এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • লকডাউন : দক্ষিণ কলকাতার না-মানুষদের সঙ্গে কথাবার্তা

    অর্ক ভাদুড়ী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০২ মে ২০২০ | ৩৫১৫ বার পঠিত

  • আমি যেখানে থাকি, তার আশেপাশে প্রচুর গাছপালা আর পাখি। লকডাউনের সময় প্রতিদিন পাখির কিচিরমিচির শুনে ঘুম ভাঙছে। আগে কিন্তু এমনটা হত না কখনও। রোজ সকালেই দেখি, ব্যালকনি দিয়ে বেশ কয়েকটা পাখি ঢুকে পড়ছে ঘরে। হুটোপুটি করছে। ফ্যান বন্ধ করে দিতে হয় তখন। বেশ লাগে। সেদিন গাছে জল দিতে গিয়ে দেখলাম, একটা ছোট্ট চড়াই জানলার গ্রিল টপকে ঢুকে পড়েছে। বইপত্তরের উপরে বসে একদৃষ্টিতে গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটা বিস্কুটের টুকরো দিতে গেলাম, ঝটপট করে পালিয়ে গেল।


    চারপাশে শব্দ বেশ কমে গিয়েছে। এমন অনেক কিছু কানে আসছে, যেগুলো আগে তেমন ভাবে শুনতে পেতাম না। কাছাকাছি কোনও মসজিদ নেই, কিন্তু কোথা থেকে কে জানে, প্রতিদিন, আজানের শব্দ ভেসে আসছে। কোন মসজিদ তা তো বোঝার উপায় নেই, কিন্তু আমি মনে মনে একটা চেনা মসজিদকে ভেবে নিই। ছোট্ট একটা মসজিদ, পাশেই মাজার। মাজারে ঢোকার মুখে, ডানদিকে, একটা টুলের উপর বাক্স রাখা থাকে। খয়েরি রঙের বাক্সটার গায়ে লেখা- প্রণামী।



    করোনার সময়টা বড় অদ্ভুত। অনেককিছু হয়তো একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে। কিছুদিন পরে আরও বেশি করে বদলাবে নিশ্চয়। সংকট আরও তীব্রতর হবে বলে মনে হচ্ছে। হয়তো আরও অনিশ্চিত, বিপদসংকুল হবে জীবন। সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে নতুন সম্ভাবনাও কি দেখতে পাব কিছু? সেদিন খুব বৃষ্টি হল রাতে। ব্যালকনি থেকে মনে হল, গলার ভিতর ধোঁয়ার গন্ধমাখা জাল। ফেলে আসা উনুনের ধোঁয়া। সারা শরীরময় অজস্র ঠিকানা লেখা যেন। অথচ বৃষ্টির ছাঁট মাখতে মাখতে মনে পড়ল, কোথায় যেন পড়েছিলাম, কেবল বাড়ি থেকে বেরনো এবং ফিরে আসা কোনও স্বাভাবিক মানুষের গন্তব্য হতে পারে না। অব্যবহিত সম্পর্ক এবং প্রয়োজনগুলোকে জুড়লে যে রেখা তৈরি হয়, তা দিয়ে দেশ, কাল, মানুষ ও প্রকৃতিকে ধরা অসম্ভব। কোথায় পড়েছিলাম মনে নেই৷ আদৌ পড়েছিলাম কি?


    ব্যালকনি বলতে মনে হল, এই দেশের অধিকাংশ মানুষের কোনও ব্যালকনি নেই। তাঁরা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে লকডাউনের নিঝুম মাঝরাত্তিরে বৃষ্টি দেখেন না। সে কথা থাক।




    এই এলাকায় একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে। অন্য কোথাও হচ্ছে কিনা জানি না। নিশ্চয় হচ্ছে। এখানে কিছু কুকুর ছিল, যারা আবর্জনা, জঞ্জাল খেয়ে বাঁচত। কিন্তু পুরসভা এখন আশেপাশের খোলা ভ্যাটগুলোয় আর ময়লা ফেলতে দিচ্ছে না। লোকে ফেলছেও না তেমন। রাস্তাঘাট বেশ পরিচ্ছন্ন থাকছে। সকালবেলায় বাঁশি বাজানো ময়লাগাড়ি সব ময়লা তুলে সেই বড়রাস্তার ওইদিকের বিরাট বড় ক্রেনের মতো মুখওয়ালা ভ্যাটে ফেলছে। ফলে আবর্জনা খুঁটতে দেখতাম যে কুকুরদের, তারা সম্ভবত এখন আর প্রয়োজনমতো খাবার পাচ্ছে না। প্রায়শই দেখি, একটা বা দু'টো বেড়ালের আধখাওয়া মৃতদেহ। বেশিক্ষণ থাকে না অবশ্য। মাস্ক-গ্লাভস পরা পুরসভার সাফাইকর্মীরা লাশ নিয়ে চলে যান।


