আরে কোন ব্যাঙ্কের লোগো যে হতে পারে একটি হৃষ্টপুষ্ট গাভীন গাই এই লোক আদালতে না এলে কোনদিনও জানতে পারতাম কি ! গাইগরুতে এল্যার্জি ছোটবেলা থেকেই। নিজেদের গ্রামের বাড়ির বিরাট গোয়ালে গোবর আর গোমূত্র শুঁকে। আমি যেতাম রাধারানীর টানে, সে আমাদের বাগালের মেয়ে, গোয়াল পরিষ্কার করত, তবে আমারই বয়সী বলে মেলামেশায় বাধা দেওয়া হত না। পাকরি নামে গরুটির বাচ্চা হবার সময় সেইই চুপি চুপি আমায় ডেকে নিয়ে গেছিল। আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে বেড়ার ফুটোতে চোখ দিয়ে দাঁড়িয়ে আর ভেতরে শুশ্রূষারত তার বাবা। গোয়ালের আধো অন্ধকারের সেই ছবিটা চোখে আছে আজও।তখন কি আর জানতাম নিজের, মানে একবিংশ শতকের ভারতবাসীর জন্মবৃত্তান্তের দর্শক হচ্ছি আর ওই পরমাণুজাত তেজস্ক্রিয়ারোধী মূত্র মলের ওপর গবেষণার জন্য কাউকে ডিলিট দেওয়া হবে মহা সমারোহে !
যাক, এটা গরু বা মানুষ জন্মাবার বা বেদে কি আছে তার গল্প নয়, এমনকি রাধারানীরও নয়, কারণ বহুদিন আগেই মায়ের মুখে শুনেছি তাকে স্বামী, শাশুড়ি মিলে ঝুলিয়ে দিয়েছিল বাঁশের আড়ায়। বাছুর হয়নি বলে।
এটা লোক আদালতের ঘটনা। যদিও সেটা কি বা কেন এটা নিয়ে সাধারণের ধারণা দু হাজার আট সালের অসামরিক পরমাণু চুক্তির মতোই ধোঁয়াটে। সরকার পড়ে গেল তবু খায় না মাথায় মাখে গোছের চাউনি। তেমনি ব্যাংকের দেনা শুধতে পারা যাচ্ছে না, কিন্তু লোক আদালতের নামও শুনিনি। সেদিন আদালতের সামনে গায়ে আগুন ধরিয়ে মরল এক যুবক, কাগজে এই খবরটা পড়ে এইরকমই প্রতিক্রিয়া হল আমার। তবে একটা সীমার পর লোক আদালতেরও আর কিছু করার থাকে না। হয়ত ছেলেটি সেই চূড়ান্ত সীমারেখাটি পার করে ফেলেছিল।
যেটুকু না বললেই নয় একেবারে সেটুকুই বলি। কারণ পরে এ নিয়ে বিস্তারিত লেখালিখির ইচ্ছে আছে। যেহেতু এদেশের বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত শ্লথ আর ব্যয় বহুল, National Legal Services Authority র অধীন এই লোক আদালতের মূল কাজ হচ্ছে মধ্যস্থতা করা। সে মধ্যস্থতা হতে পারে গার্হস্থ অশান্তি বা ক্লাবের রাস্তা বানানো নিয়ে, তবে মূলত এই মধ্যস্থতা আর্থিক। অর্থাৎ যে লোন নিয়েছে আর যে দিয়েছে, তাদের দু পক্ষকে একসাথে বসিয়ে সমঝোতা করিয়ে দেওয়া। যে লোন শোধ হবার আর কোন চান্সই নেই তারও খানিকটা আদায় হয়ে যায় এই পদ্ধতিতে। সে লোন হতে পারে যে কোন ব্যবসা শুরুর জন্য, ছেলেমেয়ের পড়া চালাবার জন্য, এমনকি মোবাইলের বিল বাকী রাখা কেসও কম মেটালুম না এতো বছরে। মোবাইল কমপানীগুলো ছাড়াও যত বেসরকারি ও ন্যাশনালাইজড ব্যাংক প্রত্যেকের খুব উৎসাহ তাই লোক আদালতে। যা কোনদিনই পাওয়া যাবে না, তার ফিফটি পার্সেন্ট উঠে এলেই তো হাতে চাঁদ পাওয়া। তবে যারা খবর রাখেন তারা আবার ইচ্ছে করে লোন শোধ করেন না, কবে লোক আদালতের ডাক পাবেন আর ফিফটি পার্সেন্টে রফা করবেন সেই আশায়।
তবে দুষ্টু লোক আমার চোখেও পড়ে কম, তাই যত কেস মিটিয়েছি তার নব্বই শতাংশ বড় গরীব এবং ধান্ধাবাজি কাকে বলে জানেন না। এদের মধ্যে, হিসেব কষে দেখে নিয়েছি, তপশিলি আর সংখ্যালঘুর হার সবচেয়ে বেশি। বেশির ভাগই গ্রামীণ জনতা, ছোট ব্যবসায়ী। আর উপজাতিয়রা সবচেয়ে কম, তথাকথিত শহুরে বাবুর মতই। আর কম নারী। এদের মনে হয় মোবাইল ব্যবহার করতেও লাগে না, নিজের ব্যবসা শুরু করা তো দূরস্থান।
যারা বেশি তারা কেন বেশি সেটা পরিষ্কার হয় যখন দেখি তপশিলি আর সংখ্যালঘু স্কুলছুট বেড়েই চলেছে। ২০১৪-১৫ সালে সংখ্যা লঘু স্কুলছুট প্রাথমিকে১.১১।পরের বছরই সেটা হল ২.২৬। উচ্চ মাধ্যমিকে তফশিলি স্কুলছুট ৩.৮৬ থেকে বেড়ে একবছরে হলো ৫.০৬ শতাংশ। অই স্তরে সংখ্যা লঘুর হার ৪.৩৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হল ৫.৭০শতাংশ। গোড়া কেটে দিলে আগায় জল ঢালা ছাড়া আর কিই বা করার থাকে লোক আদালতের !
ইংরেজির মাস্টার আদালতে কি করে এই ন্যায্য প্রশ্নের উত্তর অন্যদিন, কিন্তু এটা বলতেই হবে মিনি ভারতবর্ষ দেখার সুযোগ করে দিয়েছে আমাকে এই আদালত। কত যে বিচিত্র মানুষ, কত চাপা কান্না, লুকোনো গল্পের গন্ধ আদালত চত্বরে ! সিটি সিভিল কোর্ট, হাই কোর্ট সর্বত্র ঘোরার শেষে মনে হয়েছে গাই বাছুর নয় কিছু মানুষের কাছাকাছি আসা গেল।
আগেই বলেছি মানবীর সংখ্যা লোক আদালতে নগণ্য। পিতৃতান্ত্রিকতা,অবরোধ, অশিক্ষা, গার্হস্থ্য হিংসার বাধা টপকে বাইরের পৃথিবীটা দেখা এখনো শহরের চৌহদ্দির বাইরে গ্রামেগঞ্জের বেশিরভাগ মেয়েদের কাছে স্বপ্ন। লড়াই করতে শিখবে কি ! নিজের ব্যবসা তো দূরস্থান। তাই হঠাৎ কাউকে তেমন দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যেমন গেল এবারে। আর কাকতালীয়ভাবে সেদিনটা ছিল ৮ই মার্চ।
পুতুলের( নামটা কাল্পনিক) স্বামী তারই নিজের বোনকে নিয়ে দেশান্তরী। দুটো বাচ্চা। একটা বসতবাড়ি। আর গাছপালার প্রতি বুনো টান। এই নিয়ে পুতুল মণ্ডল। শ্রীহীন, সস্তা শাড়ি পরা মেয়েটি শ্বশুর শাশুড়িকে বুঝিয়ে ভিটে বন্ধক রেখে গাই-লোগো ব্যাংকের কাছ থেকে লোন নিয়ে নার্সারির ব্যবসা শুরু করেছিল কয়েক বছর আগে। দু তিন বছর নিয়মমতো ব্যাংকের পাওনা সে মিটিয়েই দিয়েছে। হঠাৎ অকাল বর্ষণে নার্সারি ডুবে গেলে পুতুলের হাতে হ্যারিকেন ঝুলিয়ে দেয় তারই প্রতিবেশী। নিজের নার্সারি থেকে আল কেটে বাড়তি জলটুকু পুতুলের নার্সারিতে যাতে বেশ থিতু হয়ে দাঁড়াতে পারে রাতারাতি সে ব্যবস্থা ক'রে।
এখন রাতের অন্ধকারে আল কাটা, কে কেটেছে সাক্ষী নেই, পুতুল মন্ডল থানা পুলিশে রিপোর্ট লেখায় বটে, কিন্তু পরদিনই বুদ্ধি করে এই ব্যাংকের স্থানীয় শাখায় গিয়ে কর্তৃপক্ষকে সরেজমিন তদন্তে রাজি করায়। ফলে সে যে মিথ্যা বলছে না সে প্রমাণ রইল। কিন্তু সত্য মিথ্যার ওপর নির্ভর করে তো আর সুদের হার থেমে থাকেনা। ফলে ব্যাংকের পাওনা তার কাছে দাঁড়ায় ৬০৬৮৭২ টাকা।
আমাদের তিনজনের বিচারকের বেঞ্চকে পুতুল হাত পা নেড়ে বোঝায় বীজতলা থেকে সবুজ চারা তৈরি হতে একবছর। অনেকে বৃদ্ধি দেখেও আগাম বায়না করে। কিছু পাওনা মকুব করে তাকে ছ' মাসের সময় দেওয়া হোক। সে ইনস্টল্মেন্টে সব শোধ করে দেবে। নইলে ভিটে ছেড়ে বুড়ো বুড়িকে আর বাচ্চাদের নিয়ে সে গাছতলায় থাকবে। ব্যাংক যেন নিয়ে নেয় তার ভিটে।
আমি এক মহিলা দেখে তার স্বাচ্ছন্দ্য বোধ হয় হয়ত। সে বলে, বলতেই থাকে,
-- এ একেবারে গভভ্যের ধনের মতো। আদর চায়। যে নিশ্বাস চেপে মারলে তার বিচার ভগমান করুক। কিন্তু আপনেরা না দেখলে পুতুল কোতায় যায় ! কেউ না দেখলে সরকারও দেখবে না ! আমি রাত বিরেত মানি না, ওদের সাথে কথা বলি, গান করি, গায়ে হাত বোলাই, ওরা ফনফনিয়ে বাড়ে বাড়তেই থাকে।
পেছন থেকে স্থানীয় ব্যাংকের ম্যানেজার নিজের মাথা আঙুল দিয়ে দেখান। স্বামী চলে যাবার পর সেখানে একটু গোলমাল।
যাহোক আমরা তাকে একহাজার টাকা টোকেন এমাউন্ট দিতে বলি। ছ'টি ইনস্টলমেন্টের ব্যবস্থা করে দিলে পুতুলের ম্লান মুখে একটা হাসি। ছায়ার মতো।
আর দিনের মহিমার কারণে কিনা জানি না, ব্যাংকের রিজিওনাল মেনেজারও আপত্তি করেন না যখন মোট পাওনার পরিমাণ কমিয়ে আনা হয় সাড়ে তিন লাখে।
কিন্ত তারপর থেকে আমি বৃষ্টি -আতঙ্কে ভুগছি। অসময়ে এত জল ! এই কি বৃষ্টি হবার সময় ! না- দেখা নার্সারির ডুবন্ত চারাগাছের দম আটকে আসা ভয় দেখাতে থাকে।
এক একটা মানুষ অল্প দেখাতেই এতো জ্বালায় না !!