উপদেশে উপদেশে ভেসে যাচ্ছে সম্পাদকীয় পাতা, সোশ্যাল মিডিয়া....আমিও সেই স্রোতে গা ভাসাইনি এমন নয়, কিন্তু যা কিছু বলছি বা শুনছি, আমার ওপর ভার থাকলে নিজেই কি করতে পারতাম?
যা নেই তার খোঁজে যা আছে সেগুলোকে না ছুটিয়ে তাই দিয়ে কি করা সম্ভব খুঁজতে গিয়েই চোখে পড়ল ডা: শ্রীনাথ রেড্ডির একটা ইন্টারভিউ। প্রকাশিত হয়েছে ২৬শে এপ্রিল ২০২০র কোয়ার্টজ ইন্ডিয়া পত্রিকায়, আমানত খুল্লারের "হোয়াই ইন্ডিয়া শুডন'ট মিমিক দ্য ওয়েস্ট ইন দ্য ফাইট এগেন্সট করোন" শিরোনামের একটি রচনায়।
ডা: শ্রীনাথ রেড্ডির একটা ছোট পরিচয় দিয়ে রাখি। ডা: রেড্ডি দিল্লীর অল ইন্ডিয়া ইন্সটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সের (AIIMS) কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের অন্তর্ভুক্ত ন্যাশনাল ইন্সটিটুট অফ মেডিসিনের ফরেন অ্যাসোসিয়েটেড মেম্বার রূপে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ হার্ভার্ড স্কুল অফ পাবলিক হেলথের প্রথম বার্ণার্ড লোন ভিজিটিং প্রফেসর অফ কার্ডিওভাসকুলার সায়েন্স ছিলেন। এখনো তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজানক্ট প্রফেসর, এবং সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের সাম্মানিক অধ্যাপক। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের চেয়ারম্যানও ছিলেন ২০১৩-১৪য়। ২০০৫ সালে পদ্মভূষণ। অনেকদিন ধরেই পাবলিক হেলথ ফাউণ্ডেশনের প্রধান।
বিলিতি যোগাযোগের জন্য নয়, ২০১০ সালে তাঁর নেতৃত্বে অধুনালুপ্ত প্ল্যানিং কমিশন একটি হাই লেভেল এক্সপার্ট গ্রুপ অন ইউনিভারসাল হেলথ কভারেজ গঠন করেছিলেন। চাকরীর শেষবেলায় সে রিপোর্ট পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তৎকালীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার খুব বৈপ্লবিক কিম্বা অবাস্তব পরিবর্তনের সুপারিশ না করেই এই কাঠামোতেই কী করে সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিসেবা দেওয়া যায় তার রূপায়নসম্ভব প্রস্তাব। সেই রিপোর্ট প্ল্যানিং কমিশন নিজে কতটা পাত্তা দিয়েছিলেন জানি না, অনেক সুখ্যাতি করেও রিপোর্ট প্রকাশের পর তৎকালীন ইউপিএ সরকার খুব কংক্রিট কিছু করেননি। বর্তমান সরকার একদমই ত্বভিন্ন পথে হেঁটেছেন।
অনেক কারণেই ভারত আমেরিকার সঙ্গে তুলনীয় নয়। আমাদের জনসংখ্যার ৬ শতাংশের বয়স ৬৫ র ওপরে, গড় ২৮ শতাংশ ভারতীয়ের বয়স ২৯, জনসংখ্যার ২৮ শতাংশর বয়স ১৪র নীচে। আমেরিকায় মাথাপিছু ১১ হাজার ডলার খরচা হয় স্বাস্থ্য খাতে, আমাদের এখানে ৭৫ ডলার, অতএব ওদের সঙ্গে আমাদের একরাস্তায় হাঁটা বোধহয় অনুচিত হবে।
এমনিতেও দক্ষিণ এসিয়ার করোনা আক্রান্তের সংখ্যাটাও আমাদের জনসংখ্যার অনুপাতে কমই ঠেকছে। সবকটা সার্ক দেশ মিলেও সারা বিশ্বের করোনা আক্রান্তের ১ শতাংশের সামান্য বেশি। করোনা মৃত্যুর নিরিখে প্রায় ০.৫ শতাংশ। এ সব জনসংখ্যায় অল্পবয়সীদের অনুপাত বেশি বলে নাকি আমাদের মারী নিয়ে ঘর করার অভ্যাস থেকে, আমি জানি না।
প্রতি ১০ লক্ষে এখনো অবধি দুশোর কিছু বেশি টেস্ট করা হচ্ছে ভারতে। ইউরোপ বা পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে তুলনায় দাঁড়ায় না ব্যাপারটা। জার্মানি তে দশলক্ষ পিছু ১৫৭৩০ জনের টেস্ট হচ্ছে, ইটালিতে ১৪,১১৪, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০৫৬৪।
যতই চেঁচাই টেস্টিং ওই পর্যায়ে পৌঁছতে পৌঁছতে রোগের চেয়ে চিকিৎসা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে দেশবাসীর জন্যে। আমাদের আর্থিক, প্রশাসনিক ইত্যাদি সব ক্ষমতাই অনেক সীমিত।
সেই বাস্তবের কথা মনে রেখেই ডা: রেড্ডি মনে করেন কেবল টেস্টিং এর মন্ত্র জপে লাভ নেই। অন্য পথে চলতে হবে আমাদের। কোভিড -১৯ এর জন্য যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়নি এখনো, টেস্টিং থেকে আমরা কেবল বুঝতে পারি কাউকে অন্তরীন হতে হবে কী হবে না। চিকিৎসা করা হয় রোগের আপাতলক্ষণের ভিত্তিতে।
তাঁর মতে করোনা আক্রান্ত সমাজটিকে যদি একটি পিরামিডের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তাহলে সে পিরামিডের একদম চুড়ায় আছেন যাঁরা প্রবল ভানে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হচ্ছেন, মাঝামাঝি আছেন যাঁরা সংক্রামিত হয়ে অন্তরীন থাকছেন, এবং একেবারে নীচে থাকছেন লক্ষণহীন বা ন্যূনতম লক্ষণযুক্ত সংক্রামিত মানুষজন।
অনেক রাজ্যতেই এখন যে ইনফ্লুয়েঞ্জার লক্ষণযুক্ত মানুষদের চিহ্ণিত করনের চেষ্টা চলছে নানা স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে তা থেকে মাঝের স্তরটা অনেকটাই ধরা যাবে। একদম নীচের স্তরটা আমাদের বর্তমান বা নিকট ভবিষ্যতের বর্ধিত টেস্টিং এও অধরাই থেকে যাবে।
ভারতে এখনো পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৭০ শতাংশ কেসই অ্যাসিম্পটোম্যাটিক বা।রোগলক্ষণহীন। একমাত্র কনট্যাক্ট ট্রেসিং বা কেউ রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন কিনা তার খোঁজ খবর নিয়েই চেস্টা চলছে অ্যাসিম্পটোম্যাটিক কেসদের ধরতে। স্বাস্থ্যকর্মীদেরও টেস্টিং করার কথা নিয়মিত। কিন্তু ডা: রেড্ডির মতে বাকি অ্যাসিম্পটোম্যাটিকদের র্যানডম টেস্ট থেকে যেটুকু পাওয়া যাবে সেটুকুই আমাদের জানার পরিধির মধ্যে থাকবে। তাছাড়া এই নেগেটিভ অ্যান্টিজেন টেস্ট থেকে এই গ্যারান্টি তো আমরা পাবো না যে আজ যাঁকে নেগেটিভ পাওয়া গেল ক'দিন বাদে তিনি সংক্রমিত হবেন না।
(এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ২০১৮ সালে বিবিসি তে কন্ট্যাজিওন নামে একটা ডকু সিরিয়াল করেছিলেন গণিতশাস্ত্রী ড: হানা ফ্রাই। (https://www.bbc.co.uk/
অত: কিম
এত বড় একটা দেশে সবার জন্য একই ধরনের লকডাউন পরবর্তী পদক্ষেপের প্রেসক্রিপশন দেওয়া ঠিক হবে না। লক ডাউন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কিছুটা সময় দিয়েছে প্রস্তুতি নেবার। সংক্রমণ ছড়ানোও আটকেছে অনেকটাই।
