Ayi Kwei Armah
হৃদয়পুর দ্বীপের হাসপাতালটার গোটা দেশেই খুব নামডাক। হঠাই সেই হাসপাতালে ভরতি হতে হয়েছে বাবাকে। খুব শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল বাবার। নিমাই আর ধ্রুপদী যখন সেখানে পৌঁছোল, বাবা তখন পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু আজ সারাদিন বাবাকে এখানেই থাকতে হবে। ডাক্তারেরা নজর রাখবেন তাঁর ওপর। খুবই সুদৃশ্য, বিলাসবহুল একটা ঘরে রয়েছেন বাবা। বালিশে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন তিনি। ওদের দেখে বলে উঠলেন, “আরে, এসো, এসো। তা নিমাই, কাজ কতদূর এগোল?”
নিমাই কিছু বলার আগেই ধ্রুপদী বলে উঠল, “ওর কাজ তো প্রায় শেষ।”
“বাঃ!” বাবা হাসলেন। যেন জানতেন, এরকমই কিছু একটা হবে।
—আপনাকে দেখে বেশ ভালো লাগছে।
“হ্যাঁ, আমি পুরোপুরি সুস্থ।” বাবা যে মনের কথাই বলছেন, তা বোঝা গেল টেবিলের ওপর রাখা হুইস্কি ও ভোদকার বোতল দেখে। পাশেই আধ খাওয়া একটা হুইস্কির গ্লাস। ঘরে ঢোকার মুখে এই গ্লাসটাই তাঁকে ঠোটের কাছে ছুঁইয়ে থাকতে দেখেছিল ওরা।
ওদের মনের ভাব বুঝে বাবা বলে উঠলেন, “একটু আগে শুভাশিস আর অমলকান্তি এসেছিল। ওরাই দিয়ে গেছে। বলল, আর কী! ভালোই তো হয়ে গেছেন। এবার একটু খুশি মনে পান করুন!” কথাটা শেষ করেই বেশ জোরে হেসে উঠলেন বাবা।
“একটা কথা ছিল বাবা... ” একটু সংকোচ নিয়েই বলে উঠল ধ্রুপদী।
বাবা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর বললেন, “নিমাইয়ের ব্যাপারে?”
“হুঁ।” ধ্রুপদী এবার লজ্জাই পেল একটু।
“তুমি তো দেখছি ওর পোস্ট অফিস হয়ে গেছ!” বলেই আবার জোরে হেসে উঠলেন বাবা। ধ্রুপদীর ফরসা মুখ লাল হয়ে উঠেছে। সেই লাল মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তবু কথাটা সে বলবেই। মনের জোর দেখাতেই হবে।
ধ্রুপদী বলল, “বাবা, নিমাই কবে সার্টিফিকেট পাবে?”
বাবা কেমন কাঠ কাঠ গলায় বললেন, “একটু সময় লাগছে। ওটা তো ওর প্রাপ্যই।”
বাবার কথা শুনে ধ্রুপদী আশ্চর্য হয়ে গেল। বলল, “এ কেমন বিচার আপনার? অচ্যুৎ একের পর এক সার্টিফিকেট পেয়ে যাচ্ছে। আর তারই জোরে একের পর এক সুযোগ। আর নিমাই অভিনয় কলায় দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পেয়ে বসে আছে। ওর কপালে একটা সুযোগও জুটছে না?”
“কী বলতে চাও তুমি?” বাবার গলা এবার বেশ কঠোর শোনায়।
ধ্রুপদী একদমে বলে যায়, “নিমাই যে এখানে সার্টিফিকেট নিতে এসেছে, শুভাশিস বা অমলকান্তি কী একথা জানত না? ওরাও তো ওর অভিনয় দেখেছে! না কী ওরা ধরতেই পারেনি নিমাইয়ের প্রতিভাকে? অচ্যুৎ সমাদ্দারের পাশাপাশি নিমাইকেও কী অভিনয় করার সুযোগ দেওয়া যেত না? অন্তত ভাঁড়ামির বদলে প্রকৃত অভিনয়-রস উপভোগ করতে পারতেন দর্শকেরা। কিন্তু কে বলবে নিমাইয়ের হয়ে? কেনই বা বলবে? নিমাইকে সবাই যেন ছোটো করেই রাখতে চায়। কেউ তার হয়ে কিছু বলতে চায় না। তার উপস্থিতি সবার কাছেই যেন অস্বস্তির কারণ। তাই তাকে লুকিয়ে রেখেই তারা হয়তো স্বস্তি বোধ করে। এর কারণ কী, আমিও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এখনও। কেন নিমাইকে প্রকাশ্যে আসতে দেওয়া হচ্ছে না? নিমাইকে কিছু বললেই বলে, কেউ তাকে স্বীকৃতি না দিক, বাবা ঠিকই বুঝবেন। তাঁর মতো বিচারক আর কে আছেন? তাঁর একটি ইশারায় গোটা পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। সবাই নিমাইয়ের পক্ষে এসে যেতে পারে। তার হয়ে গলা ফাটাতে পারে। বাবা, আপনি কী ওকে একটু তাড়াতাড়ি সার্টিফিকেটটা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন না?”
বাবাও বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে না গিয়ে সটান গুলি ছুড়লেন, “কী যা তা বলছ তুমি? কার সঙ্গে কার তুলনা করছ তুমি? অচ্যুতের সঙ্গে নিমাইয়ের তুলনা?”
ঘরে যেন বাজ পড়ল। ধ্রুপদী স্তম্ভিত হয়ে বাবার দিকে তাকাল। আর নিমাই যেন এই ঘর থেকে ছুটে পালাতে পারলেই বাঁচে!
বাবা নির্দয়ভাবে বলে চললেন, “তা ছাড়া কথায় কথায় অত অচ্যুৎকে টান কেন? ও তো নিমাইয়ের নামে কখনও কিছু বলে না? মনে রেখো, ওর মতো ছেলে কলকে পাচ্ছে না। সেখানে নিমাই... ”
নিমাই ক্রমেই অচ্যুতের তুলনায় নিজের তুচ্ছতাকে যেন টের পাচ্ছে। অচ্যুৎ তার চোখে ক্রমেই আরও বড়ো হয়ে উঠছে। আর সে অচ্যুতের তুলনায় অপাঙ্ক্তেয়।
ধ্রুপদী সরাসরি বাবার মুখের দিকে তাকাল। সেই মুখে একটুও রাগ নেই। তিনি হাসছেন। আর তাই দেখেই আবার যেন ভরসা পেল ধ্রুপদী। তার মনে হল, বাবা যখন রেগে যাননি, তখন কথা চালানো যেতে পারে। এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। বাবা যে মজা পাচ্ছেন, সেটাই সে বুঝল না।
—নিমাইয়ের জীবনে স্থায়িত্ব আসা দরকার। স্টেবিলিটি ছাড়া...
হো হো করে হেসে উঠলেন বাবা। তারপর বললেন, “স্থায়িত্ব? কার আছে স্থায়িত্ব? অত সহজে কিছু পাওয়া যায় না... ”
বাবার হাসিটা খুব বিশ্রি শোনাল। একজন মানুষ বিপন্ন, তার মুখের ওপর ওইভাবে হো হো করে হাসি, স্পর্ধা ও বিদ্রুপ মিলেমিশে যেন আছড়ে পড়ল নিমাইয়ের ওপর। ধ্রুপদীর মুখের আলো নিভে গেল হঠাৎ। কেমন একটু কুঁচকে গেল সে। কিন্তু তবুও সে বলল, “নিমাই খুব গরিব। অসুস্থ মা ছাড়া ওর কেউ নেই। ওর কোনো চাকরি নেই। সামাজিক সম্মান নেই। আপনি তো সবই জানেন। ওকে শুধু ওর সার্টিফিকেটটা পেতে দিন। ও তো অন্যায্য কিছু চাইছে না... ”
বাবা যেন ধ্রুপদীর অস্ত্র দিয়েই এবার ঘায়েল করতে চাইলেন তাকে। বলে উঠলেন, “স্টেবিলিটির কথা বলছ, তাই না! অদ্যুতের মতো ছেলের স্টেবিলিটি নেই, সেখানে নিমাই... ”
বলেই তিনি হাতের মোবাইল ফোনটা নিয়ে কয়েকটা সুইচ পরপর টিপলেন। তারপর বলে উঠলেন, “শুভাশিস, অচ্যুতের চাকরিটা পার্মানেন্ট করার ব্যাপারে এবার তোমরা দুজন একটু উদ্যোগ নাও। ছেলেটার চাকরি খুব দরকার। আর সে যোগ্যও বটে!”
নিমাই যেন বাবাকে নয়, চোখের সামনে একজন শিকারিকেই দেখছে। তার মুখে অভিমান, অপমান, অসম্মান সব একাকার হয়ে ফুটে উঠেছে। সে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কিন্তু বাবা তখনও আক্রমণ শানিয়ে চলেছেন। ভালো শিকারি গোড়াতেই শিকারের ওপর সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে শিকার প্রথম থেকেই বেসামাল হয়ে যায়। তার আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। বাবা ঠিক এটাই করছিলেন। কোনো রেয়াত না করে ফোনটা রেখেই তিনি বলে উঠলেন, “আসলে সবাই সব কিছু পারে না, বুঝলে? অভিনয়টা এমন একটা ব্যাপার... ”
“আপনি তো নিমাইয়ের অভিনয় দেখেছেন।” শেষ চেষ্টা করতে চাইল ধ্রুপদী। বাবা খোঁচা খাওয়া বাঘের মতো বলে উঠলেন, “কিছুই হয়নি। খুবই কাঁচা কাজ... ”
ধ্রুপদী তাকিয়ে দেখল, বাবার মুখে হাসি। তিনি কিন্তু একটুও রেগে যাননি। নিমাইয়ের দুর্বলতার কথা জানিয়ে ধৈর্য হারিয়ে নিজেই সে যেচে বাবার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। আর সেই অস্ত্র দিয়েই বাবা অনায়াসে খোঁচা মারলেন! বাবা বুঝে গেছেন, তাঁকে ছাড়া নিমাইয়ের গতি নেই!
বাবার কথা শুনে নিমাইও অবাক হল একটু। তার অভিনয় নিয়ে ঠিক এইভাবে কখনও তাচ্ছিল্য করেননি বাবা। বাবাও যেন একটু সতর্ক হলেন। আর তারপরই হঠাৎ তিনি কৌশল বদলে ফেললেন। সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “তুমি যদি এরকম করতে থাক, সবাই তো এরপর নিমাইকে করুণা করতে শুরু করবে! আর তোমাকে সন্দেহ! তোমরা কী এটাই চাও?” বাবার কথা বলার ভঙ্গি পালটে যাওয়ায় ধ্রুপদীর মুখ থেকেও হঠাৎ যেন মেঘ সরে গেল। সে উৎসুক হয়ে বাবার মুখের দিকে তাকাল।
বাবা বললেন, “তা ছাড়া অত হতাশ হওয়ার কী আছে? এই তো সবে শুরু... ”
ধ্রুপদীর মুখ এখন ঝলমল করছে।
বাবা বলে চলেছেন, “নিমাই সার্টিফিকেটটা পেয়ে গেলেই… ”
ধ্রুপদী অপলক চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।
বাবা বলছেন, “অভিনয় করার জন্য স্কলারশিপ পাবে... ”
ধ্রুপদী হতবাক। যেন বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়তে পারলে বাঁচে।
—বিদেশে যাবে...
“সত্যি?” এবার অস্ফুটে জানতে চায় ধ্রুপদী।
বাবা বলে চলেন, “তা নয়তো কী? তোমরা আমার সঙ্গে থাকো। ধৈর্য ধরো। অনেক সুবিধা পাবে... ”
বাবা যেন ধ্রুপদীকে লেজে খেলাচ্ছেন। একটার পর একটা টোপ দিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ নিমাইয়ের মাথায় যেন বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। সে বুঝতে পারল, ধৈর্য হারিয়ে ধ্রুপদী নিজেকে দুর্বল করে ফেলেছে। বেশি মরিয়া হতে গিয়ে বাবাকেই সুযোগ করে দিয়েছে। লোভ দেখিয়ে ফেলেছে সে। আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাও! আর বাবাও কি ঠিক এটাই চান না?
ধ্রুপদীর কথা ভেবে কষ্ট হল নিমাইয়ের। কিন্তু সে ঠিক করল, আসল কথাটা খুলে বলবে না। এতে ধ্রুপদীর কষ্ট আরও বাড়বে। কিন্তু বাবাকে প্রশ্নটা করা দরকার। সে তাই জানতে চাইল, “আমার অভিনয় কি সত্যিই খুব কাঁচা?”
“তোমাকে আরও পরিণত হতে হবে।” হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিলেন বাবা। মুখে মিটিমিটি হাসি।
নিমাই সরলভাবেই জানতে চাইল, “আমার সমস্যাটা কোথায়?”
ধ্রুপদী বুঝতে পারল, নিমাই নিজেই বাবার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে। বাবা বললেন, “তোমার সমস্যা অনেক। আসলে সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না, বুঝলে! এটা নিয়ে আপশোস করে লাভ নেই।”
“আমার সমস্যাগুলো ঠিক কী কী?” নিমাই আবার জানতে চাইল।
বাবা বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে না গিয়ে বলে গেলেন, “তোমার উচ্চতা কম, গলার স্বর একটু মেয়েলি, মঞ্চে আরও দ্রুত চলাফেরা করতে হবে, চরিত্রের সঙ্গে অত বেশি একাত্ম হয়ে গেলে চলবে না, যে-কোনো চরিত্রেই নিজেকে অত বেশি ভাবুক দেখালে চলবে না... ”
ধ্রুপদী বুঝতে পারল, বাবা বাজে বকছেন। নিমাই বাবার কথাগুলোবোঝার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অর্থহীন, অসাড় কতগুলো শব্দ তার মনে কোনো দাগই কাটতে পারল না। কিছু শিখতে চাইছিল সে। কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারল, বাবার কথাগুলো থেকে প্রতারণার কৌশল ছাড়া আর কিছুই শেখার নেই। নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছিল তার।
নিমাইয়ের কষ্ট হচ্ছিল ভেতরে। কেমন যেন দম আটকে আসছিল। তবু সে বলল, “আমি কী সার্টিফিকেটটা পাব?”
“নিশ্চয়ই। ওটা তো তোমার প্রাপ্যই। ফাইলের কাজটা শেষ হলেই... ” বাবা আবার আশ্বাস দিলেন।
ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকল অচ্যুৎ। হাতে একটা হুইস্কির বোতল। সেই দেখে বাবা সত্যি সত্যিই খুব রেগে গেলেন। একটা খেলা বেশ জমে উঠেছিল। অচ্যুতের উপস্থিতি রসভঙ্গ ঘটিয়ে দিল তাঁর। তা ছাড়া কেমন একটা ধরা পড়ে যাওয়ার অনুভূতিও হল যেন।
বাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, “কী ব্যাপার? হঠাৎ এই সময়?”
অচ্যুতের মুখের আলো নিভে গেল। বাবা তো বুঝতেই পেরেছেন, সে এখানে কেন! তারপরও এই প্রশ্ন! আর ওই রাগ! অচ্যুতের উপস্থিতবুদ্ধি প্রখর। সে বুঝতে পারল, ভুল সময়ে এসে পড়েছে সে। কিন্তু তখন আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই।
বাবা আবার চেঁচালেন, “যাও, যাও, চলে যাও, যত সব উপদ্রব! আসার কোনো সময়-অসময় নেই! আর কখনও এভাবে যখন-তখন এসে বিরক্ত করবে না আমাকে... ”
অচ্যুৎ সম্পূর্ণ থতমত খেয়ে গেছিল। এক মুহূর্ত ভাবল, হাতের বোতলটা নিয়ে কী করবে! প্রথমে টেবিলে বোতলটা রেখেই নিমেষের মধ্যে পালানোর কথা ভাবল। কিন্তু তারপর সিদ্ধান্ত বদলে বোতলটা হাতে নিয়েই এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
ধ্রুপদী আর নিমাইও হতভম্ব হয়ে গেছিল। বাবা যে অচ্যুতের সঙ্গেও এই ব্যবহার করতে পারেন, তা তাদের ধারণার বাইরে ছিল। কিন্তু এখন দেখা গেল, বাবা সবই পারেন। তেমন হলে অচ্যুতকেও তিনি রেহাই দেন না। বাবার দিকে ওরা তাকিয়ে দেখল, তিনি এখন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি। পুরো ব্যাপারটা যেভাবে মিটে গেল, তাতে তিনি সন্তুষ্ট! ওরা বাবার অনুমতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাইরে এসে ধ্রুপদী বলল, “অচ্যুতটার সত্যিই কোনো আত্মসম্মানবোধ নেই। বাবা ওকে ওইভাবে তাড়ালেন... ”
নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “লাভটা কিন্তু ওরই হল। ও মুখ থেকে টুঁ শব্দটি বার করেনি। ওর আনুগত্যে বাবার কোনো সন্দেহ রইল না। তুমি কিন্তু শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেলে... ”
“কিন্তু নিজের কথাটা তো বলতেই হবে।” একরোখার মতো বলল ধ্রুপদী!
“আমি তোমাকেই সমর্থন করছি। কিন্তু এর ফল আমাদের দুজনকেই ভুগতে হবে।” নিমাই থেমে গেল।
ধ্রুপদী এগিয়ে দিচ্ছিল নিমাইকে। ঘরে গিয়েই ফাইল নিয়ে বসবে নিমাই। সমুদ্রের ধার দিয়ে সরু, পায়ে হেঁটে চলার মতো একটা পথ। আর তখনই উলটোদিক থেকে আসতে দেখা গেল শুভাশিস আর অমলকান্তিকে। হঠাৎ কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ধ্রুপদী বলে উঠল, “আর কবে আপনারা ভাববেন নিমাইয়ের কথা?”
দুজনেই থমকে দাঁড়াল। তারপর অমলকান্তিই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “বাবা তো কখনও নিমাইয়ের কথা বলেন না। উনি সবসময় শুধু অচ্যুতের কথা বলেন!”
“গতকালের অনুষ্ঠানে অমলকান্তি তো নিমাইয়ের নাম তুলেছিল!” শুভাশিস বলল এবার, “কিন্তু বাবাই তো রাজি হলেন না!”
“আমি আলাদা করেও বাবাকে বলেছিলাম।” অমলকান্তি বলল। “বাবা বললেন, ও ফাইল নিয়ে এখন ব্যস্ত আছে। সেকথা শুনেও আমি বলেছি, কিন্তু অভিনয়টা উনি চমৎকার করেন। একদম সহজাত প্রতিভা। আমি ওঁর অভিনয় দেখেছি।” তবু বাবা রাজি হলেন না! শুধু বললেন, “ওকে ফাইল-সংগ্রাহক হিসাবেই থাকতে দাও... ”
“গতকালের পার্টির কথাটাও বাবা ওঁকে জানাতে বারণ করেছিলেন।” শুভাশিস বলল। “কিন্তু অমলকান্তিই বোঝাল, এটা উনি জেনে যাবেনই। বাবা তখন বললেন, ঠিক আছে, আমিই ওকে বারণ করে দেব... ”
“এই তো শুনলাম,” হঠাৎ বলে উঠল অমলকান্তি, “অচ্যুৎকে উনি বিদেশে পাঠাচ্ছেন। মানে, আরও একটা সার্টিফিকেট।”
ধ্রুপদী জ্বলে উঠল যেন। নিমাই কিন্তু আমল দিল না। ওদের খোঁচা দেওয়ার জন্যই কথাটা বলা হয়েছে। বিষটা গায়ে মাখলে চলবে না। তা ছাড়া অচ্যুৎ বাবার দয়া-ভিক্ষা পেয়ে যা খুশি করুক। ও তো শুধু নিজের সার্টিফিকেটটা ছাড়া আর কিছু চায় না।
ধ্রুপদী কিন্তু জানতে চাইল, “কেন?”
—দেশের প্রতিনিধি হিসাবে। অচ্যুৎ দেশের ভবিষ্যৎ। তরুণ অভিনয় প্রতিভা!
“ও!” থেমে গেল ধ্ৰুপদী। তারপর হঠাৎ বলে উঠল, “অচ্যুৎ যদি এই দেশের মুখ হয়, তবে এই দেশ সম্পর্কে বাইরের লোকের কী ধারণা হবে, বলতে পারেন? গোটা দুনিয়া এই জন্যই এই দেশটাকে ছ্যা ছ্যা করে। কোনো সম্মান দেয় না!”
ধ্রুপদীর কথা যেন শুনতেই পায়নি এমনভাবে শুভাশিস বলল, “তবে একটা কথা বলতেই হবে। বাবা নিমাইয়ের ফাইল গোছানোর কাজে খুব খুশি! কথাটা বলতে কাউকে উনি বাকি রাখেননি!”
ধ্রুপদী দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “সে তো হবেই। নিমাইয়ের তো একটা পরিচয় দরকার।”
অমলকান্তি হঠাৎ নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “ফাইল গুছিয়ে বাবার স্নেহধন্য হয়ে উঠেছেন আপনি। অথচ ফাইল দেওয়া নিয়ে আপনার প্রতি মানুষের ক্ষোভ কিন্তু বাড়ছেই... ”
একটু অবাক হয়েই নিমাই জানতে চাইল, “কেন?”
শুভাশিস বলল, “কারণ আপনি শুধু ফাইলটাই দিচ্ছেন না। সেই ফাইল কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেটাও বুঝিয়ে দিচ্ছেন।”
সেটাই তো স্বাভাবিক। নিমাই বলল, “আমি ফাইল গোছাচ্ছি। একমাত্র আমারই স্পষ্ট ধারণা রয়েছে ওই ফাইল কীভাবে ব্যবহৃত হতে পারে... ”
—এতে আপনি সবার চোখে অপ্রিয় হয়ে যাচ্ছেন। বদনাম হচ্ছে আপনার...
—তারা ফাইল হাতে নিয়ে বাবাকে গিয়েই ধরছে...
—নিজেদের মতো করে সেই ফাইল ব্যবহার করার অনুমতি চাইছে...
—আর বাবাও অবাধে তাদের সেই অনুমতি দিচ্ছেন...।
—বাবা সবার কাছে প্রিয়ই থাকছেন। মাঝখান থেকে শুধু শুধু আপনি...
নিমাই বলল, “ঠিকই বলেছেন। কিন্তু বাবার কাজের ক্ষতি হবে এমন কিছুই আমি করতে পারি না... ”
শুভাশিস সহানুভূতির সুরে বলল, “বাবা কিন্তু সেভাবে ভাবছেন না। ক্ষতিই যদি হবে, বাবা ওদের কথায় রাজি হতেন কী? আপনি সবকিছুই নিজের মতো করে ভেবে নেন। বড়ো সূক্ষ্ম সেসব ভাবনা, সবাই বোঝে না। নিজের কথাও এবার একটু আপনার ভাবা উচিত!”
ওরা দুজনেই চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে নিমাই আবার বলল, “ওরা দুজন আমার প্রতি এত সদয় আচরণ করছে কেন?”
“কারণ, ওদের ফাইল দরকার।” বলেই হো হো করে হেসে উঠল ধ্রুপদী। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে সে তাকিয়ে রইল সমুদ্রের দিকে। তারপর বলল, “তোমাকে কিন্তু চেষ্টা করে যেতে হবে।”
“কোনো লাভ নেই!” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল নিমাই।
“কেন, ওকথা বলছ কেন?” সে জানতে চাইল।
—কারণ, আমি এর মধ্যে একশোরও বেশি অভিনয় কোম্পানিতে ফোন করেছি। কেউ রাজি হয়নি। বাবার সঙ্গে পরামর্শ না করে কেউ আমাকে চাকরি দেবে না। আর পরামর্শ চাইতে গেলে কী হবে, সে তো তুমি বুঝতেই পারছ! আসলে সার্টিফিকেটটা না পেলে, কিছুতেই কিছু হওয়ার নয়...
—কিন্তু কেন উনি এরকম করছেন? তোমার সঙ্গে ওঁর কীসের শত্রুতা?
নিমাই হাসল একটু। তারপর বলল, “আমাকে চাইলে উনি ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে পারেন, তাই না? এত খাতির করে তাহলে রেখেই বা দিয়েছেন কেন?”
“ঠিক আছে।” ধ্রুপদী বলল, “তোমাকে উনি চাকরি দেবেন না। কিন্তু আমাকে? তুমি গিয়ে বলো না... ”
নিমাই রাজি হল।
দুপুরে খাওয়ার পর বাবাকে দেখতে গিয়ে প্রস্তাবটা দিল নিমাই। বলল, “বাবা, ধ্রুপদীর একটা চাকরির খুব দরকার। আপনি যদি একটা ব্যবস্থা করে দেন... ”
বাবা কোনো আপত্তি করলেন না। একটা চিঠি লিখে দিলেন। ব্যাপারটা এত মসৃণ হওয়ায় নিমাই খুব অবাক হয়ে গেল। তার মনে হল, সহজে যেখানে কিছুই হয় না, সেখানে এত সহজে ব্যাপারটা হয়ে যাওয়াটাই সন্দেহজনক।
বাবা যতক্ষণ লিখছিলেন, নিমাই তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। খুব হিংস্র দেখাচ্ছে বাবার মুখটা। কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল নিমাইয়ের। চিঠি লেখা শেষ হলে সে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তারপর ছুটতে ছুটতে গিয়ে চিঠিটা ধ্রুপদীর হাতে দিল।
বাবা যখন চিঠিটা লিখছিলেন, একটা ঘটনা ঘটল। এই ঘটনাও গভীর ছাপ ফেলে গেল নিমাইয়ের মনে। হঠাৎ বাবার মোবাইল বেজে উঠল। চিঠি লিখতে লিখতে অন্যমনস্ক বাবা বলে উঠলেন, “ফোনটা ধরো তো... ”
নিমাই সুইচ অন করতেই ওপাশ থেকে বুড়ো অভিনেতার গলা ভেসে এল। তিনি বললেন, “কে নিমাই, বাবা আছেন?”
বাবা মুখ তুলে জানতে চাইলেন, “কে?”
“বুড়ো অভিনেতা।” নিমাই বলল।
—বলে দাও, আমি নেই। পরে ফোন করতে।
বাধ্য হয়েই নিমাই বলল, “উনি তো নেই। পরে ফোন করবেন।”
বুড়ো অভিনেতা শুধু বললেন, “বুঝেছি বাবা!” সেই বিরল মানুষটির সঙ্গে এই নিমাইয়ের শেষ কথা।
ফোনটা রেখে গভীর অনুশোচনা হলো নিমাইয়ের। বুড়ো অভিনেতাকে কখনও সে মিথ্যা কথা বলেনি। উনি অত্যন্ত সৎ মানুষ। কিন্তু বাবাকে অমান্য করা মানে তো দেশদ্রোহিতা!
চিঠিটা পড়ে ধ্রুপদীর মুখটা গম্ভীর হয়ে উঠল। নিমাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পড়ে দ্যাখো।” নিমাই চিঠিটা হাতে নিয়েই পড়তে শুরু করল। দু-লাইনের একটা চিঠি। বাবা লিখেছেন, “প্রিয় মৌসুমী, তোমার কাছে একটি মেয়েকে পাঠাচ্ছি। দ্যাখো, যদি তুমি বা তোমার অফিসের কেউ ওর কোনো কাজে আসতে পারো। বাবা।”
ধ্রুপদী বলল, “এই চাকরি আমি নেব না। আমি শুধু ‘একটি মেয়ে’? আমার কোনো নাম নেই? পরিচয় নেই? সম্মান নেই? আমি কি নিছক একজন করুণাপ্রার্থী? ভিক্ষুক?”
নিমাই বলল, “পাগলামি কোরো না। বাবা কিন্তু সবসময় তোমার এই প্রতিবাদ মেনে নেবেন না!”
শেষ পর্যন্ত ধ্রুপদী রাজি হল। খুব দূরে নয় মৌসুমীর অফিস। ধ্রুপদী চলে যাওয়ার পর নিমাই খুব নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগল। ধীরে ধীরে ওর মধ্যে যেন একটা বিশৃঙ্খলার জন্ম হচ্ছে। কেন এরকম হচ্ছে, তার কোনো কারণ খুঁজে পেল না ও। ওর মনে পড়ল, বুড়ো অভিনেতার একটা কথা। তিনি বলেছিলেন, “মানুষের জীবনটা আসলে খণ্ড খণ্ড সময়ের সমষ্টি। প্রতিটা খণ্ডে সে আলাদা আলাদা মানুষ। তাদের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে তুলতে না পারলে জীবনকে জীবন বলেই চেনা যায় না।”
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক হয়ে গেল ধ্ৰুপদীকে ওরা বসিয়ে রেখেছে। এখনও ভেতরে ডাকেনি। ধ্রুপদী বাবার চিঠি ভেতরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তবু এই পরিস্থিতি! আসলে চিঠিটা খুব তাচ্ছিল্য করে লেখা হয়েছে। এমনভাবে লেখা হয়েছে, যাতে ওটা পড়েই বোঝা যায়, নিতান্ত দায়সারা গোছের ব্যাপার। ‘তুমি ও তোমার অফিসের কেউ’, মনে পড়ল ধ্রুপদীর। কোনো আন্তরিকতা নেই। ভিক্ষে দেওয়ার মতো করে লেখা।
বসে থাকতে থাকতেই একটা স্বপ্ন দেখে ফেলল ধ্রুপদী। সে দেখল, একটা ঢেউ খেলানো সবুজ উপত্যকা। সেখানে অজস্র ভেড়া। আর সেই ভেড়াগুলোর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা গলার একটা উট। উটের সেই লম্বা গলা দেখে ভেড়াগুলোর খুব ঈর্ষা হল। তারা সবাই মিলে চেপে বসল উটটির ঘাড়ে। তারপর তার গলাটিকে বেঁকিয়ে খাটো করার প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে লাগল। উটটা তীব্র আর্তনাদ করতে শুরু করল। উটের মুখের বদলে এক ঝলকে নিমাইয়ের মুখ দেখতে পেল সে। উপত্যকার সবুজ রং ধীরে ধীরে বদলে গিয়ে লাল হয়ে গেল। আর ঠিক তখনই কে যেন ডাকল ধ্রুপদীকে।
ভেতরের সুদৃশ্য ঘরে মৌসুমীকে দেখতে পেল ধ্রুপদী। চল্লিশের ওপর বয়স। সুন্দরী নয়, তবে চাকচিক্য খুব। মুখ নয়, যেন মুখোশ পরে আছে সে। আর সেই মুখোশটি পাথরের। কোনো মানুষের মুখ এমন ভাবলেশহীন, পাথরের মতো হতে পারে না। মৌসুমী যেখানে বসে আছে, তার ঠিক পিছনেই একটা পেইন্টিং। ছবিটা মৌসুমীই এঁকেছে, ছবির গায়ে তাঁর নামাঙ্কিত হস্তাক্ষর। সেই ছবিতে বৃষ্টি আছে, ফুল আছে, প্রজাপতি আছে। মৌসুমীর ভেতরে তাহলে একটা মানুষের মন আছে। বাইরে থেকে দেখলে কিন্তু পাথর ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না!
ধ্রুপদীর মনে পড়ল, মৌসুমীকে নিয়ে তাদের কাছে বাবা ভুরি ভুরি প্রশংসা করেছিলেন। এই মহিলার উদ্যোগ, তৎপরতা ও ব্যাবসাবুদ্ধির কোনো তুলনা নেই! তুলনা নেই সাহস, নিষ্ঠা ও দূরদর্শিতার! নইলে এই দেশে এত দ্রুত ব্যাবসা জমিয়ে ফেলা সহজ কথা নয়। কিন্তু শুধু ব্যাবসা নিয়েই থাকে না এই মহিলা। সময় পেলেই ছবি আঁকে। সুন্দর সুন্দর জায়গায় বেড়াতে যায়। শুধু বাবাকে নিয়েই মৌসুমী এখনও পর্যন্ত তিনশো ছবি এঁকে ফেলেছে। বেড়াতে গেছে কমপক্ষে দুশো জায়গায়। বাবার এক পয়সাও লাগেনি। সব ব্যবস্থা মৌসুমীর। গাড়ি-বাড়ি-আহার-আমোদের ঢালাও আয়োজন। ব্যাবসা থেকেই এই আয়।
মৌসুমীর হাতে ধরা বাবার লেখা চিঠি। মুখে কোনো হাসি বা প্রশ্রয় নেই। সে শুধু বলল, “তোমার সার্টিফিকেট আছে তো?”
—নাঃ, তবে এবার পেয়ে যাব।
বাবার চিঠিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মৌসুমী বলল, “এটাও অবশ্য একটা সার্টিফিকেট। ঠিক আছে, জয়েন করো। কাজ বুঝে নাও।”
কিন্তু কাজ বুঝে নিতে গিয়েই অবাক হয়ে গেল ধ্ৰুপদী। সে দেখল, কোনো কাজই নেই। বসের কাছে গিয়ে সে বলল, “আমায় কোনো কাজ দিন।”
বস যে মেয়েটি, তার নাম কমলিকা। সে বলল, “এখন তো কোনো কাজ নেই। যখন আসবে তখনই পাবে। এখন চুপ করে গিয়ে বসো। আর শোনো... ”
ধ্রুপদী থমকে দাঁড়াল। কমলিকা বলল, “তোমাকে তো বাবা পাঠিয়েছেন... ”
“আপনিও কী ওঁকে বাবা বলেই ডাকেন?” ধ্রুপদী জানতে চাইল।
“শুধু আমি কেন, এই অফিসে সবাই, স্বয়ং মৌসুমী ম্যাডাম ওঁকে বাবা বলে ডাকেন। তা ছাড়া, উনি আমাদের কাছে বাবারই মতো। আর কী নামেই বা ওঁকে ডাকা যায়?”
ধ্রুপদী বলল, “হ্যাঁ, বাবাই পাঠিয়েয়েছেন আমাকে।” কমলিকার মুখে একটা কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল।
ধ্রুপদী গিয়ে আবার নিজের চেয়ারে বসল। দূর থেকে কমলিকাকে সে লক্ষ করছিল। ওই হাসিটার অর্থ বোঝার চেষ্টা করছিল। এমনিতে মেয়েটি হাসিখুশি, সবার সঙ্গে হেসে হেসেই কথা বলছে। আর যখন বলছে না, তখন নিজের ল্যাপটপ খুলে নানা ধরনের গেমস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। বোঝা গেল, তারও কোনো কাজ নেই। কিন্তু বাবা পাঠিয়েছেন শুনে কৌতুক বোধ করল কেন মেয়েটি!
কাজ একসময় এল। কমলিকা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘরের বাকি তিনজনও তার সঙ্গে উঠে পড়ে লাগল। শুধু ধ্রুপদীকে ডাকা হল না। একসময় অধৈর্য হয়ে উঠে পড়ল সে। তারপর কমলিকার কাছে গিয়ে বলল, “আমায় যে কোনো একটা কাজ দিন।”
কমলিকা অন্যমনস্কভাবেই বলল, “এই ঘরের পর্দাটা খুব নোংরা হয়েছে। একটা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দাও তো... ”
ধ্রুপদী স্তম্ভিত হয়ে গেল। তারপর বলল, “ধুলোয় আমার অ্যালার্জি রয়েছে। আপনি এমন কোনো কাজ দিন, যেটা আমি পারব... ”
কমলিকা মুখ ফিরিয়ে কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তাহলে যে তোমাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে ভাই... ”
বাবার চিঠিটাকে এরা কতটা গুরুত্ব দিয়েছে, ধ্রুপদী ক্রমেই তা বুঝতে পারছিল। হঠাৎ সে শুনতে পেল কমলিকা মোবাইলে কাকে ফিসফিস করে বলছে, “বড়ো বড়ো খেলোয়াড়েরা খেলা না থাকলেও ঠিক ময়দানে নেমে পড়েন। ছোটোখাটো আমোদ-ফুর্তি করে নেন। ওসব না হলেই ওদের মনখারাপ... ”
বাবা নিমাইকে ডেকেছেন। কয়েকটা ফাইল সঙ্গে নিয়ে আসতে বলেছেন তিনি। নিমাই হাসপাতালের সুদৃশ্য ঘরটার সামনে থমকে দাঁড়াল। কেন যেন এই ঘরটার সামনে দাঁড়ালে হাসপাতাল নয়, দামি হোটেলের ঘর বলেই মনে হয়। তা ছাড়া বাবার জন্য কোনো বিধিনিষেধও নেই, অন্য রোগীদের যেমন আছে। বাবা যেভাবে থাকতে চাইছেন, সেভাবেই আছেন, মদ-সুখাদ্য-নারী-স্তাবক পরিবৃত হয়ে। নিমাই ঘরে ঢুকতেই তাদের দেখতে পেল। অচ্যুৎ-শুভাশিস-অমলকান্তি-নাবিক সবাই আছে। আছে হুইস্কি, ভোদকা, কাবাব, ফিশ ফ্রাই, কাজু বাদাম। আর সেই দুটি মেয়ে, যাদের একজন লাস্যময় নাচ দেখিয়েছিল, অপরজন বাবার প্রচারযন্ত্র হিসাবে কাজ করে।
বাবাকে দেখেই নিমাইয়ের মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল। সে বলল, “বাবা, আপনার জন্যই... ”
অচ্যুৎ বলল, “সুখবরটা আমরা সবাই পেয়েছি। ধ্রুপদীর চাকরি হয়েছে।”
নাবিকটি বলল, “একটু আগে দেশের একটি প্রাইভেট চ্যানেল খবরটা প্রচার করেছে। বাবার বদান্যতায় দেশশুদ্ধ লোক ধন্য ধন্য করছে।”
খবরটা নিয়ে ইতিমধ্যেই বেশ ঢাকঢোল পেটানো হয়ে গেছে। ধ্রুপদীর চাকরিটা তাহলে পাকা। একটু আশ্বস্ত বোধ করল নিমাই।
শুভাশিস বলল, “মোট পঞ্চাশজন প্রবীণ অভিনেতাকে এবার সার্টিফিকেট দেওয়া হবে।”
অমলকান্তি বলল, “নামগুলো একবার পড়ে শোনান তো নিমাই।”
নিমাই ফাইল থেকে কাগজ বার করে নামগুলো পড়ে শোনাতে লাগল। পরপর কয়েকটি নাম পড়ে গেল সে। তারপর একটি নাম পড়তেই বাবা বললেন, “থাক, এই নামটি তুমি বাদ দাও নিমাই... ”
যে নামটি বাবা বাদ দিতে বললেন, সে নামটির সঙ্গে নিমাই বহুদিন ধরে পরিচিত। তাঁর অভিনয়-দক্ষতা প্রশ্নাতীত। দেশের শ্রেষ্ঠ একজন অভিনেতা তিনি। একটু অবাক হয়েই নিমাই জানতে চাইল, “আমি বেশ কয়েকবার এঁর অভিনয় দেখেছি। চমৎকার। এঁর নাম বাদ দেব?”
“হ্যাঁ, দাও।” বাবা সপাটে বললেন, “আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না লোকটি। দেশের একে কী প্রয়োজন?”
