সে এক অসীম সারল্যের সময় ছিলো, যখন আমার শিল্প- অশিক্ষিত মন সাদা কালোর খোপে, একমাত্রিকতায় গেঁথে ফেলতে পারতো যাবতীয় শিল্পপ্রচেষ্টাকে। অল্পবয়সে যেমন হয় (সবার নিশ্চয়ই হয়না), মনে করতাম মাত্র দুইরকম সাহিত্য হয়ঃ দরকারি আর না-হলেও চলে। আগে দরকারিগুলো পড়ে নিয়ে তারপর সময় হলে অন্যসব পড়াটড়া যাবে। তখনও জানিনা, যে অন্যসব কিছুর মত শিল্পচর্চাও খুবই ব্যক্তিগত স্তর থেকে উঠে আসা একটা ব্যাপার। এখানে চর্চা বলতে আমি শুধুই একজন পাঠক/দর্শক/শ্রোতাদের চর্চা বললাম, এবং সেই চর্চার স্তর একেবারে দাড়ি কাটতে কাটতে রেডিও চালিয়ে রাখা থেকে বিদগ্ধ আলোচনা পর্যন্ত বিস্তৃত, সুতরাং একই পংক্তির একধারে আমি আর অন্যধারে শিক্ষিত ও বিদগ্ধ সমালোচক রয়েছেন। এই একদল লোক, খানিকটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের এই মুহূর্তে এক পংক্তিতে না বসিয়ে উপায় নেই, কারণ শিল্প উত্তীর্ণ হয়েছে কিনা সে বিষয়ে এই সময়ে তাদের মতামতের গুরুত্ব ক্রমশই কাছাকাছি সরে আসছে। কবিতা থেকে রবীন্দ্রনাথ --- এইসব বিষয়ে এখন আমার বক্তব্য শঙ্খ ঘোষের প্রায় কাছাকাছি গুরুত্ব পেতেই পারে, কারণ আমাকে আর মতামত প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে হয়না। সেখানে কোন গুরুঠাকুর আমার সিভি খুঁটিয়ে দেখে আমার বৈদগ্ধ্য বিচার করেন না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (অবশ্যই তর্কসাপেক্ষ কতদূর স্বাধীনতা, কিন্তু সে অন্য প্রবন্ধ), তার উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম, তার চটজলদি প্রতিক্রিয়া ----এসবই আমার মৌলিক অধিকার। বাকিসব জিনিসের মতই এই ভালো পরিবর্তনেরও কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে।
সৃষ্টি ও স্রষ্টার যে সম্পর্ক তা যেমন ব্যক্তিগত, সৃষ্টি ও ভোক্তার সম্পর্কও, অনেকক্ষেত্রে সেরকমই ব্যক্তিগত হয়ে উঠতে পারে। সেই জায়গা থেকে তৈরী হয় ভালো লাগা খারাপ লাগা। সেই জায়গা থেকে আমরা বুঝি বা বুঝিনা স্রষ্টার বক্তব্য। সেই জায়গা থেকে এমনকি আমরা নির্ধারণ করে দিতে থাকি (বা চাই) সৃষ্টির গুরুত্ব, তার দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। আমরা বুঝতে চেষ্টা করি, সফল বা ব্যর্থ হই সে প্রচেষ্টায় --- এবং কতটা সফল হলাম, তার ছাপ পড়তে থাকে আমাদের মতামতে। এরই মধ্যে কোন এক সময় আমরা হয় আরো আগ্রহী হয়ে উঠি, বা অনাগ্রহী হয়ে ঠিক করে ফেলি সেই শিল্পবস্তুটি আমার সময় দাবি করবে কি করবেনা। এর মধ্যে কোন অস্বাভাকিত্ব নেই। কিন্তু এই ব্যাপারটা যে হয় সেটা স্বীকার করে নিলে কোন গোল থাকেনা। ব্যক্তিগত আগ্রহ অনাগ্রহের জায়গাটা অস্বীকার করলে বরং সমস্যা অনেক বিপজ্জনক বাঁক নিতে পারে। তখন ঐ একই পংক্তিতে বসা লোকেদের মেধা বুদ্ধি ও বৈদগ্ধ্য নিয়ে আলোচনা করতে হয় (কারণ এবার আমাদের মতামতের হায়ারার্কি তৈরী করে ফেলে কিছু লোকের কথা বাতিল করতে হবে)--- যা শিল্পচর্চার আলোচনায়, আমার মতে, গৌণ বিষয়, এবং তাতে আর যাই হোক, নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা বাড়েনা।।
আমাদের পরবর্তী আলোচনা তাই একেবারেই ব্যক্তিগত আগ্রহ অনাগ্রহর জায়গা থেকে এগোবে। আলোচনার সুবিধের জন্য আমি বেছে নিচ্ছি পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি "উনিশে এপ্রিল", যা ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। আমি ছবিটি তার কিছুদিন পরে প্রথমবার দেখি। ধরে নিচ্ছি সেটা ১৯৯৬-৯৭ সাল। তারপরে আবার ছবিটি দেখলাম গতকাল। অর্থাৎ ২০২০ সালে। এই দীর্ঘ ২৩-২৪ বছরের ব্যবধানে দুবার ছবিটি দেখা হলো। দুবারের আমি কিন্তু দুটি আলাদা লোক। দুবারেই ছবিটি দেখা এক একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। এবং যে অপরিচয়ের সমস্যায় ২০২০ সালের আমি নব্বইয়ের দশকের আমিকে বুঝতে সমস্যায় পড়বে, সেই একই অপরিচয়ের সমস্যায় এই দুটি অভিজ্ঞতা দীর্ণ।
যেকোন শিল্প নিয়ে আলোচনায় কয়েকটি আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ আছে। খুব গোদা করে বললেও, তার একটা ক্রাফটের জায়গা আছে, তার একটা বক্তব্যের জায়গা আছে, তার একটা বিনোদনের জায়গা আছে। এবং তার একটা ব্যক্তিগত পরিসরে প্রাসঙ্গিক হওয়ার জায়গা আছে। বক্তব্যের খোপটার আবার রকমফের থাকতে পারে, সেখানে একটা রাজনৈতিক বক্তব্যের কথা এসে পড়ে। আপাতত আমরা ধরে নিচ্ছি সব বক্তব্যই কোন না কোন রাজনীতির কথা, এটা পুরোপুরি ঠিক না হলেও অনেকাংশে যে ঠিক তা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই।
ঋতুপর্ণর ছবি নিয়ে আজকাল আলোচনায় প্রথমেই চলে আসে তাঁর যৌনচেতনার কথা, তার একটা সমস্যার জায়গা হলো তাতে বাদবাকি দরকারি কথা চাপা পড়ে যায়। তাই সে কথায় আমি পরে আসছি।
নব্বইয়ের আমি ঋতুপর্ণ দেখলো, কারণ লোকে সে ছবির কথা খুব বলাবলি করছে। সাদা বাংলায় বইটা খুব হিট করেছিলো, তাই। তারপরই পরিচালক ধীরে ধীরে খ্যাতি পেলেন, যেমন হয়, অমুকের উত্তরসূরী এসে গেলেন ইত্যাদি বলা শুরু হলো। তাই নব্বইয়ের আমি ছবি দেখলাম যে ব্যক্তিগত তাড়নায়, তার আগ্রহের জায়গাটা, খুব নরম করে বললেও --অস্পষ্ট। যেভাবে লোকে খুব গরমে মোটা জিন্স পরে ঘেমে ওঠে কিন্তু প্রশ্ন করেনা সেইরকম, ফ্যাশনেবল বলে। প্রথম দেখায় মনে দাগ কাটলোনা তেমন, খুব কিছু অপছন্দের বলেও মনে হলোনা। মনে হলো, এ ছবি নিয়ে আমি কী করবো? অনভিজ্ঞ আমার চোখে ধরা দিলো সচ্ছ্বল মধ্যবিত্ত ড্রইংরুম, দুঃখবিলাস, চমৎকার বাসনে ডালভাত আলু খাওয়া একদল বাঙালী মনিব যাঁরা হয় উচ্চমেধার নয় এন্টাইটেল্ড অথবা দুটোই।
এই ভাবনার মধ্যে কোন অন্যায় নেই। কিন্তু একজন নিম্ন-মধ্যবিত্ত, আজন্ম পিতৃতান্ত্রিক আবহাওয়ায় পালিত, স্নাতকস্তরের ছাত্র যার কাছে কিসে খাওয়া হবের থেকেও খাওয়া হবে কিনা এই প্রশ্নই বেশি প্রবল -- তার কাছে তাই অধরা থেকে গেল আরো অনেক কিছু। ক্রাফটের দিক থেকে ঋতুপর্ণ অনেক জায়গাতেই, বিশেষ করে সত্যজিৎ রায়ের ছবি দেখা অভ্যস্ত চোখে মধ্যমানের, তাই বিনোদন ধাক্কা খেয়েছিলো। এরপর খাপছাড়া ভাবে বিভিন্ন সময়ে, মাঝের বছরগুলোতে দেখা হতে থাকে অন্য ছবিগুলো। একেবারে শেষে চিত্রাঙ্গদা দেখা আমি, যে অনেকখানি পাল্টে গিয়েছে, তার হঠাৎ খেয়াল হয় আমার নিজের সঙ্গে অপরিচয় ভারি গভীর হয়ে উঠেছে।
৩০শে মে এসেছে বলে উনিশে এপ্রিল দেখলাম, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম না। দেখছিলাম আসলে গীতবিতান ডট নেট। সেখানে একটি গানের পাশে দেখি লেখা আছে সেই বছর কবির চারপাশে আর কী হচ্ছিলো। সালটা ইংরেজি ১৮৮৪। দেখলাম লেখা আছে ১৯শে এপ্রিল, কাদম্বরীর মৃত্যু। উনিশে এপ্রিল ছবির কথা মনে না হয়ে পারেনা। আবছা মনে পড়লো, উনিশে এপ্রিলেও আছে একাকীত্ব, অভিমান, অপরিচয় ও বহুদিনের জমে থাকা দুঃখের কথা। অতএব ছবিটি ফিরে দেখা।
ছবিটা দেখতে দেখতে আরো কিছু টুকটাক ব্যাপার খেয়াল করছিলাম। কাদম্বরীর আত্মহত্যা আফিম খেয়ে চিরনিদ্রা, ছবিতে অদিতি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করতে চায় -- বহুদিনের সঞ্চিত একাকীত্ব ও মায়ের ওপর অভিমান থেকে। পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথকে নানাভাবে এনে ফেলেছেন তাঁর কাজে। তাহলে কী রবীন্দ্রনাথই ছিলেন পরোক্ষে, প্রেমরূপ বৈরীতা ও স্নিগ্ধ বিষাদে উনিশে এপ্রিল জুড়ে?
কিন্তু ক্রমশই দেখা গেল, ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত সব অলৌকিক প্রাসঙ্গিকতায় আচ্ছন্ন ছবিটি। যে বিস্মৃতি উনিশে এপ্রিলের অন্যতম বিষয়, বিস্মৃতি বা অবজ্ঞা -- তা একমাত্রিক নয়। তা আমার অনূর্দ্ধ একুশ জীবনে ধরা পড়েনি বলে, তা সাধারণ বাঙালী পরিবারের মন-ভালো-করা আড্ডায় অস্বস্তিকর বলে সেটা নেই হয়ে যায় না, যায় নি কোনদিন। উনিশে এপ্রিল অস্বীকার করতে চায় দুর্বল সম্পর্ককে, দুর্বল ও সংকীর্ণ জীবনসঙ্গীকে --- পারে কিংবা পারে না। আমি আমার ২৩-২৪ বছরের ব্যবধানে আবিষ্কার করি মেধাবী মানুষীদের, মেয়ে বলে, মা বলে, তাদের হাতে অদৃশ্য খাঁড়া বয়ে চলতে হয়। কোন এক দুর্বল মুহূর্তে নিজের জন্য সে হয়ত খুন করে ফেলবে একটি অকিঞ্চিৎকর, অপমানকর সম্পর্ককে --- হয়্তবা ভালোবাসার শিশুটিকেও। তাকে ঘিরে বাকি পৃথিবী বসে আছে শকুনের মতন। মনে পড়ে এই ২০২০ সালেও সম্পর্ক গলায় ফাঁস হয়ে থাকা মেয়েদের কথা। নিজের ভালো বোঝা, নিজের খুশি মত যাপনের, কাজকে অগ্রাহ্য করে সন্তানপালন যে মায়ের দায়িত্ব নয় সেকথা সোচ্চারে বলতে না পারার অক্ষমতা যেখানে এখনও প্রাসঙ্গিক।
কাদম্বরীর উদ্দেশ্যে গদ্যকবিতা রবীন্দ্রনাথ শুরু করছেন "হে জগতের বিস্মৃত, আমার চিরস্মৃত...." বলে (রবীন্দ্রজীবনী, প্রথম খন্ড, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, পৃঃ ১৭৮)। কাদম্বরীর মৃত্যু ঘিরে বিস্মৃতি ও অস্বীকার রয়েছে। এই বিস্মৃতি ও তজ্জনিত অভিমান উনিশে এপ্রিলের বহিরঙ্গে ওতপ্রোত। দুটি মানুষের দূর্ভাগ্যজনক অপরিচয় উনিশে এপ্রিলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। হলেও হতে পারতো পরমাত্মীয়, সময়ের ফেরে অপরিচিত। তাকে ছোঁয়া যায়, চেনা হয়ে ওঠেনা। ঐ একই গদ্যকবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,
" ...যদি অনেকদিন পরে সহসা দেখা হয়, তখন তাঁহার নিকটে আমার অনেকটা অজানা, আমার নিকটে তাঁহার অনেকটা অপরিচিত। অথচ আমরা উভয়ের নিতান্ত আপনার লোক।"
ছবির শেষে মা ও মেয়ের কথোপকথন খেয়াল করুন।
এই মিল বা মিলের চশমা দিয়ে দেখতে পারা, এ নিছক খেলা বৈ কিছু নয়। দিনের শেষে এ কাগজচাপার গায়ে চোখ লাগিয়ে দেখা। কিন্তু একটা কথা পরিষ্কার। এই দেখাটি মিথ্যে নয়। যেমন মিথ্যে নয় এই তর্কটিও, যে ১৯৯৪ সালে একজন পরিচালকের কী দায় ছিলো বিভিন্ন ফর্মের ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স পর্দায় এনে ফেলার? প্রথম মুক্তি পেতে চলা ছবিতে? যেখানে তিনি হীরের আংটির মত নিরাপদ, ফীল গুড গল্প ভালোভাবেই উতরে দিতে পারেন?
