
বন্ধুদের সম্পর্কে কিছু লিখতে বড্ড দ্বিধা হয়। লিখব লিখব করেও লিখতে পারি না। প্রতীকদা, প্রতীক বন্দ্যোপাধ্যায় তো আমার বন্ধুই, দাদার মতো বন্ধু। কিন্তু খুব বড় কোনও সংকটের সময় কোনও কোনও বন্ধু কেবল আমার বন্ধু হয়ে থাকে না, সময়ের সাহসী সন্তান হয়ে যায়। একটা গোটা সময়ের প্রতিস্পর্ধার সঙ্গে সে নিজেকে জুড়ে নেয়। করোনা- লকডাইন- ছাঁটাই- ক্লোজারের এই বিচ্ছিরি সময়ে প্রতীকদাও ঠিক সেটাই করেছে। অসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে পা বাড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই অনেকে জেনে গিয়েছেন ওর কথা। কিন্তু তাও লিখতে ইচ্ছে হল।
প্রতীকদা একটা সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে বেশ উচ্চপদে কাজ করত। ভারতের সর্বাধিক বিক্রিত ওই দৈনিকে পূর্ব ভারতের রিজিওনাল স্পোর্টস ডেস্কের দায়িত্বে ছিল। অনেক দিনের চাকরি। বেশ মোটা মাইনে। লকডাউনের আগে থেকেই প্রতীকদা আঁচ পাচ্ছিল, কোম্পানির মতিগতি ভাল নয়। ছাঁটাই শুরু হবে। টুকটাক কথাও হচ্ছিল এই নিয়ে। ওর টিমটা ছোট, ৫ জনের টিম। টিমের প্রত্যেকের সঙ্গে ওর সম্পর্ক 'বস' নয়, বন্ধুর। প্রতীকদা বুঝতে পারছিল, যে কোনওদিন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা এইচ আর থেকে ফোন আসবে। টিম থেকে কাকে ছাঁটাই করা যায়, তার নাম চাওয়া হবে। আর তখনই, লকডাউন চলার মধ্যেই, ও ঠিক করে ফেলেছিল, ওর হাত দিয়ে একটিও ছাঁটাই হবে না। একটিও না। যদি কোনও নাম দিতেই হয়, তাহলে প্রথম নামটাই হবে ওর নিজের।
কিন্তু কেন? প্রতীকদার যুক্তি স্পষ্ট, "আমি আমার টিমের প্রত্যেকের আর্থিক অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানি। কেউ পরিবারের একমাত্র রোজগেরে, কারও বাবা গুরুতর অসুস্থ, চিকিৎসার খরচ বিপুল। কেন ওদের নাম দেব! আমাদের এই ছোট্ট টিমে আমার আর্থিক অবস্থাই সবচেয়ে ভাল। বাচ্চাটা একদম ছোট, পড়াশোনার খরচ আছে ঠিকই, কিন্তু আমার স্ত্রী সরকারি স্কুলে চাকরি করেন। খরচ একটু কমালে, বুঝেশুনে চললে ঠিক ম্যানেজ হয়ে যাবে। আর যাই হোক, ডাল-ভাতের অভাব হবে না।" বলা বাহুল্য, প্রতীকদার স্ত্রী, আমার দিদির সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল এই সিদ্ধান্তে।
অবশেষে দিনটা এসেই গেল। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ প্রতীকদার টিমের সবচেয়ে 'খারাপ পারফর্মার'-এর নাম জানতে চাইলেন। বলা হল, কোম্পানির অবস্থা ভাল নয়, লোক না কমালে উপায় নেই। রিজিওনাল স্পোর্টস টিম থেকে অন্তত একজনকে না ছাঁটাই করলে চলবে না। জবাবে প্রতীকদা সরাসরি জানিয়ে দিল, যদি ছাঁটাই করতেই হয়, তাহলে প্রথম ছাঁটাইটা তাকে দিয়েই হোক। ওর হাত দিয়ে কোনও সহকর্মীর নাম ছাঁটাই-এর জন্য যাবে না। একজনের নামও নয়। কোম্পানি তো অবাক! এই রকম 'বস' তো তারা আগে দেখেনি তেমন৷ দেখার কথাও নয়। ফলে শুরু হল নানা রকম ভাবে বোঝানো। কোম্পানির বড়কর্তারা কতটা মানবিক, কর্মীদের তাঁরা কতটা ভালবাসেন, তার লম্বা ফিরিস্তি। কিন্তু প্রতীকদা তার নিজের সিদ্ধান্ত অটল। ও কোনও বিপ্লব করছে না, বিদ্রোহ করছে না, কেবল স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছে, ওর হাত দিয়ে কারও চাকরি যাবে না। কিছুতেই নয়।
দফায় দফায় বিভিন্নজনকে দিয়ে কথা বলিয়েও যখন কিছু লাভ হল না, তখন কোম্পানি প্রতীকদার রেজিগনেশন অ্যাকসেপ্ট করা নিয়ে টালবাহানা শুরু করল। বলল, ইস্তফা গ্রাহ্য হবে না। পরিবর্তে ওকে টার্মিনেট করা হতে পারে। সে সব অনেক কথা। এখানে বিশদে যাচ্ছি না। অবশেষে প্রতীকদার রেজিগনেশন অ্যাকসেপ্ট করেছে ওই বিখ্যাত সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক। প্রতীকদা এখন মুক্ত বিহঙ্গ। বলছে, নিজের মতো লেখালিখি করবে। ইতিমধ্যেই নিজের ব্লগে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছে। টানটান লেখা। বন্ধুরা পড়ে দেখতে পারেন। বলা হয়নি, পেশায় সাংবাদিক হলেও প্রতীকদা নেশায় সাহিত্যকর্মী। অসম্ভব ভাল লেখে- কবিতা তো বটেই, গদ্যের হাতটাও বড্ড টানটান।
খুব বড় কোনও মিডিয়া এই বিষয়টা নিয়ে লেখেনি, লেখার কথাও নয় তাদের। ছোট, মাঝারি কিছু অনলাইন মিডিয়া খবর করেছে। একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে লেখাগুলো।
এই সময়টা অদ্ভুত। এমন অনেককিছু চারপাশে ঘটে চলেছে, যা হয়তো ঘটার কথা ছিল না। এমন অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়ে যাচ্ছে, যাঁদের সঙ্গে হয়তো আলাপ হত না কোনওদিন। চোখের সামনে বদলে যাচ্ছেন মানুষ। পাহাড়ের মতো বড় হয়ে যাচ্ছেন কেউ, কারও ওজন হয়ে যাচ্ছে পাখির পালকের মতো হাল্কা।রাস্তাঘাট, চেনা শহর, পরিচিত মুখ- বদলে যাচ্ছে সবকিছুই। অন্ধকার বাড়ছে। তাই প্রতীকদার মতো আকাশপ্রদীপদের পাশে পাশে থাকাটা জরুরি।
আলো মানুষ। ভাল মানুষ।
প্রতীকবাবুর ব্লগের URL টা দেবেন প্লিজ!
ar | 96.23.***.*** | ২০ জুলাই ২০২০ ১৯:১৫95372
রত্না দাস | 2402:3a80:a97:2974:268a:5d8e:b19d:***:*** | ২০ জুলাই ২০২০ ১৯:২৬95374একরাশ শুভেচ্ছা রইলো... এমন মানুষের জন্য।
ar | 96.23.***.*** | ২০ জুলাই ২০২০ ২০:২০95375
দেবাশীষ চৌধুরী ডায়মন্ড হারবার | 59.94.***.*** | ২০ জুলাই ২০২০ ২০:৪৮95377শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে এল। প্রতীকবাবু আমার নমস্কার গ্রহণ করবেন।
হিমজা চক্রবর্তী | 223.226.***.*** | ২০ জুলাই ২০২০ ২০:৫৪95378ব্লগ এর লিঙ্ক টা দিন । ওনাকে অনেক ধন্যবাদ
গবু | 2402:3a80:aa6:f646:33bd:285d:24e3:***:*** | ২১ জুলাই ২০২০ ০০:১৩95384