এভাবে বেশ কয়েকজনের নাম বাদ চলে গেল। এঁরা প্রত্যেকেই বাবার সমসাময়িক। অসম্ভব দক্ষ সব অভিনেতা! এদের সঙ্গে প্রায়ই অভিনেতা হিসাবে বাবার তুলনা চলে। এবং বহু লোকের কাছে এঁরাই বাবার চেয়ে বেশি নম্বর পান।
নিমাইয়ের যেন বুক ফেটে যাচ্ছিল। তার প্রতি যে অবিচার চলছে, তাকে সে মেনে নিয়েই মন দিয়ে কাজ করে গেছে। কিন্তু এরা সব প্রবীণ অভিনেতা। প্রত্যেকেরই বয়স হয়েছে। দেশের অভিনয়ের ইতিহাসে এদের জায়গা ইতিমধ্যেই পাকা। এদের প্রতি এই অবিচার, এভাবে এদের বর্জন, কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছিল না নিমাই। ধ্রুপদী থাকলে হয়তো বলত, বাবা, অভিনয়ের নতুন ইতিহাস লিখতে চান। কিন্তু ধ্রুপদীও যে এখন পাশে নেই!
নিমাই কিন্তু আলাদা আলাদা ভাবে প্রত্যেকের সম্পর্কেই বাদ দেওয়ার কারণ জানতে চাইল। বাবা একটু অপ্রসন্ন হলেও উত্তর দিলেন। কখনও তিনি বললেন, “না, না, এর অভিনয় আমার পছন্দ নয়, কখনও বা, এর তো কোনো হৃদয়ই নেই, শুধু মাথা দিয়েই অভিনয় করেন, কখনও, ইনি একবার আমার সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেছিলেন, কেন কে জানে,” এইরকম সব। সবই ব্যক্তিগত কারণ। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ। ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই রাষ্ট্রীয় সার্টিফিকেট পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করছে! যাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, জাতি ও দেশের প্রতি তাঁর অবদান, তাঁর অভিনয় প্রতিভা, শ্রম, মেধা, দায়বদ্ধতা, কোনো কিছুই বিবেচ্য নয়।
নিমাই চুপচাপ বাছাই হওয়া নামগুলো একটা পরিষ্কার কাগজে লিখতে লাগল। আর তখনই বেশ কয়েকটা নাম দেখে তার দারুণ খটকা লাগল। এই দেশের অভিনয়ের ইতিহাস সে ভালোভাবেই জানে। কিন্তু এই নামগুলো আগে কখনও শোনেনি। সে মাথা তুলে জানতে চাইল, “এরা কারা বাবা?”
আর তখনই গোটা ঘরে যেন আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। শুভাশিস লাফ দিয়ে উঠে বলল, “ইনি আমার বোনের শ্বশুরমশাই।” অমলকান্তি বলল, “ইনি আমার বান্ধবীর কাকা।” অচ্যুৎ বলল, “আঃ, ইনি তো আমার কোম্পানির বসের বাবা।” সেই নাচ দেখিয়েছিল যে মেয়েটি, সে বলল, “ইনি আমার হবু বরের মেসো।” প্রচারযন্ত্র যে মেয়েটি, সে বলল, “ইনি আমার দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী।” শেষে নাবিকটিও মিনমিন করে বলল, “আর ইনিই তো পরমা দেবীর মা!”
একে মরণোত্তর দেওয়া হবে...
এরপর আর কোনো কথা চলে না। তবু নিমাই একটু ইতস্তত করে জানতে চাইল, “এদের কী রাখতেই হবে বাবা?”
ঘরসুদ্ধ লোক এই কথায় হো হো করে হেসে উঠল। তারপর বাবাই বললেন, “এদের না রাখলে, এই যে ঘরে যাদের দেখছ, তারা সবাই আমায় ছিঁড়ে খাবে... ”
কথাটা বলেই তিনি সবার থেকে জোরে হো হো করে হেসে উঠলেন। বাকি সবাই আবার তার সঙ্গে গলা মেলাল। নিমাই মাথা নীচু করে বসেছিল। তার চোখের সামনে যেন একটা প্রহসন চলছে। রাষ্ট্রীয় সার্টিফিকেট কাকে দেওয়া হবে না হবে ঠিক হচ্ছে নিতান্ত ঘরোয়া পরিবেশে, খেলাচ্ছলে। কাজের গুণ ও মান বিচার করা হচ্ছে না। আর সেটা নিয়েই হাসিঠাট্টা চলছে, কারও মধ্যে কোনো তাপ-অনুতাপ-প্রশ্ন-দ্বিধা নেই।
এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গোটা দেশটা এভাবেই চলছে।
অমলকান্তি বলল, “আমার চ্যানেলে খবরটা এবার প্রচার করে দিই।”
প্রথম ফোনটা নিমাই পেল ধ্রুপদীর কাছ থেকে। নিমাই তখন নিজের ঘরে বসে মন দিয়ে ফাইল গোছাচ্ছে। ধ্রুপদী প্রবলভাবে হাঁপাচ্ছিল। সে বলল, “এক্ষুনি টিভিটা চালাও। দ্যাখো, কী কাণ্ড হয়েছে... ”
নিমাই বুঝল গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে। তবু সে জানতে চাইল, “তোমার কাজ কেমন চলছে?”
“আমার এখানে কোনো কাজ নেই।” বলেই ফোনটা রেখে দিল ধ্রুপদী।
পুরো ব্যাপারটাই যেমন দুর্বোধ্য, তেমনই রহস্যময়। নিমাই তাড়াতাড়ি টিভি চালাল। একটু পরেই সে বুঝতে পারল কী ঘটেছে। প্রতিটি চ্যানেলে প্রবীণ অভিনেতাদের বাছাই নিয়ে ধুন্ধুমার চলছে। একদিকে বাবার প্রতি সবার সহানুভূতি ঝরে পড়ছে। অন্যদিকে নিমাইয়ের মুণ্ডপাত করতে কেউ বাকি রাখছে না।
একটি চ্যানেলে শুভাশিস আর অচ্যুৎ বসে আছে। তাদের প্রশ্ন করছে অমলকান্তি। সে জানতে চাইল, “যারা বাদ গেছেন, তাদের বাদ যাওয়াটা যেমন আশ্চর্যের, তেমনই মর্মান্তিক। এইসব মানুষ বাদ যান কী করে? এরা তো ইতিমধ্যেই ইতিহাসের পৃষ্ঠায় জায়গা করে নিয়েছেন!”
“দেখুন”, শুভাশিসের মুখে ধূর্ত হাসি ফুটে উঠল, সে বলল, “বাবার বয়স হয়েছে। তাঁকে এখন প্রতিটা ব্যাপারে কারও না কারও ওপর নির্ভর করতে হয়। এখন তারা যদি সঠিকভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন না করেন, নিজেদের কর্তব্যে অবহেলা করেন, দেশের ইতিহাস না জেনে বাছাই করতে শুরু করেন, তবে এরকম হতেই পারে!”
এবার অচ্যুৎ বলল, “গোটা দেশ জানে সারা জীবন সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যাপারে বাবা কতটা নিরপেক্ষ থেকেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর বিচক্ষণতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু সবাই তো বাবা নন। তিনি এখন অসুস্থ, হাসপাতালে ভরতি এবং বয়সের ভারে ক্লান্ত। যাদের ওপর তিনি নির্ভর করেন, তাদের মধ্যে কেউ যদি অবিবেচক হয়, তার মধ্যে যদি প্রকৃত শিক্ষার অভাব থাকে, সঠিক তথ্য না জেনেই বাবার উপস্থিতি ও নামের সুযোগ নিয়ে তিনি যদি নিজের অজ্ঞানতাকে হঠকারিতা ও ঔদ্ধত্যের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চান, তবে তার দায়িত্ব তো বাবা নিতে পারেন না!”
অমলকান্তি সব শুনে বলে উঠল, “আমি শুধু একটা কথাই বলব, কাজের সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে এবার থেকে বাবাকে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে, সার্টিফিকেট দেওয়ার মতো কাজ। তিনি প্রাজ্ঞ, মহৎ, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ, গোটা দেশ একথা জানে। তিনি যে এই ধরনের হঠকারিতা করতে পারেন না, সেকথাও সবার জানা। তিনি এখন অন্যের ওপরে নির্ভরশীল। কিন্তু সেই নির্ভরতা যেন তাঁর পক্ষে আশঙ্কাজনক না হয়ে ওঠে, সেটা আমাদের সবাইকেই দেখতে হবে... ”
ঠিক এই সময় আবার ধ্রুপদীর ফোন। সে জানতে চাইল, “কী বলছে ওরা এসব?”
