১. জুলাই ১৮৭১, প্যারি
Debout, les damnés de la terre
Debout, les forçats de la faim
La raison tonne en son cratère
C'est l'éruption de la fin…
(Stand up, damned of the Earth
Stand up, prisoners of starvation
Reason thunders in its volcano
This is the eruption of the end).
সিন নদীর পারে সেবারের জুলাইটা ছিল সত্যিই অন্যরকম। ইউজিন, তোমার কি মনে পড়ে? জুলাই বরাবরই এই ফরাসী দেশে ভিন্ন আভা, ভিন্ন দীপ্তি নিয়ে আসে। প্রায় পৌনে একশ বছর আগের জুলাইয়ের চোদ্দ তারিখের গল্পটা পিতামহ পিতামহীরা শোনায় নি কি? দিকে দিকে খবর রটে গেছিল যে বাস্তিল দুর্গের উপর কামান থেকে গুলি ছোঁড়া হবে সাধারণ, নিরস্ত্র মানুষের উপর। আর সে খবরে এত দিনের ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত ও বিপন্ন মানুষ যত ভয় পাবার বদলে বরং উল্টো হঠাৎই অতিকায় দৈত্যের মনের জোর নিয়ে ছুটলো সো-জা বাস্তিল দুর্গ বরাবর। ১৪ই জুলাইয়ের দু’দিন আগেই রাজা ভার্সেই থেকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এসে জনতার উপর আক্রমণ চালিয়েছিল। জনতাও এর উত্তরে সাথে সাথেই পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তÍত হয়ে গেছিল। শহরের ঘণ্টা বেজে উঠলো। জনগণের পক্ষ থেকে সতর্ক ঘণ্টা। জনতা দরকারে রাষ্ট্রীয় অস্ত্রভাণ্ডারও দখল করতে প্রস্তÍত। একটি গার্ড রেজিমেন্ট জনতার পক্ষে অবস্থান নিল। ঠিক তার দু’দিন পরেই অর্থাৎ চোদ্দ তারিখেই যেই না খবর রটলো যে বাস্তিল দুর্গ থেকে মানুষের দিকে গুলি ছোঁড়া হবে, অমনি সব ধেয়ে গেল দুর্গ বরাবর। তারপর বাকিটা ইতিহাস। গিলোটিনে অভিজাতদের মাথা। লিবার্তে-ফ্রাতের্নিতে-ইগালিতে...সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা...মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মায়...তথাপি সে সদা শৃঙ্খলিত! তবু, ইউজিন...যেমনটা তোমার পিতামহ বলতেন আর এ-ও জানা কথাই...প্রতিটা বিপ্লবের পরই আসে একটি করে প্রতিবিপ্লব...হাজার অন্যায়ের প্রতিবাদেও কারখানায় শ্রমিক ধর্মঘট করতে পারত না। নারী রয়ে গেল আগের মতই নিরক্ষর, গৃহকর্মের দাসী। তবে বিপ্লবটা কোথায়? তবু ১৭৯২ থেকে ১৮৭০...গুনে গুনে ৭৮টা বছর পরে আবার এই জুলাই...সে যেন একইসাথে রক্তবর্ণ অথচ পিঙ্গলাভ মেঘ, যা যে কোন ঝড়ের আগে দেখা যায়।
‘আমাদের প্রেসিডেন্ট মানে লুই বোনাপার্ট হঠাৎ জার্মানী আক্রমণ করতে গেলেন কেন? ইউজিন, তোমার কী মনে হয়?’
সিন নদীর পাড়ে ছোট ছোট কাফেতে তাদের আড্ডা জমতো। বন্ধুদের ভেতর ক্ষুদে দোকানী, শ্রমিক, ছাত্র, পত্রিকায় লিখিয়ে কিম্বা ইউজিনের মত একই সাথে গোপন বিপ্লবী দলের সভ্য আর পিয়ানো স্কুলের বয়স্ক ছাত্র সবাই বসতো।
‘কী আর মনে হবে? প্রেসিডেন্ট নিজের এন্তার দুর্বলতা ঢাকতে প্রতিবেশী দেশ আক্রমণ করে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা সৃষ্টি করতে চাইছে। নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে চাইছে।’
‘সেটাই হবে। নয়তো হঠাৎই পড়শি দেশের সাথে এমন যুদ্ধ ঘোষণা কেন?’ স্যুপের বাটিতে চামচ ডোবায় জাঁক।
‘যুদ্ধের হম্বি-তম্বির আভাস অবশ্য প্রেসিডেন্ট সেই ডিসেম্বর মাস থেকেই দিচ্ছেন। আর শ্রমিকেরা, লে পতি বুর্জোয়াজি বা ক্ষুদে বুর্জোয়া শ্রেণী সবাই এই যুদ্ধের প্রতিবাদই করছে। তবু প্রেসিডেন্ট অনড়। তার মতলব যে কী?’ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে লেদার কারখানার শ্রমিক পিয়ের।
‘আজ ত’ ১৫ই জুলাই। বারো তারিখের লিফলেটটি দেখেছ? কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের লিফলেট?’ ইউজিন পেতিয়ে বলে তার শরতের আকাশের মত স্বচ্ছ, নীল দুই চোখ তুলে।
‘তা’ আর দেখি নি বলতে?’ পিয়ের তার কোটের পকেট থেকে একটি দোমড়ানো, ছাপানো কাগজ বের করে, চোখের সামনে নাচিয়ে পড়তে থাকে,
‘ইউরোপীয় শক্তি-সাম্য রক্ষার অজুহাতে, জাতীয় সম্মান রক্ষার অজুহাতে, বিশ্বশান্তি আর একবার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খায় বিপন্ন। ফরাসী, জার্মান, স্পেনীয় শ্রমিক, আসুন আমরা গলায় গলা মিলিয়ে একযোগে যুদ্ধকে ধিক্কার জানাই। ...রক্তক্ষয় থেকে নিজেদের গা বাঁচিয়ে জনসাধারণের দুর্দশায় নতুন ফাটকা খেলার সুযোগ দেখে যারা যুদ্ধ ঘোষণা করছে, আমরা তাদের প্রতিবাদ করছি। আমরা চাই শান্তি, কাজ ও স্বাধীনতা। জার্মানীর ভাইয়েরা! আমরা বিভক্ত হয়ে পড়লে রাইনের দুই তীরেই স্বৈরাচারের পরিপূর্ণ বিজয় ঘটবে। ভাড়াটে প্রচারকদের প্রচারকে ফ্রান্সের সত্যিকার ইচ্ছে বলে ভুল করবেন না।’
যুদ্ধে কিন্তু হেরে গেল ফ্রান্স। জার্মানীর সেনাবাহিনী সীমান্তের ওপারে আলসেস ও লরেন জয় করে নিল।
হায়, সেদানে ৩য় নেপোলিয়ানকে আত্মসমর্পণ করতে হলো আশি হাজার সৈন্য নিয়ে। সেটা সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ, তাই না ইউজিন? প্যারির বড়লোক অভিজাতশ্রেণী নয়, ছোটলোক শ্রমিকরাই তখন দেশ রক্ষায় জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে নাম লিখাতে দলে দলে ছুটলো। ২রা সেপ্টেম্বর সম্রাটের ভিন দেশের কাছে আত্মসমর্পণের পর সারাদিন পার্লামেন্টের বড়লোক সদস্যরা চুপ করে থাকলো। সন্ধ্যা থেকেই সংসদ ভবনের বাইরে মানুষ জমায়েত হতে থাকলো- ‘প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক!’ ৪ঠা সেপ্টেম্বর সকাল থেকেই রাজধানীর রাস্তায় বিরামহীন মানুষের ঢল। অস্ত্র হাতে শ্রমিকেরা দখল করে ফেলেছে টাউন হল। রাজতন্ত্রের অবসান ঘোষণা করে প্রজাতন্ত্রের কথা বলা হলো।
২.
Du passé faisons table rase
Foule esclave, debout, debout
Le monde va changer de bas
Nous ne sommes rien, soyons tout
: C'est la lutte finale
Groupons-nous, et demain
L'Internationale
Sera le genre humain
(Of the past let us make a clean slate
Enslaved masses, stand up, stand up.
The world is about to change its foundation
We are nothing, let us be all.
: This is the final struggle
Let us group together, and tomorrow
The Internationale
Will be the human race).
কত বড় ভুল তোমরা করেছিলে ইউজিন! কেন বুর্জোয়াদের এতটা বিশ্বাস করলে? সশস্ত্র শ্রমিকদের গড়া ‘জাতীয় প্রতিরক্ষার সরকারে’ও কেন অভিজাত অর্লিয়ান্সীদের তোমাদের রাখতে হলো? আসলে এটা চোদ্দ পুরুষ ধরে অভিজাতদের হাতে শোষিত হয়েও তাদের প্রতি বিস্ময় মাখা শ্রদ্ধার উত্তাধিকার। অথবা নিজেদের উপর পুরো ভরসাটা রাখতে না পারা। আরো কি মারাত্মক বোকামি! ধনিক অর্লিয়ন্সবাদীদের হাতে নিজেরাই তুলে দিলে ক্ষমতার মূল ঘাঁটি। সেনাবাহিনী আর পুলিশ আর শ্রমিক বা খেটে খাওয়া মানুষদের হাতে পড়লো যত বক্তৃতা দেবার দপ্তরগুলো। অভিজাতরা ত’ তলে তলে ভয়ানক সেয়ানা। বিসমার্কের সৈন্যবাহিনী ধেয়ে আসছে ফ্রান্সের রাজধানী বরাবর। শহরের অসংখ্য ক্ষুধার্ত, সাধারণ নর-নারীকে তারা বুঝ দিচ্ছে খুব শক্তভাবেই শত্রুর সাথে লড়া হবে। কিন্ত, মোটেই অভিজাতরা আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নেয় নি। প্রজাতন্ত্রী সরকারের শ্রমিকদের সাথে মিলে-মিশে থাকার চেয়ে তারা ভিনদেশী বুর্জোয়া, জার্মান জেনারেলদের দাসত্ব করাটা শ্রেয়তর জ্ঞান করেছিল। নগররক্ষার কাজে শহরতলির দুই লক্ষ নিম্ন আয়ের মানুষকে কাজে না লাগিয়ে উল্টো কর্তৃপক্ষ তাদের নিয়ে এলো শহরের ভেতরে। সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ জার্মান সৈন্য পৌঁছে গেল রাজধানীতেই। শুরু হলো প্যারি অবরোধ। অভিজাত ফরাসী সরকার লোক দেখানো দু’একটা মেকি ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ খেললেও সে ত’ মেকি খেলাই। তু্যঁলো আর স্ত্রাসবুর্গের ততদিনে পতন হয়েছে। প্যারির কুড়িটা মহল্লার শ্রমিকদের পক্ষ থেকে তোমরা তখন মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের জন্য প্যারির মেয়র জুল ফেরির কাছে দাবি তুলছো। বলছো, এক্ষুণি কমিউনের নির্বাচন দিতে হবে, প্যারিকে রক্ষার ভার প্যারির মানুষের উপরই ছেড়ে দিতে হবে। অভিজাতরা কি সেই দাবি শোনে? ৩১ শে অক্টোবরের সকালে এলো সেই ভয়ানক দুঃসংবাদ। প্যারির উত্তর-পূর্ব দিকের গ্রাম ‘বুরজেৎ’ জার্মানীর অধিকারে চলে গেছে। সে যেন ছিল তোমাদের যৌবনের প্রতি নিদারুণ বিদ্রুপ, সহসা বজ্রপাত, তাই না ইউজিন? প্যারিতে সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই বৃষ্টির ভেতরেই তোমরা টাউন হলের ভেতরে ঢুকে সরকারের অভিজাত সদস্যদের বন্দী করে ফেললে। কিন্ত রাত তিনটা নাগাদ...ঘণ্টা বারোর ভেতরেই বুর্জোয়াদের একটা ব্যাটালিয়ন জনতার হাতে বন্দী মন্ত্রীদের মুক্ত করে ফেললো। আর জনতার হাত থেকে মুক্তি পেয়েই অভিজাতরা জানালো তারা তোমাদের মানে শ্রমিকদের কোন দাবিই পূরণ করবে না।
জার্মানদের অবরোধে হু হু করে বাড়তে থাকলো ক্ষুধা। দেখতে দেখতে ঘোড়ার মাংসও দুর্লভ হয়ে উঠলো। খাবারের অভাবে কুকুর, বেড়াল, ইঁদুরের মাংসও খাওয়া শুরু হলো। দেখা দিল মেয়েদের অনাহার ভাতার বিরাট বিরাট লাইন। মায়েদের শুকনো বুকে বাচ্চারা মরে পড়ে রইতে লাগলো। ফরাসীপক্ষের অভিজাত জেনারেল ত্রশ্যু যুদ্ধের ভান করতেই লাগলেন। এসব যুদ্ধে শ্রমিক সৈন্যরা না পেল কম্বল, না তাঁবু কি নিদেনপক্ষে একটি এ্যাম্বুলেন্স। লাশ আর কঙ্কালের শহর হয়ে উঠলো প্যারি, তাই না ইউজিন?
জানুয়ারির ছয় তারিখ নাগাদ তোমরা, পারির শ্রমিকেরা, ‘লাল প্ল্যাকার্ডে’ সরকারের অবসান ও কমিউনের দাবী জানালে। শ্রমিক নেতা ফ্লুঁরাসকে গ্রেপ্তার করলো অভিজাত সরকার। শ্রমিক বস্তিগুলোয় অভিজাত সরকারের নাম হলো ‘একদল জুডাস।’ জুডাস কি সেই বিশ্বাসঘাতক নয় যে স্বয়ং যিশুকে ধরিয়ে দিয়েছিল? ফ্লুঁরাস সহ অন্য শ্রমিক নেতাদের অবশ্য দ্রুতই জেল থেকে ছাড়াতে পারলো শ্রমিকেরা। তারপর? এলো ২ শে জানুয়ারীর ভয়াল সন্ধ্যা। সরকারের পেটিবুর্জোয়া বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে ১২জন শ্রমিককে গ্রেপ্তারের পর ১২ জন গ্রেপ্তার হলো, খুন হলো ত্রিশ জন। এর পরপরই গ্রেপ্তারের সংখ্যা আরো বাড়লো। ৮৩ জন গ্রেপ্তার হলো। সমাজতন্ত্রী সংবাদপত্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো। ২৮শে জানুয়ারী জার্মানীর কাছে প্যারির আত্মসমর্পন। বিসমার্কের শর্তমতে যদিও আট দিনের ভেতরেই জাতীয় পরিষদে নির্বাচন দিতে রাজি হলো অভিজাত ফরাসী সরকার, সেই নির্বাচনে ছিল মস্ত বড় ‘শুভঙ্করের ফাঁকি।’ নানা কলাকৌশলে ৭৫০-এর ভেতর ৪৫০-ই হলো রাজতন্ত্রী। বোর্দোতে প্রথম দিনের আইনসভা অধিবেশনেই গ্যারিবল্ডির মত সাধারণ মানুষের নেতারা বুঝলেন পদত্যাগ ছাড়া রাস্তা নেই। বড়লোকদের হাতেই সব সংবাদপত্র। শ্রমিক সৈন্যদের বাহিনী রক্ষীবাহিনীর ভাতা বন্ধ হলো, তাই না ইউজিন? শ্রমিকদের বকেয়া সব বাড়িভাড়া একবারেই আদায়ের কথাও শোনা গেল।
Il n'est pas de sauveurs suprêmes
Ni Dieu, ni César, ni tribun
Producteurs, sauvons-nous nous-mêmes
Décrétons le salut commun
Pour que le voleur rende gorge
Pour tirer l'esprit du cachot
Soufflons nous-mêmes notre forge
Battons le fer quand il est chaud
: C'est la lutte finale
Groupons-nous, et demain
L'Internationale
Sera le genre humain
(There are no supreme saviours
Neither God, nor Caesar, nor tribune.
Producers, let us save ourselves,
Decree the common salvation.
So that the thief expires,
So that the spirit be pulled from its prison,
Let us fan our forge ourselves
Strike the iron while it is hot.
: This is the final struggle
Let us group together, and tomorrow)
হ্যাঁ, এই গানের...অমরত্ব ও আশার এই গীতিকবিতা তুমিই রচনা করেছিলে, ইউজিন! যখন ২৫শে মার্চ সকালে গোটা প্যারি জেগে উঠেছিল ড্রামের শব্দে। শ্রমিকদের জাতীয় রক্ষীবাহিনী মার্চ করে এগোলো ফরাসী বিপ্লবের স্তম্ভের সামনে। ধীরে ধীরে গোটা প্যারি যেন ভেঙ্গে পড়লো সেখানে: ‘ভিভরে দো লা রিপাব্লিক! (প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক)!’ হাজার মানুষের ভেতর থেকে কে যেন একজন একটি লাল পতাকা নিয়ে এসে স্মারক স্তম্ভের উপর উঠে স্বাধীনতার প্রতিমূর্তির মাথায় উড়িয়ে দিল লাল পতাকা। হৈ চৈ করে চিৎকার করে উঠলো সবাই আনন্দে।
৩. ‘এই ফাঁসি ফাঁসি চাই-রাজাকারের ফাঁসি চাই!’
‘একটাই দাবি-ফাঁসি!’
‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা-মেঘনা-যমুনা!’
‘তোমার আমার ঠিকানা-শাহবাগের মোহনা!’
গত ৫তারিখ থেকেই বন্ধুরা তাকে সমানে টেক্সট মেসেজ করছিল শাহবাগে আসার জন্য। জাদুঘরের সামনে মানব-বন্ধন। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়ার প্রতিবাদ। বেয়াল্লিশ বছর পর খোদ মুক্তিযুদ্ধের সরকার কিনা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে এই বিচারের হাল? এক মিরপুরেই সাড়ে তিনশো মানুষ খুন করেছে এই কাদের মোল্লা একাত্তরে। হত্যা করেছে কবি মেহেরুন্নিসা সহ কত অসহায় নর-নারীকে! ধর্ষণ করেছিল মোমেনা নামে একজনকে। লোকে তাকে ডাকত ‘কসাই কাদের।’ তাকে যাবজ্জীবন দেওয়া মানে? সরকার কি জামাতে ইসলামীর সন্ত্রাস ও সহিংসার হুমকির কাছে আগাম নতি স্বীকার করে বসলো? মুস্কিল হলো কিছুদিন হয় দীপায়ণের ফেসবুক একাউন্ট তারই ভাইয়ের ছেলে কি একটা কায়দায় বন্ধ করে বিদেশ চলে গেছে। এটা সাধারণ ডি-এ্যাক্টিভেশন না। চাইলেই আবার এ্যাক্টিভেট করা যায় না। মজার ব্যপার হলো দীপায়নের অনুরোধেই এটা করা হয়েছিল। তাদের অফিস আগামী মাসে একটি আন্তর্জাতিক ওয়ার্কশপ করতে যাচ্ছে। ওয়ার্কশপের দু’টো পেপার লেখার দায় তার ঘাড়ে। ফেসবুক খোলা থাকলে এত বেশি সময় যায় যে কাজ হতে চায় না। এজন্যই ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছিল। অথচ শাহবাগে নাকি নানা কিছু ঘটছে। অফিসের চাপে কৌতুহল সত্ত্বেও গত তিন দিন সে শাহবাগ যেতে পারে নি। তবে পত্র-পত্রিকায় আসছে ছেলে-মেয়েগুলো নাকি বাড়ি ফেরে নি। অল্প যে কয়টা মানুষ হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে পাঁচ তারিখ শাহবাগ চত্বরে জমা হয়েছিল তারা নাকি আর ঘরে ফিরে যায় নি। বরং একটু একটু করে সংখ্যা বাড়ছেই তাদের। বলে কি? এদিকে বন্ধুদের ফোনে রীতিমতো রাগ-দুঃখ-অভিমান প্রকাশ পাচ্ছে।
‘বাপরে! আমাদের বোহেমিয়ান দীপায়ন কিনা এখন এত মন দিয়ে চাকরি করছে। এদিকে আমরা রাত জাইগা, গলা ভাইঙা, এক জামায় তিন রাত্রি পার করলাম! খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নাই, গোসল নাই...মেয়েরা পর্র্যন্ত দিন-রাত্রি শ্লোগান দিচ্ছে...এক কাপড়ে তিন রাত্রি থাকতেছে আর তুই...আচ্ছা, রাত্রিতে থাকার দরকার নাই। লেখার হাতটা আল্লায় দিছে...একটু আইসা দেইখা যাইয়া ফেসবুকে লেখলেও ত’ হয়!’
শুক্রবার সকালে তাই বাসা সেই মেরুল বাড্ডা থেকে স্নান-খাওয়া সেরে, বের হয়ে শহরের এদিকটা আসতে আসতেই দুপুর একটা বেজে গেল? একি শাহবাগের মোড়েই কেন তাকে থামিয়ে দিল স্কুটার? হেঁটে যেতে হবে? এত মানুষ হয়েছে নাকি? আরে, ভিড় ত’ গিজগিজ করছে! কি মুস্কিল! এখন মধ্যদুপুর। ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাদুঘরের সামনে আসতে আসতেই সে দ্যাখে চারপাশে শুধু মানুষের মাথা। চতুর্দিক থেকে এই ব্যস্ত মহাসড়কের সব ক’টি পয়েন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিশাল একটি লাল সবুজ পতাকা পত্পত্ করে উড়ছে। আর একপাশে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছবি। বিপুল ভিড় পিঁপড়ার মত সাবধানে পায়ে এগোতে এগোতেই মাইক্রোফোনে মেয়েদের গলায় শ্লোগান, ‘রাজাকারের আস্তানা- ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও!’ ‘ক-তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার! তুই রাজাকার! ন-তে নিজামি, তুই রাজাকার! তুই রাজাকার! ম-তে মুজাহিদ, তুই রাজাকার! তুই রাজাকার! গ-তে গোলাম আজম! তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!’ আর একটু পরপরই হাজার হাজার মানুষ মিলে আকাশে গলা তুলছে, ‘জয় বাংলা!’ বলে কি? এ কি ১৯৭১ সাল নিয়ে নির্মিতব্য কোন সিনেমার শ্যুটিং? হ্যাঁ, শ্যুটিংয়ে এত স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের অংশগ্রহণ থাকলে কথা ছিল না।
‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা-মেঘনা-যমুনা!’
আরে, এই শ্লোগান ত’ শুধু ইতিহাস বইয়ের পাতায় পড়েছে সে এতদিন? সেই শ্লোগান আবার ফিরে এলো? সমবেত সবার সাথে দীপায়নও গলা মেলায়, ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা-মেঘনা-যমুনা!’ ‘জয় বাংলা! জয় বাংলা!’
৪. ২৬শে ফেব্রুয়ারি ভার্সেইয়ে বিসমার্কের সাথে ফ্রান্সের সন্ধিচুক্তিতে একগাদা শর্ত দেওয়া হয়েছিল, তাই না ইউজিন? প্রথম শর্ত আট দিনের মধ্যে ফ্রান্সে জাতীয় সভার নির্বাচন শেষ করতে হবে, ১৫ দিনের মধ্যে বিসমার্ককে ২০০ কোটি ফ্রাঁ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, প্যারির বেশির ভাগ দুর্গ জার্মানীর হাতে ছেড়ে দিতে হবে এবং ফরাসী সামরিক বাহিনীর সব ক’টি কামান গোলা-বারুদ জার্মানদের কাছে দিতে হবে। উপরের লোক দেখানো চুক্তির আড়ালে অভিজাতরা কিন্তু ঠিকই গোপনে বিদেশী জার্মানদের সাথে হাত মেলালো দেশের শ্রমিক শ্রেণীকে শায়েস্তা করতে। অভিজাতরা একটা লোক দেখানো সাধারণ নির্বাচন করলো বটে; কিন্ত কমিউনিস্ট নেতারা সবাই ছিল শ্রমিক নেতা। শ্রমিক বস্তির বাইরে কেউই তাদের চেনে না। রাজধানীতে প্রজাতন্ত্রী গ্যারিবল্ডি, গ্যামবোঁ, ফেলিক্স প্যাট, তোঁলা আর মাঁলো জিতে গেলেন। আহা, লাল পতাকার এক গুচ্ছ পপি ফুল নাম যেন! কিন্তু প্যারির বাইরে প্রদেশগুলোতে হাজার ক্ষুধা-বঞ্চনাতেও সাধারণ মানুষ ঈশ্বরের নামে, চার্চ আর পাদ্রিদের নামে মন্ত্রমুগ্ধ। তাদের বোঝানো হলো যে কমিউনিস্ট মানেই ঈশ্বর বিদ্বেষী আর নাস্তিক। প্রদেশগুলোতে তাই জিতল প্রতিক্রিয়াশীলরাই। গ্রামে ভূমিদাসকে শোষণ করে যে জমিদার, সেই জমিদারকেই দেবতার কাছাকাছি কিছু ভেবে ভোট দিল চাষীরা। বোর্দোতে সংসদের প্রথম দিনের অধিবেশনেই সব দেখে হতাশ হয়ে গেলেন গ্যারিবল্ডি। ভাবলেন পদত্যাগ করবেন। ওমা, পদত্যাগের কথা ঘোষণা করতেই রক্ষণশীলরা বিদ্রুপের চিৎকারে তাকে থামিয়ে দিল। অধিবেশনের পর তোমরা সবাই...মনে আছে ইউজিন...কেমন হাতে ফুল আর লাল পতাকা নিয়ে ছুটে গেছিলে গ্যারিবল্ডিকে উল্লসিত অভিবাদন জানাতে? কিন্ত তার মাঝেই এলো সেই খারাপ খবর। বোর্দো থেকে খবর এলো যে শ্রমিকদের গড়া জাতীয় রক্ষীবাহিনী নিরস্ত্র করা হবে, জাতীয় রক্ষীবাহিনীর ভাতা আদায় করা হবে আর শ্রমিকদের বকেয়া বাড়ি ভাড়া আর বিলগুলো সব একবারেই আদায় করা হবে। ফেব্রুয়ারির ২৬ তারিখ জার্মানদের প্যারিতে কুচকাওয়াজ করে ঢোকার কথা। কিন্ত ২৫ তারিখ সকালেই গোটা প্যারি ড্রামের শব্দে জেগে উঠলো। শ্রমিকদের গড়া জাতীয় রক্ষীবাহিনী মার্চ করে চললো ফরাসী বিপ্লবের স্মারকস্তম্ভের সামনে। সবাই শ্লোগান দিচ্ছে- ‘প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক!’ একজন উড়িয়ে দিল লাল পতাকা।
পরের দিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টির মত মানুষের ঢল নেমেছিল, মনে কি পড়ে ইউজিন? সবাই মিলে স্বাধীনতার স্মারকস্তম্ভের দিকে ছুটছে। সাধারণ শ্রমিক আর সমাজতন্ত্রীদের সাথে সেদিন যে পুলিশ আর সামরিক বাহিনীর লোকেরাও ছুটছিল। ছুটছে নারীরাও। গৃহবধূরা আজ সবার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসছে, বাসা থেকে রুটি নিয়ে আসছে। সিন-রাইন-ভোলগা...ইউরোপের সব নদীর মিলিত স্রোতের চেয়েও দুস্তর সে জনতরঙ্গে তুমি কি গিটার বাজাও নি ইউজিন?
