নবারুণের নারী প্রায়শই খানদানি খানকি। বেশিরভাগ নিষ্ঠ সমালোচক ও পাঠকের কাছে এবং স্বাভাবিক ভাবেই। মূল কারণটি বোধহয় ঐ মাণিকজোড় -- -বেবি কে আর বেগম জনসন। প্রথমজন পেট্রোলকখেকো খানকি,তো দ্বিতীয়ার কাছে 'বিজনেস ইজ বিজনেস।' সেই বিজনেসের বাড়বাড়ন্তে বন্দরে বন্দরে ভেসে বেড়াতেও সে দ্বিধাহীন। কারণ লম্ফ জ্বালিয়ে পোকা ধরার জীবন সর্বথা পরিত্যাজ্য একথা সার বোঝার মত ঘিলু আছে এই সফল আঁত্রেপ্রেনুরের মাথায়। বিশেষত সামনে যখন উন্মুক্ত সমুদ্র আর জমকালো ইয়টের প্রবল হাতছানি। বেগমকে ভাবলেই আমার ব্যক্তিমানসে কেবল স্বল্পবাসা লেডি ডায়না। সোনালি চুল, আর প্রেমিকের উদ্দাম প্রমোদতরী।
আর বেবি কে যেন কিমি কাতকার। টেবিলের ওপর তাকে নাচাচ্ছিল উন্মত্ত,অগুনতি আমেরিকান সোলজার। চুম্মা দে দে। যেই মুখে গুঁজে দিল সোহাগের সাদা সিগারেট, অমনি জুম্মাবারে ইস্তাম্বুল কাঁপানো বিকট বিস্ফোরণ। কারণ "হার অনলি ফুড ইজ পেট্রোল।"
বুঝতে বাকি থাকে না এ হলো নবারুণের বিদ্রোহী সত্তার সশব্দ ফেটে পড়া।
শ্রীমতী বেচামণি সরকার এতটা খুল্লামখুল্লা না হলেও ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাকের গোপন মক্ষীরাণী। রাণী মৌমাছিটির মত অদৃশ্য, কিন্তু সব কর্মকান্ডের একেবারে মাঝখানটিতে তার উপস্থিতি।
কাঙাল মালসাটে "বাঙালি প্রতিষ্ঠানটি"র নাম AKU 47! প্রপ্রাইটার শ্রী ভদি সরকার আর তার সুযোগ্য সহধর্মিণী শ্রীমতী বেচামণি সরকার। ফিনান্সিয়াল এডভাইসর মাইকেল কালাশনিকভ। এই এ-বলে-আমায়- দ্যাখ-ও-বলে-আমায় জুটির আন্ডারে ব্যস্ত আছে অসংখ্য ফ্যাতাড়ু যারা খোঁচাতে চায়, ভাঙতে চায়। বিদ্রোহ করে গুঁড়িয়ে দিতে চায় প্রাতিষ্ঠানিকতার রাইটার্স বিল্ডিং। ফালতু রাজনৈতিক শক্তির ততোধিক ফালতু পালাবদলে তাদের কিইই বা আসে যায় !
ফ্যাতাড়ুরা হাত মিলিয়েছে চোক্তারদের সঙ্গে, যারা তাৎপর্যপূর্ণভাবে মাতৃশক্তির উপাসক। হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর লিগ্যাসির অটুট প্রবাহমানতায় বিশালস্তনী ও স্ফীতোদরার পুজামন্ত্রের কাল্পনিক ফ্যাতাড়ুসুলভ রূপান্তর হতে পারে, "ঢেপসিরা পেপসিতে লাগায় চুমুক / যতবড় পাছা তার ততবড় বুক।"
তাই মিত্রশক্তি হিসেবে বেগম জনসনের দিকে হাত বাড়াতে দ্বিধা নেই একটুও। প্রাক্তন নকশাল, পুলিশের খোচর,খুনি, কবর থেকে উঠে আসা কবন্ধ, সবাই নজর রাখছে। আর তাদের প্রাণভোমরা এই বেচামণিরা। ঘরের ভেতর বারুদ জমাচ্ছে, কখনো শাণ দিচ্ছে শুধু কাঁটা চামচেই। এই মিথ্যে উন্নয়নের শহরে যেদিন সর্বত্র শুধু ফ্যাঁত ফ্যাঁত সাঁই সাঁই, সেদিন একসাথে সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে ফুটপাথের দেওয়ালে খোদাই করা দেব দেবীদের মুখের ওপর মূত্রত্যাগ করতে। আপাত-অদৃশ্য প্রান্তিকের এই দৃশ্যমানতালাভ পর্বে আরো ধারালো হয়ে ধরা পড়বে বেচামণি বা বেগমের কন্ট্যুর।এই লড়াইয়ে সাফল্যের দায়ভাগ তাদের ফিফটি ফিফটি।
এই সহিংস প্রতিরোধ আর দাপুটে খানকিগিরি প্রায় অনুপস্থিত নবারুণের ছোটগল্পে। এখানে প্রধান নারী যারা, তারা যেন সুকুমার রায়কে সত্য প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে," ক্ষীর ননী চিনি আর ভালো যাহা দুনিয়ার, তাই দিয়ে মেয়েগুলি তৈরি !"
তবে কে না জানে নবারুণে ফেয়ার ইস ফাউল, ফাউল ইজ ফেয়ার, উল্টেপাল্টে যাহা আলো, পরমূহুর্তেই তাহা অন্ধকারের নামান্তর। তবু একথা বলাই যায় খানকিদের কাচভাঙা হাসি,অকারণ ফিসফাস আর অন্ধকারে বিড়াল-চক্ষু চলাফেরা, ছোটগল্পে সব কেবল ব্যাকগ্রাউন্ড।সামনের সারিতে হারবার্টের জেঠিমার মত ক্ষণিকলব্ধ মানবীরা। তাই ক্ষণিকা।
প্রতিবিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক গল্পে সারাক্ষণ এক ভালোবাসার মেয়ের নিঃশব্দ আনাগোনা। যাকে ট্রেণের শব্দে মনে পড়ে,নিগ্রোদের গানে মনে পড়ে,এমনকি 'কালো চোখ কুকুরদের দেখলেই আমার তোমাকে মনে পড়ে '। কখন কি ভাবে বিস্ফারণ ঘটবে এবং কে তা ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রের এখনো বাকি আছে -- -এই হুঁশিয়ারির পাশে বড় অন্যরকম আর মায়াময় সেই মেয়ের শরীরের নিজস্ব আলোর মায়া আর এক পেলব অসহিষ্ণু অন্ধকারে তাকে আড়াল করার ইচ্ছে। বার বার নাগাড়ে চার ঘন্টা ধরে ইন্টারোগেশন পর্বে মেঘ ও রৌদ্রের মতো যন্ত্রণা আর প্যাশনের দ্রুত পালাবদলের সাক্ষী হয়ে থাকি আমরা।
চারঘন্টা পর খেতে দিয়ে বিছানা দেখানো। কিন্তু যেই ঘুমে ঢলে পড়া অমনি হ্যাঁচকা টানে আবার সেই গোল সাদা আলোর নীচে। প্রশ্নকর্তাকে দেখা যায় না, শুধু পিস্তল রাখার হোলস্টারের চামড়ার গন্ধ,আর অন্ধকার থেকে উড়ে আসা দুর্গন্ধ মুখের নিশ্বাস আর থুথু।
তখনই আবার আসে সে। ' তুমি আমাকে চুমু খেতে শিখিয়েছো আর ঠোঁটের ওপর চুমু খেতে খেতে আমি যখন একটু ক্লান্ত হয়ে পড়ি তখন আমি তোমার মুখের সুন্দর গন্ধটা পাই...কিন্তু এরকম করে বেশিক্ষণ থাকা যায় না বলে আমি উঠে খাটের ধারে বসে টেবিলের ওপর হাতড়ে সিগারেট খুঁজি...জানি যে দপ করে জ্বলে ওঠা লালচে আগুনে তুমি আমার মুখ ও এলোমেলো চুল দেখতে পেয়েছো...সেই আলোয় তোমাকে দেখা যায় তুমি তাকিয়ে আছ আমার একটা হাত নিয়ে তোমার বুকের ওপর রেখে নিজের হাত দিয়ে ঢেকে রাখ আর বল আমার আঙুলগুলো অসম্ভব সুন্দর।'
নবারুণ অল্প অল্প আভাস দিয়ে যান শুধু। আর তিলে তিলে গড়ে উঠতে থাকে অত্যাচারিত যুবকটির মানসপ্রতিমা। হ্যাঁ, তাকে ধরে নিচ্ছি একবগগা স্বপ্নদেখা এক যুবক হিসেবেই, সত্তরের দশক যার স্বপ্নের নির্মাণ ও ধ্বংসের নিষ্ঠুর সাক্ষী। স্বপ্ন ও ভালোবাসায় ধনী সেই ছেলেটির নখের ভেতর সূঁচ ঢোকায় রুণু গুহনিয়োগীর ঔরসজাতরা আর তার প্রথম ধাক্কায় মনে হয় হাতের শিরাগুলি গুটিয়ে আসছে কাঁধের দিকে। 'ছুঁচটা যে ঢোকায় সে চেয়ারে বসে ঝুঁকে পড়ে মুখ দিয়ে কুৎসিত শব্দ করে।... হাতটা স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা। ছুঁচটা নখের নিচ দিয়ে শেষ অব্দি পৌঁছে যায়। তখন আঙুলের মধ্যে ছুঁচটাকে ঘিরে রক্ত ভয়ে চিৎকার করে। হাড়ের গায়ে লেগে ছুচঁটা একটু ঢুকতে চেষ্টা করে,তারপর থেমে যায়। তখন নিজের হাতের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে এমন সব শিরা ফুলে উঠেছে যাদের আমি কখনো দেখিনি।'
লক্ষ্য করার ব্যাপার এখানে ওই কুৎসিত শব্দের উৎসই একমাত্র জীবন্ত প্রাণী নয়। ছুঁচ, রক্ত,শিরা,হাড় সবাই জ্যান্ত, সবাই সক্রিয়। এই অমানবিক অতিসক্রিয়তাকে আবছা করে দিতে পারে একমাত্র ভালোবাসার মানুষটি-- -'তোমার মতো আমি কাউকে কখনো দেখিনি কেউ আমাকে এত নিঃশর্তভাবে ভালবাসতে পারবে না কারো ভালোবাসা এত সমগ্র ও প্রশ্নাতীত নয় কোনো চোখের মধ্যে এত সম্মতি নেই এত সমর্থন কোনো রক্তের সহজাত নয়'
বিশুদ্ধ প্রেমের কবিতায় মজে যাই। যন্ত্রণার সে কবিতা যতিচিহ্নহীন,অনর্গল। আধো চেতনা আর অমানুষিক কষ্টের ভেতর থেকে যে হাত বাড়াচ্ছে সে কি করে দাড়ি কমা ফুলস্টপের বোতামঘরে বাঁধা থাকতে পারে! তাই প্রতিটি স্বগতোক্তি কোথাও হোঁচট খায় না, থামে না,অবিরল বলে যায় সেই মানবীর কথা যাকে ভালোবেসে উঠে আসা যায় অর্থহীন অস্তিত্ব আর চূড়ান্ত যন্ত্রণার ব্ল্যাকহোল থেকে।
এমন নয় যে নবারুণের ছোট গল্পে খানকিরা একেবারে উবে গেছে। মার্ডারারের ভাইতে পুলিশ ভ্যান মেয়েছেলে তোলে আর মেয়েগুলো হাসে। শেষরাত গল্পে মোতি আছে, বয়স্কা খানকি, বিধবা, কিন্তু বস্তিতে খোলামেলা ভাবেই বাস করে বয়সে ছোট বিবাহিত লাভারের সঙ্গে। সমাজ এদের হাফ বেশ্যা বলে চেনে। কিন্তু ওর পায়ের কোমরের পিঠের ঘাড়ের আলগা ভাব যুবক গরিবুয়াকে খুব মাতায়।
স্বাভাবিকভাবেই মোতি আর ফোয়ারা ( ফোয়ারার জন্য দুশ্চিন্তা) খানকিগিরিতে বেগম আর বেবির পায়ের নখের যুগ্যি নয়। অসাধারণ নয়,এরা সব সাধারণ খানকি। শুধু স্ট্যাটাসে বা প্রতিহিংসায় এঁটে না উঠতে পারা নয় , আসলে ভালোবাসা নামে একটা নিরস্তিত্ব ধারণার কাছে এই পাতি সরল খেটে খাওয়া মেয়েগুলি সত্যি ভারী বেকুব।
এই মোতির ছেলে ল্যাংড়ার সঙ্গেই উদোম যুদ্ধ গরিবুয়া বা গরিবের। কারণ ভাতের বদলে গরিব ল্যাংড়ার মায়ের সঙ্গে শোয়। নিজের ডবকা বৌ থাকা সত্ত্বেও। তার লজিক খুব সিম্পল। খাদ্যের বদলে সেক্স। এই সিম্পল লজিকেই সে তার ধর্মপত্নী কালো অথচ চমৎকার দেখতে মালতীকে খারাপ খারাপ কথা শোনায়,
-- -- - আমি বলেছিলাম, আমাকে শাদি করতে ? হামারা বাপ বিয়ে দিয়েছিল, তোকে এনেছিলো...ঐ শুড্ডাকে বল তোকে নিয়ে থাকতে,ভালো মাল আছিস।
মালতী উচ্চারণ করে, 'জানোয়ার'! তারপর আবার ঘরের দিকেই ফিরে যায়। আর তার ফিরে যাওয়া দেখে এতক্ষণ পরস্পরকে খুন করতে চেয়ে তুমুল মারামারিতে ব্যস্ত গরিব ও ল্যাংড়া যৌথ হাসিতে ফেটে পড়ে।
রোজকার এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, যা আসলে অবদমিত ঘৃণার প্রকাশ,শেষ হয় গলির মুখে আলগা নরম বছর পঁয়তাল্লিশের মোতি এসে দাঁড়ালে। ল্যাংড়া জল ভেঙে ভেঙে মায়ের দিকে ছোটে, মার বুকে মুখ ঘসে,কামড়ায়, কাঁদে।
-- -- -- -- -- -- মা !
মোতি ছেলেকে চুমু খায়। গোল বেঢপ মাথায়।
-- -- - মা ও হামকো বহোত মারিসে। দেখনা, মেরা মু মে খুন !
-- -আমি ওকে খুব বলে দিব। চলো বেটা। ঘরে চল। রাত কত হয়ে গেল বাবা।
ল্যাংড়া কাঁদে...ওর মুখের রক্ত মোতির বুকের ওপর লাগে, আবার বৃষ্টিতে ধুয়েও যায়।
-- -মা দেখে লিবি আমি তোর বেইজ্জত হতে দিব না। তু মুঝকো দুধ পিলা দে মা। আমি ওর লাশ ফেলে দিব।
মোতি ছেলের মুখে চুমা খায়। আদর করে।
-- -ইতনা শরাব পিয়া বাবা। ঘর চলো মেরি লাল! চল।
অন্ধ জল, ঠাণ্ডা হাওয়া,থই থই করা নোংরা জঞ্জাল ভেঙে এক হাফ খানকি ম্যাডোনার মতো বুকে জড়িয়ে ধরে আত্মজকে। নিয়ে যায় নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। ওই ফেয়ারের হঠাৎ ভোল পালটে ফাউল হয়ে যাবার মতোই মোতি-ম্যাডোনা গরিবের বিছানায় খানকি, তো পরক্ষণেই গলির মোড়ে ক্ষণিকা। আর ক্ষণিক দর্শনেই চিরকাল মনে রাখবার মতো।
মৃত্যু-হত্যা-আত্মহত্যার অনিবার্য মোটিফের পুনরাবৃত্তি নবারুণের ছোট গল্পে, কিন্তু তা প্রেম,স্নেহ, মমতাকে নিকেশ করতে একেবারে ব্যর্থ। শুকনো কংক্রিটের গায়ে গজিয়ে ওঠা সবুজ ছোপের মতো ঐ নিকেশহীন সংবেদনাই তার খানকিদের ক্ষণিকা করে তোলে বার বার।
যেমন ফোয়ারা। মাত্র তিনটে গল্পে এই খানকির কথা রটিয়েছেন নবারুণ -- -ফোয়ারার সেই মানুষজন, পাঁচুগোপাল, ফোয়ারার জন্য দুশ্চিন্তা। ফোয়ারা একজন সাধারণ বেশ্যা, কিন্তু সে মরে গেলে তার প্রেমিক পুরো নিলাম হয়ে যাবে।
ফোয়ারাদের ঐ সারবাঁধা দরমার ঘর, রাস্তার কাঁচা নর্দমা, স্যাঁতসেঁতে ছাইকাদা রাস্তা,কেরোসিন পলতের আলোর ঘুপচি পৃথিবী উন্নয়নের ত্রিফলা থেকে কতো দূরে !
তবু তার অসুখ করলে অবুঝ প্রেমিকের মনে হয়, 'ফোয়ারা শুকিয়ে যাচ্ছে, আর লোক এত বড়ো বিদ্বান যে জানবেই না ?'
এও এক অদ্ভূত প্রেমের গল্প,শরীরের ছায়ায় মনের গল্প। ফোয়ারার মন খারাপকে অমূলক প্রমাণ করতে চেয়ে প্রেমিক বলে,
-- -- -শরীরের অসুখ তো মনের কি? সেরে যাবে। ও নিয়ে আমি ভাবি না। জানো অত বন্দুক ছুরি ধরেচি,কিন্তু মন বাঁচিয়ে।
-- -- -তোমরা পুরুষ যে।
ফোয়ারার ভেতরের ক্ষণিকা নিশ্চয়ই খুব নীচু স্বরে উচ্চারণ করে কথাটা। শরীর আর মন তার কাছে আলাদা নয় আর। মুখে যাইই বলুক, ঐ কারণেই প্রেমিকের পার্মানেন্ট ঠিকানা এখন তার ঘর। কোনদিন এক গুলিবিদ্ধ পার্টিকর্মী আশ্রয় পেয়েছিল যেই ঘরে। বিনা চিকিৎসায়, সকলের অজান্তে সে মরে গিয়েছিল ফোয়ারার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে। তেমনি সারাক্ষণ প্রেমিকের চোখের দিকে তাকিয়েই থাকবে ফোয়ারা। আমৃত্যু।
ফোয়ারার মতো ক'টা বেশ্যার মরণ হলে, আর তার বারো ভাতারের ক'টা নিকেশ হলে জন্মায় কিছু চোক্তার আর ফ্যাতাড়ু, জানা নেই। তবে নবারুণের ছোট গল্প একথা জানান দিয়েই যায় যে উন্নয়নের গ্রাফে উল্লম্ফবাজ এই শহরের যে স্তরটি অদৃশ্য, অথবা যাকে অদৃশ্য রাখবার জন্য ভদ্রসমাজের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, সেখানে শুকোবো শুকোবো করেও শুকোয় না মানবিকতার শেকড় ; চরম নির্লিপ্তি আর নিষ্ঠুরতার মধ্যেও থেকে যায় প্রেম আর মমতার রসায়ন। আর সেটা মূলত এই খানকি-কাম-ক্ষণিকাদের জন্যই। এরা সুপার উয়োম্যান তো নয়ই,বরং সাধারণেরও সাধারণ। তবু এরাই কখনো কখনো ছাপিয়ে যায় নবারুণীয় অতিমানবীদের। এরাই মিথ্যে প্রমাণ করে এই আলোচনা যে নারীসত্ত্বার যে দিকগুলো একদিকে নারীবাদী এবং অন্যদিকে নারীবিদ্বেষী হবার জন্য সবচেয়ে বিতর্কিত, সেই ছম্মকচ্ছল্লো ব্যাপারগুলিকেই শুধু ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন নবারুণ। আসলে এর বাইরেও কিছু পাতি বোকা মেয়েছেলের কাঠামোয় মাটি চড়িয়েছেন তিনি, যারা ভালোবাসার টানে মরা আগলেও বসে থাকতে পারে।
এইখানে একটু নবারুণের বহুচর্চিত রাজনৈতিক মতাদর্শের কথা। আমৃত্যু মার্ক্সবাদে বিশ্বাস গচ্ছিত রেখেছেন নবারুণ। শ্রেণীমুক্তি মানেই লিঙ্গ নিরপেক্ষ মুক্তি। সর্বজনের। তাই সংগ্রাম যতই রূপকধর্মী হোক না কেন, তার মূল লক্ষ্য শ্রেণীমুক্তি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের অনুরূপ একটি ক্ষমতার পাকা কাঠামো যে পিতৃতন্ত্রে অবিচ্ছেদ্য এবং সাম্রাজ্যবাদ দূর হটলেও সে যেমন তেমনি থাকে এ নিয়ে ভাবনা আশু লক্ষ্য প্রাপ্তির চেষ্টার কাছে গৌণ মনে হওয়াই স্বাভাবিক। লিঙ্গ বৈষম্য ও যৌন হেনস্থা শুধু ধনতান্ত্রিক সমাজের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া এবং সব প্রান্তিক মানুষ একই শ্রেণীতে পড়েন এইরকম চিন্তার উল্টো পিঠটা নেড়েচেড়ে লিঙ্গ বৈষম্যের অনন্যতা ধরতে চেষ্টা করেছেন ধ্রুপদী মার্কসবাদে বিশ্বাসী নবারুণ এইরকম মনে হয় না।
চোক্তার ও ফ্যাতাড়ুদের সংগ্রাম পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধেও কিনা পরিষ্কার বোঝা যায় না। বরং লিঙ্গনির্বিশেষে উচ্চর্বগকে জ্বালানোই তাদের অভীষ্ট । তাই ফ্যাতাড়ু গল্পে আলোকোজ্জ্বল ভাসমান ফ্লোটেলে স্পেশাল তন্দুরি নাইটে তন্দুরি চর্বণরত সাহেবসুবো, নর্তকী, স্মাগলার, মডেল,পলিটিশিয়ান, বিউটিশিয়ান, মালকিন, পিম্প, জিগালোর সুগন্ধি অস্তিত্বের ওপর হঠাৎ ছপ্পর ফুঁড়ে নেমে আসে বিষ্ঠা, ছনছনে মুত, ভাঙা উনুন, মুড়োঝাটা, পাঠার মাথার উৎকট ঘুগনি, বাতিল টুথব্রাশ, সেলুনের কাটা চুল,বেড প্যান, আরো কত কি!
মেয়েরাও একাজে সক্রিয় সঙ্গী , কিন্তু নিজেদের সমস্যার বহুস্তরীয় তাৎপর্য সম্বন্ধে তারা সারল্যপূর্ণ অজ্ঞতায় ভোগে। তাই নবারুণের ক্ষণিকারা সহিংস প্রতিরোধে খুব একটা সামিল হয় না। বিকল্প রণনীতির স্বামীহারা সরমা শ্বশুরের কাছে কেঁদে ফেলে যখন শহরের ভালো স্কুলে তার মেধাবী সন্তান ভর্তি হতে পারেনা। কারণ সরমার দেওর বিকল্প বামে আস্থাশীল ও সক্রিয়। সে ফেটে পড়ে না, চেঁচায় না, লোকাল কমিটির সেক্রেটারিকে কোন টোপ দেয় না।
আর ডাইনিঘর গল্পে দুই বৌ পর পর খুন হয়ে যায় গুরুদেবের উসকানি আর স্বামীর অন্ধবিশ্বাসের কারণে। কিন্তু দিবাকরই তাদের খুন করে নাকি নিজেদের সারল্য, বিশ্বাস আর অতিনির্ভরতার হাতেই খুন হয় তারা, সে লাখ টাকার প্রশ্ন ! বড় বৌ পরমগুরুর কথামতো কায়মনোবাক্যে ঈশ্বরীয় ধ্যানে যখন নিমগ্ন, তখনই গায়ে মাথায় এসে পড়ে কালান্তক কেরোসিন। আর দ্বিতীয় সতীদাহের ব্যবস্থাপক তো সতী নিজে ! প্রেশার বেড়েছে, হাওয়া বদলের অছিলায় স্বামী দীঘা বেড়াতে নিয়ে যাবে, রেঁধেই খাবে, কারণ বিদেশবিভুঁই, দোকান থাকে কি না থাকে। ফলে স্টোভ আর কয়েক লিটার কেরোসিন নিতে হবে। দিবাকর ছদ্ম বিরক্তি দেখায়,
-- -- -- --ও অনেক ঝামালা। গন্ধ বেরুবে। ছলকাবে।
দুনম্বর বৌ তাকে আশ্বস্ত করে,
-- -- -- -- জেরিক্যানে ভালো করে মুখ আটকে দেব। ও কত কেরোসিন নিয়ে গেছি আমরা। দেখবে,কেউ বুঝতেও পারবে না।
ডাইনি ঘরের মতো গল্পগুলো আগুনে ছ্যাঁকার মতো। বড় বড় ফোসকা পড়ে যায়। আর তার ভেতর বিজবিজ করে ঘেন্না, ভয় আর অসহায়তা। যে ভেতর-ফাঁপা সিস্টেম এতো অসহ্য সেটাতেই এডজাস্ট করে প্রতি মূহুর্তে বাঁচার কষ্ট মালতীর মতোই পুড়িয়ে খাক করতে থাকে। আর তখনি শৈশবে ব্রতকথার শেষে লম্বা দুর্বোঘাসের আগায় শান্তিজল ছেটানোর মতো সামনে এসে দাঁড়ায় ভাসানের পাগলি। তার চোখে এমন মায়া আর মনে এমন ভালোবাসা যে সারাদিন ধরে বেওয়ারিশ লাশের কষে বসা মাছি তাড়িয়ে তাড়িয়েও সে ক্লান্তি বোধ করে না। নাকি সমাজ রাজনীতি, সংস্কৃতি,ইতিহাসকে ঘিরে গড়ে ওঠা মিথ্যে মিথে ভর্তি এই আবাল সিস্টেমে এই মায়ামমতা নিছকই এক অস্বাভাবিকতা এবং বিচ্যুতি? আর তাই সে পাগল এবং জড়বুদ্ধি?
সে যাই হোক, পাগলির সঙ্গে যখন প্রথম দেখা, তখন সে মৃতদেহের পাশে বসে অঝোরে কাঁদছিল। ইনিয়েবিনিয়ে গাইছিলো ব্যক্তিগত শোকগাথা। লাশের ভূতপূর্ব মালিকের অকপট স্বীকারোক্তি,
-- -- -- -- -- -- -পাগলিকে কোনদিনও আমি ভালবাসি নাই। মরিবার সময়ও নয়। তাহার জন্য আমি দুঃখবোধ করিতেছিলাম।
তবু অনাত্মীয় ভবঘুরের মড়া আগলে সারারাত পাগলি কুকুর বেড়াল তাড়ালো, ভোরবেলা তার মুখে জল দেবে বলে টিনের কৌটো নিয়ে জল আনতে গেল। ভবঘুরেটিও তার জীবদ্দশাতেও এমন একটি অর্থহীন কাজ করেছিল। একটি পরিত্যক্ত শিশুর প্রাণ বাঁচিয়েছিল। এরা এমনি মাণিকজোড় !
বেলা বাড়লে পুলিশ এল। মরা সরাতে চাইলে পাগলি গালাগালি শুরু করল। কিন্তু জমাট ভিড় যারা তাকে এবস্ট্রাক্ট বেহুলা ডেকেছিল তাদের এবং পুলিশের তত্ত্বাবধানে স্ট্রেচারবাহকেরা জোর করে লাশটি কালো গাড়িতে তুলে দিল। পরেরটুকু মৃতদেহের জবানীতেই শোনা যাক,
-- -- - চতুর্দিক অন্ধকার। শুনিতে পাইলাম পাগলি চিৎকার করিয়া কাঁদিতেছে।...
গাড়িটা গরগর শব্দে কাঁপিতেছে। মনে হইল চলিলাম। আরও মনে হইল পাগলিকে আমি বড় ভালোবাসি। কালো গাড়ি চলিতে লাগিল। এইসব দুঃখ থেকে প্রেমে উত্তরণের বাঁধা গৎ কোট করে, বা শাশ্বতের চর্বিতচর্বণ লিখে ক্ষণিকাদের জিতিয়ে দেব এমন কোন অসদুদ্দেশ্য আমার নেই। ক্ষমতাও না। একে তো মোতির মতো তারা প্রায়ই মিলেমিশে একাকার,উপরন্তু নবারুণকে বোঝা অত সহজ নাকি ! দেবা ন জানন্তি কুতো মনুষ্যাঃ
তারপরেও আবার মনে গেঁথে আছে খানকিদের বস্ত্র যোগাবার অসাধারণ ছবিটা। সেই যে যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ফিল্মের সেই পালাতে চাওয়া নগ্ন মেয়েটির সঙ্গে স্বপ্নে হারবার্ট ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ দেখে হাসপাতালের চত্বরে একটা ছায়া ছায়া জায়গায় খানকিরা মরা মেয়েদের কাপড় বিক্রি করছে। খুব সস্তায় বিদেশিনীকে একটা নাইলন শাড়ি কিনে দিল হারবার্ট, তবে না সেই ক্ষণিকার লজ্জা নিবারণ হলো!
আমার বলবার কথা এইটেই যে নবারুণীয় নারীরা, কি খানকি কি ক্ষণিকা, সবাই "প্রাচীন লিপির মতো সম্ভাবনাপূর্ণ অথচ এখনো যার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।" (হারবার্ট)