এই যে এখন কম্পিউটার খুলে বসেছি গুরুচণ্ডা৯ ডটকম, অ¡ন্তর্জালে বাংলাতেই লেখাপড়া করছি অনায়াসে, বাংলাদেশে ঠিক এমনটি কি আমরা ভাবতে পেরেছিলাম বছর দশেক আগে? নি:সন্দেহে এটি তথ্য প্রযুক্তির অগ্রগতি তথা ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় বাংলা ভাষারই অগ্রগতি। আচ্ছা, বাংলার এই উল্লম্ফন শুরু হলো কবে থেকে?
এ নিয়ে যারা দীর্ঘদিন ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তাঁদের কয়েকজনের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, বাংলাদেশে প্রযুক্তির সিঁড়ি বেয়ে মাত্র চার দশকে বাংলা ভাষা ব্যবহারে বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য ভাষার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাতেই এখন সম্ভব হচ্ছে কম্পিউটারে লেখালেখি, বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশ, গবেষণা, ওয়েবসাইট নির্মাণ, তথ্য ও ছবি অনুসন্ধান, ই-মেইল আদান-প্রদান, এমনকি ব্লগিংও। ব্যবহারিক দিক বিবেচনায় এ সবই বাংলা ভাষার জন্য এক-একটি মাইলফলক বৈকি।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, বিশ্বে এখন অন্তত ২৩ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাংলা ভাষা ব্যবহার করছেন। ভাষাভাষীর সংখ্যা অনুসারে বাংলার স্থান ষষ্ঠ। কোনো কোনো হিসাবে এ ভাষাভাষীর সংখ্যা এরই মধ্যে ২৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং এর অবস্থান এখন চতুর্থ। ভারতে বাংলা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কথিত ভাষা।
বছর বিশেক আগে আন্তর্জাতিক বর্ণ সংকেতায়ন ব্যবস্থা -- ইউনিকোডে বাংলা ভাষা যুক্ত হওয়ার পর এর সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গিয়েছিল। জনপ্রিয় ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিন গুগল ১৩০টি ভাষার সঙ্গে বাংলাকেও যুক্ত করেছে। ফলে এখন গুগল বাংলায়ও ব্যবহার করা যায়। বছর চারেক ধরে কম্পিউটারে ফোনেটিক কি-বোর্ড ব্যবহার করে খুব সহজেই সব ধরনের বাংলা লেখা সম্ভব হচ্ছে।
ফলে যারা কি-বোর্ডের কোথায় কোন বাংলা হরফ আছে তা জানেন না, তারাও সহজেই বাংলায় লিখতে পারছেন। বাংলা উইকিপিডিয়া এখন বিশ্বের বৃহত্তম বাংলা ভাষার ওয়েবসাইট। পূর্ণাঙ্গ নিবন্ধ ও খসড়াসহ এর নিবন্ধনের সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে!
বাংলা ভাষার অগ্রগতি ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুকেও। এর প্রায় ৩০ কোটি ব্যবহারকারীর মধ্যে লাখ দেড়েক বাংলাভাষী। কিছুদিন আগে ফেসবুকও বাংলা সংস্করণ যুক্ত হয়েছে। তবে সরাসরি ইংরেজী থেকে যান্ত্রিক অনুবাদ হওয়ায় এর আরো বিকাশ প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে। একই কথা বলা হয়, গুগলের বাংলা সংস্করণ সর্ম্পকে।
অভ্র সফটওয়্যারে ইউনিকোড ব্যবহার করে ই-মেইল, ফেসবুক, বাংলা ব্লগসহ সব সাইটেই বাংলায় লেখালেখি সম্ভব হচ্ছে। অভ্রকে অনেকেই বলছেন ইন্টারনেটে বাংলা ব্যবহারের মাইলফলক। বাংলাদেশে নোকিয়া মোবাইল ফোন সেট ব্যবহার করে বাংলাতেই সংক্ষিপ্ত বার্তা -- এসএমএস আদান-প্রদান করা যাচ্ছে। তবে বাংলা বর্ণমালায় ডট-এর সংখ্যা বেশী হওয়ায় অনেক সময়ই দেখি, একটি ছোট এসএমএস লিখতে দু-তিন পৃষ্ঠা লেগে যাচ্ছে, অর্থাৎ এতে খরচ পড়বে একটু বেশী। এছাড়া নোকিয়া থেকে নোকিয়া ফোন সেটেই বাংলায় এসএমএস-এর আদান-প্রদান সম্ভব, নোকিয়া থেকে অন্য সেটে এমন সম্ভব নয়। অর্থাৎ এ নিয়েও আরো কাজ করার অবকাশ রয়েছে।
এ ছাড়া মাস চারেক আগে জি-মেইল ১২টির ভাষার সঙ্গে বাংলাকেও অনুবাদিত ভাষা হিসেবে যুক্ত করায় এখন ফোনেটিক বাংলাতেই ই-মেইল আদান-প্রদান সম্ভব। এমনকি যিনি বাংলা টাইপ করতে জানেন না, তিনিও ফোনেটিকে ইংরেজি অক্ষরে বাংলা উচ্চারণে শব্দটি টাইপ করলে, এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলা হয়ে যাবে; যেমন এখন কিবোর্ডে ইংরেজিতে Pukur লিখলে, জি-মেইল নিজেই অনুবাদ করে তা বাংলায় রূপান্তর করে নেবে "পুকুর'।
সম্প্রতি উবুন্টু লিনাক্স, মাইক্রোসফট উইন্ডোজ -- এসবের মাধ্যমেও বাংলায় কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এর পাশাপাশি ওপেন অফিস, ফায়ারফক্স এ সবেরও বাংলা সংস্করণ বেরিয়েছে। বাংলাদেশের অত্যন্ত উদ্যমী একঝাঁক তরুণ কাজ করে চলেছেন বিভিন্ন সফটওয়্যারকে স্থানীয়করণ করতে।
তবে এখনো ইন্টারনেটে বাংলা লেখার সুবিধা কম বলেই কেবল অনেকে বাংলা কথাকে ইংরেজি হরফে লিখছে বা ইংরেজিতেই আলাপ করছেন। ই-মেইল, ফেসবুক বা ব্লগে সরাসরি বাংলায় লেখার সহজ ব্যবস্থা পেলেই বাঙালিরা বাংলাতেই আরো অনেক বেশী বাংলার চর্চা করবেন বলেই মনে হয়।
কম্পিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তফা জব্বার বাংলাদেশে প্রথম ১৯৮৭ সালে বাংলা সফটওয়্যার "বিজয়' এবং একই নামে ১৯৮৮ সালে বাংলা কি-বোর্ড উদ্ভাবন করেন। বাংলাদেশে বাংলার এই ফ্রন্ট ও কি-বোর্ডই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। ১৯৮৭ সালের ১৬ মে কম্পিউটারে প্রথম পত্রিকা "আনন্দপত্র'ও প্রকাশ করেন তিনি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে "মুনীর অপটিমা' টাইপরাইটার উদ্ভাবন করেন। এর পর অনেক অফিস-আদালতে কাগজ-কলমের বদলে টাইপরাইটার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শুরু হয় নতুন প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার পথচলা। এটি বাংলা ভাষা ব্যবহারের এক ধাপ অগ্রগতি।
পরে আটের দশকে বাংলাদেশে কম্পিউটার চালু হলে "বিজয়'-এর বাংলা লেখালেখি, পত্র-পত্রিকা প্রকাশ আরো সহজ হয়। কালক্রমে ইউনিজয়, প্রভাত, অভ্র ছাড়াও আরো কয়েকটি বাংলা কি-বোর্ড তৈরি হয়। একই সঙ্গে সম্ভব হয় ফোনেটিক পদ্ধতিতে বাংলা লেখা। এ সবই প্রযুক্তির হাত ধরে বাংলা ভাষারই প্রসার।
মোস্তফা জব্বারের ভাষ্য মতে, প্রযুক্তি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের এই উন্নতিটুকু দরকার ছিল। তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। এ জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রধান উদ্যোক্তা এবং আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ড| রাগিব হাসান। এক ইমেইল বার্তায় তিনি এই লেখককে বলছেন, গত চার দশকে বাংলা ভাষার ব্যবহার এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা। এ ক্ষেত্রে ইউনিকোড প্রযুক্তি সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। এতদিন কম্পিউটারে বাংলা লেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হতো, যার কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল ছিল না। গত পাঁচ বছর ধরে সার্বজনীন ইউনিকোডে বাংলা লেখা হচ্ছে, ফলে ইন্টারনেটে বাংলার ব্যবহার অনেক বেড়ে গেছে। বাংলা ব্লগের বিপুল জনপ্রিয়তা ও বাংলা উইকিপিডিয়ার বিস্তার লাভই এর বড় প্রমাণ।
"অভ্র' সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান খান। মেহেদী, রিফাতুন্নবি, তানভিন ইসলাম সিয়াম, রাইয়ান কামাল, শাবাব মুস্তফা, নিপুণ হক -- এই কয়েকজন বন্ধু গত ছয় বছর ধরে অভ্র নিয়ে কাজ করছেন।
"ভাষা হোক উন্মুক্ত' এই শ্লোগান নিয়ে "অভ্র'র এগিয়ে চলা। এর সমস্ত সংস্করণ বিনামূল্যে ডাউনলোড করে ব্যবহার করা যায়। ব্যবহারকারীর ইউনিবিজয়, প্রভাত ও ফোনেটিক কিবোর্ড বাছাই করারও সুযোগ রয়েছে। এমনকি যিনি কম্পিউটারে বাংলা লিখতে অভ্যস্ত নন, তিনি যেন অন্তত কিছু বাক্য বাংলায় লিখতে পারেন, সে জন্য মাউস চেপে (ভার্চুয়াল কিবোর্ড) বাংলায় লেখার অপশনও তৈরি করেছেন অভ্রর কোডাররা। বাংলা উইকিপিডিয়া, সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটের সার্চ ইঞ্জিনে এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছে অভ্র-ফোনেটিক অপশন।
মেহেদী হাসানের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পাই, অভ্রর কোডাররা এখন কাজ করছেন, কি-ভাবে অফলাইনে ফোনেটিক অপশন ব্যবহার করা যায়, সে সুবিধা তৈরি করতে। এই গুরুতর বিষয়টি সম্ভব করে তোলা গেলে বাংলা টাইপিং একেবারে ছেলেখেলা হয়ে দাঁড়াবে বৈকি।
জনপ্রিয় বাংলা ব্লগ সাইট আমারব্লগ ডটকম-এর প্রধান সঞ্চালক ও ব্লগার সুশান্ত দাসগুপ্তর সঙ্গে কিছুদিন আগে তথ্য-প্রযুক্তিতে বাংলার অগ্রগতি নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। তাঁর মতে, মূলত ইউনিকোডের কল্যাণেই বাংলায় ওয়েবসাইট তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। ওয়েবে বাংলা প্রসারে হাসিন হায়দার, সবুজ কুণ্ডু, ঈসএম মাহবুব মুর্শেদ, আহমেদ অরূপ কামাল, আরিল প্রমুখের অবদান উল্লেখযোগ্য।
সুশান্ত তার অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, আমি নিজে বাংলা টাইপ করতে ভয় পেতাম, কিন্তু অভ্র কি-বোর্ড আসার পর এখন আমি ইংরেজির চেয়েও দ্রুত গতিতে বাংলা টাইপ করতে পারছি। |||তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার প্রসারে মুস্তফা জব্বার, লিড প্রোগ্রামার পাপ্পান এবং অভ্রর সব কোডারের বড় অবদান রয়েছে।
এ কথা বলা ভালো, ইউনিকোড বা অভ্র ব্যবহার তুলনামূলক সাম্প্রতিক হওয়ায় অনেকেই এর ব্যবহার শুরু করেননি। বাংলাদেশে এখনো বিজয় সফটওয়ারই বেশি জনপ্রিয়। ফলে লেখালেখির আদান-প্রদানে ফন্ট ভেঙে যাওয়াসহ নানা সমস্যা হচ্ছে।
সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক গত ২১ বছর ধরে কম্পিউটারে বাংলা ভাষায় সব ধরনের লেখালেখি করছেন। তিনিও মনে করেন, প্রযুক্তির বিকাশে বাংলা ভাষা ব্যবহারিক দিকে এগিয়েছে -- এটি অবশ্যই জাতীয় জীবনের একটি মাইলফলক। কিন্তু প্রযুক্তিগত দিকে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো অনেক কাজ বাকি। ইংরেজি ভাষার মতো কম্পিউটারে এখনো বাংলা ভাষা বিশ্বে সবার কাছে পাঠযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
তার ভাষায়, আমি যে ফ্রন্টে বাংলায় লিখি, তা পশ্চিমবঙ্গের কোনো লেখক বা প্রকাশক পড়তে পারেন না। আবার তারা যে ফ্রন্ট ব্যবহার করেন, সেটিও আমি পড়তে পারি না। এ জন্য দুঞ্চদেশের কম্পিউটার বিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখকের একসঙ্গে বসে একটি একক ব্যবস্থায় কম্পিউটারে লেখার সহজ পদ্ধতি আবিষ্কার করতে হবে। বাংলাদেশকেই এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে হবে।
বর্ণমালার জন্য রক্ত দিয়ে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। বোধকরি সে কারণেই সৈয়দ হকের ঐ নেতৃত্বদান বিষয়ক মন্তব্য।
সবশেষে বলি, পাঠক নিশ্চয়ই একমত হবেন যে, প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলা ভাষার ব্যবহারও এগিয়ে চলেছে এটি অবশ্যই একটি অগ্রগতি। তবে প্রযুক্তি এখনো সমাজের মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই শুধু প্রযুক্তির বিকাশই শেষ কথা নয়।