শত কণ্ঠে আবার গর্জে উঠলো বাংলাদেশের কিশোর কিশোরী ছাত্র ছাত্রীরা।
অবশেষে বাংলাদেশের কথিত সফল শিক্ষামন্ত্রী এবং তদীয় মন্ত্রণালয় নড়ে চড়ে বসলেন। নিয়মের পর নিয়মের নিগূঢ় বন্ধনে শেকলপরা বাংলাদেশের ছাত্র ছাত্রীরা েই নিয়ে বার দুয়েক সরব প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে। প্রথমত , সেই দুজন শিক্ষার্থীকে দলে পিষে মারার প্রতিবাদে নিরাপত্তা সড়ক চাই এর দাবিতে। আর দ্বিতীয়ত অরিত্রী অধিকারীকে “নিহত” হতে বাধ্য করার প্রতিবাদে। দুটো দাবিরই শ্লোগান ছিল এক, বিচার চাই।
প্রাথমিক বিচার হয়েছে। আরো বিচার হচ্ছে এবং হবে। ৯ জানুয়া্রি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে আদালত। প্রমাণ হলে দণ্ডবিধির ৩০৫ ধারায় করা এই মামলায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড। এ ধারায় সর্বনিম্ন শাস্তি দশ বছর কারাদণ্ড, সেই সঙ্গে অর্থদণ্ড। তা ছাড়া আসামির বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণিত হলে তাকে যাবজ্জীবন করাদণ্ডও দেওয়া যাবে।
তার আগে আমরা আরেকবার জেনে নিই, স্বনামধন্য ভিকারুন্নেসানুন ইশকুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর অপরাধ কী ছিল, সে বিষয়ে ।
অপরাধ ঃ পরীক্ষা চলাকালীন সময় মোবাইলে নকল করেছে অরিত্রী এবং তা ধরা পড়েছে তার শিক্ষকের কাছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি অন্যায় নাকি অপরাধ ?
এবার আসি অপরাধ এবং অন্যায় বলতে আমরা ঠিক কী বুঝি সে বিষয়ে । অপরাধ হচ্ছে এক বা দলীয়ভাবে এমন কিছু সাংঘাতিক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলা , যা আইনের পরিপন্থী। যাতে মৃত্যু, ক্ষয়, দেশান্তর, হত্যা এবং হত্যাচেষ্টায় প্ররোচনা দেওয়া, খুন করা বা খুন হতে বাধ্য করা বা প্ররোচনা দেওয়া, আগুন দেওয়া, সম্পত্তি নষ্ট করাসহ ইত্যাদি।
আর অন্যায় কাকে বলে ! অন্যায় হচ্ছে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতে এমন কোনো কাজ করা যা করা ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের উচিত নয়।
আমাদের অরিত্রী এই অন্যায়টি করেছিল বলে তার ইশকুলের অধ্যক্ষ এবং শিক্ষকদের বক্তব্য। কিন্তু এই অন্যায়ের বিপরীতে তারা অরিত্রী এবং তার বাবা মায়ের সাথে যা করেছে তা অপরাধ। এই পৃথিবী থেকে অরিত্রীকে “খুন” হতে বাধ্য করেছে এই অধ্যক্ষ এবং তার শিক্ষকরা।
দেশে দেশে যখন শিক্ষাব্যবস্থাকে সহজ সরল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে, যখন পরীক্ষা নামক ভয় থেকে ছাত্র ছাত্রীদের মুক্ত করতে পরীক্ষা ব্যবস্থাই তুলে দেওয়া হচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশ জেঁকে বসে শিক্ষা বাণিজ্য করে যাচ্ছে। পরীক্ষা দেওয়া, পাশফেল শিক্ষকদের হাতে থাকা, ফলে কোচিং করাসহ ইত্যাদি উপায় বের করে ছাত্র ছাত্রীসহ তাদের বাবামাকে আর্থিক এবং মানসিকভাবে শোষণ করা ইত্যাদি।
অভিভাবকরাও তেমন গাড়ল । ছেলেমেয়েদের দাবড়িয়ে তেজী ঘোড়ার মত ছুটিয়ে নিতে ব্যতিব্যস্ত থাকছে সর্বক্ষণ। তারা একবারও ভেবে দেখে না তাদের সন্তানকে তারা কোথায় পাঠাচ্ছে। যেনো ভিকারুন্নেসানুন ইশকুল এন্ড কলেজই একজন ছাত্রীর শেষ গন্তব্য। এই ইশকুল এন্ড কলেজের ছাত্রীরাই কি কেবল সফল বাকীরা দেশ বিদেশ জুড়ে ঘাস কাটছে আর কলা চিবুচ্ছে !
এ পর্যন্ত এই ইশকুল এন্ড কলেজের যাঁতাকলে পড়ে অনেক ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। অনেক ছাত্রী এই কলেজে পিতামাতা সহ অপমানিত হয়ে টিসি পেয়েছে। একটি ইশকুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা যখন নির্দয় আর অমানুষ হয়ে ওঠে তখন সেই শিক্ষাকেন্দ্র রাক্ষসরাজ্যে পরিণত হয়। এই জাতীয় শিক্ষকদের বিচার না হলে আগামীতে এরা আরো নৃশংস হয়ে ছাত্রীদের সাথে এমন নিষ্ঠুর খেলা খেলে যাবে। আরো অরিত্রীরা মৃত্যুর কোলে ঝরে পড়বে আর আমরা আমাদের কিশোরী মেয়েগুলোর ছবি দেখে কেঁদে বুক ভাসিয়ে অন্য মেয়েটিকেও ঠেলে দেবো এসব ইশকুলের পাতা মৃত্যু ফাঁদে।
এসব ইশকুলের অধ্যক্ষা মাননীয়রা ছাত্রীদের বয়স, স্বাভাবিক অনায়বোধ, সহজাত অভিমান না বুঝে অমানবিক এবং বিকৃত মানসিকতার শিক্ষকদের চরমতাকে বিবেচনা করে অভিভাবকসহ ছাত্রীদের হরহামেশ অপমান করে থাকে। এদের না আছে আত্মমর্যাদাবোধ, না আছে অন্যদের মানব মর্যাদাবধের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। ছোটবড়, ছেলেমেয়ে, ধনী নির্ধনের মানবমর্যাদা বোধে আঘাত করা যে অপরাধ— এই শিক্ষা, শিষ্ঠাচার, প্রয়োজন এবং ভব্যতা সভ্যতা তাদের নেই। এসবের ধারও তারা ধরে না। কেননা একজন অরিত্রী মরে গেলে আরো দশজন অরিত্রী অই সিটে ভর্তি হওয়ার জন্যে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সাথে আছে তাদের বাবামায়েরা।
অত্যন্ত দ্রুততার সাথে শিক্ষামন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে এই প্রথম এ ইশকুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু অরিত্রী কি ফিরবে ? ওর বাবামা কি ফিরে পাবে কাঠগোলাপ কানে গোঁজা হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল মেয়েটিকে ?
শত শত ছাত্রছাত্রী বিচার চেয়ে পথে নেমেছে। তাদের অশ্রুবিদ্ধ মনে শিক্ষক আর শিক্ষাকেন্দ্র সম্পর্কে ঘৃণার ধারণা তৈরি করে দিয়েছে এই সব ইশকুল আর কলেজগুলি।
সরাসরি মেরে ফেলা আর মরে যেতে প্ররোচনা দেওয়ার আইনগত শাস্তি আছে। বরখাস্ত আর বেতন বন্ধ করার শাস্তি বিধান করা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু অরিত্রী হত্যার বিচার চাই, চাই ভিকারুন্নেসানুন ইশকুল আর কলেজের মত এধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি রাক্ষস রাক্ষসীদের যথেচ্ছাচারের বিকৃত মানসক্ষেত্র থেকে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন অভয়কেন্দ্র হয়ে উঠুক।