শ্বশুর মশায় তার কন্যাটিকে নিয়ে দিন পনেরোর জন্য চলে যাওয়ায় একদিক থেকে ভালই হলো দীপায়নের। ঘরে বউ নেই বলে রাঁধা-খাওয়া অত হয় না। তবে সকালে অফিসে গিয়ে চা-বিস্কিট, দুপুরে অফিসেই লাঞ্চ আর সন্ধ্যা থেকে শাহবাগেই রাত কাবার। পুরনো বন্ধুদের সাথেও...চাকরি আর সংসারে যারা দূরে দূরে ছিটকে পড়ছিল...তাদের সাথে দেখা হচ্ছে তার। অবাক লাগে মেয়েদের দেখলে! কী ভয়ানক সাহস আর শক্তি এদের! ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাইক্রোফোনে শ্লোগান দিয়ে চলছে ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে। পুরনো বন্ধুরাও চাকরি আর সংসারের জাড্য ভেঙ্গে ছুটে আসছে। কেউ দু’পাতার কবিতা-গান ভরা পত্রিকা বিলি করছে। কেউ চাঁদা তুলে প্রজেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা দেখাচ্ছে। আর একটু পর পর হর্ষোৎফুল্ল মানুষের আকাশভেদী বিপুল নাদঃ ‘জয় বাংলা! জয় বাংলা! জয় প্রজন্ম! জয় মুক্তিযুদ্ধ! জয় জয় জয় শাহবাগ! জয় মুক্তিযুদ্ধ!’
মূল মঞ্চের চারপাশে ত’ অসংখ্য মিডিয়ার ক্যামেরা আছেই। ক্রেনে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছে টিভি চ্যানেলের আলোকচিত্রীরা। একটি ট্রাকের উপরেই দাঁড়ানো গণজাগরণ মঞ্চের সামনের সারির মানুষগুলো। সেখান থেকে শ্লোগান, গান, কবিতা পাঠ আর বক্তৃতা ত’ চলছেই। মূল মঞ্চ থেকে একটু দূরেই পরপর অসংখ্য ছোট ছোট বৃত্ত আর উপবৃত্ত গড়ে আরো অনেক তরুণ-তরুণী শ্লোগান দিচ্ছে, সন্ধ্যার পর মোম জ্বালিয়ে আর ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে গড়ছে আলো আর ফুলের শহীদ মিনার! শাহবাগ, ওপারে রমনা উদ্যান চত্বর আর সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবধি ফাল্গুনের রাতের আঁধারের হাল্কা রেখা মুছে গিয়ে দূর আকাশের আলোর পরীরা এই গোটা প্রজন্ম চত্বর বুঝি আলোয় আলোয় ধুইয়ে দিচ্ছে। এত আলো এতদিন কোথায় ছিল দীপায়ন?
বুকের ভেতর জমা করে রাখা টুকরো বাংলাদেশ
সারা পৃথিবীর শাহবাগ মিলে শাহবাগে হয় শেষ।
জনতার স্রোতে একাকার হয়ে রাজপথ হয় নদী
একাত্তরের ধর্ষক খুনী সেইখানে আসে যদি-
৬. ২৬ শে ফেব্রুয়ারি বিসমার্কের সাথে ফ্রান্সের আর এক দফা সন্ধি চুক্তি। ওহ্, মাতৃভূমির কি দুঃসহ অবমাননা ক্রমাগত ঘটেই চললো! নয়া চুক্তিতে বলা হয় ক্ষতিপূরণের ৫০ কোটি ফ্রাঁ না পাওয়া পর্যন্ত ফ্রান্সে অবস্থান করবে জার্মান বাহিনী। দালাল অভিজাতরা জার্মান সৈন্য আসার আগের দিন ইচ্ছা করেই রাস্তায় রাস্তায় কামান ফেলে যায় যেন জার্মান বাহিনী এসে কুড়িয়ে নেয়। তোমরা ছোটলোকের দল...হাভাতে শ্রমিক আর ঘুঁটে কুড়ুনীর ছেলে-মেয়েরাই সেই কামানগুলো সাথে সাথে চিলের মতো ছোঁ করে কুড়িয়ে নাও। মঁমার্ত, বেলভিল আর লা ভিলেতের শ্রমিক কলোনী আর বস্তিগুলোয় কামান রাখা হয়। রাজধানীর যে পথে জার্মান সেনাবাহিনী ঢুকবে, সেই পথে ৪০,০০০ লোক জমা হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ...মনে পড়ে ইউজিন...সবাই মিলে তোমরা ঠিক করলে শ্রমিকরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলেই কামানগুলো সব সারাবে, গোলা-বারুদ জড়ো করবে? কি প্রবল কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে তোমরা সবাই!
...এলো ১লা মার্চ। প্রুশীয় সেনাবাহিনী প্যারিতে ঢুকলো। শোকে-বেদনায়-অপমানে প্যারির প্রতিটা বাড়িতে ঝুললো কালো পতাকা। শুন্য, বিরান রাস্তা-ঘাট। দোকানপাট সব বন্ধ। রাতে বড় রাস্তাগুলোয় আলো জ্বলছে না। দরিদ্র যে গণিকারা অর্থের জন্য জার্মান সৈন্যদের কাছে গেছিল, তাদের পরে প্রকাশ্যে বেত মারা হলো। জার্মান সৈন্যদের জন্য খোলা কাফেটা লুটপাট হলো। জার্মান সৈন্যের দালাল অভিজাত সরকার মার্চের তিন তারিখ নাগাদ সংসদে বকেয়া বাড়ি ভাড়ার বিল আনলো। আগামী ছয় মাসে পরিশোধযোগ্য বাড়ি ভাড়া এখনি সব শোধ করতে হবে। মধ্যবিত্ত, চাকরিজীবী, দোকানদার, ক্ষুদে শিল্পপতি সবাই মিলে পথে বসার অবস্থা! আগুনে ঘি ঢালার মত সাধারণ, শ্রমিক সৈন্যদের ভিক্ষা দেবার মত আট শিলিং করে ছুঁড়ে দিল বুর্জোয়া সরকার। যেন কুকুরকে ছুঁড়ে দেওয়া রুটির টুকরো। ফ্লুরাস আর ব্লাঙ্কুইয়ের মত নেতাদের কোর্ট মার্শালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। তোমরা প্রজাতন্ত্রীরা, শ্রমিক আর সাধারণ মানুষের দল, এর প্রতিবাদে অসংখ্য পোস্টারে-ব্যানারে ছেয়ে ফেললে শহর। সীমান্তে জার্মানদের সাথে হেরে যাওয়া ২৩,০০০ সৈন্যকে তড়িঘড়ি করে বুর্জোয়া সরকার পাঠালো প্যারিতে শ্রমিক আর বিপ্লবীদের শায়েস্তা করতে। লাভ হলো না। সৈন্যদেরও দেশের প্রতি ভালবাসা ছিল। উল্টো তারা শ্রমিকদের পক্ষে যোগ দিল। বুঝলো, মেহনতি মানুষই শেষ শক্তি। ক্ষুধা আর শীতে কাতর এই সৈন্যদের শ্রমিক-বস্তির মেয়েরা দিল গরম গরম স্যুপ আর শীতের কম্বল।
মার্চের ১৮ তারিখ ভোর রাতেই বুর্জোয়া সরকারের নাইন রেজিমেন্টের কয়েকটা বাহিনী রওনা করলো প্যারির শ্রমিক বস্তিগুলোর দিকে। জেনারলে মাসবেল ছয়শো সৈন্যের দুটো ব্রিগেড নিয়ে যাত্রা করলেন মঁমার্তের দিকে। চারপাশে কেমন সুনসান নীরবতা! জেনারেল পাতুয়েল মুযঁলা দ্য লা গালেৎ দখল করে নিলেন। লোকেঁৎ দখল করলেন সেলফেরিনোর টাওয়ার। তখন বাজে মাত্র সকাল ছয়টা, তাই না ইউজিন?
এদিকে একটু একটু করে শ্রমিক-বস্তিগুলো জাগতে শুরু করেছে, রাস্তায় দোকানপাট খুলছে। দুধের দোকানের সামনে, মদের দোকানের সামনে মানুষের ছোট ছোট ভিড়ের জটলা। সবার আগে নামলো শ্রমিক-বস্তির মেয়েরা। রাস্তায় পাহারারত সৈন্যদের ঘিরে ধরে, তীক্ষ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে অস্থির করে তুললো তাদের। প্যারিকে জাগানোর জন্য শ্রমিকরা ড্রাম বাজানো শুরু করলো। নারী-পুরুষ-শিশুর এক দীর্ঘ মিছিল চললো মমাঁর্ত অবধি। তোমরা সেদিন ঘিরে ধরেছিলে জেনারেল লোকেঁৎ-এর বাহিনীকে, মনে পড়ে ইউজিন? ঘোড়সওয়ার জেনারেল পাতুয়েলকেও তাড়া করলে তোমার? বেলভিল, বাট্স, লুকসেমবুর্গ সবখানেই ড্রামের আওয়াজে মানুষ জড়ো হচ্ছে আর বুর্জোয়া দলের সৈন্যরাও সেই মিছিলগুলোয় যোগ দিচ্ছে। সকাল ১১টার ভেতরেই বুর্জোয়া সরকারের ঠ্যাঙারেদের তোমরা তাড়িয়ে দিলে, মনে পড়ে? মমাঁর্ত, বেলভিল সহ সব শ্রমিক এলাকাগুলোয় গড়ে উঠছে ব্যারিকেড। মেয়েরা ঘুরে ঘুরে রান্না করা খাবার খাওয়াচ্ছে সবাইকে। বিকাল চারটা নাগাদ তোমরা সবাই মিলে ক্লেমাতঁমাকে ধরে ফেললে যে কিনা ‘প্যারির ছোটলোকদের’ শেষ করে দিতে চেয়েছিল। ক্লেমাতঁমা আর লোকেঁৎকে তোমরা সেদিনই হত্যা করলে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ অভিজাত বাহিনীর সার্জেন্টরা সবাই পালালো। সেদিন রাতটা শ্রমিক কলোনীতে তোমরা সবাই ভাল ঘুমিয়েছিলে, তাই না ইউজিন?
Hideux dans leur apothéose
Les rois de la mine et du rail
Ont-ils jamais fait autre chose
Que dévaliser le travail ?
Dans les coffres-forts de la bande
Ce qu'il a créé s'est fondu
En décrétant qu'on le lui rende
Le peuple ne veut que son dû.
: C'est la lutte finale
Groupons-nous, et demain
L'Internationale
Sera le genre humain :
(Hideous in their apotheosis,
The kings of the mine and of the rail.
Have they ever done anything other
Than steal work?
Inside the safeboxes of the gang,
What work had created melted.
By ordering that they give it back,
The people want only their due.
: This is the final struggle
Let us group together, and tomorrow
The Internationale
Will be the human race).
৭.
শকুনেরা আজ শুনে রাখ শুধু সময় হয়েছে শেষ
মনীষীরা আজ জেগে আছে রাত, হৃদয়ে বাংলাদেশ।
জনতার স্রোতে নেশা লেগে যায় স্বপ্নমাখা ঘোর
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মিলে প্রজন্ম চত্বর।
...ছয়, সাত আর আট তারিখ কেটে গেছে ঘোরের ভেতর। তারপর আবার ছ/সাত দিন শাহবাগে যাওয়া হয় নি ফারহানার। বাবা আওয়ামি লীগ করতেন। কিন্ত একটু বড় হতে হতেই চারপাশে ফারহানা শোনে আওয়ামি লীগ অর্থই নাকি ‘ভারতের দালাল’ যারা মুসলমানের সাধের পাকিস্থানকে কেটে দু’টুকরো করেছে। শেখ মুজিব পাকিস্থানকে ভেঙ্গে অমার্জনীয় অন্যায় করেছে। আওয়ামি লীগকে ভোট দেয় বেশির ভাগই হিন্দুরা যারা এদেশে থেকেও ওদেশের স্বপ্ন দেখে। যাদের কখনোই আসলে বিশ্বাস করা যায় না আর উচিতও নয়। বাড়িতে ফারহানা শিখেছিল ১৯৭১-এ ইন্দিরা গান্ধীর ভারত নাকি আমাদের খাবার দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে, সৈন্য পাঠিয়ে, দেশ-বিদেশে জনমত গড়ে তুলে বিপুল সাহায্য করেছিল। নাহলে যুদ্ধে জেতাই যেত না। কিন্ত সেই স্কুলে থ্রি-ফোরে পড়ার সময় টিচারদের কাছে থেকে শুরু করে বাইরে প্রায় সবার কাছেই ফারহানা যে শোনে ইন্দিরা গান্ধী সেই ভয়ানক চতুর মহিলা যিনি পাকিস্তানকে দু’টুকরো করেছেন। ভারতই বাংলাদেশের সব সমস্যার মূলে দায়ী। সে বাংলাদেশকে নদীর পানি দেয় না, সীমান্তে কাঁটা তার দিয়ে রাখে, ব্যবসায় ঠকায়। বাসা থেকে যে পাল্টা যুক্তিগুলো শেখে ফারহানা যেমন ভারতে কত বাংলাদেশী চিকিৎসা করতেই যায়, ভারতের গরু-চিনি-পেঁয়াজ-কাপড়-ফেন্সিডিল মায় হিন্দি সিনেমা ছাড়া আমাদের একটা দিন চলে না, ওপারের বই-গান-নাটক ছাড়া জীবনই পানসে থাকে...শেষ কথাটা দাঁড়ায় আওয়ামি লীগ ক্ষমতায় এলে হিন্দুদের খুব জোর বাড়ে। তাদের মাথায় তোলা হয়। তারাই ‘সংখ্যাগুরু’ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ, ফারহানার শ্বশুর ও বিএনপির কড়া সমর্থক মোসাদ্দেক সাহেবের চেয়ে ফারহানার বাবা সালাম সাহেব নামাজ-রোজা বেশি করেন। আবার দলের হিন্দু নেতা-কর্মীরা সারাদিনই বাসায় আসত যেত। ফারহানার বর অতীশ রাজিউলকে সে প্রথম দেখেছিল ক্যাম্পাসেই। একটি বাম দলের নেতা হিসেবে নিজেকে সে ফারহানার কাছে প্রথম পরিচিত করায়। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ বা ‘শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিকতা’ শুনতে শুনতেও ফারহানার মাঝে মাঝে অস্বস্তি হত যে অতীশরা যখন আওয়ামি লীগ বা ভারতের নিন্দা করতে শুরু করে, সে সমালোচনা যেন কেমন একটা পর্যায়ে বিএনপি বা জামাতের সমালোচনার মত লাগে। কেমন সাম্প্রদায়িক কুৎসার মত শোনায়! নাকি তারই ‘ভারতের দালালে’র কাণ? অতীশকে ভাল লাগার জন্যই ওদের দলের কথাগুলো সে তোতা বুলির মত মুখস্থ করে: ‘নয়া বিশ্ব কাঠামোয় মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদীর পাশে দক্ষিণ এশিয়ার নয়া আঞ্চলিক ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী সাম্রাজ্যবাদ ভারত তার সুচতুর বেনিয়া মুনাফা বাংলাদেশের মত ক্ষুদ্র দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলো থেকে আদায় করতে চায়।’ বলতে বলতে বুকে খচখচ করতো ফারহানার। ছোট ফুপুকে পাঞ্জাবি আর্মির বাঙ্কার থেকে উদ্ধার করার সময় তার নগ্ন দেহ পাগড়ির কাপড়ে ঢেকে দিয়েছিল এক শিখ সৈন্য। বেশিদিন বাঁচেন নি এরপর। নিজেই সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই ডাইনিং টেবিলের সামনে সাদা-কালো ছবিতে এক কুড়ি-একুশের তরুণীর সরল, আত্মভোলা হাসির ছবি দেখে মুগ্ধ হতো ফারহানা। মা’কে জিজ্ঞাসা করতো, ‘উনি কে মা?’
‘তোমার বাবার ছোট বোন ছিল মা! তোমার হেনা ফুপু।’
‘উনি বেঁচে নাই?’
‘না-’
‘মরে গেল ক্যানো? অসুখ করেছিল?’
‘হ্যাঁ- মা-অসুখ করেছিল।’
প্রতি বছর হেনা ফুপুর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে ফারহানাদের বাসায় কুলখানি হতো। সেমাই আর জর্দা রান্না করা হতো। দাদি মা সেদিনগুলোতে কেন জানি একদম ভেঙ্গে পড়তেন। বিছানা থেকে উঠতেই পারতেন না। অনেক বড় হয়েই আর জানতে পারে ফারহানা। মা-ই তাকে খুলে বলেছিল, ‘তোমার ছোট ফুপু...বাড়ির ছোট ছিল বলেই খুব সহজ-সরল ছিল...তোমার বড় বা মেজ ফুপুর মত না...আমাকে পরের ঘরের মেয়ে বলে কখনো অন্য চোখে দ্যাখে নি, অন্য দুই ফুপু দোষ ধরতে এলে সে-ই আমাকে বাঁচাতে আসত...আমার খুব প্রিয় ননদ ছিল...এত ভাল মানুষের কপালে আল্লা কেন এটা রেখেছিল জানি না...সে ক্যান্সারে মারা যায় নি রে! তাকে আর্মি আর রাজাকাররা তুলে নিয়ে গেছিল। বাড়িতে পুরুষ সদস্য ছিল না। ও-ই ইয়াং, অবিবাহিত মেয়ে ছিল। অন্য দুই ফুপুর ত’ বিয়ে হয়ে গেছিল। আমিও বিবাহিত, সন্তানের মা। আমাদের ত’ আর নেবে না- ওকেই তুলে নিয়ে গেল! কি মেয়ে গেল আর কি মেয়ে ফিরে আসল! পেটে বাচ্চা এসে গেছিল। সেটা জেনেই ঘরে দরজা দিয়ে- আল্লাহ গো- শোন্, বাইরে এটা বলবি না। বাইরে সবাই যেন জানে তোর ছোট ফুপু ক্যান্সারেই মারা গেছে, বুঝলি?’
শাহবাগে গেলেই তাই ফারহানার ভেতর থেকে অদেখা ছোট ফুপুর জন্য, হলদে হয়ে আসা একটি সাদা-কালো ছবির জন্য, বুক চিরে...গলা চিরে...তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে... কান্নার আর্ত ধ্বনির মত শ্লোগান বের হয়, ‘আমাদের ধমনীতে বীরাঙ্গনার রক্ত-এই রক্ত কোনদিনও বৃথা যেতে পারে না! এই রক্ত কোনদিন পরাভব মানে না! বেঈমানি করে না!’
অথচ অতীশ রাজিউলদের বাড়িতে বিয়ের পরই কেবল সে জানতে পারল তার শ্বশুর বিএনপি করেন। যৌবনে তিনিও অবশ্য আব্দুল হকের দল অর্থাৎ বামদের নানা শাখা-প্রশাখার একটি দল করতেন। অতীশের দাদা ছিলেন মুসলিম লীগের এমএলএ। অথচ, অতীশদের বাড়িতে নামাজের বালাই নেই। সন্ধ্যা থেকে স্টার প্লাসে হিন্দি সিরিয়াল। শ্বশুর মহাশয় দিব্যি স্যুটেড-বুটেড। এই বয়সেও নিয়মিত ঢাকা ক্লাবে যান, বিলিয়ার্ড খেলেন। অতীশ আর শ্বশুর মহাশয়...বাপ-বেটা মিলে একসাথে ড্রিঙ্ক করেন...অতীশের শাশুড়িও তাতে মাঝে মাঝে যোগ দেন...অতীশের ছোট ভাই একটি ব্যান্ড দলের বেইজ গিটারিস্ট। তার লাইফ-স্টাইল নিয়ে কথা না বলাই ভাল। অতীশের বোণরা সব দারুণ স্মার্ট। স্লিভলেস ব্লাউজ, এক পাল্লা শাড়ি বা গলায় ওড়না। অথচ ‘খোদা হাফেজ’ না বলে ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলবে। কথায় কথায় ‘বিসমিল্লাহ-মাশাল্লাহ-ইনশাল্লাহ’ আছে। এদিকে সবারই ভ্রু নিপাট প্লাক আপ, বাইরে বের হতে হলেই মুখে ফাউন্ডেশন, ম্যাক্স ফ্যাক্টর। ফারহানা কোন তাল পায় না! খাবার টেবিলেই এদের যত ধার্মিকতা! সেটা গোটাটাই ভারত আর হিন্দুদের নিয়ে গালি-গালাজ। সারাক্ষণই শেখ হাসিনা আর আওয়ামি লীগ, বঙ্গবন্ধু ও তার নিহত পরিবারের চরিত্র হনন! বিএনপি-জামাত বিষয়ে একটি বক্তব্য নেই। ছোট ভাইয়ের হোন্ডা দুর্ঘটনার পর ফারহানা এক বেলা নামাজ পড়ায় তারা ঠাট্টাও করেছিল। আবার ফারহানা কপালে টিপ পড়লে শাশুড়ি গম্ভীর হন; বলেন এটা ধর্মসম্মত নয়। ফারহানা শ্বশুরবাড়ির বিজনেস পার্টিগুলোয় তিন ভাঁজ আচলের পুরু প্লিটের শাড়ি পরে, চুলে ফুল বা কপালে টিপ পরে বলে তাকে সবাই গ্রহান্তরের আগন্তকের মতো দ্যাখে। সে ছায়ানটে পঞ্চকবির গান মানে ঐ রবীন্দ্র-নজরুল-রজনীকান্ত-দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদের গান শিখত বা এখনো মাঝে মাঝে গায় বলে তার দেবর তাকে বিদ্রুপ করে। আর অতীশও খুব অদ্ভুত। সারাদিন বাবার ব্যবসা সামলায়, একটা এনজিও-ও বোধ করি খুলছে আর সন্ধ্যার পর তার পার্টির নারী ও পুরুষ কমরেডরা আসে। নারী কমরেডরা জিন্স পরে, কপালে বিশাল টিপ আর সিগারেট খেতে খেতে তালিবান ও আল-কায়েদার গড়ে তোলা দুর্বার মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধের কথা বলে, ফ্রান্সে মুসলিম নারীর হিজাব পরার মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলে, মাদ্রাসার ছাত্রদের উপর সেক্যুলার সরকারের দমন-পীড়নের কথা বলে।
‘ফরহাদ মজহারের লেখাগুলো পড়ে দ্যাখো ফারহানা! শাহবাগের এই আন্দোলন মধ্যবিত্তের আন্দোলন। গরীব, নিম্নবর্গের বা প্রান্তিক, খেটে খাওয়া মানুষের আন্দোলন নয়। আজ শিবিরের সাথে তোমাদের এই সো-কলড সেক্যুলার বাট ফ্যাসিস্ট সরকারের মারামারি...মাদ্রাসায় কারা যায়? নিম্নবিত্ত আর প্রান্তিক ঘরের বাচ্চারাই যায়। তাদেরই আজ মুখোমুখি শত্রু খাড়া করে...’
‘মানছি মাদ্রাসায় গরীব মানুষের সন্তানরাই যায়। জামাত ইসলামের বড় নেতাদের সন্তানরা ত’ সব ওয়েস্টে দামি বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ছে। তাদের ছেলে-মেয়েরা আরামে আছে কিন্ত এই গরীব ছেলেদেরই জিহাদ করতে হবে। জিহাদের নামে বিভ্রান্ত ছেলেরা পুলিশের মাথা ইঁট দিয়ে থেঁতলে দেবে, মানুষের হাত-পায়ের রগ কাটবে, দোষ সেক্যুলার সরকারের, তাই না?’
‘তোমার আওয়ামি ভুত ঘাড় থেকে আর নামল না।’
ফারহানা কথা না বলে ঘর থেকে বের হবার উদ্যোগ নেয়।
‘যাচ্ছ কই, শাহবাগ? যাও- চেতনার ব্যবসা চলছে ভালই। সরকারের হাজারটা দুর্নীতি চেতনার শ্লোগান তুলে আড়াল করার অপচেষ্টা!’
‘এ সরকারের দুর্নীতি আছে অস্বীকার করি না। কিন্ত বিএনপি-জামাত আমলে কি এর চেয়ে কয়েক হাজার গুণ দুর্নীতি ছিল না?’
‘মার্ক্সিস্ট পড়াশোনাটা তুমি আসলে করলে না কিনা ফারহানা!’
ফ্রিজ থেকে বের করা চিল্ড স্মিরনফ বোতলে ঢেলে তার ভেতর লেবুর রস চিপতে চিপতে বলে অতীশ রাজিউল। গত ছ’মাস হল তারা এক বিছানায় শোয় না। নাহ্, তাই বলে রাজনৈতিক মতপার্থক্য এখনো গায়ে হাত তোলার পর্যায়ে যায় নি। ঝগড়া-মারামারি এখনো হয় নি। রাজিউলের কি কোন দরকার আছে ফারহানাকে? ফারহানা বাড়ি থেকে বের হলেই রাজিউলের সেই নারী কমরেড যে আসবে তা’ ত’ ফারহানা জানে। মেয়েটি বিবাহ বিচ্ছিন্ন। সেই সিগারেট, জিন্স, কপালে বিশাল টিপের স্মার্টনেস- সমানে ছেলেদের সাথে স্ল্যাং বলার, গাঁজা খাওয়ার বিপ্লব এবং সমানে হিজাব ও তালিবান শক্তির পক্ষে ওকালতি। ক্লান্তি এত ক্লান্তি...অথচ, মেয়েটিকে নিয়ে যৌন ঈর্ষা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকাতরতাও তার তৈরি হয় না...কেন? অতীশের প্রতি তার কি আকর্ষণ হারিয়ে গেছে? অতীশ তার নারী কমরেডকে আসলেই কি ভালবাসে? নাকি স্রেফ রুচি বদল?
শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের কাছে আসতে আসতেই অবশ্য ফারহানার সব কষ্ট এক লহমায় হাল্কা হয়ে গেল। গান বাজছে জোরে। কবির সুমনের অনবদ্য গলাঃ
বিমানে উড়তে তিরিশ মিনিট
এতো কাছে তবু দূর
বিলকুল নেই পাসপোর্ট ভিসা
সীমানা চেনে না সুর।
সীমানা চিনি না আছি শাহবাগে
আমার গীটারও আছে,
বসন্ত আজ বন্ধুরা দেখো
গণদাবী হয়ে বাঁচে।
...একটা রুদ্র পলাশের ডাল বাতাসে অসহ সুখে বা বিষাদে মূহুর্মূহু দোলে।
বাঁচো গণদাবী, বাঁচো গণদাবী
আসল বিচার চাই,
যার যা পাওনা তাকে সেটা দাও
গণদাবী একটাই।
...আট তারিখের পর আজ পনেরো তারিখ। সাত দিন পর আবার ফারহানা শাহবাগে! মাঝখানে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের একগাদা খাতা দেখা, পরীক্ষার হলে গার্ড দেওয়া, রুটিন বা প্রায় মিউচ্যুয়াল কনসেন্টে ডিসফাংশনাল হতে থাকা দাম্পত্যের ছক...
গুটি গুটি পায়ে প্রজন্ম চত্বরের ফোয়ারার কাছে গিয়ে সবার সাথে ফারহানাও গলা মেলায়, ‘জয় বাংলা!’
৮. ‘প্যারির প্রলেতারীয়রা শাসক শ্রেণীসমূহের ব্যর্থতা দেশদ্রোহিতা থেকে এ কথাই উপলব্ধি করছে যে রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ পরিচালনার ভার স্বহস্তে গ্রহণ করে পরিস্থিতি ত্রাণের মুহূর্তটি আজ সমাগত...সরকারী ক্ষমতা দখল করে আপন ভাগ্য নিয়ন্তা হয়ে ওঠা যে তাদের অবশ্য কর্তব্য এবং পরম অধিকার এ কথা তারা অনুভব করছে।’
১৮ই মার্চই ইশতেহারে তোমরা একথা লিখেছিলে, তাই না ইউজিন? আর পরদিন সকালে গোটা প্যারি জেগে উঠলো নতুন সাজে? টাউন হলের মাথার উপর লাল পতাকা পত্ পত্ করে উড়ছে আর হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে বুর্জোয়াদের সেনাবাহিনী। তুমি, জাঁক, পিয়ের, নিকোলা সবাই মিলে সকাল থেকেই টাউন হলের সামনে। দুপুর একটায় তোমরা দখল করলে অর্থ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ঠিক এক ঘণ্টা পরেই জয় করে নিলে নৌবাহিনী ও যুদ্ধ দফতর। তারও কিছুক্ষণ পরে টেলিগ্রাম অফিস ও সরকারী মুখপাত্রের কেন্দ্রীয় দপ্তর। শ্রমিকদের প্রতিরক্ষা বাহিনী সেদিনই কমিউনিস্ট নেতাদের মৃত্যুদ- প্রদানকারী কোর্ট মার্শালকে বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করলো। উল্লাসে ফেটে পড়েছিলে সেদিন তোমরা? তুমি, নিকোলা, জাঁক আর পিয়ের? শ্যাম্পেন ত’ বড়লোকের পানীয়। তবু বাড়ির পুরনো রূপার একটি বাটি বন্ধক দিয়ে সেদিন তুমি কেভিয়ার আর শ্যাম্পেন খেয়েছিলে, বন্ধুদেরও খাইয়েছিলে?
...এক সপ্তাহের মাথায় প্যারিতে ঝলমল করছে আলোর বন্যা। প্যারির স্বাধীন শ্রমিকশ্রেণী আজ তাদের সরকার নির্বাচন করবে। নির্বাচনের হলগুলোর সামনে আর কোন পুলিশ নেই, সন্ত্রাস নেই, ষড়যন্ত্র নেই। দু’লক্ষ সাতাশি হাজার ভোটারের ভেতর দু লাখ ‘ছোটলোক’ ভোটার তোমাদের ‘ছোটলোক’দের দলকেই ভোট দিল, তাই না ইউজিন? রাইফেলের বেয়নেটের ডগায় টুপি পরিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক সেই বেয়নেটধারী স্পর্ধিত বন্দুক তুলে ধরলো আকাশের দিকে। গোটা টাউন হলে লাল স্কার্ফের অগ্নি বন্যা। টাউন হলের মাঝখানের উঁচু পাটাতনে নির্বাচিত শ্রমিক নেতারা এলেন। প্রত্যেকের কাঁধে জড়ানো লাল স্বার্ফ। শ্রমিক নেতা রানভিয়ের বললেন, ‘বন্ধুরা, আজ আমি...আজ আমি এতটাই উদ্বেলিত যে কোন কথাই বলতে পারছি না। প্যারির সাধারণ মানুষ গোটা পৃথিবীর সামনে যে উদাহরণ রেখে গেলেন, তার জন্য আমি তাদের ধন্যবাদ জানাই। আর কিছুই আমার মনে আসছে না।’ এক সেকেন্ড থেমে রানভিয়ের ঘোষণা করলেন: ‘সাধারণ মানুষের নামে প্যারি কমিউন প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করছি!’
‘ভিভরে দো লা রিপাব্লিক! ভিভরে লা রেভল্যুইশিও!’
গলা থেকে লাল স্কার্ফ খুলে তোমরা সবাই নাচা শুরু করলে। পিয়েরের প্রেমিকা মার্থা, জাঁকের বউ শার্লি, নিকোলার প্রেমিকা এলিজা...সবাই মিলে হুল্লোড় তুলে নাচ! জানালা, ঝুল বারান্দা, ছাদ থেকে মেয়েরা উড়িয়ে দিল লাল রুমাল। হাজার হাজার লাল পতাকা উঠে এলো আকাশে। যেন গোটা পারি এক মস্ত আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেই আগুনে যা কিছু নোংরা, মন্দ, কদর্য, পুরনো আবর্জনার স্তুপ সবকিছু পুড়িয়ে নতুন সৃষ্টি ডেকে আনবে।
Ouvriers, paysans, nous sommes
Le grand parti des travailleurs
La terre n'appartient qu'aux hommes
L'oisif ira loger ailleurs
Combien de nos chairs se repaissent
(Workers, peasants, we are
The great party of labourers.
The earth belongs only to men;
The idle will go to reside elsewhere.
How much of our flesh have they consumed?)
৯. ইশসৃগত সাতদিন প্রজন্ম চত্বরে আসতে পারে নি আর এর ভেতরেই এত কিছু ঘটে গেছে? মানুষ আর মানুষ চারপাশে। আসতে আসতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। রিক্সা আজ তাকে থামিয়েছে চারুকলার সামনে। ওদিক থেকে ভিড় ঠেলে আসতে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাতে আজ ফারহানা পরেছে শাড়ি। কিন্তু এই ভিড়টা যেন ছয়, সাত বা আটের ভিড়ের থেকে একটু কি আলাদা? সেই ভিড়গুলোতেও একাই ঢুকেছিল ফারহানা। কিন্তু ভিড়ের প্রতিটা ছেলে কোন সুযোগ নেবার চেষ্টা দূরে থাক, বরং বোনের মত জায়গা ছেড়ে দিয়ে, দরকারে অভয় নিরাপত্তার বেষ্টনী দিয়ে তাকে পার করিয়েছে। কিন্ত আজ যেন সন্ধ্যার অন্ধকারে না চাইতেও কেমন একটি অনাকাঙ্খিত স্পর্শ, হঠাৎই লোভী, পুরুষালি হাতের চকিত চাপের ছোঁয়া তাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। কারা ঢুকছে, কারা ঢুকলো ভিড়ে? পৃথিবীতে কিছুই কি বেশিদিন নির্মল থাকে না, থাকবে না নাকি থাকতে নেই? না, এসব কি ভাবছে ফারহানা? নাকি পুরুষের পৃথিবীতে একা মেয়ের নিত্য চলা চলতে চলতে তার ভেতরেই সব সময় তাড়া করে ফেরে এক অকারণ ত্রাস আর সংশয়? ভিড় ঠেলতে ঠেলতে যথারীতি শাহবাগের ফোয়ারার সামনে এসে বসে সে। দেখতে দেখতে অমন ভিড়েই কিছু চেনা মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায়। যদিও প্রচুর মানুষ, শ্লোগানে-গানে আজো গমগম করছে, তবু অনেকের মুখেই ম্লান ছায়া।
‘সরকার থেকে বলছে আজই উঠিয়ে নিতে হবে মঞ্চ।’ ফারহানার ক্যাম্পাসের দু’টো জুনিয়র ছেলে জানালো।
‘কি বলছো তোমরা? অয়ন, রাশিদুল...চা খাবে?’
‘হ্যাঁ আপা...চা চলতে পারে!’
আজ ফারহানা বলেই এসেছে শ্বশুরবাড়িতে যে শাহবাগ থেকে সে সোজা বাবার বাসায় যাবে। মেজ আপা বিদেশ থেকে এসেছে।
‘মনটা খারাপ লাগছে আপা। শেষপর্যন্ত সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে কিনা, জামাতে ইসলামী বন্ধ করতে সরকারে আইন পাশ হবে কিনা কে জানে? জানেন, অনেক শিবিরের মানুষ ঢুকে পড়ছে ভিড়ে। আমাদের মানুষদের পকেটে গাঁজার ছিলিম ভিড়ের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে ছবি তুলে পরে ওদের ওয়েব-সাইটে আপলোড করে বলছে এটা গাঁজার আড্ডা। সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েদের ছবি ফটোশপ করে জঘন্য পোশাকের ছবি জুড়ে দিয়ে বলছে শাহবাগে সেক্সের আড্ডা। আজ বিকেলে এক বান্ধবী বলছিল শুরুর দিকে ভিড়ের ভেতর কোন বাজে টাচ পায় নি, এখন নাকি পাচ্ছে। এটা নিশ্চিত জামাতিদের কাজ?’
‘তাই? আশ্চর্য, আজ না আমারও তেমন মনে হচ্ছিল!’
রাত প্রায় দশটার মত বাজে। বাসায় যাবার জন্য উঠবে কি ফারহানা? কাল থেকে এই মঞ্চ উঠে যাবে? হঠাৎই মূল মঞ্চ থেকে একটি ঘোষণা এলো, ‘বন্ধুরা! আমাদের কাছে একটি অত্যন্ত দুঃখজনক সংবাদ এসেছে। ব্লগার রাজিব হায়দার যিনি থাবা বাবা নামে ব্লগে লিখতেন, তিনি তার বাড়ির কাছে দুঃখজনক ভাবে খুন হয়েছেন। আমরা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মঞ্চ না উঠানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।’
অয়ন আর রাশিদুল সাথে সাথে লাফ দিয়ে উঠে নাচতে থাকে। সে কি নাচ! নাচ আর থামেই না!
‘কি আনন্দ আপা! দাঁড়ান, ঘুইরা আসি একটু!’
ওরা একটু তফাতে সরে না যেতেই জুয়েলের সাথে দেখা। কট্টর বামপন্থী ছিল। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে জুয়েলের কি একটু বাধে? ফারহানার নিজের বাবা আওয়ামি লীগার হলেও ক্যাম্পাসে বামপন্থীদের সাথে মেলা মেশা বেশি ছিল বলে ফারহানা ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিত না। কিন্তু শাহবাগ আন্দোলন ত’ এই ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান আবার ফিরিয়ে আনছে!
মূল মঞ্চের মাইক্রোফোন থেকে বিস্মিত, শোকার্ত আর ক্রুদ্ধ গলার শ্লোগান আসছে, ‘শহীদ রাজিবের মৃত্যু বৃথা যেতে পারে না- শহীদ রাজিবের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না! শাহবাগ জেগে আছে- শাহবাগ ঘুমায় না! জয় জয় জয় বাংলা! জয় শাহবাগ! জয় প্রজন্ম! জয় জনতা!’
ফারহানা লক্ষ্য করলো সে ‘জয় বাংলা’ বললেও জুয়েল ‘জয় বাংলা’ বলছে না। তবে ‘জয় প্রজন্ম,’ ‘জয় শাহবাগ,’ ‘জয় জনতা’ বলছে!
মঞ্চ ভেঙ্গে যাবে বলে যারা বাসায় ফিরে যাচ্ছিল তারা আবার ফিরছে। স্তব্ধ বিস্ময় ভেঙ্গে সবাই শ্লোগান দিচ্ছে,
‘জামাতে ইসলাম/মেড ইন পাকিস্থান/
মেড বাই পাকিস্থান/ জামাতে ইসলাম!
ই-তে ইবনে সিনা/ তুই রাজাকার, তুই রাজাকার!
ম-তে মেডিনোভা/ তুই রাজাকার/তুই রাজাকার!
দ-তে দিগন্ত টিভি/ তুই রাজাকার, তুই রাজাকার!
জেগে আছে শাহবাগ/ জেগে আছে বাংলা!
শাহবাগ জেগে থাকে/শাহবাগ ঘুমায় না!
পাকিস্থানের প্রেতাত্মারা/পাকিস্থানে ফিরে যা!’
রাত প্রায় এগারোটা বাজে। বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি দু’টোই খুব বেশি প্রগতিশীল না। বাবার বাড়িই শাহবাগ থেকে কাছে। দ্রুত একটা রিক্সা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা করে ফারহানা। আধা ঘণ্টায় পৌঁছে যায়।
কলিং বেল টিপতেই মেজো আপা দরজা খোলে, ‘শাহবাগ থেকে মাত্র ফিরলি? জানিস, ব্লগার থাবা বাবা যে মারা গেছে? টিভিতে বললো!’
‘হুম- রাজিব হায়দার নামে একজন মারা গেছে জানি...’
‘সে-ই ত’ থাবা বাবা নামে লিখত। তুই ত’ আর ব্লগ পড়িস না। আমি বাবা লন্ডনে থাকি বলে দেশের সব পেপারের ই-ভার্সন আর ব্লগ পড়তে হয়! ছেলেটা নাস্তিক ছিল। তা’ নাস্তিক হওয়া কি দোষের? তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নাই? তাই বলে তাকে খুন করতে হবে? কবে আমরা একটু সভ্য হবো?’