এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  খবর  টাটকা খবর

  • ডুয়ার্সের ডায়রিঃ ষষ্ঠ কিস্তি

    শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস লেখকের গ্রাহক হোন
    খবর | টাটকা খবর | ০৩ জানুয়ারি ২০১০ | ৯৪৮ বার পঠিত
  • (এই ডায়রিটা শুরু ১১ই নভেম্বর, ২০০৯ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত "জলপাইগুড়ির টাটা চা বাগান" লেখাটার পর থেকে। গত ১৩ই ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় পঞ্চম কিস্তি (http://www.guruchandali.com/?portletId=20&porletPage=1&pid=wpgc:///2009/12/13/1260672740309.html)। আজ ষষ্ঠ কিস্তি।)

    ১৯শে ডিসেম্বর সন্ধ্যা ০৭:৪০




    বেশ কিছু দিন ধরে বাগানেই থাকতে হচ্ছে বেশিরভাগ সময়টা। সেখানে বিদ্যুতের অভাবে ডুয়ার্সের ডায়রির জন্য কিছুই লেখা হয়নি। আরও সমস্যা হয়েছে এই মুহূর্তের ডুয়ার্সের অবস্থার কারনে। একটা দিন সম্পূর্ণ বাগানে বসে কাটালাম কোনও কাজ না করে। ধর্মঘট। আর এখানে কাজের জায়গাগুলো এতই দূরে দূরে যে, ধর্মঘটে ঘটের মত বসে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। নিজের আস্তানায় থাকলে যদি বা নিজের কথা লেখা যায়, বাগানে থাকলে তারও ধর্মঘট।

    তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের সামান্যতম আভাস পাওয়ার সাথে সাথেই এখানে গোর্খাল্যান্ডের দাবি আবার উঠে এল বেশ জোরদার গতিতে। গোর্খা মানুষদের ল্যান্ডের ইমোশনাল ডিমান্ড। এই ডিমান্ডকে আমি খাটো করতে চাইছি না, কিন্তু আমি যে জায়গাটা বুঝতে পারি না, বা বলা ভালো অন্য যে জিনিসটা বুঝতে চাইছি সেটা এই যে, ল্যান্ডের পাশাপাশি সেখানকার সাধারন মানুষের জীবনযাত্রার মানের কী উন্নতি হবে, কী ভাবে উন্নতি হবে সেই পরিকল্পনাটা কোথায়। সেই বিষয়টা কিছুতেই এই ল্যান্ডের ডিমান্ডের মধ্যে থাকেনা। আমাদের চোখের সামনে ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, উত্তরাখন্ড হতে দেখলাম। কিন্তু সেখানকার ভূমিপুত্রদের জীবনের মানের কোন পরিবর্তন চোখে পড়েনি আজও। যে পরিবর্তনটা চোখে দেখেছি তা হল, কয়েকজনের নেতা হয়ে ওঠা, সরকারি ক্ষমতা তাদের হাতে আসা, আর সেখান থেকে কোটি কোটি টাকার মালিকে পরিণত হওয়া। এবং তাদের, আর পাঁচটা জাতের নেতাদের মতই, অন্য দরিদ্র খেটেখাওয়া মানুষদের কথা ভুলে যাওয়া।

    তবুও গোর্খা মানুষদের নিজেদের ল্যান্ডের ডিমান্ডের প্রতি আমার সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। পাহাড়ের শোভা দেখতে যাওয়া ছাড়া কখনও তো জানতে চাইনি ওঁদের কথা। কি ভনক দারিদ্রে কাটে ওঁদের জীবন। আর উত্তরবঙ্গের বাঙালী মানুষদের চোখে গোর্খা আর আদিবাসীদের প্রতি তাচ্ছিল্যই দেখেছি। তারা মস্করা করে বলে নেপালীদের হাঁটুতে বুদ্ধি, আর আদিবাসী মানুষদের তো বুদ্ধিই নেই, তারা কেবল সরল মানুষ। এই সরলতাকে এক্সপ্লয়েট করেছে তারা সবসময়। আজও বুদ্ধিমত্তার সাথেই লড়িয়ে দিতে পারে এরা দরিদ্‌র্‌য আদিবাসী আর নেপালি মানুষদের একে অপরের বিরুদ্ধে।

    গোর্খাল্যান্ডের দাবি কতটা সরকার মেনে নেবেন আমি জানিনা। পাহাড়ের মানুষদের গোর্খাল্যান্ডের দাবি আমরা বুঝতে পারি, তাদের প্রতি দীর্ঘ সময়ের বঞ্চনার কথা আমরা জানি, তাদের দাবিকে উপলব্ধিও করতে পারি শ্রদ্ধার সাথে। কিন্তু ডুয়ার্সে যেখানে ৮০% মানুষ আদিবাসী, চা শ্রমিক, সেই অংশকে গোর্খাল্যান্ডের অন্তর্ভুক্ত করার দাবী মানতে আমার অসুবিধা হয়। কারন এই ল্যান্ডের দাবিতে কোথাও এই বিশাল সংখ্যক আদিবাসী চা শ্রমিক মানুষদের অবস্থানকে ব্যাখ্যা করা হয়নি। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার নেতৃত্বে যতটা আবেগের সাথে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে তারা আন্দোলন চালাচ্ছেন তার একভাগ আবেগের সাথেও এই অঞ্চলে পরপর খুলে যাওয়া বন্ধ বাগানগুলির খোলার চুক্তিতে যে ভনক ভাবে শ্রমিকদের স্বার্থের বিরোধিতা করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করেননি। ঠিক এই জায়গাটায় এসে বুঝতে পারিনা শুধুমাত্র ল্যান্ডের এই দাবি সত্যিই কতটা এই অঞ্চলের গরীবগুর্বো সাধারন মানুষের কথা বুঝতে পারবে, বা বলতে পারবে তাদের কথা।

    কিছুদিন ধরে শিকারপুর বাগানে শ্রমিক সমবায় করার প্রক্রিয়া হিসাবে শ্রমিক লাইনগুলিতে শ্রমিক সমবায় নিয়ে মিটিং চলছে। আমাদেরও থাকতে হচ্ছে শিকারপুর বাগানে। সেখান থেকেই ঠিক করেছিলাম ১৬ই ডিসেম্বর নেওড়ানদী বাগানে যাব। কিন্তু ১৫ তারিখ রাতে একটা খবর এল, গ্রেটার কোচবিহারের ডিমান্ডে ১৬ তারিখ ধর্মঘট। আর সেই ধর্মঘটের আওতায় রয়েছে আসামের ৬টি জেলা সহ উত্তরবঙ্গের ৬টি জেলা। শুনলাম কামতাপুর পিপলস পার্টিও সমর্থন করেছে এই ধর্মঘটের। কিন্তু মনে মনে ভাবলাম সংগঠনই নেই এই দলগুলির তেমন, প্রচারও হয়নি, তাই হয়ত ধর্মঘট তেমন ভাবে হবেনা। আমরা হয়তো যেতে পারব নেওড়ানদী বাগানে। কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বর উত্তরবঙ্গবাসী ধর্মঘট পালন করল। সকালের কাগজে জানতে পারলাম ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে সেপারেট স্টেট ডিমান্ড কমিটি। ১২টি ভিন্ন ভিন্ন দলের সমন্বয়। সবার দাবি পৃথক রাজ্য। কোনও প্রচার দেখিনি, কোনও মিছিল দেখিনি ধর্মঘটের সমর্থনে। অথচ ধর্মঘট সফল। এই সফল ধর্মঘটের অর্থটা বুঝিনি ঠিক। এর মানে কি পৃথক রাজ্যের ডিমান্ডের প্রতি সকল উত্তরবঙ্গবাসীর সহমত আছে? নাকি শুধুই ধর্মঘটের অনুষ্ঠান? আমার কাছে এই বোঝাপড়া গুলি খুবই অস্পষ্ট।

    আবার একটু গভীর ভাবে যখন ভেবে দেখলাম কী আছে গ্রেটার কোচবিহারের ডিমান্ড, তখন সত্যিই সমর্থন করার মত নৈতিক জোর তেমন পেলাম না। কী এই দাবী? কোচ রাজার রাজ্যের সীমানা অনুযায়ী রাজ্য চাইছেন ওঁরা। অর্থাৎ রাজার রাজত্ব ফিরিয়ে দাও। দ্বায়িত্বশীল আর ভক্ত প্রজাদের দাবি। জানিনা এই দাবিতে আজকের সমস্যাকে কোথায় কিভাবে রাখা হয়েছে। সত ভাবে বলতে পারি রাজার অবর্তমানে প্রজাদের রাজার রাজত্বের প্রতি এই আনুগত্য আমার সন্দেহপ্রবণ মন ভালোভাবে নিতে পারেনি। আর সেই রাজার রাজত্ব ফিরিয়ে দেবার দাবিতে আরও একটা ধর্মঘট, সমস্ত কাজ কর্ম বাতিল, এই বিষয়টা তো অসম্ভব হতাশ করেছে।

    ২০শে ডিসেম্বর বেলা ১২:০৫


    গতকাল শিকারপুর বাগান থেকে ফিরে আসার সময় তিন জায়গায় তিনটি ভিন্ন রিক্সা দেখলাম। আগামী ২১এ ডিসেম্বর বাঙালী ও বাঙলা ভাষা বাচাও কমিটির পক্ষ থেকে, বাঙলা ভাগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে, ধর্মঘটের প্রচার চলছে। সক্রিয় কোনও বাঙালি দেখলাম না। সংগঠনের অভাবে রিক্সার মধ্যে ক্যাসেট চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। খুব হাসি পেল, কিন্তু আমি জানি এই ধর্মঘটও সফল হবে। মানুষ আসলে বেশ কনফিউজড, বাঙলা ভাগ ভালো নাকি জোড়া থাকা ভালো ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কারণ, যাঁরা ভাগ চাইছেন আর যাঁরা বিরোধিতা করছেন তাঁদের কেউই কিন্তু এখানকার মানুষের বুনিয়াদি সমস্যা নিয়ে কিছুই বলছেননা। যেন সেগুলি কোনও সমস্যাই না। আর বাঙালী এবং বাঙলা ভাষা বাঁচানোর জন্য একটা ধর্মঘট কতটা যৌক্তিক সেটাও বেশ দুর্বোধ্য।

    আসলে এতগুলি ধর্মঘটের ধাক্কায় যে সমস্যাটা এখানকার বেশিরভাগ মানুষ অর্থাৎ চা শ্রমিকদের জন্য তৈরী হয় তা হল একের পর এক রোজগারহীন দিন। এখানকার চা শ্রমিকরা প্রায় সবাই দৈনিক মজুরির, ডেইলি রেটেড লেবার, এই নামেই তাদের প্রশাসনিক ভাবে ডাকা হয়। তাদের কাজের দিন অনুযায়ী মজুরি। রবিবার ছুটি, তাই সেদিনের মজুরিও নেই। তাই এদের কাছে এদের সমস্যা সংক্রান্ত ডিমান্ড ছাড়া শুধুমাত্র পৃথক রাজ্য বা ল্যান্ডের দাবীতে বা তার বিরোধিতা করে ডাকা ধর্মঘটগুলো বেরোজগারের এক একটি দিনের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। যদি কোথাও এদের সমস্যাগুলোকে ধরা যেত এই সব দাবির মধ্যে তাহলেও একটা যৌক্তিকতা খুঁজে পেতেন এঁরা ধর্মঘটের। যে কারো ল্যান্ড বা রাজ্যে এদের অবস্থান তো একই থাকবে, ডেইলি রেটেড লেবার, দিন মজুর। তাই এদের সমস্যার কোনও কথা যেখানে বলা নেই সেই দাবির জন্য এক একটা দিনের মজুরি হারানোর কী অর্থ থাকতে পারে এঁদের কাছে? আর মজুরিও তো মাত্র ৬২ টাকা ৫০ পয়সা। কেমন করে চলে এই টাকায় এক একটা পরিবার? ঐটুকু টাকা আসার দিনটাও যদি ধর্মঘটে যায় কিভাবে বাঁচবেন এঁরা? আমরা যাঁরা মহান বাঙলা ভাষা এবং বাঙালির অস্তিত্ব অটুট রাখার জন্য সংগ্রাম করছি, ধর্মঘট ডাকছি, যাঁরা মহান কোচ রাজার রাজত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য লড়াই করছি, ধর্মঘট করছি, তারা তো একবারও ভাবছিনা যে আমাদের মহান লড়াইএর যাঁতাকলে পিষে মারছি এই মাটিরই অন্য ভূমিপুত্রদের। যাঁদের বিরুদ্ধে আমার লড়াই হতে পারেনা তাদের বিরুদ্ধেই চলে যাচ্ছে। যাঁদের শত্রু আমাদের সবার শত্রু সেই বৃহ্‌ৎ পুঁজির বিরুদ্ধে একটা কথাও বরং আমরা বলতে পারছিনা।

    মজার কথা একটা বলি। শিকারপুর বাগানের কথা তো আগেই বলেছি। ২০০৬ সাল থেকে বন্ধ। আগের মালিক শ্রমিকদের টাকা পয়সা যা বাকি রেখে মানে চুরি করে পালিয়েছেন তার অঙ্ক প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি। প্রভিডেন্ট ফান্ডের শ্রমিকদের অংশের টাকা, যা মালিক বেতন থেকে কেটে নিলেও পিএফ ডিপার্টমেন্টে জমা করেননি তার অঙ্কই দেড় কোটি। এই বাগানে বর্তমানে একজন মালিক খোলার জন্য আসতে চাইছেন। তিনি যোগেশচন্দ্র নামের একটি বন্ধ বাগান খুলেছেন কিছুদিন আগে। সেখানেও শ্রমিকদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে মালিক, প্রশাসন আর কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের করা চুক্তির মধ্যে দিয়ে। শ্রমিকদের জন্য এঁরাই তো ঈশ্বর। মুর্খ শ্রমিকরা কী বোঝেন তাঁদের নিজেদের ভালোমন্দের। এই মালিক শিকারপুরে আসতে চাইছেন বেশ কিছুদিন ধরে। শ্রমিকদের পাওনাগন্ডার কথা দূরে থাক, ব্যাঙ্কের বকেয়া টাকাই মেটাতে চাইছিলেন না। ব্যাঙ্কের বকেয়া টাকা না দিতে পারলে ব্যাঙ্ক এদের বাগানে ঢোকার অনুমতি দিচ্ছিল না। শ্রমিকরা ভাবতে শুরু করেছিল যে, যে মালিক ব্যাঙ্কের টাকাই মেটাতে চায় না সে তো শ্রমিকদের টাকা অনায়াসে না মিটিয়ে বাগানের লাভ লুটে নেবে। কিন্তু এত সব প্রগ্রেসিভ ভাবনা কি নেতাদের সহ্য হয়? তারা প্রচার শুরু করল যে মালিক না এলে শ্রমিকদের ভবিষ্যত অন্ধকার। এমনিতেই যুগযুগ ধরে মগজে বসে থাকা মালিকের গোলামির অভ্যাস, তার মধ্যে অন্ধকার ভবিষ্যতের ধমকি, সব মিলিয়ে আবার কনফিউশন। যাই হোক নতুন মালিক মাঝখানে চুপচাপ বসে ছিল। কি সব রফা তলায় তলায় হয়েছে কে জানে? হঠাত মালিক আবার ত্‌ৎপর হয়েছে বাগান খোলার জন্য। আসলে আন্তর্জাতিক বাজার সহ দেশীয় বাজারে চা এর দাম গত কয়েক বছর ধরে খুব বেশি, আর সেটাই মূল কারণ এই সব মালিকদের বাগান খোলার উৎসাহের পিছনে। এই অবস্থায় আমরা ক্যাম্পেন শুরু করেছি শ্রমিক সমবায় করার। আমাদের ক্যাম্পেন চলছে বহুদিন ধরে। ২০০৬ সালে ঠিক বন্ধ হবার পরই আমরা শুরু করেছিলাম শ্রমিক সমবায়ের সপক্ষে ক্যাম্পেন, বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম নিজেদের বাগান নিজেরাই গড়ে নিতে, উৎসাহিত করেছিলাম বাগান গড়ার প্রক্রিয়াকে। ২০০৬ সাল থেকেই ওঁরা নতুন গাছ রোপনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ কোন ট্রেড ইউনিয়নই এই কাজগুলিকে উৎসাহিত করেনি। কারন শ্রমিক সমবায়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সুবিধা খুব স্পষ্ট নয়। আমরা এই মুহুর্তে খুব জোরের সাথেই শ্রমিক সমবায়ের ক্যাম্পেন চালাচ্ছি। একেবারে শ্রমিকদের লাইনে শ্রমিকদের সাথে বসে আলোচনা চালাচ্ছি শ্রমিক সমবায়ের পক্ষে। আমাদের মনে হয়েছে ট্রেড ইউনিয়নের নাটুকে ২ টাকা বাড়ানোর সংগ্রামে শ্রমিকদের কোনও লাভ হয়নি। বরং মালিকেরা নানা রাস্তা খুঁজে পেয়েছেন কিভাবে শ্রমিক নেতাদের কিনে নিয়ে তাদের সঙ্গে নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী রফা করা যায়। বর্তমানে যে কটি বন্ধ বাগান খুলেছে সেগুলি খোলার চুক্তিতেই প্রমাণিত হয় শ্রমিক নেতাদের অবস্থান। সুতরাং তারা চাইবেন কেন শ্রমিক সমবায়?

    যে প্রসঙ্গে বাগান খোলা বা শ্রমিক নেতাদের অবস্থানকে ব্যাখ্যা করছিলাম সেই প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসা যাক। নরেন্দ্র বেরিলিয়া বাগান খোলার জন্য ১৭ তারিখ তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনকে আলাদা ডেকে নিয়ে বসেন, নানা রফা করার জন্য। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের বাকি অঞ্চলের চিত্র দেখে হয়ত বেরিলিয়া সাহেবের মনে হয়েছে বাকি ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে সহজেই মানানো যাবে, তাই বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা চালাতে চেয়েছেন এই নতুন ট্রেড ইউনিয়নের সাথে। সেখানে ছাঁটাই এর দাবি মালিক রেখেছেন, দাবি রেখেছেন শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা এক বারে না মেটানোর, এবং শ্রমিকরা ২০০৬ সাল থেকে নিজেরাই বাগানের উন্নয়নের জন্য যে খরচ করেছেন সেই টাকাগুলি তাদের ফের্ৎ দেবার প্রসঙ্গে একটি কথাও মালিক বলেননি। কিন্তু মজার বিষয় হলএই যে, এই নতুন ট্রেড ইউনিয়নটিও সেখানে মালিকের এই অসত উদ্দ্যেশ্যের বিরুদ্ধে তার সামনে কোনও প্রতিবাদ করেনি। ঐ বাগানের নিজস্ব ট্রেড ইউনিয়নের যে প্রতিনিধি তাঁরা নিজেদের সংখ্যালঘু অনুভব করে তেমন ভাবে তাদের আপত্তির কথা জানাতে পারেননি। তারা কেবল ভরসা করেছেন বাগানের শ্রমিকদের উপর, আস্থা রাখতে চেয়েছেন বাগানের শ্রমিক সমবায়ের পক্ষে চলা ক্যাম্পেনের উপর। ঐ শ্রমিক প্রতিনিধিরা, বা বাগানের শ্রমিকরা এখন কিন্তু বোঝেন যে একই ফর্মুলায় গড়ে ওঠা পার্টি ও ভোট নির্ভর ট্রেড ইউনিয়নগুলো যে সঠিকভাবে শ্রমিক স্বার্থকে দেখতে পারে না এই সহজ সত্যটা শ্রমিকরা এখন জানেন। আর তার প্রতি আস্থা রেখেই শ্রমিক সমবায় গড়ার স্বপ্ন দেখি আমরা। ঠান্ডায় কষ্ট হলেও রাতে খোলা আকাশের নিচে বসে শ্রমিকদের সমবায় সংক্রান্ত নানা জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে একটা অন্য ভালোলাগার অনুভুতি তৈরি হয়। ভালো লাগে এই ভেবে যে কেবল নেতাদের কথা শোনার অভ্যাস বদলে তারা নিজেদের প্রশ্ন তৈরি করছেন, বুঝতে চাইছেন নতুন বিষয়কে, ভাবতে পারায় অভ্যস্ত হচ্ছেন ধীরে ধীরে। যে অভ্যাস বদলে গিয়েছিল অনেক বছর আগে, শ্রমিকরা অভ্যস্ত হয়েছিলেন মান্য করায়। তাই প্রশ্ন করার অভ্যাস দেখলে একটা ভালো লাগার, একটা আশার অনুভুতি হয়। ঐটুকুই কাজ করে চলার অক্সিজেন।

    ২৮শে ডিসেম্বর বিকেল ০৫:৩২


    কয়েকদিন লিখতে পারিনি মোটেই। কাজের চাপের পাশেই ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি একেবারে। মাঝখানে যেটুকু লিখেছিলাম তার রেশটা আর মাথায় ছিলনা। তাই নতুনভাবে লিখছি। একটা টেনশন আছে এই মুহূর্তে। আগামীকাল শিকারপুর চা বাগান নিয়ে মালিক সংগঠনের দপ্তরে নতুন মালিক আর বাগানের শ্রমিকদের মিটিং আছে। এর আগে জেলাশাসকের অফিসের মিটিং-এ নতুন মালিক বাগান খোলার ক্ষেত্রে শ্রমিক ছাঁটাই এর শর্ত আরোপ করায় স্পষ্ট ভাবেই শ্রমিকরা জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁরা রাজি নন এই প্রস্তাবে। তার সবচেয়ে বড় কারণটা এই যে এই বাগানে এখন শ্রমিক সমবায়ের বিষয়ে আমরা খুব ভালো ভাবে শিক্ষামূলক ক্যাম্পেন চালাচ্ছি। শ্রমিকরা অনেকটা উপলব্ধিও করতে পারছেন তারা নিজেরাই বাগান চালাতে পারেন মালিকদের থেকে অনেক ভালো ভাবে। আসলে তো তাঁরা পারেনই। বোঝাপড়ার অভাবে যেটুকু ছিলনা তা হল আত্মবিশ্বাস। গত দুই মাস ধরে আমাদের ক্যাম্পেন সেইটুকু আত্মবিশ্বাস কিছুটা হলেও ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এই অবস্থায় যদি বাগানের শ্রমিক প্রতিনিধিরা একটুও তাদের মালিক নির্ভরতার কাছে মাথা নুইয়ে মালিকের প্রস্তাবে রাজি হয়ে আসে তবে সেটা শ্রমিকদের অন্যরকম এক উদ্যোগের পথকেই ধ্বংস করবে। এইটাই মূলত টেনশনের বিষয়।

    এই শ্রমিক সমবায়ের কথা বলতে একটা অভিজ্ঞতার কথা মনে এল। বলতে ইচ্ছা করছে। তোমাকে এইটা লিখতে চাই বলায় বলেছিলে যে ডুয়ার্সের ডায়রি যেন ত্রিপুরা নিয়ে থিওরি না হয়ে যায়। আসলে সেটা বিষয় না। কেন ত্রিপুরার কথা মাথায় এলো সেটাই বলার। ২০১১ তে কি হবে জানিনা। মনে হয় এই সরকারটা আর থাকবে না। হাওয়া তাই বলে। তবে এই সময় পর্যন্ত ত্রিপুরা আর পশ্চিমবঙ্গের যে মিলটুকু আছে তা হল সেখানে আর আমাদের এখানে দুই জায়গাতেই বামফ্রন্টের শাসন। এই বামফ্রন্ট, পশ্চিমবঙ্গের এই কম্যুনিস্টদের সাথে শাসন, জামানা শব্দগুলি বেশ যায়, তাই না? যাই হোক, বামফ্রন্টকে খোঁচা দেবার বিশেষ বাসনা আমার নেই। শুধু একটু তুলনা মূলক আলোচনা করার ইচ্ছা আছে। কারন ত্রিপুরা আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টেও মিল এর সাথে সাথে একটা অমিলও আছে। এখানে অনেক অনেক পুঁজি আছে আর ত্রিপুরায় পুঁজি সেই অর্থে ঢোকেনি বললেই চলে। পুঁজি না থাকলে যা হয়, মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী রিক্সা করে আমজনতার মত বাজার করেন। পুঁজি থাকলে মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী প্রায় ফার্স্টলেডি হয়ে যান। এসকল সহজ পার্থক্য আছে আরকি। আবারও অজান্তে বামেদের খোঁচা দিয়ে ফেলেছি। আসল বিষয়ে আসা যাক। আমরা ২০০৭ সালে ত্রিপুরা গিয়েছিলাম চা শিল্পে শ্রমিক সমবায় দেখতে, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে। কারণ আমাদের প্রতি মুহূর্তেই মনে হয় শ্রমিক সমবায় হল শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের কাছে একটা শক্তিশালী হাতিয়ার। মিছিল মিটিং আর ধর্মঘটে তেমন আর কাজ হয়না। ওগুলি বর্তমানে ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের ব্যবসা করার এক একটা মাধ্যম। একটা ধর্মঘট তুলে দেওয়ার জন্য একটা মোটা টাকার বায়না। মুম্বাইয়া ভাষায় বললে বলা যায় শ্রমিক আন্দোলন খতম করার সুপারি।

    ২০০৭ সালে ত্রিপুরা গিয়ে জানতে পারলাম সেখানে চা-এ ১৩টি শ্রমিক সমবায় আছে। এই ১৩টি শ্রমিক সমবায়ের মধ্যে একটি ছাড়া সবগুলিই খুব ছোট ছোট। কারখানা নেই প্রায় কোনওটাতেই। তারা কাঁচা পাতা বিক্রি করে কাছের কোন বড় বাগানে। কিন্তু একটি বাগান খুবই বড়। বাগানটা খুব বড় এমনটা না, তবে তার কর্মকান্ড বিশাল। আর সেই বাগানটির কথা শুনেই আমরা ত্রিপুরা গিয়েছিলাম। বাকি বাগানগুলোর কথা জানতে পেরেছিলাম সেখানে গিয়ে। বড় বাগানটির নাম দুর্গাবাড়ি। ১৯৭৮ সালে দুর্গাবাড়ি শ্রমিক সমবায় গড়ার উদ্যোগ শুরু হয়। ১৯৮২ সালে তারা রেজিস্ট্রেশন পায়। এই প্রক্রিয়া শুরুর আগে ১০ বছর বাগানটি বন্ধ ছিল। বহু শ্রমিক বাগান ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বিকল্প কাজের সন্ধানে, বহু শ্রমিক আর তাদের পরিবারের মানুষের মৃত্যু হয়েছিল না খেতে পেয়ে। আজ এই বাগানটির নাম চা বাগানের কথা যাঁরা জানেন, তাঁরা সবাই জানেন।

    আমি এখানে আমার অভিজ্ঞতার কথাই বলব। দুর্গাবাড়ি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলাম আমরা আলাদা একটা রিপোর্টে। সেখানে নানা রকমের সংখ্যা, তথ্য দেওয়া আছে। আমি সেইসব সংখ্যায় বা তথ্যে যাব না। আমি সেখানে যা শুনেছি, যা দেখেছি সেটাই লিখব।

    দুর্গাবাড়ি পৌঁছে যে মানুষটার সাথে দেখা না করলে দুর্গাবাড়িকে ভালো করে জানা যায়না তার নাম শ্রী সুধাময় মজুমদার। সকলে তাঁকে পানুদা বলেই চেনেন। ৮২ বছরের যুবক পানুদা। এখনো রোজ সকালবেলা বাগানে চলে আসেন। কিলোমিটার ছয়েক হাঁটেন বাগানে। সবার সাথে সুখ দু:খের কথা বলেন। আর সবার সাথে পরিকল্পনা করেন আরও কী কী করা যায় বাগানের জন্য।

    বাগানটিকে শ্রমিক সমবায় বানানোর পরিকল্পনা পানু মজুমদারের ছিলনা। সেই সময় তিনি ছিলেন সিপিআইএম এর পার্টি কর্মী। পানুদার কথায়, "নৃপেনদা আমাকে ডেকে বললেন যে দুর্গাবাড়িতে একটা শ্রমিক সমবায় গড়তে হবে। ওখানকার মানুষগুলো না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছে। বাগান থাকতে মানুষগুলো মরে যাবে এটা ঠিক না। আর শ্রমিকরাই পারে বাগান গড়তে আর বাগান চালাতে। আমি বলেছিলাম কিন্তু এই কাজ আমি করতে পারব না। আমি পার্টি কর্মী, আমার কাজ পার্টি করা। তাতে নৃপেনদা বলেছিলেন পার্টি করার কাজটা শ্রমিক সমবায় গড়ার কাজের থেকে কিভাবে আলাদা সেটা বুঝিয়ে দিতে। আমি বোঝাতে পারিনি। নৃপেনদা আমাকে পাঠিয়ে দিলেন দুর্গাবাড়ি।" এই ছিল পানুদার কথা। আরও অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলাম পানুদার কাছে। দিনের বেলা তো বটেই, কিভাবে রাতের পর রাতও ওঁরা কাজ করেছেন বাগানের উন্নতির জন্য। ত্রিপুরার ত্‌ৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তী সরকারি ভাবেও সমস্ত ধরনের সহযোগিতা করেছিলেন ওঁদের। পরবর্তী কালে টি বোর্ড সহ নাবার্ডের কাছ থেকে লোনেরও ব্যবস্থা করেছিলেন ওঁদের জন্য। পানুদা বলেছিলেন যে কম্যুনিস্টরা সরকারে থাকলে সরকার পক্ষে থাকবে সাধারণ মানুষের এটাই তো শিক্ষা, এটাই তো ভরসা। কথাগুলি শুনতে শুনতে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কাদের সাথে কথা বলছি। আমরা পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম দেখে অভ্যস্ত। একই পার্টি, একই শ্রমিক সংগঠন, অথচ পুঁজির উপস্থিতির মাত্রার বদলে এখানে তাদের ভাষাই বদলে গেছে। বদলে গেছে যুক্তি।

    পানুদার কথাগুলি শুনেও মনের মধ্যে একটা সন্দেহের জায়গা তখনও ছিল। সেটা এই যে, বলছেন তো অনেক কথা, সত্যিই করছেন কিনা। জিজ্ঞাসা করলাম শ্রমিকদের কোয়ার্টারগুলো দেখা যাবে কিনা। তাদের সাথে কথা বলা যাবে কিনা। এখনকার অভিজ্ঞতায় জানি যে, এমন ইচ্ছা প্রকাশ করলে স্থানীয় নেতারা সঙ্গ দেয়। যাতে শ্রমিকরা তাদের কারনামা ফাঁস না করে দেয়। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বললাম ওনাকে সঙ্গ দিতে বললাম আমরা। উনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন আমরা যেন স্বাধীনভাবে যাই। শ্রমিকদের মধ্যে, যারা আসলে এই বাগানের মালিক, যদি কোনও ক্ষোভ থেকে থাকে তারা স্বাধীনভাবেই বলতে পারবেন। এমন আচরণও আমাদের কাছে খুবই নতুন। এমনটা আমাদের পশ্চিমবঙ্গে কখনও হয়নি।

    এক এক করে শ্রমিকদের ঘরে ঢুকে পড়ছিলাম। তারাও বেশ আদর করেই আমাদের চা খাওয়ার জন্য ডাকছিলেন। একজন বয়স্ক শ্রমিক বললেন। "এখন একটু কষ্টে আছি আমরা। এই দুই বছর। কারণ আমরা ফ্যাক্টরি বানানোর জন্য ২ কোটি টাকা লোন নিয়েছিলাম। তাই সব কিছু নিতে পারছিনা। এই বছর সব লোন শোধ হয়ে যাবে তখন আমরা আরও ভালো ভাবে থাকতে পারব।"

    এখানে শ্রমিকদের ভাঙাচোরা ঘর দেখেই অভ্যস্ত। ওখানে গিয়ে দেখলাম প্রত্যেক শ্রমিকের সুন্দর কোয়ার্টার। তাতে নানা আসবাব আছে। সেগুলিও তারা সমবায় থেকে বাৎসরিক উপহার হিসাবে কিছু কিছু পেয়েছেন। আবার শ্রমিকরা কিনেছেনও। এখানে শ্রমিক কোয়ার্টারে বাথরুম বা পায়খানার কোন অস্তিত্বই নেই। ওখানে সবকটি শ্রমিক কোয়ার্টারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বাথরুম পায়খানা দেখতে পেলাম। অঢেল জল। সব কোয়ার্টারে। যা আমরা এই পশ্চিমবঙ্গে খুব পুঁজিওয়ালা টাটার বাগানেও দেখিনা। পুঁজি তো টাটার। শ্রমিকের কী? বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে প্রত্যেক কোয়ার্টারে। সমবায় সব শ্রমিকদেরই ইলেক্ট্রিক পাখা কিনে দিয়েছে। গ্যাস ওভেন কিনে দিয়েছে সমবায় সব শ্রমিক পরিবারের জন্য। মাসে একটা করে গ্যাস সিলিন্ডার বরাদ্দ সব শ্রমিক পরিবারের জন্য। ঐটাই লোন পরিশোধের জন্য একবছর ধরে দেওয়া হচ্ছেনা। একথা জানালেন সব শ্রমিকরা। তাতে তাদের কোন কষ্ট দেখলাম না। বরং তারা ভাবছেন যত দ্রুত লোন শোধ হবে ততই তাদের জন্য ভালো। দুই বছর ঐটুকু ত্যাগ করাই যায়। এই ত্যাগের ধারনাটাই আমাদের এখানে মালিকের বঞ্চনায় সব অধিকার বাধ্যতামূলক ত্যাগের মত লাগেনি। ওখানে তাঁরা নিজেরাই অংশ নিচ্ছিলেন। এবং সমবায় থেকে সব সুবিধা শ্রমিকদের দেওয়া হচ্ছে বিনা পয়সায়।

    এরপর আরও আছে দেওয়ার তালিকা। প্রত্যেক শ্রমিক পরিবারের বাচ্চাদের মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়া, বইপত্র, স্কুলের পোষাক বিনামূল্যে সমবায় তাদের দেয়। একজন ফিজিক্যাল এডুকেশনের শিক্ষককে তাঁরা বাগানে নিয়োগ করেছেন শিশুদের খেলাধুলা শেখানোর জন্য। উচ্চশিক্ষার জন্য সমবায় যতটা সম্ভব সাহায্য করে তবে পাশাপাশি তাদেরও টিউশনি করে কিছুটা টাকা রোজগার করার জন্য উৎসাহ দেয়। বাগানে কোনও হাসপাতাল নেই। কিন্তু কাছেই সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। বাগানে আছে অ্যাম্বুলেন্স। অসুস্থ শ্রমিক বা তাঁদের পরিবারের যে কোন অসুস্থ ব্যক্তির জন্য অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস দেওয়া হয় বিনা পয়সায়। চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করে সমবায়। খুব খরচ সাপেক্ষ জটিল রোগের ক্ষেত্রেও। পুকুর কেটে মাছের চাষও করে সমবায়। শ্রমিকদের পরিবারের যে কোনও অনুষ্ঠান, বা পূজা-পার্বণে বিনা পয়সায় যাতে শ্রমিকরা মাছ খেতে পারে। শ্রমিকদের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে কিচেন গার্ডেন করতে নিজেদের কোয়ার্টারের খোলা জায়গার মধ্যে। তাদের ছাগল, গরু, শুয়োর, হাঁস, মুরগি পোষার জন্যও উৎসাহিত করেছে সমবায়। ঋণও দেওয়া হয়েছে বিনা সুদে। যাতে তারা তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী শাকসব্জি, প্রোটিন জাতীয় খাদ্য খেতে পারে। ফলের বাগান করা হয়েছে বাগানের অব্যবহৃত জমিতে। সেই ফল শ্রমিকদের মধ্যেই ভাগ করে দেওয়া হয়। কেমন যেন আজব দুনিয়া লাগছিল দেখতে। অন্য রকম। যদিও বড্ড বেশি পানুদা নির্ভর। ঈশ্বরের মত করেই দেখেন সবাই পানুদাকে। তা দেখুক। নিন্দুকের চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে কোথাও কিছু না পেয়ে এখন এইসব যুক্তি বানাচ্ছি।

    ২রা জানুয়ারী ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৫৩


    এই চিত্র যখন এসে এখানে আমাদের পরিচিত শ্রমিক বন্ধুদের বলেছিলাম, তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারেননি। বলা ভালো তারা বুঝতেই পারেননি, ধারনাই করতে পারেননি বিষয়টা কী। গল্প বলেই ধরে নিয়েছিলেন। ধরে নিয়েছিলেন বলার থেকে বলা ভালো এখনও এগুলিকে গল্পই ভাবেন, বা কিছুই ভাবেন না। এখানকার মার্কসবাদী নেতাদের সামনেও যখন প্রশ্ন তুলেছি আমরা এমনটা এখানে করা যাচ্ছেনা কেন, তারা কোনও উত্তর দেননি। দেবেন কী করে, তাদের এখানে তো পুঁজি আছে, পুঁজির সঙ্গে সম্পর্ক আছে, পুঁজির নানা ভালো দিক আছে, যা পানুদাদের জানা নেই। যা পানুদারা বুঝেই উঠতে পারবেননা।

    মনটা খারাপ হয়ে আছে। দুদিন আগেই গর্বের সাথে লিখছিলাম আমাদের সমবায়ের শিক্ষামূলক ক্যাম্পেনে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। কিন্তু তাদের কাছে একবারও তাদের মতামত জানতে না চেয়েই শিকারপুর বাগান খোলার সিদ্ধান্ত নিলেন নতুন মালিক, ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা আর প্রশাসন। শিকারপুর বাগান খুলে গেল গতকাল। এক মারওয়ারী নরেন্দ্র বেরেলিয়া কিনে নিলেন বাগানটাকে। মজার কথা এই যে, এই শিকারপুর বাগানটার জন্য আমরা অনেকটা পরিশ্রম করেছিলাম। ওঁদের উৎসাহ দিয়েছিলাম বাগানের উন্নয়ন করে নেওয়ার জন্য। মাথার মধ্যে সমবায়ের ধারনা নিয়েই। শ্রমিকদের বোঝাতেও শুরু করেছিলাম আমরা। শ্রমিকরা নিজেরাই বাগানটা চালাচ্ছিলেন খুব ভালো ভাবে। সাড়ে তিন হেক্টর জমিতে নতুন গাছ লাগিয়েছিলেন ওঁরা নিজেদের শ্রমের টাকায়। খুব সামান্য কিছু টাকা আমরাও যোগাড় করে দিয়েছিলাম ওঁদের বাগানের ইরিগেশন সেট কেনার জন্য। তিন বছর ধরে বাগান চালানোর পরও মালিক-নির্ভরতা যায়নি। তিনদিন আগে ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের সাথে সরকারি প্রশাসন আর নতুন মালিক পক্ষ বসে শ্রমিকদের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেললেন।

    শ্রমিকদের বকেয়া টাকার মাত্র ৫০% ফেরৎ দেবে মালিক। তাও আবার ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে। নেতারা ভাষণ দিয়েছেন শ্রমিকরা নাকি মালিকের জন্য আর বাগানের উন্নতির জন্য তাদের বকেয়া টাকার ৫০% ত্যাগ করেছেন। শ্রমিকরা ত্যাগ করলেন, নাকি তাদের ঐ ৫০% এর কিছু অংশের বিনিময়ে বিক্রি করলেন নেতারা, সেটা কে জানে। এই তিন বছর যখন শ্রমিকরা তাদের শ্রমের টাকায় বাগানের উন্নতি করেছেন, তখন কোন নেতাকে আসতে দেখা যায়নি। মালিক এসেছে, ম্যানেজমেন্ট, শ্রমিক ক®¾ট্রাল, নানা সমঝোতার মওকা, এই সবের সাথে সাথে নেতারাও এসেছেন। শ্রমিকরা জানেননা তাদের প্রত্যেকের বকেয়া টাকার পরিমান কত। সেটা তাদের জানিয়ে যদি নেতারা জানতে চাইতেন যে তাঁরা তাদের ৫০% ত্যাগ করতে চান কিনা, তাহলেই স্পষ্ট হয়ে যেত শ্রমিকরা কী চান। আর এই সব জানানোর কোন দায়ই অনুভব করেননা নেতারা। জানলেই তো ব্যবসা বন্ধ। আরও মজার কথা এই যে বর্তমানে সংগ্রামী যে পার্টি, ২০১১ তে যাদের কে নিয়ে মানুষের আশা ভরসা তারাও কিন্তু এই চুক্তির কোথাও কোন বিরোধিতা করেননি। সমবায়ের যে প্রক্রিয়াটা চলছিল তাকে কখনও সম্মাণ করেননি। আসলে টিকিগুলিতো একই জায়গায় বাঁধা। অপেক্ষা আর কাজ করে যাওয়া সেই সময়ের দিকে তাকিয়ে যেদিন এই আদিবাসী শ্রমিকরা বুঝবেন নিজেদের শক্তি, নিজেদের ভালো মন্দের রায় নিজেরাই নেবেন। শিকারপুরের ঘটনা খানিকটা মন খারাপ করিয়েছে, তবে হতাশ হচ্ছিনা। একটা শক্তিশালী স্বাধীন শ্রমিক সংগঠন খুবই জরুরি এইটা বুঝতে পারছি। এইটা শ্রমিকরাও আস্তে আস্তে বুঝতে পারছেন। আর সেইটা বেশি করে বুঝতে পারছেন তুলনামূলক বড় পুঁজির বাগানগুলির শ্রমিকেরা। টাটার বাগানের ঘটনা তারই একটা বড় উদাহরণ। আর সেই জন্যই সন্ত্রস্ত হচ্ছেন তথাকথিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা। গতকালই এক শ্রমিক বলছিলেন, "নেতারা খুব ভয় পাচ্ছে, কারণ তাদের এবার নোট নেই, ভোট নেই, আবার সংগঠনও ভেঙে যাচ্ছে, মানে জোট নেই"। শিকারপুরের অভিজ্ঞতায় মন খারাপ যেমন আছে, তেমনই অন্য একটা আশার জায়গাও রয়েছে এই নতুন ভাবে ভাবতে পারছেন যে মানুষগুলি তাদেরকে ধরে।

    ৩রা জানুয়ারী, ২০১০


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • খবর | ০৩ জানুয়ারি ২০১০ | ৯৪৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন