('চলো, আমরা যবন ধর্ম গ্রহণ করি শ্যামাঙ্গ! এ ধর্ম ত্যাগ করলে আমরা যে মৃত্তিকা থেকে বিচ্যুত হব')
কথাসাহিত্যে রচনা কর্মের আঙ্গিক নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক হতে দেখা যায়। চোদ্দ শতকে স্পেনে সার্ভেন্তেসের রচিত ‘দন কিহোতে’ কি উপন্যাসের সূচনা বিন্দু? অনেকেই যেতে চান আরো অতীতে। ভারতের মহাভারত, পঞ্চতন্ত্র, জাতক কাহিনী বা কথাসরিৎসাগর, আরবের আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা, গ্রিসের ঈশপ’স টেলস, ইতালীর ‘দেকামেরন’ প্রভৃতি প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যিক ট্র্যাডিশনে অনেক সমালোচকই আধুনিক গল্প ও উপন্যাসের বীজ সণাক্ত করেন। আঠারো-উনিশ শতকীয় রুশ বাস্তববাদী ঘরানায় কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে দীর্ঘ পরিশ্রম এবং বলতে গেলে গবেষণা সাপেক্ষে (বাংলা উপন্যাসে তারাশঙ্করের এমন কাজ আছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে, দেবেশ রায়ের উপন্যাসগুলোও অনেকটা সেই ধাঁচের) একটি নির্দিষ্ট স্থান বা ভৌগোলিক পরিসর, একটি নির্দিষ্ট সময় এবং সেই সময় ও পরিসরে নানা পাত্র-পাত্রীর বিচিত্র আচরণ-কর্ম-স্বপ্ন-বাসনা-হতাশার প্রায় দালিলিক বিবরণ ‘গ্র্যাণ্ড নভেল’ হিসেবে প্রায়ই প্রশংসিত হয়ে থাকে। উনিশ শতকীয় রুশী ঘরানায় তলস্তয়ের এমন ধাঁচের সর্বাধিক কাজ রয়েছে। ইংরেজি উপন্যাসে চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসগুলোও এই ঘরানার। ফরাসী ঔপন্যাসিক বালজাক বা গুস্তাভ ফ্লবেয়ারও এই ‘রিয়েলিস্ট’ ঘরানার উপন্যাসই লিখেছেন। অথচ তলস্তয়ের কিছুটা আগের সময়ের হলেও রচনাশৈলীতে আরো পরবর্তী সময়ের বলে মনে হয় সেই দস্তয়েভস্কির লেখা রিয়েলিস্ট হয়েও খুব রিয়েলিস্ট নয়। তাঁর পাত্র-পাত্রীরা কখনো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা সংলাপ (ব্রাদার্স কারামাজভ্স-এ যেমন) আবার কখনো টানা মনোলগের জগতে (ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টে রাস্কলনিকফ যেমন) আচ্ছন্ন থাকে। উনিশ শতকের গ্র্যাণ্ড ন্যারেটিভের শেষে বিশ শতকের প্রথমার্দ্ধে ইংরেজি ভাষায় ফকনারের রচনায় স্যুরিয়ালিস্ট রচনাশৈলীর নিরীক্ষা পেল পাঠক। পাশাপাশি ছিল হেমিংওয়ের রিয়েলিস্ট, সরল গদ্যে লেখা মিতায়তণ সব উপন্যাস। ১৯৩০-এর দশকেই পূর্ব ইউরোপের প্রাগ নগরীর এক ক্ষীণকায়-অসুস্থ-অবিবাহিত-ইহুদি যুবক ফ্রাঞ্জ কাফকা বিশ শতকের উপন্যাস বদলে দিলেন যখন গ্রেগর সামসার পোকাতূল্য জীবন বোঝাতে সত্যিই তাকে পোকা করে দিলেন তিনি কলমের অদ্ভুত এক আঁচড়ে। আমেরিকা না গিয়েও লিখলেন ‘আমেরিকা।’ কী অপরাধ করেছে না জেনেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মরতে মরতে তাঁর নায়ক জোসেফ কে. বললেন, ‘কুকুরের মতো!’
‘হুতোম প্যাঁচার নকশা,’ ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বা ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ ইত্যাদি আদিপর্বের উপন্যাসের পর বাংলা উপন্যাসের যৌবন শুরু হয়েছিল বঙ্কিম চন্দ্রের হাতে। শরৎ চন্দ্রের বিপুল জনপ্রিয় সব আখ্যানের পর বিশ শতকের শুরু থেকেই ‘তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ে’র হাতে বাংলা উপন্যাস ত্রিবিধ মাত্রা পাওয়া শুরু করে। তারাশঙ্করের আখ্যানে রাঢ়-বীরভূম অঞ্চলের স্থানিক কাহিনীগুলো মহাকাব্যিকতা অর্জন করে। মাণিক আসেন তাঁর ভয়াবহ তীক্ষè ও নির্মেদ গদ্যের তলোয়ার নিয়ে...ভিখু-কুবের-কপিলা-শশী-কুসুম-হেরম্ব-চারু-পরীদের অদ্ভুত মনোবিকারের জগতে! পাশাপাশি বিভূতি ভূষণের অনন্য প্রকৃতিচর্যা ও জীবনবেদ আমাদের ভাবনার বিষয় হয়ে ওঠে! দেশভাগের পর বাংলা সাহিত্যের ভুগোল প্রধান দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব বাংলায় যে কথা সাহিত্যিকের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয় তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। ‘একটি তুলসী গাছের আত্মকাহিনী’ নামে গল্পেই পাঠক তাঁর জাত চিনতে পারে। একে একে পাঠক পায় তাঁর ‘লালসালু,’ ‘কাঁদো নদী কাঁদো, ‘চাঁদের অমাবশ্যা’ বা ‘কদর্য এশীয়’র মত সব উপন্যাস। শওকত ওসমান, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত প্রমুখ পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে এপার বাংলার কথাসাহিত্যের ভুবন পরিপুষ্ট করেছেন। এরপর সত্তর, আশির দশক হয়ে নব্বই ও শূণ্যের দশকেও অনেকেই এসেছেন এবং লিখছেন এই বাংলায়। রচনার আয়তনের কথা মাথায় রেখে এই নোটে আমি লেখক শওকত আলীর একটি মাত্র উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ নিয়েই আলাপ করব।
লেখক শওকত আলীর নিজেরই একাধিক উপন্যাস যেমন ‘উত্তরের খেপ,’ বা উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লেখা ট্রিলজি ‘দক্ষিণায়নের দিন’- ‘কুলায় কালস্রোত’ বা মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘দলিল’ কিম্বা তাঁর পরের দশকের লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’ বা ‘চিলেকোঠার সেপাই'য়ের মত ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ সমসাময়িক জীবন বা রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে লেখা ‘দালিলিক’ ঘরানার উপন্যাস নয়। এই উপন্যাস আয়তনেও খুব বিপুল নয়। মিতায়তণ এই আখ্যান আলো ফেলেছে কিছু অতীতে। কিছু অতীতে বলতে কয়েক শতাব্দী আগে। কোন্ সেই সময়? বাংলায় সেন বংশের শেষকাল। উচ্চবর্ণ বা উচ্চকোটির মানুষের হাতে নিপীড়িত-দলিত সমাজের নব্বই ভাগ অন্ত্যজ ও নারীর ঘোর দুঃসময় কাল। পাল রাজবংশের সময়ে বর্ণাশ্রমের দলিত যে অন্ত্যজ শ্রেণী বৌদ্ধ হয়েছিল, সেই বৌদ্ধরাও সেন আমলে দারুণ নির্যাতিত। এই ডোম-ডোমনী, শুঁড়ি-শুঁড়িনী, ধোপা-ধোপানী, মেছুনি...এরাই তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে, বজ্রযান আর সহজিয়া চর্যায় আশ্রয় নিয়েছিল মুক্তির আশায়। তাদের সবারই তীব্র তাড়নপর্ব চলছে সেন রাজ্যশাসনে। শ্যামাঙ্গ নামে এক মৃৎশিল্পী যুবককে ইতিহাসের এই প্রদোষকালের ফ্রেমে নায়ক হিসেবে এঁকেছেন শওকত আলী। শ্যামাঙ্গ আত্রেয়ি বা বর্তমান উত্তর বাংলার আত্রাই নদীর পাশ দিয়ে চৈত্রের এক খরতাপ দিনে আসার সময় ক্লান্ত হয়ে এক গৃহস্থ বাড়িতে আশ্রয় নেয়। গৃহস্থের কন্যা শ্যামাবতী প্রবাসী বণিক বসন্ত দাসের স্ত্রী। শ্যামাঙ্গকে সে ভাইয়ের মত যত্ন করে। শ্যামাবতীরই সখী লীলাবতী আবাল্য স্বামী পরিত্যক্তা একটি সুন্দরী মেয়ে। শ্যামাঙ্গ আগামীকাল সকালে যেপথে যাবে সেপথে লীলাবতীর শ্বশুরবাড়ি বলে শ্যামাবতী তার সখীর জন্য শ্বশুরবাড়ি ও যোগাযোগবিচ্ছিন্ন স্বামীর খোঁজ-খবর এনে দিতে শ্যামাঙ্গকে অনুরোধ করে।
ধীরে ধীরে নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে শ্যামাঙ্গ আর লীলাবতী পরষ্পর প্রণয়-সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। লীলাবতীর স্বামী কোন না কোন ঘোর সূক্ষ্ণ কারণে লীলাবতীকে ত্যাগ করেছে (সেই সময়টা হিন্দু নারী পতি বা শ্বশুরকুল থেকে ক্ষুদ্র-বৃহৎ, সূক্ষ্ণ-স্থূল লক্ষাধিক নানা কারণে যেমন প্রায়ই পরিত্যক্ত হত; অন্য কোথাও বিয়ে করারও আর উপায় থাকত না তার)। অনাথা লীলাবতীকে দেখার প্রায় কেউই নেই এই সংসারে। কিন্তু তাকে ভোগ করবার, তাকে অন্যায় উপদ্রব করার মানুষের অভাব নেই। ক্ষত্রিয়-রাজপুরুষ-সৈন্য-সামন্ত....