বসুমতী পত্রিকা লিখেছিল, 'কংগ্রেসের খেলাঘর যেখানে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে, সুরেন্দ্রনাথের মতো রাজনৈতিক নেতা এতদিন ধরে যে জাতীয় ঐক্য আনতে ব্যর্থ হয়েছেন, মোহনবাগানীরা খেলার মাধ্যমে সেই ঐক্যসূত্র তৈরি করেছে।'
সাহেবদের কাগজ দ্য ইংলিশম্যান লিখেছিল, 'কংগ্রেস ও স্বদেশীওয়ালারা এতদিনের চেষ্টায় যা পারেননি, নেটিভদের চোখে ইংরেজদের অপরাজেয়তার সেই মিথ চুরমার করে দিয়েছে মোহনবাগান।'
দ্য মুসলমান পত্রিকা লিখেছিল, "...ভারতীয়রা যে কারও চেয়ে কম নন, মোহনবাগান তা প্রমাণ করেছে।... যদিও মোহনবাগান বাঙালি হিন্দুদের নিয়ে গঠিত দল, কিন্তু তাদের সাফল্য প্রকৃতপক্ষে সর্বজনীন।.. এই জয়ের খবরে মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাবের সদস্যরা আনন্দে প্রায় পাগল হয়ে যান এবং আত্মহারা হয়ে মাঠিতে গড়াগড়ি দিতে থাকেন।"
দ্য এম্পায়ার লিখেছিল, "এগারোজন ফুটবলার কেবল নিজেদের মহিমান্বিত করেননি, তাঁরা তাঁদের মহান জাতির বিজয়পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন।"
দ্য স্ট্যান্ডার্ড সাইকেল কোম্পানি ফাইনাল খেলার দু'দিন পরের অমৃতবাজার পত্রিকার সঙ্গে বিজয়ী মোহনবাগান দলের প্রায় লাখখানেক ছবি বিলি করেছিল। দ্য হ্যাল্ড অ্যান্ড চ্যাট তাদের তৈরি করা হারমনিয়ামের উপর মোহনবাগানের সম্মানে ১০ শতাংশ ছাড় ঘোষণা করেছিল।
সেই সময়ের বিপুল জনপ্রিয় দ্য গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার তাদের নাটক 'বাজিরাও'-এর প্রচারে মোহনবাগানের নাম ব্যবহার করা শুরু করে : Mohun Bagan has won the Shield! It is a victory for Baji Rao!
শিল্ড ফাইনালের পর গুজব রটে গিয়েছিল মোহনবাগানকে দেশীয় রাজণ্যবর্গ বিপুল অঙ্কের অর্থ উপহার দিতে চলেছেন। 'মোহনবাগান চ্যালেঞ্জ শিল্ড' নামে টুর্নামেন্ট শুরু করার প্রস্তাবও হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অমৃতবাজার রীতিমতো লেখালিখি শুরু করে এই নিয়ে। উত্তর কলকাতায় মোহনবাগানের নামে একটি বড় পার্ক তৈরির বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। টাউন হলে ফুটবলারদের সম্বর্ধনা দেওয়ার কথাও ওঠে। বেঙ্গলী পত্রিকা রীতিমতো চাঁদা তুলে মোহনবাগানকে পুরস্কার প্রদানের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ক্লাব কর্তৃপক্ষ কাগজে বিবৃতি দিয়ে জানান, তাঁরা এসবে একেবারেই আগ্রহী নন।
২৯ জুলাই, ১৯১১ ভারতীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় জলবিভাজিকা। এর চেয়ে বড় সাফল্য আর নেই, আগামীতেও হবে না কখনও। ভারত বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলেও তা শিবদাস ভাদুড়ীদের গৌরবকে স্পর্শ করতে পারবে না। মোহনবাগানের শিল্ড জয় গোটা জাতির চেতনায় যে নতুন স্পন্দন এনে দিয়েছিল, উপমহাদেশের ক্রীড়াজগতে তার তুলনা নেই।
অথচ টুর্নামেন্টের শুরুতে মোহনবাগানকে কেউ তেমন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু সেন্ট জেভিয়ার্সকে ৩-০, রেঞ্জার্সকে ২-১, রাইফেল ব্রিগেডকে ১-০, মিডলসেক্সকে ৩-০ গোলে হারিয়ে সবুজ মেরুন যোদ্ধারা গোটা বাংলা জুড়ে অভূতপূর্ব উন্মাদনা সৃষ্টি করলেন। ফাইনাল খেলার তারিখ ২৯ জুলাই ছিল শনিবার। তার আগেই হাওয়া গরম হতে শুরু করে। দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া ইলাসট্রেটেড উইকলি লিখছে, "বৃহস্পতি এবং শুক্রবার সর্বত্র বাঙালিরা মাথা উঁচু করে সগর্বে চলাফেরা করছিলেন। ট্রামে, অফিসে, রাস্তার মোড়ে- সর্বত্র বাঙালিবাবুদের আলোচ্য বিষয় কেবল মোহনবাগান। খালি পায়ে খেলে বাঙালি ছেলেদের বুট পায়ে দেওয়া ব্রিটিশ সৈন্যদের হারিয়ে দেওয়া গল্প।" অন্যদিকে ইংরেজরা একেবারেই ভাল চোখে দেখেননি মোহনবাগানের এই আচমকা উত্থান। ৪ অগস্টের হিতবাদী পত্রিকা জানাচ্ছে, সেমিফাইনালের দিন সন্ধ্যায় একই ট্রেনের বগিতে ভ্রমণরত একজন ভারতীয় খ্রিস্টান সরল মনে ইংরেজ সহযাত্রীর কাছে খেলার ফল জানতে চান। উত্তরে ইংরেজটি ওই ভারতীয় ভদ্রলোকের গালে সজোরে একটি চড় কষিয়ে দেন।
২৯ জুলাই। শনিবার। সকাল থেকেই কলকাতার সব রাস্তার গন্তব্য ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব। ফুটবলে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ যেন সেদিন। সুদূর পাটনা, পূর্ণিয়া, কিষাণগঞ্জ, ঢাকা, অসম, বরিশাল, নাটোর, বর্ধমান, মেদিনীপুর, মানভূম থেকে হাজার হাজার মানুষ খেলা দেখতে চলে এসেছেন কলকাতায়। বিপুল দর্শক সমাগমের কথা ভেবে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে খেলার দিন বর্ধমান এবং নদীয়া থেকে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করে। বরানগর ও রাজগঞ্জ থেকে অতিরিক্ত স্টিমার চলাচলের ব্যবস্থাও হয়। কিন্তু তাতে আর কত লোক ধরে! বেলা বাড়তেই রাজপথে শুধু কালো মাথার সারি। ট্রামে পা রাখার জায়গা নেই৷ গোটা মধ্য কলকাতায় বিপুল যানজট। খবরের কাগজ বলছে, সকাল এগারোটার মধ্যেই মাঠের চারপাশে প্রায় হাজার দশেক লোক। লালবাজারের পুরনো নথি ঘাঁটতে গিয়ে দেখছি, দুপুরে পর মোট জমায়েতের সংখ্যাটি প্রায় দু'লক্ষ! তবে ময়দানে সেদিন ছিলেন আশি হাজার থেকে এক লক্ষ মানুষ।
এই প্রথম ময়দানে টিকিট নিয়ে কালোবাজারি হল! একটা দু'টাকার টিকিটের দাম পৌঁছেছিল ১৫ টাকায়! ৫০ পয়সা থেকে দু'টাকায় মাঠের দু'ধারে দাঁড়িয়ে খেলা দেখার জন্য বাক্স, টুল, টেবিল, চেয়ার, পাটাতন, ইট ভাড়া দিলেন জোগানদারেরা। পাইওনিয়ার পত্রিকা জানাচ্ছে, একটা সিদ্ধ আলু ১ পয়সা, একটা পান এক আনায় বিক্রি হচ্ছিল দুপুর পর্যন্ত।
ক্যালকাটা মাঠের একদিকে সভ্যদের আসন, অন্যদিকে বি এইচ কোম্পানির চেয়ার পাতা। সেদিকে সাহেবসুবোদের জমায়েত। তাদের হাতে হাতে ঘুরছে কাগজের তৈরি শিল্ড আর মোহনবাগানের কুশপুতুল। মাঠের বাকি দু'টো দিক খোলা। সেখানে জনসমুদ্র। ঢেউয়ের মতো দুলছে, কাঁপছে, আবেগে ফেটে পড়ছে কালো মাথার ভিড়। সবুজ মেরুন পতাকা বাতাসে টানটান- গাড়ির ছাদে মানুষ, বাক্সের উপর মানুষ, পিপের উপরে মানুষ, গাছের ডালে ডালে ঝুলছে মানুষ। যে দিকে চোখ যায় কেবল মানুষ আর মানুষ। ক্ষুদিরাম বসুর দেশের মানুষ, প্রফুল্ল চাকির দেশের মানুষ, পি মিত্র আর অরবিন্দের দেশের মানুষ।
রয়টার-এর সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, এই বিপুল জনতার অধিকাংশই খেলার প্রায় কিছুই দেখতে পাননি। গাছের উপরে যাঁরা ঝুলছিলেন, তাঁরাই চিৎকার করে বলে দিচ্ছিলেন ফলাফল। সঙ্গে ছিল ঘুড়িতে গোলের সংখ্যা লিখে উড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। আর দ্য এম্পায়ার পত্রিকা ক্যালকাটা মাঠে একটা অস্থায়ী টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বসিয়ে সারা কলকাতায় ফলাফল জানানোর ব্যবস্থা করেছিল।
খেলা শুরু হল। শুকনো খটখটে মাঠ। সুধীর চ্যাটার্জি বাদে মোহনবাগানের সকলেই খালি পায়ে খেলছেন। প্রবল উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে গোটা চত্বর। চিৎকার চেঁচামেচিতে রেফারির বাঁশির আওয়াজ শোনা দায়। সাহেবদের দাপট বেশি থাকলেও পাল্লা দিচ্ছে মোহনবাগান। শিবদাস, বিজয়দাস, হাবুল, কানুরা খেলার গতি একটু কমিয়ে দিয়েই ফের আক্রমণে উঠছেন। সুযোগও তৈরি হচ্ছে গোলের। কিন্তু আচমকাই ইস্ট ইয়র্কসের জ্যাকসনের জোরাল ফ্রি-কিক একটু ডানদিকে বাঁক নিয়ে গোলে ঢুকে গেল। ০-১ পিছিয়ে পড়ল মোহনবাগান। গ্যালারির উত্তরদিকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল মোহনবাগানের কুশপুতুল। নেটিভদের গ্যালারি স্তব্ধ। পিনপতনের শব্দ নেই। আকাশে উড়ল কালো ঘুড়ি, তাতে লেখা ইস্ট ইয়র্কস ১, মোহনবাগান ০।
হাফ টাইমের পর মোহনবাগান নতুন উদ্যমে আক্রমণ চালাল। রাজেন সেনগুপ্ত, অভিলাস ঘোষ ড্রিবল করে সমস্যায় ফেলে দিলেন ব্রিটিশদের। মিনিট কুড়ি প্রবল চাপ তৈরির পর শিবদাসের জোরাল শটে গোল পেয়ে গেল মোহনবাগান! বাঙালির দল, বাংলার দল গোল শোধ করে দিয়েছে! বাঙালির চিৎকারে কেঁপে উঠল ময়দান। আকাশে উড়ল নতুন ঘুড়ি- ইস্ট ইয়র্কস ১, মেহনবাগান ১। আরও চাপ বাড়াল সবুজ মেরুন। আক্রমণের পর আক্রমণ। খেলা শেষ হতে যখন মিনিট দু'য়েক বাকি শিবদাসের পাস থেকে বল পেয়ে শরীরের দোলায় দু'জনকে কাটিয়ে ভীমবিক্রমে বলশুদ্ধ গোলের ভিতরে ঢুকে গেলেন অভিলাস ঘোষ! গোওওওল! সঙ্গে সঙ্গে যেন বিস্ফোরণ হল কলকাতায়। লাখো বাঙালির চিৎকারে কেঁপে উঠল ধর্মতলা। মাঠের ভিতরে বাইরে শুরু হয়ে গেল ছাতা, জামা, জুতোর বৃষ্টি। সেই সঙ্গে উন্মাদের মতো নাচ আর চিৎকার। নিজেদের গায়ের জামা টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে আকাশে উড়িয়ে দিল লোজে। আকাশে আবার উড়ল সবুজ মেরুন ঘুড়ি। এবার মোহনবাগানের জয়ের খবর নিয়ে। মোহনবাগান কি জয় স্লোগানের সঙ্গে মিশে গেল বন্দেমাতরম। হ্যাঁ, বন্দেমাতরম। যে স্লোগান দেওয়ার অপরাধে কিছুদিন আগে ১৫ ঘা বেত খেতে হয়েছিল কিশোর সুশীল সেনকে। বেত মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিংসফোর্ড। ২৯ জুলাই, ১৯১১- কিংসফোর্ডকে হারিয়ে দিয়ে জিতে গেলেন সুশীল সেন।
সারা কলকাতা সেদিন আনন্দে প্লাবিত। আলোয় আলোময়। কেবল অন্ধকারে ডুবে ছিল সাহেবপাড়া। লালবাজারের নথি বলছে, চৌরঙ্গী এলাকা অন্ধকার, পার্ক স্ট্রিট নিস্তব্ধ। এমনকি সাহেবপাড়ার অধিকাংশ দোকান ঝাঁপ খোলেনি সেদিন সন্ধ্যায়। সান্ধ্যভ্রমণে বেরোননি কোনও সাহেব-মেম। গোটা সাহেবপাড়ায় যেন নেমে এসেছিল শোকের ছায়া।
বিকেলের পর বিরাট বড় একটা ঘোড়ার গাড়িতে চেপে শহর পরিক্রমা করতে শুরু করলেন বিজয়ী যোদ্ধারা। জায়গায় জায়গায় উড়ে এল ফুলের পাপড়ি আর মালা। ধর্মতলার মোড়ে মসজিদের সামনে ব্যান্ড-পার্টি নিয়ে হাজির মুসলমানেরা। শোভাযাত্রার সামনে ব্যান্ড বাজাতে বাজাতে তাঁরা এগোলেন। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধে হয়ে গেল। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠল সন্ধ্যাপ্রদীপ, বেজে উঠল শঙ্খ। রাস্তার দু'পাশের বারান্দা থেকে মহিলারা উলু দিতে শুরু করলেন। লাখো মানুষ ভালবাসা মেখে শোভাযাত্রা পৌঁছল শ্যামবাজারে। ক্লাব সম্পাদক শৈলেন বসুর বাড়িতে। সেখানেও তখন হাজার হাজার মানুষের ভিড়। পরের দিনও দলে দলে শিল্ড দেখতে লোক ভিড় করলেন শৈলেনবাবুর বাড়িতে। বহু মেসে, ছাত্রাবাসে, ক্লাবে আয়োজন হল আনন্দ উৎসবের৷ শৈলেন বসু নিজেও আয়োজন করেন বিশাল ভোজের। সঙ্গে ছিল গানের আসর, ম্যাজিক, থিয়েটার, আরও কত কী! তবে এসব তো দরবারি উদযাপন। আসল উৎসব হয়েছিল বাংলার গ্রাম, শহরে, মফস্বলে, কলেজে কলেজে, রাস্তায় রাস্তায়। সেই উদযাপন ছিল জনতার নিজস্ব উৎসব।
২৯ জুলাই-এর মৃত্যু নেই। ২৯ জুলাই অমর। যতদিন ভারতে ফুটবল খেলা হবে, ততদিন ২৯ জুলাই বেঁচে থাকবে৷ যতদিন আমাদের স্মৃতিতে পরাধীনতার দুঃসহ ইতিহাস বেঁচে থাকবে, ততদিন রয়ে যাবে প্রতিস্পর্ধী ২৯ জুলাই। ২৯ জুলাই মুফতে আসেনি, এর জন্য দাম দিতে হয়েছিল অনেক। সাহেবরা এই অপমানের বদলা নিতে ছাড়েনি৷ পরের দু'টো দশক তাই ফুটবলের মাঠে ভারতীয়দের সহ্য করতে হয়েছে অনেক বঞ্চনা আর অপমান। তারপর এসেছে তিরিশের দশকের আশ্চর্য মহামেডান স্পোর্টিং। তারও পরে এসেছে দুরন্ত ইস্টবেঙ্গল। কিন্তু প্রথম আলোকবিন্দুটি ২৯ জুলাই। তার লয় নেই, ক্ষয় নেই।
২৯ জুলাই অমর হোক। সকলকে মোহনবাগান দিবসের শুভেচ্ছা।
সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল,
সব দলের সেরা আমাদের ইস্টবেঙ্গল!!!!