“আমি জানি না।” নিমাইয়ের গলা ভেঙে গেল। “আমি সত্যিই জানি না কিছু। ওরা যা বলেছে, আমি তাই লিখেছি। এখন সুনামটা নিজেরা নিয়ে সমস্ত বদনামটা আমার ওপরই চাপানো হচ্ছে। এটা অন্যায়, খুবই অন্যায়। তুমি বাবাকে গিয়ে বলছ না কেন? দেরি করছ কেন? বাবা একটা বিবৃতি দিলেই তো... ”
“হ্যাঁ, যাচ্ছি। কিন্তু আমাকে যেতে হবে কেন? উনি কী আগেই বলতে পারতেন না, এই বাছাইয়ের জন্য কোনোভাবেই একা আমি দায়ী নই?” ধ্রুপদী চুপ করেই রইল।
নিমাই হাসপাতালে বাবার ঘরে ঢুকতেই আসন্ন ঝড়ের আভাস পেল। মহিলারা বাদে যারা ছিল, তারা সবাই আছে। কিন্তু সবার মুখই গম্ভীর। অপ্রসন্ন। শুধু বাবাই খুব মন দিয়ে মুখের ওপর একটা ডায়েরির পৃষ্ঠা খুলে কী একটা পড়ে যাচ্ছেন। তিনি একটা কোলবালিশে ঠেস দিয়ে আধ-শোয়া অবস্থায় আছেন। নিমাই বাবার বিছানার কাছে গিয়ে একটা টুলের ওপর বসে পড়ল। কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই অচ্যুৎ বলে উঠল, “এই যে আমাদের সর্বঘটে কাঁঠালিকলা এসে গেছে... ”
অচ্যুতের কথা বলার ধরনে নিমাই হঠাৎ চমকে উঠল। সে অবাক হয়ে অচ্যুতের মুখের দিকে তাকাল। অচ্যুৎ হাসতে হাসতেই বলল, “অবাক হয়ো না। বুড়ো অভিনেতার প্রতি তোমার আনুগত্যের কথা আমরা সবাই জানি। আবার বাবার প্রতিও কী অসীম আনুগত্য তোমার! সত্যি! একমাত্র তুমিই পারো দুটোই একসঙ্গে চালাতে! তুমি সর্বঘটে আছ। তুমি কাঁঠালিকলার মতো... ”
ঘরে একটা হাস্যরোল উঠল। নিমাই বাবার মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু তাঁর মুখ দেখা যাচ্ছে না। তিনি মন দিয়ে ডায়েরির পৃষ্ঠা পড়েই যাচ্ছেন।
নিমাইয়ের মনে পড়ল, গতকালই অচ্যুৎ তার কাছ থেকে ৫৭ নং ফাইল চেয়েছিল। ওই ফাইলটা চেয়ে আরও তেত্রিশজন প্রকাশক ফোন করেছিল। কিন্তু নিমাই ওটা অচ্যুৎকেই দেয়। খুব কাকুতিমিনতি করেছিল অচ্যুৎ। নিমাই আর না বলতে পারেনি। সে বাবার মত নিতে গেছিল। মৃদু আপত্তি জানিয়েছিলেন বাবা। নিমাই রাজি করিয়েছিল বাবাকে। ওই ফাইলে কিছু বিরল কাগজপত্র ছিল। সেইসব লেখা অচ্যুৎ তার এক বন্ধু প্রকাশককে দেয়। সে ওইগুলি নিয়ে একটি বই করবে।
আজই সেই অচ্যুতের গলার স্বর পালটে গেছে।
এবার শুভাশিস কথা বলে উঠল হঠাৎ। নিমাইয়ের দিকে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলল, “বাবাকে সব কথা জানিয়েছি আমি। হ্যাঁ, সব কথা।”
তার কথা বলার ধরনে নিমাই আবার চমকে উঠল। মনে পড়ল, গত পরশু শুভাশিসকে সে ১৬৯ নং ফাইলটি দিয়েছিল। ওই ফাইলে কিছু দুর্লভ ছবি ছিল। তিপান্ন জন সাংবাদিক ওই ছবিগুলো চেয়ে ফোন করেছিল নিমাইকে। কিন্তু শুভাশিসের স্বরের গাঢ় বেদনাকে সে উপেক্ষা করতে পারেনি। তীব্র অভিমান যেন ঝরে পড়েছিল শুভাশিসের গলায়। সে বলেছিল, “ওইসব সাংবাদিক কত বছর বাবাকে চেনে? কত বছর? আমি তিরিশ বছর ধরে বাবার সঙ্গে আছি। তিরিশ বছর। তাহলেই ভাবুন, আমার দাবি কী ওদের থেকে বেশি নয়?” শুভাশিসের যুক্তি মেনে নিয়েছিল নিমাই। বাবার কাছে সোজা গেছিল তাঁকে রাজি করাতে। এবারও মৃদু আপত্তি করেছিলেন বাবা। কিন্তু নিমাইয়ের কথাতেই শেষপর্যন্ত তিনি রাজি হয়ে যান। পরদিন অর্থাৎ গতকাল ছবিগুলি একটি দৈনিক কাগজে ছাপা হয়। এই দৈনিকের সম্পাদক শুভাশিসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ছবিগুলি নেওয়ার সময় শুভাশিস বলেছিল, সে অবশ্যই নিমাইয়ের কাছে ঋণস্বীকার করবে। কিন্তু ছবিগুলি ছাপলেও ঋণস্বীকারের কথা কোথাও ছিল না। শুভাশিস নিমাইয়ের নামটা বেমালুম চেপে গেছিল।
নিমাই অবশ্য তাতে কিছু মনে করেনি। কিন্তু শুভাশিসের গলা আজ এমন বেসুরো লাগছে কেন? শুভাশিস বলল, “গতকাল যে ছবিগুলো ছাপা হয়েছে, তার প্রতিটি ছবির জন্য আপনি টাকা চেয়েছেন। বাবাকে আমি একথা জানিয়েছি। কথাটা আপনি অস্বীকার করতে পারেন?”
গোটা ঘরে যেন বাজ পড়ল। সবচেয়ে বেশি চমকে উঠল নিমাই। তারপর দৃঢ় স্বরে বলল, “না। তবে... ”
ঘরের সবাই কৌতূহলী হয়ে নিমাইয়ের মুখের দিকে তাকাল। আস্তে আস্তে নিমাই বলল, “বাবাকে জানিয়েই আমি টাকাটা চেয়েছিলাম। হ্যাঁ, বাবা একথা জানতেন।” “বাবা জানতেন?” এবার শুভাশিসের অবাক হওয়ার পালা। বাবার দিকে আড়চোখে সে তাকাল। বাবা মন দিয়ে ডায়েরির পৃষ্ঠা পড়ে চলেছেন।
নিমাই বলল, “টাকা চাওয়ার আগে আমি বাবার অনুমতি নিয়েছিলাম। আমার মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আমি অর্থাভাবে ভুগছি। বাবা আমাকে বলেছিলেন, এই ছবিগুলি হারিয়ে গেছিল। এগুলো খুঁজে পাওয়ার সব কৃতিত্বই আমার। তখন আমি জানতে চেয়েছিলাম, এগুলো একটি দৈনিক চাইছে। শুভাশিসের পরিচিত। এর বিনিময়ে আমি কী কিছু টাকা চাইতে পারি? বাবা বলেছিলেন, নিশ্চয়ই। এগুলো তুমিই খুঁজে পেয়েছ। এগুলোর যদি কিছু অর্থমূল্য থাকে, তা তোমারই প্রাপ্য। সেকথাই আমি আপনাকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু পরে বাবা আমাকে ডেকে বললেন, দ্যাখো, আমার কাছে কাজ করছ বলে এমনিই তুমি তোমার যা প্রাপ্য, তা পাচ্ছ। তুমি যদি এভাবে টাকা চাও, সেটা ভালো দেখায় না। আমি তৎক্ষণাৎ বাবার কথা মেনে নিই। ছবিগুলোর বদলে একটি পয়সাও আমি নিইনি। একথা আপনি অস্বীকার করতে পারেন?”
শুভাশিস একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বাবার সামনে কথাবার্তা হচ্ছে। ফলে নিমাইকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কিন্তু তাকে প্যাঁচে ফেলার নতুন রাস্তা বার করতে দোষ কী? শুভাশিস তাই বলে উঠল, “আমার আরও অভিযোগ আছে। আপনি শুধু টাকাই চাননি। পাশাপাশি একথাও বলেছিলেন, আপনাদের দ্বীপে আমার যে অডিটোরিয়ামটি আছে, সেখানে আপনাকে অভিনয়ের সুযোগ করে দিলে তবেই আপনি ওই ছবিগুলো আমাকে দেবেন। তাই না?”
বাবা এবার ডায়েরির পৃষ্ঠা থেকে চোখ সরিয়ে কৌতূহলী হয়ে নিমাইয়ের দিকে তাকালেন। নিমাই সরাসরি শুভাশিসের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “সত্যকে আপনি বিকৃত করছেন। আমি নয়, ধ্রুপদী আপনার কাছে নিছক কৌতূহলে জানতে চেয়েছিল, আপনার অডিটোরিয়ামে আমার অভিনয়ের কোনো সুযোগ আছে কি না! হ্যাঁ, আবারও বলছি, নিছক কৌতূহলে। সে বলেছিল, আপনারা তো তরুণ প্রতিভা হিসেবে অনেককেই সুযোগ দেন। আমার তেমন কোনো সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কী না! তাও সার্টিফিকেট পাওয়ার পর। সে আমার সার্টিফিকেটের ওপর জোর দিয়েছিল। কোনো বিনিময়ের প্রশ্ন এখানে আসেই না। তাও এরকম একটা নোংরা ব্যাপার! আর অত্যন্ত স্পর্ধারও! বাবার দুর্লভ ছবি একটা ঐতিহাসিক সম্পদ। সেখানে আমার অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া তো অতি তুচ্ছ একটা ব্যাপার। এদের মধ্যে কোনো বিনিময় চলতে পারে কী? আপনি কী ভাবেন, এইটুকু মাত্ৰাজ্ঞানও কি আমার বা ধ্রুপদীর নেই? মনে আছে, আপনি জবাবে বলেছিলেন, কে তরুণ প্রতিভা আর কে নয়, সেটা একমাত্র বাবাই ঠিক করতে পারেন। বাবার পরামর্শ নিয়েই আপনি যা করার করবেন। ধ্রুপদী আর কথা বাড়ায়নি। আমি নিঃশব্দে আপনার হাতে ফাইলটি তুলে দিয়েছিলাম। আপনি খুশি হয়ে বলেছিলেন, আমাদের দুজনকে একটা দামি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে খাওয়াবেন। পাহাড়ের মাথায় আপনার যে সুদৃশ্য রিসর্ট আছে, বিনা পয়সায় সেখানে আমাদের দুজনকে ঘুরে আসার সুযোগ করে দেবেন। ধ্রুপদী একটা হাঁচি মারলে আপনি ওকে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালের সবচেয়ে বিলাসবহুল ঘরে কিছুক্ষণের জন্য ভরতি করে এসেছিলেন। এগুলো সব ভুলে গেছেন? আপনি এখন এসব বানিয়ে বানিয়ে বলছেন কেন?”
বাবা আবার ডায়েরির পৃষ্ঠায় মন দিয়েছেন। শুভাশিসের মুখটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। খুব নিষ্ঠুর দেখাচ্ছিল সেই মুখ। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই অমলকান্তি বলে উঠল, “যথেষ্ট হয়েছে। এবার আমার কথা বলি তবে... ”
নিমাইয়ের মনে পড়ল, গত পরশু অমলকান্তি তার কেবিনে এসেছিল। নাবিকটির কাছ থেকে খবর পেয়ে। একটু আগেই দুশো তেইশ নম্বর ফাইল থেকে একটা সিডি পেয়েছিল সে। শেক্সপিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকে ব্রুটাসের ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন বাবা। তারই দুর্লভ সিডি। নাবিকটির কাছ থেকে খবর পেয়ে মোট সাতাশি জন টিভি চ্যানেলের মালিক ওই সিডি চেয়ে ফোন করেছিলেন। নিমাই কিন্তু ওটা অমলকান্তিকেই দেয়। বাবাকেও রাজি করায়। অমলকান্তি করুণ মিনতি করে বলেছিল, “সিডিটা আমাকেই দিন নিমাই। বাজার খুব খারাপ যাচ্ছে। একটা চমক দরকার। নইলে অন্য সব ছেড়ে আমাদের চ্যানেল লোকে দেখবে কেন?” বাবা কিন্তু প্রথমে রাজি হননি। কিন্তু শেষপর্যন্ত কেন কে জানে, রাজি হয়ে যান। পরশু রাতেই অমলকান্তির চ্যানেলে বাবার এই দুর্লভ অভিনয় দেখানো হয়। গতকাল অমলকান্তির কোম্পানি এই সিডিটিকে একটি লোভনীয় প্রোডাক্ট হিসাবে প্রচুর বিজ্ঞাপন করে বাজারে ছাড়ে। কিন্তু কোথাও নিমাইয়ের প্রতি ঋণস্বীকার করা হয়নি। নিমাইয়ের নামও কেউ উল্লেখ করেনি। নিমাই শুনেছে, প্রথমদিনই পঞ্চাশ হাজার সিডি বিক্রি হয়ে গেছে। রয়ালটির চেকও বাবার কাছে পৌঁছে গেছে। নিমাইকে কেউ এক পয়সাও ঠেকায়নি।
অমলকান্তি বলছিল, “ফাঁকিবাজ, একমাত্র ফাঁকিবাজ ছাড়া আপনাকে কিছুই বলা যায় না! বাবার কাছ থেকে যথেষ্ট অর্থ পান আপনি। বাবার অসম্ভব উদারতা ছাড়া এটা হতো না। কিন্তু তার বদলে তাকে কী দিয়েছেন আপনি? ওই অর্থ পেলে এদেশের বেশিরভাগ ছেলে চবিবশ ঘণ্টাই বাবার কাজে নিজেকে উজাড় করে দিত। ঘুমের মধ্যেও বাবার কাজের কথাই চিন্তা করত। আপনি ক-ঘন্টা দেন? কতক্ষণ কাজ করেন বাবার? কিন্তু এত পেয়েও আপনি সন্তুষ্ট নন। সবসময় বিষণ্ণ। মুখ গোমড়া করে আছেন। আপনার মুখ দেখলে বাবার সম্পর্কে ভুল ধারণা হতে পারে লোকের। অথচ সে ব্যাপারে কোনো বোধই নেই আপনার। আপনার কাজে বাবা একটুও সন্তুষ্ট নন। একথা মুখ ফুটে বলার মানুষ উনি নন। উনি আপনাকে স্নেহ করেন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি। এভাবে ওঁর স্নেহ আর উদারতার সুযোগ আপনি নিতে পারেন না। কাজ না করে প্রতিদিন হাত পেতে টাকা নিতে পারেন না। আমাদের চোখের সামনে এসব ঘটছে। আমরা এসব হতে দিতে পারি না। আপনার ফাঁকি সবার চোখে পড়ছে। অথচ এ ব্যাপারে কোনো হুঁশই নেই আপনার! নিজেকে কী ভাবেন আপনি? যা খুশি তাই করবেন, আর কেউ আপনাকে কিছু বলবে না? আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি আমি। বাবার কাজ নিয়ে কিন্তু কোনো ছেলেখেলা নয়... ”
নিমাই মনে মনে ভাবল, এসব অভিযোগ করার অধিকার কে দিয়েছে অমলকান্তিকে? তার কাজ নিয়ে বলার অমলকান্তি কে? সে কতটা খোঁজ রাখে তার কাজের? অথবা খোঁজ রাখে বলেই হয়তো ঠিক উলটো কথাটা বলছে। বুড়ো অভিনেতা একবার বলেছিলেন, “সফল লোকেরা কী বলে জান? যেটা ঠিক মনে করবে ঠিক তার উলটোটা বলবে। তবেই টিকে থাকতে পারবে।” বাবার প্রশ্রয় ছাড়া এই স্পর্ধা দেখানো অমলকান্তির পক্ষে কখনোই সম্ভব হত না। কিন্তু তার চেয়েও গুরুতর একটা বিষয় ভাবাচ্ছিল তাকে।
এখানে আসার পর থেকে শুধু অপমান আর হেনস্থাই জুটেছে নিমাইয়ের। কিছু তোষামুদিও জুটেছে বটে। কিন্তু সে ওর দরকার ছিল বলে। বাবার ষাট বছরের কর্মজীবনে যে কাজ হয়নি, সে কাজ ও গুছিয়ে তুলবে বলে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাবে বলে। যা হোক, এইটুকু ভরসা ওর ছিল, নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত সম্মান না পাক, কেউ অন্তত ওকে ফাঁকিবাজ বলবে না! ফাইল গোছানোর কাজ পেয়েছে সে। আর কী নিষ্ঠাতেই না সেই কাজ করে গেছে। নিজের সমস্ত মনোযোগ, শ্রম আর ভালোবাসা এই কাজেই ঢেলে দিয়েছে। মাত্র চারদিনে দুশো তিরাশিটি ফাইল গুছিয়ে ফেলেছে। লোকের সপ্রশংস দৃষ্টি আর টুকরো মন্তব্যও পেয়েছে। আর এই মুহূর্তে তার কাছ থেকে সেই শেষ অবলম্বনটাকেও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে! আর সেটাও হচ্ছে এরকম নিষ্ঠুরভাবে!
মাথা নীচু করে বসেছিল নিমাই। তার মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে। কী বলবে সে? কাদের বলবে? এরা কী মানুষ? এদের কারও হৃদয় বা বিবেক বলে কিছু আছে? তার মনের ভেতরে জন্ম নিয়েছে গভীর অনিশ্চয়তাবোধ। এই অনিশ্চয়তাবোধ নিয়ে জীবনে সে কোথায় পৌঁছোবে? এই দেশ তার কাছে একটা অন্ধ গলির চেয়ে বেশি কিছুই মনে হচ্ছে না!
এবার নাবিকটি কথা বলে উঠল। নিমাইয়ের দিকে তর্জনী তুলে সে বলে উঠল, “আমি ভাবতেই পারিনি, উনি এরকম একটা লোক... ”
অচ্যুৎ বলে উঠল, “এরকম একটা লোক... ”
নাবিকটি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “উনি চোর। উনি চুরি করেছেন... ”
ঘরে আবার যেন বাজ পড়ল। নাবিকটি বলল, “উনি যে ঘরে আছেন, সেখানে বুক সেলফে আগে মোট উনসত্তরটা বই ছিল। এখন সেখানে মাত্র ছিয়াত্তরটা বই আছে। আজ সকালে গুনতে গিয়েই আমি তাজ্জব হয়ে গেছি। বাকি বইগুলো কোথায় গেল? উনি, এই নিমাই-ই, বইগুলি চুরি করেছেন, কোথাও সরিয়ে রেখেছেন... ”
কিন্তু, অচ্যুৎ একটু দ্বিধা করেই বলল, “বইয়ের সংখ্যা তো বেড়ে গেছে দেখছি। চুরি করলে তো কমে যেত... ”
নাবিকটি বিরক্ত হয়ে বলল, “বেড়ে যাওয়ারই কথা। রোজ নতুন বই আসছে। আমি হিসেব করে দেখেছি, আশিটি বই থাকা উচিত!”
“ও তুমি ছেড়ে দাও!” এবার শুভাশিস কথা বলে উঠল, “বই চুরি এমন কী ব্যাপার? এ তো টাকাপয়সা, সোনাদানা, গয়নাগাটি নয়... ”
এবার নিমাই বলে উঠল, “ওসবের চেয়ে বই আমার চেয়ে অনেক বেশি বড়ো ও পবিত্র ব্যাপার। বই আমার ধর্ম। তা ছাড়া যাই চুরি যাক, চুরি মানে চুরি-ই। এটা কোনো ঘটনা নয়। আমার স্বভাব, আমার প্রকৃতি, আমার চরিত্র, এটা নিয়েই কথা! ঠিক আছে, আপনি প্রমাণ করতে পারবেন?”
হো হো করে হেসে উঠল অমলকান্তি। তারপর বলল, “প্রমাণের কী দরকার? অভিযোগ উঠেছে, এটাই কি যথেষ্ট নয়?”
“হ্যাঁ, যথেষ্ট।” নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। তারপর যোগ করল, “একজনকে শেষ করে দেওয়ার পক্ষে আর কী লাগে?”
তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে সে ভাঙা গলায় জানতে চাইল, “আপনি চুপ করে আছেন কেন বাবা? এত এত অভিযোগ! এসবই তাহলে আপনি সমর্থন করেন?”
বাবা মুখের সামনে থেকে ডায়েরিটি সরালেন। তারপর মৃদু হেসে শান্তস্বরে বললেন, “না, না, আমার কোনো অভিযোগ নেই!”
—ওরা তো আপনার সামনেই বলছে...
“তাই নাকি? আমি তো কিছুই শুনিনি। আর ওরা তো... ” একটু থেমে বাবা বললেন, “আমার সঙ্গে কোনো আলোচনাও করেনি!”
নিমাইয়ের কাছে সবই দুর্বোধ্য ঠেকছিল। তবু সে বলল, “ওরা মিথ্যে কথা বলছে বাবা।”
বাবা এবার উঠে বসলেন। তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন, “ওরা? নাঃ, ওরা তো কেউ মিথ্যে কথা বলে না, কেউই না... ”
নিমাই আবার গভীর সংকটে পড়ে গেল। তারপর দৃঢ় স্বরে বলল, “আপনি প্রতিবাদ করুন, প্লিজ... ”
হঠাৎ অচ্যুৎ বলে উঠল, “আরে! ভুলেই গেছি, বাবার প্রিয় গাছটার টবে জল দেওয়ার সময় হয়ে গেছে... ”
নাবিকটি বলল, “বাবার কুকুরটাকে খেতে দেওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে... ”
শুভাশিস বলল, “আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, একটু জিরিয়ে নিই এবার...”
অমলকান্তি বলল, “আমার খুব খিদে পেয়েছে। হ্যাঁ, গলাটাও শুকিয়ে গেছে দেখছি... ”
ওরা চারজনই দ্রুত ঘর থেকে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে কেমন একটা আপশোসের স্বরে বাবা বললেন, “প্রতিবাদ! হ্যাঁ, সে তো করাই উচিত। একসময় সেসব অনেক করেছিও বটে! তবে ওদের ভালোমতো ধমকে দেওয়া উচিত ছিল। ঠিক তাই। ধমকানিটাই দরকার ছিল। কিন্তু এখন ওদের কোথায় পাব? সবাই যে চলে গেল! আচ্ছা, সে হবে খন। কিছু মনে কোরো না তুমি। আমি দেখছি ব্যাপারটা... ”
বাবা আবার ডায়েরির পৃষ্ঠায় মন দিলেন।
ধ্রুপদী দৌড়োচ্ছিল। হাতে আর মাত্র দশ মিনিট। দূরের দ্বীপটাকে এখন দেখা যাচ্ছে। ওর হাতে খামে ভরা মৌসুমীর একটা চিঠি। সেটাই পৌঁছে দিতে হবে ওকে।
তার কানে ভাসছিল বাবার খুব শান্তস্বরে বলা সেই কথাগুলো, “ওরা যা বলবে, চুপচাপ করে দেবে। কোনো প্রশ্ন করবে না। কোনো প্রতিবাদ করবে না। ওদের সুবিধামতো তোমাকে কাজ করে দিতে হবে। নিজের সুবিধা দেখলে হবে না! যতই হোক, এ তোমার চাকরির ব্যাপার...”
বাবাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন করেছিল ধ্রুপদী। তখনই এসব কথা শুনে খুব আশ্বস্ত বোধ করেছিল সে।
সবার ছুটি হয়ে গেছিল। ওরও ছুটি হওয়ার কথা ছিল। ঠিক তখনই ওরা কাজটা করতে বলল। আর খুব কম সময়ে। ধ্রুপদী দৌড়তে শুরু করেছিল। কাজটা হারাতে চায় না সে। আর শেষ পর্যন্ত সে অসাধ্য সাধন করেছিল।
ধ্রুপদী ভেবেছিল, অফিসে ঢুকে কমলিকার কাছ থেকে অভ্যর্থনা পাবে সে। অন্তত দু-একটা উৎসাহজনক বা প্রশংসাসূচক শব্দ। কমলিকা তখনও ছিল। সে অফিসেই থাকে। অন্য কোনো জীবন তার নেই। কিন্তু কমলিকার মুখটা খুব গম্ভীর দেখাচ্ছিল।
একটা টুলের ওপর ধপ্ করে বসে পড়ল ধ্রুপদী। সে তখনও রীতিমতো হাঁপাচ্ছিল। ওর দিকে তাকিয়ে কমলিকা বলে উঠল, “তোমার একটা চিঠি আছে।”
—চিঠি? কে পাঠিয়েছে?
—মৌসুমীদি। একটু আগে ওঁর খাস বেয়ারাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
তাড়াতাড়ি চিঠিটা খুলে পড়ল ধ্রুপদী। একটি মাত্র লাইন। “বিশেষ কারণে তোমাকে এক্ষুনি চাকরিতে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।” অর্থাৎ, ছাঁটাই।
ধ্রুপদী তার সার্টিফিকেট পেয়ে গেল।
তার চোখমুখ ভয়ানক হয়ে উঠেছিল। তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়তে চাইছিল সে। কিন্তু তার বদলে দু-চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে শুরু করেছিল। সে কমলিকার দিকে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিল, কেন?
কমলিকা নাক ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, “আমি কিছুই জানি না ভাই।”
কিন্তু কোনো কারণ তো থাকবে! কোনো যুক্তি! অজুহাত! অভিযোগ! সমস্যা! এদেশে যে মানুষ কাজ দেখায়, তার সঙ্গে কি এরকমই করা হয়? এই অবিচার?
কমলিকার সেই এক কথা। কিছুই জানে না সে। মুখে তার কুলুপ। ধ্রুপদী ছুটতে ছুটতে গেল মৌসুমীর ঘরের সামনে। সেখানে তাকে বাধা দিল মস্ত গোঁফওয়ালা এক রক্ষী। গম্ভীর গলায় ঝাঁঝিয়ে জানতে চাইল, “কী চাই?”
—আমি ম্যাডামের সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।
—উনি তো নেই।
—কখন ফিরবেন?
—কিছু বলে যাননি।
—আজ ফিরবেন কি?
—না। আজ আর ফিরবেন না।
ধ্রুপদী মনমরা হয়ে বেরিয়ে এল। সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটছিল সে। নিমাইকে এখন খুব দরকার তার। সে নিমাইকেই ফোন করল। সব কথা খুলে বলল। এক ঘণ্টার ভেতরেই নিমাইয়ের কাছে পৌঁছে যাবে সে। নিমাই ছুটতে ছুটতে এল বাবার ঘরে। কিন্তু ঘরে ঢোকার মুখেই থমকে দাঁড়াল। চমকে উঠল। বাবা একটা সোফায় বসে আছেন। আর তার কোলে বসে আছেন এক মহিলা। দুজনে পরস্পরকে তীব্র আবেগে চুম্বন করছেন। মহিলাটি বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আছে। বাবা নিমাইকে দেখে মুখ সরিয়ে বলে উঠলেন, “মৌসুমী, দেখি এই ছোকরা আবার কী চায়!”
“ছোকরা? কোন্ ছোকরা?” মৌসুমী চমকে উঠে বাবার কোল থেকে নেমে পাশের সোফায় গিয়ে বসল।
“নিমাই।” বাবা বললেন।
মৌসুমীর মুখটা হঠাৎ পাথরের মতো হয়ে গেল। সে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর যেন একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়েছে, এমনভাবে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিমাইয়ের দিকে একবারও ফিরেও তাকাল না। কোনও দুঃখ প্রকাশের প্রশ্নই নেই। কেমন একটা একরোখা ভাবই ফুটে উঠল চোখেমুখে।
নিমাই বুঝতে পারল, এই সেই মৌসুমী! খবরের কাগজের হেডলাইন। মনে পড়ল তার।
বাবা বললেন, “এসো, এসো নিমাই। তা, ধ্রুপদীর খবর পেয়েছ তো?”
“পেয়েছি।” সংক্ষিপ্ত জবাব দিল নিমাই। তারপর উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে।
বাবা যেন সাফাই গাইছেন, এমনভাবে বললেন, “আসলে ধ্রুপদীর কোনো দোষই ছিল না... ”
নিমাই চুপ করে রইল। বাবা বলে চললেন, “ও ভালোই কাজ করছিল। কিন্তু মৌসুমীই বা কী করবে বলো... ”
নিমাই বলল, “যে কোনো দোষ করেনি, ভালো কাজ করেছে, তার তো চাকরিতে বহাল থাকারই কথা বাবা... ”
“ঠিকই বলেছ।” বাবা বললেন। তিনি মিটিমিটি হাসছিলেন। তাঁর সামনে একটা টেবিলে কয়েকটা মোমো রাখা ছিল। কাঁটা চামচ দিয়ে একটা মোমো তুলে মুখের ভেতর দিয়ে গভীর তৃপ্তিতে চিবোতে চিবোতে তিনি বললেন, “ওদের অফিসে নতুন কোনো লোককে চাকরি দেবে, এমন অবস্থা নেই। পুরো ভরে আছে। কোথায় কাজ করবে ধ্রুপদী। ওকে বসিয়ে রাখাও যাবে না। আবার বসিয়ে রেখে পয়সা দেওয়াও যাবে না। দুটোই অসম্ভব... ”
—সেকথা প্রথমে বললেই হত। ও কত আশা করেছিল...
নিমাইয়ের চোখে জল আসছিল। সেদিকে তাকিয়ে কৌতুক ও শ্লেষ মেশানো হাসিটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে বাবা বললেন, “মৌসুমী প্রথমটায় ঠিক বোঝেনি। ভেবেছিল, পেরে যাবে। জায়গা দিতে পারবে ধ্রুপদীকে। কিন্তু পরে দেখেছে, পারবে না। ওর কিছুই করার নেই।”
পরে নিমাই নিজের নোটবুকে সবুজ কালিতে লিখেছিল, “আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কথা চালিয়ে লাভ নেই। একটা নিষ্ঠুর ঠাট্টা করা হয়েছে ধ্রুপদীর সঙ্গে। প্রথম থেকেই সব ঠিক ছিল। ধ্রুপদীকে চাকরি দেওয়া হবে। তারপর কেড়ে নেওয়া হবে। কোনো কারণ ছাড়াই। এটা করা হবে, ওর মনে একটা আঘাত দেওয়ার জন্য। ওকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য। চাকরি, নিরাপত্তা, স্বস্তি, স্থায়িত্ব—ঠিক যখন এইসবে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে ওর মন, তখনই ওকে গভীর খাদে ঠেলে দেওয়া হবে। চরম অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেওয়া হবে ওর জীবন। আর এইভাবে দেখা হবে, ওর প্রতিবাদের দৌড় কতখানি!’’
ধ্রুপদী নিমাইয়ের কাছে এসে পৌঁছেছিল আড়াই ঘণ্টা পরে।