এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • কিম্পুরুষঃ দি স্টোরি অফ দি গ্রেট বিয়ার

    কুলদা রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ | ৮০৩ বার পঠিত
  • আমাদের শহরে একবার ভালুক এসেছিল। ভালুকের গা ভর্তি কালো চুল। চারপায়ে হাঁটতে পারে - দুপায়েও পারে। দশাসই ফিগার। তর তর করে গাছে চড়ে। ভালুকটিকে কেউ দেখে নি। গলায় একটি ঝুমঝুমি আছে। খবরটি তাজা। শুনে আমার বন্ধু প্রতীক বরইগাছের কচি ডাল পুড়িয়ে চারকোল বানিয়ে নিয়েছে। আর জোগাড় করেছে বড় সড়ো কার্টিস পেপার। কাঁধে ঝোলা। আমাকে নিয়ে সারা শহরময় ঘুরে বেড়ায়। ইচ্ছে জ্যান্ত ভালুকের ছবি আঁকবে-এই লাইভ পোর্টেট অব অ্যান আননোন বিয়ার। এ ভবে সুযোগ সব সময় আসে না হে। ডরো মাৎ।

    আমরা দুজনে মিলে পাচুড়িয়া পার হয়ে সোনাকুড় পর্যন্ত যাই। নদীর পাড়ে বসে থাকি। শশ্মানঘাটে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। ব্যাংক পাড়ায় পদ্মপুকুর পাড়ে নসুকাকু ছিপ রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখ খুব কালো। তার মাছ ধরার সাধ। টোপ নাই। যে লোকটি বনবাঁদার খুঁজে টোপ এনে দেয়-তার কোনো পাত্তা নাই। জীবনে এই প্রথমবারের মত নসুকাকু দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে ছিপ নাই। সামনে নিস্তরঙ্গ পুকুর। আমাদের দেখে ফস করে বলেন, কী রে তোদের ভয় করে না?

    --ভয় করবে কেন। আমরা তো ভূত খুঁজছি না। ভালুক খুঁজছি।

    --ভালুকটার বাড়ি কোথায় রে?

    --জানি না। কোনো আফ্রিকার জঙ্গলে টঙ্গলে হতে পারে।

    ঘরের মধ্যে লোটাস জানালায় ছিল। আমাদের গলা শুনে দৌঁড়ে ঝুল বারান্দায় ছুটে এসেছে। চেঁচিয়ে বলে, আফ্রিকায় কেন হবে! ওইটার বাড়ি গৌরনদী। জিলা বরিশাল। বিখ্যাত দি লক্ষ্মণদাস সার্কাসের ভালুক। খাঁচায় খাঁচায় থাকে। খেলা দেখায়।

    লোটাস আরও কী সব তথ্য বলে হাত নেড়ে নেড়ে। লোটাসের মা এসে পাশে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। এইবার বোঝা যায়-মাকে ছাড়িয়ে গেছে মেয়ে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মায়ের বুকের ভিতর থেকে। হাত দিয়ে লোটাসের লম্বা চুল নাড়ে চাড়ে। বেণী বেঁধে দিতে সাধ জাগে। নসু কাকু এইসব দেখে না। পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জলে চাঁদ ওঠে। মাছ ধরা ছিপটি ঘাসের মধ্যে পড়ে আছে। বলে, খুব সাবধান। ভালুক ভয়ংকর প্রাণী। ধারালো দাঁত আছে। চিন্তিত নসুকাকা এইসব বিড়বিড় করে বলে। আর মায়ের সামনেই লোটাস ভেংচি কেটে বলছে, ভ-এ কারে উল্লুক-ভাল্লুক।

    পদ্মপুকুরে পদ্ম ফোটে। লাল পদ্ম। নীল পদ্ম। পাশাপাশি। গলাগালি করে ফোটে। লোটাস এলে জলের উপরে হাওয়া খেলে যায়। গোল গোল পাতা হালকা করে নেচে ওঠে। প্রতীক কখনো লোটাসকে লোটাস বলে ডাকে নি। ডাকে, পদ্ম। পদ্মরাগমণি। পদ্মই রাগ করে মন থেকে বলতে পারে-হুইম, বেটা ভাল্লুক।

    চানমারিতে মাসে একবার ফায়ারিং হয়। সেদিন আমাদের শহরে মানুষজন একটু নড়ে চড়ে ওঠ। খুব বুড়ো এবং জালি ছেলে মেয়েরা দল বেঁধে চানমারিতে গুলি খুঁজতে বের হয়। পুলিশ তখনো মাটিতে শুয়ে পড়ে গুলি করার ঢং করছে। আর তাদের পাছার উপরে পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বস। চেঁচিয়ে বলে, গুলি কর।

    --গুলি নাই। গুলি করুম কেমনে?

    --হালার পো হালা। গুলি নাই তো কি অইছে। কইছি গুলি কর। তুই গুলি করবি। অর্ডার। ইহা কথা না--পুলিশি অর্ডার।

    পুলিশগুলো বন্দুকের ট্রিগারের হাত রাখে। ল্যাতল্যাতে আঙুল দিয়ে ট্রিগার খোটাখুটি করে। লোকজন হা হা করে হাসে। আর জালি ছেলে মেয়েরা ওদের সামনেই চানমারিতে দৌঁড়ে যায়। মাটি খুঁড়ে গুলি বের করে আনে। কেউ কেউ পুরনো দেওয়ালে ইটের ফাঁক ফোঁকরে হাত ঢোকায়। বস বলে--গুলি কররে হারামজাদা। অর্ডার। জালি ছেলে মেয়েদের কেউ কেউ বলে ওঠে, পাইসি। ক্ষুদে ক্ষুদে গুলি। অমৃত মুচি চৌরঙ্গীর মোড়ে জুতা সেলাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে এই সব গুলির গায়ে ফুঁ দেয়। মজুরী এক আনা। বলে লাল সুতোয় বেঁধে ছেলেরা ডান হাতে আর মেয়েরা বাম হাতে বেঁধে ন্যাও গো বাবুসাব। ডরো মাৎ। ভালুক বলে বাপরে বাপ। আমি আর নাই--নাই রে সোনা।

    এই অমৃত মুচিকেই ধরা হয়। অমৃত মুচি শহরে খ্যাতিমান লোক। শিডিউল কাস্ট কোটায় একবার ভোটেও দাঁড়িয়েছিল। ফল--অতিশয় দুর্বল। অমৃত মুচি দুপায়ের ফাঁকে জুতো ঢুকিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে সেলাই করতেই ভালবাসে। বলে-- বুঝলে বাপো, আমাগো দ্যাশের পারলামেন্টের জন্য জুতা বানানো দরকার। হ্যার পায়ে ধুলা। কেউ কেয়ার করে না।

    অমৃত মুচি দুআনা পয়সা চায় আমাদের কাছ থেকে। হাত বাড়িয়ে বলে, দ্যাও।

    ---কী দেব?

    --গুল্লি।

    --আমরাতো গুল্লি খুঁজছি না দাদু।

    --কী--কী খুঁজতাছ কাগু?

    --ভাল্লুক। ভাল্‌-ল্লু-উ-ক।

    অমৃত মুচি শুনে থমকে যায়। নিজের চক্ষু দুটো হাতের চেটোর ভাল করে ঘষে। আমারদের দুজনের কপাল গভীর করে দেখে। তারপর মাথা নাড়ে এদিক ওদিক। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বলে, পাবা। একটু সবুর ধইরো। সবুরে মেওয়া ফলে। আমাদের মেওয়া বলে কিছু নেই--আছে মেথর। মেথড় পাড়া আছে। সোনালী ব্যাংকের পিছন দিয়ে সরু রাস্তা। ইট বিছানো। পা রাখলে ইটগুলো ধড়ফড় করে। একটু এগুলেই মেথর পাড়া। বৈরাগীর খাল পাড়ে কয়েক সারি খুপরি ঘর। আধাআধি ফাঁকা। ছাড়া বাড়ি। ঘরের সামনে জল কাদা। আর একপাল শুয়োর চরছে। খালি গায়ে কয়েকটি শিশু ভোলানাথ তাদের সঙ্গে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একটি সজনে গাছের নিছে লছমিপ্রসাদজী দিন দুপুরে তাড়ি গিলছে। আর হড়বড় করে চেঁচিয়ে বলছে, বুয়েছিস কাহু, তুরা ভাল্লুক ভি আছিস। উল্লুক ভি আছিস। শুল্লুক ভি আছিস। লছমিপ্রদসাদজীর বহুবিবি শিউলীবালা এক হাড়ি খালের জল তার সোয়ামীজীর মাথায় ঢেলে দিয়েছে। আর হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নেচে উঠেছে- হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দুপাট্টা মল মল ও যায়ে।

    শহরের উত্তর পাড়ায় গোরস্তান। এর সামনেই ডাইরেক্ট বেদগাঁ রোড। এখানেই ছোট খোকাদের বাড়ি। পুরনো আমলের টিনের ঘর। চালে দুপাশে ময়ুর-জং ধরা টিনের ময়ুর। মাঝখানে চান তাঁরা। বাড়িতে ছোট খোকা নেই। খবর এসেছে, ছোট খোকা মারা গেছে। ঢাকায়। লাশ মর্গে পড়ে আছে। লাশ আনতে কিছু টাকা পাঠাতে হবে জরুরী ভিত্তিতে। ছোট খোকাদের বাসার সামনে কিছু লোক জমে গেছে। কেউ শুকনো মুখে ঘুরছে। কেউ ফিসফিস করছে। কেউ স্টার সিগারেট ধরিয়ে বাহ্য আগমনের অপেক্ষা করছে। কেউবা লম্বা একটা হাই তুলে বাসায় ফিরে যাচ্ছে।

    ছোট খোকার মা বুড়ি মানুষ। কাঁদবেন কি আছাড়ি বিছাড়ি খাবেন বুঝতে পারছেন না। একবার বারান্দায় উঠছেন। একবার ঘরের দরোজায় উঁকি দিচ্ছেন। আবার উঠোনে কোমর ধরে ছুটে আসছেন। চুলায় ভাত উতরায়। একটি বিড়াল লেজ উঁচিয়ে চুলার চারধারে ঘুরছে। ঘরের মধ্যে বড় খোকা নিমকাঠের পালঙ্কে ঘুমিয়ে আছে। তার সদ্য স্নাত বউটি খুব খেয়াল করে সিঁথি কাটছে। আর মাঝে মাঝে বড় খোকার গায়ে ঠেলা মেরে বলছে, ওঠো। ওটপা না। উইঠা দ্যাখো। ছোট খোকা আবার মইরা গেছে।

    বড় খোকার কপাল কুঁচকে গেছে। তার আরও গভীর করে ঘুম পায়। পাশ ফিরে বলে, এই নিয়া ছয়বার মরল। আরও দুএকবার মরুক। তারপর উঠবানি।

    একটি লিকলিকে লোক বারান্দায় বসে মুড়ি খাচ্ছে। খেতে খেতে দেখছে, মুড়ির গন্ধে পিঁপড়ে এসে গেছে। মাটিতে পড়ে থাকা কয়েকটি মুড়ি কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সারি বেঁধে যাচ্ছে। পিঁপড়েদের কোনো টেনশন নেই। দেখতে দেখতে লোকটির মনে হয়-আরেকটু নলেন গুড় হলে ভাল হত। কাছে একটি কুকুর পায়ের ভিতরে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। নিস্তব্ধ। এদিক ওদিক তাকিয়ে লোকটি উঠে পড়েছে। বুড়ি মা তার দিকে দৌঁড়ে আসে। হাত ধরে বলে, যাইও না বাবা। টাকা লৈয়া যাও।

    লোকটি হাসে। এক খাবলা মুড়ি মুখে পোরে। কয়েকটি মুড়ি মুখের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। এই মুড়ির গন্ধে একটু পরে পিঁপড়ে ঠিক এইখানেও আসবে। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা জরুরী নয়।লিঁকলিকে লোকটি শান্ত গলায় বুড়ি মার হাতটি ছাড়িয়ে নিয়ে বলে-চিন্তা নাই। আপনে ট্যাকার জোগাড় করেন। লাশ আইব।

    লোকটির বামগালে একটি বড় কাটা দাগ । আলোতে চকচক করে। অন্ধকারে ধকধক করে জ্বলে। লোকটি যখন আর আসে না তখন ছোট খোকার বুড়ি মা ফ্যাল ফ্যাল করে আকাশ পানে চায়। সুর্যটা মাথার উপর থেকে পশ্চিমে একটু হেলে পড়েছে। কয়েকটি কাক উড়ে যাচ্ছে দূরে কোথায়। তখন মনে পড়ে লোকটির গোঁফজোড়া পেরজাপতির মতো পাঙ্খা মেলা। সাদা আর কালো। ঝিলমিল করে গো। তোমরা শুইনো গো বাছা।

    বেলা পড়ে এলে গোরস্তানের একপাশে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে ছোট খোকার বুড়ি মা। সামনে ছোট একটি আচি খাল। নাম বৈতরণী। কুল কুল করে জল আসে। ভুল ভুল করে জল চলে যায়। দুএকটা গুই সাপ সড় সড় করে মাথা গুঁজে মাছ খুঁজে ফিরে যায়। সাঁজবাতির পরে রাত্রি নেমে আসে। চন্দ্রও মেঘের সঙ্গে গলাগলি করে উঠে পড়ে। তাড়াহুড়া করে বলে পুরোটা উঠতে পারে না। আধখানা করে উঠে। আমার বন্ধু প্রতিক এই অর্ধ চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ভালুক খে?ঁজে। আর থেকে থেকে আমাদের খিদে পায়। চোখ দুটো জ্বলে ওঠে। আধো অন্ধকারে আধো আলোতে দেখা যায় ঝোঁপের পিছনে একটি দুপেয়ে ভাল্লুক বেরিয়ে এসেছে। গা ভর্তি কালো চুল। দশাসই ফিগার। থরথর করে কাঁপছে। বুড়ি মা মমতা ভরে ভালুকটির গায়ে পিঠে হাত বোলায়। বলে, দুষ্টু ছাওয়াল। ভাল্লুক সাজছিস ক্যান। ভয় দেহাবি? ভালুক চোখ বোজে আরামে। তার গায়ে অনেকদিন পরে সুড়সুড়ি লাগে। বলে, ভয় দেহাব ক্যান গো মা। খেলা দেহাবার সাধ হয়।

    --তাইলে?

    --মানুষ সাইজা থাকা বড় কষ্ট। ভাল্লুক হইবার মঞ্চায়।

    এই ভালুকটা কিন্তু মিথ্যা। বুড়ি মানুষের ভীমরতি। সত্যি সত্যি ভালুক তো আসে না। এলেও তো তিনকেলে বুড়ির দেখার কথা নয়। বুড়ির চোখ নাই। চোখে দুটো সাদা পাথর জ্বলজ্বল করে। মাঝে মাঝে কিছু জল গড়িয়ে পড়ে। ডালিম দানার মত টলটলে। লাল। হালকা গরম।

    বুড়ি ছোট খোকার আশায় গোরস্থানের অশ্বত্থগাছের নিচে বসে থাকে। হাওয়া আসে। শুকনো চুল ওড়ে--সাদা সাদা চুল। দুএকটা পাতার উপরে খচখচ শব্দ হয়। পায়ের কাছে আচি খাল কুল কুল করে বয়ে যায়। খালের নাম বৈতরণী। খুব জাগ্রত খাল। এই খালের ওপারে যারা যায় তাদের নাম হুব্বুত--ছায়াময় কায়া হে। বুড়ি কিছুটা বোঝে--কিছুটা বোঝে না। খনখন করে বলে, ছোট খোকা--অ ছোট খোকা, আইলি?

    কোথায় ছোট খোকা! চাঁদের ভিতর থেকে এক টুকরো ভিজে আলো এসে বুড়ির ঠোঁটে এসে লাগে। থরথর করে ঠোঁট দুটো কাঁপে। জল পিপাসা মেটে। আর কিছু নয়। এ সময় গেট খোলার শব্দ হয়। প্রতীক আমার হাত চেপে ধরে। বলে, ভালুক আসছে। রেডি হ। ভালুক আসছে। প্রতীক আমার হাতটা খুব শক্ত করে চেপে ধরেছে। হাতদুটো বেশ গরম। কিছুটা ভয় ভয় করে। প্রতীকের গা ঘেঁষে বসতে হয়। প্রতীক কার্টিস পেপারের ভাজ ঠিক করার চেষ্টা করে। ফিস ফিস করে, শ্‌ । ভালুক আসছে। আমাদের ভালুক সত্যি সত্যি আসছে। রেডি ওয়ান, টু, থ্রি। গেট খোলার শব্দ আরেকটু জোরে হয়। বহু পুরনো মর্চে ভাঙার শব্দ। বুড়ি অন্ধকারের দিকে মুখ করে বসে আছে। গেট খোলার ক্যাচর ম্যাচর শব্দ হয়। বৈতরণীর জলে কী একটা উসুক করে ওঠে। বুড়ি বলে, অ ছোট খোকা দেরি করতিছিস ক্যান। তর ঠাণ্ডা লাগে না বাপো?

    বুড়ির গলাটা শ্লেষ্মা জড়ানো। ঠোঁটের কম্পন আরও তীব্রতর হয়। দাঁত নাই। ফসফস করে একটা বায়ু সরার মত আওয়াজ ওঠে। প্রতিক ফস করে বলে, অই দ্যাখ। --কী --ভালুক। ভালুক আইছে রে।

    ভালুক কই। দুইটা মানুষ। একটা পুরুষ। আরেকটা মাইয়া। মেয়ে মানুষটির মুখ ব্যাজার। এবং কিছুটা ভীত। বারবার গোরস্থানের স্তব্ধ কবরগুলোর দিকে তাকায়। আর নিজের বুকের আঁচলটি টেনেটুনে গলায় প্যাচ মারে। পুরুষটির হাতের ফাঁকে ঢুকে যেতে চেষ্টা করে। খামচে ধরে পেশল বাহু। বাহু থেকে একটি গুলির কবজের লাল সুতো ছিঁড়ে যায়। ঘাসের মধ্যে ছিটকে পড়ে। মেয়ে মানুষটি পুরুষটির মুখের পানে চেয়ে বলে, চান মাথার উপ্রে যাওয়ার আর দেরী নাই। চলেন,ঘরে যাই। আজ চান ফিরা গেলি ঝামেলা। রোজ রোজ ভাল লাগে না।

    স্বামীটি কথা বলে না। তার পিঠে সামান্য ঘাম জমেছে। বউটি বলে, কেশির মা কৈছেন-ঠিক মাথার উপ্রে চান-নবমীর দিন-যদি স্বামীসঙ্গ কর-তাইলে হবে। বউটি হালকা হাঁপায়।স্বামীর বুকে নাক ঘষে। বলে, কেশির মা সব জানে।

    আঁচলের খুট খুলে স্বামীটিকে পান শুপারি দেখায়। আর তখন একখণ্ড মেঘ চাঁদের উপরে এসে পড়েছে। আলো কিছুটা ম্লান। ঠিক ঠাওর করা কঠিন।চারিদিকে সারি সারি কবর। খুব ঠাণ্ডা। একটি কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুল এসেছে। ঝিরঝিরে পাতা দোলে। তার উপর এক ঝাঁক জোনাকি চুপ করে থেমে আছে। আগুন জ্বলে না। শুধু একটি ফুঁয়ের অপেক্ষা।

    স্বামী বউটির কোমল সদাতৎপর হাতটি সরিয়ে দেয়। তার হাতে উল্টো পিঠে কালো কালো লোম। শির শির করে কেঁপে উঠছে। হাতের পেশির উপর চোপে বসেছে পাঁচটি আঙুলের ছাপ। চাপা কলির মত। একটি ছাপে লাল দাগ। রক্ত জমেছে। নখ বসে গেছে। এ সময় তার সামান্য জলপিপাসা লাগে। বলে, আদুরী জল দে।

    প্রতীক বলে, শুনছিস, নাম আদুরী।

    --কার?

    --বউটির। বাপে আদর করে নাম রেখেছিল আদুরী। আ-দু-রী।

    --কিন্তু স্বামীতো হ্যারে আদর কর না। তাইলে?

    --সেইটা অন্য কেইস। চ্যাইয়া আদর পাইতে কেমুন ঢপ করতেছে।

    আদুরী তার স্বামীটিকে জাপটে ধরেছে। দুহাত দিয়ে শক্ত করে পেচিয়ে ধরেছে। বুকে নাক ঘষছে--মুখ ঘষছে। রমণীর বসন ভূষণ আলগা হয়ে এসেছে। তার গা ধবল জ্যোৎস্নার মত সাদা। স্বামীটির সম্মুখ গতি থেমে গেছে। তার ভিতরে নরম কিছু গলে জল হয়ে যাচ্ছে। টের পাচ্ছে তার পায়ে এক রমণীর গা থেকে ধবল জ্যোৎস্নার খোলসটি হড়কে যাচ্ছে। তাই রমণীটি হি হি করে কাঁপছে। একটি হিলহিলে সাপের মত মুচড়ে পড়ছে। জ্যোৎস্নার কারণে হঠাৎ করে বোঝা যায় ওটা নারী নয়--ঠিক একটি সাপ। বলে, আমি না। আমি না।

    মেঘ না থাকলে চাঁদের আলো বিদ্যুতের মতো জ্বলে। দিনের চেয়েও স্পষ্ট হয়ে যায়। দেখা যায়-পায়ে পড়া সাপটি আলো পেলে রজ্জু হয়ে ওঠে। রজ্জু দেখে এ সময় ভাব জেগে ওঠে।

    --রজ্জু মানে কী?

    --দড়ি।

    --দড়ি?

    --হ, দড়ি। দড়ি দেইখা দাড়ি চুলকাতিছিস ক্যান?

    --ভয় খাইছি।

    শুনে হা হা করে হাসতে গিয়ে প্রতীক হঠাৎ করে থেমে যায়। হা হা রবের কারণে চারকোলটি কার্টিস পেপারের উপর অল্প করে নড়ে গেছে। কাগজের উপরে একটি দাগ পড়েছে। কিছুটা ভাঙা ভাঙা দাগ। কিছুটা আঁকাবাঁকা। প্রতীক ঝোলার ভিতরে হাত ঢোকায়। হাতড়াতে থাকে। কিছু একটা খুঁজে না পেয়ে ঝোলাটি উপুড় করে ঢালে। কাগজের উপরে আরও কয়েক টুকরো চারকোল, পাঁচটি বি৬ পেন্সিল, আধ ভাঙা ব্রাস, ছোট এক প্যাকেট নাবিস্কো বিস্কুট আর সত্যি সত্যি একটি লম্বা চুল ঠক ঠক করে পড়ে। চুলটি বেশ লম্বা। সামান্য বাঁকানো। এজন্য চুলকে চুল নয়-কেশ বলে অভিহিত করা হয়। এবং হাওয়ায় কিছুটা জবাকুসুম তেলের ঘ্রাণ ভেসে যায়। প্রতিক খুব যত্ন করে কেশটিকে চোখের সামনে তুলে ধরে। কেশের আড়ে পাহাড় লুকায়। প্রতীক বলে, চিনতে পারিস?

    --কী?

    --কেশ।

    --কার? লোটাসের। নসুকাকার মেয়ে লোটাসের চুল?

    --না। পদ্মরাগমণির।

    প্রতীক চারকোল, ভাঙা ব্রাস, পেন্সিলগুলো এবং নাবিস্কো বিস্কুটের প্যাকেটটা ঝোলার মধ্যে হুড় হুড় করে ঢুকিয়ে রাখে। জবাকুসুম কেশটিকে খুব সাবধানে অতি যত্নের সঙ্গে ঝোলার ভিতরে রাখতে রাখতে বলে, দড়ি দেইখা ভয় পাওয়ার কিছু নাই। দড়ি মানে তো ম্যানিলা দড়ি না। ম্যানিলা দড়ি জেলার সাব লুকিয়ে রাখেন। ফাঁসির আগের দিন বের করেন। তেল মাখিয়ে রাখেন। ম্যানিলা দড়ি বাজারে পাওয়া যায় না।

    প্রতীক এইসব গুহ্য কথাগুলো এত আস্তে বলে যে, পুরোপুরি শোনা যায় না। শুধু দেখা যায়-ঠোঁট নড়ছে। বাক্যগুলো অনুমান করে নিতে হয়। অনুমান করে নিলে সমস্যা মিটে যায়। কেননা আদিতে বাক্য ছিল। আলোও ছিল না। অন্ধকারও ছিল না। জলও ছিল না। স্থলও ছিল না। কোথাও এতটুকু হাওয়াও ছিল না। তাহলে কী ছিল হে? নাথিং। শুধু বাক্য ছিল। যে কোন বাক্যর অণ্‌তর্নিহিত অর্থ যাই হোক না কেন অনুমানে কিছুটা ফ্লেভার আসে। সেই ভেবে মনে হয়, ওটা লোটাসের চুল নয়-জবাকুসুম কেশও নয়। লোটাসের চুল দীর্ঘ নয়-ববছাঁট। ঝপাঝপ। ওটা একটা ম্যানিলা দড়ি। কারো ফাঁসির পরে গলা থেকে খুলে নিতে ভুলে গেছে। কেউ হয়তো দেখতে পেয়ে খুলে নিয়েছে অলক্ষ্যে। দড়ি শব্দটি শুনলে তাই গলা শিরশির করে ওঠে। শ্বাস রোধ হেয় আসে। কোনো এক প্রকাশ্য মৃত্যুর আশঙ্কায় রক্ত হিম হয়ে আসে। খুব খিদে পায়।

    এ সময় আদুরী দুটো কবরের মাঝখানে শুকনো পাতা জড়ো করে। শুয়ে পরীক্ষা করে নেয় কতটা নরম হর। তারপর পরনের কাপড়টি পাতার উপর বিছিয়ে দেয। বাঁপাশে লাল কবর। ডানপাশে নীল কবর। আদুরী চুলের খোঁপাটি এলো করে দেয়। ধলে ধরে কাঁচুলির বোতাম খোলে। পাটপট করে শব্দ হয়। দুহাত উপরে তোলে। আড়মোড়া ভাঙে। হাত বাড়িয়ে বলে, আইস। চইলা আইস। দেরী কইরো না চান।

    হাওয়া শন শন করে বয়। ঠাণ্ডা হাওয়া। গুণ গুণ করে গান শোনা যায়। দেখা যায়-মেয়েটির সাফ সুতরে? গায়ে হাজার হাজার চাঁদ সহসা জ্বলে উঠেছে। অপার মহিমাময় অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে বের হচ্ছে নীল বর্ণ। হাতে ঝন ঝন করে চুড়ি। কপালের মাঝখানে বসানো টিপটিকে তুলে নিয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয়। ভাসতে ভাসতে অমল টিপটি বহুদূরে একটি পাকুড় গাছের উপর ঘুমিয়ে থাকা একটি পাখির চোখের পাপড়িতে আঘাত করে। রাতের অন্ধকার ভেদ করে পাখিটি ডেকে ওঠে, খোকা হোক। খোকা হোক। সত্যি সত্যি খোকা হোক তোমার আট কুড়ুনি মেয়ে।

    স্বামীটি আদুরীর বাড়ানো দুহাতের দিকে এগিয়ে আসে। আদুরীর ঠোঁট হাসে। মুখ হাসে। চোখ হাসে। পাতার বিছানায় শুয়ে পড়তে পড়তে শোনে তার নধরকান্তি ম্লানমুখ স্বামীটি বিড় বিড় করে বলছে, কার খোকা হবে বউ? কার খোকা?

    --তোমার খোকা।

    --কেমন খোকা?

    --চান্দের কণার মত খোকা।

    --খোকা কী করে?

    --খোকা হাসে। হামা দেয়। টলোমলো করে হাঁটে।

    --হেঁটে কোথায় যায়?

    --শিক্ষায়তনে যায়।

    --শিক্ষায়তনের গিয়ে কী করে?

    --বই পড়ে।

    --বই পড়ে কী হয়?

    --জ্ঞানী হয়।

    --কী জ্ঞান?

    --নির্জ্ঞান।

    নির্জ্ঞান হতে হতে শোনা যায় বুড়ি মা আর্তনাদ করে কাঁদছে, বড় খোকা। অ বড় খোকা। বড় খোকা নির্জ্ঞান অবস্থা থেকে সজ্ঞান অবস্থায় আসতে আসতে অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরতে ফিরতে শোনে, বুড়ি মা নতুন করে আর্তনাদ করে বলছে, অ বড় খোকা। বড় খোকা। আদুরী স্বামীটকে গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে রেখেছে। নীল বর্ণ দিয়ে বেঁধে রাখতে চায়। বলে, খোকা হোক। খোকা হোক।

    চন্দ্র মধ্য আকাশে উঠে পড়ে। মেঘ সরে যায়। স্বামীটি ঘেমে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে পাতার বিছানা থেকে উঠে পড়ে। বলে, এখন না। এখন না। মা জাইগা আছে। আদুরী ফিসফিস করে বলে, খোকা হোক। স্বামী বলে,মা ডাকছে। আদুরী বলে, খোকা হোক। স্বামী বলে, মা ডাকছে। পরে খোকা হবে। আদুরী চেঁচিয়ে ওঠে, মা বলে কী প্রকারে? মায়ের মুখ নাই। মা শোনে কী প্রকারে? মায়ের কান নাই। মা দ্যাখে কী কইরা? মায়ের চক্ষু নাই। মা থাকে কী কইরা? মাও নাই।

    --তাইলে উনি কেডায়?

    ---উনি মা নয় কো। উনি সর্প। আর হ্যার রজ্জুটি বারান্দায় বইসা কান্দে। বোজলা সোনা, ইহা হৈল রজ্জু দেখিয়া সর্প ভ্রম।

    --মা নাই?

    --মা নাই। ম্যা আছে। ম্যা ম্যা ম্যা।

    ঠেলে ঠুলে উঠে পড়ে স্বামীটি। ক্লান্ত বিষণ্ন ঘোড়ার মত হাঁপাতে হাঁপাতে লাল কবর আর নীল কবরের মাঝখান থেকে হেঁটে যায়।তার বুকে পিঠে কালো চুল। হাতে পায়ে ভর করে যেতে যেতে দেখতে পায় না-আদুরী নীল বর্ণের ভিতর থেকে সহসা জ্বলে উঠে পুড়ে যায় লাল বর্ণ হয়ে। একটু একটু করে উপরে উঠতে শুরু করে। উঠতে উঠতে মাথার উপরে ঝুকে কৃষ্ণচূড়া গাছটির ডালে এসে ঠেকে। ডাল বলে, ও কইন্যা, তুমি একা ক্যানো। তুমার শাড়িডারেও ডাকো। শাড়িটি হাসতে হাসতে উড়াল দেয় গো কইন্যা একদম আকাশে বাতাসে। আদুরীর হাতের নাগালের কাছে এসে পড়ে। খন খন করে বলতে থাকে, ম্যা ম্যা ম্যা।

    --ম্যা মানে কী?

    --ভ্যা ভ্যা।

    --ভ্যা ভ্যা মানে কী?

    ---ভ্যা মানে ভাল্লুক। দি গ্রেট বিয়ার। পূর্বে গ্রেট বিয়ার ধ্‌রুব তারার চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাচত আর গুল্লি করত। ঠাস ঠাস ঠাস।এখন মর্তে আইসা বাঁচে।

    --ভাল্লুক কী করে গো ভইন?

    --ভাল্লুক খেলা দেখায়।

    --কী খেলা?

    --সার্কাস খেলা। দি লক্ষ্মণ দাস সার্কাস। সাং গৌরনদী। জিলা : বরিশাল। জ্যান্ত ভাল্লুকের খেলা দেখে যান গো বাবু। টিকিট মাত্র সাড়ে ছআনা। খেল খতম-পয়সা হজম।

    ফোঁস ফোঁস করে গাছের ডালে আদুরী গর্জায়। ডানহাতে শাড়িটি আর বাম হাত দিয়ে নাকের স্বেদ মুছে ছুড়ে দেয় হাওয়ায় হাওয়ায়। চাঁদের আলোয়। চাঁদটি মধ্য গগন ছেড়ে পশ্চিমে সামান্য হেলে পড়ে।

    এ সময় আমাদের শহরের লম্বা পুলিশটি হুড়মুড় করে কবরস্থানের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তার তলপেট ভারী হয়েছে। হালকা হওয়ায় প্যান্টের জিপার খুলে ফেলে। পায়ের নীচে পাতার পুরু বিছানা। বাঁপাশে লাল কবর। ডানপাশে নীল কবর। লাল কবরটি মুখ টিপে হাসে। নীল কবরটি ভ্রু কুচকে বলে, হাসতিছিস ক্যানো?

    লাল কবরটি বলে, কওয়া যাবে না। শরম করে।

    --হায় হায়। তাইলে তো শোনাই লাগে। কও ভইন।

    --এই বেডায় আন্ডার প্যান্ট নাই। একদম সদর ঘাট। হা হা হা।

    --হাসনের কি হৈল। পুলিশগো আণ্ডার প্যান্ট কবে আছিল? হ্যাগো সর্বদাই রেডি ওয়ান টু থ্রি থাকন দরকার। নো মিস ফায়ার।

    জিপারটি খুলে পুলিশ হালকা হতে যাবে ঠিক এ সময় মাথার উপরে গরম জলের ফোঁটা পড়েছে। বুকে ধ্বক করে ওঠে। ভয়ে বাঁশি বাজিয়ে দেয়। বাঁশিটির পিপি শব্দ কবরস্থান ছেড়ে বহুদূরের গ্রামদেশের ঘুমন্ত দরোজায় আছড়ে পড়েছে। পাকুড় গাছে এক ঝাঁক কাক পাখি রাত্রি ভেঙে কা কা শব্দে ডেকে উঠেছে। পাকুড় গাছটি বৈতরণী নদীর অপর পাড়ে। নদীর স্রোতের শব্দে কা কা শব্দ ডুবে যায়। ঘুমন্ত গ্রামের লোহজন আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। নদী বলে কল কল। ছল ছল। গল গল। কৃষ্ণচূড়ার পাতায় অপেক্ষমান জোনাকির ঝাঁক জ্বলে ওঠে এক সঙ্গে। বলে, ওরে ভাই-- চল চল চল-- ত্বরা করে চল।

    জিপারটি খোলা বলে জোনাকির ঝাঁক এসে সেখানে ঘিরে ধরে।এক সঙ্গে জ্বলে আর নেভে। সেজন্য জিপারটি বন্ধ করার তাড়না নাই। পুলিশটি ভাবে, এই বেশ হয়েছে। শরীরের ভিতরের ছাই চাপা আগুন বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আর কোনো কষ্ট নাই। কষ্ট করে লাভ কী? এ জগৎ সত্য নয়। সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালবাসিলাম। অপরিচিতের নাম আনিলাম এ ধরণীতে। হে কালের যাত্রার ধ্বনি, তুমি আকাশে বাতাসে ওঠো রণি।

    এ সময় তার ঘাড়ে একটি ধাতব খণ্ড পড়ে। ধাতব খণ্ডটি চানমারির গুলি-অমৃত মুচির পড়া তাবিজ। তাবিজ বলেই একটু আঘাত পায়। বেশ চমকে ওঠে। ভয়ে ভয়ে উর্ধ্বপানে তাকায়। মাথার উপরে কৃষ্ণচূড়ার ডাল কাঁপে। দুহাতে ডাল ধরে ঝুলছে এক রাত্রিচর নারী। দুপায়ে বসন জড়ানো। চাঁদের আলোয় নারীটি খুব ঝলসিত। লম্বা পুলিশটির ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। বলে, তুমি কে গা?

    --আমি কেউ গা নই।

    --গুড। হ্যাগো কেউ না, তুমি কী করো?

    --ফাঁস লাগাই।

    --ভেরি গুড। ফাঁস লাগানো অতি গুড কাম। কিন্তু লেডি, তোমার দড়ি কুনহানে?

    --দড়ি নাই। সাপ আছে।

    --সাপ? সাপ কুনহানে?

    --এই যে পায়ের উপ্রে। বসনরূপ সাপ।

    -–কোন বসন?

    ---অঙ্গবসন। ভুষণও কইতে পারেন। শাড়ি কয়গো-শাড়ি। অঙ্গে জড়িয়ে থাকে জ্যান্ত সাপের লাহান। ফোঁস করে ওঠে।

    --ভেরি ভেরি গুড। সর্প দেখিলে দর্প হয়। তাইলে তো শাড়িই ভাল।

    --শাড়ি দিয়া ফাঁস লাগানির চেষ্টা করছিলাম। জুত হয় নাই।

    --শরীরে জুত লাগায় শাড়িতে। গলায় জুত দেয় দড়িতে। যে সে দড়ি নয় গো লেডি ইহা। ইহা ফাঁসির রজ্জু। হ্যারে কয় ম্যানিলা রোপ।

    --ম্যানিলা রোপ।

    --ইয়া জানেমন। ভেরি স্ট্রং এন্ড এনারজেটিং রোপ। সুচিক্কন। গলায় বান্দিলে আর কথা নাই। ঝাপ দিবা আর কইবা হ্যাক। হ্যাকও নয়। হ্যা এর কারে হ্যাক। হরি দিনতো গেল সৈন্ধ্যা হৈল-পার করো আমারে।

    --ম্যানিলা রোপ পামু কই?

    --জেলখানায়। জেলার সাবের কাছে আছে। তিনি সইর কইরা রাখছেন সিক্রেট লকারে। বাইরে পাবা না হে লেডি।

    --তাইলে উপায় কী?

    --উপায় নাই। জেল পুলিশরে ধরো।

    --কোন পুলিশ?

    --জেল পুলিশ। তানরাও অর্জিনাল পুলিশ। লেফট রাইট-লেফট রাইট। হাতে খায়। পায়ে খায়। পুলিশের মত এমুন সাচ্চা ফ্রেন্ড আর পাবা না কুনোহানে মাতাড়ি। মাছের মইদ্যে ইলিশ-মাইনসের মইদ্যে পুলিশ। মনে রাইখো-পুলিশের বিরুদ্ধে কিছু কইতে পারবা না। রাষ্ট্রের নিষেধ। সেন্সবোর্ড আটকাইয়া দেবে। কইলে খবর আছে।

    --আপনে কেডা?

    --ক্যান, পুলিশ। সন্দেহ আছে?

    --থাকতিও পারে। আবার নাও থাকতি পারে। আপনে কেমুন কেমুন রঙ ঢঙ করেন।

    --হা হা হা। পারফেক্ট বাত কইছো সেক্সি জেনানা। আই অ্যাম নট এ সত্যি সত্যি পুলিশ। আই অ্যাম এ ফেক পুলিশ। ভেক পুলিশ। রএ্‌যাব পুলিশ। খ্যাপ পুলিশ। খাড়া পুলিশ। ভাড়া পুলিশ।

    --আসল পুলিশ কুনহানে?

    ---আসল পুলিশ দিস টাইম বউয়ের কাছে গেইছে। বউয়ের খায়েস জাগছে। বউ মানুষটি শরম ছাইড়া কয়, খোকা হোক। পুলিশ কইল, ভাইজান, পোষাকডা লন। মুই এই ফাঁকে বউয়ের খোকার জোগাড় করি। বোজেন তো পুলিশ মানুষ। আগানে বাগানে ঘুরি। সংসারতো টিকন লাগব। হা হা হা। ফুলিশ দেখিয়া পুলিশ ভ্রম। পাখি ডাকে-ও পুলিশ, তোমরার খোকা হোকগো কাহু।

    --আমারও পাখি ডাকে-খোকা হোক। এতো ভারী জ্বালা। কন তো কী করি?

    --সোয়ামির লগে যান।

    --সোয়ামি ভয় পায়।

    --কী পায়?

    --ভয়।

    --হা হা হা। ম্যাদা মরা মরদ। কিয়ের ভয়?

    --ভাল্লুকের ভয়।

    --ভাল্লুক! ভাল্লুক কী করে?

    --গব গব কৈরা জ্যান্ত মানুষ খায়। আর সার্কাসে খেলা দেখায়। রঙ মাইখা সঙ সাজে। ডুগডুগি বাজাইয়া কয়-খেলা দেইখা যানগো বাবু। দি দি লক্ষণ দাস সার্কাস। টিকিট অগ্রিম লন। সাং গৌরনদী। জিলা বরিশাল। তাইলে আপনে আসেন গো পুলিশ। আমারে একটা খোকা দেন।

    --আমি দিমু কি প্রকারে বিবি? আমার তো যন্ত্রই নাই। যন্ত্রণা আছে। দ্যাহেন কি রূপ জ্বলে আর নেভে। বাত্তির কল। তাজ্জব কা বাত নেহি। ইহাই সত্যি। ওল্ড টেস্টামেন্ট অব কিম্পুরুষ। মন্ত্র দেখিয়া যন্ত্র ভ্রম। নম: যন্ত্র:। ক্ষম যন্ত্র।

    মাথার উপর থেকে আরও পশ্চিমে টলে পড়ে ঢলে পড়া চাঁদ। দুএকটা রাত্রিচর বাদুড় ওড়ে। হাওয়ায় নদী কাঁপে। জল কাঁপে। পাতা কাপে। গাছ কাঁপে। ডালে ঝুলন্ত লেডি হাহারবে কাঁপে। নিচে ভাড়া পুলিশ কাঁপে। তার প্রজাপতি গোফ কাঁপে। লাল কবর আর নীল কবর কাঁপে। খোকা হোক কাঁপে।

    এ সময়ে ভাড়া পুলিশটির মনে পড়ে খোকাদের বাড়ি যেতে হবে। ছোট খোকা মর্গে শুয়ে আছে। টাকা নিয়ে গেলে রিলিজ। ভাড়া পুলিশ ঝটপট করে জিপখোলা প্যান্টটি খুলে ফেলে। লেদলেদে জামাটি খুলে ফেলে। মাথার উপরে দোলায়মান নারীটিকে একা রেখে চলে যায় খোকাদের বাড়ির দিকে। জোনাকি পোকাগুলো এই ফাঁকে তার নিম্নাঙ্গ থেকে উর্ধাঙ্গেও ধাবিত হয়। সারা গায়ে ছড়িয়ে পড়ে। দেখা যায় একটি হণ্টণরত মানুষ একবার জ্বলে, আর একবার নেভবে। মানুষটিতে জ্বলা নেভার খেলা জমে ওঠে।

    বৈতরণী নদীর ঘাটে বুড়ি মা কাঁপে। তাকে জড়িয়ে ধরে বড় খোকা কাঁপে। বুড়ি বলে, অ ছোট খোকা। ছোট খোকা। বড় খোকা কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, মাগো কাইন্দো না। বুড়ি মা থরথর করে কাঁপে। বড় খোকা কানের কাছে মুখটি এনে বলে, অ মা, ছোট খোকা নাই।

    --তার কি হৈছে বাপো?

    --ভাল্লুক হৈছে।

    --ভাল্লুক কেমুন বাপো?

    --হ্যার গা ভর্তি কালো চুল। চার পয়ে হাঁটতে পারে। দুপায়েও হাঁটতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে মুখে রঙ লাগায়। গায়ে সঙ লাগায়। ডুগডুগ কইরা ডুগডুগি বাজায়। মাইনসের মইদ্যে খাঁড়াইয়া কয়-খেলা দেইখা যানগো বাবু। রঙ মানুষ নহি-সঙ ভাল্লুক। সার্কাসের ভুলভুলাইয়া ভাল্লুক। ভাল করে লুক লুক। দি লক্ষ্মণ দাস সার্কাস। সাং গৌরনদী। জিলা বরিশাল। মঞ্চাইলে কয়-বিপদে বন্ধুর পরিচয়। কোথাকার ঈশ্বরচন্দ্র কয়।

    মা কাঁদে না। তার চক্ষু নাই। মা হাসে না। তার মুখ নাই। মা বোঝে না। তার মন নাই। ভ্যান ভ্যান করে কে এক ভূষণ্ডির কাকের মতো কে জানি কয়, ট্যাকা আন বাপো। গালকাডা লম্বা বেডারে দে। ছোট খোকা মর্গে শুইয়া কান্দে গো বাপো। বড় খোকা গড়াগড়ি যায়। হেচকি তুলে কাঁদে। বলে, ট্যাকা নাই মাগো। -

    --ট্যাকা কই গেল?

    --ভাল্লুক লইয়া গেছে।

    ঠাণ্ডা হাওয়ায় প্রতীক কবরস্থানের নিশুতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। গুটি শুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়েছে ঘন ঘাসের উপর। লম্বা লম্বা চারকোলগুলি মাথার চাপে ভেঙে গেছে। নাকে মুখে কালো রঙ লেগেছে। কার্টিস পেপারগুলো হাওয়া হাওয়ায় ফর ফর করে ওড়ে। সঙ্গে ওড়ে দীর্ঘ একটি চুল। চুলে জবাকুসুম। অগ্রভাগ সামান্য বাঁকা। লোটাসের চুল। লোটাস নসু কাকার মেয়ে। স্কুল পাস করেছে। সাইকেলে যায়। ওর লাল দোপাট্টা মল মল করে ওড়ে। হি হি করে হাসে। বলে, আমার নাম লোটাস নয়কো। পদ্ম--পদ্মরাগমণি। পদ্মপুকুরে বাড়ি। তোমার লগে আড়ি।

    লাল কবর বলে, খেলা দেখে যান বাবু।

    নীল কবর বলে, খেল খতম-পয়সা হজম।

    ধুশ শালা। এ দেখি লাভ ইস্টোরি। কিটি কিটি কিটি। কিটি কিটি কিটি।

    প্রতীক ঘুমের মধ্যে পাশ ফেরে। বিড় বিড় করে বলে, ভাল্‌-লু-উ-উ-ক...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১১ | ৮০৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন