এমপ্যাথি শব্দের সঠিক প্রতিশব্দ কী? সহমর্মিতা, সম্ভবত। অবশ্য, সবাই সহমত না-ও হতে পারেন, বলতে পারেন কমপ্যাশনের প্রতিশব্দ কী তাহলে - কমপ্যাশন, সিমপ্যাথি আর এমপ্যাথির মধ্যে বেড়াটা তো তেমন স্পষ্ট নয় - সহমর্মিতা শব্দের মধ্যে এমপ্যাথির পুরোটা ধরা পড়ে কিনা জানা নেই - কিন্তু, এই লেখাটা প্রতিশব্দ খোঁজা নিয়ে নয় - আলোচনার শুরু, এই এমপ্যাথির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে।
ছবিঃ আবদাল্লা আল ওমারি |
সদ্য পড়লাম সাইকোলজিস্ট পল ব্লুমের অসামান্য একখানা বই - যেখানে উনি বলেছেন, আমরা যতই ভাবি, যতই আশা করি যে আমরা অন্যের জায়গায় নিজেদের বসিয়ে তাঁর সমস্যাটা বুঝতে পারি - তাঁর দুরবস্থার সাথে একাত্ম বোধ করতে পারছি - বাস্তবে সেইটা সবক্ষেত্রে সম্ভবপর নয় - মানে, আপনি চাইলেও সবসময় অন্যের অবস্থায় নিজেকে বসিয়ে তাঁদের একজন হিসেবে সমস্যাটা বুঝতে পারবেন না। না, এমন কথা তিনি বলেন নি, যে, সহমর্মিতা বা অপরের দুঃখে দুখী হওয়া অবান্তর একটা ভাবনা - অথবা অপ্রয়োজনীয় ভাবনা - তাঁর বক্তব্য বরং তার ঠিক উল্টোটাই - শুধু তাঁর মত, এমন সহমর্মিতার ভাবনার মধ্যে আত্মতুষ্টি মিললেও ভ্রান্তি রয়ে যায় - বিশেষ করে একাত্ম হওয়ার এই ভাবনা থেকে অন্য সমস্যা তৈরী হয় - যাঁদের সাথে আমরা একাত্ম হতে পারি, অগ্রাধিকার পায় তাঁদের সমস্যাগুলোই, অনেক গুরুতর বিষয় গুরুতর সমস্যার দিকগুলো নজর এড়িয়ে যায়, কেননা সেই অধিক গুরুতর সমস্যায় থাকা মানুষগুলো আমাদের কাছে এতখানিই অপর, যে তাঁদের জন্যে এমপ্যাথি জাগে না আমাদের - বরং এইধরণের এমপ্যাথির চাইতে অনেক বেশী জরুরী এবং কার্যকরী হল, র্যাশনাল কমপ্যাশন (বাংলা প্রতিশব্দ খোঁজার ঝামেলায় আপাতত আর গেলাম না)। র্যাশনাল কমপ্যাশন - অর্থাৎ যুক্তি দিয়ে তাঁদের পরিস্থিতিটা অনুভব করার চেষ্টা করা - ও তদনুযায়ী সহমর্মিতা।
কথাটা ভেবে দেখার মতো।
আমাদের চিন্তাভাবনা তো ভুঁইফোড় কোনো বায়বীয় বস্তু নয় - শ্রেণীগত অবস্থান আর তদনুসারী শিক্ষার উপরেই তৈরী হয় আমাদের চিন্তাক্রম। এনআরসি-র ধাক্কায় ডিটেনশন শিবিরে যেতে চলেছেন যাঁরা - তাঁদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি থাকতে পারে, থাকা উচিতও - কিন্তু, তাঁদের জায়গায় নিজেদের বসিয়ে তাঁদের দুঃখের ভাগীদার হয়ে ওঠা অত সহজ নয়। তুলনায় অনেক বেশী সহজ সমশ্রেণীর মানুষের সাথে একাত্ম হওয়া। কাজেই, উদবাস্তু সমস্যা নিয়ে রাষ্ট্রের ন্যারেটিভ গ্রহণযোগ্য আর কাম্য মনে হয় - ডিটেনশন ক্যাম্পের ভয়াবহতা সেইভাবে ভাবাতে পারে না - অন্তত ততদিন পর্যন্ত নয়, যতদিন না এনআরসি-র আতঙ্ক নিজের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। একইভাবে, ধরুন, এই কয়েক দশক আগেও, পূর্ববঙ্গ থেকে উদবাস্তু ছিন্নমূল মানুষ বা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম - সেই মানুষগুলো, যাঁরা এক নদীমাতৃক সুফলা দেশ থেকে উৎখাত হয়ে এসে পড়েছিলেন পশ্চিমে - এসে উঠেছিলেন এমন এক এলাকায়, যার বৃহদংশেই ফসল ফলানো শ্রমসাধ্য, নদীতে জাল ফেললেই উঠে আসে না একঝাঁক মাছ - পূর্বজীবনে যাঁদের বাড়ির কাছে লাগোয়া জমিটুকু বা পার্শ্ববর্তী খাল থেকে উঠে আসত সম্বৎসরের খাবার, তাঁদের পক্ষে এপারের জলমাটি ঊষর - তাঁরা সেই সুজলাসুফলা দেশের গল্প শোনালেই উত্তর পেতেন, অত আরাম ছেড়ে এদেশে আসতে কে বলেছিল!! এইখানে এমপ্যাথি হয়ত সম্ভবই ছিল না, কেননা এত মানুষ এসে পড়ায় এপারের আদি বাসিন্দাদের জীবনের অর্থনীতি বদলে গিয়েছিল আগাগোড়া - তাছাড়া, দুইপারের মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান, বাস্তবতার যে ফারাক - তাকে অতিক্রম করে এমপ্যাথি-তে পৌঁছানো তেমনভাবে সম্ভব ছিল কি!! কিন্তু, র্যাশনাল কমপ্যাশন বোধহয় সম্ভব ছিল - সম্ভব ছিল, ছিন্নমূল ভিটেছাড়া মানুষগুলোর যন্ত্রণাকে যুক্তি দিয়ে ভেবে দেখা, তাদের অসহায়তাকে যুক্তির পথে বিশ্লেষণ করা, পাশে দাঁড়ানো - সম্ভব হয়েছিলও অবধারিতভাবে - আর সেইজন্যেই ঘটি-বাঙাল পাশাপাশি মিলেমিশে কাটিয়ে দেওয়া গেল এতগুলো বছর - আর এখন তো পৃথক অস্তিত্বই নেই তেমন একটা।
কয়েক শতক ধরে পাশাপাশি থেকেও, এই বাংলায়, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান - সাংস্কৃতিক অপরিচিতি - কেননা, সামাজিক আদানপ্রদান সীমিত, - মূলধারার বাংলা সিনেমায় সাহিত্যে হিন্দুচরিত্রদেরই দাপট - মুসলমান চরিত্র টেনেটুনে এনে ফেললেও তা বেশ আরোপিত ঠেকে, এবং সেইটাই স্বাভাবিক, কেননা এই অপরিচয়ের শিকার স্বয়ং লেখক/পরিচালকও - এই অপরিচয়, যেখান থেকে আসে অবিশ্বাস, যেখান থেকে সার-জল পায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতি - ঠিক সেইখানে দাঁড়িয়ে এক প্রান্তিক মুসলমানের দৈনন্দিন সমস্যার কতটুকু আঁচ পেতে পারি আমি, যে কিনা মূলধারার উচ্চবর্গের সুবিধেপ্রাপ্তদের দলে? এমপ্যাথির অহংকার নিয়ে নিজেকে ভোলাতে চাইলে, সে কি আত্মপ্রবঞ্চনা নয়? কিন্তু, যুক্তি দিয়ে তাঁদের বুঝতে চাইলে? তথ্যের ভিত্তিতে তাঁদের সমস্যাকে অনুধাবন করতে চাইলে? অতটা অসম্ভব হয়ত নয়। অর্থাৎ, সেই র্যাশনাল কমপ্যাশন।
ছবিঃ পরিতোষ সেন |
কাজেই, যে কথা বলছিলাম, স্রেফ এনআরসি হয়ে সব হারানোর আশঙ্কায় যে মানুষগুলো আত্মহত্যা করছেন, যাঁরা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন ডিজিটাল রেশনকার্ডের আশায় - তাঁদের জায়গায় নিজেকে রেখে এমপ্যাথি আপনার পক্ষে সম্ভব না হলেও - র্যাশনাল কমপ্যাশন দিয়ে ভাবতে চাইলে? আবার ধরুন, কাশ্মীর বিষয়ে আপনার ধারণা বলতে ভূস্বর্গ বা অসামান্য প্রকৃতি, রাস্তার ধারে টুকটুকে লাল আপেলে ভরে থাকা গাছ, সন্দেহজনক কিছু অপরিচিত মানুষ, কনভয়ে বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া জঙ্গীর দল। এর মাঝে রোজ ইস্কুলে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা, আর ইস্কুল বন্ধ হয়ে জারি হচ্ছে সেনাশিবির - অসুস্থ হলে ঠিক কোথায় গেলে চিকিৎসা পাওয়া যেতে পারে, সেই নিয়ে উদবিগ্ন বৃদ্ধ - লেখাপড়া শেষ হতে না হতেই রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার তোড়জোড়, কেননা নিজের অঞ্চলে চাকরির কোনো সুযোগই নেই - এঁদের আপনি চেনেনই না - এঁদের পরিস্থিতিতে নিজেকে বসিয়ে এঁদের সমস্যার কথা ভাবা তো দূরস্থান - কাজেই, এমপ্যাথির কথা ছেড়ে দিন - কিন্তু, ৩৭০-এর অবলুপ্তিতে উচ্ছ্বসিত হওয়ার সাথে সাথে এই মানুষগুলোর অবস্থাটা যদি ভেবে দেখা যেত - সেক্ষেত্রে, ওই র্যাশনাল কমপ্যাশনটুকু থাকলেই আমাদের ভাবনার স্রোত অন্য খাতে প্রবাহিত হতে পারত - তাই না?
অথচ, আমাদের ভাবনা, আমাদের সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রে এই এমপ্যাথিই মুখ্য চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়। আর, আগেই বলেছি, এমপ্যাথির অন্যতম গণ্ডগোল হল, যাঁদের সমস্যা গুরুতর, তাঁদের চাইতে আমরা বেশী বিচলিত হই তাঁদের নিয়ে, যাঁদের সমস্যার সাথে আমরা আমাদের আর্থসামাজিক শ্রেণীগত অবস্থানের সুবাদে বেশী সহজে একাত্ম হতে পারছি। যেমন ধরুন, দেশের অন্যত্র জঙ্গীহানায় মানুষ মারা গেলে আমরা যতখানি বিচলিত হই, তার চাইতে বহুগুণ বেশী ভাবি তাজ হোটেলে হামলা নিয়ে - সংবাদপরিবেষকদের অধিকাংশই আসেন আমাদের শ্রেণী থেকে, কাজেই তাজ হামলার খবর দেখানো হয় অনেক বেশী গুরুত্ব সহকারে - বস্তিতে বিস্ফোরণ হয়ে মানুষ মরলে সে খবর এক কি দুদিনের বেশী সংবাদমাধ্যমের নেকনজর পায় না। রেলে তৃতীয় শ্রেণীর স্লিপার ক্লাসে আগুন লেগে মানুষ মারা গেলে যত না ভাবি, বাতানুকূল কামরায় এসি কাজ না করার খবর পেয়ে বিচলিত হই তার চেয়ে বেশী - আর প্লেন ক্র্যাশ হলে তো কথা-ই নেই। ঘর থেকে দূরে যেতে চাইলে, সিরিয়া থেকে পালানোর পথে নৌকাডুবিতে মৃত শিশুটির সমুদ্রপারে উপুড় হয়ে পড়ে থাকার ছবিখানা বারবার স্মৃতিতে ফিরে আসে - টুকটুকে মিষ্টি বাচ্চা, পায়ে মায়ের আদর করে পরিয়ে দেওয়া জুতোটুকুও অটুট - আঃ, ভগবান না করুন, আমার বাচ্চার যেন এমন পরিস্থিতি কখনও না আসে। কিন্তু, ঠিক ওইখানে, ওই পরিস্থিতিতে একটি কালো, অনাহারে কঙ্কালসার শিশুর বিবস্ত্র মৃতদেহ এমন করেই পড়ে থাকত, এমনভাবে বিচলিত হতাম কি? খারাপ লাগত, দুঃখ পেতাম - কিন্তু, ভেতর থেকে সেভাবে আলোড়িত হতাম না, কেননা, সেই খেতে না পাওয়া কালো বাচ্চাটির বাস্তবতার সাথে আমাদের মধ্যবিত্ত যাপনের অবস্থান থেকে একাত্ম হওয়া সম্ভবপর নয়। তাহলে, এমপ্যাথির আত্মপ্রবঞ্চনা ছেড়ে একটু র্যাশনাল কমপ্যাশন-এর কথা ভাবলে হয় না?
ছবিঃ অর্পিতা সিং |
রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগ্রহণের ক্ষেত্রেও র্যাশনাল কমপ্যাশন থাকা প্রত্যাশিত ও বাঞ্ছনীয়। অবশ্য এইখানে আমি এক সদিচ্ছুক ও কল্যাণকামী রাষ্ট্রের কথা বলতে চাইছি - যাকে আপনি সোনার পাথরবাটি ভাবতে চাইলে দোষ দেব না। তা সেই কল্যাণকামী রাষ্ট্রও যখন সিদ্ধান্ত নেন, সেইখানেও তার মধ্যে রয়ে যায় সিদ্ধান্তগ্রহণকারী মানুষগুলোর, বা শাসন শ্রেণীর নিজস্ব শ্রেণীগত অবস্থানজনিত এমপ্যাথির ছায়া - কমপ্যাশন যদি কল্পনাও করা যায়, তা সম্ভবত ঠিক র্যাশনাল নয়, অর্থাৎ সেইখানেও নিজস্ব শ্রেণীর প্রতিই কমপ্যাশনে সীমাবদ্ধ থেকে যাওয়া হয়।
আপাতত না হয় রাষ্ট্র ছেড়ে ব্যক্তিতে ফিরি - না, আত্মকেন্দ্রিক বা স্বার্থচিন্তায় মগ্ন মানুষ নয় - যাঁরা সমাজের হালহকিকত নিয়ে অল্পবিস্তর চিন্তিত, সংখ্যায় কম হলেও যদি তাঁদের চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচনা করি - যদি মেনে নিই, তাঁদের মধ্যেও, অর্থাৎ সচেতন ও পরার্থপর মানুষের বড় অংশের মধ্যেও যদি এমপ্যাথিই প্রাথমিক হয়ে ওঠে - কিছুক্ষণ না হয় সেই এমপ্যাথি, বা এমপ্যাথির দাবী নিয়েই আলোচনা করা যাক। আমজনতা যখন এমপ্যাথির অবস্থান থেকেই ভাবনাচিন্তা করছেন, এবং নেতারাই সর্বদাই প্রমাণ করতে সচেষ্ট যে, তিনি আম-আদমির একজন, অর্থাৎ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আবেদন সেই এমপ্যাথির দ্বারে, আমি তোমাদেরই লোক, তোমাদের সমস্যা আমার মনোকষ্টের কারণ - কথা হোক এমপ্যাথির অবস্থান থেকেই। আর, কেমন হয়, নেতারা নিজেদের যেমন করে আমাদের কাছে পেশ করেন, তাঁদের ঠিক সেই ইমেজ শিরোধার্য করে যদি সেই এমপ্যাথির দাবীটা নেতাদের দিকেই ফিরিয়ে দিই?
ধরে নেওয়া যাক, আমাদের দেশের নেতারা স্রেফ দেশের কথা ভেবে, দেশের বেশীর ভাগ মানুষের কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন - দেশের ভালো বাদ দিয়ে তাঁদের আর কোনো দুরভিসন্ধি নেই। ধরে নেওয়া যাক, তাঁদের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্যে কোনো আল্টিরিয়র মোটিভ নেই - আছে শুধুই দশের ভালো বা জনকল্যাণের ভাবনা।
আচ্ছা, তাহলে, তাঁদের এইসব "জনকল্যাণমুখী" সিদ্ধান্তে যাঁদের রাতের ঘুম উড়ে যাচ্ছে - সেই উলুখাগড়ার দল যদি নেতাদের এমপ্যাথির আশায় বলেন, দ্যাখ কেমন লাগে?? যদি আশা করেন, বিদেশসফর কাটছাঁট করে মোদিজী দেশে ফিরে আসছেন, স্রেফ মায়ের বার্থ সার্টিফিকেট খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এই আশঙ্কায়? অথবা যোগি আদিত্যনাথ? কিম্বা সাম্প্রতিক বাড়বাড়ন্তে মা যা হইয়াছেন-এর পূর্বদশায় অমিত শা স্বয়ং খুঁজছেন মা যা ছিলেন দশার জমির দলিল??
ছবিঃ আবদাল্লা আল ওমারি |
দুর্ভাগ্য আমাদের, সারা পৃথিবীতেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, নেতারা হয়ত সমাজের থেকেই উঠে আসেন - অনেকে হয়ত উঠে আসেন সমাজের একেবারে নীচুস্তর থেকেই - কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা এক সম্পূর্ণ পৃথক শ্রেণী - যে শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে গেলে তাঁরা অতীত বিস্মৃত হন - অন্তত কার্যক্ষেত্রে বিস্মৃত হন তো বটেই - অতীতটুকু কাজে লাগে আমজনতার কাছে নিজেদের ইমেজ তৈরীর কাজে।
ক্ষমতার আসনে বসে তাঁদের নেওয়া সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ ঠিক কী সমস্যায় পড়ছেন, সেই নিয়ে তাঁরা কতটুকু বিচলিত? নোটবন্দীর সময় ক্ষমতাসীন কোনো নেতাকেই ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে দাঁড়াতে দেখা যায়নি - তাহলে কি বিশ্বাস করে নেব, যে, তাঁদের কারো বাড়িতেই রাখা ছিল না পাঁচশ বা হাজার টাকার নোট? অতএব, এমন আশা, হয়ত, অনুচিত নয়, যে, নিজেদের সিদ্ধান্তের ফলে যদি আমজনতার মতোই একইভাবে হয়রান হতেন নেতামন্ত্রী সব্বাই, তাহলে তাঁরা সিদ্ধান্তগ্রহণের ব্যাপারে আরেকটু যত্নবান হতেন - আরেকটুকু খতিয়ে দেখতেন সম্ভাব্য সমস্যাগুলো। অর্থাৎ, সেই এমপ্যাথি - প্রকৃত অর্থে, অথবা মানসিকভাবে, রাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা তাঁদের নেওয়া সিদ্ধান্তের ফলে উলুখাগড়াদের পরিস্থিতিটা অনুধাবন করতে পারছেন কিনা। এদেশ কিম্বা বিশ্বের অন্যত্র - সমাজের নীচুতলার মানুষগুলোর ছবিটা একই - নেতাদেরও তা-ই - এমপ্যাথির দাবীটাও, স্বাভাবিকভাবেই, ভিন্ন নয়।
সিরিয়ার শিল্পী আবাদাল্লা আল-ওমারি এমনই এক এমপ্যাথির আপাত অবাস্তব স্বপ্নে বাঁচেন। আশেপাশে মৃত্যু, হত্যা, উচ্ছেদ, হতাশা ছাপিয়ে তিনি এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু, তাঁর কাছে সেই স্বপ্নপূরণের প্রাকশর্ত নেতাদের সদিচ্ছা - শুভবুদ্ধি। এই শুভবুদ্ধি খুব সুলভ নয় - অতএব, আল-ওমারি স্বপ্ন দেখেন নেতাদের এমপ্যাথির।
মানুষ স্বেচ্ছায় রিফিউজি হন না - হন কোনো এক ক্ষমতাবান কলমের আঁচড়ে - যে কলম দৃশ্যমান না হলেও ঐশ্বরিক কিছু নয় - কোনো এক গজদন্তমিনারে বসে ঠাণ্ডা ঘরের শীতল সিদ্ধান্তে মুহূর্তে ভিটেছাড়া হন কয়েক হাজার, কয়েক লক্ষ মানুষ - সিদ্ধান্তের ফলে সব হারাবেন যাঁরা, সিদ্ধান্তগ্রহণের মুহূর্তে তাঁদের মতামত দেওয়ার সুযোগটুকু নেই। অথচ, সেই সিদ্ধান্ত যাঁরা নেন, তাঁরা গদিতে বসেন আমি তোমাদেরই লোক এমন দাবী নিয়ে - ক্যামেরার সামনে তিনি সদাই প্রমাণে ব্যস্ত থাকেন, সাধারণের দুঃখকষ্টে তিনি ঠিক কতখানি বিচলিত হন - অর্থাৎ, আগেই যা বলছিলাম, ভণিতা সেই এমপ্যাথির।
সেই এমপ্যাথির দাবীই রাষ্ট্রনেতাদের দিকে ফিরিয়ে দেন আল-ওমারি। তাঁর ছবিতে কোলে বাচ্চা নিয়ে অসহায় রিফিউজির বেশে দাঁড়ান ডোনাল্ড ট্রাম্প - সব হারিয়ে ফুটপাথে ভিক্ষায় বসেন ভ্লাদিমির পুতিন - অন্তহীন রিফিউজির সারির লাইনে দাঁড়ান শক্তিশালী তামাম রাষ্ট্রের প্রধানই।
শিল্পী হিসেবে আল-ওমারি মহান কিনা জানা নেই - তাঁর এই ছবি রসোত্তীর্ণ কিম্বা কালোত্তীর্ণ কিনা, সেও বলা মুশকিল - কিন্তু, যেদেশের পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ রিফিউজি হয়ে বিভিন্ন দেশে অসহায় হয়ে মাথা খুঁড়ছেন, সেই দেশ সেই বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে রসের বিচার করার মানসিকতা, সম্ভবত, আল-ওমারির নেই।
তাঁর নিজের কথায় - আমার মনে হয়েছিল, আবেগের দিক থেকেই হোক, বা সচেতনতার দিক থেকে, এটা আমার দায়িত্ব - আমি দায়বদ্ধ এই মানুষগুলোর কাছে - আমার মানবিক দায়, এই নেতাদেরকে একটা বার্তা দেওয়া - আমার দেশের এতগুলো মানুষ ছিন্নমূল হয়েছেন অনেকাংশেই এইসব তথাকথিত বড় বড় নেতাদের কার্যকলাপের পরিণামে, তাঁদের নেওয়া সিদ্ধান্তের পরিণামে - যদি এটুকুও পারি বোঝাতে, যে, এই নেতারা একটু আয়নায় নিজেদের দেখুন - আর যদি পারেন, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনুভব করুন, ঠিক কেমন লাগে নিজেদের ছিন্নমূল অসহায় উদবাস্তু হিসেবে ভাবতে।
রসোত্তীর্ণ কিম্বা কালোত্তীর্ণ হওয়ার দুশ্চিন্তা আল-ওমারির নেই - নজরুলের কথাটি সম্ভবত তিনিও বলবেন - "অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু যাহারা আছো সুখে"।
আর আমাদের দেশে? দেশের একটি রাজ্যে ঊনিশ লক্ষ মানুষকে দেশহীন করে দেওয়া হয়েছে - শাসকেরা হতাশ, কেননা তাঁদের কাছে ঊনিশ লক্ষ মাত্রই ঊনিশ লক্ষ, অন্তত চল্লিশ লাখের দাওয়াত দিয়ে রেখেছিলেন তাঁরা মনে মনে - তোড়জোড় শুরু হয়েছে আমাদের রাজ্যেও এমন সুবন্দোবস্ত কিছু করা সম্ভবপর কিনা, সেইটা খতিয়ে দেখার - নেতা হুঙ্কার দিচ্ছেন, দুকোটি - হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন - নেতার আশা, অন্তত দুকোটি মানুষকে দেশহীন করে ফেলা সম্ভব হবে - আমাদের শিল্পীরা কেমন ছবি আঁকছেন?
ছবিঃ আবদাল্লা আল ওমারি |
একদা শুনেছিলাম, কবি-শিল্পী-লেখক-গাইয়ে-বাজিয়ে-নট-প্রমুখ, অর্থাৎ যাঁদেরকে ভারিক্কি গলায় সৃষ্টিশীল মানুষ বলা হয়ে থাকে - তাঁরা নাকি ভারী সংবেদনশীল মানুষ। সমাজের প্রতিটি অনাচার, মানবতার প্রতিটি অবমাননায় তাঁদের প্রাণ কাঁদে - তাঁরা আমার আপনার চাইতে বহুগুণে বেশী সংবেদনশীল। আর তাঁদের সেই সংবেদনের প্রকাশ আলোড়িত করে সহস্র মানুষকে - উঠে আসে সামাজিক প্রতিবাদ - হ্যাঁ, তাঁদের হাতেই আছে সেই আশ্চর্য জাদুকাঠি, যা দিয়ে জাগানো যায় ঘুমন্ত সমাজকে - অন্তত এমনটাই শুনেছিলাম।
শিল্পী, অর্থাৎ ছবি আঁকেন যাঁরা, তাঁদের ক্ষেত্রে এই সুযোগ আরো বেশী, কেননা তাঁরা ভাষার ব্যবধান অতিক্রম করতে পারেন - বাংলায় ঘটে যাওয়া কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদে কবিতা লিখলে তা তামিল মানুষের বোধগম্য হয় না - কিন্তু, ছবির ক্ষেত্রে এই বাধা নেই।
বাংলার দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতার ছবি এমন করেই সবার সামনে এনেছিলেন জয়নুল আবেদিন, সোমনাথ হোর, চিত্তপ্রসাদ, দেবব্রত মুখোপাধ্যায় - এঁকেছিলেন দাঙ্গার ছবি। চাবাগানের শ্রমিকের লড়াইয়ের গল্প কিম্বা তেভাগা আন্দোলনের কথা - ডায়েরির ধাঁচে লেখায় আর ড্রয়িং-এ এনেছিলেন সোমনাথ হোড়। দেশভাগের যন্ত্রণা আর রিফিউজির অন্তহীন স্রোত ক্যানভাসে ধরেছিলেন পরিতোষ সেন। অর্পিতা সিং এঁকেছিলেন দেশভাগের মানচিত্র সম্পূর্ণ নিজস্ব শৈলীতে - কলকাতার মেয়ে দিল্লীতে ডেরা - স্বভাবতই তাঁর ছবিতে উঠে এসেছে দেশের দুই প্রান্তের ছিন্নমূল মানুষের অসহায়তা আর হানাহানির খণ্ডচিত্র। ফর্দ লম্বা হতেই পারত। বলা যেতেই পারত, দেশভাগ খুনোখুনি আর ক্ষুধার্ত মানুষের সারি গড়ে দিয়েছিল গণেশ পাইনের শিল্পীমানস - আমরণ তাঁর ছবিতে খুঁজে পাওয়া যায় এসবের অনিবার্য ছাপ। বলা যেতেই পারত বিকাশ ভট্টাচার্যের কথা - সমকাল যাঁর ছবিতে সবসময়ই প্রতিফলিত - কিম্বা রবীন মণ্ডল, প্রকাশ কর্মকারদের কথা। কিন্তু, এখন? এই গোলমেলে দিনের প্রতিফলন কতটুকু এখনকার শিল্পীদের ছবিতে?
না, শিল্পী কখনই সাংবাদিক নন - নিত্যকার ঘটনার জার্নাল মেইনটেইন করা তাঁর অবশ্যপালনীয় দায় নয়। তাঁর মনের মধ্যে আসা দৃশ্যকল্পকে তিনি রঙতুলি দিয়ে ধরেন কাগজে, ক্যানভাসে। কিন্তু, সেই মনের মধ্যে আসা দৃশ্যকল্পে সমকাল, পারিপার্শ্বিক হানাহানি, মানুষের অসহায়তা, সমাজের গরিষ্ঠ অংশের অনিশ্চয়তা ঠাঁই পাবে না এতটুকু? ছবিতে শুধুই ফুটে উঠতে থাকবে শিল্পীর সমকালবিমুক্ত অন্তর্দর্শন (শিল্পীর অন্তর্জগত যদি সমকালীন সঙ্কটে আলোড়িত না হয়, তাহলে সেই অন্তর্দর্শন তো নিছক আত্মকেন্দ্রিকতা), কিম্বা স্বপ্নের নারী, অথবা দৃষ্টিনন্দন প্রকৃতিদৃশ্য? এ কী তাঁদের অন্তর্জগতের যথার্থ প্রতিফলন? নাকি, তাঁরা সর্বার্থেই এমন অন্তঃসারশূন্য হয়েছেন, যে ক্লিশে বিষয় বাদ দিয়ে কিছুই আনতে পারেন না ক্যানভাসে?
তা যদি না হয়, এই বীভৎস সমকালের ছবি কেন পড়ছে না বর্তমান শিল্পীদের ছবিতে? এমপ্যাথি না হোক, র্যাশনাল কমপ্যাশনটুকুও অনুপস্থিত?
তেভাগার ডায়েরি আঁকার সময় সোমনাথ হোড় গিয়ে থেকেছিলেন আন্দোলনের মানুষগুলোর সাথে। একসাথে থাকা, খাওয়া, একই যাপন - তবু, ব্যবধান ছিল দুস্তর - সেইসব মানুষদের সাথে একাত্ম হলেও, এবং সেই মানুষেরা তাঁকে নিজেদের একজন বলে বুকে জড়িয়ে নিলেও, দিনের শেষে, অনিবার্যত, তিনি ছিলেন বহিরাগত। এই বাস্তব স্বীকার করেই তিনি এঁকেছিলেন তেভাগার ছবি, চাবাগানের মানুষগুলোর ছবি। এমপ্যাথির চাইতেও বড় হয়েছিল, ওই, র্যাশনাল কমপ্যাশন - যা তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন বইয়ের শুরুতেই - "খরায় গ্রাম পোড়ে, বন্যায় গ্রাম ভাসে। শহরে আঁচ লাগে কিংবা ভিজে যায়। দুইয়ে তফাত অনেক।… তোমাদের দুঃখ আমরা বুঝি, কিন্তু প্রতিদিনের সেই দুঃখ ভোগ করি না। এই দুইয়ে ফারাক খুব বেশী।" আর সেই সচেতন সীমাবদ্ধতা মেনেও তাঁর কাজ কালোত্তীর্ণ - আজও সমকালীন।
আর এখন? এই গোলমেলে বর্তমান সময়ে? তাহলে কি যেমন আশঙ্কা করেছিলাম, তা-ই সত্য? ধরে নিতে হবে, আজকের শিল্পীদের মধ্যে সহমর্মিতার বোধটুকুই অনুপস্থিত? তাহলে - এমপ্যাথির কথা বাদই রাখলাম - এমনকি, কমপ্যাশন হারিয়ে তাঁরা আদপেই সৃষ্টিশীল মানুষ তথা শিল্পী থাকছেন তো? তাঁদের সৃজন আদপেই শিল্প থাকছে তো? শিল্পীদের দুচারজন ইদানীং সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত - বিশেষ বিশেষ প্রতিবাদমঞ্চ আলো করে থাকতে দেখা যায় তাঁদের - কিন্তু, তাঁদের ছবিতে শিল্পে সেই প্রতিবাদ কোথায়? তাহলে কি তাঁরা তাঁদের পাব্লিক পার্সোনা আর শিল্পীসত্তার মধ্যে পাঁচিল তুলতে সক্ষম হয়েছেন? একে কি আমরা দ্বিচারিতা বলবো? র্যাশনাল কমপ্যাশন থেকে কমপ্যাশন হারিয়ে ব্যাপারটা শুধুই র্যাশনাল - যাকে আপনি আর কপনির আখের গুছোনো বলেও দেখা যেতে পারে?
এক প্রতিবাদী গায়ক একদা গান বেঁধেছিলেন - গানের গল্পটা মোটামুটি এরকম - গায়ক ও তার বন্ধু কোনো এক সুদূর অতীতে দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে রাজনীতি করতেন - সেই দিন বদল হয় না, কিন্তু গায়ক গানকে নিজের পেশা করেন - একদিন এক হাইওয়ের ধারে গায়কের সাথে দেখা হয় পুরোনো সেই বন্ধুর - সেই বন্ধু এখনও মানুষের সাথেই আছেন - কিন্তু, গায়ক আজ নিছকই পেশাদার এক গায়ক - সফলও বটে - সেই বন্ধু গায়ককে বলেন, এখন তো তোর নাম হয়ে গেছে, সুখেই আছিস তাহলে - বন্ধু চলে যান - কিন্তু, বন্ধুর সেই কথাগুলো আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় গায়ককে - ভুলতে পারেন না অমোঘ সেই কথা, সুখেই আছিস তাহলে!!
গায়ক আজ ক্ষমতার পাশে ঘুরঘুর করেন - গান করেন কম, উপস্থিত থাকেন বেশী। তবু, গানটা ভুলে যাওয়ার নয়।
তবে কি বর্তমানের এই কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে, এই মহৎ শিল্পীদের উদ্দেশ্যে সেই একই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার সময় এসেছে আমাদের - সুখেই আছেন তাহলে??