-"শুনেছিস?"
-"হুঁ, শুনলাম।"
-"কখন? কে বলল?"
-"এই তো একটু আগে। মিসেস চৌবে ফোন করেছিল। অনুপমকেও কে জানি ফোন করেছিল।"
-"ছি: ছি:, কী লজ্জা বলতো? আমরা বাঙালীরা আর কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব? সবাই তো মওকা পেয়ে নিন্দের বন্যা বইয়ে দেবে। বলবে "বঙ্গালীলোগ এয়সে হী হোতে হ্যায়"। ছি:!"
রুমেলা বিরক্ত হল। যা হয়েছে তা খুবই বাজে ঘটনা, শুনে অবধি তার মেজাজ খারাপ, তবু এসময়ে দেবযানীর এইসব টীকাটিপ্পণী সহ বক্তব্য আর নেওয়া যাচ্ছেনা। সে ফোনপর্ব শেষ করার ইঙ্গিত দেয়,
-"ওসব ভেবে কী লাভ। যাদের যা বলার তারা এমনিতেও বলবে, অমনিতেও বলবে। ওতে কান না দেওয়াই ভালো। যাক শোন, অনুপম অফিস বেরোবে। ব্রেকফাস্ট রেডি হয়নি এখনো। এখন রাখ, সারাদিন পড়ে আছে। এসব আলোচনা পরে হবে।"
-"আরে, আমার বরও তো অফিস যাবে। সময় নেই একদম, ভাবলাম তুই যদি খবরটা না পেয়ে থাকিস, তাই ফোন করলাম। রাখছি, পরে ফোন করব।"
দেবযানীকে ও পুরোটা সত্যি বলেনি। ব্রেকফাস্ট আগেই রেডি হয়ে খাবার টেবিলে রাখা আছে। অনুপম ঘড়ি কবজিতে বাঁধতে বাঁধতে এসে চেয়ার টেনে বসল। খাবার বাড়তে গিয়ে ওর চোখ চলে গেল দেওয়াল ঘড়িটার দিকে, রোজের অভ্যেসে।
-"সবে সোয়া আটটা, এত তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছ আজ? মিটিং আছে?"
পরোটার টুকরো আলুর ঝোলে ডুবিয়ে মুখে পোরে অনুপম। খাবার চিবোতে চিবোতে ড্রইং রুমের টিভির দিকে চোখ, খবর হচ্ছে।
-"না, একটু থানা হয়ে যাব। পলাশকে তুলে নিয়ে যাব, ওর আজ নাইট শিফট। ওকে থানায় ছেড়ে দিয়ে আমি অফিস চলে যাব।"
রুমেলা স্বামীকে খেতে দিয়ে দুজনের চা আনতে গিয়েছিল রান্নাঘর থেকে। ও এত তাড়াতাড়ি জলখাবার খায়না। এখন শুধু এককাপ চা খায়,পরে ধীরেসুস্থে স্নানটান সেরে ব্রেকফাস্ট করবে। সকালে ঘটনাটা শোনা থেকেই বুকের মধ্যে একটা ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিল। ভেতরের রাগটা আর চেপে রাখতে পারেনা,চায়ের কাপ দুটো ঠক করে টেবিলে নামিয়ে রাখে।
-"মানে? তুমি থানায় যাবে, কিসের জন্যে?"
-"আরো অনেকেই যাচ্ছে, গিয়ে দেখি যদি কিছু সাহায্যে লাগি। পালদা এখানে বাঙালীদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র। অসুবিধেয় পড়েছে, সবাই যাচ্ছে, আমিও যাচ্ছি।"
-"অসুবিধেয় পড়েছে? তাই যাচ্ছ? একটা রেপিস্ট, শুধু বাঙালী বলে তাকে বাঁচাতে দৌড়বে তোমরা, সক্কালবেলায় অফিস না গিয়ে?"
টিভি থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকায় অনুপম। চায়ের কাপ তুলে নেয় হাতে। চোখে হাল্কা বিরক্তি, গলার স্বরে কাঠিন্য,
-"বোকা বোকা কথা বোলোনা। অভিযোগ প্রমাণ কিছু হয়নি এখনো। একজন শ্রদ্ধেয় মানুষ, তার সম্পর্কে কথা বলার সময় একটু ঠিকঠাক বিশেষণ ব্যবহার করো।"
-"চমৎকার। শ্রদ্ধেয় মানুষ, একা বাড়িতে কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করে যে লোক জেলে গেছে তার জন্যে সঠিক বিশেষণ টা কী? মহাপুরুষ? তার আবার সুবিধে অসুবিধে, তাকে সাহায্য করতে বাঙালী সমাজ জড়ো হচ্ছে। তোমাকে তো আমি কিছুই চিনি না মনে হচ্ছে। আমি ভাবতে পারি না এরকম একটা ব্যাপারে তুমি ঐ ধর্ষণকারী পশুটার হয়ে সালিশী করছ আমার কাছে।"
শেষ দুটো বাক্যে ওর গলায় কেমন নিজের অজান্তেই একরাশ হতাশা ঝরে পড়ে। অনুপম কি একটু অপ্রস্তুত হয়? বোঝা যায় না,তবে গলার স্বরটা নরম হয় ঠিকই।
-"আমি সালিশী করছি না,রুম। তুমি বড্ড বেশী রিয়্যাক্ট করছো, বড় তাড়াতাড়ি। একটু ঠান্ডা মাথায় বোঝার চেষ্টা করো। এইসব এলাকা, তারওপর অফিসের উঁচুমহলের রাজনীতির তুমি কিছুই জান না, বোঝো না। এটা সোজাসাপটা একটা রেপ কেস হলে কিছু বলার থাকত না। আমি এর মধ্যে থাকতে যেতাম না। কিন্তু সব দেখেশুনে এত কিছু সরল মনে হচ্ছেনা। পালসাহেব একজন অত্যন্ত সৎ, ভালোমানুষ অফিসার। উঁচু মহলে অনেক নোংরা লেনদেনের ব্যাপারস্যাপার থাকে। ওনার আমলে সেসব প্রায় বন্ধ হবার যোগাড়, তাই নিয়ে অনেকের অনেক অসন্তোষ ছিল ওর ওপর। উনি অপরাধী হলে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু যদি লোকটাকে মিথ্যে ফাঁসানো হয় তাহলে ওনার পাশে না দাঁড়ানোটাই বরং অপরাধ হবে।"
রুমেলা একটু থমকে গেল। অনুপম সাধারণত কম কথার মানুষ। তাকে এতগুলো কথা একসাথে বলতে শুনে একটু অবাকও হল। তবে প্রত্যয় হল না। একটা মেয়ে, সাধারণ আদিবাসী গ্রামের মেয়ে, সে অতবড় একজন লোকের বিরূদ্ধে অভিযোগ আনবে এমনি এমনি? এধরণের অভিযোগ? যাতে তার মান সম্মান, ভবিষ্যত সামাজিক অবস্থান, সব কিছু জড়িয়ে আছে। শুধু অনুপম না কোনো পুরুষমানুষই বোধহয় ধারণা করতে পারে না যে এক নারীর কাছে সে যেই হোক না কেন, সমাজের যে শ্রেণীরই, এটা কী চরম অপমানের!
-"পলাশের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বুঝলে, এরকম কেস এর আগেও হয়েছে এই কলোনিতে কিন্তু কম্পানি থেকে উদ্যোগ নিয়ে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ অবধি কখনোই গড়াতে দেওয়া হয়নি।
এক্ষেত্রে পুলিশের তৎপরতা আর সাহস দেখার মত। সাধারণ গরীব আদিবাসী গ্রামের দুজন গিয়ে অভিযোগ করার সাথে সাথে এসে একেবারে অ্যারেস্ট করে ফেলল। তাও আবার এতবড় কম্পানির একজন উচ্চপদস্থ অফিসারকে। যদি মিথ্যে প্রমাণ হয় পুলিশকে এর জন্য কত জবাবদিহি করতে হবে তার ইয়ত্তা নেই! তা সত্ত্বেও ওরা এত তাড়াহুড়ো করে স্টেপ নিল,এত ঝুঁকি নিয়ে, সেটা সন্দেহের নয়?
পলাশের ফোন পাওয়ার পরে আমি পাবলিক রিলেশনস অফিসার খেমচাঁদকে ফোন করলাম। বলল, আমাদের কাছে যা খবর, ওর কাছেও নাকি তাই, এখান সেখান থেকে পাওয়া উড়ো খবর। অফিস থেকে বা এইচ আর থেকে কোনোরকম কেউ যোগাযোগ করেনি ওর সাথে। ভাবা যায়,কাল রাত নটায় পালদাকে নিয়ে গেছে অথচ এখনো কোনো অফিশিয়াল উদ্যোগ নেই ব্যাপারটা নিয়ে।"
কেন জানি কথাগুলো শুনতে একটুও ভালো লাগছে না, কোনো যুক্তিই এতবড় একটা অপরাধকে অন্যভাবে ভাবাচ্ছে না। বরং রাগটা কেমন তরল হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছে, শিরায় শিরায়। এরকম আগেও হয়ে চাপা দেওয়া হয়েছে? এবারও সেরকম না হওয়া নিয়ে আক্ষেপ? ভগবান!
অনুপম কথা বলতে বলতেই জুতোর ফিতে বাঁধে। কথা বলতে ইচ্ছে করেনা তবু গাড়ির চাবিটা ওর হাতে তুলে দিয়ে একটু যান্ত্রিক ভাবেই মুখে এসে যায়,
-"খেমচাঁদ কী করবে এব্যাপারে, অফিশিয়ালি তাকে জানাবে কেন?"
অনুপম চাবিটা হাতে নিয়ে দরজার ছিটকিনিতে হাত দেয়,
-"আরে এসব ব্যাপারে সবার আগে এরা খেয়াল করে জানাজানি যেন না হয়, খবরের কাগজ মিডিয়া ইত্যাদি। এমনিতে মিডিয়ার লোক থানায় ফিট করা থাকে। কিছু হলেই তারা খবর দিয়ে দেয় আর খবর পেলেই সব এসে পড়ে, ভাগাড়ে শকুনির মত। তখন ওদের সঙ্গে দরাদরি করতে হয় যাতে খবরটা না বের করে। কম্পানি সংক্রান্ত কোনো কিছু হলে খেমচাঁদই মিডিয়াকে সামলায়। তাই যে কোনো পুলিশ কেসের ঘটনা ঘটলে আগে খেমচাঁদের কাছে নির্দেশ আসে থানায় যাওয়ার জন্যে। এবারে সেরকমটা হয়নি, এখনো। তার মানে ওপর থেকে কেউ বা কারা চাইছে খবরটা ছড়াক। হয়ত ব্যাপারটা এমন দাঁড়াবে যে পালসাহেব শেষপর্যন্ত রিজাইন করতে বাধ্য হবে। এসব কেস একবার কোর্টে গেলে সহজে নিষ্পত্তি হয় না, চলতেই থাকে।"
অনুপম বেরিয়ে গেলে দরজাটা বন্ধ করে ফোনের কাছে এসে বসে। কাকে ফোন করবে ঠিক করতে পারে না। কোনো একজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে, অস্থির লাগছে। বাড়িতে ফোন করবে? না:, ওরা হয়ত বুঝবে না ঠিকমত এতদূর থেকে। কাছে থেকেই বা কতজন বুঝছে? মেয়েটার কথা কেউ ভাবছে না। তার তো শুনে থেকে শুধু মেয়েটার কথা মনে হচ্ছে।
বয়স নাকি বছর কুড়ি হবে, ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছিল। স্বামী নেয়নি, গাওনার সময় পণ দিতে পারেনি বলে। টাউনশিপের পেছনের গেট দিয়ে কিছু দূর গেলে নদীর ধারে ওদের ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের বাসিন্দারা সব আদিবাসী, আগে বন জঙ্গলে কাঠ কেটে, মহুয়া কুড়িয়ে দিন চলত ওদের। এখানে কারখানা হওয়া থেকে এখন ওরা অনেকে কারখানায় মজদুরের কাজ করে, ঠিকাদারের লেবার। মেয়েরা কলোনির বাড়ি বাড়ি কাজ করে।
সংসারে মেয়েটার বাবা আর ঠাকুমা আছে, মা নেই। মিসেস চৌবেই এতসব খবর দিল। ঠাকুমাই আগে কলোনির বাড়ি বাড়ি কাজ করত, ইদানীং অসুস্থ হয়ে পড়ায় মেয়েটা আসছে।
মিসেস পাল ছোট ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় বিয়েবাড়ী গেছে, মেয়ে কলেজের হোস্টেলে। ছি: ছি:, অত বড় বড় ছেলেমেয়েদের বাপ হয়ে একটা মেয়ের বয়সী মেয়ের সাথে ওরকম করতে লজ্জা করল না লোকটার!
অনুপম যা বলছে ওর ঠিক মাথায় ঢুকছে না, বিশ্বাস করতে পারছে না। বুঝতে পারছে না ওরা কেন এমন করে কথা বলছে। আরো তো অনেক বড় অফিসার রয়েছে কলোনিতে,শুধু এই লোকটির বিরুদ্ধেই এরকম অভিযোগ উঠল কেন, একেবারে কিছু না করলে?
ফোন করার আগেই ফোন এল, সারাদিন ধরে ফোন বেজেই গেল। কেউ না কেউ কলকলিয়ে কথা বলেই যাচ্ছে। প্রত্যেকেরই অনেক কিছু বলার আছে, অনেক মতামত। কলোনির নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রায় এরকম উত্তেজক ঘটনা, লোকে নাওয়া খাওয়া, কাজকম্ম ফেলে শুধু এই নিয়ে পড়েছে।
একজন সিনিয়র অফিসার, স্ত্রী পুত্রের অনুপস্থিতিতে, ফাঁকা বাড়িতে উনিশ কুড়ির কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। থানায় কী হচ্ছে তার খবর না পেলেও মহিলারা নিজেরা তৎপর হয়ে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে নানা রায় দিয়ে যাচ্ছে। মিসেস পাল লেডিজ ক্লাবের একজন পাণ্ডা। ফার্স্ট লেডি, জেনারেল ম্যানেজারের স্ত্রী মিসেস রামমূর্তির পরেই ক্লাবে ওনার স্থান। শোনা যাচ্ছে সেক্রেটারী ও অন্যান্য কমিটি মেম্বাররা প্রেসিডেন্ট মিসেস মূর্তিকে চাপ দিচ্ছে, মিসেস পালের মেম্বারশিপ বাতিল করার জন্যে। প্রেসিডেন্ট এখনো নাকি মনস্থির করতে পারেনি তাই আপাতত কিছু হচ্ছে না। তবে এব্যাপারে আলোচনা করার জন্যে আজ সেক্রেটারী মিটিং ডেকে দিয়েছে।
রুমেলার অদ্ভুত লাগল, মিসেস পালের এতে দোষ কোথায়! ওনার স্বামীর অপরাধে ওনাকে শাস্তি দেওয়া হবে কেন? লোকটাকে বাঁচানোর জন্যে ওদিকে ভিড় করছে সবাই, কম্পানিও হয়ত সমস্ত ক্ষমতা ব্যবহার করবে। কিন্তু তার নিরপরাধ স্ত্রীকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে এক মুহূর্তও সময় অপচয় করতে চায় না কেউ। তাড়াহুড়ো করছে যাতে মওকা হাতের বাইরে না চলে যায়? অদ্ভুত ব্যাপারস্যাপার এদের!
রুমেলা লেডিজ ক্লাবের মেম্বার, তবে যায় টায় না। বিয়ে হয়ে আসার পরেই পাশের কোয়ার্টারের বর্ষা ওকে নিয়ে গিয়ে মেম্বার বানিয়ে ছিল। অনুপম তেমন গুরুত্ব দেয়নি ব্যাপারটাতে,শুধু একটু হেসে মন্তব্য করেছিল, "দ্যাখো, এক আধবার গিয়ে, ভালো না লাগলে বেশী না গেলেই হবে। এমনিতে ওটা গসিপের আখড়া, তবে সবার সঙ্গে চেনাজানা হবে, ভালোই তো"!
গিয়েছিল এক দুবার, এখনো কোনো অনুষ্ঠান হলে দল বেঁধে সেজেগুজে যায়। তবে ওখানে বড় বেশী কার স্বামী কোন পোস্টে আছে সেই নিক্তিতে সব কিছু মাপা হয়। সিনিয়র অফিসারদের বৌয়েরা দলবাজী করে, ক্লাবের কর্মকাণ্ড বড় বেশী অফিস রাজনীতির রঙে রাঙানো। ওদের যাদের স্বামীরা অনেক জুনিয়র তাদের পোষায় না, তারা নিজেদের মত দল বেঁধে আলাদা থাকে। অবশ্য ওদের যাওয়া না যাওয়া নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামায় না। ঠিকসময় চাঁদা দিলে আর দু চারটে প্রোগ্রামে দল ভারী করলেই তারা খুশী।
মিসেস পাল বা পালবৌদির সঙ্গে ওর প্রথম দেখা হয়েছিল সাপ্তাহিক শনিবাজারে। সেই কিছুদিন হল বিয়ের পর ওরা নতুন কোয়ার্টারে উঠে এসেছিল। দেবযানীরা আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। অনুপমের সঙ্গেও পালেদের আলাপ ছিল না তখন। অনুপম এমনিতে মুখচোরা, বিয়ের আগে ওর বাঙালী সমাজে মেলামেশা বিশেষ ছিল না। পালসাহেবকে চিনত এইটুকুই, তার বা তার পরিবারের সঙ্গে কোনোরকম আনুষ্ঠানিক পরিচয় ছিল না।
মহিলাকে ওর খুব একটা ভালো লাগেনি। কথা যদিও ঠিকঠাক বলছিল তবু কেমন একটা ভীষণ অহঙ্কারের ছাপ ছিল চোখেমুখে। এর পরে বাঙালী অ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানে পুজো ইত্যাদিতে দেখেছে কয়েক বার। ঐ দেখা হলে হাসি, "কী, কেমন", এর বেশী আলাপ এগোয়নি। সেদিন ভদ্রলোক বরং তুলনায় প্রচন্ড অমায়িক ও আন্তরিক ব্যবহার করেছিল।
মনে পড়তেই রুমেলার অস্বস্তিতে ভরে গেল মন। মানুষকে কতটুকু চিনি আমরা?
এতজনে এত কথা বলছে, মেয়েটার জন্যে একটা আহাও নেই কোনো মুখে! এ সমাজের নয় সে, তাই বোধহয় তার ক্ষতি নিয়ে কারোর কোনো মাথাব্যথা নেই। অনুপম মাঝে একবার ফোন করেছিল, বেল হচ্ছেনা। অফিস থেকে সেরকম চেষ্টাই নেই, যদিও এইচ আরের লোক পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছে। জি এম এখন এখানে নেই, বিদেশে গেছেন। তাই সবাই গড়িমসি করছে। অবশ্য মিডিয়াটা নাকি সামলানো গেছে, এখনি লোক জানাজানি হচ্ছে না।
দু:খেও হাসি পায় রুমেলার। লোক জানাজানির যেন এখনো কিছু বাকী আছে? বাড়িতে বাড়িতে টেলিফোন আছে কী করতে? বাঙালী বৌয়েরা এদিকে জাতের অপমান হল বলে একেবারে লজ্জায় ঘেন্নায় মুষড়ে পড়ছে, ওদিকে আবার নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে কলকাতা ও আরো যেখানে যত নিজেদের আত্মীয়স্বজন আছে, সবাইকে জানাচ্ছে।
দুপুরে লাঞ্চে এল অনুপম। খুব গম্ভীর, ওরা গিয়ে লক আপে পাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছে। একরাতে লোকটার যা অবস্থা হয়েছে তা নাকি চোখে দেখা যায় না। ওনার কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে মিসেস পালকে ফোন করে আসতে বলে দিয়েছে। সত্যি কথাটা জানায়নি,বলেছে পাল সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। উনি আজকে রাতের ট্রেনেই রওনা হবেন, কাল ভোরে পৌঁছবেন।
-"অসুস্থই তো। কোনো সুস্থ মানুষ এরকম আচরণ করে না।"
অনুপম হঠাৎ রেগে গেল ওর মন্তব্যে, থালাটা একটু ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল,
-"শান্তিতে খেতেও দেবে না? আমার তো তোমাকেই অসুস্থ মনে হচ্ছে। অন্যের ব্যাপার নিয়ে সকাল থেকে বাড়িতে অশান্তি করছ।"
ও একটু থমকে গেল। অনুপম এমনিতে খুবই ঠান্ডা, এরকম রেগে যায় না চট করে। কিন্তু সকাল থেকে ঐ রেপিস্ট লোকটাকে কিছু বললে এত খেপে যাচ্ছে! মুহূর্তের জন্যে এক অচেনা ভয় যেন গ্রাস করে ওকে, নি:সাড় করে দেয়।
কোনো রকমে সামলে নিয়ে, ও থালাটা আবার অনুপমের সামনে করে দিয়ে বলে,
-"সরি, খেয়ে নাও। তোমার যখন শুনতে ভালো লাগছে না, এনিয়ে আমাদের মধ্যে আর কথা না হওয়াই ভালো।"
অনুপমও বোধহয় ওভাবে তাৎক্ষণিক স্বভাব বহির্ভূত ব্যবহার করে একটু লজ্জিত হয়ে পড়ে। আর কোনো কথা না বলে খেয়ে নেয়।
দুপুরে ঘরে একাকিনী রুমেলা টিভি খুলে এ চ্যানেল ও চ্যানেল করতে থাকে। দিল্লীতে একজনকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করেছে কতগুলো লোক। মহারাষ্টের কোন গ্রামে এক দলিত বিধবা মহিলাকে গ্রামের উচ্চবর্ণের সমাজপতিরা এসে তার ছেলেমেয়ের সামনে ধর্ষণ করেছে। চারিদিকে সব চ্যানেলে শুধু যেন আজ ধর্ষণের বা অন্য কোনোভাবে মেয়েদের ওপর অত্যাচারের খবর। এরকম কি রোজের খবরেই শোনা যায় নাকি আজই সারা পৃথিবীজুড়ে কোথাও না কোথাও বিভিন্ন মেয়েরা ধর্ষিত,অত্যাচারিত হয়েছে? কে জানে, হয়ত রোজই এরকম হয়ে থাকে, খবরে বলেও, সেই হয়ত আগে কখনো খেয়াল করে শোনেনি।
ভাবতেই কেমন যেন অস্বস্তি হয়, দু একটা খবর মন দিয়ে শোনার পরে টিভি বন্ধ করে দেয়, অসুস্থ লাগে।
চোখ বুজে বিছানায় শুয়েও বিদেশী চ্যানেলের ঐ মেয়েটার মুখ ভাসে চোখে। কালো মেয়ে, বারো না তের বছর বয়সে বিদ্রোহীরা কিডন্যাপ করে জঙ্গলে ধরে নিয়ে গেছিল, আরো অন্য মেয়েদের সাথে। তারপরে আটবছর ধরে ওদের এক কম্যান্ডার নিয়মিত ওকে ধর্ষণ করে, প্রায় রোজ, প্রতিদিন। আটবছর বাদে সরকারী বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াইয়ে,বিদ্রোহীরা পরাজিত হলে, মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয় অন্য মেয়েদের সাথে। সাক্ষাতকার যে নিচ্ছিল সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, "তোমার কী মনে হত? কী করে সহ্য করতে তুমি?"
মেয়েটি কেমন একটা অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে একটা বুক নিংড়োনো স্বরে বলছিল,
-"রোজ রাতের পরে আমার ভেতরটা খালি হয়ে যেত। মনে হত আমার ভেতর থেকে সবকিছু বার করে নেওয়া হচ্ছে। সারাদিন, মাস বছর আমি সেই খালি, রিক্ত আমিকে নিয়ে ঘুরতাম। কোনো কিছুতেই কিছু মনে হতনা, কারণ আমার মধ্যে কিছু ছিল না, কোনো অনুভূতি, অন্য কোনো কিছু।"
-"এখন কী মনে হয়? তুমি প্রতিশোধ নিতে চাও? বিদ্রোহ শেষে শান্তিস্থাপনের পরে ঐ কম্যান্ডার তো এখন এই শহরেই থাকে।"
সেই উদাস চাহনিভরা চোখ কেমন যেন জ্বলে ওঠে এ কথা শুনে, কালো মুখে আগুনের ফুলকি ছড়ায়। কোলে তার ধর্ষণকারীর সন্তান,
-"হ্যাঁ, চাই। আমি প্রতিশোধ নিতে চাই।"
ক্যামেরা এবার সেই ধর্ষণকারীর মুখে জুম করে। লোকটার সাফাই গাওয়া আর দেখতে পারেনি। ওই মেয়েটার ওপর দৈত্যটা অমন অত্যাচার করেছে ভেবে ভীষণ গা গুলিয়ে উঠল। এই মেয়েটাকে তো দেখেনি কিন্তু কেমন মনে হচ্ছে ঐ টিভির মেয়েটার মতোই হবে মুখখানা, কালো মেয়ে। নিজের ভেতরটা খালি করে তার সেই শূন্যতা নিয়ে কোন আড়ালে বসে আছে এখন, কে জানে!
-"শুনেছিস?'
-"কী?"
-"লোকটার তো জামিন হচ্ছে না। ঠিক হয়েছে, না হওয়াই ভালো। হ্যাঁরে, অনুপম নাকি থানায় গেছিল?"
দেবযানীর চোখ এড়িয়ে এই অঞ্চলে কোথাও কিছু হওয়ার জো নেই।
-"হ্যাঁ, ঐ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারী পলাশদা যেতে বলল।"
-"ও:, ওটা আরেকটা। সুশান্তকেও ফোন করেছিল, ও সোজা যাবেনা বলে দিয়েছে। অনুপম গেল কেন? এসব ব্যাপারে ঢুকতে যাওয়া একদম উচিৎ হয়নি।"
মতে যদিও মিলছে এ ব্যাপারে তবু বুঝতে পারল দেবযানীর ভাবনা ওর ভাবনাস্রোতের সম্পূর্ণ বিপরীতে বইছে। ওরা এব্যাপারটায় ঢুকতে চায় না কারণ ব্যাপারটা তাদের ভাষায় নোংরা তাই।
-"যদি সত্যি ভদ্রলোক নির্দোষ হয়? অনেকেই তো মনে করছে ওনাকে ফাঁসানো হচ্ছে।"
-"চুপ কর, সবাইকে ছেড়ে ওনাকেই কেন ফাঁসানো হচ্ছে একেবারে কিছু না করলে? আমার এ কলোনিতে অনেকদিন হল, তুই তো সবে এসেছিস। এখানকার সব ভদ্রলোকেদের যা কীর্তি, শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। এসব কি ওই পলাশ বলছে? ওটা কি কম শয়তান নাকি? বলবেনা কেন, সুশান্ত বলছিল ওর তো দারুর আড্ডা চলে পালসাহেবের সাথে। তুই জানিস পলাশদের কথা? সেই যে ছেলেটার বউ আত্মহত্যা করেছিল, ওদের দলে নাটের গুরু তো এই পলাশই ছিল।"
রুমেলার এখন আর অন্য কিছু শুনতে ইচ্ছে করছিল না। কেমন যেন মনে হচ্ছিল দেবযানীকে না থামালে ও সেই ঢাকনাটা খুলে দেবে আর কৌটোভর্তি ঘিনঘিনে পোকার দল কিলবিল করে বেরিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে যাবে। ভাবতেই শিরশির করে উঠল গা, তাড়াতাড়ি বলে,
-"আরে ছাড় না, ওসব কথা। তুই ক্লাবে যাবি নাকি? বর্ষা ফোন করে বলল সেক্রেটারী মিসেস আগরওয়াল সবাইকে অবশ্যই যেতে বলেছে, আজকের মিটিং জরুরী।"
লেডিজ ক্লাব দেবযানীর খুব প্রিয় টপিক। ঐ প্রসঙ্গ তুলতে সে পলাশের কথা ভুলে গেল।
-"গেলে হত, কিন্তু আজ আমাদের একটু সুন্দরনগরে যেতে হবে। সুশান্তর বন্ধুর মেয়ের জন্মদিন। তুই যাবি ক্লাবে?"
-"না, আমি যাব না। এক অন্যায়ের জবাব আরেক অন্যায় দিয়ে হয় না। স্বামীর দোষে মিসেস পালকে শাস্তি দেওয়া হলে, তাতে আমি নেই।"
দেবযানী হেসে ফেলল ওর জবাব শুনে,
-"সত্যি, রুমেলা তুই না কেমন যেন। সুশান্ত ঠিকই বলে যে তুই এখানে, এই কলোনিতে একদম বেমানান। লেডিজ ক্লাবের ভিত্তিটাই তো আমাদের স্বামীদের চাকরি, তাদের কাজের ফলাফল ওখানের কাজকর্মে প্রতিফলিত হওয়া তো স্বাভাবিক। কাল যদি পালসাহেবের চাকরি না থাকে তো মিসেস পাল কি আর এই কলোনিতে বা ক্লাবে থাকতে পারবে?"
দেখতে গেলে ভুল খুব কিছু বলছে না। ওদের প্রত্যেকটা যুক্তি ওদের মত করে একদম ঠিক। তাহলে সেই কি বেমানান এখানে? কে জানে! কিছুক্ষণ একভাবে শুয়ে থেকে উঠে পড়ে, জল খায়। বেলা চারটে বেজে গেছে। ঝাড়ু নিয়ে ঘরগুলো ঝাঁটা দিয়ে দিল। আজ কাজের লোক আসেনি। বুড়ি ভানমতীর নাতির অসুখ, সে কাল ছুটি নিয়ে গেছে। ভানমতী ঐ গাঁয়ের লোক, ও যদি আসত আজ, ওর থেকে মেয়েটার খবর জানা যেত!
ভীমা পাহাড়ের গা বেয়ে দেহাতী সন্ধ্যা নেমে আসে। অনুপম বাড়ি ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে চা নিয়ে বসতে না বসতে পলাশ ও আরো দুজন এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল। ফিরল সেই রাতে। খাবার টেবিলে রুমেলা ঐ প্রসঙ্গে একটা কথাও জিজ্ঞেস করল না। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্বগতোক্তির মত করে অনুপম আওড়াতে থাকে,
-"ষড়যন্ত্র একটা হয়েছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। নাহলে এইচ আর এত উদাসীন হয়! কিন্তু কারা করছে বার করা যাচ্ছে না। ওপরে যাদেরই সঙ্গে দেখা করছি, মুখে খুব সহানুভূতি দেখাচ্ছে, কিন্তু কাজের কাজ কিস্যু হচ্ছেনা। মেয়েটার বাবার সঙ্গে কথা বলতে একজনকে পাঠিয়েছিল পলাশ, তা তারা কেউ বাড়িতে নেই, কোথায় আছে কেউ বলতে পারলনা বা বলল না। শহরের একজন উকিল ধরা হয়েছে জামিনের জন্যে। সে তো কোনো আশাই দিতে পারছেনা।
রামমূর্তি সাহেব নেই, সেই সুযোগটা নিয়েছে বদমায়েশরা। উনি থাকলে পুলিশ অবধি কোনোভাবেই গড়াতনা ব্যাপারটা। এখন চার্জে আছে বুড়ো কেতকার, তার তো রিটায়ারমেন্টের আর দুমাস বাকী। পুরো শিখন্ডী, শুধু নিজের পি এফ গ্র্যাচুইটির হিসেব কষে আর যে যা ফাইল আনে, লোকের মুখ দেখে সই করে। থানা থেকে বলছে গ্রেফতার করার আগে ওরা নাকি কেতকারের অফিসে ফোন করে সব জানিয়েছিল, সেখান থেকে কোনো আপত্তি জানানো হয়নি। কাল পালবৌদি আসছে, খুব স্যাড। "।
রুমেলা কোনো উত্তর করে না। বিরক্তিতে মন ভরে যায় তার। যার শাস্তি হওয়া উচিৎ সেই লোকটাকে, একটা লম্পটকে, উল্টে ভিকটিম সাজানোর প্রক্রিয়া চলছে। এমনি এমনি রেপ চার্জ আনতে পারে না পুলিশ কারোর ওপর। সে ঠিক জানে না তবে যা পড়ে কাগজে তাতে মনে হয়েছে পুলিশে রিপোর্ট করলে তারা প্রথমে মেডিক্যাল টেস্ট করায় অভিযোগকারিণীর। প্রাথমিক টেস্ট রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই অ্যারেস্ট করে। নিশ্চয়ই পুলিশ সেসব করিয়েছে। এমনি এমনি একজন বড় অফিসারকে শুধু একটা আদিবাসী মেয়ের মুখের কথার ওপর গ্রেফতার করেনি।
মেয়েটার কী হয়েছে? তাকে ডাক্তার দেখে চিকিৎসা করেছে না এমনি ছেড়ে দিয়েছে গরীব বলে, ঘেন্নায় অবহেলায়? সেকী মনের সাথে সাথে শরীরেরও যন্ত্রণাতে কুঁকড়ে কোথাও আড়ালে অন্ধকারে পড়ে আছে? মনে হতে আর ঘুমোতে পারে না ও। এপাশ ওপাশ করে ভাবতে চেষ্টা করে সেই ব্যথার কথা, পারে না!
সকালে ভানমতী এল একটু দেরী করে। অনুপম তখন অফিসে বেরিয়ে গেছে। রুমেলা ভেবেছিল আজও বোধ হয় ভানমতী কাজে আসবেনা। অবশ্য কাজ সবই পড়ে ছিল। ভানমতী এসে ময়লা কাপড় সব বাস্কেট থেকে নিয়ে ভিজিয়ে ফেলল। তারপরে ঘরদোর পরিস্কারে লেগে গেল। রুমেলা দেখেশুনে নিশ্চিন্ত হয়ে দুদিনের পুরনো কাগজ নিয়ে ড্রইংরুমে বসল। এই কোয়ার্টারে আসা থেকে ভানমতীই ওর বাড়ি কাজ করছে। বয়স হয়েছে কিন্তু এখনো বেশ কর্মঠ। সবচেয়ে যা ভালো লাগে রুমেলার তা হল ওর পরিচ্ছন্নতা আর নির্লোভ স্বভাব। নিজে সকাল বিকেল পরিস্কার খারে কাচা কাপড় পরে আসে। বিকেলে আবার মাথায় তেল মেখে কগাছি চুলকে টানটান করে বড়ি খোঁপা বেঁধে রাখে। সকালে কাজ করে এখানেই জলখাবার খায় আবার দুপুরে এসে ভাত খেয়ে কাজ করে। ও খেতে চায়নি, রুমেলা নিজে এই বন্দোবস্ত করেছে। বুড়ির দুই ছেলে মাকে দেখেনা, মেয়ের সঙ্গে থাকত, মেয়ে মরে গেছে। সেই মেয়ের ছেলে নাতিকে নিয়ে ভানমতী আলাদা থাকে। রুমেলা ছাড়া ও কিংগে সাহেবের বাড়িতে কাজ করে। কিংগেরাও বুড়িকে খুব ভালোবাসে, সাহায্য করে, চলে যায়। নাতিটাকে স্কুলে পড়াচ্ছে।
বিয়ে হয়ে আসা থেকে ভানমতী রুমেলার সঙ্গে অভিভাবকের মতো থেকে, ওকে সংসারের কত কিছু শিখিয়েছে। ভানমতীকে ছাড়া সংসার ও ভাবতেই পারেনা। অথচ দুজনের মধ্যে কথা গল্প খুব বেশী হয়না, তবু একটা সুন্দর বোঝাপড়া কাজ করে যা হয়ত মনিব ভৃত্য সম্পর্কের থেকে কিছু বেশী গভীর।
ও অপেক্ষা করতে থাকে কখন ভানমতী সব কাজ সেরে রুটি তরকারী নিয়ে পেছনের বারান্দায় বসবে। ভানমতীও বোধহয় তেমন কোনো অপেক্ষায় ছিল।
সীতা, মেয়েটার নাম। সীতা নামের মেয়েরা কি দুনিয়ায় রাবণদের দ্বারা অতাচারিত হওয়ার জন্যেই জন্মায়? "ও মেয়ে বড় ভালো দিদি, ছোট থেকে দেখছি, সাদা মেয়ে"। তবে বড় দুখী, বাপটা মদ খায়, এই করেই রোজগারের সব পয়সা উড়িয়ে দিয়েছে। পণ না দেওয়ার জন্যে মেয়েটার গাওনা হয়নি, তারা ছেলের আরেকটা বিয়ে দিয়েছে। তাও ওর ঠাকমা বুড়ি গেছিল তাদের পা ধরতে যদি সতীনের কাজকম্ম করার জন্যেও বিনাপণে ঘরে নেয় মেয়েটাকে। তা তারা রাজী হয়নি, বিনাপণে একটা খাওয়ার মুখ কে আর বাড়াতে চায় শুধু শুধু।
ঐ ঠাকুমার রোজগারেই ওদের খাওয়াপরা চলে কোনোরকমে, তাও সে বুড়ি একমাস হল রোগে ভুগছে। এদিকে মেয়েটার আবার ভাব হয়েছে গাঁয়ের ছেলে লখনের সাথে। লখন ছেলে ভালো, করিৎকর্মা। কারখানায় ঠিকাদারের মজদুরের কাজ ছাড়াও বাবুর বাড়ি মালির কাজ করে। একটু টাকা জমলেই ওরা বিয়ে করত। সব গোলমাল হয়ে গেল।
গাঁয়ে লোক বেশী নেই, তার মধ্যে যাদের একটু অবস্থা ভালো তারা সব কারখানার মজদুর। কারখানার বাবুর বিরুদ্ধে থানায় গেছে মেয়েটা, সবাই ভয়ে ভয়ে আছে। কেউ এখন ইচ্ছে হলেও ওদের সাহায্য করবে না। মেয়েটাকে আর ঠাকুমা বুড়িকে নদীর ওপারে মেয়েটার পিসীর ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সীতার কথা কি ও বলবে অনুপমকে? বলবে ভানমতীর কাছে যা শুনেছে সেইসব কথা? সাদা সরল গেঁয়ো মেয়েটা মিথ্যে কথা বলতে পারেনা, কোনো ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হতে পারেনা। অন্যায় হয়েছে ওর সাথে।
সারাদিন ভেবেও ঠিক করে উঠতে পারে না সে কী করবে। অনুপম কলেজে ইউনিয়নের পান্ডা ছিল, এ নিয়ে অনেক গল্প অনেকবার শুনেছে। শুনে মুগ্ধ হয়েছে, সাহসী, সত্যবাদী,অসহায় মানুষের পাশে থাকত সে, তাদের জন্যে লড়াই করত। সীতার মত মেয়েদের কথা,সবহারাদের কথা, বুঝিয়ে বললে বুঝবে না?
দুপুরবেলায় ফোন এল। আগেরদিন সারাদিনরাতে ঘুম তেমন ভালো হয়নি। খাওয়ার পর থেকে চোখটা টেনে আসছিল। একটা বই নিয়ে শুয়েছিল কিন্তু এক পাতা পড়তে না পড়তেই ঘুম জুড়ে এল দু চোখের পাতায়। ঘুমের মধ্যেই ফোনের আওয়াজ কিন্তু তখন হাত বাড়িয়ে সাইড টেবিল থেকে রিসিভারটা তোলার মত চৈতন্য নেই। ফোন বেজেই যেতে থাকল, থেমে থেমে আবার, অনেকবার। শেষে ভেঙে গেল ঘুম, উঠে বসল ধড়ফড় করে। ফোন অনেকক্ষণ বেজে যাচ্ছে, এটা খেয়াল হতেই একটা অপরাধবোধ, তখন অবশ্য থেমে গেছে। ফোনটা এল কয়েক মিনিট বাদে আবার। পালবৌদির ফোন।
-"শুনেছিস?"
-"কী শুনব?"
-"পালবৌদি সকালে এসেছে। জানিস, এসে থানায় যায়নি। সোজা গেছে মিসেস রামমূর্তির কাছে, কেঁদেকেটে একসা। মিসেস মূর্তি তো ভালোমানুষ, সান্ত্বনা দিয়ে চা টা সব খাইয়েছে। গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। মূর্তিসাহেব কাল ফিরছেন। উনি এলেই যে করে হোক জামিনের বন্দোবস্ত করাবেন বলেছেন। কিরকম ধুরন্ধর মহিলা দেখলি, একেবারে এদিকওদিক না ঘুরে সোজা আসল গন্তব্যে পৌঁছে গেছে।"
-"ওনার সঙ্গে লেডিজ ক্লাবের জন্যে মিসেস মূর্তির দহরম বেশী, তাই ওখেনে গেছেন। ভুলটা কোথায়?"
-"শুধু তাই, সবাইকে ফোন করছেন। ইনিয়ে বিনিয়ে ওনার স্বামীর সঙ্গে কী অন্যায় হচ্ছে তার কথা। আমাকেও করেছিল, সে কী গলা, একেবারে মধু মিছরি মেশানো।"
-"তোদের সাথে তো ওদের ভালো সম্পর্ক ছিল। তোরাই তো আমাদের সঙ্গে আলাপ করে দিয়েছিলি।"
-"সম্পর্ক আবার কী, কলোনিতে কিছুদিন হয়ে গেলে সবাই সবাইকে চেনে। নাহলে উনি আমাদের পাত্তা দিতেন নাকি? ঐ বাঙালী বলে পুজো পয়লা বৈশাখে মেলামেশা করতেন। ওনার বাড়ির অন্যান্য সব হাই ফাই পার্টিতে তো শুধু বড় বড় লোকেদের ডাকত। সেই সব লোকেরা আর ওর লেডিজ ক্লাবের সঙ্গীসাথীরা তো এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তাই এখন বাঙালীরাই ভরসা।
সে কী কথা, তুই যদি শুনতিস। "বিশ্বাস কর দেবযানী, উনি এরকম করতেই পারেন না। আমি স্ত্রী, আমার স্বামী সেরকম হলে আমি জানব না। তোমাদের পালদা তোমাদের এত ভালোবাসেন, তোমরা ছাড়া আমাদের আর কে আছে!"
রুমেলা আর বলে না যে সেও ফোন পেয়েছে মিসেস পালের। ফোনটা পেয়ে ওনার কথা শুনে একটু খারাপ লাগছিল। একবার মনে হচ্ছিল অন্তত এই ভদ্রমহিলার জন্যে, ছেলেমেয়েদুটোর জন্যে, সমস্ত অভিযোগ মিথ্যে বলে প্রমাণিত হোক। তখনি আবার সীতার কথা মনে পড়ে গেল, সেই সীতা যে রামায়ণ কে উল্টে লখনকে ভালোবাসে, যে কোনো রামের ভরসায় না থেকে নিজেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে রাবণের বিরূদ্ধে।
-"তা তুই কী বললি? শুনিয়ে দিলি তো দুকথা?"
ব্যস, না জেনেই সাপের মন্ত্র আউড়ে ফেলেছে ও, দেবযানীর ফণা মানে গলার স্বর নেমে গেল। আমতা আমতা করে বলে,
-"না মানে সেকথা কি মুখের ওপর বলা যায় কারো? বললাম চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।"
অনুপম আজ তাড়াতাড়ি ফিরল। আজ আর কেউ ডাকল না, কারো ফোনও এলনা। প্রাথমিক উত্তেজনায় একটু ভাটা পড়েছে মনে হয়, লোকটা এখনো জেলে। টিভিতে খবর শেষ হতে উঠে কম্পিউটারে গিয়ে বসল। এখানে বেশীরভাগ দিনই নেট ঠিকমত চলেনা। কিছুক্ষন চেষ্টা করে বিরক্ত হয়ে বন্ধ করে দিল। রুমেলা একটা গানের প্রোগ্রাম দেখছিল, অনুপম সেখানে এসে বসল।
-"ধুত্তোর, এই বি এস এনেলের কানেকশন টা বন্ধ করে দেব। অর্ধেকদিন তো চলেই না। চললেও এত স্লো, কিছু করা যায়না। একটু ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখব ভাবছিলাম। যতসব বনজঙ্গলের পুলিশ, পুরো জঙ্গলের নিয়মকানুন চলছে। উকিলও তো তেমনি এখানকার, পড়ে পাস করেছে বলে মনে হয়না। বৌদি এত আপসেট হয়ে পড়েছে, পলাশের বাড়িতে দেখে খারাপ লাগল। কালকে জি এম বিকেলে অফিসে আসবেন। পলাশরা তখনি গিয়ে আগে ওর সঙ্গে দেখা করবে।"
রুমেলা টিভির সাউন্ড টা কম করল। বৌদি আপসেট হবার দু:খে কাতর হওয়াটাকেও সয়ে নিল। অনুপমের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা না বলার প্রতিজ্ঞা আর রাখা যাচ্ছেনা। বাড়ির এই অস্বস্তিকর আবহাওয়া একটু হাল্কা করার উদ্দেশ্যেই দু কাপ চা করে আনল অসময়ে,
-" মেয়েটার নাম জানো? সীতা, বড্ড দুখী মেয়ে"।
একটু একটু করে শোনায় ও সীতাকাহিনী। যদি হতে পারে অনুপম আজকের রাম, যদি পারে উদ্ধার করতে সীতাকে। শুধু কি সীতাকে, ওকে নয়? চারপাশ দেখে ও নিজেও যে কেমন একটা আশংকার, ভয়ের চোরাবালির অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। আজ যদি অনুপম ওর হাত না ধরে আর কে ধরবে!
-"কে বলল তোমাকে এসব? ভানমতী। হ্যাঁ, ওতো ঐ গ্রামেই থাকে। কোন বাড়িতে মালির কাজ করে লখন? ডি -১২, ডি - ১২ মানে শ্যামলালের বাড়ি। আরে শ্যামলাল, এইচ আরের হেড। ও, এখন বুঝতে পারছি, এব্যাপারে শ্যামলাল জড়িত। এইজন্যেই পুলিশের এত তড়পানি। দাঁড়াও, পলাশকে ফোন করি। তুমি তো দারুন একটা ক্লু জোগাড় করেছো ঘরে বসে বসে। না:, আমার বৌ টা দেখছি ক্যাবলা মত হলেও আসলে ভালোই বুদ্ধি ধরে।"
রুমেলা ঠিক বুঝতে পারেনা কী হল বা কী হতে চলেছে। কী করে বসল সে? মাথার মধ্যে সমস্ত চিন্তা ভাবনাকে ঠেলে সরিয়ে খালি করে দিয়ে সে জড় হয়ে যায়। মনের আয়নায় নিজের সঙ্গে দেখা করার সাহসটুকুও তার আর রইল না। একটা আধো জাগরণে আধো ঘুমের অবস্থায় সকালে ওঠে। কিছুই মনে থাকে না, মনে রাখতে চায় না। সে অন্য রুমেলা হয়ে যায়, হয়ে যেতে চায়। আত্মকেন্দ্রিক, সংসারী বুঝি বা স্বার্থপরও। মুখে কিছু না বললেও ভানমতী বার বার ওর দিকে চেয়ে থাকে, আশায়। সেই আশার ঝলক যেন ধাঁধিয়ে দ্যায় রুমেলার চোখকে। ও সেই যে চোখ সরিয়ে নিল, আর সারাদিনে ভানমতীর দিকে তাকালো না।
-"দারুন খবর, কালই জামিন পেয়ে যাবে পালদা। রামমূর্তি সাহেবের সঙ্গে আমাদের কথা হয়ে গেছে। সব শুনে শ্যামলালকে উনি ডেকে পাঠালেন আমাদের সামনে। ভেবে দ্যাখো, এতদিনে টুঁ শব্দ করেনি, অথচ ওই পুলিশকে ফোন করে কেসটা নিতে বলেছিল। এখন বলছে, সেসময় লখন ওর বাড়িতে কাজ করছিল, মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে সেখানে লখনের কাছে আসে। লখন ওকে সব বলতে, মেয়েটার কথা বিশ্বাস করে সে নাকি ওদের থানায় যেতে বলেছিল। সাহেব তো খুব ঝাড় দিয়েছে, কম্পানির সুনামের কথা খেয়াল না করে এরকম কাজ করেছে বলে।
বেটা বিহারী, ঘুষখোরের জাত, ভাবখানা একেবারে সাধু যুধিষ্ঠিরের। বলে ওর নাকি তখন মানবিক বোধ জেগে উঠেছিল, কম্পানির কথাটা ভুলে গিয়েছিল। কাল সকালে প্রথমে উকিলকে নিয়ে এসে জামিনের সব ফর্মালিটি সারতে হবে। সাহেব বলে দিয়েছেন কম্পানির লইয়ারও সঙ্গে যাবে। আগে পালদার জামিন হোক তারপরে ওই লখনকে ডেকে পাঠিয়ে ওদের রগড়াতে হবে যাতে কেস তুলে নেয়।"
রাতে স্বপ্ন দেখল, আফ্রিকার সেই কালো মেয়েটাকে, কোলে তার ধর্ষণকারীর সন্তান। রুমেলা পাতালে তলিয়ে গেল সীতার হাত ধরে। অনিচ্ছুক নারীদেহকে ছিঁড়ে খুঁড়ে সম্পন্ন হয় বীর পুরুষের বিজয় উৎসব অনুষ্ঠান। আর নারী? সে শূন্য হয়ে গেল,স্বপ্নহীন, স্মৃতিহীন। তার মধ্যে আর কিছু রইল না। পৃথিবীর কেউ জানল না, মিডিয়ার খবর না হয়েও সে সীতাদের দলের একজন হয়ে গেল আজ, সেই একই হৃদয়, এক অনুভূতি, বুঝি বা একই ব্যথা।
ভানমতীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে ব্যাঙ্কে গেল রুমেলা। কলোনির ব্যাঙ্কের সময় শুরু হয় কারখানার সময়ের সঙ্গে। রিকশাওয়ালাকে যখন ফাঁকা রাস্তার ধারে টিলাটার পাশে ছেড়ে দিল, ছেলেটা ওর দিকে বিস্ময়ে তাকালো ওরকম জায়গায় নামতে দেখেই বোধহয়,তবে মুখে কিছু বলল না। দূরে কলোনির পাঁচিল দেখা যাচ্ছে, কোয়ার্টার এখান থেকে বেশী দূরে নয়। প্রথম প্রথম ছুটির দিনে বিকেলে একটা ফ্লাস্কে চা আর ব্যাগের মধ্যে কাপ, চানাচুর বিস্কুট নিয়ে এই টিলার দিকে হাঁটা দিত। টিলার ওপরে পাথরে বসে চা খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখত দুজনে বা কখনো আর কেউ কেউ থাকত বন্ধুরা। এখন টিলাটাকে দেখে সেসব যেন কোন জন্মের কথা মনে হল। টিলাটা পেরিয়ে এর আগে কখনো যায়নি, কাঁধের ব্যাগটা চেপে ধরে এগোলো, পিছনে পড়ে রইল এক বাধার পাঁচিল।
চারধারে গাছপালা বড্ড কম, রুক্ষ শুকনো পাথরের উঁচুনীচু, কাঁটাঝোপ। একটু হাঁটতেই একটা ছোট্ট নালা এলো, শুকনো। নালার ওপারে ভানমতী দাঁড়িয়ে, সঙ্গে আরেকটা লোক। ভুল করে যাতে সে গ্রামের ভেতরে না ঢুকে পড়ে তাই ওরা এগিয়ে এসেছে।
কৌতূহলে, পাশ কাটিয়ে যাওয়া গ্রামটাকে দেখে। লোক দেখা যায়না, সব কাজে বেরিয়ে গেছে। বাচ্চা বুড়োবুড়িরা যারা আছে তারাও হয়ত সব জঙ্গলে বেরিয়ে গেছে। দুটো গোরু বাঁধা, কয়েকটা মুর্গী চরছে, কয়েকটা চালা এদিক সেদিকে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা নদী পারে আসে। নদীও তেমনি, চওড়ায় খালের মত, মাঝখানে হাঁটুজল হবে, এরা বলে নালা। তবে তলায় কাদা না বালি, আর স্বচ্ছ তিরতিরে জলের স্রোত। বড় পিচের রাস্তা ধরে কিছুটা গাড়িতে গিয়ে জঙ্গল আর পাহাড়ের মাঝে এই নদীর ধারে একটা পিকনিক স্পট আছে। সেখানে দু একবার গেছে, দলের সঙ্গে। সঙ্গের খাবার জল ফুরিয়ে গেলে ওরা এই নদীর জল খেয়েছে, খুব মিষ্টি জল, খেয়ে শরীর খারাপ হয়নি।
ওরা ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে নদী পার করালো। শুধু পায়ের পাতা ভিজলো, কী আরাম, ঠান্ডা একটা অনুভব পা থেকে সারা গায়ে ছড়িয়ে গেল। ওপার অত রুক্ষ নয়, বড় বড় গাছের সারি, জঙ্গলের শুরু। একটা ছোট্ট চালাঘরের বাইরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গেলে ভানমতী চেনালো, এই লখন। কালো ছেলেটার মাথাভর্তি কোঁকড়ানো রুক্ষ চুল, সাদা সাদা দাঁত বার করে একগাল হাসল ওকে দেখে।
ছেলেটাকে আগে দেখেনি তবু ওর চেনা লাগল, অনেক চেনা। ঘর থেকে দুজন মহিলা ও একটি পুরুষ বেরিয়ে এল। তারা কে রুমেলা জিজ্ঞেস করেনা, ও দেখতে চায় সীতাকে। না সীতাকেও নয়, সীতার শূন্যতাকে, সেই কালো মেয়েটির সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চায় এই কালো মেয়েটিকে, হয়ত বা নিজেকেও।
সীতা এল, শরীরটা বেঁকে মুচড়ে , চোখ প্রায় তোলেই না। রুমেলা একটা অদ্ভুত কান্ড করে বসে, কেন তা নিজেও জানেনা। চিবুক ধরে সীতার মুখটা তুলে ধরে জোর করে, তারপর ওর হাতটা জোরে চেপে ধরে, অনেক জোরে। যেন ওর দেহের সমস্ত জোর ও সঞ্চারিত করতে চায় ওই মেয়েটির দেহে। সীতার চোখে প্রথমে ভয়, বাকিরা অবাক, কিন্তু কেউ কিছু বলে না। সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে সীতা আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, চোখের দৃষ্টি সহজ, শান্ত। যে হাত ওকে চেপে ধরেছে ও সেই হাতকেই ভালো করে জড়িয়ে ধরে। সে জড়ানোতে আকুলতা নেই, অন্য একটা ভাব, খেলার মাঠের দুই বিজয়ীর হাত মেলানোর মতো।
পুরো দলটা নদী পেরিয়ে জঙ্গলের ধার দিয়ে হেঁটে হেঁটে পিচ রাস্তায় আসে। এই রাস্তা দিয়ে বাস ট্রাক যায় শহরে স্টেশনে। ও বাকীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কলোনির দিকে হাঁটা দেয়, কারখানার লাঞ্চ টাইম হয়ে যাবে একটু পরেই। ওদের দুজনের গাড়িতে ওঠার সময় ও সেখানে থাকতে চায়না। লখন অল্প লেখাপড়া জানে। রুমেলা হিন্দিতে ইংরেজীতে লিখে দিয়েছে, চক্রধরপুরে মামার ঠিকানা, ফোন নাম্বার। মামার সঙ্গে ফোনে কথা হয়ে গেছে, ওদের কোনো অসুবিধে হবেনা।
রুমেলা এখন আগের রুমেলা, কলোনির জুনিয়র অফিসারের বউ। দুপুরে এর তার সঙ্গে ছুটছাট আড্ডা ফোনে,নানা গসিপ শোনা। সন্ধ্যেয় নিপুণ গৃহকর্ত্রী জলখাবারের থালা সাজিয়ে তুলে দেয় অফিসফেরতা স্বামীর হাতে।
-"তোমাদের কী খবর আজ?"
-"খবর বলতে বেল হয়ে গেছে। বাড়ি এসেছেন উনি। তবে একটা ব্যাড নিউজ আছে। দুপুরে পুলিশ অফিসারের সাথে রামমূর্তি সাহেবের মিটিং হয়। তখন ঠিক হয় ঐ লখন ছেলেটাকে ধরে নিয়ে এসে কড়কানো হবে। কেস প্রথমেই তুলে নিলে ভালো নাহলে অহেতুক হয়রানি, তাছাড়া বদনামি। অবশ্য এসব কেস চলে অনেকদিন,ততদিন কেস চালাবার ক্ষমতা ওদের নেই। এক না একদিন কেস ওদের তুলতেই হবে। কথা হল লখনকে দিয়ে স্বীকার করানো হবে যে ওরা মূলত শ্যামলালের উস্কানিতেই এটা করেছে। শ্যামলাল বেটা দেখা করতে গেলে খুব দাঁত খিঁচিয়েছিল। বলেছিল, "পালসাবকে বলুন, ফুর্তি করলে তার দাম তো চোকাতেই হবে"। ওটার একটা শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে সবদিক থেকে শান্তি হত।"
-"তা, ব্যাড নিউজটা কী সে তো বুঝলাম না।"
-"আরে ওই লখন আর মেয়েটা,দুজনেই পালিয়েছে। গাঁয়ের লোকেরা সকালে সব কাজে কম্মে বেরিয়েছিল, কেউ দেখেনি। পুলিশ গিয়ে গাঁয়ে ঝামেলা করছে বলে যদি কিছু হয়, এসব জায়গা ট্রাইব্যাল এরিয়া তো, খুব স্পর্শকাতর, তাই পুলিশ পাঠানো হয়নি। ছেলেটা যার কাছে কাজ করে সেই ঠিকাদারকে পাঠানো হয়েছিল। মেয়েটাকে ওর বাবা অন্য কোথায় পাঠিয়ে দিয়েছিল আগেই, সে সেখান থেকে পালিয়েছে। এরা কিছু জানে না। লখন ছেলেটা নাকি খুব লায়েক, বদমায়েস, অল্প লেখাপড়াও জানত, ঠিকাদার বলছে। খুব মুখে মুখে তর্ক করত, শ্যামলালের পেয়ারের লোক বলে এতদিন ওরা কিছু বলতে পারে নি। এদিকে এখন মেয়েটাকে না পেলে এই কেসের কী হবে কে জানে! পলাশ পালসাহেবকে বলেছে মেয়েটার নামে একটা মানহানির কেস করে দিতে। সেখানে প্রমাণ হয়ে যাবে, মেয়েটা দুশ্চরিত্র , একজনের সঙ্গে পালিয়েছে। তাহলে এই রেপ কেসও নাকি টিকবে না।"
-"শুনেছিস?"
-"কী শুনব?"
-"মহারাজ ফিরেছেন যে রে, শ্বশুরবাড়ী থেকে। সব তো একেবারে মালা টালা পরিয়ে সংবর্ধনা দিয়ে নিয়ে এল। অনুপম যায়নি?"
-"গিয়েছিল হয়ত। জানিনা, জিজ্ঞেস করিনি।"
-"সেকী, সুশান্ত বলছিল, অনুপম খুব হেল্প করেছে। পলাশের একার কম্ম ছিলনা এতসব করা। জি এম নাকি অনুপমের কথাতেই কনভিন্স হয়েছেন, পলাশকে তো ওপরে কেউ পছন্দ করেনা। তবে এখন জানিসতো সুশান্তও একটু দোনোমোনো। মেয়েটার নাকি স্বভাবচরিত্র ভালো ছিলনা, স্বামী পরিত্যক্তা তো। মি: শ্যামলালের বাড়ির মালিটার সঙ্গে প্রেম ছিল, তার সঙ্গেই পালিয়েছে। শ্যামলালের নাকি কীসব অফিশিয়াল দুশমনি আছে পালসাহেবের সঙ্গে। তাই প্ল্যান করে এসব করেছে। কেউ কেউ তো বলছে শ্যামলালের সঙ্গেও মেয়েটার চক্কর ছিল।"
রুমেলার নির্বিকারভাবে বলল,
-"তাহলে তো ভালোই হয়েছে। অল এনডস ওয়েল।"
-"হুঁ, মিসেস পাল সকালে গিয়ে মাতার মন্দিরে পুজো দিয়ে এসেছে, সঙ্গে পলাশের বউ মিঠু ছিল। মন্দির থেকে সোজা মূর্তি সাহেবের বাড়ি গিয়ে প্রসাদ দিয়ে এসেছে। পলাশের প্রোমোশন এবার দেখবি কেউ রুখতে পারবে না। ভদ্রমহিলা সবাইকে ফোন করে ধন্যবাদ দেওয়াও শুরু করেছে শুনলাম। তোর কাছে আসেনি ফোন? অনুপম এত করল।"
বান্ধবীর গলার হাল্কা শ্লেষ ওকে স্পর্শ করে না। "আমি শূন্য, ফাঁকা, ভেতরে যেন কিছু নেই শুধু বাইরে একটা খোলস পড়ে আছে। আসল আমিটা কোথায় কে জানে! "
-"তোর কী ব্যাপার বলতো? সব কিছু তোর ঘরের লোক করছে আর তোর ভাবখানা এমন যেন কিছুই খবর রাখিস না। কিছু বললে চুপ করে থাকিস। কোথায় তুই আমাকে সব বলবি না আমাকে অন্য লোকের কাছে অনুপমরা কী করছে জানতে হচ্ছে।"
পরদিন দুপুরে সবাই মিলে লেডিজ ক্লাবে গেল। হাউজি খেলার সাপ্তাহিক আসরের চেয়ে একটু বেশীই যেন ঝলমলে ঠেকছে ক্লাবকে আজ। কর্মকর্তাদের একজন এসে জানিয়ে গেল, মিসেস পালের রাহু কেটেছে তাই তার অনারে আজ একটু বেশী আয়োজন। হাউজির পরে চা বিস্কিটের বদলে হাই টি, সমোসা ধোকলা আর কেক। মিসেস রামমূর্তি বিকেলের রোদে একখানা হলুদ কাঞ্জিভরমে, সূর্যকেও ম্লান করে দেয় এমন উজ্জ্বল।
রুমেলা অবাক হয়ে দেখে, মিসেস পালের পরণে একখানা সাদার ওপর কালো বুটির কোরা শাড়ি, এলো খোঁপা, গয়না গায়ে প্রায় নেই। এমন নিরাভরণ ভদ্রমহিলাকে আগে কখনো দেখেছে বলে ওর মনে পড়ে না। তাঁতের এত সাধারণ শাড়িতেও দেখেনি কোনোদিন।
ওনার সম্মানে পার্টি, ওনাকেই হাউজি সঞ্চালন করতে বললেন মিসেস জি এম। আশ্চর্য, উনি প্রত্যাখ্যান করলেন, অল্প হেসে, ঘাড় নেড়ে। দু একজন অবাক হল তবে অন্যরা বিশেষ কিছু মনে করল না। অনেকে ভাবল এখনো পুরোপুরি ধাক্কা কাটিয়ে ওঠেননি। হয়ত এটা ওর প্রতিবাদ, লেডিজ ক্লাব ওকে বার করে দিতে মিটিং ডেকেছিল দুদিন আগেই, সে খবর নিশ্চয়ই পেয়েছেন। তাহলেও মিসেস মূর্তিকে প্রত্যাখ্যান?
সব শেষে প্রেসিডেন্ট ভাষণ দিলেন। এখানে সবাই এক পরিবারের মতন, সুখে দু:খে সবাই সবার পাশে থাকবে, এটাই কাম্য। মিসেস পালের দু:খের দিনে সবাই তার পাশে থেকেছে তারজন্য পরিবারের বড় হিসেবে মিসেস মূর্তি সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন। রুমেলা তাকিয়ে দেখল মিসেস শ্যামলাল আসেনি। মিসেস মূর্তির তাড়া ছিল। তিনি চলে যেতেই মিসেস পালও সবার চোখের আড়ালে তার পিছু পিছু বেরিয়ে গেল।
রুমেলা হেঁটে এসেছে দেবযানীর সাথে। ভেতরে তখন শেষ হয়েও রেশ রয়ে যাওয়ার মুডে জোর গল্প আড্ডা চলছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওর ভালো লাগছিলনা, ও বেরিয়ে এল। বাড়ি বেশী দূরে নয়, হাঁটতে শুরু করল আস্তে আস্তে। ওদের কোয়ার্টারের পরেই কিছুটা পুরু ঘাসজমি,সারি সারি ইউক্যালিপটাসের বর্ডার ঘেরা নির্জন বনভূমি পেরোলেই ওপারে বড় সাহেবদের বাংলো। বিকেল হয়নি এখনো, কাজের মানুষদের ঘরে ফিরতে কিছুটা দেরী আছে। রাস্তাঘাটে তাই লোক নেই একেবারে, সব কোয়ার্টারের দরজা জানালা বন্ধ। বাড়ির গেটে হাত দিয়ে চোখ চলে গেল ইউক্যালিপটাসের বনের দিকে। বাংলো যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা ওটা। একটা কালো বুটিদার কোরা শাড়ির আঁচল বাতাসে ওড়ে। একটু এগিয়ে গিয়ে গাছের আড়াল থেকে দেখে একটা কাটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে শাড়িতে মোড়া শরীরটা কান্নায় ফুলে ফুলে উঠছে, নির্জনতাকে সাক্ষী রেখে।
রুমেলা সরে আসে, ইচ্ছে করলেও ওই একান্তকে ছোঁয়ার কোনো অধিকার তার নেই। পা সরে না তবু জোর করে শরীরটাকে টেনে নিয়ে ঘরের চৌহদ্দিতে আসে। চাবি খুলে ঢুকে, সোফায় ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিতে দিতে ভাবে, পৃথিবীতে কত নারী কত শত নারী এভাবে প্রতিনিয়ত শূন্য হতে থাকবে, রিক্ত হয়ে শেষ হতে থাকবে প্রতিদিন!
চিত্রঃ সোনালি সেনগুপ্ত