এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • সোনার দেশের সোনার ছেলেরা

    শ্রাবণী
    আলোচনা | বিবিধ | ২৪ আগস্ট ২০০৮ | ৬৩১ বার পঠিত
  • এগারোই আগস্ট, ২০০৮ এর সকাল। অন্যান্য সকালের মতই খুব সাধারণ আর একটি সকাল। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কোথাও হাল্কা রোদ্দুর খটখটে শুকনো মাটি, কোথাও বা বৃষ্টিভেজা প্যাচপেচে কাদা। রোজকার খবরেও বৈচিত্র আশা করেনি কেউই তেমন। বন্যা, উত্তাল কাশ্মীর,রাজনীতিকদের চাপানউতোর, ছুটছাট দুর্ঘটনা, বাজারে মুল্যবৃদ্ধির আগুন এইসব নিত্য নৈমিত্তিক হেডলাইন চোখে নিয়ে ঘুম ভাঙছিল কোটি কোটি দেশবাসীর। হঠাৎ একটা খবর, একটা অন্যরকম খবর! আকাশে বাতাসে এ চ্যানেলে ও চ্যানেলে আর শেষমেশ এর মুখে তার মুখে সারা দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল।

    সোনা, সোনা, সোনা! বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রীড়াপ্রতিযোগীতা অলিম্পিকের আসর থেকে এই প্রথম ব্যক্তিগত স্বর্ণপদক এসেছে ভারতের ঘরে। মুহুর্তের মধ্যে অভিনব বিন্দ্রা হয়ে গেল ঘর ঘর কা সোনেকা লাল!

    সবার মুখে হাসি, চোখে জল। এমনকি টিভিতে দেখা যাচ্ছে বেজিং এ ভারতীয় সাংবাদিকরা পর্যন্ত তাদের পেশাদার নির্লিপ্ত হেলদোলহীন মুখোশ ত্যাগ করে চোখে জল নিয়ে হেসে নেচে গেয়ে উঠছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা বোধহয় অলিম্পিক জিনিসটা খায় না মাথায় দ্যায় তাই জানেনা তাদের মুখগুলোতেও বাতাসে ভেসে আসা আনন্দের তরঙ্গ কেমন যেন একটা হাসি হাসি প্রলেপ মাখিয়ে দিয়ে গেছে। কোনো গণক্কারের গণনা ছাড়াই এই দিনটি হয়ে ওঠে আমাদের দেশের অন্যতম শুভ দিন। দু:খদুর্দশাকে একদিনের জন্যে দুরে সরিয়ে হাসিতে কান্নায় আবেগে আমরা সোনাজয়ের উৎসবে মেতে উঠি।

    নির্বিকার শুধু একজনই, এই পুরো ঘটনার নায়ক, সে সত্যিই অভিনব। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে একনম্বর আসনে দাঁড়িয়ে তার প্রাপ্য সম্মান হাতে নিল। সারা পৃথিবীর চোখের সামনে ম্‌ঞ্চে তখন ধীরে ধীরে এদেশের পতাকা উঠছে , ব্যাকগ্রাউন্ডে ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীতের সুর, উপস্থিত সমস্ত ভারতীয় দর্শকরা ভাববিহ্বল। তাকে নিয়ে এত মাতামাতি তবু পঁচিশ বছরের এই চন্ডীগড়ী যুবক আশ্চর্য্য রকমের শান্ত, মঙ্ক ফেসড, সাধকের মত সমাহিত। সারা পৃথিবীর এবং ঘরের মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে কোনো অতিরিক্ত উচ্ছাসের লেশমাত্র নেই কথায়, "আমি না জিতলে আর কেউ জিতত, তবে আজ দিনটা আমার ছিল। এই জয়ে আমার জীবনে কিছু বদলাবেনা। এর আগে এথেন্সে আমি এর চেয়ে ভাল করেছিলাম, মেডেল পাইনি। আজ অন্য কেউ ভাল করেও মেডেল পেলনা। আমি লাকী, আর কিছুনা।"

    আমরা সাধারণ ভারতীয়রা যারা আমাদের ক্রিকেটের ভগবানদের গীতা শুনে অভ্যস্ত, তা তারা খেলতে পারুক আর না পারুক, আমাদের কানে এই ধরণের মন্তব্য কেমন যেন একটু অন্যরকম ঠেকে। ধোনির মত বোলারদের রাস্কেল না বলুক, মুখ না ভ্যাংচাক, অথবা বোলারদের মত উইকেট পেয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত সজোরে আকাশে না তুলুক, তবু আর একটু মানবিক হলে ক্ষতি কি ছিল! নাহয় আমাদের দেশের জেনারেশন এক্স অনেক কুল তবে মাঝেসাঝে একটু আধটু ইমোশন কি আর দেখানো যায় না? যুবরাজ, শ্রীশান্তরা কি এই জেনারেশনের নয়?

    আবার মাঝে মাঝেই মনের মধ্যে উঁকি দেয়, এই শীতলতা আসলে দৃঢ়তারই রূপ। যে ভাবে সারাক্ষণ লক্ষ্যে স্থির অবিচল থেকে, শেষ অংকে জয় ছিনিয়ে এনেছে সে অন্য প্রতিযোগীদের কাছ থেকে তা কোনো Thriller এর চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। "নার্ভ অফ স্টীল" বলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যম। মুখেই জগত মারা ভারতীয়দের কাছে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা বৈকী!

    অলিম্পিকের সোনা, পনেরই আগস্ট, রাখী সব নিয়ে উৎসবে মেতে উঠল সারা দেশ কাশ্মীরকে আলতো করে সাইডে রেখে। শ্যুটিংএ গতবারে রাঠোরের রূপো আর এবারে বিন্দ্রার সোনা, আমাদের আর পায় কে? আমরা এতটাই অভিভূত যে ক্রিকেট টীমের শোচনীয় পরাজয়ও আমাদের আনন্দকে মাটি করতে পারেনি। শচীন ধোনির পাশে পাশে (হয়ত বা আগেই ) এখন অভিনব আমাদের তরুণ সমাজের রোল মডেল!

    একটা অলিম্পিক গোল্ড আমাদের এত সম্মান দিতে পারে, এত খুশী দিতে পারে কিন্তু তার জন্যে আমাদের দেশের মানুষদের বা সরকারের কতটা অবদান আছে? অভিনবের নাম এর আগে কতজন জানত? অথচ সে আমাদের দেশের একজন অত্যন্ত যোগ্য, সামনের সারির শ্যুটার। এবং এই অলিম্পিক পদকই তার প্রথম সাফল্য নয়, অনেক অনেক অন্য পদকও সে এনেছে আমাদের দেশের জন্য তবু অর্ধেক দেশই তাকে চিনতনা এতদিন পর্যন্ত। ঠিক তেমনিই, যেমনি হয়ত আজও চেনেনা অন্যান্য শ্যুটারদের, যাদের সম্মিলিত পদকপ্রাপ্তি দেশের জন্য গত কয়েকবছরে একশ পঞ্চাশ!

    সত্যি বলতে কি এই সোনার পুরো কৃতিত্বই অভিনবের ধনী পরিবারের। তাই বোধহয় সোনা জেতার সঙ্গে সঙ্গেই সে ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি যেতে চায় সে। শ্যুটিং একটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল খেলা। এর সরঞ্জাম সামগ্রীর অনেক কিছুই বিদেশ থেকে আসে, খরচও পড়ে প্রচুর আর তাই শুধু সরকারী সাহায্যে এ খেলার সঠিক অনুশীলন সম্ভব হয়না। এছাড়া বিদেশী ট্রেনিংও দরকার যেহেতু আমাদের দেশে উন্নত ট্রেনিং ব্যবস্থা নেই। অভিনবের বাড়িতে তার অনুশীলনের জন্য বানানো হয়েছে অত্যাধুনিক শীততাপনিয়ন্ত্রিত প্র্যাকটিস রেঞ্জ। এছাড়া অন্যান্যদের মত ammunition এর জন্য তার অনুশীলনে কোনো ব্যাঘাত কোনোদিন হয় নি।অভিনবের জন্য পরিবারের সাপোর্ট ছিল, রাঠোরের ছিল ইন্ডিয়ান আর্মির। আর তাই এই গৌরবের জন্য বিন্দ্রা পরিবারের কাছে গোটা দেশের ঋণ অপরিসীম। ধনী হলেই যে সব পরিবার এভাবে ছেলের ট্যালেন্ট কে লালন করতে পয়সা খরচ করে তা নয়, এ শুধু এই পরিবারের স্পোর্টসের প্রতি ভালবাসার জন্যেই সম্ভব হয়েছে।

    কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন থেকে যায় সেইসব প্রতিভার জন্য, যাদের পরিবার ধনী নয় বা অন্য কোনো সাপোর্ট নেই। সরকারের বরাদ্দ পয়সার অনেকটাই যায় প্রতিযোগীতার বিদেশী কোচের খাতে, যা অত্যন্ত জরুরীও বিশেষ করে শ্যুটিং এর মত খেলায়। বিন্দ্রা জেতার পরে তার ওপর ধনবর্ষা শুরু হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ও রাজ্যের (যারা নিজেদের রাজ্যের খেলোয়াড়দের উন্নতির জন্যে কতটা কি করেছে তাতে সন্দেহ আছে! মহারাস্ট্রের শ্যুটারদের ভাষায় সরকার তাদের কোনোদিন টাকা তো দুর অস্ত বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই একটা অভিনন্দনের চিঠিও দেয়নি আজ পর্যন্ত, যদিও তারা কমনওয়েলথ, এশিয়াডে ভাল ফল করেছে। )। এই অর্থব্যয় যদি করা হত সম্ভাবনাময় সেইসব তরুণ প্রতিভাদের জন্য, ভবিষ্যতের সাফল্যের দিকে চোখ রেখে তাহলেও কি এইরকম বছরের পর বছর বিশ্বের ক্রীড়ামঞ্চ থেকে লজ্জায় মুখ ঢেকে বিদায় নিতে হত?

    এক অলিম্পিক ছাড়া কমনওয়েল্‌থ বা এশিয়াডের মত জায়গায় আমাদের শ্যুটাররা অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়ে চলেছে অনেকদিন থেকেই। আর এ কথা সাধারণ লোকে বেশী না জানলেও আমাদের সরকারের জানা আছে খুব ভালভাবেই। তবু কেন অলিম্পিকের জন্য কোনো বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি? গতবারের অলিম্পিকের পরের বছর পার্লামেন্টারি ক্রীড়া বিষয়ক কমিটির মিটিংএ এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা হয় তা সে সময় খবরে আসে। কথা হয় যে অলিম্পিকের স্পোর্টসগুলিকে স্পন্সর করার জন্য কোম্পানীদের ট্যাক্স রেহাই দেওয়া শুরু হোক, বাইরে থেকে আনা ক্রীড়া সরঞ্জামের ওপরে কাস্টম ডিউটির ছাড় দেওয়া হোক। এও আলোচনা হয় বিসিসিআইএর মত ধনী স্পোর্টস বডিকে নির্দেশ দেওয়া হোক অলিম্পিকের জন্য ফান্ড আলাদা করে রাখতে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে আর একটা অলিম্পিক এসে গেছে, খেলোয়াড়দের অবস্থার কোনো বিশেষ উন্নতি ছাড়াই।

    এ দেশের স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনগুলি অনুন্নত পরিকাঠামো, অর্থাভাব, দুর্নীতি ও রাজনীতির শিকার। আর তা নিয়ে আমাদের নেতাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। সাফল্য এলে তারা শুধু অভিনন্দনের বার্তা পাঠিয়ে আর ক্ষেত্রবিশেষে কিছু পুরস্কার ঘোষণা করেই দায়িত্ব শেষ করেন, সে বিরোধী বা সরকারপক্ষের নেতা যেই হোক। তুঘলকাবাদের শ্যুটিং সেন্টারে যা কিনা আমাদের শ্যুটারদের অন্যতম প্রধান ট্রেনিং গ্রাউন্ড সেখানকার সাজসরঞ্জাম ১৯৮২ সালের পুরানো। অভিনব এই গ্রাউন্ডে অনুশীলন করে নি, করলে কি হত বলা যায় না! অভিনব জার্মানীতে তার ব্যক্তিগত কোচের কাছে ট্রেনিং নিয়েছে। শ্যুটিংএর কোচ ছাড়াও তার জন্যে ছিল ফিজিক্যাল ট্রেনার, মেন্টাল কোচ, সাইকোলজিস্ট ইত্যাদি। খেলার সাথে সাথে তার শারীরিক ও মনস্তত্বের ট্রেনিং এর ফলেই যে অভিনব একটি টান টান উত্তেজনাময় প্রতিযোগীতায় মাথা ঠান্ডা রেখে শেষ হাসি হাসতে পারে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহই থাকেনা। আর এখানেই হেরে যায় এই অলিম্পিকে সায়না, অখিল, জিতেন্দর, দোলার মত আমাদের অন্যান্য প্রতিভাশালী প্রতিযোগীরা। শ্যুটিং এ নজন কোয়ালিফাই করেও মেডেল সেই একটিই আসে বিন্দ্রার হাত ধরে যার অনুশীলনে সরকারী মেশিনারীর কোনো হাত নেই।
    সরকারী প্রতিনিধিদের মতে যেখানে আমাদের দেশ এখনো প্রতিটি মানুষের মুখের নিত্য খাবার যোগাতে লড়াই করছে, খেলার জন্যে অতিরিক্ত ব্যয় সেখানে বিলাসিতা। আর বিশ্বমানের পর্যাপ্ত সংখ্যক পুল, জিমন্যাসিয়াম, ট্র্যাক, ট্রেনিংএর ব্যবস্থা ছাড়া অলিম্পিকে মেডেল পাওয়া সম্ভব নয়। ক্রীড়ামন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী জনসংখ্যার মাত্র পাঁচ শতাংশ লোকের কাছে পৌঁছে থাকে স্পোর্টসের বিভিন্ন সুযোগসুবিধা। পয়সা ছাড়াও একটি বড় সমস্যা হল প্ল্যানিং এর। ক্রীড়াবিশেষজ্ঞ দের মতে এদেশে সরকারের কোনো লং টার্ম স্পোর্টস প্রোগ্রামই নেই। তবে বর্তমান ও প্রাক্তন অ্যাথলীটরা মনে করেন অর্থের পরিমাণের সমস্যার থেকেও বড় সমস্যা হল বরাদ্দ অর্থের সঠিক সদব্যবহার!

    হ্যাঁ, হয়ত ধনী দেশগুলির মত খরচ আমরা খেলাধূলার খাতে করতে পারিনা কিন্তু কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ তো নেওয়াই যায় যেমন বিভিন্ন খেলাধূলায় অন্তত রাজ্যস্তরের খেলোয়াড়দের বাধ্যতামূলক ভাবে চাকরি প্রদান, অ্যাসোসিয়েশন গুলিকে আর একটু প্রফেশনালি চালানো, দুর্নীতি কম করা ইত্যাদি। বিভিন্ন সংস্থায় যেটুকু ক্রীড়াখাতে বরাদ্দ তারও অনেকটাই যায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ খরচখরচায়। সেটা কম করে, খেলোয়াড়দের ওপরে খরচের বরাদ্দ কি বাড়ানো যেতনা? কোটি কোটি লোকের দেশ থেকে অলিম্পিকে অংশগ্রহনকারী অ্যাথলীটের সংখ্যা মাত্র বাহান্ন। আর অবশ্যই প্রতিবারের মতই কর্মকর্তাদের সংখ্যা সে তুলনায় অনেক অনেক বেশী!

    এবার আমাদের কথা, মানে এদেশের গণদেবতাদের আর বিভিন্ন মাধ্যমের কথা আর কি। ক্রিকেট আমাদের ধ্যান জ্ঞান,দিনের জপ,রাতের স্বপ্ন। জীবনে কোনোদিন ব্যাটবল না ছুঁয়েও এ খেলার সমস্ত কিছু আমাদের বেশীরভাগেরই নখদর্পণে। ফুটবল বা টেনিস ( তাও প্রায়শই দেশের প্রতিযোগীতা নয়! ) নিয়ে কখনো সখনো কেউ কেউ উৎসাহ দেখালেও অন্য সব খেলাই আমাদের কাছে ব্রাত্য। সাধারণ স্কুলে কলেজে খেলাধূলার সুযোগ পর্যাপ্ত নয়। এরই মধ্যে যারা অন্যান্য খেলায় উৎসাহ দেখায় তারাও শেষমেষ পরিকাঠামোর অভাবে সরে যেতে বাধ্য হয়। এছাড়া সাধারণ ছেলেমেয়েদের স্কুলকলেজের পরে রুজির খোঁজে বেরোতে হয় যা খেলা তাদের দিতে পারেনা। যোগ্য ট্যালেন্ট আর প্রতিযোগীতার অভাবে তাই অন্যান্য স্পোর্টস দর্শকদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়।

    অ্যাথলেটিক্স আমাদের দেশে একটি অত্যন্ত অবহেলিত ক্রীড়াবিভাগ, সরকারী দিক দিয়েও আর পাবলিক ইন্টারেস্ট এর দিক থেকেও। দেশে জাতীয় স্তরের প্রতিযোগীতা গুলিতে ফাঁকা গ্যালারিই বলে দেয় সে কথা। জনপ্রিয়তার অভাবই কর্পোরেট সাহায্য থেকে বঞ্চিত রেখেছে এই সব স্পোর্টসকে। সরকারের রাজনীতি, সরকারী বডিগুলির দুর্নীতি, এতো ভারতবর্ষে কোনো নতুন চিত্র নয়, কিন্তু এই যে আম আদমীর মুখ ঘুরিয়ে থাকা, এর দায়িত্ব আমরা এড়াতে পারিনা। একজন ক্রীড়াবিদও অন্য যে কোনো পারফর্মারের মতনই চায় পয়সাকড়ির সাথে সাথে স্বীকৃতি ও প্রশংসা পেতে। টাকাপয়সার থেকেও বড় মোটিভেশন পাবলিক পরিচিতি ও সাপোর্ট। আমরা প্রতিটি অলিম্পিকে সরকারকে, ক্রীড়ামন্ত্রককে তেড়ে সমালোচনা করে আমাদের দায়িত্ব শেষ করে দিই। এর পরের চারবছরে আবার ক্রিকেট ফুটবল (হ্যাঁ হকিও নয় ) ছাড়া অন্য কিছু দেখলেই পাতা উল্টে যাই বা চ্যানেল চেঞ্জ করি। আমাদের দেশে সানিয়া মির্জা যত না তার পোষাক আশাক আর গ্ল্যামারের জন্যে খবরে থাকে তার চেয়ে অনেক কম থাকে তার খেলার জন্যে!

    প্রাথমিকভাবে সোনাজয়ের আনন্দে দেশ মেতে উঠলেও পরবর্তী দিনগুলিতে রাঠোর নারঙ্গ, সানিয়া, লিয়েন্ডারের পরাজয়ে দেশের ক্রীড়ানুরাগীরা ভারতের অলিম্পিকে একাধিক পদকপ্রাপ্তি সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়ে। আর ঠিক এই সময়েই আট দিন পরে ২০ শে আগস্ট একদিনে দুটি ব্রোঞ্জ মেডেল লেখা হল ভারতের নামে। দিল্লীর ও হরিয়ানার দুটি গ্রামের দুই ছেলে অভিনবের সাথে মিলে রেকর্ড করলে অলিম্পিকের আসর থেকে ভারতে প্রথম দুইএর অধিক পদক আনার। সবদিক দিয়ে বিচার করলে এদের নিজ নিজ গ্রামবাসীদের মত আমাদেরও স্বীকার করতেই হয় যে এই ব্রোঞ্জ গুলিও সোনার চেয়ে কম নয়!

    অভিনব এখন আমাদের সুপারহীরো। যেসব মা বাপ আগে ছেলেদের শচীন হতে বলত এখন হয়ত অভিনব হতে বলবে। হ্যাঁ, তার বাবার কোটি কোটি টাকার অর্থবলের কথাটা না বোঝার ভান করেই। বুঝি বা ভাবছে অ্যায়সা দিন নহী রহেগা। এর পরে ক্রিকেটের মত শ্যুটিংএও আসবে কোটি কোটি টাকা। অ্যাডে ধোনি শচীনের বদলে বিন্দ্রা, নারঙ্গ, রাঠোররা। এও হতে পারে কিছুদিন নাচনকোঁদন করে আমরা অভিনবকে ভুলে গিয়ে আবার চারবছরের মত আইপিএলে মেতে যাব। একমাত্র এ দেশেই সম্ভব যে কোনো অলিম্পিকের মেডেলধারী দারিদ্রে, অবহেলায়, বিস্মৃতিতে তার জীবন কাটিয়ে যায়। স্বাধীন ভারতের প্রথম ব্যক্তিগত পদকধারী মহারাস্ট্র রাজ্য পুলিশের কর্মচারী কে ডি যাদব তার শেষবয়স কাটান দারিদ্র্যে, ১৯৮৪ তে একটি পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। পদক জয়ের পরে পরেই তাকে নিয়ে কিছুদিন মাতামাতি চলে তারপরে তিনি মিলিয়ে যান বিস্মৃতির গহ্বরে। রাজ্য পুলিশে তাকে চাকরী দেওয়া হলেও অবসরের মাত্র এক বছর আগে তাকে দেওয়া হয় চাকরীজীবনের প্রথম ও শেষ প্রোমোশন। রাজনীতির ঘুর্ণিপাকে জীবিতকালে কোনো সরকারী সাহায্য বা কোনো পুরস্কার ইনি পাননি কোনোদিন। মৃত্যুর দীর্ঘদিন পরে ১৯৯৩ সালে মহারাস্ট্র সরকার দেয় ছত্রপতি অ্যাওয়ার্ড আর ভারত সরকার তাকে অর্জুন অ্যাওয়ার্ড দেয় ২০০১ সালে। ক্রীড়াবিদদের সম্মানের এই ট্র্যাক রেকর্ডে আর কোন ভারতীয় সাহস করে এ দেশের জন্য অলিম্পিক ট্র্যাকে নামবে? তবু এত বছর বাদে যাদবের একজন উত্তরসূরী এসেছে, সুশীলকুমার, আর আমরা সুযোগ পাচ্ছি আমাদের ভুল শোধরাবার। সুশীলকুমার কে উপযুক্ত মান দিয়ে, দেশে কুস্তির উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিলে আমরা একভাবে কে ডি যাদবকেই তার প্রাপ্য সম্মান দেব ।

    তবু যারা দেশের বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক, তারা একটু সময় নিয়ে দেশের নানা প্রান্তে শহরে গ্রামে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন খেলা ভালবাসা খেলায় উৎসর্গীকৃত প্রাণগুলির কথা জানবে ভাববে। সেইসব খেলোয়াড়রা যারা অপ্রচলিত, আনপপুলার খেলাকে ভালবেসে সাদামাটা জীবন ছেড়ে সংগ্রামের জীবন বেছে নিয়েছে। আর সেইসব দ্রোণাচার্যরা ( সত্যিকারের, সরকারী নয় ) যাদের কেউ কেউ হরিয়ানার অখ্যাত শহরে বক্সিং ক্লাব পত্তন করে সেখানে একাধিক অলিম্পিকের বক্সার তৈরী করে। সেই ক্লাবে বক্সারদের প্রাকটিসের পর্যাপ্ত গ্লাভস নেই, প্র্যাকটিস শেষে খাবার জলের জন্য ভরসা একটিমাত্র হ্যান্ডপাম্প, তবু তাদের চোখে স্বপ্ন দেশের জন্য পদক আনবার। তাদের সাথে আছে ভিওয়ানির অসংখ্য বাসিন্দা যাদের উৎসাহে এই ছোট্ট শহর ভারতের বক্সিং হাব, অলিতে গলিতে কোচ, ক্লাব। ঘরে ঘরে এদের ছেলেদের জন্য বক্সিং ক্লাবে অ্যাডমিশন, স্কুলে অ্যাডমিশনের মতই জরুরী। আর তাই আজ সেখান থেকে তিনজন সদস্য অলিম্পিকে কোয়ার্টার ফাইন্যাল অবধি গিয়েছে, একজন পদকের অধিকারী। এরপরেও কি বিদ্বজনেরা বলবে শুধুমাত্র টাকার অভাবই আমাদের দেশে বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরীর পথে অন্তরায়!

    একা অভিনব নয়, সুশীল ও বিজেন্দর এরা দুজনেও ফিল্ডে যে ধৈর্য্য ও সংযম দেখিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা সামাজিক স্তরের মানুষ হয়েও একই ধরনের মানসিকতার অধিকারী। এরা হচ্ছে আজকের ভারতীয় তরুণ সমাজের নতুন মুখ। খেলা শুধু মানুষের নিছক বিনোদনের উপকরণ নয়, খেলা সমাজের, জাতির চরিত্রগঠন করে। আমাদের দেশে প্রতিভার অভাব নেই তাতো এতেই বোঝা যায় যে বক্সিং ও কুস্তির মত তথাকথিত গ্রামীণ ক্রীড়াতেও আমরা একাধিক বিশ্বমানের খেলোয়াড় পাচ্ছি কোনো উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়াই। জয়ের পর এদের সবার বক্তব্যও প্রায় একই। এরা আশা করে, এদের সাফল্য এনে দেবে দেশে অলিম্পিক স্পোর্টস এর জন্য আরো সুযোগসুবিধা, সরকারের আরো মনোযোগ, যাতে আরো বেশী সংখ্যক প্রতিভাশালী খেলোয়াড়রা সামনে আসতে পারে। এছাড়া তিনজনেরই মতে, এই পদকপ্রাপ্তি যদি দেশে অলিম্পিক স্পোর্টসের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করে তাহলেই হবে এই জয় সার্থক। আর আমরা, অন্য পুরস্কার না দিতে পারি, এদের কথা ভেবে এদের জন্য, দেশের জন্য, চেষ্টা করলে নিজেদের ক্রীড়াপ্রেমের পরিধিটা আর একটু বাড়াতে পারিনা কি?

    ২৪ আগস্ট, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ২৪ আগস্ট ২০০৮ | ৬৩১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন