এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  শনিবারবেলা

  • সার্টিফিকেট (৫)

    রাহুল দাশগুপ্ত
    ধারাবাহিক | ২১ নভেম্বর ২০২০ | ১৪৯৭ বার পঠিত
  • তৃতীয় দিন

    Evil and perverse men elevated to high places and supreme offices and rewarded, and good men exiled, cast down, and humbled. There are innumerable clear instances of ingratitude to the good and criminal leniency to the bad.
    Giovanni Boccaccio

    হৃদয়পুর দ্বীপে একটা চমৎকার রেস্তোরাঁ আছে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে সেখানেই এসেছে নিমাই। রেস্তোরাঁটি তিনদিকে খোলা, সেখানে অকূল, নীল সমুদ্র ছড়িয়ে আছে, মাথার ওপর কাচের মতোই স্বচ্ছ আকাশ। নিমাইয়ের ডানদিকে যে লোকটি বসে আছে সে বেঁটে, কালো, মোটা একটা গোঁফ আছে আর গলার স্বরটা খ্যানখ্যানে। আর বাঁ-দিকে যে লোকটি বসে আছে, তার রীতিমতো দশাসই চেহারা, গাত্রবর্ণ কালো, মোটা গোঁফ, কোঁকড়া চুল, গমগমে গলায় বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে সে। প্রথম লোকটির নাম, শুভাশিস সাউ। আর দ্বিতীয় লোকটির নাম, অমলকান্তি দাস।

    গতকাল গভীর রাতে এরা এসেছে। আজ সকালে ঘুম ভাঙার পরই নাবিকটিকে তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়তে দেখেছিল নিমাই। নাবিকটি জানিয়েছিল, বাবার অনুমতি নিয়েই দুজন ব্যক্তি তার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

    শুভাশিস বলছিল, “তাহলে বুঝতেই পারছেন, কী জীবন আমার! প্রথমে আমি ছিলাম বাসের কনডাকটর। তারপর হলাম ড্রাইভার। শেষে মালিক। এখন আমার তিনশোটি বাস সর্বশক্তিমানের দ্বীপগুলোয় নানা রুটে চলাচল করে। এই দ্বীপগুলোর যেখানে যত অডিটোরিয়াম আছে, সবগুলোর মালিক আমি। গত চার বছরে আমি মোট উনিশটি নতুন অডিটোরিয়াম তৈরি করেছি। তার মধ্যে একটি আবার আপনাদের দ্বীপে। আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন সেটা...”
    নিমাই মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল, সে দেখেছে। কতদিন ওই অডিটোরিয়ামের পাশ দিয়ে গেছে সে। টিকিটের খুব দাম। একমাত্র পয়সাওয়ালা লোকেরাই সেখানে ঢুকতে পারে! সে কোনোদিনই ঢুকতে পারেনি। অত দাম দিয়ে টিকিট কেনার ক্ষমতা তার ছিল না। অথচ রোজই ভাবত, একবার যদি ঢুকতে পারে...
    শুভাশিস বলে চলে, “হৃদয়পুর দ্বীপের সবচেয়ে বড়ো অডিটোরিয়ামটি আমারই করা। আজ সন্ধ্যাবেলায় একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি সেখানে। সর্বশক্তিমানকে অনুরোধ করেছি, বহুদিন পর তিনিও একক অভিনয় করতে রাজি হয়েছেন। বুঝতেই পারছেন, এ আমার জীবনে কতো বড়ো সৌভাগ্য! আমার সবকিছু তো তাঁরই জন্য! উনি আমার বাবার মতো। আর আমি ওঁর সন্তানতুল্য!” হঠাৎ থেমে গিয়ে মুখের সামনে হাতজোড় করে কপালে ঠেকাল শুভাশিস। চোখ বন্ধ হয়ে গেল তার। তারপর জানতে চাইল, “ঠিক বলেছি কি না?” “কোন্‌টা?” নিমাই অবাক হয়ে জানতে চাইল।
    “ওই যে, বাবা... ”
    আবার চোখ বুজে এল তার। নিমাইয়ের জবাবের অপেক্ষা না করেই কয়েক সেকেন্ড পর আবার শুরু করল সে, “দেশ-বিদেশ থেকে নানা গুণীজনকে ইতিমধ্যেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দুপুরের মধ্যেই তাঁরা সব এসে যাবেন। আপনাকে শুধু ফাইল খুঁজে স্ক্রিপ্টটা বার করে দিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কোন্‌ ফাইলে আছে ওটা?”
    বাবার মুখটা এক মুহূর্তে ভেসে উঠল নিমাইয়ের চোখে। কত ভরসা করেন তিনি ওর ওপর! এত বড়ো একটা ব্যাপার। উনি ওর ওপরেই পুরোটা ছেড়ে দিতে চান। ধ্রুপদী যাই বলুক, বাবার এই ভরসা করাটা ওর ভালোই লাগে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তখন। মানুষের কাছ থেকে তাচ্ছিল্যই সে পেয়েছে বেশি। এই গুরুত্ব তার ভালোলাগে। ধ্রুপদীকে একবার বলেওছিল কথাটা। ধ্রুপদী উড়িয়ে দিয়ে জবাব দিয়েছিল, এরকম গুরুত্ব পাওয়ার চেয়ে না পাওয়া ভালো। “এতে তোমার কৃতিত্ব কোথায়? তোমার বশ্যতা আর আনুগত্য ছাড়া এতে আর কিছুই নেই। অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে তোমার। ফাইল গুছানোয় কোনো প্রতিভা লাগে না। লোকে তোমাকে নয়, গুরুত্ব দেয় আসলে বাবাকে। তোমার নিষ্ঠা আর শ্রমকে স্রেফ ব্যবহার করা হচ্ছে, আর কিছুই না। প্রতারিত হয়ো না, আত্ম-প্রতারণা করো না... ” “বুড়ো অভিনেতার মতো কথা বলছো তুমি... ” নিমাই বলেছিল।
    চোখ বুজে একটু ভাবল নিমাই। তারপর বলল, “৭৯ নং ফাইল। ওই একবারই একক অভিনয় করেছিলেন বাবা।”
    শুভাশিস গদগদ কণ্ঠে বলল, “আপনি হয়তো জানেন না, বাবার দ্বীপগুলোয় যত বড়ো বড়ো রেস্তোরাঁ আছে, সবগুলিরই মালিক আমি। বাবাকে এই সব ক-টি রেস্তোরাঁতেই নিয়ে গেছি। সাধ্যমতো ভালো-মন্দ খাইয়েছি। এবার আপনাকেও নিয়ে যাব। খাওয়াব। ভালোলাগবে আপনার। এই আমি মা কালীর দিব্যি দিয়ে বলছি, ভালো আপনার লাগবেই। না, না, অন্য কিছু হতেই পারে না। কথা দিতে হবে আমায়। দেবেন তো? যাবেন তো আমার সঙ্গে?”
    এবার গলাখাঁকারি দিয়ে উঠল অমলকান্তি। মানে কিছু বলতে চায়। নিমাই তার দিকে তাকাতেই সে শুরু করল, “দেখুন, বাবাকে নিয়ে অনেকদিন ধরেই আমি নানারকম কাজ করে চলেছি... ”
    নিমাই একটু ইতস্তত করেই বলল, “বাবা?”
    —তা নয়তো কী! উনি তো আমার বাবার মতোই...
    —আর আপনি ওঁর সন্তানতুল্য?
    “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।” খুবই খুশি এবার অমলকান্তি। তারপর বলে ওঠে, “তুল্য-টুল্য আর বলবেন না, আমি ওঁর সন্তানই!”
    নিমাই চুপ করেই রইল। গত দু-দিন ধরে যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে, তারা সবাই সর্বশক্তিমানকে নিজের বাবা বলেই ভাবে। উনি সেভাবেই সবাইকে ভাবান। এত মানুষের বাবা হওয়া সহজ কথা নয়! নিমাইও ইতিমধ্যেই ভাবতে শুরু করে দিয়েছে, উনিই তার বাবা।
    অমলকান্তি বলে চলল, “এ দেশের মানুষ নানাভাবে বাবাকে দেখতে চেয়েছে। এ নিয়ে অজস্র সাক্ষাৎকারও নেওয়া হয়েছে। কেউ তাঁকে দেখেছে প্রবল ক্ষমতাবান এক রাজনীতিবিদ হিসেবে, কেউ তাঁকে দেখেছে অসীম অর্থবান এক ব্যবসায়ী হিসেবে, কেউ বা তাকে উদার, মানবদরদী, পরম উপকারী, দেশ ও সমাজের হিতকারী এক চিন্তাবিদ হিসেবেই দেখতে চেয়েছে। তাঁকে নিয়ে কত কাহিনি, কত কিংবদন্তি, কত আলোচনা, কত কল্পনা! কিন্তু...”
    একটু থামল অমলকান্তি। তারপর আবার শুরু করল, “বাবা যে এত বড়ো অভিনেতা, তা নিয়ে কারও মধ্যে যেন কোনো হেলদোলই নেই। অথচ বারবার নানা সাক্ষাৎকারে বাবা কি বলেননি, অভিনয়ই তাঁর জীবনের প্রথম প্রেম? তার আরও বহু পরিচয় থাকতে পারে, কিন্তু সবার আগে তিনি একজন অভিনেতা, আর এই পরিচয়েই তিনি মানুষের মনে থেকে যেতে চান?”
    নিমাই সায় দিল।
    —অভিনয় ও বাবার সম্পর্ক নিয়েই আমি আসলে একটা সাক্ষাৎকার নিতে চাই। দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। আমি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক। সেখানে কয়েকটি এপিসোডে এই সাক্ষাৎকারটি দেখানো হবে। কিন্তু বাবা বললেন...
    নিমাইয়ের কৌতূহল বেড়েই চলেছে। সে বলল, “কী, কী বললেন?”
    —সাক্ষাৎকারটি তিনি আজ দুপুরে দেবেন। সন্ধ্যায় বাবার একক অভিনয়ের পর সেই সাক্ষাৎকারটি দেখানো হবে আজকে উপস্থিত দর্শকদের। একইসঙ্গে দেখানো চলবে টেলিভিশনেও। কিন্তু সেখানে কিছু দুর্লভ ছবি ব্যবহার করতে হবে। বাবার অভিনয় জীবনের কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত। আর সেই ছবিগুলো জোগাড় করে দিতে পারেন একমাত্র আপনিই। ক্যাপশনগুলোও আপনিই করে দেবেন। এগুলো কোন্‌ ফাইলে আছে বলতে পারেন?
    সত্যি, কতভাবেই না ওকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলছেন বাবা! একটি বিশাল বটবৃক্ষের গায়ে লেগে থাকা একটি ছোট্টো পোকাকে তিনি যেন কাউকে না দেখিয়ে ছাড়বেন না! কেন তিনি ওকে এতো স্নেহ করেন? একটু ভেবে নিমাই বলল, “২১৭ নং ফাইল। আমি দেখছি।”
    ইতিমধ্যে ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বার করে পটাপট নিমাইয়ের কয়েকটা ছবি তুলে নিল শুভাশিস। নিমাই অবাক হয়ে তাকাতেই সে হেসে ফেলল। তারপর বলল, “এটা আমার শখ। রোজ আমি কয়েকশো ছবি তুলি। আর ছবি তোলার জন্য সবসময়ই আমার হাত নিশপিশ করতে থাকে।”
    নিমাই একটু বিরক্ত হয়েই জানতে চাইল, “তা আমার কেন?”
    শুভাশিস বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, “বলেন কী! আপনার মতো একজন ফাইল-সংগ্রাহক! ক-টা ফাইল আছে আপনার জিম্মায়?”
    হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, “উনি কিন্তু শুধু ফাইলই জমান না। ওঁর আরও একটা পরিচয় আছে।”
    নিমাই তাকিয়ে দেখল, ধ্রুপদী। কপালে ভাঁজ পড়ল তার। অমলকান্তি কৌতূহলী হয়ে বলে উঠল, “তাই নাকি? সেটা কী?”
    ধ্রুপদী বলল, “উনি একজন চমৎকার অভিনেতা। এখানে উনি সার্টিফিকেট নিতে এসেছেন।”
    “বাঃ!” শুভাশিস বলে উঠল, “ওঁর এই পরিচয়টা তো জানা ছিল না!”
    “কী করে জানবেন? কেউ দিলে তো?” ধ্রুপদী ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠল। তারপর যোগ করল, “শুনলাম, বাবার একক অভিনয়ের আগে আপনারা কয়েকজন তরুণকেও সুযোগ দেবেন। তা ওকে দেবেন না?”
    কপালে ভাঁজ পড়ে শুভাশিসের। বাবার অনুমতি না নিয়েই দুম করে এরকম একটা প্রস্তাব ধ্রুপদী দেওয়ায়, একটু যেন স্তম্ভিতই। তারপর বলল, “বাবার সঙ্গে কথা বলি আগে, দেখি উনি কী বলেন... ”
    এবার কথা বলে ওঠে অমলকান্তি, “আপনি চাইলে আমার চ্যানেলে অভিনয় করতে পারেন। তবে যাই করুন, তার সঙ্গে বাবার সম্পর্ক থাকতে হবেই... ”
    “কেন?” ধ্রুপদী ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “উনি ওঁর মতো করে অভিনয় করবেন, সেখানে বাবা আসবেন কেন? ওঁর নিজের অনুভূতি আর অভিজ্ঞতাই সেখানে একমাত্র বিবেচ্য হবে, তাই না?”
    “না, বাবাকে রাখতেই হবে।” অমলকান্তির গলাটা একটু নাছোড়বান্দা শোনায়। তারপর যোগ করে, “অবশ্য সবার আগে বাবার অনুমতি নিতে হবে। উনি যা বলবেন... ”
    “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই করুন না। মানে, বাবাকে নিয়েই। সেটাই তো ভালো।” শুভাশিসও সায় দেয়। তারপর অমলকান্তির দিকে তাকায়। দুজনের মধ্যে ইশারা-বিনিময় হয়।
    “আমাদের চ্যানেলে,” অমলকান্তি বলল, “বাবার এই ইন্টারভিউটা নিয়ে ইতিমধ্যেই সাড়া পড়ে গেছে... ”
    শুভাশিস বলল, “গত কয়েক বছরে আমার কোনো অডিটোরিয়াম এত তাড়াতাড়ি হাউস-ফুল হয়নি... ”
    ধ্রুপদী নিমাইয়ের কানের কাছে ঠোঁট এনে বলল, “বাবাকে বাদ দিয়ে এদের কাছে কারও কোনো অস্তিত্বই নেই! সবাই ছায়া মাত্র!”
    নিমাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সেটাই তো স্বাভাবিক! এরা বাবার কাছে এসেছেন। আমার কথা যদি বল, বাবা আমাকে তার কিছু সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন মাত্র! এ আমার খুব বড়ো সৌভাগ্য... ”


    প্রাচীন দুর্গের ভেতরে একপাশে অনেকটা জমিতে এই দ্বীপের সবচেয়ে বড়ো অডিটোরিয়াম। সেই অডিটোরিয়ামের মঞ্চে একটা নরম, তুলতুলে গদিমোড়া সোফায় বসে আছেন বাবা। হাতে কফির কাপ। একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছেন সেই কাপে। বাবার মাথার ঠিক পিছনে তারই একটা বিশাল তৈলচিত্র।

    অদ্ভুত একটা পোশাক পরে আছেন তিনি। তাঁর পাশেই বসে শুভাশিস। মাইকের সামনে অমলকান্তি। গমগমে গলায় অমলকান্তি বলছিল, “আপনারা সবাই জানেন, বাবা এক বহুমুখী প্রতিভা। তাঁর অন্যান্য গুণের কথা সকলেই জানেন। কিন্তু সে সব তো রোজই কাগজে বেরোচ্ছে। আজ আপনারা দেখবেন অভিনয়ে তাঁর কী অসামান্য দক্ষতা, অনায়াস সাফল্য, সাবলীল বিচরণ। বাবার জীবনের প্রথম প্রেম, অভিনয়। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি অকপটে বলেছেন, তাঁর সমস্ত সাফল্যের মূলে আছে, অভিনয়। গোটা জীবন ধরে তিনি শুধু একের পর এক কৃতিত্ব দেখিয়ে গেছেন। কিন্তু নিজের সেরা কৃতিত্বকে কখনও সামনে আনেননি। সবসময় তাকে আড়াল করেছেন। আজ এই সন্ধ্যায়, সেই রহস্যময় পর্দা উঠতে চলেছে। দু-চোখ ভরে এদেশের মানুষ আজ দেখবেন বাবার অভিনয়। বাবার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি!”

    গোটা হল হাততালিতে ফেটে পড়ল। এবার শুভাশিস বলতে শুরু করল, “বাবার অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে আমরা বাবারই পরামর্শে একটি ছোট্ট অনুষ্ঠান রেখেছি। আপনারা জানেন, গোটা জীবন ধরে বাবা অজস্র তরুণ প্রতিভাকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন, তাদের বড়ো বড়ো মঞ্চে সুযোগ দিয়েছেন, সবচেয়ে বড়ো কথা, তিনি গত কয়েক দশকে যতো সার্টিফিকেট দিয়েছেন, তার আগের কোনো অধিকর্তার আমলে তা কল্পনাই করা যেত না! এ তাঁর এক মহৎ গুণ। তিনি জানেন, “এইসব তরুণেরাই দেশের ভবিষ্যৎ এবং এই ভবিষ্যতের ব্যাপারে দেশের অভিভাবক হিসেবে তাঁর দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি! এই অনুষ্ঠানেও আমরা পাঁচজন তরুণ-প্রতিভাকে সুযোগ দিতে চলেছি, যারা একক অভিনয় করে বাবার মঞ্চে আবির্ভাবের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করবে। এবার আমি নামগুলি ঘোষণা করব... ”

    শুভাশিস পরপর পাঁচটা নাম পড়ে গেল। কিন্তু তার মধ্যে নিমাইয়ের নাম নেই। প্রথম নামটাই অচ্যুতের। ঘোষণা শেষ করে শুভাশিস যোগ করল, “আমি আরও কুড়িজনের তালিকা প্রকাশ করছি। খুব শিগগিরই এঁদের কোনো না কোনো অনুষ্ঠানে আপনারা অভিনয় করতে দেখবেন। আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি, এঁরাই দেশের ভবিষ্যৎ। আমাদের আশা-ভরসা। তাই নামগুলো চিনে রাখুন আপনারা। আজ নয়, তবে খুব শীঘ্রই এঁরা আসর জমাতে নামবেন... ”

    আরও কুড়িটা নাম। এবারও নিমাই বাদ। কুড়িবার যেন ছুরি মারল কেউ। নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল ধ্রুপদী। বেশ ভালোই প্রাপ্য জুটছে তার। অন্ধকারে ভালো দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, নির্বিকারভাবে তাকিয়ে রয়েছে মঞ্চের দিকে। ধ্রুপদী আগেই জানত। তবু একদম নির্বাক, স্তব্ধ হয়ে গেছে সে। দেশের পঁচিশজন তরুণ অভিনয়-প্রতিভার নাম! অথচ কোথাও নিমাই নেই! অচ্যুৎ সবার প্রথমে। এত এত সাধনা। কোনো স্বীকৃতি নেই তার? নিমাইয়ের পাণ্ডিত্যের কোনো শেষ নেই। ত্যাগ ও মগ্নতারও। অবিরাম তার সাধনা! এ দেশে তাহলে সাধনার জায়গা কোথায়? আস্তাকুঁড়ে? দেশের সেরা প্রতিভাদের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিলে সেই দেশের নিজেরও আস্তাকুঁড় হতে বেশি সময় লাগে না! জোরে চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা করল ধ্রুপদীর। নিমাইয়ের জন্য নয়। নিজের জন্য। তার নিজের হাত-পা কেউ যেন বেঁধে দিয়েছে। কে সে? ফিসফিস করে নিজেকেই শোনালো ধ্রুপদী, নিয়তি!

