লারপেন্ট সাহেবের ভাগ্যটা নেহাত মন্দ ছিল না। কাজের ক্ষেত্রে তার সুনাম ছিল বেশ। বড়সাহেবরা তার নাম বিলক্ষণ জানতেন। অনেকেই হয়ত করিৎকর্মা হতে পারে কিন্তু তার মত এমন সুযোগ ক’টা লোকের কপালেই বা জোটে? তা,এমন সুযোগ হঠাৎ এসে পড়ার কারণ হল, হালাত, সোজা কথায় যাকে বলে অবস্থার ফের।
আলেক্সজান্দ্রিনা ভিক্টোরিয়ার নজর এড়িয়ে কোন কিছু ঘটা সম্ভব ছিল না। সমুদ্র ঘেরা ওই একরত্তি দ্বীপের রাজপ্রাসাদে বসে সব তার নখ দর্পণে ছিল। সবই চলছিল ঠিকঠাক। বেশ খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে। এদিকে নেটিভ সেপাইগুলো হই হই করে বিদ্রোহ শুরু করে দিল। হাতির মত পেল্লাই এক দেশ। অসন্তোষের বারুদ জ্বলে উঠছে। গিন্নিমা বুঝলেন এবার রাশ টানতে হবে নিজের হাতে। ওই বেনেদের কোম্পানিকে আর বেশি লাই দেওয়া যাবে না। ও দেশে সোনা ফলে। এমন লক্ষ্মীমন্ত দেশের চাবি তার আঁচল থুড়ি গাউনের পকেটেই থাকা উচিত কি না।
বিদ্রোহের আঁচ নিভে যেতেই সময় নষ্ট না করে তিনি চাবির গোছা নিজের হাতে তুলে নিলেন।আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন ধীরে ধীরে কেমন ইংরেজি শিখে ইওরোপিয় আদব কায়দা শিখে একদল বেশ অবস্থাপন্ন জমিদার ঘরের লোক কলকাতায় বসে কেমন ঘোঁট পাকাতে শুরু করেছে। মোলায়েম ইংরেজিতে দাবিদাওয়া জানাচ্ছে বড়লাটের কাছে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ সরগরম করে রেখেছে ভারতসভার মঞ্চ। এরমধ্যে ফস করে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট জারি করে গণ্ডগোল পাকিয়ে দিলেন বড়লাট লর্ড লিটন। কলকাতার শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর সরকারি বিধিনিষেধে যথেষ্ট রেগে গেলেন। সে সময় সরকারি চাকরির একটা বড় অংশে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রবেশ শুরু হয়ে গেছে।রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ঊনিশ।
গিন্নিমা এবং তার সচিব, উপ সচিবের দল বুঝে গেলেন স্থানীয় পৌর প্রতিষ্ঠান গুলোতে এবার নজরদারি কিঞ্চিৎ বাড়াতে হবে। ভিত মজবুত করতে হবে। প্রশাসনের একেবারে তলার স্তর থেকে গড়ে তুলতে হবে শক্তপোক্ত ঘাঁটি। এদেশে উপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের হাত ধরেই এসেছিল মানব হিতৈষণা আর উদার পন্থা। অদ্ভুত বৈপরীত্য। গিন্নিমার নিজের দেশে তখন লিবার্যাল পার্টি ক্ষমতায় এসে গেছে। সেই সুদূর জোয়ারের সঙ্গে এলেন উদারপন্থী গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নতুন বড়লাট লর্ড রিপন। স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসনে ছিল তার গভীর সমর্থন। লোকাল বডি অর্থাৎ পৌর কমিটি,জেলা ও তালুকের লোকাল বোর্ডের মধ্য দিয়ে প্রশাসন নেমে আসতে পারে একেবারে সাধারণ মানুষের ঘরকন্নার মধ্যে। জল সাপ্লাই, ময়লা সাফাই, আলোর ব্যবস্থা,চিকিৎসা স্বাস্থ্য শিক্ষা সব এর মধ্যে। সরকার বাহাদুরের ইচ্ছে একজন একজামিনার অফ লোকাল আকাউন্টস নিযুক্ত করা,যিনি কাজ করবেন অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেলের অধীনে এবং তার কাজ হবে লোকাল বডি গুলোর আয় ব্যয়ের নিরীক্ষা করা।
তদানীন্তন অর্থ দপ্তরের দক্ষ কর্মচারী এফ ডি লারপেন্ট ডিসেম্বরের এক শীতের সকালে হাতে পেলেন সচিবের মোহর দেওয়া খাম। প্রথম এগজামিনার অফ লোকাল আকাউন্টস হিশেবে তার নিয়োগপত্র। মাস মাইনের সঙ্গে ২৫০ টাকা বিশেষ ভাতা।১৮৮০ সালে ২৫০ টাকা ভাতা বলেই দিচ্ছে পদ টি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ দায়িত্বশীল। খুব উঁচু মহলের সুপারিশ আনতে হয়েছিল।এইভাবেই স্থানীয় স্বায়ত্ত শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তার হিশেব পরীক্ষার কাঠামোটিও সমান গুরুত্ব দিয়ে রানি গিন্নিমার সচিবরা বানিয়ে দিয়েছিল। রাজ্য মহাফেজখানার দলিল দস্তাবেজে লারপেন্ট সাহেবের দপ্তরের ইতিহাস এখন আরাম করে ঘুমিয়ে আছে। আর সেদিন লারপেন্ট সাহেবের অনারে দাড়ি নেড়ে কলিমুদ্দি মিঞা মুরগি মটনের রোস্ট বানিয়ে ছিল, ইয়ারদোস্তরা খুলেছিল শ্যাম্পেনের বোতল, সাঁঝবাতির মৃদু আলোয় পিয়ানোর সিম্ফনির সঙ্গে মেহফিল তখন তুঙ্গে।
২
~~~~
তারপর কী হইল? আমার মামাতো বোন তাতাই ছোট্ট বেলায় কোত্থেকে শেখা একটা অদ্ভুত ছড়া বলত “এ বিধি কী হইল,/আরশোলা পাখি হইল,/দুর্যোধনে ভীম বধিল... (যদিও সে উচ্চারণ করত ভেম্বদিল)।তবে অঘটন ঘটন পটিয়সী বিধি সে রকম কিছু অঘটন ঘটালেন না। টেমস আর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেল। লারপেন্ট সাহেব হেভেনে গেলেন। উথাল পাতাল রাজনীতির ভিতর দিয়ে দেশ স্বাধীন হল। দেশ ভাগ হল। বিপুল জনসংখ্যা, গরিবি,অশিক্ষা বেরোজগারির চাপে নাভিশ্বাস উঠে লোকাল বডিগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল। সেগুলো নিজেরাই এতো নিস্তেজ হয়ে পড়ল যে হিশেব নিকেশ পরীক্ষার সেই সাহেবি দাপট তার জাতপাত সব খুইয়ে বসল। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে জনগণের বৃহত্তম অংশ সেই অবহেলিতই রয়ে গেল। তাদের নতুন পরিচয় হল এবার, তারা হয়ে দাঁড়াল রাজনীতির রাঘব বোয়ালদের ভোট ব্যাঙ্ক।
আর সেই সঙ্গে সমান তালে ক্ষীণজীবি হয়ে পড়ছিল পৌরসভা বা পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থবল নেই,ক্ষমতা নেই। একেবারে কোণঠাসা, মুখচোরা কতগুলো গরিবগুরবোদের এলেবেলে প্রতিষ্ঠান।