এইভাবে আমাদের ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গা, যদি সেটা ছবিটি সম্পর্কে জেগে ওঠে, সেখান থেকে অন্য একটা পথ চলা শুরু হতেই পারে। আমাদের পারিপার্শ্বিক, সামাজিক অবস্থান, যে পথ পেরিয়ে এসেছি সে পথের রক্ত ও কাদা আমাদের মনে করিয়ে দিতেও পারে অন্য কিছু। সেই অন্য কিছু, যা জরুরি ও অদরকারির মত পূর্বনির্ধারিত খোপে বসে নেই। সে কথা পরিচালক যে বলতে চাইছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। ক্রাফটের সীমাবদ্ধতা সেই যোগাযোগে ব্যর্থ হতে পারে কোন কোন ক্ষেত্রে, কিন্তু উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারেনা। যেমন সন্দেহ থাকার কথা নয় রাজনীতি নিয়ে। উনিশে এপ্রিলে ২০২০ সালে আমি স্পষ্টই দেখি গায়ে হাত না তুলেও পিতৃতন্ত্র কীভাবে ছকের বাইরের লোককে রক্তাক্ত করতে পারে। প্যাসিভ অ্যাগ্রেশন কথাটা নব্বইয়ের দশকে জানা ছিলো কি অনেকের? দেখি সম্পর্ক কোন না কোনভাবে কাজ করাতেই হবে, এই নিরুপায় গৃহহীনতা। প্রেম করে সম্পর্ক স্থাপনের পর ভুল করেছি আবিষ্কারের যন্ত্রণা ও দ্বন্দ্ব। দেখি, সন্তানের মতই কর্মক্ষেত্র নিয়েও থাকতে পারে মানুষের সীমাহীন মমত্ব। এগুলো ঠিক কীভাবে বা কী ভেবে ঋতুপর্ণ লেখেন আমাদের জানা নেই, তার দরকারও নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত নিবিড় দেখায় এই গল্প এক একজন প্রান্তিক মানুষের গল্প হয়ে ওঠে।
সেই মেয়েটির কথা কি ভুলতে পারি যাকে ফোনে রোজ বেশ্যা বলে গালাগাল করে তার দয়িত, আর মেয়েটি শান্ত হয়ে খিস্তি খেয়ে আবার পরেরদিন ফোন করে, সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলার খাঁড়াটা প্রাণপণে লুকিয়ে রাখতে চায়। অপরাধবোধের মত চমৎকার কাব্যিক ভারি অলংকারে সেজে পরের দিন সে আবার ফোন করে।
এবং এই পর্যায়ে এসে আমরা ঋতুপর্ণের একাকীত্ব নিয়ে কথা বলতেই পারি। ২০১৩ সালে, ঋতুপর্ণর মৃত্যুর পর ইন্দ্রনীল ঘোষ দস্তিদার লিখেছিলেন [1],
"আমরা এই যারা অনেক কাল হল কাজের মাসি আর বাজারের দোকানী ছাড়া আর কোনো ছোটলোকের সঙ্গে মিশি না, আমরা যারা এককালে রাস্তায় দুয়েকপা ঝাণ্ডা হাতে মিছিলে হাঁটতাম, যারা পাহাড়ে চড়ার স্বপ্ন দেখেই কাটিয়ে দিলাম আর বচ্ছরান্তে এক হপ্তার ছুটি নিয়ে দার্জিলিং-কালিম্পং-নেওড়া ভ্যালির ইকো হাটে ঘুরে বেড়িয়ে এলাম,তারা কি একজন রেনম্যান চেয়েছিলাম ? ঋতুপর্ণ'র কি দায় রয়েছে নিজের জীবনটাকে -ও সেই সঙ্গে সিনেমাকে-উল্টে দিয়ে নতুন রাস্তা খুঁড়ে চলবার? ঋতুপর্ণর কি দায় ছিল কোনো আমাদের কাছে?"
এবং ঐ সময়েই, একই মায়াপাতায় লেখা সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা থেকে [2],
"মনে আছে, যুবক বয়সে দার্জিলিং শহরে বেড়াতে গিয়ে আমি এক ফরেস্ট রেঞ্জারের পাল্লায় পড়ি। পাল্লায় পড়ি কথাটা বলা ভুল, ভদ্রলোক ভারি অতিথি পরায়ণ ছিলেন। বাড়িতে ডেকে রীতিমতো ভুরিভোজ করিয়ে সাহিত্য আলোচনা করেছিলেন, মনে আছে। আমার ভালো লেগেছিল। তিনি ছিলেন প্রজাপতি সংগ্রাহক। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে প্রজাপতি জমাতেন। নৈশাহারের পরে গর্ব করে দেখিয়েছিলেন, তাঁর প্রজাপতির সংগ্রহশালা। একটা কার্ডবোর্ডের উপর থরে থরে পিন দিয়ে এঁটে রাখা মৃত প্রজাপতি। কী অপূর্ব তাদের ডানা। রঙের বিন্যাস। ভালো করে দেখার জন্য একপা এগোতেই দেখি পিনে আটকানো একটা প্রজাপতির ডানা থিরথির করে নড়ে ওঠে। ওড়ার চেষ্টায়। অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই, তিনি স্মিত হেসে বলেন, ওটা এখনও মরেনি। ............
তা, এই আবেগ ভ্যাদভ্যাদে বেদনার দিনে, ফিল্ম-টিল্ম গোল্লায় যাক, শুধু প্রজাপতিটির ডানা-কাঁপানো মনে পড়ে। আহা কি ছিল তার রঙের বাহার। কী অপূর্ব সেই ডানার কাঁপন। কি ন্যাচারাল। যেন পাতার উপরে নিজের পালকশরীর বিছিয়ে সে বসে ছিল। শরীরে গেঁথে থাকা পিনটা এতই ছোটো, সেটা চোখেই পড়েনি। "
~~~~~~
দীর্ঘ সাত বছর পেরিয়ে এসে এখন আমরা আরো পরিশীলিত হয়েছি। আমরা এখন আর ঋতুপর্ণর মেয়েলিপনা নিয়ে কথা বলি না পারতপক্ষে, খোলাপাতায় তো নয়ই। আমাদের রাজনৈতিক চেতনার মেরুকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে। আমরা পরিষ্কার বক্তব্য রাখতে পারছি একজন শিল্পীর শিল্পমাধ্যম নিয়ে। আমরা এমনকি এটাও বলে দিতে চাইছি কোনগুলো রাজনীতি আর কোনগুলো নয়, বা হয়ত ঋতুপর্ণর ছবিতে রাজনীতি ছিলোইনা।
এইসব পরিষ্কার জোরালো আত্মবিশ্বাসে ভরপুর বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে আমি বাটিকের লুঙ্গি পরে আধশোয়া একজন মনীশকে দেখতে পাই। অনাগ্রহী একজন পুরুষ, হীনমন্য, দুর্বল, ভাবনায় ঘেঁটে থাকা সেই ছেলেটিকে দেখতে পাই যে ফোন করে প্রেমিকাকে খিস্তি করে অকারণ। চিত্রাঙ্গদা পর্যন্ত ঋতুপর্ণর হয়ে ওঠা ক্ষতগুলোর চিহ্নসমূহ ধরা পড়ে, এমনকি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে গিয়েও যাঁর যন্ত্রণাদায়ক আত্মপ্রকাশ লুকিয়ে রাখা যায়না। আর ঋতুপর্ণর সঙ্গে হেঁটে এই পথ চলার শেষে কোথাও গিয়ে মনে হতে থাকে যে সেই অসীম সারল্যের সময়, আজ যা অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগের মত সুদূর ঠেকে, তা সম্ভবত পেরিয়ে আসা গেল। ব্যক্তিগত আগ্রহ, ব্যক্তিগত যাত্রা, সামান্য ব্যক্তিগত উত্তরণ ---- এর বাইরে আর চাইবার কিই বা আছে?
~~~~~~