১)নারী ও সংসার।
'তবুও আমি স্বামীর ভাত খেতে চাই।'
বায়না আর কি, চাইলেই দিচ্ছে কে ! বরং স্বামীর উত্তর হতে পারে, ' ওরে আমার কে রে ! আমি যে কেবল কিল মারবার গোঁসাই।'
কোন কম্পানী কত ডিসকাউন্ট দিচ্ছে প্রডাক্টে তার জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনের প্রতীকী মর্যাদা হরণ করতে হবে নাকি, যখন এখনো গ্রামে গঞ্জে এবং শহরেও সমাজ এবং পিতৃতন্ত্র কিল মারার গোঁসাইয়ের ভূমিকাতেই রয়ে গেছে!
কত কত দিন সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে, ভ্যালেন্টাইনস ডেতে কত জাঁক, সেসব দিনে ব্যবসা ভালো হয় কিনা, তাই তাদের অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণের দায় নেই কোন গয়না উৎপাদকের।
সব ব্যাটাকে ছেড়ে বেড়ে বেটাকে ধরার এই প্রবৃত্তি আসে একটি বিশেষ মানসিকতা থেকে যে মেয়েরা লিঙ্গের কারণে চরম সুবিধাভোগী। ট্রামে বাসে তাদের সিট আলাদা, তারা বিশেষ সামাজিক সম্মানের অধিকারী, মাতৃরূপেন সংস্থিতা। এমন কি দেশের আইন আদালত তাদের স্বপক্ষে আইন প্রণয়ন করেছে। ফলে ডিসকাউন্ট-অজুহাতে নিজেদের প্রতীকী সম্মান জানাবার এই দিন, উৎসাহ উদ্দীপনা ভরে ওঠবার এই অছিলাকে মোমবাতির মতো এক ফুঁয়ে নিভিয়ে দাও।
শুরুর সংলাপটি একেবারেই কাল্পনিক নয়। নির্যাতিতা মেয়েদের কান্না শুনছিলাম শহর থেকে দূরে এক এন জি ওর শেল্টার হোমে। ছ'টি মেয়ের মধ্যে পাঁচজনই স্বামীর 'ভাত' খেতে চায়। এমনকি চারবার হাতবদলের পর আশ্রয় পাওয়া ঈষৎ মানসিক টালমাটাল মেয়েটিও মুখে হাসি নিয়ে বলে, 'আছে আছে, ভালো ছেলেও আছে। তারা এইরকম করবে না।'
ভাত মানে তো তার কাছে শুধু আটপৌরে দুবেলার উদরপূর্তি নয়, শান্তি ও প্রেমভরা গার্হস্থ, সন্তান, এমনকি গোয়ালের গরুটিও ভাতের গন্ধের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই মায়া সেই মোহ থেকে সরে আসা অনেক শিক্ষিতা শহুরে মেয়ের পক্ষেও অসম্ভব হয়ে পড়ে।
যেমন বলি উনিশ বছরের কালো অল্প পোড়া মেয়ে সুখবাঁশির কথা। এমন রোমান্টিক নাম তার বাপ মা কি ভেবে রেখেছিল কে জানে, কিন্তু আটবোনের এক বোন সে ছোটবেলায় ধানসেদ্ধ করার উনোনে পড়ে গিয়ে অল্প পুড়ে যায়। তাতে তার দীঘল চোখ বা সরল মনের কোথাও কোন কমতি হয়নি, কেবল পাত্রপক্ষের তাকে নিতান্ত অযোগ্য ভাবা ছাড়া। তাই ক্লাস এইট অব্দি পড়বার পর গরীব বাপমা তার বিয়ে দেয় নিজেদের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে ! ৮০ হাজার টাকা, কাঁসার বাসন, গয়না দেবার পরও বিছানাপত্র দেওয়া হয়নি বলে তাকে শুতে হত মাটিতে।
বিয়ের পর সুখবাঁশি প্রেগন্যান্ট হলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় জেলাশহরের এক মেডিক্যাল সেন্টারে। সেখানে 'ছবি' তোলা নির্বিঘ্নে সাঙ্গ(কি করে হয় কে জানে !) হলে তার সব সুখ উবে যায়। স্বামী, শাশুড়ির উগ্র মূর্তিতে হতভম্ব মেয়েটি প্রতিবেশীর কাছে জানতে পারে তার পেটে রয়েছে যমজ বাচ্চা এবং তারা মেয়ে। অত্যাচার চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছলে একদিন তাকে ফ্যানে ঝুলিয়ে দেবার চেষ্টা সে কি করে ব্যর্থ করে বাপের ঘরে পালিয়ে আসে সেকথা এখন নিজেও ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতে পারেনা।
তবুও সুখ যেখানে বাঁশির মতো বাজে তার কাছে, তা তার স্বামীর ঘর। সেও সেখানকার ভাত খেতে চায়, কেউ যদি স্বামীকে বুঝিয়ে সুপথে আনতে পারে, তবে সে মেয়েদের নাম রাখবে হাসিবাঁশি আর খুশিবাঁশি। তার স্বপ্ন ফুৎকারে ওড়াতে হয়, কারণ তার স্বামীর এটি তৃতীয় বিয়ে, প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীও বিতাড়িত, তারা কোথায় কেউ জানে না। বাচ্চাগুলোকে এডপশনে দেবার কথা এই সরল মেয়েটিকে বলতে ভয় হয়, কারণ স্বপ্ন ছাড়া মানুষ বাঁচে না, আসন্নপ্রসবার পথ্য আর যত্নের সঙ্গে স্বপ্ন না মিশলে আরোগ্য কঠিন হয়।
বিয়ে একটা ইন্ডাস্ট্রি, পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ করে গঙ্গার এপারের এই প্রাচীন ভূখন্ডের গ্রামাঞ্চলে। ক্যাশ ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে বিয়ে করা, তারপর সেগুলো রেখে তিন চারমাসের মাথাতেই বধূ বিতারণ। আবার বিয়ে, আবার পণ। বাপ মায়েরা খবর পেলেও কখনো অসহায়, কারণ এক মায়ের জবানীতে, 'এই জাতের মধ্যে বড় কথা।' সব জাতেই এখনো পুরুষমাত্রেই কুলীন।
আইবুড়ো মেয়েকে নিয়ে কথা সব জাতেই। বড় জ্বালা ওঠে, ফোস্কা পড়ে সমাজের গায়ে। আইবুড়ো অবস্থায় সে বাইরে গেলেই সন্দেহ খারাপ কাজে যাচ্ছে। বিয়ে তাই এই রাজ্যেও সামাজিক অসম্মান এড়াবার অন্যতম রাস্তা। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী কোন কিছুই এই দৃষ্টিভঙ্গীর তেমন রূপান্তর ঘটাতে পারেনি এখনো। গাইগরুর মূল্য মেয়ের চাইতে বেশি, তাই পণের পাখার হাওয়া খাওয়া বধূটির কপালে জোটে না। অবিশ্বাস্য লাগলেও অনেক বাড়িতে গাভীন গরুর গোয়ালে ঘোরে সে পাখা।
আমরা ভাবি খাপ পঞ্চায়েত এ রাজ্যে নেই। ওসব গোবলয়ে হয়। একেবারেই ভুল ধারণা। এন জি ও গুলির তথ্য ভান্ডার ঘাঁটলেই দেখা যাবে এখানে খাপ পঞ্চায়েতের উদ্যোক্তা স্বয়ং পুলিশ। গার্হস্থ হিংসার ঘটনায় দু পক্ষকে ডেকে তারা মিটমাট করে নিতে বলে। কিছু টাকার বিনিময়ে স্বামীটির স্বেচ্ছাচারকে আইনি তকমা দেবার চেষ্টা করে। এতে দু তিনটি উদ্দেশ্য সাধিত হয়।
এক, এলাকাকে শান্তিময় দেখানো, দুই আদালতের ঝামেলা এড়ানো এবং সর্বোপরি জাতীয় অপরাধপঞ্জীতে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সে রাজ্য যেন এগিয়ে না থাকে সেটি সুনিশ্চিত করা। কন্যাপক্ষও আদালতে দৌড়োদৌড়ি, উকিলের পয়সা দেবার অপারগতা, এবং পণের টাকার যেটুকু ফেরত আসে তাইই সই, এই মনোভাব থেকে পুলিশি মধ্যস্থতায় রাজি হয়ে যায়। আর স্বামীটি পুলিশের পকেটে কিছু ঢুকিয়ে নিশ্চিন্ত প্রস্তুতি নিতে থাকে পণসহ পরবর্তী শিকারটির জন্য।
এছাড়া 'সমাজ' নামক খাপ পঞ্চায়েত তো রয়েইছে। পুলিশের কাছে না যাবার জন্য এবং আদালতের সাহায্য না নেবার জন্য এইগুলিতে প্রবল চাপ সৃষ্টি করা হয়।
২)নারী ও লোক আদালত।
এইখানে দৃষ্টান্তমূলক কাজ করছে লোক আদালত এবং এবং কিছু স্থানীয় এন জি ও।নির্যাতিত মেয়ে ও তার পরিবারকে এন জিও ভলান্টিয়াররা বোঝাচ্ছে কোন ফয়সালা যদি করতেই হয় তা থানায় হবে কেন! পারিবারিক লোক আদালতে ফয়সালা হলে মেয়েটি অনেক বেশি অর্থ পাবে। শুধু তাইই নয় মহিলা কমিশনের নির্দেশে পুলিশই তখন তাকে সুরক্ষা দিতে বাধ্য। ডেট পড়লে এন জিও ভলান্টিয়ারই মেয়েটিকে পরিবারের লোকসহ আদালতে নিয়ে যাচ্ছে। একদিনে ফয়সালা হয়না, কোর্টের নির্দেশেই ঠিক হয় মেয়ে তখন শেল্টার হোমে থাকবে না বাবার বাড়িতে। যেখানেই থাকুক অত্যচারের হাত তখন তাকে ছুঁতে ইতস্তত করে। যেমন হয়েছে আসন্নপ্রসবা সুখবাঁশির ক্ষেত্রে। বাচ্চা ভূমিষ্ঠ না হওয়া অব্দি সে মায়ের কাছে রয়েছে আদালতের নির্দেশে। কেস চলছে। যদি আর ফিরে যাবার সম্ভাবনা একেবারে বিনষ্ট হয়েই যায়, তবু পণের আশি হাজার ফেরৎ পেলেই অনেক। তার বাপ মা যে বড় গরীব, আর এখনো দুটো বোন বিয়ের বাকি, সুখবাঁশির হাতদুটো স্ফীত পেট চেপে ধরে, চোখের কোণা চিকচিক করে।
জেলার এই পারিবারিক লোক আদালতগুলি ডিস্ট্রিক্ট লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটির আওতাভুক্ত। স্টেট অথরিটি অব লিগ্যাল সার্ভিসেস ডি এল এস এর মাথার ওপর রয়েছে। এরা নির্যাতিতার জন্য সম্পূর্ণ নিখরচায় আইনি সাহায্যের ব্যবস্থা করে থাকেন। ২৫ জন নির্যাতিতার কেস কিছু আগে বহরমপুর ডি এল এস এর কাছে পাঠানো হয়েছিল। তাদের মধ্যে একটি চল্লিশ হাজার টাকায় রফা হয়েছে, যেখানে প্রথমে নির্যাতনকারীরা প্রায় নিখরচায় বধূ বিতারণের ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছিল। কয়েকজনের বিপদের আশংকা থাকায় তারা বাবার বাড়িতে রয়েছে। বেশিরভাগ মিটমাটে ইচ্ছুক থাকায় তাদের পতিগৃহে পাঠানো হয়েছে, আর অত্যাচারের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে।
৩)আদালতের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে।
এখন এই মায়া, এই বশ্যতা স্বীকারের প্রবণতা কন্যাসন্তান খুব ছোট থেকে অর্জন করে পরিবার, পারিপার্শ্ব এবং সমাজের তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। সংসার আগলে রাখা তার প্রধান কর্তব্য, কারণ সে ঘরের লক্ষ্মী, মাতৃত্বেই তার সেরা পরিণতি এসব তার মাথায় ঢুকে যায় অতি মসৃণভাবে, অত্যন্ত শিশুকাল থেকেই। নির্ভরশীলতাই তার নারীত্বের প্রধান লক্ষণ হয়ে ওঠে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
এই মেয়েকে শুধু অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার গল্প শোনালে নারীমুক্তি কতটা সার্থকতা অর্জন করবে তা বোঝা বড় মুশকিল। একটি ছাগল, কয়েকটি মুরগি বা একটি সেলাই মেশিন তার সার্বিক মুক্তি আনবে কি ? নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ এবং মর্যাদাপূর্ণ বাঁচার জন্য দরকার যে মানসিক ধাঁচা তার জন্য মাছ চাষ, সেল্ফ হেল্প গ্রুপ, ছাগদুগ্ধ বা ডিম বিক্রয় কোনটাই যথেষ্ট কার্যকরী হয় না, যদি না অর্থনৈতিক দিকটির সঙ্গে সঙ্গে নারীমুক্তির রাজনৈতিক তাৎপর্যটিও মাথায় না রাখা হয়। সার্বিক নারীমুক্তি মূলত একটি পরিশ্রমী ধারণা যেটি শুরু থেকেই প্রশ্নহীন লিঙ্গানুগত্য বর্জন করতে শেখাবে, অন্যান্য দমনমূলক ধাঁচার চিনহিতকরণ ও তার বিরুদ্ধাচরণ শেখাবে, এবং সবশেষে সামূহিক রাজনৈতিক চেতনার অগ্রগমনকে সম্ভব করবে।
আমাদের দেশে ও রাজ্যে কোথাও এই লক্ষ্যে কোন কাজ হয় না, তার বদলে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, হাঁসমুরগি, সেলাইমেশিনের নারীমুক্তির প্রয়াস চলতেই থাকে, সুখবাঁশিদের সুখবর্জিত অত্যাচারিত অস্তিত্ব সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি ও আদালতের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকে।
রাজনীতিবর্জিত এই "মুক্তি" আর যাকেই হোক সেই নারীটিকে মোটেও কোথাও এগিয়ে নিয়ে যায় না, যার মুক্তির জন্য বিদেশি এন জি ও থেকে স্বদেশী নারীবাদী, সবাই বেজায় ব্যস্ত।