স্বাধীনতার এতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও গ্রাম এবং শহরের অগুন্তি সাধারণ মানুষদের ন্যূনতম মানবিক অধিকার গুলো যেন ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না। যোজনার পর যোজনা এসেছে। একই স্কিম নাম বদলে বদলে বার বার এসেছে। অবস্থার সুরাহা হয় নি। টাকাপয়সাগুলো যে কোথায় উড়ে গেল। কোটি কোটি অসহায় মুখ আর গদির লড়াই, এই নিয়েই চলছিল বেশ। স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম এবং স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধিজি। সংবিধানে সেই আদর্শের স্থান হল ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপল বা নির্দেশক নীতিসমূহে। এর মধ্যে রাজনীতির মোড়লদের মনে হল জনগণের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। সাধারণ মানুষকে তার অধিকার ও ভূমিকা সম্বন্ধে সচেতন করতে হবে, করতে হবে গনতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণ। বা অন্যভাবে কায়েমি স্বার্থের মৌরুসিপাট্টা। কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম। ১৯৯২ সালে ৭৩ ও ৭৪ তম সংবিধান সংশোধনের ভিতর দিয়ে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত, পৌর প্রতিষ্ঠান গুলোকে স্বনির্ভর ও শক্তিশালী করার রাজসূয় যজ্ঞ শুরু হয়ে গেল। কেন্দ্র থেকে হু হু করে টাকার বন্যা বয়ে যেতে লাগল। আর যাদের নিয়ে এসব কাজ কারবার তারা নিজেরাই জানে না কী ঘটতে চলেছে। দেদার টাকা, প্রচুর নতুন ক্ষমতা ,রাজনীতির ভাগ বাঁটোয়ারা, মাটির বাড়ি নিমেষে পাকা হয়ে যাচ্ছে, ধুলো ওড়ানো মোটর বাইকের ভটভটি, গলায় সোনার হার, ছোটোছেলের প্রোমোটারির ব্যাবসা। আর তারই পাশাপাশি ভ্যাবাচ্যাকা প্রান্তিক মানুষের দল ভুয়ো মাস্টার রোল, আজব বিপিএল তালিকা আর যোজনার পর যোজনার খেলায় নাস্তানাবুদ। স্বপ্নের উন্নয়ন তখনও অধরা। তছরুপ আর দুর্নীতি মাকড়শার জাল বুনছে। রাজ্যের পঞ্চায়েত এবং পৌর দপ্তরের সামনে তখন এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। নতুন করে সব ঢেলে সাজানোর অসম্ভব পরিশ্রম ও কঠিন প্রয়াস।
এদিকে লারপেন্ট সাহেবের সেই ঘুমিয়ে পড়া দপ্তরের কী হাল হল দেখা যাক। সেই বুড়ো দপ্তর তো তখন অন্তর্জলি যাত্রার পথে। কিন্তু তাহলে তো চলবে না। লোকাল বডিগুলোতে তখন হুমহাম করে কাজ শুরু হয়ে গেছে। এক পয়সার তৈল কীসে খরচ হইল ? এখন তো আর এক পয়সা নয়, কোটি কোটি টাকার গল্প। উপরন্তু হিশেব নিকেশ নিয়ম কানুনের ধার ধারতে এই নতুন ক্ষমতাশালীদের ভারি বয়েই গেছে। কাজেই সেই বুড়ো কে হেঁইয়ো জোয়ান হেঁইয়ো জোয়ান বলে আবার জাগিয়ে তোলার বিপুল চেষ্টা শুরু হয়ে গেল। তার চুলে কলপ লাগিয়ে, দাঁত বাঁধিয়ে,চশমা বদলিয়ে, হাতে পায়ে বাতের তেল মালিশ করে, ছেঁড়া জামায় তাপ্পি লাগানোর কাজ যখন পুরোদমে চলছে তখন সেই “অশ্লেষার রাক্ষসী বেলায় সমুদ্যত দৈব দুর্বিপাকে” বুড়োর সঙ্গে আমার দেখা হল। লারপেন্ট সাহেবের দপ্তরের ভার নিলাম আমি। প্রথম দিন অফিসে ঢুকে মনে হল ভুল করে কোন ছাপাখানায় চলে এসেছি না তো? পর পর দাঁড়িয়ে আছে ফোটোকপি মেশিন। হু হু করে কপি হচ্ছে দিস্তে দিস্তে কাগজ। বান্ডিল বান্ডিল অডিট রিপোর্ট।৩৩৫৪ টা গ্রাম পঞ্চায়েত , ৩৪১ টা পঞ্চায়েত সমিতি আর ১৮ খানা জিলা পরিষদ। পৌরসভা আর কর্পোরেশনও পিছিয়ে নেই। চারদিকে শুধু কাগজ কাগজ আর কাগজ। বসার জায়গা নেই, চলা ফেরার জায়গা নেই।ফাইলের পেছনে চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষের মাথা। উন্নয়নের খতিয়ান কাগজবন্দি করে চলেছে লোকাল অডিট অফিস। এমন অদ্ভুত অফিসে এর আগে কাজ করিনি।
কিন্তু কাজ করার লোক কোথায়? এই বিপুল অডিটসাম্রাজ্যের সৈন্যসামন্ত পেয়াদা বরকন্দাজ কোথা থেকে জোগাড় হবে? পুরোনো দপ্তরের তো হাতে গোনা লোক। তাদের অনেকেরই চিন্তা ভাবনায় জং পড়ে গেছে। কয়েকজন খুব ভাল ছিলেন, মনে আছে, তবে সংখ্যায় খুব কম। কাজেই বিভিন্ন অডিট অফিস থেকে ডেপুটেশনে লোকজন বন্যার জলের মত আসতে শুরু করল। সে এক উটকো বিপদ। বেনো জলের সঙ্গে সঙ্গত ভাবেই প্রচুর ঘোলা জল, কাদা আগাছাও আসত। নানান কিসিমের লোকজনকে সামাল দেওয়াও তখন একটা নিয়মিত ঝামেলার ব্যাপার ছিল। কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। উপরন্তু লোকাল অডিট তারা জানে না,কাজেই দফায় দফায় ট্রেনিং দাও।এই কম্ম করতে করতে ইয়া বড় একটা ট্রেনিং মডিউল তৈরি হয়ে গেল। তবে এই বেয়াড়া ধরনের কাজের কয়েকটা ভাল দিকও ছিল বৈকি।
প্রথম ভাল ব্যাপারটা হল বুড়ো অনেকটা সতেজ হয়ে উঠে ছিল। বহু বহু দিন কোণঠাসা হয়ে থাকার পর এই প্রথম হঠাত আলোর ঝলকানিতে তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছিল। কনফারেন্স, সেমিনার,ট্রেনিং সব সব তার নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। অডিটের অন্য শাখার স্মার্ট সহকর্মীদের সঙ্গে তুলনা করে একটা মুখচোরা হীনমন্যতা কোথাও বা লুকিয়েছিল। তাই এই এগিয়ে আসাটা দেখে খুব ভাল লাগত। পুরোনোরা ব্যাপারটা খুব উপভোগ করতেন।
কাজের ভাল মন্দ বিচার না করেই বলছি,অজ পাড়াগাঁ গন্ডগ্রাম, জলে কুমীর বনে বাঘ,গাছে সাপ,ঘরে মৌচাক, হাতি দাপানো জঙ্গল, হিমালয়ের গুহা কন্দর,বানভাসি এলাকা, মাফিয়া গুন্ডার হুঙ্কার কোথায় না অডিট ঢুকে পড়েছিল সেই সময় ! পানীয় জল নেই শৌচালয়ের ব্যাবস্থা নেই,এমনও অনেক জায়গা ছিল। ছিল রাজনৈতিকদাদাদের চোখ রাঙানি।
৩
~~~~
“গোরুবাথানের ঠান্ডা ভোর মনে আসে / পিছনে পাহাড় / টিলার ওপর সেই ফরেস্ট বাংলোর শান্ত সন্ধ্যা / তিস্তা, লিস,ঘিস নদীগুলি সঙ্গে এসেছিল/ থেকে গেল / থেকে যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং তুমি”
একবার ঠিক হল নর্থ বেঙ্গলের গোরুবাথানের কাছে একটা গ্রাম পঞ্চায়েত দেখতে যাব। এর আগে লাভা গিতবিয়ং নামে হিমালয়ের কোলে একটা সুন্দর ছবির মত পঞ্চায়েত দেখে এসে খুব উৎসাহ বেড়ে গেছে। পঞ্চায়েতের দুজন নিতে এসেছেন। কিছুদূর যাবার পর ওনারা গাড়ি থেকে নামতে বললেন। কেন? আর তো গাড়ি যাবে না। এবারে হাঁটতে হবে। ঠিক আছে, তাই হবে, চলুন। তারপর দেখলাম, না কিছুই ঠিক নেই। হাঁটতে হবে কালো বোল্ডার বিছানো পথে। দুএক কিলোমিটার তো বটেই। পুরো রাস্তাটাই নাকি এই রকম। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সেই দিন ওখানেই থেমে যেতে হয়েছিল।
“ বরং ভাল যাও ফিরে যাও তোমার রঙিন তাসের ঘরে / এ অন্ধকার তালার চাবি আরেক কর্মকারই গড়ে/ ঝরনা তখন বর্ণালিময় /মুচকি হেসে বলে না, না/সভ্য মানুষ কাব্য লেখো, ঝরনা হতে অনেক মানা “।
আরেকবার একটা পঞ্চায়েত সমিতিতে গেছি। এক তরুণ বিডিও বললেন লাঞ্চ টা করেই যান, রান্না তো হচ্ছেই।
না, না তা কেন? ও আমরা নিজেরাই ব্যাবস্থা করে নেব।
উনি বারবার অনুরোধ করেন। আমি বারবার একই কথা বলতে থাকি। আসলে অডিটের কাজে এসেছি, অকারণ আবার খাওয়া দাওয়া করব কেন ? ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাপারটা ঠাহর করতে পেরে বিডিও টি এইবার বললেন,” সে আপনি নাই খেতে পারেন। বলছিলাম কি,এখন বেলা আড়াইটে বাজে, পনেরো কিলোমিটারের মধ্যে কোন খাবার জায়গা নেই কিন্তু!”
এবারেও স্বীকার করতে লজ্জা নেই, ড্রাইভার ও অন্যান্যদের কথা ভেবে চাড্ডি ভাত মুখে দিতেই হয়েছিল সেই গ্রামে। দানে দানে পে লিখখা হ্যাঁয় খানেওয়ালো কা নাম।
আরেক মহিলা প্রধান কোন এক যোজনা খাতের টাকা দিয়ে মন্দির সংস্কার করেছেন। তাকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না যে কাজটা নিয়ম মেনে হয় নি। বাবার থানের সংস্কার করেছেন, এত ভাল একটা কাজ, চড়কে কতো বড় মেলা হয়, কত দূর দূর থেকে লোক বাবার থানে মানত করে,চরণামৃত খেয়ে ভাল হয়ে যায়। আর আজ আপনি বলছেন কাজ টা ঠিক হয় নি? আশ্চর্য ! তার কাছে গ্রামের উন্নয়নের মানে হচ্ছে বাবার থানের সংস্কার। এই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে যে দেশের সাধারণ মানুষের বড় অংশ গনতন্ত্র বিকেন্দ্রীকরণের মানেই বোঝে না,স্বাধিকার কি, সিদ্ধান্ত কি ভাবে নিতে হয়, ক্ষমতায়ন কাকে বলে, সে টা খায় না মাথায় দেয়,তাদের সচেতন ও আলোকিত করা একটা তুমুল কঠিন কাজ।
যতদূর জানি অডিটকে কেউ পছন্দ করে না। আমরা ঠান্ডা ঘরে সুদৃশ্য কাপে কফি আর কাজুবাদাম খেতে খেতে টেবিলের ওপাশে বসা সুটটাই পরা কর্পোরেট কর্তাদের খুব মেপে মেপে মিহি ইংরেজিতে বলি আমাদের নেগেটিভ ভাবে নেবেন না। আমরা তো aid to management। আপনাদের কাজে সাহায্য করি মাত্র, ভুল ত্রুটি নজরে এনে।
এই মেঠো অডিটের কাজে নেমে প্রকৃত অর্থেই aid to management হতে হয়েছিল আমাদের। এই প্রথম অডিটের পাশাপাশি আমাদের দিতে হয়ে হয়েছিল হ্যান্ড হোল্ডিং সাপোর্ট। হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা, আমি যে পথ চিনিনা। কি ভাবে ক্যাশ বই লিখতে হয়, কি ভাবে ক্যাশ মেলাতে হয়, ব্যাঙ্ক আকাউন্ট রাখতে হয়, ভাবে বিভিন্ন স্কিমের টাকার হিশেব রাখতে হয়,প্রায় হাত ধরে শিখিয়ে দিতে হত। তখন পঞ্চায়েত দপ্তরের সঙ্গে অডিট হাতে হাত মিলিয়ে একে অন্যের পরিপূরক হয়ে কাজ করেছিল বছর কয়েক। কাজের সূত্রেই আলাপ হয়েছিল প্রধানসচিব ডক্টর মানবেন্দ্রনাথ রায়, যুগ্ম সচিব দিলীপ ঘোষ, এনাদের অনুজ দিলীপ পাল প্রমুখদের সঙ্গে। পঞ্চায়েত দপ্তরে তখন ছিল ভাল ভাল অফিসারদের চাঁদের হাট। খুব ভাল কাজ করতেন তাঁরা। আমরা সময়োপযোগী সাহায্য করতাম সবসময়। পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল খুব সুন্দর ও সহায়তাপূর্ণ। বস্তুত প্রথম তিন চারটে বছর আমরা একরকম পার্টনারশিপে কাজ করেছি বলা যেতে পারে।অডিটের গতানুগতিক খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে এই কাজ করে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম। কাজকে ভালবাসা আর জ্ঞানের পরিধি, ওনাদের এই দুটো বিষয়ই ছিল মনে রাখার মতো। শ্রদ্ধা করার মতো।
৪
~~~~
এদিকে আমাদের অফিসের ব্যাপারটাও একটু অন্যরকম হয়ে পড়ল। বেনো জোল থিতিয়ে গেলে উর্বর পলির স্তর ফেলে যায়। ঠিক তেমনি আমাদের এখানেও নানা রকম ঘূর্ণি স্রোতের মধ্যে মধ্যে দিব্যি একটা সুন্দর দল তৈরি হয়ে গেল।
যাদের নিয়ে তৈরি হল তারা সবাই বাইরের অফিস থেকে এসেছিলেন। এমনকি অন্য রাজ্য থেকে। এই প্রথম শুকনো নীরস কাজের মধ্যে সৃজনশীলতার একটা চোরা স্রোত বইতে শুরু করল। আমাদের কাজকে নিয়ে যেতে হবে একেবারে সাধারণ মানুষের মধ্যে। গতানুগতিক পথে হাঁটলে হবে না। আউট অফ দা বক্স –বাস্কো থেকে বেড়িয়ে নতুন ভাবনা চিন্তার পালা,ফাইলের পাহাড় থেকে লাইফ কে তুলে আনা। কাজের মধ্যে নানা অভিনবত্ব আনবার,মনোগ্রাহী করে তোলার একটা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছিল খুব সঙ্গত কারণেই। সেই সময় দিলীপ চৌধুরী ( তখন এতজন দিলীপ ছিলেন!) ত্রিপুরা থেকে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। পন্ডিত মানুষ। উপরন্তু যে কোন ছাপাখানা সংক্রান্ত কাজে দারুণ উৎসাহী, অভিভাবক সুলভ এবং দক্ষ। নানান রকম পরিকল্পনা তাঁর কাছ থেকেও আসতে শুরু করল।এই ধুনোর ধোঁয়ায় বাতাস দিতে লাগলেন শুভ জোয়ারদার। ইন্দিরা আবাস যোজনা নিয়ে তার একটা সুন্দর কাজ ছিল। কিভাবে টাকা তছনছ হয়, কিভাবে মাথার ছাদ বিকিয়ে যায় তার একটা সচিত্র প্রতিবেদন। এই দলে আরও অনেকেই ছিলেন। সবচেয়ে বেশি উৎসাহ আর প্রশ্রয় এল তখনকার অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল জাফা সাহেবের কাছ থেকে।তার মারফৎ কতগুলো নতুন ভাবনার আমদানি হল। সেই প্রথম আমরা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নাম শুনলাম। আই আই টির এঞ্জিনিয়ার ইন্ডিয়ান রেভেনিউ সারভিস ছেড়ে দিয়ে রাইট টু ইনফরমেশনের আন্দোলনে মেতেছেন। রাজস্থানের প্রত্যন্ত গ্রামে সফল হয়েছে তার “জন শুনবাই “, সাধারণ মানুষের অধিকার সচেতনতার লড়াই। তার নাম সোশাল অডিট। অডিটর কোন বাইরের লোক নয়,গ্রামেরই জনতা। একেবারে ভেতর থেকে আসুক পরিবর্তন।তারাই তাদের ন্যায্য পাওনা বুঝে নিচ্ছে। না হলে প্রশ্ন করছে, কাগজ প্রমান দেখতে চাইছে, না পেলে ঝামেলা করছে। দিল্লি শহরের মিউনিসিপালিটি নিয়ে কেজরিওয়ালের আরেকটা কাজ ছিল, “হমারা পয়সা, হমারা হিসাব”। সাধারণ মানুষ ট্যাক্স দেয় অথচ নাগরিক সেবা পায় না। হিশেব বুঝে নেবে জনতা নিজেই। এই সব সিডি গুলো আমরা কাজে লাগাতে শুরু করলাম। অডিও ভিসুয়াল অনেক বেশি কাজ দেয়।
তাহলে আমরাও তো একটা এমন কিছু করতে পারি। সেই চিন্তা থেকেই এসেছিল “পঞ্চায়েতের চাবি” নামে পঞ্চায়েত দপ্তর আর অডিটের কাজ নিয়ে পুতুলনাচের সিডি। শুভ জোয়ারদারের বঙ্গপুতুল তার নামভূমিকায় । অডিট আর পঞ্চায়েত ডিপার্টমেন্টের যৌথ প্রয়াস। খুব সফল হয়েছিল এই উদ্যোগ। গ্রামের পর গ্রামে এই সিডি দেখান হত। সাধারণ মানুষের অধিকার, মেয়েদের অধিকার, ধর্ম নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছ হিশেব নিকেশ সব নিয়ে ঠাস বুনুন এক জমজমাট নাটক। কেন্দ্রীয় চরিত্র এক মহিলা গ্রামপ্রধান।
কিন্তু হলে হবে কি। ভাল কাজের বাগড়া না হলে সেটা আবার ভাল কাজ হল কেমন করে? ভাল কাজে বাগড়া ফাউ। সবাই আবার আনন্দের ভাগ নিতে জানে না। ওই ক’টা লোকের ভেতরেই আবার কিছু কাঁটা আর হুল লুকিয়ে ছিল। চেনা পথে না হাঁটলেই বিপদ। তাদেরই কোন এক পরিচিত সাংবাদিক চিবিয়ে চিবিয়ে রসিকতা মাখিয়ে মাখিয়ে ফোন করলেন “আচ্ছা, এটা কি পারফর্মিং আর্টের স্কুল?”।মানে বলতে চাইছিলেন, এটা কি নাইট্যশালা? তার নাম মাঝে মধ্যে একটি বাংলা দৈনিকে দেখা যায়। এখানেই শেষ নয়,একটি নাতি দীর্ঘ রিপোর্টও লিখলেন তিনি,নানান অনিয়মের অভিযোগ এনে ওই পুতুল নাচ নিয়ে,কিচ্ছু না জেনে, না বুঝে। অডিট ও পঞ্চায়েত একসঙ্গে মুখের ওপর উপযুক্ত জবাব দিল। সেটা ছাপাও হল। খুব তাড়াতাড়ি।
আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছিলাম, ওই মোটা গাবদা অডিট রিপোর্টের সারাংশটুকু নিয়ে একটা ছোট হাতবই বা বুকলেট বের করব, বাংলায়। সেটা প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েতে যাতে পৌঁছয় তার ব্যাবস্থা করা। খুব ছিমছাম সহজ বাংলায় যাকে বলে রিডার ফ্রেন্ডলি ভাবে অলঙ্করণ সমেত একটি পুস্তিকা আমরা বের করেছিলাম যাতে তাদের কাজের অনিয়ম অসঙ্গতিগুলো স্থানীয় লোকজনদের নজরে আনা যায় এবং তারা সে গুলো শুধরে নিতে পারে। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ এবং অধিকার সচেতনতা প্রয়াসে এরকম অনেক নতুন কাজ আমরা হাতে নিয়েছিলাম।
লোকাল অডিট ডিপার্টমেন্টের ১২৫ বছর (১৮৮০-২০০৫) পূর্তিতে একটা স্মারক সংখ্যা আমরা বের করি। সেখানে এই দপ্তরের ইতিহাস ও বর্তমান ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু মূল্যবান লেখা আছে। ভাল লিখেছিলেন দিলীপ চৌধুরী, শুভ জোয়ারদার,গৌতম দাশগুপ্ত প্রমুখরা।
সাধারণ মানুষের মধ্যে এন জি ও রা অনেকদিন ধরেই কাজ করে আসছে। এন জিও দের কাজ অনেক সময় অডিটের কাজের পরিপূরক হত। জাতীয় স্তরে অনেক অগ্রণী এন জি ও র সঙ্গে তখন সেমিনার বা প্যানেল ডিসকাশন করতাম আমরা। সামাজিক স্তরে কাজ করতে হলে অডিট কে শুধু কাগজের মধ্যে আটকে রাখলে চলবে না। কারণ কাগজ সব সময় সত্যি বলেনা। গরিব মানুষ গুলোর মধ্যে নেমে কাজ করতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সেই পথেও আমরা এগিয়ে ছিলাম। বাধাও ছিল প্রচুর। গ্রামে নানা রকম কায়েমি স্বার্থ কাজ করত। ব্যাপারটা তারা ভাল চোখে দেখত না। ভেতর থেকেও বাধা আসত। আসলে অডিটর তো সমাজ থেকে বাইরের কেউ নয়, কাজেই এ ধরণের কাজে যে সদিচ্ছা,দৃষ্টিভঙ্গি,পরিশ্রম দরকার ছিল তা হয়ত অনুপাতে কম ছিল আমাদের।
অডিটে অর্থনীতির অগ্রণী ক্ষেত্রগুলো বরাবরই হিশেব পরীক্ষার কাজে সবচেয়ে বেশি গুরত্ব পেয়ে এসেছে। সার্বিক ভাবে সেটাই বাঞ্ছনীয়। ওই সব মানুষ গুলো তো আর পেট্রল, গ্যাস, কয়লা নয়, সাঁজোয়া ট্যাংক নয়,বোমারু বিমান, কামান, এরোপ্লেন নয়, রেলগাড়ি নয়, রাজস্ব আমদানি নয় নিতান্ত হেলাফেলার কতগুলো আকাঠ অর্বাচীন চাষাভুষো,তারা দুমুঠো খেতে পেল কিনা, মাথার ওপর ছাদ পেল কিনা, ১০০ দিনের কাজ পাচ্ছে কি না এসব দেখার সময় আমাদের হাতে কম।
শেষ পর্যন্ত বাক্স থেকে বেরিয়ে আসা যায় না। তবুও তারমধ্যে ওই কিছুটা অন্যরকম তিন বছরে সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ, ফুল্লরার বারোমাস্যার সঙ্গে নিজেকে জুড়তে পেরে ভাল লেগেছিল। যতই যাই বলি না কেন আমরা, মানুষ কে মানুষের কাছেই ফিরে আসতে হয়। তবে জানি না, লারপেন্ট সাহেবের দপ্তর তার সামাজিক দায়বদ্ধতা ধরে রাখতে পেরেছে কি না।