একেবারে হিন্দি সিনেমার মতো। ১৮ টি ট্র্যাক্টর ভর্তি দশাসই চেহারার উচ্চবর্গীয়রা এলো, কিছু কথা কাটাকাটির পর শস্যখেতে কাজ করা কিছু মানুষ, নাকি মুনিষদের ওপর ট্যাট ট্যাট ট্যারারারা করে গুলি চালালো, তারপর মেঠো পথে সাদা ধুলো উড়িয়ে চলে গেল যে দিক থেকে এসেছিল সেই দিকেই।
দেড় ঘন্টা বাদে হাঁপাতে হাঁপাতে পুলিশ এলো। ততোক্ষণে সব ভোঁ কাট্টা। খেতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে খানদশেক মেয়ে মরদের মৃতদেহ। তাদের হাঁমুখ আর রক্তেভেজা মাটি মাছিতে ঢেকে যাচ্ছে বলে নিকট আত্মীয়রা গামছা নাড়িয়ে মাছি তাড়াচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গত করছে হাহাকার আর কান্নার আওয়াজ। আহত আঠারো জন। পারফেক্ট হিন্দি ছবির সিকোয়েন্স!
কিন্তু ছবি তো নয়, এ ঘোর বাস্তব। উত্তর প্রদেশের শোনভদ্র জেলার একটি অখ্যাত গ্রাম উবভা। দেশের রাজধানী থেকে দূরত্ব মাত্র পাঁচশ মাইল। একলপ্তে অনেকটা জমির মালিকানা নিয়ে ঝামেলা চলছিল গ্রামমুখ্যের সঙ্গে। তাই জাতে হতদরিদ্র চাষি গুলোকে একেবারে নিকেশ করে দেওয়া। ঘাসের চাপড়া তোলার মতো শেকড়সুদ্ধ চড়বড় করে তোলা। বহু পুরুষ ধরে চষে এলেও জমি কখনো ছোটলোকের মালিকানায় যায় না এটা বোঝাবার জন্য গুলি চালিয়ে খানকতককে মেরে ফেলার চাইতে আরো ভালো উপায় কী হতে পারে ! গুজ্জরদের হাতে মরলেও এই গোন্দ ট্রাইবাল না- মানুষ গুলির স্বর্গপ্রাপ্তি হওয়া উচিত!
এই দেশের মূল অধিবাসী আদিবাসীদের জমি জঙ্গল রক্ষার্থে নানা আইন থাকলেও এদেরকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা খুব সোজা। প্রথমে ল্যান্ড মাফিয়ারা জমির রেকর্ড নিয়ে নানা কারিকুরি করে। হলে ভালো, নয় তো ভয় দেখানো, হাতে অল্প কিছু টাকা গুঁজে দেওয়া, তাতেও কাজ না হলে ভবনদী পার করিয়ে দেওয়া। আর জমি যদি হয় শোণভদ্র এলাকার মতো সোনা উগরানো, মিনেরালসে বোঝাই, তাহলে তো যা খুশি তাইই করবার অধিকার জন্মে যায় উচ্চবংশীয় প্রভুদের। আইনের ফাঁকফোকর এদের ভালোই জানা আছে। সে কারণেই জেলে বিচারাধীন বন্দীদের ৫৩% দলিত আদিবাসী আর মাইনরিটি। অথচ এরা গোটা দেশের জনসংখ্যার মাত্র ৩৯%। জনসংখ্যার অনুপাতকে ছাপিয়ে গরীবের এই জেল ভরার রহস্য আরো একবার উন্মোচিত করল শোনভদ্র ম্যাসাকার।
এই অবিচার এবং শোষণ প্রতিরোধে যেখানেই প্রতিবাদ এবং সংগ্রাম জন্ম নিয়েছে সেই সমস্ত জায়গাকেই দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে চরমপন্থার আঁতুড়ঘর হিসেবে। শোণভদ্র জেলা যেহেতু আদিবাসী অধ্যুষিত এবং মাটির তলায় ঠাসা খনিজ পদার্থের উপস্থিতির কারণে খুবই লোভ-জাগানিয়া, এখানেও স্বাধীনতার আগে এবং পরেও লাগাতার চলেছে আদিবাসী উচ্ছেদ এবং জমিদখল। সঙ্গে বিগত কয়েক দশকে নকশালপন্থীদের উপস্থিতি। সে সব অবশ্য এখন ইতিহাস। সেই ইতিহাস লেখার জন্য নির্বিচার ধরপাকড়, হাজতবাস, বন্দুকীরাজ, প্রাণহানি, সবই চলেছে। শুধু কোন চেষ্টা হয়নি আসল সমস্যা সমাধানের। তাই থেকে থেকে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো অশান্তি এই এলাকাকে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। অনুকূল পরিবেশে সে অশান্তি মহীরুহে পরিণত হয়ে ছিনিয়ে নিল দশটি তাজা প্রাণ, যার মধ্যে তিনজন মহিলা। পরিবেশ যে অনুকূলতর হচ্ছে তার প্রমাণ আছে ২০১৫-১৬ র ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর রেকর্ডে। ওই দুবছরেই দলিত আদিবাসীর বিরুদ্ধে অপরাধ বেড়েছে ৩৮,৬৭০ থেকে ৪০,৮০১। উত্তর প্রদেশ, বিহার,রাজস্থান এ ব্যাপারে এগিয়ে। এতো পুরনো রেকর্ড দিতে হল কারণ ২০১৬ সালের পর ব্যুরোর ডাটার আর কোন নবায়ন হয়নি। এ ব্যাপারে কেন্দ্র ও এই রাজ্যের শাসকেরও প্রবল অনীহা।
