কাশ্মীর নিয়ে গুরুচন্ডা৯'র আলোচনাচক্রের একেবারে শেষে কথা ওঠায় বলেছিলাম কাশ্মীরের মানুষ মূলত ব্যবসায়ী। পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে থাকা যেসব প্রাচীন জনপদ ভৌগোলিক অবস্থানের কল্যাণে একদা নানা সংস্কৃতির "মেল্টিং পট" ছিলো, তারই একটা কাশ্মীর। এইরকম অঞ্চলের মানুষদের কয়েকটা বৈশিষ্ট্য থাকে। তাঁরা ভালো কথা বলতে পারেন, মজার হন, ব্যবসায় সফল হন এবং অত্যন্ত অতিথিবৎসল হন। পুলোয়ামার কথায় এসব মনে পড়লো। কেন, সেকথায় পরে আসছি।
পুলওয়ামা নিয়ে আবহাওয়া খুব ভারি। অন্যের যুদ্ধ লড়তে লড়তে আরো কিছু জওয়ান মারা গেলেন। বিজেপি সরকার পাকিস্তানকে যথাযথ জবাব দেবে বলে আস্ফালন করছে। পাকিস্তান সরকার সমস্ত অস্বীকার করছে, মায় মাসুদ আজহারের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজের প্রমাণ নেই, এখনও নেই, এরকমও বলছে। চীন অতীতের মতই আবারও ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে কয়েকদিনের মধ্যেই। যুদ্ধ হবে বা হবেনা, সার্জিকাল স্ট্রাইকের মত অবিশ্বাস্য চাপানউতোর চলবে আরো কয়েকদিন পরে। দেশশুদ্ধ মানুষ জয়ধ্বণি দেবে। পাকিস্তানের সংবাদপত্র "দ্য ডন" লিখেছে ক্রস বর্ডার সন্ত্রাসবাদ অতি বিষম বস্তু, যৌথভাবে মোকাবিলা করা উচিত। ইরানে, ভারতে পরপর কনভয়ে হামলা হওয়ার পর তাদের একমাত্র বক্তব্য পাকিস্তানের কোন দায় নেই। প্রতিটি বিস্ফোরণ, প্রতিবার একদল করে মানুষ মারা যাওয়ার পর যে ফর্মে তারিখ বসিয়ে স্টেটমেন্ট দেওয়া হয় পাকিস্তানের তরফ থেকে সেই টেমপ্লেট সমানে চলছে।
এসবের মধ্যেই আরো কিছু কাশ্মীরী শালওয়ালা মার খেয়ে যাবেন। স্মৃতি নিয়ে আদিখ্যেতা করার জায়গা নেই, লোকে স্রেফ একটা রাজ্যের অধিবাসী হওয়ার জন্য মার খেয়ে যাচ্ছে এ ভারতে নতুন না। শিখদের সাথে হয়েছে। এবার কাশ্মীরের পালা। পুলওয়ামার আফটারম্যাথে শালওয়ালা মার খেলে যে ধরণের সুবিচার হয় ---ভারত এখন সেই ধরণের সুবিচারের তীর্থক্ষেত্র। মব ভায়োলেন্স খুব স্মার্ট কথা। আধুনিক ভারতের শপিং মল আর মাল্টিপ্লেক্সের মতই ঝকঝকে সেই শব্দবন্ধে ধরা আছে বিপুল মানুষের মনোভাব। এ নিয়ে লেখাপত্রও নয় নয় করে কম হলোনা। গুরুচন্ডা৯তেই সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন মব কীভাবে ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। মোদ্দা কথা সবই যেমনটা হওয়া কথা ছিলো তেমনই হচ্ছে ও হবে। আর কদিন পরেই ক্রিকেট শুরু হয়ে যাবে।
পুলওয়ামা বিস্ফোরণ পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে দেশজুড়ে যে জিঙ্গৈজমের রবরবা, তা যে মব মানসিকতা সেকথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। যে চারাগাছে গত কয়েকবছর সারজল পড়েছিলো নিয়মিত, আজ তা মহীরূহে পরিণত। সেই একই রেটরিক, যুদ্ধ চাই যুদ্ধ চাই চিৎকার, সেই ইশকুল-কলেজ-অফিস ফেরত ভারতবাসীর আইপিএলসুলভ আবাল মস্তি নিয়ে যুদ্ধের গজল্লা ---কিচ্ছু পাল্টায় নি। যেমন পাল্টায়নি কাশ্মীর নিয়ে মানুষের সীমাহীন অজ্ঞতা, যদিও গুরুচন্ডা৯ প্রকাশিত কাশ্মীরের প্রথম সংস্করণ প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় কীই বা লেখা যায়? আমার জানা নেই কোন ভাষায় লিখলে, কোন শব্দ ব্যবহার করলে মানুষকে অন্য মানুষ সম্পর্কে সচেতন করা যায়। তার ওপরে দেশপ্রেমের জোয়ারে অন্য কথা বলাই যাচ্ছেনা।