    বাবার মুখে মিটিমিটি হাসি। খুব খুশি তিনি। নিমাইয়ের ব্যাপারটা ক্রমেই আরও দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে। নাকি, বাবাই তাঁর জাদু শুরু করে দিয়েছেন? রহস্য, পুরোটাই রহস্য। কিছুই যেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

    ওরা টেরও পায়নি কখন নাবিকটি ওদের পাশে এসে বসেছে। ফিসফিস করে সে বলল, “আজ দুপুরেই লিস্টটা তৈরি হয়েছে।”

    “কে করেছে?” ধ্রুপদী জানতে চাইল। বাবা মুখে মুখে বলে গেলেন। আর অমলকান্তি টুকে নিল।

    “তাই নাকি!” ধ্রুপদী চমকে উঠল। একটু চুপ থেকে জানতে চাইল, “কেউ নিমাইয়ের কথা বলেনি? ও তো এখানে সার্টিফিকেটের জন্যই এসেছে। অভিনয় কলায় সর্বোচ্চ ডিগ্রির... ”
    অমলকান্তি একবার তুলেছিল। বাবা রাজি হলেন না! একটা সিগারেট ধরিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “না, না, ওর এখনও সময় হয়নি... ”

    সময় হয়নি! স্তম্ভিত হয়ে বলে উঠল ধ্রুপদী। তাহলে ও কেন এসেছে এখানে?

    ধ্রুপদীর মনে পড়ল, বিকেলেই রেস্তোরাঁয় শুভাশিস ও অমলকান্তিকে একটা লিস্ট নিয়ে আলোচনা করতে দেখে সে ব্যাপারটা কী জানতে চেয়েছিল। তখনই জানতে পারে, নিমাইকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সে অবশ্য কিছুই বলেনি ওদের। নিমাইকেও। তারপর ছুটে গিয়েছিল বাবার কাছে।

    ধ্রুপদীকে তার ঘরে ঢুকতে দেখেই বাবা নিমেষের মধ্যে ধরে ফেললেন প্রসঙ্গটা কোন্‌ দিকে যাচ্ছে। তাই আগেই বলে উঠলেন, “এ ব্যাপারে আমার কী করার আছে? ওসব তো শুভাশিস ঠিক করেছে... ”

    ধ্রুপদীর চোখে বিস্ময় যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। শুভাশিস ঠিক করেছে! বাবাকে না জানিয়ে? বাবার সম্মতি না নিয়ে? এই বুকের পাটা বাবার রাজ্যে শুধু শুভাশিস কেন, কারও রয়েছে কী? কিন্তু বাবা তো শুভাশিসকেই দায়ী করছেন। বাবাকে অবিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল ধ্রুপদীর। যার ওপর আমরা নির্ভর করি, তাকে কী সহজে অবিশ্বাস করা যায়? কিন্তু বাবা যা বলছেন, তা যে কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না! তবু বাবা কী অবলীলায় বলে চলেছেন সেসব কথা।

    মাঝেমাঝে বাবার উপস্থিত বুদ্ধি দেখে সত্যিই চমকে উঠতে হয়। তিনি যেন কাকে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করছিলেন। একটু পরেই বলে উঠলেন, “শুভাশিস... হ্যাঁ, নিমাইয়ের নামটা বাদ গেল কেন?... আরে, অচ্যুৎকে রেখেছ ঠিক আছে, ওর সার্টিফিকেট আছে, কিন্তু নিমাইও তো সুযোগ পেতে পারত, ও তো এখানে সার্টিফিকেট নিতেই এসেছে, তাই না?... অনুষ্ঠানটা না হয় একটু বেশি সময় ধরেই হত... না, না, এ তোমরা ঠিক কাজ করোনি... আমি তো মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না... ঠিক আছে, তোমার ওপর আস্থা রাখলাম তাহলে... তোমার কথায়... পরের বার নিমাইকে তোমরা... হ্যাঁ, পাক্কা কথা হয়ে গেল... দেখো, আর যেন নড়চড় না হয়... আচ্ছা, আচ্ছা... ”

    বাবা ফোনটা রেখে দিলেন। ধ্রুপদীর মুখ খুশিতে ঝলমল করছে।

    বাবা বলছিলেন, “আসলে, মাঝে মাঝে এরকম ভুল হয়ে যায়। ইচ্ছাকৃতভাবে হয়তো নয়। তবু হয়ে যায়। ঠিক আছে, পরের বার... ”

    “বাবা,” ধ্রুপদী বলে উঠেছিল, “এখনও তো সময় আছে। কিছুই কী করা যায় না?” তার চোখে ভেসে উঠেছিল দুপুরের ছবিটা। কী নিষ্ঠায় নিমাই বাবার জন্য একের পর এক ফাইল রেডি করে যাচ্ছে! তার মন জুড়ে শুধু বাবা। অথচ বাবা নিমাইয়ের কথাই ভুলে গেলেন? সার্টিফিকেট কী সবাই পায়? শুভাশিস যতই লিস্ট তৈরি করুক, বাবাকে নিশ্চয়ই একবার দেখিয়ে নিয়েছে!

    “দ্যাখো,” একটু বিরক্তি নিয়েই বললেন বাবা, “অত হতাশ হওয়ার কী আছে? এই তো সবে শুরু... ”

    কথাটা মেনে নিল ধ্রুপদী। তারপর যেন নিজের মনেই বলে উঠল, “অচ্যুতের ব্যাপারে কখনও কারও ভুল হয় না... ”

    “তুমি ভুল করছ।” বাবা শুনতে পেয়েই বলে উঠলেন।
    —ভুল? নিমাইয়ের মেধা অনেক বেশি।
    —ওর অভিনয় সবাই বুঝতে পারে না। দুর্বোধ্য। অচ্যুতকে সবাই বোঝে। ও অসম্ভব জনপ্রিয়।
    —তাহলে মেধাই নিমাইয়ের শত্রু?
    —এ দেশের মানুষের রুচিবোধ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্পজ্ঞান যে স্তরের, অচ্যুৎ তার পক্ষে একদম উপযুক্ত। নিমাই নয়। অচ্যুতের অভিনয় সবাই পছন্দ করে। ও এই দেশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র! নিমাইয়ের অভিনয় গুটিকয় বোদ্ধা ছাড়া কেউ কখনও দেখেনি। পছন্দও করেনি। সাধারণ দর্শকের ধরাছোঁয়ার বাইরে ও। এসবও মাথায় রাখতে হয়!
    —নিমাই সবাইকে মাথায় ছাড়িয়ে গেছে। এটাই তাহলে ওর দোষ?
    —সেটা তোমার চোখে। তুমি দেখতে পাচ্ছ। অন্য কেউ দেখছে না। তারা যা দেখতে পায়, যতটুকু দেখতে পায় অচ্যুত ঠিক সেইরকম। ওকে কেউ ঠেকাতে পারবে না। ও সফল হবেই।

    পাঁচজন অভিনয়-প্রতিভা একে একে নিজেদের কেরামতি দেখাল। তাতে কেউ ঘুমিয়ে পড়ল, কেউ হাই তুলল, কেউ বিরক্ত হয়ে টয়লেটে চলে গেল, কেউ কোনো মুখরোচক খাদ্য বা ফিসফিসানিতে মন দিল। শুধু একদম শেষে এসে অচ্যুত সবাইকে মাতিয়ে দিয়ে গেল। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখল ওর অভিনয়। গোটা হল হাততালিতে ফেটে পড়ল। মঞ্চে উঠেই কেউ কেউ তার সই নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সবচেয়ে বেশিক্ষণ ধরে হাততালি দিলেন বাবা। তারপর মঞ্চ থেকে এমনভাবে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে রইলেন, যার মানে হল, কী, কেমন দিলাম?
    ভুরু কুঁচকে ধ্রুপদী বলে উঠল, “কোনো গভীরতাই নেই। শুধু চটক দিয়ে লোকের মন ভোলানো।”

    নিমাই একদম চুপ হয়ে গেছিল। বহুক্ষণ পর কথা বলল সে, “এরকম একটা দেশে আর কী চাও তুমি? এটাই কী স্বাভাবিক নয়?”

    অচ্যুৎ তখন বলে চলেছে, বৈষ্ণবদের কাছে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ যা, তার কাছে বাবা ঠিক তাই। আজ যে অভিনয়ের জন্য তার এত স্বীকৃতি, এত প্রশংসা, সবই তো বাবার কাছ থেকে শেখা। নইলে সে তো কাউকেই চিনত না, কারও কাছে কখনও যায়নি, অভিনয় শিক্ষার জন্য কখনও কারও মুখের দিকে চোখ তুলে পর্যন্ত তাকায়নি! ও শুধু বাবাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছে আর সেটাই ছিল ওর কাছে যথেষ্ট শিক্ষা। বাবার অজান্তে, তাঁর অসম্ভব ব্যস্ত জীবনকে একটুও বিব্রত না করে, দূর থেকে দিনের পর দিন নিবিষ্ট হয়ে শুধু তাঁকে দেখে, এই শিক্ষা সে সম্পন্ন করেছে।

    নিমাই যেন নিজেকেই বলল, “ও এখনও অভিনয় করে চলেছে... ”

    ধ্রুপদী অবাক হয়ে তাকাল নিমাইয়ের দিকে।

    নিমাই ধ্রুপদীকে বুঝিয়ে বলল, “কেউ বুঝতে পারছে না। ও এখনও অভিনয় করে চলেছে... ”

    অচ্যুতের বিনয় সবাইকে মুগ্ধ করছিল। সে কথায় কথায় মাথা ঝোঁকাচ্ছিল আর পকেট থেকে বার করে হাতে তুলে নিচ্ছিল বাবার একটা ছবি আর বাক্যটা শেষ করে আবার সেটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখছিল। বুকের সঙ্গে ঘষছিল সেই ছবিটিকে। পারলে ফেভিকল দিয়ে সেটাকে সে বুকের সঙ্গেই সেঁটে দিত। কিন্তু তাহলে সেটা হয়তো একটু বেশিই দৃষ্টিকটু মনে হত। সেটা ঠিক বাবার রুচিসম্মত হত না।

    ছোট্ট একটা বিরতি চলছিল। হলের বাইরে এসে একটা অন্ধকারমতো জায়গা খুঁজে নিল ধ্রুপদী। তারপর নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “বাবাও কী আসলে এটাই চাইছিলেন?”
    নিমাই অবাক হয়ে তাকাল ধ্রুপদীর দিকে।

    ধ্রুপদী বলল, “তোমাকে মঞ্চে আসতে দিলে বাবার অভিনয় করতে সমস্যা হত। তাই বাবা কৌশল করে তোমাকে বাদ দিয়েছেন।”

    বিরক্ত হল নিমাই। তারপর বলল, “কার প্রসঙ্গে কাকে টেনে আনছ?”
    “তুমিই বুঝতে চাইছ না।“ ধ্রুপদী বলে। তারপর যেন ঘোরের মধ্যেই আরও বলে যায়, “আসলে এইসব অভিনেতাদের অপদার্থতা যত বেশি প্রকাশ পাচ্ছে, লোকের সমস্ত কৌতূহল আর ঔৎসুক্য তত বেশি তাদের ছেড়ে বাবার দিকে মোড় নিচ্ছে। বাবার অভিনয় দেখার জন্য দর্শকদের ছটফটানি তত বাড়ছে।”
    —কেন, এই তো অচ্যুৎ এত হাততালি পেল?
    —সমঝদার দর্শকেরা ঠিকই বুঝতে পারছে, ফাঁকিটা কোথায়...
    —আমার অভিনয় কেউ দেখত না, ধ্রুপদী।
    “বাবা চাননি, উনি মঞ্চে ওঠার আগেই কেউ দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করুক।” ধ্রুপদী তার বক্তব্যে নাছোড়। “আর সেটাই তোমাকে বাদ দেওয়ার কারণ।”
    নিমাই একটু হেসে বলল, “সবকিছু নিয়েই তোমার প্রতিবাদ!”

    কিছুক্ষণের জন্য মঞ্চ অন্ধকার হয়ে গেছিল। আলো জ্বলতেই দেখা গেল বাবা একটা সিংহাসনে বসে আছেন। এবার উঠে দাঁড়ালেন বাবা। তারপর কিছুক্ষণ মঞ্চের ওপর পায়চারি করলেন। মঞ্চের মেঝের দিকে আঙুল দেখিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, “আঃ, আর কতো ধুলো চাটবে? আর কত?”
    নেপথ্য থেকে কে যেন বলে উঠল, “এখান দিয়ে আপনি হেঁটে গেছেন। এখানে জিভ ঠেকালেই আপনার পায়ের ধুলো! তাই... ”
    “না, না, অনেক হয়েছে। এবার বলো, কেন এসেছ তোমরা... ” গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন বাবা।
    কয়েক সেকেন্ড পর একটি কণ্ঠ নেপথ্য থেকে বলে উঠল, “সবে আমি বিদেশ থেকে এসেছি বাবা, আমার কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি, আমি আপনার সেবায় আসতে চাই, আপনার সব খরচ আমার, আপনার নামে একটা আশ্রম তৈরি করতে চাই, রোজ আপনার বাজার করে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে চাই, দামি দামি মদ আর মাংসের জোগান দিতে চাই, আপনাকে নিয়ে এখানে ওখানে ঘুরতে যেতে চাই, বিলাসবহুল হোটেলে রাখতে চাই, আপনাকে একটি ব্যক্তিগত হেলিকপ্টার উপহার দিতে চাই, আপনার গানের সিডি বার করতে চাই, আপনাকে সিনেমায় প্রধান চরিত্রে নামাতে চাই, আমাদের নিউজ পেপারে নিয়মিত আপনাকে দিয়ে লেখাতে চাই, টিভি চ্যানেলে আপনাকে দিয়ে সম্ভব হলে রোজই বলাতে চাই, আপনাকে আমাদের কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসাবে পেতে চাই, আপনার একটু সেবা করতে পারলেই আমি ধন্য হয়ে যাব বাবা... ”
    “চিন্তা নেই,” বাবা আশীর্বাদ করার ভঙ্গিতে বললেন, “তোমার সব আশাই পূর্ণ হবে। এবার দেশের সর্বোচ্চ মূল্যের সার্টিফিকেটটি তুমিই পাবে... ”
    দর্শকেরা চেঁচিয়ে বলে উঠল, “ম্যাজিক। ম্যাজিক।”
    অচ্যুৎ ফিসফিস করে নাবিকটির কানে কানে বলল, “যার অত টাকা, তাকে আবার এত টাকা দিয়ে কী হবে?” নাবিকটি বলল, “বাবার সেবায় যা খরচ হবে তার কিছুটা তো সরকারি ফান্ড থেকে তুলে দিতে হবে।”
    এবার একটি মেয়ের কণ্ঠ শোনা গেল। সে বলল, “আপনার জন্যই একটা নাচ শিখেছি বাবা। একটু দেখাতে চাই...”
    মঞ্চের পেছনের স্ক্রিনে হঠাৎ একটি মেয়েকে নাচতে দেখা গেল। তার মুখ ঢাকা। কিন্তু শরীর প্রায় অনাবৃত। কিছুক্ষণ ধরে বেশ লাস্যময়ী ভঙ্গিতে মেয়েটি বিচিত্র ছন্দে নেচে দর্শকদের মাতিয়ে তুলল। নাচের ফাঁকে ফাঁকে সে বাবার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে আর নানা যৌন উদ্দীপক অঙ্গভঙ্গি করে আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসছে। বাবার মুখে মিটিমিটি হাসি। পুরুষ দর্শকেরা সকলেই উত্তেজিত। কখনও ঠোঁটের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে সিটি দিচ্ছে। মহিলারা মেয়েটিকে দেখে তারই মতো ভঙ্গি করে বসে বসেই সারা শরীর দোলাচ্ছে। অনেকে এমনভাবে মাথা ঝাঁকাচ্ছে যে, দেখেই ভয় হচ্ছে এই বুঝি ঘাড় থেকে তাদের মুণ্ডুটা খসে পড়বে। গোটা হলে একটা মাদকতাপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। মেয়েটির নাচ শেষ হতেই স্ক্রিনটি আবার অন্ধকার হয়ে গেল।
    স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ বাবা মিটিমিটি হাসছিলেন। এবার তিনি বরাভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “তোমাকে আমি বেডরুম ডিপার্টমেন্ট মানে শয্যাঘর দপ্তরের চেয়ারম্যান করে দিলাম। আজ রাতেই তুমি সার্টিফিকেটটা পেয়ে যাবে। ওতেই সব লেখা থাকবে। অবশ্য রোজ রাতে বাড়ি ফেরার আগে একবার করে এসে আমাকে সারাদিনের ব্যাপারে রিপোর্ট দিয়ে যাবে।”
    মেয়েটি বুকটা ঝুঁকিয়ে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে একটা উড়ন্ত চুমু দিল। তার স্তনসন্ধির ছবি গোটা স্ক্রিনে ছড়িয়ে পড়ল। সেই দেখে বহু পুরুষের মাথা ঘুরে গেল। তারা চোখ বুজে সেই ছবিটাই দেখতে লাগল বহুক্ষণ ধরে।
    দর্শকেরা আবার চেঁচিয়ে উঠল, “ম্যাজিক। ম্যাজিক।”
    এবার একটি ছেলেকে দেখা গেল স্ক্রিনে। সাদামাটা চেহারা। কিন্তু ধূর্তের মতো চাহনি। হাত কচলাতে কচলাতে বাবার সামনে গিয়ে সে বলল, “বাবা, বাবা, আমি সর্বস্ব হারিয়েছি, শুধু আপনাকে ছাড়া,” চোখ দিয়ে টপটপ করে তার জল পড়তে লাগল, ঝাপসা হয়ে গেল চোখের সেই ধূর্ত ভাব, “আপনাকে নিয়ে আমি গান বেঁধেছি, আপনার ছবি এঁকেছি আমি, আপনার মূর্তি বানিয়েছি, আপনিই আমার সব, আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা, আমি কিছুই জানি না, অজ্ঞ-মূর্খ-বেকার, আমার আশা-ভরসা-বিশ্বাস-নির্ভরতা সবই আপনি... ”
    বাবা মন দিয়ে তার আঁকা ছবিটি দেখলেন, তার বানানো মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, চোখ বুজে তার গান শুনলেন। তারপর বললেন, “বাঃ!”
    ছেলেটি বলল, “আমি আপনার মধ্যেই আকণ্ঠ ডুবে আছি বাবা! আমি গরিব হতে পারি, কিন্তু আমার মতো স্তাবকতা আর কেউ করতে পারবে না আপনার, কেউ এমন রাতদিন এক করে আপনার হয়ে ফাইফরমাস খাটতে পারবে না, আপনার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খামখেয়াল মেটাতে পারবে না, আমি আপনার ব্যাগ বইব, আপনি বললে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রবল তাপপ্রবাহের ভেতর দাঁড়িয়ে আপনার প্রচারপুস্তিকা বিলি করব, বরফের ঝড়ের ভেতর ছুটতে ছুটতে আপনার জন্য দামি দামি মদ নিয়ে আসব, পায়ে ব্যথা করলে পা টিপে দেব, তেল মালিশ করে দেব, পায়ের নখ কেটে দেব, পদসেবায় আমি অদ্বিতীয় এই দেশে, আপনি আমার ওপর নিশ্চিন্তে ভরসা করতে পারেন বাবা... ”
    বাবা হাত বাড়িয়ে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “কাল থেকেই এ দেশের সর্বোচ্চ মূল্যের স্কলারশিপের ব্যবস্থা করছি তোমার জন্য। সার্টিফিকেটটা নিয়ে নিও... ”
    দর্শকেরা সকলেই বলে উঠল, “ম্যাজিক। ম্যাজিক।’
    কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর একটি মেয়েকে দেখা গেল। জিনস আর টি শার্ট। মাথার চুল ছোটো করে ছাঁটা। সে বলল, “গত কয়েক বছর ধরে যেখানেই গেছি সেখানেই আপনার হয়ে প্রচার করেছি আমি, আপনার প্রগতিশীলতা-আধুনিকতা-আন্তর্জাতিকতা-সংস্কারহীনতা-উদারতা-নিরপেক্ষতা-অসম্প্রদায়িকতা-লিঙ্গবৈষম্যহীনতা-সুবিচার-ন্যায়পরায়ণতা, সবকিছুই তুলে ধরতে চেয়েছি মানুষের কাছে, খবরের কাগজে নিয়মিত আপনার সম্পর্কে লিখেছি, টিভি-রেডিও-ওয়েবসাইট যেখানে পেরেছি আপনার কথা বলেছি, আমার স্বামী যেখানে গেছে আপনার জন্য সেরা জায়গায় সবচেয়ে দামি হোটেল বুক করে আসতে বলেছি, আমার ভাই যেখানে গেছে আপনার জন্য সেরা মেয়েটিকে আনতে বলেছি, আমার বাবা যেখানে গেছে আপনার জন্য শ্রেষ্ঠ খাদ্য আনতে বলেছি, আমার পুত্র যেখানে গেছে আপনার জন্য শ্রেষ্ঠ মদ আনতে বলেছি। আপনাকে ছাড়া আর কোনো কিছুই ভাবিনি আমি...”
    বাবা বললেন, “জানি জানি। এই জন্যই এই দেশের সবচেয়ে বড়ো মিডিয়া হাউসের চিফ এডিটর করা হল তোমাকে। কালই বিদেশ চলে যাও। কয়েক মাস ঘুরেফিরে এস। সার্টিফিকেটে সবই লেখা থাকবে। আজই নিয়ে নিও... ”
    দর্শকেরা আবার বলে উঠল, “ম্যাজিক। ম্যাজিক।”
    ধ্রুপদী ফিসফিস করে বলল, “এইসবই তাহলে শর্ত!”
    নিমাই অবাক হয়ে তাকাল ধ্রুপদীর দিকে।
    ধ্রুপদী কোনো আমল না দিয়ে বলে উঠল, “পুরুষদের দেখছি বেশ ধনী হতে হবে।”
    পাশে বসা নাবিকটি হঠাৎ বিষণ্ণ স্বরে বলে উঠল, “আর গরিব হলে থাকতে হবে ফাইফরমাস খাটার ক্ষমতা।”
    ধ্রুপদী আবার বলল, “মেয়েদের ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত, যৌনতা। হ্যাঁ, লাস্যময়ী হতে হবে দেখছি।”
    নাবিকটি বলল, “ওরা তো এসে যখন-তখন ওঁর কোলে লাফিয়ে ওঠে। উনি খুব মজা পান তাতে।” নিমাই বলল, “কেন, ওই দ্বিতীয় মেয়েটি?”
    “ও তো দেখছি আস্ত একটা প্রচারযন্ত্র, ধনী, প্রচুর যোগাযোগ, সব গুণই আছে। তা ছাড়া... ” একটু থামল ধ্রুপদী। নিমাই তাকিয়ে রইল। ধ্রুপদী শেষ করল, “চোখের ধুলোও তো বটে! নিরানব্বই জন লাস্যময়ী, একজন চোখের ধুলো। হয় না এমন?”
    নাবিকটি আবার ভাঙা গলায় বলে উঠল, “সে যাই বলুন, সবাইকেই তোষামোদ করতে হবে। আনুগত্য দেখাতে হবে। ওটাই আসল।”
    “তোমার দেখছি কোনো যোগ্যতাই নেই।” হঠাৎ নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে তার গাল টিপে দিল ধ্রুপদী।
    নিমাই কিন্তু গ্রাহ্যই করল না সে কথা। সে বলল, “কী অবলীলায় অভিনয় করে চলেছেন বাবা। সত্যি বলতে কী, অভিনয় বলে যেন মনেই হচ্ছে না। বাবা এইভাবেই কথা বলেন, হাসেন, তাকান, হাঁটেন, বসেন। তিনি ঠিক যেমন, ঠিক সেইরকমই মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি। অভিনয়ের কোনো সচেতন প্রয়াস নেই তাঁর। নাঃ, মনেই হচ্ছে না বাবা অভিনয় করছেন।”
    “ঠিক বলেছেন।” সায় দিল নাবিকটি।
    —বাবা ঠিক এরকমই, তাই না?
    নাবিকটি যেন খুব মজা পাচ্ছে নিমাইয়ের কথায়। সে বলল, “এরকমই বলতে?”
    —মানে, মঞ্চে বাবাকে এখন ঠিক যেমন দেখাচ্ছে...
    হঠাৎ ধ্রুপদী ফিসফিস করে বলে উঠল, “এটাই তো আমার প্রশ্ন! বাবা যদি এরকমই হন, তবে তিনি কী সবসময়ই অভিনয় করে চলেছেন? না হলে বাস্তবে তাঁকে যেমন দেখায় এবং মঞ্চে তিনি যেমন, তার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই কেন? অবশ্য, ভালো অভিনয়ের গুণ তো এটাই। একজন বড়ো অভিনেতাকে দেখলে কখনও মনেই হয় না, তিনি অভিনয় করছেন! যার অভিনয় দর্শকের চোখে ধরা পড়ে, দর্শক যাকে দেখে বুঝতে পারে, সে অভিনয় করছে, সে আবার অভিনেতা কীসের! বাবা কী তাহলে একজন বড়ো মাপের অভিনেতা?”
    এবার আবার নেপথ্যে একটি কণ্ঠ শোনা গেল। সে বলল, “আমি প্রাণপণ খেটে চলেছি বাবা!”
    “জানি।” বাবা বললেন।
    —এদের সবার চেয়ে বেশি।
    —হ্যাঁ।
    —আমার লোভ আছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। নিজেকে গোপন করতে পারিনি আমি। চাইও নি কখনও। তা ছাড়া আপনি নিজেই তো লোভ। নিজেই তো উচ্চাকাঙ্ক্ষা। যার ওসব থাকবে না, আপনার উপস্থিতিতে তার মধ্যে ওগুলো এমনিই জেগে উঠবে। কিন্তু এটাও ঠিক, আমি আপনাকে ভালোবাসি বাবা। ওদের সবার চেয়ে বেশি। তাই আপনার কাজের মধ্যে ওদের চেয়ে অনেক গভীরে ঢুকেছি আমি। অনেক ভেতরে ঢুকে খোঁজাখুঁজি করেছি। আপনাকে হাড়েমজ্জায় বুঝতে চেয়েছি। ওরা ভালোবাসা দেখায়। লোভ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে গোপন রাখে। আমার কিছুই গোপন নয়। সবটাই প্রকাশ্য। এর মধ্যে কোনো স্ববিরোধ নেই। সবটাই স্বতঃস্ফূর্ত।”
    —জানি, জানি। তুমিই তো আসল লোক। কিন্তু...
    ছেলেটি অবাক হয়ে তাকায়। বাবা বললেন, “তোমার মাপটা ঠিক নেই। তুমি বড়ো বেশি বেখাপ্পা। কোনো ছাঁচেই ফেলা যায় না তোমাকে... ”
    —চারপাশে কত কিছু ঘটছে বাবা।
    —অনেক কিছু।
    —আমি তো অন্যায্য কিছু চাইনি বাবা। শুধু নিজের প্রাপ্যটুকু। একটা সার্টিফিকেট। তারপর আমি নিজেই চেষ্টা করব। সবকিছুর ভেতরে আপনি আমাকে রেখেছেন। সব ব্যাপারে জড়িয়েছেন। অথচ আমি কোনো কিছুরই অংশ নই। সবকিছুর বাইরে থেকে যাচ্ছি। সবকিছু থেকেই বাদ। যেখানে আমি আপনার, সেখানেই আমি সবকিছুর ভেতরে আছি। যেখানে আমি নিজের, সেখানেই আমি বাদ।
    —ওটাই তো আসল ম্যাজিক!
    বাবা যেন একটু থেমে থেমেই বললেন। আর তখনই গোটা হল হাততালিতে ফেটে পড়ল।
    ধ্রুপদী আর নিমাইও যত জোরে পারে হাততালি দিল। নাবিকটি আড়চোখে ওদের দেখছিল। একসময় ফিসফিসিয়ে বলল, “এই শেষ ম্যাজিকটাতেই বাবা বরাবর বাজিমাৎ করে দেন। এটাই আসল। নইলে অন্যগুলো তো বাবার জায়গায় থাকলে যে কেউ দেখাতে পারে...”
    ওরা দুজনে আবার নীরবে একে অপরের দিকে তাকাল।
    বাবা হাত জোড় করে তখনও সকলের অভিবাদন গ্রহণ করছেন। মঞ্চের পেছনে বাবা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর পর্দা নেমে এল।

    এবার বাবার ইন্টারভিউটা দেখানো হবে। আজ দুপুরেই নেওয়া হয়েছে। ইন্টারভিউটা নিয়েছে অমলকান্তি। পাশেই বসে আছে শুভাশিস। অমলকান্তিরই বিশেষ অনুরোধে। এতক্ষণ বাবা ছিলেন মঞ্চে। এবার তাঁকে দেখা যাচ্ছে পর্দায়। তাঁর জন্য বিশেষভাবে বানানো রাজকীয় চেয়ারটিতে বসে মিটিমিটি হাসছেন। তাঁর পায়ের কাছে দু-দিকে বসে আছে অমলকান্তি এবং শুভাশিস। মাথা তুলে তারা বাবার দিকে তাকিয়ে দেখছে। মাথা নীচু করে বাবা তাঁর স্নেহদৃষ্টি বর্ষণ করছেন তাঁদের দিকে।
    অমলকান্তি এবার দর্শকদের দিকে তাকাল। তারপর বলল, “আজ আমরা যার ইন্টারভিউ নিতে এসেছি, তাঁকে আপনারা সবাই চেনেন... ”
    দর্শকদের ভেতরে গুঞ্জন উঠল।
    “তিনি মহামানব।” শুভাশিস বলল।
    “সর্বশক্তিমান।” অমলকান্তি বলল।
    তারপর পালা করে দুজনে বলেই চলল।
    —এ দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে তাঁরই মাথা।
    —প্রতিটি বাণিজ্যিক সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে তাঁরই ইশারা।
    —প্রতিটি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে তাঁরই বুদ্ধি।
    —প্রতিটি সাংস্কৃতিক সিদ্ধান্তের পিছনে রয়েছে তাঁরই আশীর্বাদ।
    —প্রতিটি পুরস্কারের ব্যাপারে শেষ কথা বলেন তিনিই।
    —প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের তিনিই মুখ্য উপদেষ্টা।
    —তিনি ভূপর্যটক। অভিযানপ্রিয়। বোহেমিয়ান। প্রেমিক। পরোপকারী। উদার-হৃদয়। বলিষ্ঠ-স্বভাব।
    —দিনে আঠারো ঘণ্টা পড়াশোনা করেন। ভাবেন। ঘুমের মধ্যেও জ্ঞানার্জন করেন।
    —তিনি সাহসী, প্রতিবাদী, নিরহংকার, প্রতিভায় বহুমুখী, সংবেদনশীল, বিচক্ষণ, মেধাবী।
    —তিনি মানবিক, দেশপ্রেমিক, আন্তর্জাতিক। বিশ্বের দরবারে আমাদের একমাত্র প্রতিনিধি। আমাদের গর্ব, অহংকার, মাথার মুকুট।
    —তিনি আমাদের অবলম্বন, অভিভাবক, সকলের কাছে বাবার মতো। আমরা সবাই তাঁর কাছে সন্তানতুল্য।”
    হঠাৎ বাবা বলে উঠলেন, “থাক, থাক, অনেক হয়েছে, এবার তোমাদের প্রশ্নগুলো বলো।”
    কিন্তু বাবা কিছু বলার আগেই ওরা বলে দিচ্ছে। এসব কথা সব জায়গায় বহুবার লেখা হয়েছে। বাবা শুধু হুঁ, হাঁ করে যাচ্ছেন। দু-একটা ছোটো ছোটো মন্তব্য করছেন। অত্যন্ত তীক্ষ, ধারালো সেসব মন্তব্য। মাঝেমধ্যে সেই দুর্লভ ছবিগুলো দেখানো হচ্ছে। বাবা যা বলছেন সেসবেরই অকাট্য প্রমাণ ওই ছবিগুলো। অতি সাধারণ সব রঙ্গমঞ্চের মুহূর্ত। কিন্তু সেগুলো অসাধারণ হয়ে উঠেছে বাবারই মাহাত্ম্যে। তিনি যেভাবে সিগারেট ধরে আছেন, যেভাবে কোমরে হাত দিয়েছেন, যেভাবে পেনটা কপালে ঠেকিয়ে ভাবছেন, যেভাবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছেন, যেভাবে সূর্যাস্ত দেখছেন, সবকিছুর মধ্যেই যেন একটা বীরত্ব রয়েছে। তিনি যে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’, সেই বার্তাটিই যেন উঠে আসছে প্রতিটি ছবি থেকে। তিনি যে সকলের চেয়ে আলাদা, তারই ইশারা রয়েছে প্রতিটি ছবিতে।
    ইন্টারভিউয়ের শেষে গর্বিত অমলকান্তি ঘোষণা করল, “বাবা জীবনে বহু ইন্টারভিউ দিয়েছেন। কিন্তু অভিনয় নিয়ে সব কথা তিনি বলে দিয়েছেন এই ইন্টারভিউতে। এ এক বিরল ইন্টারভিউ। নিজের অভিনয় জীবন নিয়ে বাবার এরকম পূর্ণাঙ্গ ইন্টারভিউ ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল আজ থেকে।”
    শুভাশিস বলল, “আপনারা জানেন ‘ইতিহাস’ বাবার সবচেয়ে প্রিয় শব্দ।”
    অমলকান্তি বলল, “বাবা যা করেন তাই ইতিহাস হয়ে যায়।”
    আবার পালাক্রমে দুজনে বলেই চলল।
    —বাবা হাঁচি দিলে সেটাও ইতিহাস।
    —বাবা চুল আঁচড়ালে সেটাও ইতিহাস।
    —বাবা ভুরু কুঁচকালে সেটাও ইতিহাস।
    —বাবা ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরলে, সেটাও ইতিহাস।
    —বাবার নাকে মাছি বসলে, সেটাও ইতিহাস।
    —বাবা নাক ঝাড়লে সেটাও ইতিহাস।
    —বাবার চশমা, ঘরে পড়ার চটি, অ্যাসট্রে, ফেলে দেওয়া সিগারেটের টুকরো, সাইকেল, জলের বোতল, হাতের ঘড়ি, গোঁফ, দাড়ি, চুল, বুকের লোম, সব, সবকিছুই ইতিহাসের অংশ।
    বাবা বলে উঠলেন, “থাক, থাক। আসল ঘোষণাটা এখনও বাকি।”
    বাবা একটু সময় নিচ্ছেন। হঠাৎ ধ্রুপদী বলে উঠল, “একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না!”
    নিমাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল।
    সে বলল, “ইন্টারভিউটা নিতে এসে সেটাই মন দিয়ে করা উচিত। তাই না?”
    নিমাই মৃদু হাসল। ধ্রুপদী এবার যেন ঝাঁঝিয়ে উঠল, “অত, অত প্রশংসা! সবাই তো জানে, নতুন কিছু তো নয়!
    এসব অনুষ্ঠানে এরকম হয়ই।” পাশ থেকে নাবিকটি যেন উড়িয়ে দিতে চাইল তার কথা। সে ওদের কথা শুনছিল।
    হাতে ধরা কাগজ থেকে মুখ তুলে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে বাবা এবার বললেন, “এবার দেশের সর্বোচ্চ সাংস্কৃতিক সম্মান যুগ্মভাবে পাচ্ছেন শুভাশিস আর অমলকান্তি।” নিজের দু-হাতে দুটো সার্টিফিকেট তুলে ধরলেন বাবা। গোটা হল হাততালিতে ফেটে পড়ল।
    আর তরুণ প্রতিভার সার্টিফিকেট, একটু চুপ থেকে বাবা জানতে চাইলেন, “বলুন তো কে?”
    হল থেকে সমবেত কণ্ঠে ভেসে উঠল, “অচ্যুৎ সমাদ্দার... ”
    বাবা বললেন, “আপনারা তো তাহলে জানেনই... ”
    গোটা হল আবার হাততালিতে ফেটে পড়ল।
    নাবিকটি দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “কী বিচার বাবার! কী বিচক্ষণতা!”
    অমলকান্তি শেষ করল, “আজকের এই সন্ধ্যা ইতিহাস হয়ে গেল এই মুহূর্ত থেকে... ”
    শুভাশিস জুড়ে দিল, “ধরে নিন, ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চেই আজ আমরা সবাই মিলে জড়ো হয়েছি... ”
    দর্শকরা সকলেই উঠে পড়েছে। সবাই কেমন যেন আবিষ্ট, অভিভূত, বিমুগ্ধ। গোটা স্ক্রিন জুড়ে লেখা হল, সমাপ্ত।

    বাবা বলছিলেন, “আসল ব্যাপারটা কী জানো... ”
    একটা অত্যন্ত আরামের, নরম, বিলাসবহুল সোফায় বসে ছিলেন বাবা। শুভাশিস আর অমলকান্তি বাবার সামনে নীচে দামি কার্পেটে বসে মুঠোর ভেতর খৈনি নিয়ে ডলছিল। দুজনেরই চোখ বাবার দিকে।
    বাবা শেষ করলেন, “ওপরে উঠতে গেলে আগে নীচে নামতে হয়। সে যে কতটা নীচে, কতটা নরকে... ”
    নিমাই, ধ্রুপদী আর অচ্যুৎ বাবার পিছনে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসেছিল। বাবা যেন কিছু একটা ইশারা করতে চাইলেন।
    শুভাশিস জানতে চাইল, “আজকের অনুষ্ঠানটা কেমন লাগল আপনার?”
    “ভালোই তো।” বাবা বললেন। তারপর জানতে চাইলেন, “স্ক্রিপ্টটা বদলে গেছে দেখছি অনেকটাই। কে করেছে এসব?”
    শুভাশিস বলল, “নিমাই।” বাবা উত্তরটা জানতেন। আসলে নিমাইকে দেখিয়ে সবাইকে তিনি ওর নামটা শোনাতে চাইছিলেন। তারপর বললেন, “খুব সমইয়োপযোগী হয়েছে। কিছু কিছু জায়গা পালটাতেই হত। পুরো আইডিয়াটাই বেশ নতুন।”
    অচ্যুৎ বলে উঠল, “ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে নিমাইয়ের মাথা পেকে উঠেছে।”
    নাবিকটি জানতে চাইল, “ওই ফাইলগুলোয় সব আছে নাকি?”
    অচ্যুৎ বলল, “সবটাই। বাবার কাছ থেকেই তো সবটা পাওয়া।”
    নিমাই বুঝতে পারল, এরা বাবাকেও বোঝেনি। ওকেও নয়। বাবা আবার জানতে চাইলেন, “আর ইন্টারভিউয়ের প্রশ্নগুলো? কে করেছে ওগুলো?”
    এটাই বাবার গুণ। মানুষ চিনতে কখনও তার ভুল হয় না। তিনি নির্ভুলভাবে জানেন, “এই প্রশ্নগুলো অমলকান্তির পক্ষে করা সম্ভব নয়। কাউকে দিয়েই সে করিয়েছে।”
    অমলকান্তিও বলে উঠল, “নিমাই।”
    বাবা এটাও জানতেন। খুশি হয়ে তিনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই শুভাশিস বলে উঠল, “কালকের কাগজে কিন্তু স্ক্রিপ্টটার সমালোচনাই বেরোচ্ছে। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু জানাল। ওটা নাকি আর-একটু গুছানো যেত।”
    “আর ইন্টারভিউয়ের প্রশ্নগুলোও একটু এলোমেলো হয়েছে। সময়ের দিক থেকে যেটা যার পরে যাওয়ার কথা, তেমনটি যায়নি।” অমলকান্তি বলল।
    “তাই নাকি?” বাবা ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর বললেন, “স্ক্রিপ্টটার কিছু কিছু গোলমাল অবশ্য আমারও চোখে পড়েছে।”
    ধ্রুপদী অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু বাবা, স্ক্রিপ্টটা তো আগেই আপনাকে নিমাই দেখিয়েছিল!”
    বাবা মৃদু হেসে বললেন, “হ্যাঁ, তখনই চোখে পড়েছিল। আর ওইটাও... ”
    “কোন্‌টা?” ধ্রুপদী ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল।
    “ওই যে, ইন্টারভিউয়ের প্রশ্নগুলো। সময়টা একটু এদিক-ওদিক হয়েছে। আগের ঘটনা পরে, পরের ঘটনা। আগে বলতে হয়েছে... ”
    ধ্রুপদীর বিস্ময় বেড়েই চলেছে। সে আবার বলে উঠল, “কিন্তু বাবা, ওটাও তো... ”
    বাবার ভুরু এবার কুঁচকে গেছে। তিনি বললেন, “হ্যাঁ, চোখে আমার ঠিকই পড়েছিল।” ধ্রুপদী কিছু বলার আগেই তিনি যোগ করলেন, “কাজটা তোমার ঠিক হয়নি নিমাই।”
    ধ্রুপদী একদম হতবাক। সে বুঝে গেছে, এ ব্যাপারে বাবা নিমাইয়ের পাশে থাকবেন না।
    একটু পরেই শুভাশিস আর অমলকান্তির দেওয়া পার্টি শুরু হবে। সবাইকেই উঠতে হবে। ধ্রুপদী নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “চলো নিমাই, রেডি হতে হবে।” বাবা যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন। হঠাৎ মরিয়া হয়ে বলে উঠলেন, “না, না, ও যাবে না।”
    ধ্রুপদী কেঁপে উঠল হঠাৎ। তারপর ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, “নিমাইয়ের জন্যই তো সব। এত খেটেছে। ও ছাড়া এই পার্টি... ” এবার সে নিমাইয়ের মুখের দিকেও তাকাল। আর তখনই চোখে পড়ল, অচ্যুতের মুখটা দারুণভাবে বিকৃত হয়ে উঠেছে। সেই মুখে হিংসা আর কৌতুক মিলেমিশে গেছে।
    নিমাই নিজেই এবার খুব কষ্ট করে জানতে চাইল, “আমি যাব না বাবা?”
    “না, তুমি যাবে না।” বাবার গলা এবার একটু রুঢ় শোনাল। তিনি বললেন, “সবাইকে সব জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায় না!”
    “আমিও যেতে পারছি না বাবা।” সপাটে জানিয়ে দিল ধ্রুপদী। “একটা বিশেষ কাজ পড়ে গেছে... ”
    বাবার ভুরু কুঁচকে গেছে। সেটাকে সমান করে মৃদু হেসে তিনি বললেন, “ওখানে তোমার থাকা দরকার। তোমার জন্য নতুন পোশাক রাখা আছে।”
    ধ্রুপদী ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল। তবু সে দৃঢ়স্বরে বলল, “না আমি যাব না।”
    বাবা শান্ত স্বরে বললেন, “তোমার সব কিছুতেই প্রতিবাদ! এই সৌন্দর্য তোমার! শেষ পর্যন্ত কোনো কাজেই এল না।” তারপর হঠাৎ নিমাইয়ের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “একটু আগে পরমা বলে গেল, আজ রাতে তোমার ওর সেক্রেটারিকে ফোন করার কথা, তা দেরি করছ কেন?”
    শুভাশিস বলল, “বিভিন্ন জায়গায় চাকরির চেষ্টা করছেন আমাদের নিমাই!”
    অমলকান্তি বলল, “পরমার অভিনয় কোম্পানিতেও ফোন করেছিলেন নাকি!”
    “সে ব্যাপারেই রাতে... ”
    অচ্যুৎ কৌতুক করে জানতে চাইল, “বাবাকে কিছু জানাওনি নিমাই?”
    নাবিকটি হেসে বলল, “এদিকে সবাই এসে বাবাকেই জানিয়ে যাচ্ছে... ”

    সমুদ্রতীরে, নির্জনে, মিহি বালির ওপর চুপ করে বসেছিল নিমাই। জায়গাটা একটু অন্ধকার। একটু দূরে ঝাউ, নারকেল, তাল গাছের সারি। ধ্রুপদী গিয়ে নিমাইয়ের পাশে বসে পড়ল। তার কোলে ঢেলে দিল অনেকগুলি ঝিনুক। নিমাই চমকে তাকাল। তার চোখে জল। তারপর বলে উঠল, “এরকম হল কেন?”
    —বাবা তো নিউজ পেপারের বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলেন না।
    —আর আমার নিষ্ঠা?
    —বাবা শক্তি যাচাই করে ঠিক করে নেন কার হয়ে কথা বলবেন।
    —আর আমার সততা?
    —হাওয়া যেদিকে, বাবা তো তার উলটোদিকে যান না।
    —আর আমার আত্মা?
    “ওসব নিয়ে বাবা ভাবেন না।” বলেই বেশ জোরে হেসে উঠল ধ্রুপদী। তারপর যোগ করল, “বাবা একজন পেশাদার মানুষ। আত্মা-ফাত্মা নিয়ে ভাবার সময় কোথায় বাবার?”
    নিমাই আর কিছু বলল না। ধ্রুপদীই আবার বলল, “তবে তোমাকে বাদ দেওয়াটা! তুমিই সব করলে যেখানে... ”
    নিমাই মৃদু স্বরে বলল, “ও নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই! শুধু সার্টিফিকেটটা যদি... ”
    ধ্রুপদী আরও জোরে হেসে উঠল। তারপর বলল, “আমার আছে। ওখানে কত লোকের কত ফাইলের দরকার হবে। তুমি না থাকলে কে ওসব জোগাড় করে দেবে?”
    নিমাইয়ের বিষণ্ণ মুখেও হাসি ফুটে উঠল। তারপর সে বলল, “একদিক থেকে আমার অবশ্য ভালোই হয়েছে। অনেক কাজ আছে আমার। শুধু শুধু সময়টা নষ্ট হত।”
    “কী কাজ?” কৌতূহলী হয়ে ধ্রুপদী জানতে চাইল।
    —আমার এখন খাতির খুব বেড়ে গেছে ধ্রুপদী। কত লোক আমাকে ফোন করে। নানা ধরনের সাহায্য চায় তারা। বাবার কাছাকাছি যেতে চায়। বাবার ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়। বাবাকে নিয়ে তাদের কৌতূহলের শেষ নেই। তাদের অনেককেই ফোন করব বলে রেখেছি...
    —এসব ব্যাপারে সতর্ক থেকো। এদের অনেকেই তোমার অবস্থানের সুযোগ নিতে চায়। তোমার অনভিজ্ঞতা আর ভালোমানুষিরও। বেশি প্রশ্রয় দিও না এদের...
    —ঠিকই বলেছ তুমি। আরও আছে। আমি নিজেই অনেক প্রবীণ অভিনেতার সঙ্গে যোগাযোগ করি। এদের কাছ থেকে অনেক শিখেছি আমি। অনেক কিছু শেখার আছে এখনও। এদের স্নেহ, প্রশ্রয় মাখা কণ্ঠস্বর শুনলে আমার ভালোলাগে। জীবনে এরা কিছুই পায়নি। অথচ এ দেশের অভিনয়ের ইতিহাসে এদের অসামান্য অবদান রয়েছে। আমি এদের সবসময় সাহায্য করার কথা ভাবি। সুযোগ পেলেই এদের কথা বলি। অথচ আমার আর কী সাধ্য! কে শুনবে আমার কথা! সমবেদনা প্রকাশ করা ছাড়া এদের জন্য আর কী করতে পারি আমি? এরা অবশ্য ওসবের ধার ধারেন না, নিজেদের কাজ নিয়েই মগ্ন হয়ে থাকেন।
    —এরা কী সবাই বাবার সমর্থক?
    —না, তা হয়তো নয়।
    —তাহলে এখন এদের সঙ্গে যোগাযোগ করো না তুমি। অন্তত সার্টিফিকেটটা পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো...
    —কী বলছ তুমি! আমি তো অমলকান্তি আর শুভাশিসকেও এদের নাম করে করে সাহায্য করার কথা বলেছি...
    —খুবই ভুল করেছে। কথাটা বাবার কানেও পৌঁছে গেছে তাহলে! তোমার নিজের কী আছে যে পরোপকারের জন্য এখনই এতো ব্যস্ত হয়ে উঠলে?
    —আর ওই অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েরা, যারা সার্টিফিকেট নিয়ে আমার ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছে? কী প্রতিভা ওদের! অভিনয় নিয়ে কত ভাবনা-চিন্তা! অথচ দিন কাটছে একটা ভেজা, স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার করিডোরে, সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা গুনে। ওদের সঙ্গেও কথা বলতে ইচ্ছা করে আমার...
    —সবাই তোমার মতো করে ভাবে না নিমাই। ওদের মধ্যেও দেখবে কেউ তোমাকে ঈর্ষা করে, কেউ সন্দেহ করে, কেউ বা সত্যিই তোমাকে ভালোবাসে। নির্বিচারে বিশ্বাস না করে একটু যাচাই করে নিও...
    “পার্টিতে তুমি গেলে না কেন?” প্রসঙ্গ পালটে নিমাই জানতে চাইল হঠাৎ। অন্ধকারে তার মুখ ভালো দেখা গেল না।
    “আমার এখন অনেক ফাইলের দরকার।” ধ্রুপদীর গলাটা ভাঙা শোনাল, “পার্টিতে গেলে কে আমাকে ওসব জোগাড় করে দেবে?”

    পার্টি জমে গেছিল। সবাই খাদ্য-পানীয় নিয়ে মেতে আছে। শুধু বাবা সবকিছুর মধ্য থেকেও যেন কিছুর মধ্যেই নেই। তাঁকে ঘিরে সবসময়ই ভিড়। কিন্তু সেই ভিড়ের মধ্যেও তিনি যেন একা। খাদ্য স্পর্শ করেননি তিনি। মাঝে মাঝে চুমুক দিয়ে পান করছেন। সবাই তাঁকে কিছু না কিছু বলতে চায়। তিনি সবকথাই শুনছেন। কিন্তু নিজে কথা বলছেন খুব কম। হাসি দিয়েই মূলত কাজ সারছেন। দু-একটা কথা যা বলছেন, তাও নিতান্ত দায়সারা গোছের। গুরুত্বহীন। কোনো ভারী আলোচনার ভেতর ঢুকছেনই না।
    এমন সময় অমলকান্তি এসে হাজির হল। বাবা এখন একা। ফিসফিস করে সে বলল, “আপনাকে একটা কথা বলার ছিল... ”
    —হ্যাঁ, বলো না...
    —শুভাশিস কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। ও সবসময়ই আমাকে টেক্কা দিতে চায়। আপনার বেশি কাছে যেতে চায়। বেশি সুবিধা পেতে চায়। আমার প্রতি ওর খুব ঈর্ষা। আপনি কী ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন?
    “করেছি।” বাবা সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন।
    —ও কী এটা ঠিক করছে?
    —না, মোটেই না।
    —এর বিহিত আপনাকে করতেই হবে।
    —দেখছি কী করা যায়! তুমি চিন্তা করো না...
    বাবার আশ্বাস পেয়ে অমলকান্তি ভিড়ে মিশে গেল। একটু পরেই এল শুভাশিস। বাবাকে একা দেখেই সে এসেছে। বাবার একদম কাছে গিয়ে ফিসফিস করে সে বলল, “এবার কিন্তু অমলকান্তিকে আমি ছাড়ব না। উপযুক্ত জবাব দেব। অনেক হয়েছে... ”
    বাবা গম্ভীর হয়ে জানতে চাইল, “কেন, কী করেছে অমলকান্তি?”
    শুভাশিস বলল, “আপনি নিশ্চয় লক্ষ করেছেন। আপনার চোখ এড়িয়ে... ”
    —তা করেছি।
    —ও ভেবেছে কী? যা খুশি তাই করবে এভাবে? ঈর্ষা, ঈর্ষায় জ্বলে যাচ্ছে ও। আমার সাফল্য সহ্য করতে পারছে না। ও বুঝতে পেরেছে, আপনি আমাকে বেশি স্নেহ করেন। প্রশ্রয় দেন। এটাই সহ্য হচ্ছে না ওর। আরও একটা সমস্যা হল...
    বাবা কৌতূহলী হয়ে তাকালেন। শুভাশিস বলল, “ও খুব মিথ্যা কথা বলে। আর কথারও কোনো ঠিক নেই। দশ জায়গায় দশ রকম কথা বলে। বিশেষ করে, আমার নামে কিছু রটাতে পারলে... ”
    “ঠিকই।” বাবা সংক্ষেপে বললেন।
    —আপনি কিছু করতে পারেন না?
    “দেখছি। করতে তো হবেই।” বাবা বললেন।
    আশ্বস্ত হয়ে শুভাশিস চলে গেল।
    মঞ্চে একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়েছে শুভাশিস আর অমলকান্তি। হাতে মাইক নিয়ে অচ্যুৎ বলে চলেছে, “আমরা সবাই জানি, শুভাশিস আর অমলকান্তির বন্ধুত্ব, এ যুগের একটা দৃষ্টান্ত! ওরা দুটি আলাদা মানুষ। কিন্তু ওদের হৃদয় অভিন্ন। নিজেদের সাফল্যকে ওরা আলাদা করে দেখে না। জোট বেঁধে আনতে চায়। তাই ওরা সবসময় সফল। এ ওদের বন্ধুত্বের জয়! আসুন, সবাই মিলে ওদের এই বন্ধুত্বকে আমরা সম্মান জানাই। এই শ্যাম্পেনের বোতল... ”
    বাবা দেখলেন, নাবিকটি তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি বললেন, “কিছু বলতে চাও?”
    —আর তো পারা যায় না!
    “কেন?” বাবা মিটিমিটি হাসছেন।
    —সুযোগ পেলেই অমলকান্তি আর শুভাশিস একে অপরের নামে বলছে। একটু শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না আমাকে...
    —তোমাকে একটা কথা বলি...
    নাবিকটি অবাক হয়ে তাকাল। বাবা বললেন, “যেমন চলছে চলতে দাও। এটাই ঠিক। বুঝতে পারলে না তো?”
    বাবা হাসছেন। আবার তিনি বললেন, “এরকম চলতে থাকলে দুজনের খবরই পাওয়া যাবে। কেউ নিজেকে লুকোতে পারবে না। এ ওরটা ফাঁস করে দেবে। আর আমার সমর্থন চাইবে।”
    “আর আপনি কী করবেন?” নাবিকটি জানতে চাইল।
    —আমি দুজনকেই সমর্থন করব। আমার দুজনকেই দরকার। একটা কথা মনে রেখো...
    নাবিকটি তাকিয়ে আছে। বাবা বললেন, “ওদের শত্রুতা ওদেরকেই দুর্বল করে দিচ্ছে। আর বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার প্রতি নির্ভরতা। আমি এটাই চাই... ”
    নাবিকটি বুঝতে পারল, ওকে কী করতে হবে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২১ নভেম্বর ২০২০ | ১৪৯৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন