আছড়ে পড়ার শব্দে মুখ তুলে তাকায় মনীষা। চিলের ছানা মনে হলো । নাকি পায়রা। রেস্টোরান্টের পুরু কাঁচের ওপাশে উড়ে এসে ধাক্কা দিয়ে, সড়সড় নেবে গ্যালো। মনীষা কফিতে মন দেয়। কমলেশের দিকে চিনির প্যাকেট এগিয়ে, কফিতে এক চুমুক দিয়ে, শূন্য কাঁচের দিকে তাকায় আরেকবার। কোনো আঁচড়ের দাগ নেই। কফিকাপ নাবিয়ে রেখে স্পষ্ট তাকিয়ে বলে ,
- না , কাকু । এই অনুরোধটা করবেন না । আমি যা সত্যি বলে জানি , তার বাইরে গিয়ে গল্প সাজানো সম্ভব নয় ।
কমলেশ একটু কাশেন । এরকম সময়ে কাশতে হয় । সরকারি সচিব হিসেবে "না" শোনার বড় একটা অভ্যেস নেই তাঁর , মন্ত্রী-সান্ত্রী ছাড়া । মনীষার ব্যাপার অবশ্য একটু আলাদা । বন্ধুকন্যা । তারওপর , নির্দেশ আছে কোনো জটিলতায় না গিয়ে পরিস্থিতি সামলে নেবার । কমলেশ তৈরী হন , কফিতে চুমুক দিয়ে : বেশ তুমিই বল, তোমার বাবা ,কবি অখিলবন্ধু সেন , সাত বছর আগে , হিমাচলের কাঠুরি হিল স্টেশনে গেলেন একা একা , এবং তারপর তাঁর বডি , স্যরি, মরদেহ উদ্ধার হলো একটা খাদ থেকে , প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় উনি, খাদে , ঝাঁপ দিয়েছিলেন ।
- দু’দিকে হাত ছড়িয়ে ।
মনীষা যোগ করে । চীজকিউব কাটা স্বর । তার চোখ কাঁচের দেয়াল ছাড়িয়ে দূরে কোথাও ।
কমলেশ ধরে নেন : হ্যা-অ্যা , ঠিক ! আ ক্লীন কেস অফ সুইসাইড । কিন্তু কেন ? তোমার কী মনে হয় ?
- উনি পাখি হতে চেয়েছিলেন । কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ।
কমলেশ একটা গোলমরিচের কৌটো উল্টোতে উল্টোতে সামলান এবার । যেন পিসার মিনারকে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করছেন, এমত কুশলতায় , সোজা দাঁড় করিয়ে , ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন মনীষার দিকে ।
-পাখি ? ?? একজন ফিফটি এইট ইয়ার্সের ইংলিশের লেকচারার অ্যান্ড , অ্যান্ড দি মোস্ট ওয়েলনোন রাইটার অফ আওয়ার টাইম , তিনি পাখি হতে চেয়ে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিলেন ? এইসব গল্প তুমি স্কুল কলেজের বইতে লিখতে বল ? মনীষা প্লীজ ! প্লীজ বিহেভ ম্যাচিওর !
এবার , চশমা খুলে ন্যাপকিন ঘষতে থাকেন । ওয়েটার অপেক্ষায় ছিল ।সরু গোঁফ ও সুরেলা গলায়, দিব্যি ছেলেটি । টেবিলের আলোচনা থেমেছে ভেবে ফাঁক খুঁজে জিজ্ঞেস করে : ম্যাডাম আর কিছু ? মনীষা বলার আগেই কমলেশ হাত নেড়ে : না । সজোরে , গ্লাস জোড়া ঘষতে ঘষতে বলেন : চারপাশে কী ঘটছে তুমি জানো না ! এই অসময়ে জ্যাম পেরিয়ে , আর ইয়েস তোমাকেও কাজের মধ্যে থেকে এখানে ডেকে এনেছি কেন , প্লীজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড !
কমলেশের চশমা চোখে ওঠেনা। আমলার কাঠিন্য, উপযাচকের অনুরোধ সব লেপ্টে থাকে সারা মুখে।
- কী মুশকিল ! বাবার পাখি সিরিজ সবচে আলোচিত এবং বিখ্যাত বই । মানুষ তার জীবনের বিকেলবেলায় পৌঁছে পাখি হয়ে যাওয়ার কথা সেখানে বারবার আছে তো ! এন্ড দ্যাট’স অল্সো , থ্রু আ ফাইনাল অ্যান্ড ফ্রি-ফল ।
মনীষা এইটুকু বলে, একটু জল খায় । পাশের টেবিলের মাথায় ঝাড়বাতির কারুকর্ম তদারক করে খানিক । সেদিক তাকিয়েই বলে : কবি অখিলবন্ধুকে অস্বীকার করলে আর তাঁর কবিতা ঘটা করে ক্লাসে পড়ানোর দরকার কী ?
কমলেশ সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলেন । হাল ছাড়েন না ।
আবার ধীর স্থির ভাবে হাতেখড়ি থেকে শুরু করেন : দেখো মনীষা - এই ঘটনাটা নিয়ে শিক্ষা দপ্তরের উপর রীতিমতো চাপ আসছে । অভিভাবকদের ফোরাম দাবি তুলেছে যে , অখিলবন্ধু মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এটা লিখিতভাবে কবি পরিচয়ে রাখতে হবে । ইউ নো , আজকাল এসব ব্যাপারে মানুষ খুবই সচেতন । একজন বিখ্যাত লোক , মানে বিখ্যাত কবি আরকি, তিনি হঠাৎ সম্পূর্ণ বিনাকারণে আত্মহত্যা করলেন , এ মানে, চাইল্ড অ্যান্ড ইউথের মনে ভীষণ খারাপ প্রভাব ফেলবে । ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া জল কদ্দুর গড়িয়েছে । শহরের নামী সাইকোলজিস্টদের ইন্টারভিউ ছেপেছে দৈনিক চায়েগরম পত্রিকা । প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কবির বন্ধু ছিলেন এসব কথা উঠছে । ইটস টেকিং আ পলিটিকাল কালার । তুমি , তুমি জাস্ট একটা স্টেটমেন্ট দিলেই ব্যাপারটা এখন সামলে যায় !
হাঁফ ছাড়েন শেষটুকু বলে । চেয়ারে পিঠ দিয়ে বসেন ।
মনীষা নিজেতে ডুবে ছিল। কমলেশের কথায় ফিরে আসে : কবির ব্যক্তিগত জীবন কবে থেকে এত গুরুত্বপূর্ণ হলো কাকু? কবি ভক্তিপদ সামন্তর বর্ণময় মাতলামির ইতিহাস নিয়ে আপনারা কী করছেন ?
কমলেশ লুফে নেন : তুমি জানোনা ? আই সী । ভক্তিপদকে নিয়ে তো অলরেডি "নেশার কবলে একবিংশ " প্রবন্ধমালা লেখা হয়েছে । তার অংশবিশেষ আমরা রেখেছি হাইস্কুলের সিলেবাসে ।
-তাহলে আর কি ! আপনাদের প্রাবন্ধিকদের বলুন একটা "আত্মহন্তা অখিলবন্ধু " নাবিয়ে ফেলতে । মিটে গ্যালো !
মনীষা ব্যাগ গুছোতে গুছোতে ,ফাইনাল ভারডিকটের মতো শুনিয়ে দেয় : আমার জ্ঞানতঃ আমার বাবা অখিলবন্ধু সেন কোনো মানসিক সমস্যার চিহ্ন দেখান নি । কাজেই আমি ওরকম কোনো স্টেটমেন্ট দিতে পারছি না । উঠি আজ ।
কিন্তু ওঠা হয়না । কাঁচের দরজা খুলে যে লোকটি টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছিল সেদিকে চোখ যায় মনীষার । অনিকেত এখানে এলো কিকরে ? তোতনকে ইস্কুলে আনতে যাওয়ার কথা তো । তাহলে কি কমলেশ অনিকেও ...!
ভাবনাচিন্তার মাঝেই ধাতব বিশ্রী আওয়াজ । তুলে ধরে চেয়ার সরাতে পারেনা অনিকেত । কোনোকালেই ।কমলেশ ও মনীষার মাঝের জায়গাটি দখল করে এসে বসে হাঁসফাঁস কোরে। কোন প্রশ্নের আগেই , বলে : আরে আঙ্কলকে একটা দরকারে কল করে জানলুম তোমরা এখানে থাকবে ,তো আরকি , হে হে ।
মনীষা কিছুই বলেনা । তিনপাশে কাঁচের দেওয়াল । বহুতল মলের ওপর বিলাসবহুল ঝুলন্ত রেস্টোরান্ট । শহরের অনেকদূর অবধি দেখা যায় ,কিন্তু বাইরের হাওয়ার ঝাপট -ধুলো কিছুই পৌঁছোয়না । শুধু এসি মেশিন চলার খুব নীচু ভোঁতা আওয়াজ অবিরাম । নওলকিশোর ওয়েটার । তার মধ্যেও কেমন দমবন্ধ হয়ে আসে মনীষার । উঠে কি চোখেমুখে জল দিয়ে আসবে ? কমলেশকাকু অনিকে ডেকেছেন কেন ? ভালো ঠেকছেনা ।
নওলকিশোর আশপাশেই । মনীষা তাকে ডেকে মেনুটা অনিকেতের হাতে ধরায় । অনিকেত না তাকিয়েই ক্যাপুচিনো অর্ডার করে । সুরেলা কিশোরকণ্ঠে আরো কিছু খাবারের নাম ভেসে আসে , তার মাঝেই কমলেশ অনিকে বলেন ,
-তোমরা কথা বলে নাও । আমি আমার দিক থেকে মনীষাকে যা জানাবার জানিয়েছি ।
-আমিও আমার দিক থেকে যা বলার বলেছি ,কাকু । ঝটিতি উত্তর দেয় মনীষা ।
অনিকেত , মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে নওলকিশোরকেে সরায় । তারপর , নম্র স্বরে কিছু একটা বলতে গিয়ে বোকার মতো হেসে ফ্যালে । গম্ভীর হয় , মনীষার দিকে তাকায় । কিন্তু শেষে সেই গোলমরিচের কৌটোর দিকে তাকিয়ে বলে ,
- আমি কিন্তু আঙ্কলকে কথা দিয়েছি যে ...
- কথা দিয়েছো মানে ?
অনিকেত একটু সামলে নিয়ে বলে : মানে এটা সিরিয়াস ব্যাপার । তুমি টিভিফিভি দেখোনা তাই জানতে পারোনি । এইতো গত সপ্তাহে, নাজী বাংলায় চৌকো-মন বলে যে প্রোগ্রামটা হয় , সেখানে বাবাকে নিয়ে ডিসকাশন ছিল । সোশ্যাল মিডিয়ায় সবাই আলোচনা করছে ! জাস্ট থিঙ্ক ,আঙ্কল একটা গাভমেন্ট ম্যাটার নিয়েও পার্সোনালি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। মেন্টাল ইস্যুটা তুমি একসেপ্ট করে নেবে ,এটা ভেবেই আমি কমিট করেছি যে ...
মনীষার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায় । অনিকেত কী বলছে এসব ! মাথা দপদপ করতে থাকে । প্রেশারটা বাড়লো নাকি । একবার গলা চড়িয়ে বলতে যায় , তুমি আমার হয়ে কমিট করেছো মানেটা কী ...তার বাক্য সম্পূর্ণ হয়না । দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরে ওঠে ।
অনিকেত হাত ধরে নেয়, কমলেশ ইঙ্গিতে বলেন তিনি দাম মিটিয়ে বেরিয়ে যাবেন । উইল কল এন্ড টক লেটার ।
... দুজনে গাড়িতে ওঠে ,ড্যাশবোর্ডের ওপরেই প্রেশারের ওষুধ ছিল । ছোট বোতলে জল ।
অনিকেত একবার স্যরি বলে । মনীষা জানলার অর্ধেক তোলা কাঁচে মাথা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে । নিঃশব্দে ওভারব্রিজ পেরোতে থাকে গাড়ি । একটু উসখুস করে ,অনিকেত আবার জিজ্ঞেস করে , অখিলবন্ধু পাহাড়ে যাওয়ার আগে, ঠিক কী বলেছিলেন । মনীষা জানায় : দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে গেস্ট লেকচার । রেকর্ড আছে , শুনে নিও । অনিকেত আগে শুনেছে । লিটারারি ফর্ম -মনের মুক্তি এসব নিয়ে দুর্বোধ্য হাবিজাবি । ওগুলো কমিটির হাতে তুলে দিলে কি ওরা কোনো কনক্লুশন ড্র করে নিতে পারবে ? এনিওয়ে, কমলেশ আঙ্কলকে জানাতে হবে ।
অখিলবন্ধুর লেখালেখি অনিকেতের কেমন লাগে সে নিজে বিশেষ জানেনা । বিখ্যাত কবির জামাই হিসেবে কেউ রেকগনাইজ করলে তো ভালোই লাগে । কিন্তু একটা মৃত মানুষের উপস্থিতি তার ফ্যামিলি লাইফ ঘেঁটে দিচ্ছে এটা জাস্ট অসহ্য ।
গাড়ি সিগন্যালে দাঁড়ায় । টক-টক শব্দ । অর্ধেক তোলা কাঁচের ওদিকে গোলাপ বেচা বাচ্চা একটা । অনিকেত কাঁচ তুলে দেয়। বিড়বিড় করে : কবরখানার ফুল যত । ডিসগাস্টিং। গাড়ি ছাড়ে , তোতনের ইস্কুলের স্টপে পৌঁছে অনিকেত বলে ; অন্তত বাচ্চার কথা ভাবতে । তোতন এমনিতেই জেদি হচ্ছে দিন কে দিন । স্কুল থেকে বলছে একটা সেশন নিতে কাউন্সেলরের কাছে । বড় হয়ে সে কি জানবে তার দাদু পাখি হবার জন্যে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করেছিলেন ?? মনীষা -মনীষার বাবা সবাই এত সেলফিশ কেন ?
গাড়ি দাঁড় করিয়ে অনিকেত নেবে যায় । মনীষা বসে বসে চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে । তোতন । অনেক, অনেকগুলো তোতন । তোতনরা যেই জানতে পারছে দাদুভাই পাখি হয়ে গেছিলেন , অমনি তাদেরো ডানা গজাচ্ছে । উড়ে বেড়াচ্ছে । এদিকে চোখ খুলতেই সামনে বড় রাস্তা জুড়ে পায়রা , কারা দানা ছড়িয়ে রেখেছে কে জানে । দল বেঁধে সব ঝাঁপিয়ে এসেছে রাস্তায় । এখানে আগে বাজার ছিল । সব ক্লীন করে আন্তর্জাতিক মানের ইস্কুলবাড়ি উঠেছে । শুধু একদল চিল এখনো উড়ে বেড়ায় এদিক ওদিক । ওরা তো দানা খায়না । তাও কেন ওড়ে কেজানে । অথচ গাড়ির ভেতর কেমন দমবন্ধ । মনীষার কান্না পায় হঠাৎ । কিন্তু উড়ন্ত তোতনদের দৃশ্যে কেমন নাক-কান বেয়ে ফিনিক দিয়ে হাসি বেরিয়ে আসে রক্তের মতো , একা খিলখিল করে হাসতে থাকে মনীষা গাড়ির মধ্যে বসে । অকারণ।
অনিকেত তোতনকে নিয়ে গাড়ির দিকে আসছিলো । শ’য়ে শ’য়ে পায়রা এলোমেলো উড়ে বেড়াচ্ছে চারপাশে । গাড়ি দেখা যাচ্ছেনা, এমন! ছেলেটাও এত অবাধ্য হয়েছে।ওই ওই হাত ছাড়িয়ে পায়রাদের পেছনে ছুটে গেলো ! ! এলোমেলো ঝটাপট আওয়াজ । বিশ্রী পালকের গন্ধ । এর মধ্যে দিয়ে অনিকেত এগোবে কিকরে ! দূর থেকে ,ভেতরে মনীষাকেও দেখতে পায়না। ওদিকে ,পাখিগুলো কাঁচে ,ফ্রন্ট মিররে আর দরজার লকে ফিরে ফিরে ঠোক্কর দিচ্ছে। আছড়ে পড়ছে পাখির দল । মনীষা কেঁপে কেঁপে হেসে চলেছে গাড়ির ঠাণ্ডা শাদা শব্দের ভেতর ।
`
"
..."সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধা আসে; ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে---সব নদী---ফুরায় এ জীবনের সব লেন দেন"...
দারুন গল্প...প্রচুর ভালোলাগা রইল...