বহু কিছু বলা যাচ্ছেনা। বলা যাচ্ছেনা ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যর্থ হয়েছে, বলা যাচ্ছেনা আহত জওয়ানদের হেলিকপ্টার না পাওয়ার কথা। বলা যাচ্ছে না প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখে আসা যে সেনা কনভয় কাশ্মীরে যখন বেরোয়, সেই রাস্তায় পাহাড়ার প্রচন্ড কড়াকড়ির কথা। কোনরকম অন্য সম্ভাবনার কথা বলা যাচ্ছেনা, বলা যাচ্ছেনা যে অন্তর্ঘাত হয়ে থাকতে পারে। বলা যাচ্ছেনা যে বিজেপি সরকার পাতি চুয়াল্লিশ জন জওয়ানকে বলি দিয়ে দিলো ভোট এসে গেছে বলে। এসব বলা যাচ্ছেনা, প্রশ্ন তোলা যাচ্ছেনা কারণ মব ঘুরছে। আমার আপনার সবার মাথার পেছনে সারসার রক্তপিপাসু মানুষ অপেক্ষায় --বেচাল দেখলেই হলো।
পরিস্থিতি অনেকটা দেশভাগের সময়ের মত । ভারতের জেলে বন্দী এক পাকিস্তানের নাগরিককে অন্য কয়েদিরা মেরে ফেলেছে। পাকিস্তানে একটা স্কুলে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি নিয়ে অনুষ্ঠানে হিন্দি গান বাজানোর জন্য স্কুলের রেজিস্ট্রেশনই বাতিল হয়েছে। একে একে স্টেডিয়াম থেকে সরে যাচ্ছে ক্রিকেটারের ছবি। যদিও এখনও কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের, মন্ত্রীদের ছবি সরিয়ে ফেলার খবর নেই। খবর নেই প্রধানমন্ত্রীর দাবিদাওয়ার, নোটবন্দী থেকে সার্জিকাল স্ট্রাইক পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কার্য্যক্রমে যে সন্ত্রাসবাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা সেই জিনিসই বিপুলভাবে ফিরে আসে কিকরে সে জবাবদিহির। কৈফিয়ৎ চাইতে কেউ রাজি নয় - কিছু সিকুলার লিবটার্ড বামপন্থী আর কাশ্মীরীদের বাদ দিলে।
মুষ্টিমেয় যাঁরা খবর রাখেন তাঁরা সৌদি আরব থেকে পেট্রোডলার ঢোকার কথা বলছেন। অজিত দোভালের নাম এ প্রসঙ্গে উঠে আসছে, শৌর্য্য দোভালের নামও। কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে একটা ব্যাপার তেমনভাবে উঠে আসছেনা। সেটা হলো অজিত দোভালের কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি নীতি। দোভাল ডক্ট্রিন বলে পরিচিত এই নীতিতে কোন কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেই। এই নীতি বলে "অফেন্সিভ-ডিফেন্সিভ" নামে একধরণের স্ট্র্যাটেজি, যার মূল কথা হলো আক্রমণ করে যাও কোল্যাটেরাল ড্যামেজের কথা না ভেবে। মিজোরামে, কাশ্মীরে -দুই জায়গাতেই দোভালের স্ট্র্যাটেজি একই - অস্থিরতার মোকাবিলায় মিলিটারি অফেন্সিভ চালিয়ে যাওয়া। দোভালের মতে এইভাবে অগ্রাসন চালিয়ে গেলে একটা সময় প্রতিরোধ করার শক্তি হারিয়ে ফেলবে উল্টোদিকের লোক। বলা বাহুল্য, এই উল্টোদিকের লোক ভারতবাসী। দোভাল ডক্ট্রিনের আরো একটি মহামূল্যবাণ কথা - ব্যক্তিগত নৈতিকতার ওপরে দেশের ভালোকে জায়গা দিতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে "গ্রেটার গুড' এর ছবি দেখিয়ে ড্রোন আক্রমণে সিভিলিয়ান মেরে মেডেল পায়, দোভাল নেতৃত্বাধীন কাউন্টার-ইন্সার্জেন্সিও একই পথের পথিক। শুধু তফাৎ হলো দোভাল এটা করেন নিজের দেশের মানুষের ওপর।
পরের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আরো কঠিন। অজিত দোভালের মত দুঁদে লোকের হাতে ইন্টেলিজেন্স, যিনি নিজেই নাকি সাত বছর পাকিস্তানে আন্ডারকভার এজেন্ট হিসেবে কাজ করে এসেছেন, গিলানি থেকে ইয়াসিন মালিক সবার সঙ্গে আলাপ আছে যাঁর ---তাঁর ইন্টেল বলতে পারলোনা এত বড়ো পরিকল্পনার কথা? জিতলে মেডেল, ব্যর্থ হলে পদত্যাগ কেন নয়? বিশেষ করে এতবড় ব্যর্থতার? যদিও যুদ্ধ যুদ্ধ করে লাফানো মানুষেরা কেউ কৈফিয়ৎ চাইছে বলে খবর নেই।
শুরুতেই লিখেছিলাম কাশ্মীরের মানুষের ব্যবসা বোঝার কথা। কাশ্মীর নিয়ে একেবারে হালে যা হচ্ছে তা হলো একটা সুপরিকল্পিত ব্যবসায়িক পদক্ষেপ। পুলওয়ামা পরবর্তী কাশ্মীরে সবথেকে বড়ো আঘাত আসছে ব্যবসার ওপর। ইতিমধ্যেই কাগজে প্রতিবেদন হচ্ছে ট্যুর বাতিল নিয়ে ---পর্যটকেরা ভয় পেয়েছেন স্বাভাবিকভাবেই। অন্য রাজ্যে গিয়ে যাতে ব্যবসা না করা যায় তার ব্যবস্থা হচ্ছে সুরভিত মব লেলিয়ে দিয়ে। ছাত্ররা বা কর্মসূত্রে অন্যত্র থাকা কাশ্মীরীদের সুযোগ পেলেই মারধরেরও খবর আসছে। একটা রাজ্যকে, তার সিংহভাগ মানুষসমেত চুলোর দুয়ারে পাঠানোর ব্যবস্থা সম্পূর্ণ। কাশ্মীর, তার ইতিহাস, মানুষ ও সম্ভাবনা সমেত আসন্ন ভোটের কোল্যাটেরাল ড্যামেজ হতে চলেছে। ২০১৮ সালেই ব্যবসাপত্রের যা অবস্থা ছিলো, এরপর ওদের কেউ বাঁচাতে পারবেনা।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কী করতে পারি ? এই মুহূর্তে যা করতে পারি, তা হলো না জেনে কথা বলা বন্ধ করতে পারি। চুয়াল্লিশ জন জওয়ান মারা গেলেন চাকরি করতে গিয়ে। একটু ভেবে দেখতে পারি আমাদের মধ্যে কে কে আছে যারা ঐ মাইনেয় চাকরি করতে গিয়ে রুটিন ট্রান্সপোর্টেশনের সময় মরে যেতে প্রস্তুত। যুদ্ধ যুদ্ধ বলে চিৎকার করার আগে আয়নায় নিজেকে জিগ্যেস করতে পারি যুদ্ধ সম্পর্কে কতটা অভিজ্ঞতা আমার আছে? নিজের সন্তানকে যুদ্ধে পাঠানোর এবং হারানোর প্রস্তুতি আছে কিনা জানতে চাইতে পারি নিজের কাছে, সন্তানের কাছেও। এই সহজ সত্যিটুকু স্বীকার করতে পারি - যেসব পরিবারে অকস্মাৎ মৃত্যু আসে সেসব পরিবারের কাছে ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথের থেকেও, জঙ্গীদের শায়েস্তা করার থেকেও ঘরের লোকটা অক্ষত থাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকতে পারে। সময় পেলে প্রিভিলেজের বেড়া দেওয়া নিজের জীবন নিয়েও ভাবতে পারি। নানা প্রান্ত থেকে যারা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব করছে তাদের অনেকেই প্রিভিলেজড মানুষ, অনেক আগেই ভালনারেবিলিটির সেই বেড়া পার করে নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে গেছে যেখানে যুদ্ধ পৌঁছয় না। না পৌঁছতে পারলেও কি এ যুদ্ধ চাইতাম, এবং যাদের এ প্রিভিলেজ নেই তারা কি সত্যিই চাইছে --- এই প্রশ্নগুলো নিয়েও ভাবা যেতে পারে, বিশেষত ফস করে কাশ্মীরে ডিপ্লয়েড হয়ে মরে না যাবার প্রিভিলেজ যখন আপাতত মজুত।