হাসপাতালগুলি কিছুটা হলেও প্রস্তুতি নিতে পেরেছেন, কিছু ভেন্টিলেটর সংগ্রহ করা গেছে, স্বাস্থ্যকর্মী দের জন্য কিছু পার্সোনাল।প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্টও পাওয়া গেছে।
কিন্তু সংক্রমনের সঙ্গে মূল মোকাবিলা।করতে হবে সেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার স্তরেই।
লকডাউন পর্যায় ক্রমেই উঠুক, কিন্তু কোথায় কোন পরিসেবা অগ্রাধিকার পাবে, তা নির্ধারিত হোক জেলা স্তরেই।
আর্থ সামাজিক ভাবে দূর্বল যে জনগোষ্ঠীর পক্ষে সামাজিক দূরত্ব মানা তাদের থাকার এবং যাতায়তের জন্য আলাদা ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে প্রশাসনকে। প্রয়োজনে বিয়েবাড়ি, কমিউনিটি হল, ইত্যাদির দখল নিয়ে তৈরি করতে হবে আইসোলেসন সেন্টার, কোয়ারেন্টাইন সেন্টার।
এই দীর্ঘ সময় ধরে সীমিত সংখ্যক স্বাস্থ্য কর্মীরা পরিসেবা চালাতা চালাতে ক্লামত হয়ে পড়বেন। নতুন করে নিয়োগ করে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মী সংখ্যা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মীদের যৌথ বাহিনী তৈরি করতে হবে নজরদারি চালিয়ে যেতে। এই বিশেষত দরিদ্র এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে কনট্যাক্ট ট্রেসিং, বহিরাগতদের আসা যাওয়া ইত্যাদির ওপর কড়া সামাজিক নজরদারির জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।
এর পাশাপাশি টেস্টিং চলবে আই সি এম আর এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় রোগলক্ষণযুক্ত মানুষজনদের চিহ্নিত করেও। কিন্তু কেবল টেস্টিং সংখ্যা দিয়ে নজরদারি গুণগত মানের বিচার করলে বেঠিক হবে।
কী করনীয় তার পরিকল্পনা রাজ্য স্তরে হলেও রূপায়ন পুরোপুরি জেলার হাতে ছাড়া হোক। ইতিমধ্যেই ভারতে সংক্রমণের বেগ প্রশমন করার বেশ কটা ভালো মডেল তৈরি হয়েছে, সেগুলো থেকেই আইডিয়া পাওয়া যেতে পারে।
সর্বাগ্রে নাম করতে হয় কেরালার। আন্তর্জাতিক হিসাবের তুলনায় অনেক কম টেস্ট করেও সফল ভাবে প্রতিরোধ করেছে করোনা সঙ্ক্রমন। প্রায় সত্তর শতাংশ করোনা আক্রান্ত কে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়েছে সেখানে। সংক্রমনের ঊর্ধগামী রেখাটিকে সফল ভাবে চেপে দিয়েছেন তাঁরা। কেরালা প্রস্তুতি নিয়েছিলেন সেই ফেব্রুয়ারী মাসের গোড়ার দিকেই। টেস্টিং, কোয়ারেন্টাইন, হসপিটালাইজেশনের এবং হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার নিয়মাবলী। পরিত্যক্ত হাসপাতালগুলো ব্যবহার করে তাঁরা তৈরি করে ফেলেছিলেন কোভিড -১৯ চিকিৎসা কেন্দ্র। কিন্তু কেরালার সাফল্যের সবচেয়ে বড় কারণ সফল এবং কড়া সামাজিক নজরদারি যাতে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা ছাড়া পঞ্চায়েত, মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী এবং সুশীল সমাজের সদস্যরা বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। কন্ট্যাক্ট টেসিং, মাস্ক বানানো, নি:সহায়দের কমিউনিটি কিচেন বানিয়ে খাদ্য সরবরাহ করা, মানবিকতার এবং সংক্রমণ প্রতিরোধের খুব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন কেরলবাসীরা।
অন্ধ্র প্রদেশেও ভাল উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অ্যাপের মাধ্যমে নিবিড় ভাবে কনট্যাক্ট ট্রেসিং চলছে, আড়াই লক্ষ স্বেচ্ছাসেবী নেমে পড়েছেন ওয়ার্ডস্তরে, ঘরে সমীক্ষা চালাচ্ছেন তাঁরা। প্রত্যেক ৫০ টি পরিবার পিছু একজন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন ফ্রন্ট লাইনের স্বাস্থ্য কর্মীদের সংগে। প্রত্যেক বিদেশফেরত চিহ্নিত হচ্ছেন, জ্বরের রোগীদের খবর রাখা হচ্ছে, কনট্যাক্ট ট্রেসিং হচ্ছে নিবিড়ভাবে। ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্যকর্মীদের ভিজিটের পরের পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ বাড়িগুলিতে পৌঁছে যাচ্ছেন মেডিকেল টীম।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামলানোর এক বিরল দক্ষতা ভৌগলিক কারণেই অর্জন করেছে ওড়িশা। রাজ্যব্যাপী লকডাউন প্রথম করেছেন তাঁরা। কোভিড -১৯ এর সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা চালাচ্ছেন, আই টি ব্যবহার যাঁরা বিদেশ থেকে এসেছেন তাঁদের চিহ্ণিত করছেন এবং অন্তরীন রাখছেন।
রাজস্থানের ভিলওয়াড়া জেলার মডেলটি বহু আলোচিত। সম্পূর্ণ কারফিউ, প্রতি বাড়ি ধরে সমীক্ষা, প্রত্যেকটি পজিটীভ কেসের কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, এবং তার সঙ্গে ব্যাপিক টেস্টিং মিলিয়ে অনেকটাই সাফল্য পাওয়া গেছে কোভিদ-১৯ মোকাবিলায়।
কোভিড -১৯ সামলাতে কেবল স্বাস্থ্য বিভাগের ওপর দায় ছেড়ে বসে থাকলে চলবে না, কেবল টেস্টিং এর ওপর নির্ভর করে চলবে না। সম্ভাব্য সংক্রামিত দের খুঁজে বের করা, তাঁদের নিরাপদ অন্তরীন থাকার ব্যবস্থা করা, তাঁকে সামাজিক বয়কট যাতে না করা হয় সেটাও সুনিশ্চিত করে, তাঁর সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন তাঁদের র খুঁজে বার করে টেস্ট করানো.... সব কাজেই বৃহত্তর সমাজ ও অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি দায়িত্ব নিলে তবেই পরিত্রাণ সম্ভব।
বিষয়টা মূলতঃ নীতিনির্ধারণ আর তা প্রয়োগ সংক্রান্ত। কিন্তু আমলাতন্ত্র কতটা সদিচ্ছার সাথে মোকাবেলা করছে, কেরলের মত ব্যতিক্রমী ঘটনা তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। এখন সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিচ্ছে, এটা গত মাসের 22/24 তারিখে নিলে শতাধিক মানুষের পথিমধ্যে মৃত্যু হত না।
গোটা লেখাটি উদ্ধৃতি চিনহের মধ্যে কেন !!!
উদ্ধৃতি চিহ্ণটা নিতান্তই টাইপো। বোধ হয় মেলে ফরোয়ার্ডিং নোট থেকে আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য দিয়েছিলাম, সেটা থেকে গেছে। ঠিক করে দিলে ভালো হয় প্রতিভা/ ঈপ্সীতা!