ওয়াক্কাস মীর
আমার জীবনের একটি হতাশার কারণ হল বেশির ভাগ লোকেই যেন বড্ড বেশি নাইভ। হ্যাঁ। আমার কথা পড়ে তো মনে হবেই যে আমি খুব অহংকারি, আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি খুবই চটে আছি। মালালা ইউসুফজাইএর উপর গুলি চালানোর ঘটনা নিয়ে তহ্রিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) যে জঘন্য ভুমিকায় নেমেছে সেটা তাদের পক্ষেও একটা চরম অবস্থান।
টিটিপি এটাই যে প্রথম শিশুদের উপর হামলা করল, তা তো নয়, ওরা শিশু সেনাদের মানব বোমা হিসেবে ব্যবহার করে, ছবি তোলে যখন এই অপ্রাপ্তবয়স্করা বন্দীদের মাথা কেটে ফেলে। ওরা স্কুল উড়িয়ে দেয়। এদের প্রতিনিধিরা শহরে আতঙ্ক ছড়ায় ও জেনেশুনেই শিশু সমেত নিরপরাধদের খুন করে। ওদের যুক্তিটাও সেই একই রকমের - ওরা আমাদের জীবন যাত্রাকে ঘৃণা করে ও চায় পাকিস্তানের বর্তমান অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দিতে। সুতরাং এই যে ইমরান খান সব আতঙ্কবাদী কাজের জন্য আমেরিকাকে ও তাদের ড্রোনকে দায়ী করে রাখেন এটাও এক অতিসরলীকৃত যুক্তি।
ড্রোন হামলার জন্যই যে টিটিপি হাতে অস্ত্র ধরেছে সেটা একেবারে মিথ্যা। ড্রোন নেহাৎই একটি অজুহাত। টিটিপি যে শান্তিকামী লশ্কর আর উপজাতির নেতাদের খুন করে চলেছে সেগুলির সাথে ড্রোন হামলার কোনো সম্পর্ক নেই - মালালার উপর আক্রমণেও নেই।
এই কথা আমি আগেও বলেছি এবং ভবিষ্যতেও বলব, যদি ড্রোন আক্রমণ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় তাহলেও টিটিপি তাদের এই হামলাবাজী বন্ধ করবে না। অতএব যারা দাবি করছেন যে আগে ড্রোনের হামলাকে নিন্দা করা হোক তারপরে টিটিপির সমালোচনা করা উচিৎ, কী আর বলব, সেটাকে নিছক একটি কিম্ভূত প্রলাপ ছাড়া আর কিছু বলতে পারছি না। এ ছাড়াও আরেকটা বিরাট তফাৎ আছে, সেটা হচ্ছে যুদ্ধপরিস্থিতিতে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও অসামরিক লোকের মৃত্যু আর পুরো পরিকল্পনা করে অসামরিক মানুষকে টার্গেট করে খুন করা। প্রথমটির উদাহরণ হচ্ছে ড্রোন আর দ্বিতীয়টির হচ্ছে টিটিপির হামলা। এটা তো আমেরিকার যুদ্ধ নয়। এটা আমাদের যুদ্ধ যখন দেখি একটি গোষ্ঠী বা দল চাইছে আমাদের রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে, চাইছে আমাদের সন্তানদের খুন করতে - তখন আমাদেরকেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। যারা ভেবে থাকেন একটি রাষ্ট্র কখনই কারুর প্রাণ নেবে না তাদের বোধহয় উচিৎ হবে চোখ আর কান ঢেকে বসে থাকা। এটা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ আর সেই যুদ্ধ আমাদেরই লড়তে হবে।
তো ইমরান খানের জগতে এই টিটিপি হচ্ছে একটি ভুল বোঝার শিকার একটি কিশোরের দল মাত্র। যেটা খান বোঝেন না যে এই ড্রোন বিরোধিতার ব্যাপারে খানের সমর্থনের কোনো দরকারই টিটিপির নেই। ধর্মের নামে এই হিংসা আসলে ক্ষমতার জন্য লড়াই। পুরো ইতিহাস জুড়ে এই ঘটনাপ্রবাহ ঘটে এসেছে আর কোনোদিনই ড্রোন থাকল কি না তাতে কিছু এসে যায় নি। ড্রোনে একটি আলাদা গল্প - যেটা টিটিপি চায় আমরা চাঁদমারি করি- কিন্তু তাদের নিজেদের এই নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই। টিটিপির সাথে বোঝাপড়ার চেষ্টা আগে কয়েকবার করা হয়েছিলো, আদৌ কোনো লাভ হয় নি। আর এর জন্য আমাদের শুধু SWAT অঞ্চলটিকে দেখলেই হবে। আর যারা ভাবছেন আলাপ আলোচনা করা দরকার তারা কী আশা করছেন রাষ্ট্রের কাছ থেকে? যারা ঐ টিটিপি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় থাকবে সেই মানুষদের কী হবে? আমরা আমাদের দায় দায়িত্ব সব ঝেড়ে ফেলে দেব? আর টিটিপিকে বলব যে তারা মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেবে বা প্রকাশ্য চকে চাবকাবে? আর তারা কি ভেবেছেন যে টিটিপি এর থেকে কম কিছু চাইবে?
আসলে খান ও তাঁর সমর্থকেরা যেটা বলতে চাইছেন যে কোনো দল যদি বেশ একটা বড়সড় সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে আর রাষ্ট্রকে আক্রমণ করে; আর মানুষদের খুন করতে শুরু করে তো তাদেরকে মারা চলবে না, বরং তাদের সাথে আলোচনায় বসতে হবে। এই যুক্তিটা চললে দুনিয়ার সব কটি সন্ত্রাসবাদী দলই খুশির পার্টি দেবে।এই টিটিপির লোকেরা সাধারন অপরাধী নয়, এরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে আর এদেরকে আমাদের সেই চোখেই দেখতে হবে।
বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছাপানো বেশ কয়েকটা লেখা আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে যেখানে প্রবন্ধকারেরা এই হিংসার জন্য ইসলাম ধর্মকেই দুষেছেন। বলেছেন ইসলাম ধর্ম কখনো শোধন করা হয় নি এবং টিটিপি তারই ফলাফল। আমি এই লেখকদের শ্রদ্ধা করি কিন্তু তাদের মতামতকে নয়। এটা ধর্মের ব্যাপার নয় - এটা পুরোটাই ক্ষমতা দখলের রাজনীতি। ধর্ম এখানে একটি অজুহাত মাত্র। যদি এই লোকগুলি নিরীশ্বরবাদী হতো তাহলেও এই হিংসার ঘটনা ঘটতো। এই সব হিংসার জন্য শুধু ধর্মকেই দায়ী করতে গিয়ে তারা ভুলে যাচ্ছেন যে মানুষকে নিজের দখলে আনতে হলে সব ইডিওলজিকেই হিংসার পথ ধরতে হয়েছে, অবশ্যই ধর্ম তার থেকে বাদ নেই। এটা শুধু কোনো ধর্মের দোষ নয়।নিশ্চয়ই এটা নিয়ে তর্ক ও আলোচনার সুযোগ রয়েছে কিন্তু শুধু ধর্মকে কাঠগড়ায় চাপালে মূল কারণটাকে আমরা বাদ দিয়ে ফেলব। বিশেষত; যখন আমাদের বোঝাতে হবে পাকিস্তানের আম জনতাকে যে এটা আমাদের এক যুদ্ধ। যেটা পরিষ্কার করে বলতে হবে যে টিটিপি যা করছে তা ধর্ম নয়, এটা ধর্মের বিকৃতি। আরো যেটা বোঝানো জরুরি যে টিটিপি এখন ধর্মকে ব্যবহার করছে, কেন না সেটা এখন তাদের পক্ষে সুবিধাজনক। যাঁরা ধর্মকেই হিংসার মূল বলে ভাবেন তাঁদেরকে অনুরোধ করব, তাঁরা যেন Noah Feldman আরেকবার ঝালিয়ে নেন। উনি দেখিয়েছেন এখনো পর্যন্ত সব থেকে বেশি সুইসাইড বম্বার ঘটেছে শ্রীলঙ্কার এলটিটিই আমলে - এবং তারা আদৌ কোনো ধর্মীয় দল ছিলেন না। ধর্ম এবং ড্রোন, এদের আলাদা আলাদা ব্যবহার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এদের সাথে টিটিপির অত্যাচারের কোনওই সম্পর্ক নেই। এদের সাথে আলোচনায় বসা মানে এদের এলাকার সন্ত্রস্ত মানুষদেরকে ত্যাগ করা। সেই যুক্তিই বহাল থাকছে - এই যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধ। ইতিমধ্যেই আমাদের চৌকাঠ ডিঙিয়ে এসেছে এই লড়াই- আর দেরি করা সম্ভব নয়।
অনুবা্দদ ঃ দীপ্তেন
অদিতি ফাল্গুনী
আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে সম্প্রতি আমাকে ই-মেইলে নিম্নোক্ত শিরোনাম সম্বলিত “তোমরা কি আমার নাম জানতে যদি আমি মার্কিনী বোমা (উড়োজাহাজ বা নৌপথে) হামলায় মারা যেতাম?” মালালা ইউসুফজাইয়ের যে ছবি রাহনুমা পাঠিয়েছেন তা’ আমাকে নতুন করে গোটা বিষয়টা নিয়ে ভাবাচ্ছে। মালালাকে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা মিডিয়া ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিসরে মানবাধিকার কর্মীদের শোক ও ক্ষোভ প্রকাশের পেছনে কতটুকু পাশ্চাত্য শ্বেত কূটনীতি, কতটুকু মধ্যপ্রাচ্যের তেল সম্পদের জন্য তালিবান তথা উগ্রপন্থী ইসলামী গোষ্ঠিগুলোর বিরুদ্ধে মালালার কথা তুলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বৈশ্বিক মিত্রদের ‘কুম্ভীরাশ্রু’ সেসব প্রশ্ন যুক্তিসঙ্গতভাবেই উত্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু তারপরও আপনার ই-মেইল আমার ভেতরের অস্বস্তি বা খটকা পুরোপুরি কাটাতে পারছে না। একটি কাঁটা কোথাও বিঁধে আছে যা সরানো যাচ্ছে না। কারণ মার্কিনী রাজনীতি, তেল নিয়ে পশ্চিমের লোভ এসব কিছুই কি সত্যিই এক নিরপরাধ কিশোরীর স্কুলে যেতে চাওয়ার জন্য গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে বৈধতা দিতে পারে? আজ পাকিস্তানের স্বাত উপত্যকায় তালিবানী শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যে ৫০,০০০ কিশোরীর স্কুলে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তালিবানী উগ্রপন্থীরা যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে কিশোরী মালালা, লিখেছে ব্লগে আর জানিয়েছে মেয়েদের শিক্ষার জন্য উদাত্ত আহ্বান ... তার গুলিবিদ্ধ হওয়াটা কি এত সহজেই ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা’র নামে ‘জায়েজ’ হতে পারে? হ্যাঁ, নিউ আমেরিকা ফাউন্ডেশনের দেওয়া তথ্য অনুসারেই ২০১২ পর্যন্ত ৩৩৪টি মার্কিনী ড্রোন আক্রমণে এপর্যন্ত ৩১৯১ জন মারা গেছেন। অন্য একটি সূত্র (ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিসম) বলছে সংখ্যাটির মধ্যে ১৭৬ জন শিশু/কিশোর ও ৪৭৪ থেকে ৮৮৪ জন সাধারণ মানুষ রয়েছে। মালালা এই ১৭৬ জন শিশু কিশোরের ভেতর পড়লে আমরা হয়তো তার নাম জানতাম না (সূ ত্রঃ গুরুচন্ডালি কলিকাল)। কিন্তু কথা হচ্ছে মালালা বা মালালার মত যে অসংখ্য কিশোরীর পৃথিবীর তালিবান শাসিত অঞ্চলগুলোয় কৈশোরে পা রাখতে না রাখতে পড়াশুনা বন্ধ রেখে পরিবারের পছন্দে অনেক সময় অনেক বয়স্ক পুরুষের কয়েকজন স্ত্রীর একজন হতে হয় (একক স্ত্রী হতে পারলে ভাগ্যই), কৈশোরেই ক্রমাগত গর্ভধারণ, রান্না-বান্না, গৃহ পরিচর্যা আর বড়জোর বোরখার নিচে থেকে নামাজ-রোজা ছাড়া আর কোন কিছু করারই কোন অধিকার বা সুযোগ থাকে না, সেই ‘জীবন’টাই বা কেমন ‘জীবন?’ কঠোর শরিয়া শাসিত পৃথিবীর সেই অঞ্চলগুলোয় একজন নারী কোন পুরুষ অভিভাবক ছাড়া কখনো কোথাও বের হতে পারে না, সন্তান সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের অধিকার নেই তথা অনিয়ন্ত্রিত এবং ঘন ঘন গর্ভধারণের মাধ্যমে বয়স না হতেই যৌবন ফুরিয়ে যাওয়া এবং স্বামীর তখন তরুণতর স্ত্রী গ্রহণ, শিক্ষা-দীক্ষা, বিনোদন, তথ্য-প্রযুক্তি সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরুষের জীবনভর নিষ্ক্রিয় যৌন সেবাদাসী হবার ও পরবর্তী প্রজন্মের তালিবান বা সশস্ত্র জঙ্গী উৎপাদনের জন্য ক্রমাগত গর্ভধারণের এই জীবন পার করার চেয়ে মৃত্যুও কি ভাল নয়? সম্ভবত অমন একটি জীবন চায়নি বলেই মালালা কথা বলেছিল। প্রতিবাদ করেছিল। নারীর জন্য কথা বলা, শিক্ষা সহ পাবলিক যে কোন পরিসরে সম অংশগ্রহণের সুযোগ চাওয়া সব সময়ই অপরাধ। জোয়ান অব আর্ককে ডাইনী হিসেবে পুড়তে হয়েছিল খ্রিষ্টানদের হাতে। খনার জিহ্বা কর্তিত হয়েছিল। আজ মালালার মাথায় গুলি লাগলে আমরা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কূট-কৌশলের অঙ্ক মিলাতে বসি!
আজ তাই যে ১৭৬ জন নিরপরাধ কিশোর কিশোরী পশ্চিমা ড্রোন অভিযানে মারা গেছে, তাদের সবার স্মৃতির প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানিয়েই বলছি পৃথিবীর ইতিহাসে বিভিন্ন সময়পর্বে, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে দেখা গেছে যে লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত মানুষের ভেতর একজনই হঠাৎ একটি সংগ্রাম বা আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে ২০০৪ সালে ‘র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন’ নামে যে এলিট পুলিশ ফোর্স গঠিত হয়েছে, বিগত বিএনপি সরকার যাদের সন্ত্রাস দমনের নামে সংবিধান বহির্ভূত বা বিচার বহির্ভূত ভাবে বেসামরিক নাগরিকদের যেকোন সময় তুলে নিয়ে ‘ক্রসফায়ার’ হত্যার ক্ষমতা দিয়েছে এবং তুলনামূলক ভাবে ‘লিবারেল’ আওয়ামি লীগ সরকারও ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর অদ্যাবধি র্যাবের বিলুপ্তির লক্ষ্যে কোন আইন প্রণয়নের চেষ্টা করেনি, সেই র্যাবের হাতে ২০০৪ থেকে অদ্যাবধি ৭০০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হলেও গত বছর যখন বিনা দোষে ষোল বছরের এক দরিদ্র কিশোর র্যাবের গুলিতে পঙ্গু হয়ে পা হারায়, বাংলাদেশের সব মানুষ ক্রসফায়ারে ঐ ৭০০ নিহত মানুষের নাম মনে না রেখে লিমনের নামে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ মুখর হয়েছে। লিমন হয়ে উঠেছে আমাদের দেশে বিচার-বহির্ভূত পুলিশী হত্যা ও নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক।
হ্যাঁ, আমরা জানি এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররাই আফগানিস্থানে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রী শাসন উচ্ছেদের জন্য দীর্ঘদিন ধরে তালিবান জঙ্গিদের অস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছে, সোভিয়েত শাসন উচ্ছেদে প্রাণান্ত করেছে। এবং সত্যিই আফগানিস্থান বা ইরাকে স্কুল থাকা না থাকায় মার্কিনীদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু এই আসা না আসার অজুহাত তুলে স্কুলে যেতে চাওয়া কিশোরীর মাথায় গুলি করার তালিবানী পন্থাও বৈধতা বা ন্যায্যতা পেতে পারে না। ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনায় কার্ল মার্ক্স একদিকে এই সাম্রাজ্যবাদ কী পরিমাণ ক্ষতি করবে গোটা ভারত উপমহাদেশের, কী অবিশ্বাস্য পরিমাণ সম্পদ লুন্ঠন করবে, ভেঙ্গে ফেলবে সহস্রাব্দের পুরণো গ্রামীণ উৎপাদন অবকাঠামো সেসব বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেও খুশি হয়েছেন এই আশাবাদে যে ব্রিটিশ উপনিবেশের ফলে শিল্প বিপ্লবের যে অভিঘাত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে হলেও আছড়ে পড়বে, হাজার বছরের যে অনড়-অচল-জড়-অক্ষয় হিন্দু সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামোর যে নিগড় ভেঙ্গে যাবে, তা’ একদিক থেকে আবার ভারতীয়দের শতাব্দীর নানা নিগড় থেকে মুক্তি দেবে। ভারতের গ্রাম ভিত্তিক যে সনাতনী উৎপাদিকা পদ্ধতি (তাঁতী ঘরে বসে তাঁত বুনছে বা দিনের শেষে কৃষক ক্ষেত থেকে ধানের আঁটি নিয়ে ফিরছে) মুসলিম শাসনের মুখেও বদলায় নি, ছোট ছোট গ্রাম ভিত্তিক মানুষের মোটামুটি নিরাপদ, উদ্ভিদসুলভ এবং ক্ষুদ্র গন্ডিবদ্ধ জীবনই প্রাচ্যের সব স্বৈরাচারকে চ্যালেঞ্জবিহীন কর্তৃত্ব করতে দিয়েছে। টিঁকিয়ে রেখেছে জাত-পাত। ধর্ম হয়ে উঠেছে এমনি প্রকৃতি পূজারী যে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ গরু বা হনুমানকে পুজো করেছে। ব্রিটিশের বাষ্পচালিত তাঁত কল আর ইঞ্জিন ভারতের ক্ষুদে তাঁতী আর কৃষকদের নিঃস্ব করে, ছোট ছোট গ্রামভিত্তিক স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনীতির ভিত্তি নড়িয়ে দিয়ে এশিয়ার একমাত্র সামাজিক বিপ্লবকে সম্ভব করে তুলবে বলে তিনি আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন। মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী খুব বিফলে যায়নি। বৃটিশ উপনিবেশের মন্দত্বের যেমন শেষ নেই, আবার তার ভাল দিকও কি কিছুই থাকেনি? সমাজের উপরি কাঠামোগত দিকের বদল হিসেবে দেখলে ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিঙ্কের উদ্যোগে সতীদাহ বিরোধী আইন পাশ থেকে শুরু করে রাজা রামমোহন রায় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরদের মত যুগান্তকারী সমাজ সংস্কারকদের আবির্ভাব, নারী শিক্ষার প্রসার, ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন তথা সমগ্র ভারত উপমহাদেশের মননগত পরিসরে যে বিপুল আন্দোলনের সূচনা হয়, তা’ উপনিবেশের সাথে সরাসরি সঙ্ঘর্ষ ও মিথষ্ক্রিয়ার ফলাফল। পরবর্তী সময়ে বাঙালি হিন্দু (বিশেষতঃ উচ্চ বর্ণের হিন্দু) সমাজের দেখাদেখি অ-বাঙালি ভারতীয় অন্যান্য সম্প্রদায় এবং বাঙালি মুসলিম সমাজেও কিছু পরিবর্তন ঘটে। তিরিশের দশকে ঢাকায় কাজি মোতাহার হোসেন, ‘শিখা’ গোষ্ঠির আন্দোলনের মুখপাত্র কাজি আব্দুল ওয়াদুদ বা বাঙালি মুসলিম নারী শিক্ষা ও জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন মুসলিম সমাজের নানা অচলায়তন ভাঙ্গার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন।
আজ পশ্চিমের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে একটি বিষয়ে আমাদের খুবই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা করতে গিয়ে আমরা যেন এমন কোন মধ্যযুগীয় ব্যবস্থার অনুমোদনের পক্ষে না দাঁড়াই যা দু’জন নারীর সাক্ষ্যের মূল্য একজন পুরুষের সাক্ষ্যের মূল্য হিসেবে বিবেচনা করে। যে ব্যবস্থা আজো একজন পুরুষের চারজন নারীকে একইসাথে বিয়ে করে ঘর করার অনুমোদন দেয়। যে ব্যবস্থায় চুরি করলে হাত কেটে ফেলা বা বিবাহ বহির্ভূত নর-নারীর শারীরীক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করার মধ্যযুগীয় ফতোয়া দেয়। যে ব্যবস্থার একশো ভাগ অনুসারীরা সিভিল আদালত না মেনে শরিয়া শাসন প্রবর্তন করতে চায়। যে ব্যবস্থা ‘গণতন্ত্রকে’ কুফরি বা কাফেরদের উদ্ভাবিত শাসন ব্যবস্থা বলে বাতিল করে, কোরান ব্যতীত অন্য ধর্মগ্রন্থের অনুসারীদের ‘অবিশ্বাসী’ বলে ঘোষণা করে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে কাফেরদের ‘জিজিয়া’ কর দিয়ে থাকার কথা বাতলে দেয়। যে মধ্যযুগীয় জীবন বিধানে কাফেরদের সাথে যুদ্ধে বিধর্মীদের নারীকে ‘গণিমতে মাল’ (ওয়্যার বুটি বা লুণ্ঠনের দ্রব্য হিসেবে) সৈন্যদের ভেতর ভাগ করে নেওয়াটা জায়েজ বলে স্বীকৃতি রয়েছে। এমনকি ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে তদানীন্তন পূর্ব বাংলা (আজকের বাংলাদেশ)-র মৌলানা বা আলেম শ্রেণী ফতোয়া দিয়েছিলেন যে শুধু বাঙালি হিন্দু নারীই নয়, মুক্তিযুদ্ধ/আওয়ামি লীগ/বামপন্থী মতাদর্শ বা পাকিস্তান বিরোধী মুসলিমদের নারীকেও ধর্ষণ করা জায়েজ। পাকিস্তানী সেনাদের হাতে ধর্ষিত হলে হিন্দু থেকে বিপুল সংখ্যায় ধর্মান্তরিত বাঙালি মুসলিমের ভেতর আজো যে প্রাচীন বিশ্বাস-সংস্কৃতি-লোকাচারের অবশিষ্ট রয়েছে, তা’ ধুয়ে মুছে ‘পাক মুসলিম’ বা সাচ্চা, পবিত্র মুসলিম প্রজন্ম জন্ম নেবে। বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে দুই লক্ষ বাঙালি নারীর গণধর্ষণের পেছনে এটাই ছিল তীব্র বাস্তবতা! যে ধর্ম একশ’ ভাগ মেনে চললে গান শোনা, ছবি আঁকা, ক্যামেরা-কম্পিউটার-ইন্টারনেট ব্যবহার করা, নারী-পুরুষ সহশিক্ষা বা একই জায়গায় কাজ করা ‘হারাম’ হয়ে যায়। ঈশ্বরকে বা অদৃষ্টকে ধন্যবাদ যে মানুষই সেই নিয়ত সৃজনশীল ও নিয়ত বিকাশমান প্রাণী যাকে কোন মনু, মোহাম্মদ, ভ্যাটিক্যান সিটির পোপ বা কোন রাজনৈতিক ভাবাদর্শই একশ’ ভাগ অনুশাসনের দাস করে তুলতে পারে নি। কাজেই এমনকি ইরান বা সৌদি আরবের মত দেশেও মেয়েরা বোরখা পরলেও হিজাব ঢাকা চেহারার ছবিও ক্যামেরায় তোলে, মসজিদে আজানে মাইক্রোফোন ব্যবহৃত হয়, ইসলাম ধর্ম প্রচারে জাকির নায়েকের আস্ত একটি টিভি চ্যানেল দরকার হয়। একশ’ ভাগ সহি বা সাচ্চা ইসলাম মানতে গেলে কিন্তু জাকির নায়েক টেলিভিশন দেখা বা ধর্ম প্রচারের কাজে ব্যবহার কোনটিই করতে পারেন না। যে ধর্ম নারীকে আপাদমস্তক বোরখায় মুড়ে রেখে তাকে শুধুই একজন পুরুষের চার স্ত্রীর একজন হবার ও যত বার গর্ভধারণ করা যায় ততবার গর্ভধারণ করার অনুমতি দেয়। ঠিক এইভাবে ও এই ভাষায় লিখতে গিয়ে আমি তীব্র বেদনা ও গ্লানি বোধ করছি এজন্য যে বাংলাদেশ নামের যে রাষ্ট্রে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা, সেখানকার অধিকাংশ মুসলিমই ত’ এমন কট্টর বা চরমপন্থী নন। আমাদের দেশে আজো শরিয়া আইন না, বৃটিশের প্রবর্তিত পেনাল কোড, সিভিল কোড প্রভৃতিই বহাল আছে। ১৯৮২-৯০ সাল অবধি স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে কত মুসলিম তরুণ রক্ত দিল! কত মুসলিম ছেলে মেয়ে সেখানে গান গায়, নাচে, ছবি আঁকে, সিনেমা-থিয়েটার করে, বামপন্থী ভাবাদর্শে আন্দোলিত হয়। বাংলাদেশে যেমন সাম্প্রদায়িকতা আছে, তেমনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি, পয়লা বৈশাখ, ছাব্বিশে মার্চ (স্বাধীনতা দিবস) বা ষোলই ডিসেম্বর (বিজয় দিবস)-এর মত বেশ কিছু অসাম্প্রদায়িক, সামাজিক উৎসবও আছে। বাংলাদেশ আফগানিস্থান বা পাকিস্তান নয় এবং তা’ যেন না হয় বা না হতে পারে সেই আকুলতা থেকেই এই লেখা! মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক সময়ে যে ‘র্যাডিক্যাল’ বা ‘পলিটিক্যাল’ ইসলামের উত্থান হয়েছে বা হচ্ছে তা’ শুধুই পেছনের দিকে যাত্রা। ফিলিস্তিনে মার্কিনী-ইসরায়েল অক্ষশক্তির দশকের পর দশক আগ্রাসন, আরব দুনিয়ার পেট্রোডলার নির্ভর ‘ভোগী অথচ ধার্মিক’ ও অগণতান্ত্রিক বাদশাহ গোষ্ঠির সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনন্ত প্রেম আজকের আরব তারুণ্যকে ক্ষুব্ধ করতেই পারে। এবং বিস্মিত হবার কিছু নেই যখন ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর ইসলাম ধর্মীয় পুনর্জাগরণই মধ্যপ্রাচ্য-পাকিস্তান-ইরান-আফগানিস্থানে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আদর্শিক শূন্যগহ্বরের স্থান দখল করে। কিন্তু এর সামগ্রিক ফলাফল কি আরব তথা সামগ্রিক মুসলিম বিশ্বের জন্যই কোন শুভ বার্তা দেয়? আজ ঢাকার শাহবাগে বসে আমাদের যে নারী বন্ধুরা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার জায়গা থেকেই মালালাকে নিয়ে বিশ্বব্যপী প্রচারে বিব্রত বোধ করছেন, এর পেছনে পশ্চিমের ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’র অঙ্কের হিসাব কষছেন, তাদের বিনয়ের সাথেই জানাতে চাই যে মালালার অবস্থা আর আপনার বা আমার অবস্থা এক নয়। এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হাজার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এখানে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে একজন নারী পিতার ন্যূনতম আর্থিক সঙ্গতি ও নিজের পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলে মোটামুটি স্বল্প ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়তে পারে, বোরখা না পরলেও চলে বা নগরাঞ্চলে চাইলে সে জিন্স পরেও ঘোরাফেরা করতে পারে, সরকারি-বেসরকারি যে কোন চাকরি করতে পারে (দিন দিন অবিবাহিত কিন্তু চাকরিরত, স্বাবলম্বী মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে), সামাজিক-সাংস্কৃতিক নানা কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং পুরুষ বন্ধুদের সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা বিষয়ে আলাপ-আড্ডা-বিতর্কে অংশ নিতে পারে, অনেকে ইচ্ছা করলে ধূমপানও করতে পারে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে পশ্চিমের সাথে আজ ‘ইসলামে’র (আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের সাথে) যে লড়াই হচ্ছে, তা’ মূলতঃ ‘ইহজাগতিকতা’ বা ‘বস্তুবাদ/সেক্যুলারিজমে’র সাথে ধর্মীয় গোঁড়ামির লড়াই। এই লড়াই ত’ পশ্চিম বা আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে খ্রিষ্টানরা নিজেদের ভেতর আরো কয়েক শতাব্দী আগেই লড়ে এসেছে। মধ্যযুগের যে ইউরোপে চার্চ লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ নারীকে ডাইনি বলে পুড়িয়েছে (যে কলঙ্কতিলক থেকে রক্ষা পাননি স্বয়ং ‘জোয়ান অব আর্ক’), চার্চের যে ইনকুইজিশনে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন গ্যালিলিও, ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ধর্মের সেই হাজার অনাচার থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে মার্টিন লুথার কিং প্রবর্তন করেছেন প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম। রেনেসাঁ যুগের কবি-শিল্পী-লেখকেরা খ্রিষ্ট ধর্মকেই আঁকড়ে না থেকে ফিরে গেছেন গ্রেকো-রোমানিক পৌত্তলিক ঐতিহ্যের কাছে। মেয়েরা অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, নারী শিক্ষা ও ভোটাধিকারের প্রশ্নে রাস্তায় নেমেছে। রেনেসাঁ যুগের কালোপাহাড়ি সব কাজ ছাড়া আজকের পশ্চিম তথা সমগ্র মানব সভ্যতার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এই বিস্ময়কর সব অর্জন কখনোই সম্ভব হত না। একই লড়াই হয়েছে চীনে ও জাপানে এবং কিছুটা হলেও ভারতে। ভারতে ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সময় হিন্দু কলেজের ছাত্ররা গরুর মাংসের হাড় কালিঘাট মন্দিরে ছুঁড়ে মেরেছেন। প্রবর্তিত হয়েছিল একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্ম আন্দোলন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে কলেজে ছাত্ররা কালি প্রতিমাকে ‘ব্ল্যাক, নেকেড, সাঁওতাল উমেন’ বলছেন। এতে করে সালমান রুশদির মত তারাশঙ্করের মাথার উপর কোন হুলিয়া জারি হয়নি। এবছরের শুরুতে ঢাকায় তরুণ বামপন্থী কর্মী আহমেদ জাভেদ রণি আয়োজিত একটি সেমিনারে পশ্চিমবঙ্গের কিছু মার্ক্সিস্ট নেতা ও তাত্ত্বিক এসে যখন কথাপ্রসঙ্গে বক্তৃতায় উল্লেখ করছিলেন যে কালি প্রতিমায় লাথি মেরে তাদের পার্টির সদস্যপদ পেতে হয়েছে, তখন সত্যিই আমি শিহরিত হয়েছি। মনে আছে কৈশোরে ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘দেব-দেবী নিয়ে রঙ্গরস’ নামে ধারাবাহিক লেখা পড়েছি। পাশাপাশি ২০০৭-এ বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা ‘দৈনিক প্রথম আলো’র প্রতি সোমবারের রম্য পত্রিকা ‘আলপিনে’ ষোল বছরের এক কিশোর কার্টুনিস্ট আরিফের আঁকা কার্টুন ও সাথে প্রকাশিত একটি কৌতুক (যেটি পরে অনুসন্ধানে দেখা গেছে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের পত্রিকাতেও এমন কৌতুক বহু আগেই ছাপা হয়েছে) ‘মোহাম্মদ বিড়াল’ মুদ্রণের দরুণ শুক্রবারের নামাজের পর বায়তুল মুকাররম থেকে হাজার হাজার মুসল্লী মিছিল বের করেন, কিশোর কার্টুনিস্ট একবছর জেলখানায় অন্যান্য কয়েদিদের হাতে প্রবলভাবে শারিরীক-মানসিক ভাবে নির্যাতিত হয়, ‘আলপিনে’র বিভাগীয় সম্পাদক সুমন্ত আসলাম চাকুরিচ্যুত হন এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ বাংলাদেশ (সিপিবি)-এর দীর্ঘদিনের তাত্ত্বিক ও সিপিবির সাপ্তাহিক ‘একতা’ পত্রিকার দীর্ঘদিনের সম্পাদক ও পরবর্তী সময়ে ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’ ও ‘দৈনিক প্রথম আলো’র মত দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দুই দৈনিকের সম্পাদক মতিয়ুর রহমানকে প্রকাশ্য দিবালোকে বায়তুল মোকাররমের খতিবের হাত ধরে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়। কী ছিল সেই কার্টুনে? মাদ্রাসার হুজুর জনৈক ছাত্রকে বলছে, ‘তোমার নাম কী?’ ছাত্র বলছে, ‘আমার নাম আবুল।’ হুজুর রেগে গিয়ে বলছে, ‘মুসলমানের ছেলেকে নাম বলার সময় বলতে হয় মোহাম্মদ আবুল।’ এরপর হুজুর ছাত্রকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কোলের বিড়ালটার নাম কী?’ দুষ্টু ছাত্র উত্তর করল, ‘মোহাম্মদ বিড়াল।’ কিশোর মনের নির্দোষ দুষ্টুমি ছাড়া এই কৌতুকে বিশেষ কিছুই আর ছিল না। ‘প্রথম আলো’র বিরুদ্ধে যখন পরিকল্পিত ভাবে মৌলবাদীরা রাস্তায় নামলো এই কার্টুন ছাপা হবার অপরাধে, তখন বাংলাদেশের কিছু ব্লগে ইসলামী ছাত্র শিবিরের বহু পুরনো পত্রিকার কপি স্ক্যান করে দেখা গেল সেখানে বহু আগেই ঠিক একই ধরনের কার্টুন ছাপা হয়েছে। মাদ্রাসার হুজুর জনৈক ছাত্রকে নাম বলার সময় ‘করিম'কে মোহাম্মদ করিম বলতে বলা হয় বলার পর ছাত্রের হাতে ধরা লাউ (কদু)-এর নাম কী জিজ্ঞাসা করায় ছাত্র বলছে, ‘মোহাম্মদ কদু।’ মনে আছে সেসময় আমার বাসা ধানমন্ডি থেকে গুলশানে সিএনজি করে যাওয়ার সময় সিএনজিঅলা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপা, প্রথম আলো পত্রিকা ইসলামের বিরুদ্ধে কী করছে?’ আমি শান্ত ভাবে কৌতুকটা বললে স্বল্পশিক্ষিত সেই সিএনজিঅলা হেসে ফেলে বলেছিল, ‘এইটা ত’ দুষ্টুমি। এইটা নিয়া হুজুররা রাস্তায় নামছে? দূর, জিনিষ-পত্রের যা দাম বাড়তাছে! কতদিন একটা ইলিশ মাছ কিনবার পারি না! আর আকামের জিনিষ নিয়া রাস্তায় মিছিল!’ ঐ সিএনজিঅলাও ধর্মবিশ্বাসী মুসলিম। তবে, ধর্ম নিয়ে ফায়দা লোটার মনোভাব হয়তো স্বল্পশিক্ষিত বলেই তার ছিল না বা নেই। মুশকিলের বিষয় হচ্ছে যে ঐ স্বল্পশিক্ষিত সিএনজিঅলা যে বিষয়টি ‘দুষ্টুমি’ বলে বুঝতে পেরেছিলেন, আমার এক বামপন্থী ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, থিয়েটার ও সিনেমার অভিনেত্রী, সুদর্শনা বান্ধবী উত্তেজিত হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনি জানান যে এই গোটা কার্টুনের বিষয়টি ‘পশ্চিমের সুগভীর ষড়যন্ত্র।’ কাজেই গেল শুক্রবার তিনি বায়তুল মোকাররম থেকে বের হওয়া হুজুরদের মিছিলে যোগ দিয়েছেন। প্রায় একঘন্টা ধরে মোবাইলে পয়সা খরচ করে তিনি ‘পশ্চিমের ষড়যন্ত্র’ নিয়ে ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ করছিলেন আর আমি নির্বাক, স্তব্ধ দর্শক হয়ে সব শুনছিলাম। সবটাই কি সত্যিই ‘পশ্চিমের ষড়যন্ত্র’? কেন পৃথিবীর অন্য সব ধর্মাবলম্বীদের যাবতীয় পবিত্র শহরেই মুসলিমরা ভ্রমণ করতে পারে? কিন্তু কেন ঐতিহাসিক আগ্রহ থেকেই ‘মক্কা’ নগরী ও কাবা গৃহ দেখার বিপুল কৌতূহল থাকা সত্ত্বেও ‘অমুসলিম’ আমার পক্ষে কখনোই ‘মক্কা’য় পা রাখা সম্ভব নয়? কেন ইরানে আজ আদি অধিবাসী অগ্নি উপাসকরাই নির্যাতিত, কণ্ঠরুদ্ধ আর বিতাড়িত? কেন পশ্চিমের ইমিগ্রেশন ল’য়ের এত কড়াকড়ি সত্ত্বেও ফ্রান্স-জার্মানি-আমেরিকা সহ সর্বত্রই মুসলিম অভিবাসীদের সংখ্যা বাড়ছে? পাশাপাশি বিশ্বের যেকোন মুসলিম রাষ্ট্রেই সংখ্যালঘু অন্য কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জনসংখ্যাই দিন দিন কমতে থাকে? আমার বড় দুই বোন উচ্চশিক্ষার্থে ব্রিটেন থেকে ফিরে খুব বিস্ময় নিয়ে বলেছিল যে ব্রিটিশ সরকারের ‘বাক স্বাধীনতা’র এমনি বহর যে ব্রিটিশ টেলিভিশনে পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসী মুসলিম নেতারা বলেন, ‘আমরা এই দেশকে খেয়ে-দেয়ে, টয়লেটের মত ব্যবহার করব।’ ১৯৯৪ সালের একটি হিসাব থেকে দেখা যায় প্রতি বছর ৭০০ বৃটিশ নারী অভিবাসী মুসলিম পুরুষদের বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়। পাশাপাশি কোন পাকিস্তানী বা বাংলাদেশি মুসলিম নারী বৃটিশ ছেলের প্রেমে পড়লেও পাকিস্তানীরা করে ‘অনার কিলিং’ আর বাংলাদেশিরা মেয়েটাকে দেশের বাড়ি ফিরিয়ে এনে চাচাত-মামাত-ফুপাত ভাইয়ের সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত ব্রিকলেনে শ্বেতাঙ্গ, বৃটিশ নারীরা যেকোন পোশাকে এখন হাঁটার কথা ভাবতে পারেন না। পশ্চিমা সমাজে বাবা মায়ের ঘন ঘন বিয়ে বিচ্ছেদের কারণে অনেক অসহায় শ্বেতাঙ্গ কিশোরী-তরুণী নিরাপদ জীবনের কথা ভেবে কোন মুসলিম অভিবাসী তরুণকে বিয়ে করে যেই না ধর্মান্তরিত হন, ছেলেটি অনেক ক্ষেত্রেই নাগরিকত্ব পাবার পর দেশ থেকে ‘ভাল মেয়ে’ বিয়ে করে এসে ‘অনাচারী, শ্বেতাঙ্গ তরুণী’কে তালাক দেন। ইতোমধ্যে ঐ শ্বেতাঙ্গ তরুণী গর্ভবতী হয়ে পড়লে তার সন্তানরা হাসপাতালে মুসলিম নামেই নিবন্ধিত হন যদিও বাদ বাকি জীবনটা একাকী মা অথবা বৃদ্ধ মাতামহ-মাতামহীকেই ঐ সন্তানকে প্রতিপালন করতে হয়! পার্শ্ববর্তী ভারতে আন্তঃসম্প্রদায় বিয়ের ক্ষেত্রে অভিন্ন দেওয়ানী আইন চালু থাকলেও বাংলাদেশে এমন বিয়েতে সংখ্যালঘু তরুণ বা তরুণীকেই নিজ বিশ্বাস বিসর্জন দিতে হয়। সারা পৃথিবীর ‘অবিশ্বাসী’রা ‘বিশ্বাসীদে’র সাথে এই একতরফা ভদ্রতা ও নিজের অধিকার ছাড় ঠিক কতদিন ধরে দিয়ে চলবে? এই প্রশ্নটি নিজেকেই নিজে করা কি আজ মুসলিম সমাজের জন্যই খুব জরুরি নয়? হ্যাঁ, প্রশ্ন কিন্তু উঠছে। খোদ মুসলিম সমাজেই উঠছে। কাজি নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, সালমান রুশদি, ওরহান পামুক বা তসলিমা নাসরীনরা এসব প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের অধিকাংশের অবস্থানই তাদের মুসলিম সমাজে খুব সুখের হয়নি। ব্যক্তিগত ভাবে অনেক হতাশার ভেতরেও আমি আশা হারাই না যখন দেখি ফেসবুকে বাংলাদেশের প্রচুর মুসলিম তরুণ-তরুণী আজ ধর্ম নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন, কালোপাহাড়ি সব চিন্তা-ভাবনার ঝড় তুলছেন নানা পেজ ও ব্লগে (এমন কিছু পেজের লিঙ্ক দিলাম -যঃঃঢ়ং://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/#!/ঊৎৎড়ৎওহছঁৎধহঅহফঅহধষুংরং; যঃঃঢ়ং://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/#!/ইঝঐগ৭১, যঃঃঢ়ং://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/#!/ঢ়ধমবং/ওৎধহরধহ-ধঃযবরংঃধমহড়ংঃরপ-সড়াবসবহঃ/২৪৪৯৭০৩৮৮৯১৭৩২২)।
দুঃখিত, হয়তো অনেকটাই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছি বা যাচ্ছি। আজ বাংলাদেশে অনেক বামপন্থী বা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীর ভেতর যখন দেখছি যে পশ্চিমকে বিরোধিতার নামে পারলে মালালাকে অস্বীকার করে, তাদের প্রতি আমার একটাই বক্তব্যঃ দুইশো-আড়াইশো বছর আগে ভারত উপমহাদেশে বৃটিশ উপনিবেশের যাবতীয় ক্ষতিকর ও নেতিবাচক প্রভাব মনশ্চক্ষে দেখেও যেমন কার্ল মার্ক্স পুরনো আর ঘুণে পচে যাওয়া সহস্রাব্দের ভারতীয় সমাজে এক ভাঙ্গনই আশা করেছেন নতুন গড়ে ওঠার আশায়, আজকের পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের, এই নব্য উপনিবেশবাদের হাজারটা ক্ষতিকর দিক অনুমান করে নিয়েও চোদ্দশ বছর আগের মানচিত্রে পৃথিবীকে যারা ফিরিয়ে নিতে চাইছে, সেই চুরির জন্য হাত কাটা, ব্যভিচারে পাথর ছোঁড়া আর দুই নারীর সাক্ষ্য সমান এক পুরুষের সাক্ষ্যের পৃথিবী ভাঙাটা আগে বেশি জরুরি।
কল্লোল
আমি ঠিক জানি না কেন মালালাকে নিয়ে গণমাধ্যমের হৈচৈ-কে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিতেই, তালিবানী কুকর্মগুলিকে জায়েজ বলার দোষারোপ শুরু হয়ে যায়।
মানে, কী? আবু ঘ্রাইব নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না? এবং প্রশ্ন তুললে তালিবানী নৃশংসতাকে মান্যতা দেওয়া হবে? কোল্যাটারাল ড্যমেজের নামে নির্বিচারে সাধারন মানুষকে হত্যার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললে মালালার ঘটনাকে মান্যতা দেওয়া হবে?
এতো সহজ সব কিছু? এতোই সহজ?
অথচ এঁরা জানেন যে তালিবানদের তৈরী করেছে কারা। তারপরেও অনায়সে বলতে পারেন তালিবান আর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে বাছতে বললে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকেই বাছবেন। আসলে, গায়ে আঁচ না লাগলে অনেক কিছুই বলা যায়। একটু অন্য রকম করে প্রশ্নটাকে রাখি? একজন মানুষকে যদি বাছতে বলা হয় কার দ্বারা ধর্ষিত হতে পছন্দ করবেন - একজন তালিবানের হাতে, না একজন মার্কিনী সেনার হাতে? কী উত্তর দেবেন?
আমরা কি প্রতিবারই প্রশ্নটাকে ঘৃণার সাথে ফিরিয়ে দেবো না এই বলে যে, কারুর হাতেই নয়। আমি কারুর হাতেই নিজেকে ধর্ষিত হতে দিতে চাই না। আসলে এই ধরনের প্রশ্নগুলোই একধরনের চালাকি, যা আমাদের গেলানো হয়েছে "লজিক"এর নামে। ভোট দিতে গেলে একটা না একটা চোরকেই বাছতে হবে। কাউকেই পছন্দ নয় এরকম কোন খোপ থাকবেই না। অথচ প্রভুরা যখন এমতাবস্থায় পড়েন তখন, মতামত জানানো থেকে বিরত থাকলাম - অনায়সে বলতে পারেন, সংসদ থেকে রাষ্ট্রপুঞ্জ সব জায়গায়ই।
আর এরপরেই ব্যাতিক্রমহীনভাবে সাম্রাজ্যবাদের "ভালো" দিকগুলি উঠে আসবে। উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন তুললেও ঠিক একই যুক্তি উঠে আসে, এবং কুমীরছানা দেখানোর মতো উঠে আসে সতীদাহ রদ, বিধবা বিবাহ, স্ত্রী শিক্ষা ইত্যাদির জয়গান। সতীদাহ রদ বা বিধবা বিবাহ বা স্ত্রীশিক্ষার ফল সামান্য কটা শহরেই আটকে থেকেছে। তাতে খাপ পঞ্চায়েতের রমরমা কমে নি, মালালা আজও ঘটে, আজও ধর্ষককে বিয়ে করতে বাধ্য হন ধর্ষিতা, ডাইনি বলে হত্যা আজও ঘটে চলে। আজও মাছের মুড়োটা ছেলের পাতেই যায়। কী? না, রেনেসাঁ হয়েছে!!!
তর্কটা আরও চললে এরপর আসবে প্রযুক্তির কথা, তারপর চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথা - যা আমাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুরা আমাদের দয়া করে দিয়েছেন।
খুব চেনা ছক, খুবই চেনা ছক।
কারা যেন কালীমূর্তিতে লাথি মেরে পার্টির সদস্য পদ পেয়েছেন। সেই মূর্খের দলের হাতেই তসলিমা "ঝেঁটিয়ে বিদায়" হন মোল্লা-মৌলভীদের তোয়াজ করতে। ছোট জাতের রাঁধুনীর হাতের রান্না খেতে অস্বীকার করে মিড-ডে মিলের পংক্তিতে, অবোধ শিশুরা।
আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নামে যেন মধ্যযুগ ফিরিয়ে না আনা হয়। উল্টো আশঙ্কাটা মাথায় আছে তো?
আমরা আর কবে বলবো, তোমাদের দেওয়া বিকল্প্গুলির মুখে লাথি মারি। আমাদের মতো করে বাঁচার রাস্তা আমরাই বেছে নেবো। তোমাদের বেছে দেওয়া পছন্দগুলিকে আমরা ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করছি।
আর তা না হলে আসুন আবেদন করি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কাছে - এসো সৌদি আরবকে গুঁড়িয়ে দাও, সেখানে সকলের সম অধিকার কায়েম হোক। এসো, দখল করো পাকিস্তান ও মায়নামারকে। চূর্ণ করো চীনকে। সেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র স্থাপিত হোক। ভারত দখল করে দলিত ও মেয়েদের উপর অবিচার বন্ধ করো।
হিম্মত থাকলে করে দেখাক পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ।