ভাতের থালা নিয়ে তাড়াতাড়ি টিভির সামনে বসে পড়ে ফারহানা। টক-শো চলছে। শ্লোগানকন্যা লাকি আখতার বক্তব্য দিচ্ছে। কিন্ত এর ভেতরেই শাহবাগ থেকে টিভি ফুটেজ শুরু হলো। মঞ্চে দাঁড়ানো ইমরান এইচ সরকার, ব্লগার আরিফ জেবতিক, এস এ অরণ্য, বাপ্পাদিত্য বসু আর শ্লোগান কন্যা অনিন্দ্য সাহা তুলতুল। তুলতুল কাঁদছে, ‘আমরা ত’ সাধারণ মানুষ...আমরা রাজিবের মৃত্যুর পর ঠিক করছি এখানেই থেকে যাব। আমরা এই শাহবাগ, এই প্রাণের প্রজন্ম চত্বর ছেড়ে যাব না!’
১০. কমিউন প্রতিষ্ঠার পরপরই প্যারিতে শ্রমিকদের বকেয়া বাড়ি ভাড়া আর বিলগুলো মকুব করা হঢেছিল। নোটারী, উকিল, মোক্তার, রেজিস্ট্রার সবার শোষণ আর দূর্ভোগ থেকে মানুষ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। চোর, গুণ্ডা, বদমাশ, পুরোহিত, গণিকা থেকে শেষমেশ হয়তো মুক্তি পাবে এই প্রাণের শহর, তেমনি ত’ ভেবেছিলে ইউজিন? ‘যাকেই চুরি করতে দেখা যাবে, তাকেই গুলি করা হবে’...কমিউনের এই একটি মাত্র বিবৃতিতে থেমে গেল চুরি। গণিকাবৃত্তি বন্ধের দাবি উঠলো। মহল্লায় মহল্লায় সাধারণ মানুষ বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল আবার খুলে দিল, তাড়িয়ে দিল পাদ্রিদের, মেয়েরা নিল ডাক হরকরা বা চিঠি বিলি করার কাজ। বুর্জোয়াদের মুখোশও খুলে গেছিল। জার্মানদের হাতে দেশ তুলে দেবার বিদেশী ষড়যন্ত্র, চার্চে ফাদার আর নানদের লাম্পট্য গোপন থাকে নি। ৬ই এপ্রিল তোমরা গিলোটিন পোড়ালে, মনে পড়ে ইউজিন?
...তবু বিপ্লবের পিছু পিছু পায়ে পায়ে নিঃশব্দে হেঁটে আসে যে প্রতিবিপ্লব ক্ষুধার্ত ডাইনির মতো, সে সহসাই পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপ্লবের কাঁধে ছুরি বসায়। বাঘনখে বিদ্ধ করে তার হৃৎপিণ্ড। তাই কি হয় নি? মার্চের ২২ তারিখেই অভিজাতদের কিছু দাঙ্গাবাজ গায়ে পড়ে হামলা করলো কমিউনের লড়াকু শ্রমিকদের সাথে। শ্রমিকরা আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করতেই ওরা ছুরি, পিস্তল, লাঠি রেখে পালালো। কমিউনের সেনাপতি লুলিয়ার লোকটিকে তোমাদের যে ভাল লাগত না, সেটা ত’ ঠিকই ছিল ইউজিন! অভিজাতরা তাড়াতাড়িই যে আবার দখল করে নিল দুর্গ মঁ-ভালেবিঁ। ব্যর্থতার শাস্তিতে বহিষ্কৃত হবার সাথে সাথে কমিউনের পিছু নিল সে। ভার্সেই থেকে আসা অভিজাতদের শেষ বাহিনীর পক্ষে কাজ করলো লুলিয়ার। হায়, শ্রমিক নারীরা পর্যন্ত লড়াইয়ে এগিয়ে এলো। নিজেদের দরিদ্র, নিরন্ন বস্তি রক্ষায় পুরুষের পাশাপাশি তারাও কামান চালালো। গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লো রাস্তায়। নিকোলা আর জাঁকের স্ত্রী, প্রেয়সিরা খুন হলো রাস্তায়। মৃত স্বামীর শবদেহের পিছু হাঁটতে হাঁটতে শিশু সন্তানের কাণে শ্রমিক মেয়েরা শ্লোগান দিয়েছে, ‘ভিভা পারি কমিউন!’ তবু ভার্সেইয়ের সেই বিপুল সৈন্যবাহিনীর সাথে শেষরক্ষা হলো কি? শ্রমিক নেতা ফ্লুঁরাসকে পেছন থেকে খুন করলো বুর্জোয়া সেনাপতি দেসার্ত, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের হাত থেকে যার জীবন বাঁচিয়েছিল ফ্লুঁরাসই। ফ্লুঁরাসের মৃতদেহ টুকরো করার দৃশ্য ভার্সেইয়ের গোলাপ বাগানে উপভোগ করলো বুর্জোয়াদের স্ত্রী ও রক্ষিতারা। ৬ই এপ্রিল শহীদ শ্রমিকদের শবযাত্রায় কফিনের পিছু পিছু দুই লাখ শ্রমিকের শবযাত্রার ঢল...শুধু পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না কমিউনের...ভার্সেই সৈন্যরা এপ্রিলের ৭ তারিখ দখল করে নিল নিউলি-তে সিন নদীর ঘাট। মে মাসের শেষ নাগাদ জার্মানরা বন্দী ফরাসী সৈন্যদের ছাড়ার পর বুর্জোয়াদের শক্তি আরো বাড়লো। ফরাসী বুর্জোয়াদের সাথে হাত মেলালো জার্মান বাহিনীও...আটটা দিন...আট/আটটা দিন সে কি খাণ্ডবদাহন! লোশেজের কবরখানা ভরে উঠলো নর-নারী-শিশু-বৃদ্ধের লাশের স্তুপে। ত্রিশ হাজার মানুষ হত্যার পর শুরু হলো পাইকারি গ্রেপ্তার। লড়াইয়ের শেষ দুই দিনে হেরে যাবে বুঝে শ্রমিকেরা নিজের হাতে নিজের প্যারি প্রিয়তমার দেহে জ্বালালো আগুন। বুর্জোয়া ভার্সেই যেন পায় নিছকই এক অগ্নিদগ্ধ শহর। তিন দিন ধরে দাউ দাউ করে জ্বললো আগুনের লকলক শিখা।
Mais si les corbeaux, les vautours
Un de ces matins disparaissent
Le soleil brillera toujours.
: C'est la lutte finale
Groupons-nous, et demain
L'Internationale
Sera le genre humain :
(Workers, peasants, we are
The great party of labourers.
The earth belongs only to men;
The idle will go to reside elsewhere.
How much of our flesh have they consumed?
But if these ravens, these vultures
Disappeared one of these days,
The sun will shine forever.
|: This is the final struggle
Let us group together, and tomorrow
The Internationale
Will be the human race).
১১. বাহাত্তর দিন। মাত্র বাহাত্তর দিনের প্যারি কমিউন। এর পরপরই বুর্জোয়া সরকারের তাড়ায় তোমাকে পালাতে হলো স্বদেশ ছেড়ে। স্বয়ং কার্ল মার্ক্স কমিটি গঠন করলেন কমিউনের তাড়া খাওয়া নেতাদের আশ্রয় দেবার জন্য শরণার্থী তালিকা প্রস্তুত করতে।
... ... Nikto ne dast nam izbavlenya:
Ni bog, ni tsar i ne geroy!
Dobyomsya my osvobozhdenya
Svoyeyu sobstvennoy rukoy.
(No one will grant us deliverance,
Not god, nor tsar, nor hero.
We will win our liberation,
With our very own hands.)
রুশীরা তোমার গানের ‘সিজার’ শব্দটি বদলে করলো ‘জার’... ইউজিন! অক্টোবর বিপ্লবের আগে ১৯০৫-এর যে ব্যর্থ বিদ্রোহে...ব্যর্থ প্রেমের মতই...খোদ ভ্লাদিমির উলিয়ানভের আপন ভাই ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন, সেবার বিদ্রোহের শুরুটা হয়েছিল চারজন শ্রমিকের কারখানা থেকে চাকরি চলে যাওয়ার ঘটনায়। পাদ্রি গিপন লোকটা ছিল আসলে জারের চর। ধর্মপ্রাণ, অর্থোডক্স খ্রিষ্টান শ্রমিকদের সে বোঝাতে পারল জারের কাছে দরখাস্ত দিয়ে, কেঁদে-কেটে হত্যে দিলেই গরীবি থেকে মুক্তি মিলবে। সত্যিই, লক্ষ লক্ষ মজুর তাদের বউ-বাচ্চা নিয়ে শীত প্রাসাদের দিকে। দিনটা ছিল রবিবার। প্রার্থনার দিন। রুশী খ্রিষ্টানরা বরাবর ধর্মভক্ত। সাথে জারের ছবি আর গির্জার পতাকা নিয়ে সরল মানুষগুলো ধর্মীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে পথ চলছিলো। তখনি জারের সৈন্যরা ছোটালো গুলি...হাজার খানেক মানুষ ঐ দিনই মারা গেল...আহত হয়ে পঙ্গু হলো হাজার দুয়েক।
Chtob svergnut' gn'ot rukoy umyeloy,
Otvoyevat' svoyo dobro, –
Vzduvaitye gorn i kuitye
(To throw down oppression with a skilled hand,
To take back what is ours –
Fire up the furnace and hammer boldly,
while the iron is still hot!)
‘কাজি কোথায় হে? কাজি?’
‘আরে কমরেড মোজাফফর যে! আপনি নিজেই চলে এলেন? তার থেকে আপনি ডাকলেই ত’ আমি যেতে পারতাম!’
‘একটা বিশেষ কাজের অনুরোধ নিয়ে এসেছি যে? করা যায়?’
‘আপনার আদেশ কবে অমান্য করেছি?’
‘তাহলে সেকেণ্ড কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের গানটি কি অনুবাদ করা যাবে? পৃথিবীর নানা দেশেই বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হলেও বাংলায় যে করা হয় নি! আর এ কাজটা তোমাকে দিয়েই সবচেয়ে ভাল হবে বিদ্রোহী!’
‘ওয়েট কমরেড!’
ঝাঁকড়া চুলের কাজি তখনি বসে পড়লেন হার্মোনিয়ামের সামনে।
‘সুরটা কিন্তু ঐ পশ্চিমা ধাঁচের সুরটাই রাখতে হবে। বাংলা-ভারতের কীর্তন-গজল-শ্যামা সঙ্গীত-পদাবলীতে হবে না। কেমন? তবে লিরিকস বাংলায়!
কাজি হাসেন। এক খিলি পান মুখে পুরে হার্মোনিয়ামের রিডে হাত বোলান।
‘আমি উঠি। কাজের মনঃসংযোগে ব্যঘাত ঘটাবো না।’
মুচকি হেসে কাজি একটি কাগজে হাতে লেখা ইংরেজি গানের লিরিকসটা দেখতে থাকেন।
Chtob svergnut' gn'ot rukoy umyeloy,
Otvoyevat' svoyo dobro, –
Vzduvaitye gorn i kuitye
(To throw down oppression with a skilled hand,
To take back what is ours –
Fire up the furnace and hammer boldly,
while the iron is still hot!)
কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের এই সুরটা বিলক্ষণ জানেন নজরুল। মাথার অবাধ্য চুলে আঙুল চিরুনি চালাতে চালাতে সুরটা গুনগুন করতে থাকেন:
‘জাগো জাগো, জাগো সর্বহারা!
অনশন বন্দী ক্রীতদাস
শ্রমিক দিয়াছে আজি সাড়া
উঠিয়াছে মুক্তির আশ্বাস।
সনাতন জীর্ণ কুআচার
চূর্ণ করি জাগো জনগণ
ঘুচাও এ দৈন্য হাহাকার
জীবন মরণ করি পণ।
গাও ইন্টারন্যাশনাল
মিলাবে মানবজাত।’
Stand up, damned of the Earth
Stand up, prisoners of starvation
Reason thunders in its volcano
This is the eruption of the end
১২. অতীশের সাথে ফর্ম্যাল ডিভোর্স লেটার সই হবার পর মায়ের বাড়ি এসে উঠেছে ফারহানা। রুটিন মাফিক কলেজে পড়াতে যায়। মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে শাহবাগ যায়। সাঈদির রায়ের পর দাঙ্গা, রাজিব-দ্বীপ-জগতজ্যোতিদের মৃত্যু, আস্তিক-নাস্তিক প্রশ্নে শাহবাগের ভাগ হওয়া, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি-জামাতের জয়, দেশ জুড়ে একাত্তরের মত বা তারও চেয়ে বেশি সংখ্যায় কয়েক হাজার হিন্দু মন্দির ভাঙা, হাজার হাজার গাছ কাটা, গত তিন মাস ধরে জামাত-বিএনপির টানা হরতাল, শয়ে শয়ে মানুষের পুড়ে মরা...এমন দেশ কখনো দ্যাখে নি সে! মা’র মন গতকাল থেকে খুব খারাপ। কাদের মোল্লার ফাঁসি হতেও গিয়ে হলো না। শেষমুহূর্তে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনারের চিঠি ফাঁসির রায় উল্টে দিল।
‘ক্ষমা আমি শেখের বেটিকেও করব না। আমার কুমারী ছোট ননদটাকে...তোরে এতদিন কই নাই ফারহানা...এই কাদের মোল্লার লোকরাই তুইলা নিয়া গেছিলো। আমরা ত’ তখন মিরপুর থাকতাম! তার ফাঁসি যদি না হয়, তোর আব্বার আত্মা শান্তি পাবে না!’
মা’র কথা শুনতে শুনতেই কোলে ল্যাপটপ রেখে ফেসবুকে চোখ রাখে ফারহানা। দীপায়নের পোস্ট মাত্রই ভেসে উঠলো।
কাশফুল মেঘদলঃ জগৎ বল্ল পাড়ার গণহত্যা
কুন্তেশ্বরী ঔষধালয়ের মালিক নূতন চন্দ্র সিংহের রক্ত গত বেয়াল্লিশ বছরে তোমরা অনেকটাই মুছে ফেলেছো হে আশ্চর্য কাশফুল মেঘদল! জগৎ বল্ল পাড়ার গণহত্যায় নিহত হিন্দু নর-নারীর রক্তও মুছে গেছে তোমাদের শুভ্র দেহ থেকে। আজো সেই জগৎ বল্ল পাড়ার পুরুষেরা খুনীর ফাঁসির নির্দেশে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় জঙ্গলে... সাদা মেঘ...তোমার দেহে পুড়ে যাওয়া মন্দিরের ছাই আমরা সার্ফ এক্সেলে ধুয়ে ফেলব আর ধুয়ে ফেলব নূতন চন্দ্র সিংহের রক্ত...
দীপায়নের দুই কাকা আর জ্যাঠা মারা গেছিলেন জগৎ বল্ল পাড়ায় গণহত্যায়। আরো একটা কথা জানায় না দীপায়ন লজ্জায়। কিন্তু দীপায়নের এক দূর আত্মীয়ের সাথে ভাগ্যক্রমে পরিচয়ের সুবাদে জেনেছে ফারহানা। দীপায়নের দুই মাসীকে জোর করে রাজাকাররা তুলে নিয়ে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করেছে। চট্টগ্রাম, ঢাকা, দিনাজপুর, খুলনা...কত কত কঙ্কাল আর করোটি খুঁজবে তুমি? তোমরা? হে প্রজন্ম? আরো কত ধর্ষিতার লাশ? আর কত সম্ভ্রমহানি ও গর্ভপাতের গল্প শুনলে জাতিসঙ্ঘ সহৃদয় হবে? এডিথের যে কাকা চার্চের ফাদার আর বিয়ে করেন নি...তাঁর মাধ্যমেই বহু বাঙালি, কুমারী অন্তসত্ত্বার যুদ্ধশিশুরা বিদেশে চলে গেছে বিদেশী বাবা-মা’র আশ্রয়ে।
‘ভাবিস না আপু, আজ ফাঁসি হবেই!’
ফারহানার ছোট ভাই সান্ত্বনা দেয়।
‘একটাই দাবি- ফাঁসি!’
‘ফাঁসি হয়েছে আপু- ফাঁসি হয়েছে!’
ছোট ভাই চিৎকার করে। ফারহানা মাত্রই ওয়াশ রুম থেকে বের হয়েছে।
‘ফাঁসি? হয়েছে? প্রজন্ম চত্বর যাবি?’
‘চল্ আপা- চল্’
মা উঠে দাঁড়ান। ডাইনিং রুমের দেয়ালে ঝোলানো ছোট ননদের সাদা-কালো ছবির দিকে তাকান। চোখে গাঢ় কাজল দেওয়া, দুই বেণী করা একটি মেয়ে আলাভোলা হাসছে।
‘হেনা- তোর বড় ভাই দেখছে! খুব কষ্ট ছিল লোকটার! জীবনেও ভোলে নাই তোর এই অপমান, এই অকাল মরণ!’
‘মা...এখন থেকে আমাদের বলতে দাও...বলতে দাও যে ছোট ফুপু ক্যান্সারে মরে নাই। একাত্তরে যুদ্ধের সময় রেপ হইয়া মরছে। বলতে দিবা, মা?’
‘বল্ পাগলী...বল্!’
তিরিশ লক্ষ প্রাণের শপথ, জনতা করে না ভুল
জনতার দাবি ফাঁসির মঞ্চ, নড়বে না এক চুল।
তিরিশ লক্ষ প্রাণও জেনে নিও মিছিলের পিছে আছে
শাহবাগ আজ দেশে নয় শুধু, হৃদয়ে ছড়িয়ে গেছে।
জনতার স্রোতে নেশা লেগে যায় স্বপ্নমাখা ঘোর,
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মিলে প্রজন্ম চত্বর।