একটা ছোট্ট ঘরে জমকালো রঙিন সোফায় বসেছিল নিমাই। উলটো দিকেই একটা জুতোর র্যাক। তাতে কাচের সেলফে নানা ধরনের জুতো সাজানো। তাদের রং ও আকার বিচিত্র। দেখলেই বোঝা যায়, সর্বশক্তিমান জুতোর খুব সমঝদার। নিমাই জুতোগুলো দেখছিল। জুতোগুলোকে যেন খুব জীবন্ত মনে হচ্ছিল। তাদের গা থেকে কাঁচা মাংসের গন্ধ বার হচ্ছিল।
এভাবেই কেটে গেছিল আড়াই ঘণ্টা। শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। নিমাই আর একটা জুতোর র্যাক। সেই জুতোগুলোর গায়ে কাঁচা মাংসের গন্ধ। লঞ্চে ওঠার পর ঘণ্টা দুয়েক লেগেছিল এই দ্বীপে পৌঁছোতে। বন্দরেই একটা দামি গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। নিমাইকে নিয়ে নাবিকটি আসে সমুদ্রের ধারের এই সুদৃশ্য বাংলোয়।
এখানেই থাকেন সর্বশক্তিমান। চারপাশের পরিবেশ ভারী মনোরম। নিমাই পেরিয়ে আসে একটি প্রাচীন দুর্গ, সেই দুর্গের সামনেই রাখা একটা কামান, পুরোনো একটি চার্চ আর তার বিরাট ঘণ্টা। সমুদ্রের ধার দিয়েই চলে গেছে রাস্তা, সেই রাস্তার ধারে ঝাউ আর নারকেলের পাশাপাশি কাঁঠাল, কলা ও পেঁপে গাছ।
বাংলোয় ঢোকার পর এই ছোট্ট ঘরটায় তাকে বসিয়ে রেখে চলে যায় নাবিকটি। তারপর থেকেই কেমন দমবন্ধ লাগতে থাকে তার। তখন সে চোখ বুজে ভাবতে থাকে বাংলোর সামনেই যে বাগানটা আছে, তার কথা। সেই বাগানে সুগন্ধী, রঙবেরঙের কত ফুল! কৃষ্ণচূড়া আর গুলমোহরের ছায়া। চার্চের থেকে ভেসে আসে ঘণ্টাধ্বনি। ছেলেবেলায় এই ঘণ্টাধ্বনি খুব প্রিয় ছিল নিমাইয়ের। ওদের দ্বীপেও এরকমই একটি চার্চ ছিল। তবে অনেক ছোটো।
নাবিকটি আবার যখন এল, তখন সে কিছুই টের পায়নি। টানা একঘেয়েমিতে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। নাবিকটি বলল, বাবা, আপনাকে ডাকছেন।
বাবা? নিমাই চমকে উঠল।
সর্বশক্তিমানকে আমি বাবা বলেই ডাকি।
অকপট বিস্ময়ে নিমাই জানতে চাইল, কেন?
উনি আমার বাবারই মতো। বাবা ছাড়া ওঁকে আমার অন্য কিছু মনেই হয় না।
এই নাবিকটি নিজেকে তাঁর সন্তানের মতোই মনে করে তাহলে! নিমাই ভাবল। এটা নিশ্চয়ই নাবিকটির নয়, তাঁরই কৃতিত্ব! একজন সামান্য নাবিককেও উনি কত আপন করে নিতে জানেন!
নিমাই নিঃশব্দে নাবিকটিকে অনুসরণ করতে লাগল। ভয় ও কৌতূহল মেশানো একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল ওর ভেতরে। উনি সর্বশক্তিমান, সেটা নিশ্চয়ই তাঁকে দেখলেই বোঝা যাবে। দেবতাকে দেখলেই দেবতা বলে চেনা যায়। দানবকে দেখলেই চেনা যায় দানব বলে। তা তাঁকেও নিশ্চয়ই একঝলক দেখলেই সর্বশক্তিমান বলে চেনা যাবে?
যেন একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়েই ওরা হাঁটছিল। আর একসময় এসে পৌঁছোল একটা আলোকিত ঘরে। সেই ঘরে ঢুকলেই সোজাসুজি একটা বারান্দা। সেই বারান্দার সামনে অফুরন্ত নীল সমুদ্র। ঘরের ভেতর অনেকগুলি শিশু, হাতে রংবেরঙের বেলুন নিয়ে খেলছে। একে অপরের দিকে বেলুন ছুড়ে দিচ্ছে। নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে। ওদের তারা গ্রাহ্যই করল না।
এই শিশুরা এখানে কেন? এদের সে এখানে আশাই করেনি। কিন্তু শিশুদের উপস্থিতি তার ভালোলাগল। শিশুরা থাকলে সে সবসময়ই নিরাপদ বোধ করে। মা আর বুড়ো অভিনেতা থাকলেও। মঞ্চে অভিনয় করার সময় এবং অভিনয় নিয়ে বইপত্র ঘাঁটার সময়ও সে একইভাবে নিরাপদ ভাবে নিজেকে। কিন্তু বাকি প্রতিটি মুহূর্তে কেমন একটা নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি হতে থাকে তার। সে কিছুতেই স্বস্তি বোধ করে না। কিছুতেই নিজেকে বয়স্ক লোকেদের একজন ভাবতে পারে না। বিশেষ করে শক্তি ও ক্ষমতার সামনে কেমন যেন গুটিয়ে যায়। এখনও গুটিয়েই ছিল। কিন্তু শিশুদের উপস্থিতি সমস্ত জড়তা থেকে মুক্তি দিয়ে স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল করে তুলছিল তাকে।
এই রঙিন বেলুনগুলোর জন্যই সর্বশক্তিমানকে প্রথমে দেখতে পায়নি নিমাই। প্রচুর বেলুন একদম গায়ে গায়ে উড়ছিল। যেন একটা রংবেরঙের দেয়াল গড়ে তুলেছিল। আর তারই আড়ালে বসেছিলেন তিনি। এখনও যেন মধ্যবয়সীই মনে হয়। মুখে স্মিত হাসি। শান্ত অথচ সপ্রতিভ হাবভাব। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক মানুষ। বলিষ্ঠ শরীর। অথচ নিমাই জানে, মানুষটির বয়স এখন সত্তর ছুঁই ছুই। নিমাইকে দেখেই গাঢ় স্বরে বললেন, এসেছ?
নিমাইয়ের সারা মুখ নিষ্পাপ হাসিতে ভরে উঠল। নিজের অজান্তেই কৃতজ্ঞ বোধ করতে শুরু করেছিল সে।
আমাকে তুমি বাবা বলেই ডেকো। উনি বললেন।
তাহলে ইনিই সর্বশক্তিমান। নিমাই শুনেছে, এই হৃদয়পুর দ্বীপ থেকেই গোটা দেশকে চালানো হয়। ইনিই এই দেশের দেবতা। এই দ্বীপটি তাঁর রাজধানী। এই মানুষটির ইচ্ছার মধ্যেই রয়েছে তাঁর আসল শক্তি। তিনি যা ইচ্ছা করবেন, এই দেশে তাই হবে। তিনি চাইলে কেউ ধনী হবে, বিখ্যাত হবে, ক্ষমতার চূড়ায় উঠবে। তিনি না চাইলে, কেউ কিছু হতে পারবে না। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেও তার কিছু হবে না। বিপুল প্রতিভাও কোনো কাজে আসবে না। অথচ বাইরে থেকে মানুষটিকে দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই!
নিমাই কখনও কাউকে ‘বাবা’ বলে ডাকেনি। তার জন্মের আগেই তার বাবা মারা যায়। তা ছাড়া সর্বশক্তিমান বলা মাত্রই, নিমাইয়ের তাঁকে নিজের বাবার বলেই মনে হতে লাগল। আর নিজেকে তাঁর সন্তানের মতো। কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গেল সে। নিষ্পাপ গলায় তাই সে ডেকে উঠল, বাবা!
বাবা মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, তোমার সার্টিফিকেটটা রেডি হয়ে গেছে। সামান্য কিছু কাজ বাকি। তারপরই পেয়ে যাবে। আর একটা কথা...
নিমাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। সার্টিফিকেট দিতে বাবার মনে কী কিছুটা দ্বিধা আছে? আরও একটু অপেক্ষা করে, আরও কিছু পরীক্ষা নিয়ে, দেখেশুনে, বাজিয়ে যাচাই করে তবে তিনি সার্টিফিকেট দিতে চান?
বাবা শান্তভাবে তাকিয়ে বললেন, তোমাকে একটা কাজ দিতে চাই। করবে?
নিমাইয়ের চোখে হঠাৎ ভেসে উঠেছিল সেই ভেজা, স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার করিডোরের ছবি। গতকালই এই সময় ওই করিডোরে সে দাঁড়িয়ে ছিল। সামান্য চুপ থেকে সে বলল, নিশ্চয়ই।
বাবার মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি মৃদু হেসে বললেন, প্রথম জীবনে আমি একজন অভিনেতা ছিলাম। মঞ্চই ছিল আমার জীবনের প্রথম প্রেম। তোমাদের দ্বীপেই আমার জন্ম। ওখানেই ঘুরে ঘুরে অভিনয় করে বেড়াতাম। তোমাদের বুড়ো অভিনেতা আমার অনেক অভিনয় দেখেছেন। এখনও সুযোগ পেলেই আমি অভিনয় করি।
নিমাই চুপ করে শুনছিল। বাবা বলে চললেন, আমি চাই, আমার অভিনয়ের সমস্ত স্মৃতিকে গুছিয়ে রাখতে। আমার অভিনয়ের সমস্ত ছবি, খবর কাগজের কাটিং, চিঠি, ডায়েরি, সিডি, আমার অভিনয়জীবন নিয়ে লেখা বই, সাক্ষাৎকার, অজস্র টুকরো কাগজ ফাইল করে গুছিয়ে রাখতে, যাতে ওগুলো হারিয়ে না যায়। ওগুলো থেকেই আলাদা আলাদা কিছু বই বা সিডি হবে। নিজের অতীতকে আমি ফিরিয়ে আনতে চাই। শুধু নিজের কাছে নয়, গোটা দুনিয়ার সামনে৷ বিদেশি প্রকাশকের প্রস্তাব আছে। তারা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন। আমার পুরোনো বন্ধু, তোমাদের বুড়ো অভিনেতার চিঠি পেয়েই মনে হল, সার্টিফিকেটের জন্য তোমাকে এখানে যখন আসতেই হবে, তখন তোমাকেই দায়িত্ব দেওয়া যাক। তুমিই এ কাজের যোগ্য
লোক। অবশ্য তুমি যদি রাজি থাক...
এরকম একটা প্রস্তাবে সম্পূর্ণ হতচকিত হয়ে গেল নিমাই। এটা সে আশাই করেনি। সে একজন অভিনেতা। এখানে সার্টিফিকেটের জন্য এসেছে। বাবা তাকে সম্পুর্ণ অন্যরকম একটা কাজের দায়িত্ব দিতে চান। এই কাজ কী সে পারবে? এই কাজ কী তার করা উচিত?
কিন্তু এই দেশে বাবার অনুরোধই আদেশ। সেই লম্বা, সরু, অন্ধকার করিডোরটা নিমাইয়ের চোখে আবার ভেসে উঠল। ওখানে আর ফিরতে চায় না সে।
আসলে, একটু সংকোচ নিয়ে বলল নিমাই, আমি কী পারব? অবশ্য, যদি আপনি শিখিয়ে দেন, আপনার কাছ থেকে প্রতি মুহূর্তে আমি শিখতে চাই।
তা কেন! বাবা যেন লজ্জাই পেলেন একটু। তারপর গন্তীর হয়ে বললেন, আমিও তোমার কাছ থেকে শিখব।
তাঁর গলার স্বরটা হঠাৎ কেমন যেন অচেনা শোনাল। কথাটার মধ্যে যেন বিনয় নয়, দম্ভই ফুটে বেরোল। কিন্তু তাই বা হয় কী করে? এ কথার তো একটাই মানে হয়। বাবা নিমাইয়ের কাছে শিখতে চান। বাবা যে মহামানব! আর মহামানবেরা যে একটি ঘাসের কাছে, একটি বালুকণার কাছেও কিছু শিখতে চায়। তাঁদের সবই মহান। বিনয়ও মহান।
বাবা বললেন, ঠিক আছে, তাহলে আজ সকাল থেকেই কাজে লেগে যাও। মনে রেখো, হাতে সময় বেশি নেই। আজকে ধরে মাত্র পাঁচদিন।
নিমাই জানতে চাইল, আমাকে ঠিক কী করতে হবে?
বাবার মুখে হঠাৎ একটা রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল। একটু চুপ করে থেকে আগের সূত্র ধরেই তিনি বললেন, তোমাকে শুধু ফাইল গোছাতে হবে। মোট দুশো তিরাশিটি ফাইল। প্রচুর কাগজপত্র। সবই এলোমেলো হয়ে আছে। পারবে তো?
নিমাই সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল।
বাবা খুব খুশি হলেন। তাঁকে ঘিরে রয়েছে ছোটো ছোটো শিশুরা। যেন একটা জ্যোতির্বলয় ঘিরে রয়েছে তাঁকে। সেই শিশুদের জন্যই তাঁর উপস্থিতিকে যেন আরও পবিত্র ও মহৎ মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে এই শিশুরা? ওই ভেজা, স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার করিডোরে?
বাবা বললেন, এই কাজের জন্য তোমাকে আমি রোজ কিছু অর্থ দেব।
নিমাই চমকে উঠল। তারপর হতচকিতের মতো বলে উঠল, না, না, বাবা, আমাকে কিছুই দিতে হবে না।
বাবা কয়েক সেকেন্ড তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিমাইয়ের দিকে তাকালেন। যেন নিমাইয়ের অন্তরাত্মাকে পড়ে ফেললেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন, না, তা হয় না।
নিমাইও যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। অর্থ তার খুবই প্রয়োজন। তার মা অসুস্থ। নিজের কোনো চাকরি নেই। সামাজিক সম্মান নেই। নিজের প্রতিষ্ঠার জন্যই বাবার কাছে সে এসেছে। নিজেকে প্রমাণ করতেই। কিন্তু বাবাকে দেখামাত্র সে যেন সম্মোহিত হয়ে গেছে। বাবার জন্য আত্মনিবেদন করতে তার হৃদয় উন্মুখ হয়ে উঠেছে। নিজের সমস্ত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও নিষ্ঠা উজাড় করে দিতে চায় সে বাবার কাজে। সেখানে অর্থের ব্যাপারটা এলে গোটা ব্যাপারটার পবিত্রতা কেমন যেন ক্ষুণ্ণ হয়। একটা লেনদেনের ব্যাপার চলে আসে। এটাই নিমাই চায়নি। কিন্তু সে নিরুপায়।
পরে ধ্রুপদী নিমাইকে বলেছিল, অর্থ না পেলে কিছু পরেই তুমি হাঁপিয়ে উঠতে। নিজেকে বঞ্চিত ভাবতে। দুনিয়ার কাছে বাবাকে প্রশ্ন করার একটা সুযোগ থাকত। বাবা সেই পথ বন্ধ করে দিলেন। তিনি পেশাদার মানুষ। পেশাদারিত্ব দেখালেন। কিন্তু তোমার মনটাকে উনি পড়ে নিয়েছিলেন। সেই সুযোগ নিতে উনি কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তোমাকে নিংড়ে নিলেন উনি।
কিন্তু ধ্রুপদীর প্রসঙ্গ পরে আসবে।
বাবা নীরবে একটা প্লেট থেকে কাঁটাচামচ দিয়ে একটার পর একটা ফল তুলে খাচ্ছিলেন। নানা ধরনের ফল মেশানো ছিল তাতে। নিমাইয়ের অভিনয়ের ব্যাপারে তাঁকে সম্পূর্ণ উদাসীন মনে হল। ওসবের ধারকাছ দিয়েই গেলেন না। অভিনয় নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পেয়েছে সে। সার্টিফিকেট নিতে এসেছে। অথচ তার অভিনয় নিয়ে বাবার যেন কোনো মাথাব্যথাই নেই!
নিমাই ঠিক করল, ধৈর্য ধরেই অপেক্ষা করবে সে।