    মড়ক কি অভ্যাস বদলে দেবে আমার, আমাদের? অবশ্য আমি গত কয়েকদিনে বেশ কিছু রোগা হয়ে যাওয়া কুকুরদেরও দেখেছি। তবে রোগা মানুষ আমি এখনও দেখিনি।


    সেদিন ভিডিও দেখলাম, আগ্রা শহরের রাস্তায় অনেকখানি দুধ। একদল কুকুর জড়ো হয়ে সেই দুধ চাটছে। চেটে চেটে দুধ খাওয়া কঠিন, চুমুক দিয়ে খাওয়া সহজ। তাই একজন মানুষ রাস্তায় হাত ঘষে ঘষে একটা পাত্রে সেই দুধ ভরছিলেন। আমি শুনেছি মানুষ কুকুরের চেয়ে উন্নত জীব। কুকুর নিশ্চয় মানুষের মতো করে চুমুক দিতে পারে না। চুমুক দিয়ে দুধ খাওয়া সহজ।




    আশেপাশের মানুষজনের খবরাখবর নিতে ইচ্ছে করে মাঝেমধ্যে। এমন সব মানুষ, যাঁরা ফেসবুকে নেই। অথবা থাকলেও আমার বন্ধুতালিকায় নেই। সেদিন সকালে জরুরি প্রয়োজনে থানায় যেতে হয়েছিল। বহু বছরের চেনা থানা। কলেজবেলার ঘেরাও, বিক্ষোভ থেকে শুরু করে মোবাইল বা দরকারি কাগজপত্র হারিয়ে ডায়েরি করা, মাঝে কয়েক বছর খবর সংগ্রহ করতে যাওয়া, তারপর রিসার্চের প্রয়োজনে যেতে যেতে কেমন যেন চেনা অফিসের মতো হয়ে গেছে। বড্ড ভিড় থাকে সব সময়। বিরক্তিকর। সেদিন গিয়ে দেখলাম, সব শুনশান, খাঁ খাঁ করছে। চুরি, পকেটমারি যাঁরা করেন, তাঁদের অনেকেই চেনা মুখ। পরিচিত পুলিশ আধিকারিককে জিজ্ঞেস করলাম তাঁদের খবর। হাসলেন। সব বন্ধ। জানলাম, যে বাচ্চা আর তাদের মায়েরা আগে কাগজ কুড়োতেন, তাঁরা লকডাউনের শুরুর দিকে টুকটাক চুরি করতে শুরু করেছিলেন। ছোটখাটো চুরি। বাসনপত্র, বন্ধ দোকানের মাল- এইসব। কয়েকজনকে ধরেও এনেছিল পুলিশ। তারপর দেখা গেছে, এক-দু'দিনের পর চুরি আর তেমন হচ্ছে না। কী হবে চুরি করে? বিক্রি করার পরিসর এক্কেবারে কমে গেছে। তাহলে উপায়? উপায় নেই। শুনলাম, যৌনকর্মীদেরও প্রায় একই অবস্থা। খদ্দের নেই। রোজগার বন্ধ।




    আমার আস্তানা থেকে একটু দূরে একটা বস্তি রয়েছে। আমার বন্ধুরা প্রতি সপ্তাহে সেখানে চালডাল বিলি করছেন। সময়সুযোগ মতো আমিও ভিড়ে যাই তাঁদের সঙ্গে। ডাক্তারবন্ধুরা থাকেন, ঝুঁকি এড়িয়ে যতটুকু কথাবার্তা বলা যায়, বলি। বস্তিতে থাকেন অনেক চেনা রিকশচালক, ছোট দোকানদার, ইস্ত্রিওয়ালা। আরও হরেক মানুষ। প্রায় কারও রোজগারপাতি নেই এখন। তবে কৌতুক এখনও মরেনি। শুনলাম, বস্তির যাঁরা পকেটমারি করতেন, বা ছোটখাটো চুরি, তাঁরাও সব একদম ঘরে বসে আছেন।এখন তো আর লেবার খাটার সুযোগও নেই। পেটে তালা। হরিমটর। আশেপাশের মানুষজন, পড়শিরা দুঃশ্চিন্তার মধ্যেও হাসছেন ওঁদের নিয়ে। ওঁরাও এলেন, প্যাকেট নিলেন। খুবই ব্যাজার মুখ। আজ সকালেও গেছিলাম ওই বস্তিতে। একজন সিনিয়র মানুষের সঙ্গে দেখা হল, বছর ষাটেক বয়স, আগে সিনেমার টিকিট ব্ল্যাক করতেন, পরে পকেটমারিতে ঢোকেন। মানুষটি চমৎকার, হেল্পফুল। এককালে শখ ছিল মিঠুন হবেন, হয়নি। শুনলাম, গত সপ্তাহের রবিবার ওঁর একমাত্র মেয়ে মারা গেছে৷ বিয়ের কথা চলছিল, প্রেম করে বিয়ে। কাউন্সিলর সহৃদয়। লোকাল লোকজনকে দিয়ে সামান্য টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যদি কাজেকম্মে লাগে৷ একটা বিড়ি ধরিয়ে বললেন, 'এটা মাল খাওয়ার টাইম। এখনই মাল খেতে হয়। বউ আগেই মরে গেছিল, এবার মেয়েও গেল। একাবোকা লোক, মাল খাব না? কিন্তু হচ্ছে কই! টাকা নেই, পয়সা নেই, মালের চিন্তা করলে হবে!"




    এই বস্তির ঠিক উল্টোদিকে একটা দামি অ্যাপার্টমেন্ট আছে। বছর পনেরো আগে এই এলাকার সবচেয়ে দামি অ্যাপার্টমেন্ট ছিল ওটাই। এই বস্তি আর ওই টাওয়ারের সম্পর্কটা, যাকে বলে, খাট্টামিঠা। বস্তির লোকজন ওখানে ঠিকে কাজ করেন, লেবার খাটেন- এই সব। ফলে উৎসবে অনুষ্ঠানে সিকি-আধুলি জুটে যায়। আবার কালীপুজোয় হল্লা হয় বলে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে থানায় অভিযোগ করায় পুলিশ বস্তিতে এসে পিটিয়ে গেছিল, একদল ছেলেপুলেকে তুলেছিল। এখন তো দু'দিকের লোকই চাপে পড়েছে। বস্তির লোকজন একটু টাইট দিচ্ছে অবস্থার সুযোগে। যতই বিগবাস্কেট থাকুক, টুকটাক বাজার, মুদিখানার জিনিসপত্র তো লাগেই। দোকানদারেরা সকলেই প্রায় বস্তির লোক। ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হিসাবে মুখচেনা একটি ছেলে আমায় চিকেন বেচল ১৮০ টাকায়, আর ঠিক তারপরই ওই অ্যাপার্টমেন্টের একজনকে ২১০ টাকায়। সিগারেটও তাই। তবে খদ্দের ভদ্রলোকের তাতে কোনও তাপউত্তাপ দেখলাম না। স্বাভাবিক হয়তো৷ আসলে অনেকসময় অস্ত্রের ভেদশক্তি সম্পর্কে ধারনা বদলে যায় বর্মের কাঠিন্য চিনলে। যাকে অস্ত্র বলে মনে হয়, তা হয়তো নেহাতই খেলনা।




    এর মধ্যে একদিন জরুরি প্রয়োজনে টালিগঞ্জের দিকে যেতে হয়েছিল। গাড়ি নেওয়ার সুযোগ নেই।হেঁটেই গেলাম। ফেরার পথে এক রিকশচালকের সঙ্গে আলাপ হল। ভদ্রলোকের নাম দেবেন মালো। ছোটবেলা কেটেছে কালীঘাট মন্দির চত্ত্বরে। এখন রানিকুঠির কাছে থাকেন। রিকশ চালান কালীঘাটে। বাড়িতে সদস্য মোট চারজন। উনি, ওঁর স্ত্রী, বড় ছেলে নাইনে পড়ে, ছোট ছেলে সেভেনে। বললেন, "সঞ্চয় কিছু নেই৷ রিকশ চালিয়ে দিনে গড়ে আয় হয় ৩০০-৩৫০ টাকার মতো। কখনও ৪০০-৫০০ বা ২০০-২৫০ হয়ে যায়। কিন্তু সেগুলো বিরল ঘটনা। নিজের রিকশ নেই, তাই মালিককে ভাড়া দিতে হয় পার বেলা ৪০ টাকা করে মোট ৮০ টাকা। আগে ৩৫ টাকা ছিল, বেড়েছে। বাকি টাকায় সংসার চলে। সব মিলিয়ে হাজার ন'য়েক টাকা রোজগার হয়। বাজার খরচ বাদে ছেলেদের পড়ার খরচ আছে, সামান্য ওষুধপত্রও লাগে। জানালেন, ওষুধ বাবদ যা খরচ তাতে ওঁর কোনও দায় নেই, উনি সকালে উঠে নিমপাতা খান, তাতেই সারা বছর সুস্থ থাকেন৷ অ্যাসবেস্টাসের একটা ঘরে থাকেন, বাড়িভাড়া বাবদ লাগে ৩০০০ টাকা। ইলেকট্রিকের খরচ আলাদা। দেবেনবাবু বলছিলেন, "রিকশ নিয়ে না বেরিয়ে উপায় নেই। সরকার চাল দিচ্ছে, কিন্তু তাতে মাস চলবে না৷ তাই দু'বেলাই বেরচ্ছি। পুলিশ দেখতে পেলে কখনও কখনও হাওয়া খুলে দিচ্ছে, মারছে, আবার টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে হাওয়া ভরে নিচ্ছি।" সংক্রমণের বিষয়ে কী ভাবছেন জানতে চাইলাম। বললেন, "হলে হবে। কী আর করা যাবে! এমনিও তো বেঁচে থাকতে কষ্ট হচ্ছে, মরে গেলে যাব। অসুবিধা কী!" আরও বললেন, "খিদেতে শরীর দুর্বল হয়ে যায়। আপনি তিনদিন না খেয়ে থাকলে এমনিই অসুখে পড়বেন। পেট ভরা থাকলে ভাইরাস কিছু করতে পারবে না। খালি পেটে থাকলে ভাইরাস আরও কাহিল করে দেবে। ঘরে থাকলে না খেতে পেয়ে এমনিই দুর্বল হয়ে যাব।"


    বেশ অনেকক্ষণ কথা হল। শুনলাম, কালীপুজোর দিন পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে বাজি ফাটাতে গিয়ে হাতেই বড় চকোলেট বোম্ ফেটে গেছিল। হাত, মুখ, গলা ঝলসে একশা। দিন দু'য়েক বাড়িতেই ছিলেন, ভেবেছিলেন কমে যাবে৷ তারপর "বউ জোর করে বাঙুরে ঢোকাল। কাঁচের ঘরে বারোদিন ছিলাম। তুলোয় করে কী একটা ওষুধ দিত, মুখের, হাতের কালো চামড়া উঠে যেত। সাদা হয়ে গেছিলাম.. ছেলেরা দেখে ভয় পেত। আমি বলতাম, আরে বোকা, ভয় পাস কেন! দু'সপ্তাহে ঘরে ফিরব। ঠিক তাই ফিরেছি।" বলে হাসলেন। জিজ্ঞেস করলাম, জ্বালা করত খুব? তাতে বললেন, "সে একটু করত, খুবই করত। সে তো করবেই। সহ্য না করলে কী করে হবে!" উনি যেহেতু এখানে রিকশ চালান না, কালীঘাটে স্ট্যান্ড, তাই ভিতরের রাস্তা, বাড়ি এসব তেমন চেনেন না। আমি সুব্রত ভট্টাচার্যের বাড়ি দেখাতে হাত তুলে নমস্কার করলেন। বললেন, ছোট থেকেই মোহনবাগানের সমর্থক, বাবলুদার তুলনা হয় না। আরও জানলাম, আগে সিপিএমের সমর্থক ছিলেন, এখন তৃণমূলকে ভোট দেন। প্রশান্ত শূরের কথা বললেন- "গরীবের জন্য কাজ করত লোকটা, ভাল লোক, দমদার লোক। সিপিএম তো কমে গেছে এখন.." মমতা ব্যানার্জির খুব প্রশংসা করলেন- "দিদি তো খুব খাটছে, চাল দিচ্ছে, তবে টিএমসিতে প্রচুর চোর। আশেপাশের লোকগুলো দিদিকে ডোবাবে।" বিজেপি নিয়ে তেমন কিছু জানেন না, বললেন, "পতাকাটতাকা তো লাগায় দেখি। দিল্লিতে মোদী আছে, ভাল লোক, কিন্তু এখানে আর বিজেপি কই তেমন!"




    কথায় কথায় জানালাম, আমার বন্ধুরা এই চত্বরে ৬ জন রিকশচালকের ১৫ দিনের খাবারের ব্যবস্থা করেছে। ওঁদের রিকশ পুলিশ ভেঙে দিয়েছে, রোজগার বন্ধ। দেবেনবাবু শুনে খুবই খুশি হলেন। বললেন, "আমরা দান চাই না, কর্ম করতে দিক সরকার, ভাত জুটে যাবে। রিকশ ভাঙা, হাওয়া খোলা এসব ঠিক নয়। অন্যায় কাজ।" শেষে জিজ্ঞেস করলাম, "কেবল আপনার শরীরের ব্যাপার তো নয়, আপনার থেকেও তো ভাইরাস ছড়াতে পারে, তাই না? তাহলে কি আপনার ঘরে থাকা উচিত নয়? বললেন, "অবশ্যই উচিত। কে চায় মানুষ খুন করতে! কিন্তু ঘরে খাবার নেই, কী করব! খিদে পেলে আমি তো বেরবই। উপায় কী!" গল্প করতে করতে আমার বাড়ি চলে এল। নামলাম। গত কয়েকদিনে মানুষজনের সঙ্গে কথাবার্তা কম হচ্ছে। সেদিন দেবেনবাবুর সঙ্গে আলাপ হল, এই বিচ্ছিরি সময়টা ভাগ করে নিলাম, বেশ লাগল।




    আমার বাড়ির কাছে পাশাপাশি দু'জন ইস্ত্রিওয়ালা বসেন। একজন ভোজপুরের মানুষ, নাম জানি না। বয়স হয়েছে বেশ। কম কথা বলেন। একদিন কথায় কথায় রামনরেশ রামের নাম বলেছিলাম, কপালে হাত ঠেকিয়ে সেলাম করেছিলেন। অন্যজনের ঘর হাজারিবাগে। নাম অমরেশ রাজভর। মধ্যবয়স্ক, টানটান চেহারা। একটা সাইকেলে করে সকালবেলা বাড়ি বাড়ি ইস্ত্রিকরা জামাকাপড় দিয়ে আসেন, সে বাবদ ১০ টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়। অমরেশ জমাটি মানুষ। গান গাইতে গাইতে কাজ করেন, গণপতির বিরাট ভক্ত। দোকানের পিছনের গাছে বছরখানেক আগে একটা প্লাস্টিকের গণেশ ঝুলিয়েছেন। প্রতিদিন ভোরে সেই গণেশকে পুজো করে তবে ঝাঁপ খোলেন। মাঝে মধ্যে দেখি গাছে কয়েকটা ঝুড়ি অথবা সরু মালা ঝুলছে। বেশ লাগে দেখতে।


    অমরেশের সাইকেলটা সারাদিন দোকানের পাশে রাখা থাকে। আচমকা বৃষ্টি হলে সাইকেল ভেজে, আশেপাশে ছাদ নেই রাখার মতো। দোকানের ঠিক পিছনে একটা ছোট্ট পাথরের স্ল্যাব। বেশ ছোট। দু'জন বসলে অসুবিধে। একটানা দাঁড়িয়ে ইস্ত্রি করতে করতে যখন পা টনটন করে, অমরেশ তখন ওই পাথরের স্ল্যাবে বসে রেস্ট নেন খানিক। গরমকালে দেখেছি পাথরটায় শরীর বেঁকিয়ে বসে গলা ছেড়ে কিশোর কুমার, মহম্মদ রফি গাইছেন। হাতের গামছা হাওয়ায় ঘুরছে। কথা বলি, নতুন নতুন গল্প পাই। ভাললাগে।



    এমনিতে প্রায় কখনও পাথরটা ফাঁকা থাকে না। অমরেশ ছাড়াও রিকশওয়ালা, সিকিউরিটি গার্ড, বাড়ি বাড়ি ঠিকে কাজ করা দিদিরা, পাড়ার কুকুর- কেউ না কেউ ঠিক দখল করে রাখেন। লকডাউনের জেরে এই মানুষগুলোর প্রায় কেউই এই তল্লাটে নেই। রমেশও পড়িমরি দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে গিয়েছেন। ইদানিং ওই পাথরটায় আমার একচ্ছত্র অধিকার। জায়গাটা গাছপালা ঘেরা, অন্ধকার, লোকজন তেমন আসে না। আমাকে যেদিন কাজেকম্মে বেরতে হয়, আমি একটা ঠোঙায় কয়েকটা বিস্কুট ভরে পকেটে রেখে দিই। ফেরার সময় পাথরটায় খানিকক্ষণ বসি। চারপাশ দেখি। রমেশবাবুর ইস্তিরির দোকান ঘুমিয়ে রয়েছে। হুটোপুটি করে বাড়ি ফেরার সময় সাইকেলটা রাখার জায়গা মেলেনি। শিকলে তালা দিয়ে বেঁধে রেখে গিয়েছেন। গাছের উপরে রাখা গণেশ খানিকটা বেঁকে গিয়েছে অযত্নে। ধুলো জমছে। সামনে তাকিয়ে দেখি রাস্তাজুড়ে বিকেল-সন্ধের হলুদ পাতার গালচে পাতা। খসখস শব্দ হয়। পাড়ার কুকুর। বিস্কুট ছুঁড়ে দিই। সরসর করে গাছের ভিতর দিয়ে হাওয়া বয়ে যায়। ঝিঁ ঝিঁ ডাকে৷ ঘাসের গন্ধ, মাটির গন্ধ নাকে আসে। বিড়ালরা আসে মাঝেমধ্যে, তাদের বিস্কুট দিই, নিজে খাই। পিছনে সরসর শব্দ হয়, কীসের শব্দ বুঝতে পারি না, বুঝতে ইচ্ছেও করে না। ক্রমশ আরও জমাট, আরও হলুদ হয়ে ওঠে সন্ধে। সাইকেলের কাছে যাই। কখনও আলগোছে ধুলো মুছে দিই, কখনও মনে হয়, থাক। এই বিচ্ছিরি সময়টা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে জমে থাকছে সাইকেলের গায়ে। মালিক ফিরে এসে দেখবেন তাঁর না থাকার সময়টা ধুলোর জোব্বায় সেজে বসে আছে। গণেশের দিকে তাকালে মায়া হয়। কতদিন যত্ন পায়নি ভাল করে। বেঁকে গিয়েছে কেমন। এখন তো ঝড়জল হচ্ছে প্রায়ই। তেমন বড় ঝড় হলে পড়ে যাবে না তো?



    ১০


    এই সময়টা একদিন কেটে যাবে। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর অমরেশ আবার আমার পাড়ায় ইস্ত্রি করতে আসবেন। ততদিন যেন গাছকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে প্লাস্টিকের গণেশ। যতদিন না অমরেশ ফিরছেন, গাছ যেন তাঁর গণেশকে ফেলে না দেয়...



    ১১


    আমি যেখানে থাকি, তার আশেপাশে অনেক সবুজ, অনেক পাখি। এই কয়েকদিনে নানারকম রান্না শিখে নিয়েছি। চুল কাটা হয়নি অনেকদিন। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকলে হাওয়া চুলে বিলি কেটে যায়। রান্না করি, বই পড়ি, সিনেমা দেখি। ব্যালকনি দিয়ে পাখি ঢুকে পড়ে ঘরে। ফ্যান বন্ধ করে দিতে হয়। গাছে জল দিই।


    আচমকা দুর্গন্ধে দেখি, রাস্তায় আধখাওয়া বিড়ালের লাশ। বেশিক্ষণ থাকে না যদিও, পুরসভা তুলে নিয়ে যায়।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০২ মে ২০২০ | ৩৫১৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন