এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বই

  • কিছু প্রান্তবাসীর কথা, তাঁদের নিজের ভাষায়

    দময়ন্তী
    আলোচনা | বই | ০৫ আগস্ট ২০০৭ | ৭৬০ বার পঠিত
  • "লালবাতির নীল পরিরা' -- কৃষ্ণা দত্ত -- আনন্দ পাবলিশার্স।
    "আলো-আঁধারি' -- বেবী হালদার -- রোশনাই প্রকাশন।

    মানবীবিদ্যার পাঠে আগ্রহীরা এই বই দুটি নেড়েচেড়ে দেখতে পারেন। দুটি বইয়েরই আখ্যানভাগ গড়ে উঠেছে প্রান্তবাসী নারীদের জীবনযাপন, তাদের হাসিকান্না, সংগ্রাম, দৈনন্দিন খুঁটিনাটি নিয়ে। একটিতে সুপ্রতিষ্ঠিত লেখিকা বারনারীদের কথা তুলে ধরেছেন তাদের ভাষায়। আরেকটিতে প্রান্তবাসী লেখিকা স্বয়ং জানাচ্ছেন তাঁর গল্প।

    কৃষ্ণা দত্ত মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক। ইংরাজী ও বাংলা দুই ভাষাতেই লেখালিখি করেন। "লালবাতির নীল পরিরা' বইটি লিখতে চেয়েছেন যোনকর্মীদের বক্তব্য তাঁদের নিজস্ব ভাষায় ধরে রাখার জন্য, ডকুমেন্টেশানের উদ্দেশ্যে।

    বেবী হালদার এখন দেশে বিদেশে যথেষ্ট চর্চিত নাম। তাঁর প্রথম সৃষ্টি এই "আলো-আঁধারি', তাঁর নিজের জীবনের আলো ও আঁধারের গল্প। এই বইটি মূলভাষায় প্রকাশিত হবার অনেক আগেই অন্য ভাষায় অনুদিত হয়ে পাঠকের কাছে পৌঁছে গেছে ও সমাদৃত হয়েছে।

    এই বই দুটি নিয়ে কিছু আলোচনার চেষ্টা করব।

    "লালবাতির ..... ' ভূমিকায় লেখা আছে:
    "এই বইয়ে লালবাতির নীল পরিরা আপনাদের অনেক গল্প শোনাবে। গল্পের টানে আমি চেয়েছি এক প্রাচীনতম বৃত্তির কথা সংস্কারহীনভাবে আপনাদের কাছে তুলে ধরতে। বাস্তবতা বঞ্চনা, চোখের জল, শরীরের খেদ এবং সেই সঙ্গে সমাজের দেশের বিবর্তনের অলিগলি চোরাপথে একধরনের অপরিবর্তিত থাকার ঝোঁককে তুলে ধরতে। এই বই গল্পের মিছিল, কিন্তু সব গল্পের প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ঘটনা সত্য। প্রয়োজন মত নাম অদলবদল করা হয়েছে এই যা।'
    আরো লেখা আছে " ..... আমি কোন পক্ষ নিয়ে লিখিনি, চেষ্টা করেছি নির্মোহভাবে, কখনও বা সাংবাদিকতার শর্ত মেনে আবার কখনও ইতিহাস পুরাণের বিনীত ছাত্রী হিসাবে বিষয়টি দেখার।"

    তো, ভূমিকাটি পড়ে মনে আশা জাগে এক বিরাট পটভূমির, বিস্তৃত প্রেক্ষাপটের, যেখানে অনিচ্ছায় বা স্বেচ্ছায় প্রান্তবাসী হয়ে যাওয়া কিছু মানুষ তাঁদের বক্তব্য রাখবেন। তথ্য পেশের সাথে সাথে থাকবে হয়ত বা কিছু বিশ্লেষণও।