L'État comprime et la loi triche
L'impôt saigne le malheureux
Nul devoir ne s'impose au riche
Le droit du pauvre est un mot creux
C'est assez, languir en tutelle
L'égalité veut d'autres lois
Pas de droits sans devoirs dit-elle
Égaux, pas de devoirs sans droits
: C'est la lutte finale
Groupons-nous, et demain
L'Internationale
Sera le genre humain
(The State oppresses and the law cheats.
Tax bleeds the unfortunate.
No duty is imposed on the rich;
The rights of the poor is an empty phrase.
Enough languishing in custody!
Equality wants other laws:
No rights without duties, she says,
Equally, no duties without rights.
|: This is the final struggle
Let us group together, and tomorrow
The Internationale
Will be the human race).
৫. অফিসের কাজে এখন মন বসে না দীপায়নের। আগে সে আট ঘণ্টা লাগিয়ে যে কাজ অফিসে করতো, এখন তা’ এক ঘণ্টায় ঝড়ের বেগে করে রাতদিনই পড়ে থাকে ফেসবুকে। বিকাল না হতেই দৌড় দেয় শাহবাগের দিকে। প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে হাজার হাজার মানুষের ভিড় শাহবাগে। তাদের সাথে মিলে সে-ও সমানে শ্লোগান দেয়। কোন কোন রাতে বিশেষত: বৃহষ্পতিবার ও শুক্রবার রাতে সে শাহবাগেই থাকে। আন্দোলনরত ছেলে-মেয়েদের সাথে বিনিদ্র রাত শ্লোগানে-গানে পার করে। কখনো বারো টাকার পরোটা ডিম, কখনো বন রুটি-কলা-চা খেয়ে দিব্যি কাটে তার। ভোরের দিকে গান হয় ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল!’ কেমন যেন এক অদ্ভুত ঘোরের সময় কাটছে তার। প্রেমে পড়ার চেয়েও স্বর্গীয় অনুভূতির এক ঘোর। শরীর মন সব কেমন হাল্কা লাগে!
তার বাড়িতে পাশের ইউনিটে এক জামাতি সহ-ভাড়াটিয়া আছে। ফেসবুকে একদিকে সানি লিওনির পেজে লাইক দেয়, অন্যদিকে গোলাম আজম আর সাঈদির সমর্থক।
‘শাহবাগে নাকি অবাধ গাঁজা আর ড্রাগস চলে? সেক্সও নাকি চলে? হি হি হি? আপনি ওখানে যান নাকি? থাকেন নাকি? শোনেন, দীপায়ন বাবু...হাজার হোক বাংলাদেশ একটা ইসলামী দেশ। এটার একটা মূল্যবোধ আছে, বোঝেন না?’ কখনো কখনো দেলোয়ার জাহান সাঈদির কথা তোলে সে। বলে, ‘একাত্তর সালে কতই বা বয়স ছিল তার? এই সাঈদি কি সেই সাঈদি? কার দোষ কার ঘাড়ে চাপাচ্ছেন আপনারা?’ লোকটি ‘বাঁশের কেল্লা’ পেজের অনুরাগী। পড়ে ‘আমার দেশ” আর দ্যাখে ‘দিগন্ত টেলিভিশন।’ এদিকে দীপায়নের অফিসের ইমরোজও খুব অদ্ভুত সব কথা বলে, ‘আপনারা মধ্যবিত্তরা না হয় দশ টাকা দিয়ে প্রথম আলো বা সমকাল পড়েন। নিম্ন মধ্যবিত্ত রাস্তার হকার যে পাঁচ টাকায় আমার দেশ পায়, তার কাছে ত’ আমার দেশ-ই যাবে।’ ইমরোজ কট্টর বাম।
স্ত্রী তপতী বলে, ‘শোন, তুমি ঐ কাওসার সাহেবের সাথে অত কথা বলো না তো! আমার কেমন ভয় ভয় করে!’
তপতীর কিছুদিন আগে একটা মিসক্যারেজ হয়েছে। এখনো রক্তাল্পতা আর দূর্বলতায় ভুগছে সে। সে চায় দীপায়ন আরো বেশি বেশি সময় তার সাথে কাটাক। দু’এক বিকেলে তপতী নিজেও আগ্রহ ভরে দীপায়নের সাথে শাহবাগ গেছে। একদিন আন্দোলনরত ছেলে-মেয়েদের জন্য এক হাঁড়ি পোলাও আর এক বক্স পায়েসও রান্না করে নিয়ে গেছে। কত মানুষ কত কি নিয়ে আসছে। এক রিক্সাঅলা এলো একদিন পঞ্চাশটা রুটি নিয়ে। তার বয়স যখন ছয় বছর, তার বাপকে নাকি ধরে নিয়ে গেছিল আল-বদররা। পদ্মার পারে জনা বিশেক মানুষকে চোখে কালো কাপড় বেঁধে এক সাথে ব্রাশ ফায়ার করেছিল পাঞ্জাবিরা। আর তার বাপ ফেরে নি। কপালে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে সেই রিক্সাঅলা বলেছিল, ‘আম্মা বাঁইচা থাকলে দেইখা যাইতে পারত তার স্বামীরে কেউ ভোলে নাই। তার স্বামীর বিচার চাইবারে আবার লক্ষ মানুষ জড়ো হইছে। ভাল থাইকেন বাবা! আল্লাহ আপনাদের ভাল করুক।’ আর একদিন দীপায়ন দেখতে পেল সুদূর সিরাজগঞ্জের এক কৃষক ঢাকার হাটে সব্জি বিক্রি করতে এসে সাথে নিয়ে এসেছে খেজুরের রসে ভিজানো এক গামলা পিঠা। শাহবাগের ছেলে-মেয়েদের খাওয়াবে। তপতী শুরুতে কয়েকদিন দীপায়নের সব আনন্দ-উচ্ছাসে তাল দিয়ে পরে দূর্বল শরীরের কারণেই একটু ক্লান্ত আর বিরক্ত হয়ে পড়েছে। আপাতত সে বাপের বাড়ি গেছে। তপতীর শ্বশুর মেয়েকে নিতে এসে বললেন, ‘শোন বাবা- আমাদের হিন্দুদের এত লাফিয়েও লাভ নেই! খোদ শেখ সাহেবই শত্রু সম্পত্তি আইন ঠিক করলেন না। তবু আছি এই দেশে! এই দলটা ক্ষমতায় থাকলে তা-ও একরকম চলা যায়! দিন রাত্রি শাহবাগ শাহবাগ না করে চাকরি, সংসার এগুলো দেখাই একটা বয়সের পর সব পুরুষের কর্তব্য!’
এসব কথায় দীপায়নের হাল্কা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। চট্টগ্রামের যে জগৎ বল্লভ পাড়া গ্রামে তাদের বাড়ি সেখানে সাকা চৌধুরীর লোকরা ব্রাশ ফায়ার করে যে অসংখ্য নিরীহ হিন্দু পুরুষকে হত্যা করেছিল ১৯৭১-এ, দীপায়নের আপন জ্যাঠা ও কাকা সেই গণহত্যায় মৃত। একা বাবা কোনমতে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। এছাড়া দীপায়নের দুই মাসীকে জোর করে রাজাকাররা তুলে নিয়ে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করেছে। তাঁরা আর কোনদিনই স্বসমাজে ফিরতে পারেন নি। ছোটবেলায় দাদুর বাসায় গেলে মাঝে মাঝে দেখতেন সন্ধ্যার দিকে দুই বোরখা পরা মহিলা মাঝে মাঝে আসতো। মামা-মামীরা খুব ব্যজার হতো তখন। দাদু আর দিদিমা কাঁদতেন। অনেক পরে দীপায়ন জেনেছিল তারা দুই মুসলমান হয়ে যাওয়া মাসী।