ওখানকার এক্টিভিস্টদের মতে জমির রেকর্ড পালটে দেওয়া, জমির উর্ধ্বসীমা পার হয়ে গেলে দারা পুত্র, এমনকি বাড়ির কুকুরের নামেও জমি রাখা, অল্পেতেই পিটিয়ে বা গুলি করে মেরে ফেলা ছোটলোকেদের, এসবই বেড়েছে উত্তরপ্রদেশে হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় আসবার পর। "এইসব উচ্চবর্গীয়দের হাত খুব লম্বা। উঁচু পদাধিকারীদের সঙ্গে এদের খুব দহরম মহরম। এ এমন এক জায়গা যেখানে সংবিধানও অকেজো।" নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে এমনই জানিয়েছেন গোন্দ আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করা এক্টিভিস্টরা।
যেমন এই কেসটা। ২০১৭ সালে গাঁওমুখিয়া যজ্ঞ দত্ত নিজের আর পরিবারের দশ জনের নামে ১৪৫ বিঘা জমি কিনেছিল বিহার ক্যাডারের এক আইএএসের কাছ থেকে। যেহেতু গোন্দ কমিউনিটির মানুষেরা ওখানে বংশপরম্পরা চাষবাস করে আসছে, জমির দখল পেতে বেগ পাচ্ছিলেন যজ্ঞ দত্ত মশাই। জমির এই হাতবদল মেনে না নিয়ে গোন্দ চাষিরা আবার রেভেনিউ ডিপার্টমেন্টে নালিশ ঠুকে দিয়েছিল। সিভিল কোর্টেও একটা কেস ঠোকা হয়েছিল। কিন্তু আদিবাসীদের কোনো সাহায্যই করেনি যোগী সরকার। প্রশাসনের ঔদাসীন্যের সুযোগ নিয়ে ঘটে যায় এই নারকীয় ঘটনা।
তারপরেও খবর যাতে লিক না করে, অন্য পলিটিকাল পার্টির মেম্বাররা যাতে পীড়িতদের ধারেকাছে ঘেঁষতে না পারেন সেজন্য ১৪৪ ধারায় মুড়ে ফেলা হয় গোটা এলাকা। প্রিয়ঙ্কা গান্ধী চুণার দুর্গে বসে থাকেন, নিহতদের নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা না করে ফিরবেন না। পৌঁছে যান বাম দলের সদস্যরাও। কয়েক দশক ধরে চাষবাস করলেও আদিবাসীরা কেন পাট্টা পাননি সে প্রশ্ন ওঠে। অভিযোগ করা সত্বেও কেন সুরক্ষা দেওয়া হয়নি ওঠে সে প্রশ্নও।
তবে বিরোধীদের সমাগমে প্রত্যক্ষ লাভ হয়েছে এইটুকু যে ক্ষতিপূরণবাবদ প্রাপ্য টাকার অঙ্ক যোগীজি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। এক লাফে মৃতদের জন্য পাঁচলাখ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে আঠারো লাখ। আরো যে সব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সেগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করলে একবিংশ শতকেও সমস্ত সুবিধাবর্জিত একটি দীন আদিবাসী গ্রামের আসল চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যেমন সরকারী প্রতিশ্রুতির মধ্যে আছে ঘর বানিয়ে দেওয়া, একটি পুলিশ চৌকি ও অঙ্গনওয়ারি সেন্টার তৈরি করা এবং দমকল কেন্দ্র উদ্বোধন করা। একটা গণতান্ত্রিক দেশে এই মুষ্টিমেয় ন্যায্য প্রাপ্যও দশটি প্রাণের দামে কিনতে হয় !
আমরা চাঁদে যান পাঠাচ্ছি। নিঃসন্দেহে এ এক বিরাট অর্জন। কিন্তু যে মাটি থেকে উৎক্ষেপণ হচ্ছে সে মাটি দেশের মানুষের রক্তে ভেজা। সে মানুষ গরীব, আদিবাসী, সংখ্যালঘু। কারণ নানাবিধ। কখনো গোহত্যার মিথ্যা অপবাদ, ধর্মীয় বিভাজন, কখনো জমিদখলের লালসা, কখনো বা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি। কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে হবে সমস্ত জল জঙ্গল জমি। তাই মরীয়া দখল চলছে সর্বত্র। এই মাৎস্যন্যায়ের ঘূর্ণিপাকে আরো কতো মানুষ বেঘোরে মরবে তা কে জানে !