    সূচীপত্রে অধ্যায়সমূহ দেখছি
    প্রাচীনকালের রূপাদাসী
    তিলোত্তমা কলকাতা
    নিষিদ্ধ পল্লী
    জোড়াবাগান
    ওয়াটগঞ্জ
    সোনাগাছি
    উড়ান যোনকর্মী, মধ্যবিত্ত যৌনকর্মী
    মাফিয়া
    লন্ডনের ললনা
    উপসংহার।

    সূচীপত্র দেখে আশা জাগে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেরও কিছু চিত্র হয়ত পাওয়া যাবে।

    বইটি আশা পূরণে কতটা সক্ষম, তা এরপরে দেখার চেষ্টা করব।

    বইটির প্রথম অধ্যায়ে অতি প্রাচীনকাল থেকে কিভাবে নারীমাংস ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, তা দেখানো হয়েছে। অল্প কয়েকপাতার মধ্যেই লেখিকা দেখিয়েছেন রূপাদাসীরা কেমন অবাধে বণ্টিত হতেন - হিন্দু দায়ভাগ আইনে পরিস্কার করে বলা আছে ওয়ারিশদের মধ্যে কিভাবে স্থায়ী সম্পত্তির সাথে সাথে ক্রীতদাসীরাও বণ্টন করা হবে। ক্রীতদাসী, যাদের গৃহকর্মের সঙ্গে গৃহপুরুষদের যৌনসেবাও করতে হত। এখানে মোটামুটি বৈদিক যুগ থেকে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত সময়কে সংক্ষেপে ধরা হয়েছে।

    পরবর্তী দুটি অধ্যায়ে কলকাতার বিভিন্ন নিষিদ্ধ পল্লী কিভাবে গড়ে উঠল, এবং সেখানকার কিছু বাসিন্দার কথা, তাদের নামসহ প্রকাশিত। প্রকাশিত কাহিনীগুলি তাদের ভয়ংকর রুঢ়তা দিয়ে পাঠককে হতচকিত করে দেয়। জানতে পারি ৯ বছরের মেয়েকে এনে কিভাবে সরষের তেল ও মোমবাতি সহযোগে ব্যবসায় নামাবার জন্য "তৈরী করা" হয়। লেখিকা এইসব অংশে জানতে পারি নিষিদ্ধ পল্লী থেকে পালান মেয়েরা পুলিশের হাতে ধরা পড়লে, ঠাঁই হয় লিলুয়া হোমে। সেখানে কিছুদিন থাকলে, অনেকেই নিজেরাই আবার ফিরে আসে নিষিদ্ধ পল্লীতে। নরকেরও কম্পারেটিভ, সুপারলেটিভ ডিগ্রী হয়।

    পরবর্তী ৩ টি অধ্যায়ের নাম থেকেই বোঝা যায়, সেইসব অঞ্চলের যৌনকর্মীদের কথা, তাদের মুখ থেকে শোনা কথা লিখেছেন। লেখিকা এইসব অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য দূর্বারের সাহায্য নিয়েছেন, ফলে তাদের কথা এসেছে বহুবার। কোথায়ও কোথায়ও প্রায় বিজ্ঞাপনের মত লাগে।

    এর পরের অধ্যায়টির নামেই আমি ধন্ধে পড়ি। "মধ্যবিত্ত যৌনকর্মী" বলতে লেখিকা কী বোঝাতে চেয়েছেন? এতক্ষণ পর্যন্ত যতজনের কথা পড়েছি, তার মধ্যে উচ্চবিত্ত খুবই কম, শুধু "আগ্রাওয়ালি" ছাড়া আর নেই। অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত যৌনকর্মী। লেখিকা এখানে দুজন মধ্যবিত্ত গৃহবধুর কথা বলেছেন, যাঁরা সপ্তাহের কিছুটা সময় যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করেন। আগে এর তার মুখে শুনেছিলাম, এখানেও দেখলাম, বাচ্চার "ভাল স্কুল'এ পড়ানোর খরচ যোগাতে অথবা বৈচিত্র্যের সন্ধানে অনেকেই আসেন এই পেশাটিতে। এতক্ষণ পর্যন্ত দেখে এসেছি মূলত: আমাদের দেশের দারিদ্র্য, কৌলিন্যপ্রথা ও জাতপাতের বিভেদের কারণেই মেয়েরা বেশ্যাবৃত্তিকে পেশা হিসাবে নিতে বাধ্য হয়। ব্রিটিশ আইনে যৌনকর্মীদের দাগী অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই অধ্যায়ে দেখছি নিরুপায় হয়ে নয়, বরং স্বেচ্ছায় মেয়েরা আসছে!!

    "মাফিয়া" অধ্যায়টিতে তেমন কিছুই বলা হয় নি। আলাদা একটি অধ্যায় না করলেও কোন ক্ষতি ছিল না। অন্যত্র যৌনকর্মীদের গল্প বলতে গিয়ে মাফিয়াদের কথা বহু জায়গায়ই এসেছে। এই অধ্যায়টি বইট্টিতে বাড়তি কোন মাত্রাই যোগ করে নি।

    আন্তর্জাতিক যৌনকর্মীদের কথা কিছু জানা গেল। খুব একটা সুসংবদ্ধ নয় এই অংশের লেখা। লন্ডন ও প্যারিসের কিছু মহিলার কথা জানা গেল। সমগ্র বিশ্বে যৌনকর্মীদের সমস্যার একটি কমন উৎস হল পুলিশ। সহজে পয়সা তোলার জন্য, কেস দেবার জন্য সমস্ত দেশের পুলিশই যৌনকর্মীদের বেছে নেয়। সব সমাজে এঁরা ঘৃণিত হওয়ায় এঁদের ওপরে জুলুম করা সহজ। সংঘবদ্ধ হওয়াই তাদের ঠ্যাকানোর একমাত্র উপায়।

    বইটিতে বিশ্লেষণ আরো একটু থাকলে ভাল হত। সব জায়গায় নিরপেক্ষ কথকের ভঙ্গীটিও বজায় থাকে নি। আরো একটি কথা মনে হল, লেখাগুলি লিখে ফেলবার পর লেখিকা কি কথকদের দিয়ে আরেকবার যাচাই করে নিয়েছেন? ঠিক এই কথাগুলিই তাঁরা বলতে চান তো? খুব একটা নিশ্চিত হতে পারছি না।

    *********************************************************************************

    "আলো-আঁধারি'র প্রকাশক জানাচ্ছেন, "লেখার ভাষা ও সামগ্রিক এডিটিং নিয়ে সমস্যা ছিল। আমরা বিভিন্ন সময়ে বইটির ও তার মাধ্যমে বেবী হালদারের আর প্রবোধকুমারের সংস্পর্শে এসেছি -- আমাদের সামনে কতগুলি প্রশ্ন ছিল। যেমন বইটির ভাষা আদৌ পরিবর্তন করা উচিৎ কিনা। বানানের সমতা রাখা, গুরুচন্ডালী দোষ দূর করা, ইত্যাদি নিয়েও বিতর্ক ছিল। এক হিসাবে কথা সব বেবীর, আমরা উপভোক্তা মাত্র। সুতরাং পরিবর্তনের দায় একমাত্র বেবীর উপরেই বর্তায়। অন্যদিকে, আমরা যদি বেবীর সঙ্গে বইটির মাধ্যমে ও তার ফলে একে অপরের সঙ্গেও কোনও "ডায়ালগে" জড়িয়ে পড়ছি বলে মনে হয়, তাহলে ভাবের আদানপ্রদানের সমস্যা নিরসনে ভাষাগত জটিলতা দূরীকরণ অবশ্য প্রয়োজন। নানান আলোচনা ও অনেক চা কফি সেবনের পর আমরা এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে বানান ঠিক রাখা ও সামান্য যতিচিহ্ন দেওয়ানেওয়া ছাড়া অন্য কোনোভাবে আমরা বেবীর লেখাতে হাত দেব না। ফল কি হয়েছে তা পাঠকরাই বিচার করবেন।"

    বইটির ভূমিকায় শঙ্খ ঘোষ লিখছেন "সে ঠিক বুঝতে পারে না এমন কী আছে তার জীবনে বা সে জীবন নিয়ে তার লেখায় যে ওঁদের এত ভালো লাগবে।" .................... "তার লেখা কেন কারো ভালো লাগতে পারে, সেকথা বুঝবার ক্ষমতা তার না থাকাই সম্ভব, না থাকাই ভালো, কিন্তু তার স্বছ সহজ দৃষ্টি দিয়ে চারপাশের জীবনকে সে কত যে ভালো বুঝতে পারে, বিচার কর তে পারে, আর সাহস নিয়ে তার মুখোমুখী দাঁড়াতে পারে, বিস্ময়কর এই বইটির পাতায় পাতায় তার চিহ্ন আছে ছড়ানো।'

    "আলো আঁধারি' বইটি সমালোচনা করার স্পর্ধা আমার নেই। এই বইটি এমন একজনের লেখা, যাদের আমরা দেখি আশেপাশেই, চলতে ফিরতে। তার বর্ণিত টুকরো ঘটনাগুলিও ঘটতে দেখেছি এদিক ওদিক। কিন্তু এই বইটি পড়ার আগে এমনভাবে ঘটনাগুলির মধ্যে ঢুকে যেতে পারিনি কোনদিনই। আমি, আমার বন্ধুরা, পরিচিত লোকজন ঐ জীবনটি যাপন করিনা, করিনি কোনদিনই, তাই অনেককিছু দেখেও সেভাবে অনুভব করতে পারিনি, যা পারলাম এই বইটি পড়ে। বইটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করব মাত্র।

    বই শুরু হয় বেবীর ছেলেবেলার কথা দিয়ে। বেবীর জন্মের সময় তারা ছিল জম্মু-কাস্মীরে। সেখান থেকে এসে কিছুদিন মূর্শিদাবাদে থেকে আবার যায় ডালহৌসী। তার সাবলীল কলম ডালহৌসীর বর্ণনা দেয় "ওখানে আকাশ থেকে মৌমাছির মত উড়ে উড়ে বরফ মাটিতে পড়ে জমে যায়"। কিছুদিন পরে বেবীর বাবা তাদের এনে আবার মূর্শিদাবাদে জ্যাঠার বাড়ী রেখে চলে যায়। কখনও টাকা পাঠায়, কখনও পাঠায় না। জ্যাঠারও অভাবের সংসার, বিরক্তি বাড়ে, কখনও বাবা এসে এক দেড় মাস থেকে আবার চলে যায় --- এ সবই বড় চেনা গল্প। বেবীর মা একদিন বেবীর হাতে দশ পয়সা ধরিয়ে দিয়ে, তার ছোটভাইকে কোলে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তার আর কোন খবর পাওয়া যায় না। বেবীর দিদির বিয়ে হয়ে যায় পনেরো বছর বয়সে। এতকিছুর মধ্যেও কিন্তু বেবীর পড়া বন্ধ হয় না। সে স্কুলে যেতে থাকে, পড়তে থাকে। বইয়ের মধ্যে বারেবারে এসেছে তার সেই পঠনপাঠনের স্মৃতি, পড়তে ভাললাগার কথা। অনেকদিনই স্কুলে যেতে হত না খেয়ে, কিন্তু ঘরে খাবার নেই, একথা অসতর্কভাবে কোন সহপাঠীকে বলে ফেলায় বাবা তাকে এমন মারে যে তিনদিন সে বিছানা ছেরে উঠতে পারে না। অদ্ভুত উদাসীন, অসংসারী, কোনক্ষেত্রে নিষ্ঠুর বাবার কাছে থাকতে না পেরে ওর দাদা চলে যায় পিসীর বাড়ী। বেবীর বাবা আবার বিয়ে করে সৎমা আনে। একবার নয় দুই দুইবার। ওরা দূর্গাপুরে চলে আসে। ঘটনার বর্ননায় কিন্তু কোন রাগ বা বিদ্বেষ নেই, নিতান্তই ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট ভঙ্গীতে বলে যাওয়া।

    বেবীকে প্রায় বেড়াল পার করার মত করে তার বাবা কখনও পিসীর বাড়ী, কখনও দিদির বাড়ী, কখনও বা জ্যাঠার বাড়ী পাঠায়। আবার বাড়ীতে কাজের অসুবিধে হচ্ছে দেখলেই ফেরতও আনে। বার বছর এগার মাস বয়সে বেবীর বিয়ে হয়ে গেল ওর বাবার স্বল্পপরিচিত এক যুবকের সাথে। সেই বালিকা তখনও জানে না বিয়ে মানে কি। এও যেন দায় চুকানোর মতই, কোনোমতে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলা। তার নিজের ভাষায় "এত দু:খের দিন বেবী কত হাসিখুশীতে পার করে দিল? কিছুই সে বুঝতে পারল না, যে তার কি হয়ে গেল। অঘ্রান মাসে সতেরো তারিখে বুধবার বেবীর বিয়ে হয়ে গেল'। এইরকম কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেখক যেন তাঁর নিজের ভেতর থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে নিচ্ছেন। যেন তৃতীয় কোন ব্যক্তির কথা লিখছেন।

    ঐ বালিকা, স্বামী দ্বারা ধর্ষিত হয়ে বাপের বাড়ী যায়, থাকতে চায়, আশ্রয় পায় না, বরং সবাই বিরক্ত হয়। ফিরে আসতে হয় স্বামীর কাছে। আশেপাশের প্রতিবেশী বৌদের কাছে সে শিখতে থাকে জীবনের পাঠ। এমনিভাবেই পঁচিশ বছর বয়স হওয়ার আগেই বেবী তিন সন্তানের মা হয়ে যায়। তার ছেলেদের সে স্কুলে পড়াতে চায়, অশিক্ষিত স্বামী তা চায় না। ঠিকঠাক পয়সাকড়িও দেয় না। ছেলেদের অসুখ করলেও স্বামী চিকিৎসা করাতে রাজী নয়। বেবী ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করে। তাতে তার স্বামী আরও কমিয়ে দেয় টাকা দেওয়া। বাপের ঘর থেকে স্বামীর ঘর --- বেবীর প্রতি ব্যবহারের বদল হয় না। সেই এক আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপর পুরুষ, সে বাবাই হোক কি স্বামী। পাড়ায় একটি বৌকে পুড়িয়ে মারে তার স্বামী, বেবী তার নিখুঁত বর্ননা দিয়ে যায়।

    বেবীর দিদি মারা যায়, কিন্তু তার ছোট ছোট ছেলেগুলোকে বেবী একটুও দেখাশোনা করতে পারে না --- এই আফশোসে বেবীর মনে আবার ফিরে আসে তার মায়ের চলে যাওয়ার দু:খ। বইয়ে বারবার ঘুরে ঘুরে আসে "আজ যদি আমাদের মা থাকত, তাহলে আমাদের এমন হত না"। সেই বালিকা, যার হাতে একটা দশ পয়সা ধরিয়ে দিয়ে তার মা চলে গেল, সে বড় হয়েও কিছুতেই বুঝতে পারে না কেন তার মা ঐভাবে তাদের ফেলে রেখে চলে গেল! আজন্ম অনাদৃতা এই মেয়ে স্বামীর কাছে অসহ্য হলে বাপের বাড়ী যায়, আবার সেখানেও অনাদরের ঝাপটা খেয়ে ফেরৎ চলে আসে। অনেক পরে ওর সেই হারানো মা ফিরে আসলেও বেবী দেখে তাকে, তার ভাইবোনেদের কাউকেই তার মায়ের আর তেমন মনে নেই। বেবী ভাবে তাকেও হয়ত তার মায়েরই মত স্বামীর ঘর ছেড়ে চলে যেতে হবে -- কিন্তু তার সন্তানদের ছেড়ে কখনই নয়, তাদের নিয়েই যাবে সে।

    সত্যিই একদিন সে বাধ্য হয় স্বামীর ঘর ত্যাগ করে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিতে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে দিল্লীর ট্রেনে উঠে পড়ে সে। দিল্লীতে তার দাদা আছে, ভাই আছে, তারা কাজ করে, সেও কাজ করবে, করে ছেলেমেয়েদের পড়াবে। নিজের পড়াশোনার অপূর্ণ সাধ আর ছেলেমেয়েদের পড়ানোর অদম্য ইচ্ছা, চুড়ান্ত প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও লড়ে যাওয়া দেখে কোথায় যেন মিল পাই সূবর্ণলতার সাথে।

    এই মেয়েটি "স্ত্রী'র পত্র' পড়ে নি, শোনেনি ইবসেনের ডলস হাউসের কথা, কিন্তু অনায়াসে উচ্চারণ করে "স্বামীর ঘরে থেকে কত যে সুখ, সে আমার জানা হয়ে গেছে'। "আমি একাই ছেলে মানুষ করতে পারি কি না' এইটি দেখতে পথে নামা সেই মেয়ে ভাসতে ভাসতে, ঠোক্কর খেতে খেতে ফরিদাবাদ হয়ে গুরগাঁওয়ের চক্রপুরে এসে পৌঁছায়। তিক্ত, কষায়, অম্ল পার হয়ে অবশেষে সে এক মধুর আশ্রয় পায়। প্রেমচন্দের নাতি প্রবোধ চন্দ্রের বাড়ীতে "কাজের মেয়ে' হয়ে যোগ দিয়ে শোনে "তুমি এ ঘরের মেয়ে। তুমি কখনও ভাববেনা যে তুমি এ ঘরের কাজের মেয়ে।' শুদু মৌখিক উচ্চারণ নয়, তাকে দুহাত বাড়িয়ে ঘরের মেয়ে বলে গ্রহণ করেন "তাতুষ' ও তাঁর পরিবার, বন্ধুবর্গ। এই প্রথম একটি উষ্ণ, নিরাপদ আশ্রয় পায় সেই মেয়ে। তাতুষ তার হাতে ধরিয়ে দেন "আমার মেয়েবেলা', একটি খাতা ও কলম। রোজ একপাতা করে লিখতে বলেন, যেমনভাবে মনে আছে।

    কাজ করতে করতে অবসরে সময়ে লেখা এই সেই বই "আলো আঁধারি'। "কাজের মেয়ে' হয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করানো, মানুষ করা, বাংলা সাহিত্যে সুলভ। তাঁদের নিয়ে অনেক আবেগমথিত লেখাপত্র আমরা পড়ি, কিন্তু তাঁদের কথা তাঁদেরই কলমে লেখানো --- না: এমনটি আর দেখিনি। ন্যুনতম সম্পাদনা এই বইটির আকর্ষণ অনেক বাড়িয়েছে। একেবারে নিজের ভাষায় বলা কিছু কিছু বাক্যের উদাহরণ দিতে ইচ্ছা করছে। যেমন "তবুও বেবী বেবীর শৈশবকে ভালোবাসে ..... বেবী নিজের শৈশবকে চাটে, যেমন নবজাত বাছুরকে ওর মা চাটে।' কিম্বা "বুকের হাড়গুলো সব কাঁপছে। শরীর তখন জল হয়ে গিয়েছে'।

    নিজের ভাষায় নি:সঙ্কোচে নিজের কথা শোনানো এই একাকিনী সাহসিনীকে আমার শ্রদ্ধা জানাই। সমস্ত পাঠককে অনুরোধ, এই বইটি পড়ুন, পড়ে দেখুন।

    আগস্ট ৫,২০০৭
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০৫ আগস্ট ২০০৭ | ৭৬০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন