের হিন্দু নাপিতের ঘরে ক্ষুধা মেটায়, মুসলমান কৃষকদের সাহায্য করতে চর-ঘোষপুরে ছুটে যায়, জেল খাটে। জাত নিয়ে মাথাব্যথা সত্যি সত্যি তার কোনোকালেই ছিল না। সুচরিতার প্রেম তাকে ভাসিয়ে দেয়। জাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ের সকল সীমান্ত তুচ্ছ হয়ে যায়, মুছে যায় সেই প্রেমের কাছে। প্রেমের মধ্য দিয়েই দেশের সম্পূর্ণ রূপ গোরা প্রত্যক্ষ করে।
তবু একটি চূড়ান্ত আঘাতের প্রয়োজন ছিল। আর তা হল, গোরার আত্মপরিচয়। গোরা জানতে পারে, সে মোটেই ভারতীয় পিতা-মাতার সন্তান নয়, এক আইরিশ দম্পতির সন্তান। ঔপনিবেশিক ও পরাধীন ভারতবর্ষের যে অতীতকে সে নিজের অতীত বলে ভাবত, সে অতীত তার নয়। যে ধর্ম, সমাজ, সংস্কার ও শাস্ত্র যুগ যুগ ধরে বাহিত হয়ে এসে তার রক্তে প্রবাহিত বলে সে ভাবত, তাদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই। শিকড় থেকে উৎপাটিত হয়ে গোরা শিকড়কেই চিনল। সে উপলব্ধি করল, “আমি আজ ভারতবর্ষীয়। আমার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান—কোনও সমাজের বিরোধ নেই। আজ এই ভারতবর্ষের সকল জাতই আমার জাত। সকলের অন্নই আমার অন্ন। ঈশ্বর যে এমন করে আমার অশুচিতাকে সমূলে ঘুচিয়ে দেবেন, তা আমি স্বপ্নেও জানতুম না। আজ আমি এমন শুচি হয়ে উঠেছি যে চণ্ডালের ঘরেও আমার আর অপবিত্রতার ভয় রইলো না। আজ আমি ভারতবর্ষের কোলের ওপরে ভূমিষ্ঠ হয়েছি—মাতৃক্রোড় যে কাকে বলে পরিপূর্ণ ভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি।” গোরা পরেশবাবুর কাছে সেই দেবতার মন্ত্র চায়, যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন, ভারতবর্ষের দেবতা—যার মন্দিরের দ্বার কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না।
গোরার আত্মপরিচয় তাকে ভারতবর্ষ থেকে নয়, মিথ্যা ভারতবর্ষ থেকে উৎপাটিত করে সত্য ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা করল। তার পুনর্জন্ম হল। ভারতবর্ষকে ঘিরে ভাব ও ভ্রান্তির যে মিথ্যার প্রাচীর গড়ে উঠেছিল, তা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। জাত, ধর্ম, সমাজ, সংস্কার-ভেদাভেদহীন এক পরিপূর্ণ সত্য ভারতবর্ষ উন্মোচিত হল তার চোখের সামনে। গোরা উপলব্ধি করল, দেশের মাটিতে জন্মালেই কেবল হয় না। তাকে সেই দেশের মানুষ হওয়ার যোগ্য হয়ে উঠতে হয়। গোরা নিজের কৃতিত্বে এই যোগ্যতা অর্জন করেছে। তা ছাড়া আইরিশ বলেও হয়তো ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে তার রয়েছে জন্মগতভাবেই রয়েছে অকৃত্রিম ঘৃণা ও আপসহীন লড়াই চালানোর স্পৃহা। অপরদিকে ভারতবর্ষের প্রতি রয়েছে প্রাণের চেয়েও দামি ভালোবাসা, প্রেম, ভক্তি ও শ্রদ্ধা। তাই জন্মে না হলেও, কর্মে ও প্রেমে, হৃদয়ে ও আত্মায় সে একজন ভারতীয়। সত্য ভারতবর্ষকে জানার পরই এই ভারতবর্ষকে সে অর্জন করেছে। মিথ্যা ভারতবর্ষ থেকে সত্য ভারতবর্ষের দিকে এই যাত্রাই গোরা উপন্যাসের মূল উপজীব্য।
গোরার ‘সত্য ভারতবর্ষক’ আজও আমরা আয়ত্ত করতে পারিনি। গোরা তাই অনেকের কাছে হয়ে ওঠে এক উদ্ভট, কিহোতিক চরিত্র। আর সত্যিই তো, বিশ্বসাহিত্যে দন কিহোতের মতো আত্মীয় গোরার আর ক-জনই বা রয়েছে? দন কিহোতে ঠিক গোরার মতোই আখ্যানের সিংহভাগ জুড়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তির শিকার হয়ে থাকেন। কিন্তু এই মিথ্যাই সত্যের কাছে পৌঁছোবার পথ প্রশস্ত করে দেয়। সরাইখানার মালিক ভেবে যখন তিনি দুর্গাধিপতিকে প্রহার করেন, তখন আহত হয় বিকারগ্রস্ত ক্ষমতাবান অভিজাত শ্রেণিই! শেষ পর্যন্ত যখন তার মিথ্যা মোহ ও বিভ্রান্তি কেটে যায়, তখন আর সত্যের পথ থেকে ফেরার উপায় নেই। মিথ্যা দিয়ে যাত্রা শুরু করে আখ্যানের শেষে সত্যের কাছে গোরাও ঠিক এরকমই অসহায় হয়ে পড়ে। স্পেনের সন্ত দন কিহোতের মতো অন্তিম পর্বে সেও হয়ে ওঠে সত্য ভারতবর্ষের দ্রষ্টা-সাধক।