কে নয়? অস্বাভাবিক নয় যে কোমল ও শিল্পী হৃদয়ের শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর এই কষ্টে তার পাশে দাঁড়াতে চাইবে, তাকে রক্ষার চেষ্টা করবে। কিন্তু শ্যামাঙ্গ আর লীলাবতী চাইলেই ত’ হবে না? কুলীশ কঠোর হিন্দু সমাজকেও যে চাইতে হবে! বল্লাল সেন-লক্ষণ সেনের এই সমাজে ডোমনীকে ভোগ করে, প্রাপ্য পারিশ্রমিক না দিয়ে এবং তাকে খুন করে অনায়াসে চলে যেতে পারে উচ্চ বর্ণের রাজপুরুষ। নারীকে গণিকা করার, সেবাদাসী করার শত সহস্র পথ! তাকে সম্মান জানানোর একটি রাস্তাও খোলা নেই! এই বাংলায় গৃহস্থের তখন ঘোর দুর্দিন। পথে পথে দস্যু আর ডাকাতদের আক্রমণ। পথে পথে লুণ্ঠন আর অরাজকতা। একটি রাষ্ট্রের নৈতিক শক্তি কতটা দুর্বল হলেই না মুষ্টিমেয় কিছু বহিরাগত সৈন্য জয় করে একটি গোটা দেশ ও জনপদ? চাপিয়ে দিতে পারে তাদের ধর্ম? এটা ত’ সেই সময়েরই গল্প। তেমনি প্রদোষকালে লীলাবতীকে রক্ষা করতে প্রেমিক শ্যামাঙ্গ তাকে নিয়ে ছুটছে নানা জায়গায়। এই খবর লীলাবতীর রাজ অমাত্য স্বামী জেনে গেছে। স্ত্রীকে জীবনেও ঘরে না নিলেও স্ত্রীর অন্য পুরুষের সাথে জীবন যাপন যে মানবে না। শ্যামাঙ্গ ও লীলাবতীকে তাই তাড়া করে ফিরছে রাজার সৈন্যরা। এমনি পালিয়ে চলার জীবনেও ওদের মানসিক প্রেম দৈহিক ঘনিষ্ঠতায় গড়ায়। অন্তসত্ত্বা হয় লীলাবতী। ততদিনে তূরকরা (তুর্কিরা) এদেশে এসেছে। সেন রাজত্বে নিপীড়িত বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা সভা করছে যে তারা ‘যবনদের’ স্বাগত জানাবে কি জানাবে না। যবনদের স্বাগত জানিয়েও প্রাণে বাঁচতে পারে না বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। লীলাবতী আরব থেকে আসা এক সুফী সাধকের কেন্দ্রে আশ্রয় ও চিকিৎসা পায়। পথঘাটের সর্বব্যপী নৈরাজ্য ও অরাজকতা থেকে বাঁচাতে লীলাবতীকে যবন সাধু পুরুষের আশ্রয় কেন্দ্রেই রেখেছিল শ্যামাঙ্গ। দিন কয়েক পরে তার খোঁজ নিতে এলে নিজের জীবন, প্রেমিক শ্যামাঙ্গ এবং অনাগত সন্তানের জীবন বাঁচাতে মরিয়া লীলাবতী বলে, ‘শ্যামাঙ্গ! চলো, আমরা যবন ধর্ম গ্রহণ করি!’ লীলাবতী আরো জানায়, ‘আমি ওদের মন্ত্রটা শিখেছি। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদার রসুলুল্লাহ! বলো ত’ ওদের মন্ত্রে ল অক্ষরটা এত বেশি কেন?’ বলে পুনরায় হাসিতে আর কৌতুকে লুটিয়ে পড়ে লীলাবতী। সে নতুন জীবনের আস্বাদ চাইছে।
শ্যামাঙ্গ হাহাকার করে। লীলাবতীকে বোঝাতে চায় যে পিতৃ পুরুষের ধর্মে যতই অন্যায় আর ভুল থাকুক সেই ধর্মই যে মৃত্তিকার ধর্ম।
‘এই ধর্ম আমাদের মৃত্তিকার ধর্ম লীলাবতী! এই ধর্ম পরিত্যাগ করলে আমরা আমাদের শেকড় থেকে বিচ্যুত হব!’
উত্তরে লীলাবতী জানায় সে এত বড় বড় কথা বুঝবে না। তাকে বাঁচতে হবে। সে ঘর-সংসার-সন্তান চায়! হতাশ শ্যামাঙ্গ মেনে নেয়। বলে যে সে শুধু একবার বাইরে থেকে পথ-ঘাটের খোঁজ নিয়ে আবার ফিরবে। তারপরই গ্রহণ করবে নতুন ধর্ম। পথে বের হয়ে বাঁচতে পারে না শ্যামাঙ্গ। লীলাবতীর স্বামী এখন তূরকদের সহযোগী। শ্যামাঙ্গকে খুন করে তার বাহিনী। উপন্যাসের শেষে ঔপন্যাসিক জানান যে শ্যামাঙ্গকে বাঁচিয়ে রাখার কোন উপায়ই তাঁর ছিল না। ইতিহাসের সেই ঘোর প্রদোষকালে শ্যামাঙ্গর মত এক সংবেদী শিল্পীর মৃত্যুই ছিল একমাত্র পরিণতি। তবে শ্যামাঙ্গকে আজো খুঁজে পাওয়া যাবে উত্তর বাংলার নওগাঁয় পাহাড়পুর বা বগুড়ার মহাস্থানগড়েরর বৌদ্ধ বিহারের অজস্র মাটির রিলিফ, টেরাকোটা কাজ আর মৃৎ প্রতিমায়।
শওকত আলী যেকথা আর বলেন না কিন্তু আমরা জেনে যাই সেটা হল লীলাবতী নিশ্চিত ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তাঁর এবং শ্যামাঙ্গর সন্তানও নিশ্চিত মুসলিম হয়েছিল। নতুন ধর্মের আশ্রয়ে সে শ্যামাঙ্গর মৃত্যুর পর হয়তো আরো একটি বিয়ে করতে সক্ষম হয়েছিল। বঙ্কিম চন্দ্র যতই বলতে চান না কেন যে সতেরো জন অশ্বারোহী নিয়ে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের গল্প যে বাঙালী বিশ্বাস করে সে কাপুরুষ, শুধু ‘বর্বর তরবারি’র জোরে ইসলাম বাংলা বিজয় করেছে এই বাক্যেও প্রতীতী রাখা কঠিন। বর্ণাশ্রমের কঠোরতা, সমাজে নারীর শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থানের জায়গায় জাত-পাতহীন, নারীর জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনর্বিবাহের অধিকার দাতা ইসলাম সেই সময়ের প্রেক্ষিতে নির্ঘাৎ একটি ‘মুক্তিদাতা’ ধর্ম হিসেবেই দেখা দিয়েছিল। একথা মানতে বাংলার হিন্দু যতই কুণ্ঠা বোধ করুক, বুক তার পুড়ে গেলেও তথ্যটা মিথ্যা হয় না বা হবে না। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে সিন্ধুতে ইরাকি সেনাপতি বিন কাশিমের অভিযানের সময় রাজা দাহিরের হাতে দলিত জাঠরা শঙ্খধ্বনি দিয়ে বিদেশী সেনাপতিকে অভিবাদন করেছিলেন। হিন্দু ঐতিহাসিকরা এই তথ্য প্রাণপণে অস্বীকার করতে চাইলেও লাভ নেই!
তবে রিচার্ড ঈটনের ‘দ্য রাইজ অফ ইসলাম ইন বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার্স’ গ্রন্থে অবশ্য বর্ণাশ্রমই যে বাংলায় গণ ধর্মান্তরের কারণ সেটি অস্বীকার করা হয়েছে। যুক্তি হিসেবে তিনি বলেছেন যে তাহলে উত্তর প্রদেশ, বিহার বা মধ্য প্রদেশের মত রাজ্যগুলোয় যেখানে বর্ণাশ্রম ছিল আরো কঠোর, আরো সহিংস সেখানেই অধিকতর মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পারত। সেটি কেন হল না? কিন্তু এর পাল্টা হিসেবে ঈটন যে কারণ বলছেন সেটাও মানা কষ্টকর। ঈটন বলতে চাইছেন বাংলার একটি বিস্তীর্ণ অনাবাদী অরণ্য অঞ্চলের মানুষ ছিল মূলতঃ প্রকৃতি পূজারী। যেমন সুন্দরবনের বাঘ বা কুমির উপাসনা, সিলেটের অরণ্যে অরণ্যচারীদের আরো নানা প্রকৃতি উপাসনা। প্রথাগত হিন্দু বর্ণাশ্রমের ভেতর তারা ছিলই না। কোন সুনির্দিষ্ট, সংগঠিত ধর্মই ছিল না এই অরণ্যচারী বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষের। মোগল আমলে মোগল রাজপুরুষদের নির্দেশে (মূলতঃ দিল্লীর মোগল সম্রাটদের রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য) বাংলার চট্ট্রগ্রাম-খুলনা-সিলেট সহ নানা জায়গায় বিশাল অরণ্য সাফ করে যে আবাদ করা হচ্ছিল, সেই সব অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশ থেকে আসা সুফী সাধকরা। অরণ্যগুলোয় এই মেহনতের কাজের বদলে অরণ্যচারী বাঙালীকে খাবার ও মজুরি দেওয়া হত। বন সাফ করে এই আবাদি জমিগুলোয় বানানো হত মসজিদ। প্রায়-ধর্মহীন বাঙালী দলে দলে হলো ধর্মান্তরিত। সুন্দর যুক্তি। কিন্তু ভরসা হারাতে হয় যখন ঈটন লেখেন যে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা সুফী সাধকরা ‘বাঙালী’কে ধান চাষ শিখিয়েছেন...তখন এটা বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে বসে লেখা থিসিস বলে ভ্রম হয়। বাঙালী হাজার বছর আগে থেকে ধান চাষ, মাছ ধরা, নৌকা বানানো আর কাপড় বোনার কাজ পারে। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ তাকে কি করে ধান চাষ শেখাবে? তবে হতে পারে যে ‘বর্ণাশ্রমে’র কঠোরতা ছিল না বলেই উত্তর প্রদেশ বা বিহারের থেকে এখানের মানুষের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাটা সহজতর হয়েছে? সোজা বাংলায় এখানে ‘মারের উপর’ থাকলেও সাধারণ মানুষ ততটা ‘মারের উপর’ ছিল না? এত দিন পরে ইতিহাসের অত অত শতাব্দী আগের ঘটনা নিয়ে কিছু পরিষ্কার ভাবে বলা কঠিন। বলার চেষ্টাও অন্যায়।
তবে আর একটি বিষয় ভেবে দেখা উচিত সবার। অবিভক্ত বাংলায় সম্ভবতঃ ১৯০০ সালের জনগণনায় প্রথম দেখা যায় যে হিন্দুদের চেয়ে মুসলিমরা জনসংখ্যায় এগিয়ে। বর্ণাশ্রম ছাড়া আরো একটি বড় কারণ থাকতে পারে নারীর প্রতি বাঙালী হিন্দুর আচরণ। আমার এক প্রাক্তন ভারতীয় (বিহারি) হিন্দু উর্দ্ধতন কর্মকর্তা আমাকে কথায় কথায় একদিন বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালী হিন্দুকে পছন্দ করি না। এরা অবাঙালী হিন্দু ত’ বটেই, বাঙালী মুসলিমের থেকেও নির্ঘাৎ কথায় কথায় দশটা বইয়ের রেফারেন্স বেশি দিতে পারে। অনেক পড়–য়া। অনেক সাহিত্য-সংস্কৃতি বোঝে। অথচ আজো গয়া-কাশিতে গেলে যত বিধবা তার নব্বই ভাগ বাঙালী হিন্দু। সতীদাহে বাঙালী হিন্দু নারী যত পুড়েছে, সো-কল্ড কনসার্ভেটিভ রেস্ট অফ ইণ্ডিয়ায় অবাঙালী হিন্দু নারী তত পোড়ে নি।’ ঐ বিহারি কর্মকর্তা কোন অজানা কারণে আমার সাথে প্রচন্ড মন্দ ব্যবহার করলেও তার এই বক্তব্য ফেলে দেবার নয়। আইনের ছাত্রী হিসেবে এটুকু শুধু জানি উত্তর ভারতের মিতাক্ষরা হিন্দু আইনের তুলনায় বাংলায় প্রচলিত দায়ভাগা হিন্দু আইনে নারীর ছিটেফোঁটা মাত্র বেশি অধিকারও আখেরে বাঙালী হিন্দুকে নিজের মা-বোন-স্ত্রী-কন্যাকে জীবন্ত চিতায় ঠেলতে উৎসাহিত করেছে। গোটা বাংলা সাহিত্য ভরে আছে হিন্দু বিধবার চিতায় অন্তর্জলি যাত্রা, বিধবার একাকিত্ব, নিগ্রহ আর ভ্রূণহত্যার গল্পে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এ ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি প্রতিবেশি সম্প্রদায়ে একটি মেয়ে বৈধব্য বা স্বামী বিচ্ছেদের পর বারবার বিয়ে ও সন্তান ধারণের অধিকার পাচ্ছে। এই একটি কারণই কি একটি সম্প্রদায়কে জনসংখ্যায় শতাংশ হারে এগিয়ে দিতে যথেষ্ট নয়? এ দিকটা কেন গবেষকরা এত দিনেও ভেবে দেখেন নি সেটাই আশ্চর্যের। অভিজিৎ সেনের উপন্যাস ‘মৌসুমী বায়ুর উপকূলে’ গ্রন্থেও বাংলার বরিশাল-নোয়াখালি-চট্টগ্রাম অঞ্চলে মগ (বার্মিজ) বা পর্তুগীজ আক্রমণে ফ্রেফ মগের ছোঁয়ায় একজন নারীকে তার পরিবার শুদ্ধ জাতচ্যুত করা এবং এমন নানা কারণে গ্রামকে গ্রাম ইসলাম ধর্ম গ্রহণের (এমনকি উচ্চ বর্ণের হিন্দুরও ধর্মান্তরিত হবার) আখ্যান আমরা পাই।
যে বা যত সংখ্যক কারণেই অবিভক্ত বাংলায় ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা বেশি হয়ে থাকুক না কেন, জনমিতির এই সংখ্যাধিক্য বাংলা ভাগ ও দেশভাগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পলাশীর যুদ্ধের পর গোটা ভারত তথা বাংলার মুসলিম পিছিয়ে পড়েছিল আধুনিক শিক্ষায়। বাংলার বর্ণহিন্দু সারা ভারতেই শিক্ষা-দীক্ষায় নেতৃত্ব নিয়েছিল। এই অগ্রযাত্রায় কিছুটা নিজের বিকাশ নিয়ে চিন্তিত বাঙালী মুসলিম ভারতের মুসলিমের জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জিন্নাহর আবেদনে সাড়া দিয়েছিল। এরপরও বাংলায় বাঙালী হিন্দুর এই শোচনীয় দশা হত না যদি না দীর্ঘদিনের দলিত হিন্দুরা যোগেন মন্ডলের নেতৃত্বে পাকিস্থানের পক্ষে অপশন না দিত। বৃটিশ শাসকের নৃ-তাত্ত্বিক দস্তাবেজ অনুযায়ী বাংলার একমাত্র ‘মার্শাল রেস’ বা ‘সামরিক সম্প্রদায়’ নমঃশূদ্র জনগোষ্ঠি (আদিতে মরা পোড়ানো বা চন্ডাল পেশায় নিযুক্ত থাকলেও পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে কৃষিজীবী) বিশ শতকের শুরু থেকে আধুনিক শিক্ষার সংস্পর্শে আসতে থাকে। পাকিস্থান সৃষ্টির আগে বা পরে বাংলার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাগুলোয় অতি সুসংস্কৃত উচ্চবর্ণের হিন্দু ও তার মন্দিরকে মুসলিম আক্রমণ থেকে বারে বারে বাঁচানো ভয়ানক সাহসী ও আজন্ম কুশলী লাঠিয়াল নমঃশূদ্র জনগোষ্ঠি তাদের নিজেদের হিস্যা লাভেই কি পাকিস্তানে থেকে যাবার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয় (দ্রষ্টব্য: বরিশালের যোগেন মন্ডল, দেবেশ রায়)? পাকিস্তানী পুলিশ একাধিক দাঙ্গায় বুঝিয়ে দিয়েছে এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের পরিণাম (ফুটনোটে অতিরিক্ত সরলীকরণের ঝুঁকি নিয়েই বলা যায় যে শ্যামাঙ্গ আর লীলাবতীর সন্তানদের একটি অংশ হিন্দু বর্ণাশ্রমে ‘দলিত’ হিসেবেই রয়ে গেল; পিতৃ পুরুষের ধর্মে তারা দাঁত কামড়ে থেকে গেল সব গ্লানি আর অবমাননা নিঃশব্দে সহ্য করেই। আর একটি বিপুল অংশ আরবি-ফারসি নাম নিয়ে হয়ে গেল মুসলিম। যাহোক, পৃথিবীর বৃহত্তম দেশত্যাগ বা ‘হিউম্যান এক্সোডাসে’র বিনিময়ে (যার গোটাটারই বলি হয়েছে বাঙালী হিন্দু) বাংলা ভাগের পর নব পূর্ব পাকিস্থানে বাঙালী মুসলিমের শুরু হল কি নতুন লড়াই? যে লীলাবতী ‘যবন’ হলো আর তার সন্তানরাও হল ‘যবন’ নামধারী, কি হলো তাদের নতুন রাষ্ট্র পাকিস্থানে?
শ্যামাঙ্গ-লীলাবতীর যবন সন্তানদের রাষ্ট্র ‘পূর্ব পাকিস্থান’ থেকে ‘বাংলাদেশ’:
ওলন্দাজ গবেষক ভ্যান স্যান্দেল তাঁর ‘আ হিস্ট্রি অফ বাংলাদেশ’ গ্রন্থে ১৯৫২-এর একুশে ফেব্র“য়ারির ‘ভাষা আন্দোলন’ নিয়ে লেখা পরিচ্ছেদে বলছেন যে ১৯৪৮-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন উৎসবে জিন্নাহর বক্তৃতায় ‘উর্দু এন্ড ওনলি উর্দু উইল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অফ পাকিস্থান’ বক্তব্যের প্রতিবাদে পরবর্তী চার বছরের ভাষা সংগ্রামে ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক চেতনা যেমন ছিল, তেমনি ছিল উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে রাষ্ট্রীয় নানা চাকরি, শিক্ষাসহ বিবিধ অর্থকরী সুযোগ-সুবিধায় পিছিয়ে পড়ার মধ্যবিত্ত শ্রেণীগত আতঙ্ক। চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ সরকারের পরাজয়, পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধে ঢাকার অরক্ষিত অবস্থা এবং বাঙালী সৈন্যদের সাহসী ভূমিকার পরও উপযুক্ত স্বীকৃতি না পাওয়া, পাক সেনাবাহিনী-সরকারী চাকরি সহ নানা ক্ষেত্রে বাঙালীর প্রতি বৈষম্য তদানীন্তন পাকিস্থানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নির্ভর জাতীয়তাবাদী বিপুল আবেগ ও গণজোয়ারের সৃষ্টি করে। ছিলেন অসমসাহসী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২-৭৫ সাল পর্বে তাঁর সরকারের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কী করে অস্বীকার করা যাবে পাকিস্থান আমলে তাঁর সুদীর্ঘ কারাভোগ আর অমানুষিক তিতিক্ষা? সারাদিন কাজ করে আমাদের মত মানুষেরা অফিসে বসের কাছে দুই টাকা বেশি চাইতে ভয়-সঙ্কোচ-কুণ্ঠা বোধ করে। তিনি অবলীলায় তাঁর ছয় দফা দাবিতে একটি প্রদেশের জন্য পৃথক মুদ্রা চেয়েছেন। ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ইসলামী চেতনার পরিবর্তে বাঙালী মুসলিম ও তাঁর সাথে বাঙালী হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই লড়াই করেছিল নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। কিন্তু শ্যামাঙ্গ আর লীলাবতীর সন্তানদের যুদ্ধ এখানেই কি শেষ হয়ে গেল? কখনোই না। সেই ১২০০ শতক থেকে ১৯৭১...সাত শতাব্দীর ধর্মান্তরিত মানুষদের ভেতর অর্ন্তদ্বন্দ্বের কিছু প্রকাশ ত’ ১৯৭১-এ দেখা গেছে। গোলাম আজমদের মত মাস্টার মাইন্ডদের কথা বাদ দিই। গ্রাম দেশেও অনেক সাধারণ মানুষ ‘রাজাকার’ হয়েছেন। কারণ ‘ইসলাম’ ও ‘পাকিস্তান’ ততদিনে তার কাছে সমার্থক। প্রতিবেশী হিন্দু...যে আদি হিন্দুরই ধর্মান্তরিত সন্তান সে...সেই হিন্দুই আজ তার কাছে ‘মূর্তিপূজারী কাফের।’ প্রতিবেশী তথা পূর্ব পুরুষের উপাসনালয় ও বিগ্রহ আজ তার কাছে ‘শয়তানের স্থান।’ বিদ্যাধর নাঈপল একবার তেহরানে রোজার মাসে গিয়ে সারা শহর ঘুরে পিপাসার্ত অবস্থায় এক বোতল পানীয় জল না পেয়ে বিস্মিত হয়েছিলেন। ‘ধর্মান্তরিতদের ভুবন’ নামে বই লিখেছেন তিনি। পারস্য ছিল নিজের সভ্যতায় নিজেই সমৃদ্ধ। চির শত্র“ আরবের ধর্মে আজ সে কিকরে এতখানি বদলে গেল? এই একই বিস্ময় ছিল পারস্য জাতীয়তাবাদী নেতা কৌরুশ আয়েরেমানের। হ্যাঁ, ইরানী মুসলিম পরিবারেই জন্ম হয়েছিল তাঁর। বড় হবার সাথে সাথে পারস্য সভ্যতা নিয়ে গভীর পড়াশোনায় এক পর্যায়ে তিনি হতবাক হয়ে আবিষ্কার করেন যে বহিরাগত আরবরা তাদের খুন-ধর্ষণ-ক্রীতদাস বানানোর মত কাজ করেছে, সেই আরবের ধর্মই আজকের ইরাণ বহন করে চলেছে স্বগর্বে। ‘ইসলামী’ নাম পরিত্যাগ করে পুনারায় অগ্নি উপাসক সময়ের পারসিক নাম ‘কৌরুশ আয়েরেমান’ নাম ধারণ করেন তিনি। গড়ে তুলেছিলেন ‘ইসলাম না ইরাণ?’ নামের আন্দোলন। খোমেনীর গুপ্ত ঘাতক বাহিনী প্যারিসে তাঁকে হত্যা করে। ইসলামী বিপ্লবোত্তর ইরাণে আজো ঈদের থেকে ‘ঈদ-ই-নওরোজ’ বা ‘পারসিক নববর্ষ’ বেশি জনপ্রিয়। ইসলামী শাস্ত্রে পন্ডিত কবি ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’ পুরোটাই প্রাক-ইসলামী অগ্নিপূজারী বীর ও রাজাদের শৌর্যবীর্যের কাহিনী। পারস্য জাতীয়তাবাদকে পুষ্ট করতেই এই কাব্য লিখেছিলেন তিনি।
কৌরুশ আয়েরেমানের মত অত প্রবলভাবে না হলেও বাংলাদেশেও এই বিপুল ‘ধর্মান্তরিত’ জনগোষ্ঠির আত্ম-পরিচয়ের দ্বন্দ, নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে বহিরাগত ধর্মের দ্বন্দ্বই গত বেয়াল্লিশ বছরের রাজনৈতিক উত্থান-পতন, টানাপোড়েন আর মতাদর্শিক সঙ্ঘাতের উৎসস্থল হয়ে উঠেছে। ‘ধর্মান্তরিত’ এই বাঙালী মুসলিমের ভেতর থেকেই মোনায়েম খানের মত রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধকারী মানুষ তৈরি হয়েছে; তৈরি হয়েছে তমদ্দুন মজলিশ, নির্মিত হয়েছে আরবি হরফে বাংলা লেখার আন্দোলন। আবার এই আরবি-ফার্সি নামধারী বাঙালী মুসলিমের ভেতর থেকেই ওয়াহিদুল হক-সানজিদা খাতুনদের ‘ছায়ানট’ সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের লড়াই হিসেবে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে চলেছে গত প্রায় পাঁচটি দশক। এই বাঙালী মুসলিমই পা্কিস্তান রাষ্ট্র কাঠামো যুদ্ধ করে ফেলেছে। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালী হিন্দু উত্তর ভারতীয় ও হিন্দি ভাষার আধিপত্যবাদী শাসনের সাথে এমন পাল্টা লড়াই কেন লড়ে নি এটা ভাবার বিষয়। হয়তো পাকিস্থানে বাঙালী মুসলিমের যে জনসংখ্যাগত গরিষ্ঠতা ছিল, সেটা না থাকা একটা কারণ হতে পারে।
কিন্তু ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশ নামে রাষ্ট্র গঠনের পরেও শ্যামাঙ্গ-লীলাবতীর ধর্মান্তরিত সন্তানদের আত্ম-পরিচয়ের দ্বন্দ্ব ঘুচলো কি? ঘুচলো যে না তার প্রমাণ ১৯৭১-এর নয় মাসে অসংখ্য বাঙালী মুসলিম পরিবার যেমন অনেক বাঙালী হিন্দুকে আশ্রয় দিয়ে জীবনে বাঁচিয়েছে, অনেকেই প্রতিবেশীর সম্পত্তি লুট করেছে। দেলোয়ার হোসেন সাঈদিরা খুন-ধর্ষণ-লুট করেছে। আমার নিজের মা’ই যে প্রতিবেশিনীকে সরল বিশ্বাসে কিছু সোনার গহনা-তৈজসপত্র জিম্মায় দিয়ে বনগাঁ গেছিলেন, যুদ্ধের পর ফিরে এসে সেই প্রতিবেশীনীকেই বিশ্বাস করে আমানত হিসেবে দেওয়া গয়না পরে সগর্বে ঘুরতে-ফিরতে দেখে (যেন এটা তারই গহনা) লজ্জায় কিছু বলতে পারেন নি। আবার আমার বড় ভাইকে পঁচিশে মার্চের ক্র্যাক ডাউনের আগে বাঁচিয়েছেন বাবার মুসলিম বাল্যবন্ধু। এই আত্মদ্বন্দ্বের কারণেই একাত্তরে জাতি ধর্ম-নির্বিশেষে ‘এক দেহ এক প্রাণ’ হয়ে যুদ্ধ করা বাংলাদেশে বাহাত্তর সালেই দুর্গা প্রতিমার মাথা ভেঙ্গে গরুর কর্তিত মাথা স্থাপন করা হয়। পঁচাত্তরে জাতির জনকের হত্যার পর, তিন জাতীয় নেতা ও মুক্তিযুদ্ধ পন্থী সেনা অফিসার খালেদ মোশাররফের হত্যার পর দেশ হয়ে ওফে জিয়া-এরশাদ সহ একাধিক ধর্ম ব্যবসায়ী সেনা অফিসারের লীলাক্ষেত্র। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পরও আওয়ামিলীগ ভোট পেলে মসজিদগুলোয় উলুধ্বনি শোনা যাবে জাতীয় অপপ্রচারকে ক্যাশ করে খালেদা ক্ষমতায় আসেন। ১৯৯৬-এ হাসিনা, ২০০১-এ খালেদা, ২০০৮-এ আবার হাসিনা এবং বর্তমানে গত দুইমাস ধরে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে শাহবাগ আন্দোলন, জামাত-বিএনপি সহিংসতা, দাঙ্গা...এসবই কি শ্যামাঙ্গ-লীলাবতীর সন্তানদের আত্ম-পরিচয়ের দ্বন্দ্ব নয়? গণজাগরণ মঞ্চের নেতা ইমরান এইচ সরকার ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালী জাতীয়তাবাদকে আঁকড়ে ধরে ফেসবুকে ‘ফ্রেন্ডশিপ রিকোয়েস্ট’ গ্রহণের শর্ত হিসেবে জানান দেন যে তিনি আগে ‘বাঙালী’ ও পরে ‘মুসলিম।’
বাংলার ভূপ্রকৃতি আফগানিস্থান বা পাকিস্থানের মত মরু-মালভূমি প্রধান নয়। ভাষাও নয় পশতু-ফার্সি। লীলাবতী আর শ্যামাঙ্গদের ‘ধর্মান্তরিত’ সন্তানরা তাই যখনি ফুলের পাপড়িতে শহীদ মিনার বানায় (কারণ ‘পূজা’ বা ‘পুষ্পক্রীড়া’ তার শতাব্দী ব্যপী প্রজন্ম-ধমনীর রক্তে বাহিত), যখনি সে দীপ জ্বালায়, তারই অপর ভাই তাকেই কোপাতে আসে ‘ধর্ম গেল!’ বলে। এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, সমাজ-রাষ্ট্রের এই বিপুল দ্বিকোটিকরণ, এই আওয়ামি লীগ-বিএনপি সাত শতাব্দীর লিগ্যাসি। সুশীল পত্রিকা-এনজিও-জাতিসঙ্ঘ দুই নেত্রীর মুখোমুখি সংলাপে সাত শতাব্দীর লিগ্যাসি ঘুচাবে? হ্যাঁ, গত চারদশকের সৌদি টাকা আর মাদ্রাসা শিক্ষা আজ গ্রামে-গঞ্জে বাঙালী মুসলিম নারীর ‘ড্রেসকোড’ বদলে দিয়েছে। আমার কৈশোরেও এত বোরখা আর এত চাদর আমি দেখি নি। আবার বোরখা পরা নারীকে আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে দেখেছি। স্বামীর শাসনে বোরখা পরিহিতা নারীকে পহেলা ফাল্গুনে বাসন্তী রঙের বোরখা পরে চুলে ফুল গুঁজতে দেখেছি। সার্টিফিকেটের নাম ‘মাহবুব’ বা ‘শামিমা’ রাখলেও বাঙালী মুসলিম চায় বন্ধু-বান্ধবী বা প্রেমিক-প্রেমিকা তাকে ‘হিল্লোল’ বা ‘বৃষ্টি’ নামের ডাকনামে ডাকুক।
সাত কি আট শতাব্দীর যে লিগ্যাসি আজ ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-ময়মনসিংহ-বরিশালের রাস্তায় আগুন হয়ে জ্বলছে, সেই অগ্নি নির্বাপণের সদুত্তর আমাদের কারো কাছেই নেই। বাঙালীর প্রদোষকাল আজো শেষ হয় নি। শওকত আলী আমাদের সেই মহত্তম লেখকদের একজন যিনি শ্যামাঙ্গ ও লীলাবতীর এই সংলাপের ভেতর দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আত্ম-পরিচয়ের সঙ্কট তুলে ধরেছেন। এই বই দুই বাংলার বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলিম উভয়ের অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। বাঙালী মুসলিমের যে অংশ আজ এদেশকে আফগানিস্থান বানানোর স্বপ্নে দিশাহারা, তাকে পড়তে হবে আত্ম-পরিচয়ের প্রশ্নে। যে বাঙালী হিন্দু ওপারে গিয়ে সর্বভারতীয় আশ্রয়ে কোনমতে মাথা গুঁজে আত্মতৃপ্ত হয়ে ভাবছেন, ‘যাক, ওপারের মুসলিম গুন্ডাদের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছি’ তারও এই বই পাঠ জরুরি আত্ম-বিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধির জন্য। দু’জনকেই দু’জনের সঙ্কট-সমস্যা বুঝতে হবে। তবেই মিলতে পারবে শ্যামাঙ্গ আর লীলাবতীর ধর্মান্তরিত ও অ-ধর্মান্তরিত সন্তানরা। কারণ মা প্রকৃতি ত’ আমাদের চেহারায় এমন ছাপ দিয়েইছেন যা কিছুতেই মালা-দাড়ি, তিলক-টুপিতে ঢাকার যো নেই।