" Even the tree which blooms, lies " - Theodor Adorno, Minima Moralia
- দাদা একটু সরে বসবেন?
: কেনো?
- না-না, আমি কথা বলছি..
প্রথম ছেলেটিকে সরিয়ে যে এসে দাঁড়ায়, পরনে স্কার্ট, শ্যামলা একটি মেয়ে, একটু গলা ঝেড়ে খুব বিনয়ের সঙ্গে বলে:
- আমাদের এখানে একটা শুটিং চলছে। আপনাকে সরে পাশের ওই টেবলে বসতে হবে। প্লীজ যদি..
বিরক্ত হয় অনিকেত। উঠে যাবে?
: আবার অন্য টেবল কেন? চলে যাচ্ছি। আপ্নারা শুটিং ফুটিং করুন।
- স্যরি স্যার। আপনি প্লিজ উঠবেন না।
আমাদের প্রোডাকশন ম্যানেজার আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।
: তিনি আবার কিনি? এই বললেন উঠে যেতে!!
আবার কিছুক্ষণ বসে থাকা। এতক্ষনে খেয়াল করে দুটো দামড়া ক্যামেরা সেট করা লম্বা হলের দুই কোণে। ক্যামেরা দেখলে এমনিতেই বিরক্তি লাগে। তার ওপর বসিয়ে রেখে চলে গেলো। এই কাফেটা বেশ খানিক যায়গা নিয়ে। শীত খাতায়-কলমে পড়তেই কিছু পাব্লিক কোট-জ্যাকেট চাপিয়ে নিয়েছে। সার্কাস দেখার চোখে এইসব দেখছিল অনিকেত। এককোনায় নিজের মতো চুপচাপ বসে, কফি নিয়ে। অফিস থেকে ফেরার পথেই পড়ে। তাই, এটুকু চুপচাপ সময়। শুটিং পাট্টির জ্বালায় কি সেটাও ছাড়তে হবে! জীনস - লম্বা চুল একজন মাঝবয়েসী এসে দাঁড়ায় টেবলের পাশে। একই ভনিতা।
- স্যার, আপনি এই টেবল ছেড়ে অন্য টেবল-এ বসবেন্না বলেছেন?
এতো মহা ঝামেলায় পড়া গ্যালো।
: আপনাদের দাবী টা কী??
- না মানে, আপনি যদি উঠে ঐ, ওই যে ডান দিকের দুটো টেবল পেরিয়ে, কোণাকুণি গিয়ে থার্ড টেবিলে বসেন..
টেবিলটা খুব দূরে নয়। হাতের ব্যাগ বগলদাবা করে উঠে যাওয়াই যায়। কিন্তু, প্রোডাকশন ম্যানেজারের কথার ভঙ্গীতে, আঙুল নাড়ানোর কায়দায় মনে হয়, দুটো টেবিলের মধ্যে যে দূরত্ব তার মধ্যে কিছু লুকোনো হিসেব ভরে দিয়েছে সে। অচিরেই -
- আমাদের লোক মেঝে বরাবর দাগ কেটে দেবে বুঝলেন। আপনাকে কিচ্ছু ভাবতে হবে না। দাগটা ধরে গিয়ে বসবেন। আর..
দাগ! আবার দাগ ধরে হাঁটতে হবে কেনো! সেই কোভিডের সময় গোল্লা কাটা থাকতো ইলেক্ট্রিক অফিসের সামনে। এক গোল্লা থেকে আরেক তিন ফুট। বিল জমা দিতে গিয়ে সে নিয়ে কী ক্যাচাল। আবার বলছে দাগ ধরে হাঁটতে!!
বিরক্তি অথচ কৌতুহল দুই মিলেই অনিকেত কথা কাটে না ম্যানেজারের। উলটে খেই ধরায় -
: আর কী?
- আর মানে, এখন তো শীতকাল। আপনি কিছু পরেন নি। অবশ্য কোনো চিন্তা নেই। আপনার চেয়ারের পেছনে একটা উইঞ্চিটার ঝুলিয়ে দিচ্ছি। উঠে দাঁড়িয়ে সেটা পরে নেবেন। নিয়ে হাঁটবেন।
এবার ধৈর্য হারায় অনিকেত।
: কিছু পরিনি মানে?
- মানে, স্যরি, মানে গরম কিছু!
: আমাত্তো এম্নিই গরম লাগচে!! আমি কি সং যে শীত না পড়তেই গরম জামা পরে পথে পথে ঘুরবো আর ফিচিক ফিচিক করে ছোপি তুলব?? আমি বেরিয়ে যাব এখুন। ওই টেবিলে লাইন ধরে ধরে যাওয়া সম্ভব না। উঠি।
ওহহ্ নোন্নো করে ওঠে ম্যানেজার। একটু বসুন। প্লিজ। দু মিনিট। আমি আসছি। প্লিজটা এতো জোর দিয়ে বলে, অনুরোধ না আদেশ গুলিয়ে যেতো, শুধু তার শশঃব্যস্ত চলন দেখে মালুম হয়, নিজেও বেশ ঝামেলায় পড়েছে।
ঘড়ি দেখে অনিকেত। ফালতু ফৈজতে আধ ঘন্টা নষ্ট হয়ে গেলো। সটান উঠে গেলেই হয়। কিন্তু কৌতুহল ও হচ্ছে। কী এতো শুটিং চলে আজকাল। কারা করে? কেই-বা এসব করাচ্ছে??
ম্যানেজার ছেলেটা কাফের আরেক কোণে, যেখানে ক্যামেরা ফিট করা, ঠিক ওরকমি দেখতে, আরেকটু উলোঝুলো এক ছোকরার সঙ্গে হাত পা নেড়ে মেলা বকছে। নিজের ব্যাগ হাতড়ায় অনিকেত। ভিজিটিং কার্ড উপচে পড়ে। পারচেজ অফিসার হলে যা হয়। আজকাল আবার মোবাইলে কোটেশন, অর্ডার, ভিজিটিং কার্ড সব পাঠানোর চল হয়েছে। কিন্তু ওসব ঢপের কারবারে সে নেই। প্রিন্ট-আউট ছাড়া কিছু গেরাজ্ঝি করে না অনিকেত সান্যাল। সবাই জানে। এই করেই ভিজিটিং কার্ড জমানোর নেশা-টা ধরেছে। নিজের ঘরের দু' তাক ভর্তি। দেয়ালেও চিপকানো কিছু। তাই ছেলের ঘরের দরজায় পেল্লাই পোস্টার নিয়েও কিছু বলার মুখ নেই। সে থাক। ক্রেয়ন দিয়ে সারাবাড়ির দেয়ালে দাগ কাটতো ভোম্বোল, আর আঠা দিয়ে পোস্টার সাঁটতো। অনেক আগের কথা। ভালোই লাগতো। এখনকার মতো মোবাইল আঁকড়ে পড়ে থাকতো না তখন। এইসব দৃশ্য মনের মধ্যে এসে, চোখের সামনের দৃশ্য আবছা হয়ে এসেছিলো খানিক; কাটলো, প্রোডাকশন ম্যানেজার ছোকরার ফিরহাজিরায় ।
: আপনি না চাইলে টেবিল বদলাতে হবে না। বেরিয়ে যেতে পারেন। তবে প্লীজ, উইঞ্চিটারটা চেয়ারের পেছনে রইলো, উঠে দাঁড়িয়ে, ওটা পরে বেরিয়ে যান। দরজার বাইরে আমাদের লোকের হাতে দিয়ে দেবেন। থ্যাঙ্কিউ।
এরকম নিদান দেওয়ার ভঙ্গী শুনে যে কারোর পিত্তি চটে যায়। অনিকেত ব্যতিক্রম নয়। তবে সে আর কথা বাড়াতে চাইছিল না। এইসব শুটিং ফুটিং এর লোক, কার লোক কে জানে, বেশি জড়াতে চায় না অনিকেত। সটান উঠে, খামচা দিয়ে উইঞ্চিটার তুলে বাঁ হাত আধা গলিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দেয়।
দরজা পেরোতেই এক নটবর। চুমকি বসানো কুর্তা আর মাথায় টুপি। অনিকেতের গা থেকে উইঞ্চিটারট খুলে নিয়ে লম্বা কায়দা করে অভিবাদন জানায়। এদিক ওদিক আরেক দফা দেখে নেয় অনিকেত। দারোয়ান কে এতো সাজিয়েছে কেন।এখানেও ক্যামেরা আছে নাকি!
রাস্তায় নেবে প্রথম যা মনে পড়ে : বোম্বে বক্স ! এই কোম্পানির একজোড়া পাজামা আছে না বাড়িতে! দেখতে হবে তো। উইঞ্চিটারটা বোম্বে বক্সের ছিলো।
ফুটপাথে দুলে দুলে নাচছে একটি মেয়ে। বাধা পেয়ে অনিকেত দাঁড়িয়ে পড়ে। বইএর দোকান-ফোকান বসে', এমনিতেই সরু পথ। অনিকেত দাঁড়ানোতে নাচ থেমে যায়। উল্টোদিকের এক ষণ্ডা, কালো জালজাল গেঞ্জি, দুহাতে মোবাইল তাক করা, আঙুল নেড়ে অনিকেত কে বলে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে। অদ্ভুত তাচ্ছিল্যের ভঙ্গী। মাথা নীচু করে, নিজেকে প্রায় অদৃশ্য করে তুলে, বেশ খানিক সটান হেঁটে চলে যায় অনিকেত। সেই মহেন্দ্র দত্তর ছাতার দোকানে গিয়ে থামে। এপাশ ওপাশ দেখে। বিড়বিড় করে : সালা শুটিং এর জ্বালায়..
ফুলবাগান ফুলবাগান - দুজন- আদ্দুজন.. অটোওয়ালার হাঁকডাকে স্বস্তি ফেরে। পেছনে বসে গুছিয়ে। অটোওলা আবার হাঁকে। এক মহিলা আস্তেই ঘাড় ঘুরিয়ে অনিকেতকে সামনে আসতে বলে। ড্রাইভারের বাঁদিক ততক্ষণে ভর্তি। ডানদিকে, কোনোরকমে আধখানা সীটে পেছন ঠেকিয়ে ঝুলে ঝুলে যেতে থাকে অনিকেত। আজ বোধহয় হাটবার..রাজাবাজারের দুদিক জুড়ে কাপড়ের, চুরির, ফলের সারি।
লিফট বেয়ে ওঠার সময় পাশের ফ্ল্যাটের গাঙ্গুলীবাবু প্যাখনাপারা হাসেন। বিনিময়ে অনিকেত । হেসেই মনে হয়, তার হাসি ও বোধহয় গাংগুলির মতই প্যাখনাপারা হয়ে গেছে এতোদিনে। কৈ, সীমা ত কিছু বলে না! লিফট থেকে বেরিয়ে, নেহাৎ অকারণে গাংগুলি ভাসিয়ে দেন :
ঠাণ্ডা কিন্তু পড়তে শুরু করলো কী বলেন! লবি ধরে চলে যেতে যেতে, বাক্যের শেষাংশ শোনা যায়। উত্তরের কোনো অপেক্ষা আছে মনে হয় না।
নিজের ফ্ল্যাটের বেল বাজানোর মূহুর্তে, অনিকেতের মাথায় খেলে যায় : বাব্বা বোম্বে বক্স, শুটিং-এও জামা সাপ্লাই দিচ্ছে! কী কেস!
সীমা খাবার টেবিলে মূলত খাবার নিয়েই কথা বলে। জাফরানি সুক্তো না কী ভিডিও দেখেছে। সেটা একদিন ট্রাই করবে উইকেন্ড দেখে। পরমূহুর্তেই অফিস ক্যান্টিনে ডালে আরশোলা পাওয়া গেছিল, সেই প্রসঙ্গে চলে যায়। ভোম্বল গোটা সময়টা মাথা নীচু করে রুটি পাকাচ্ছিল। একবার মাথা তুলে জানতে চায়, কোশ্চেন ব্যাঙ্ক এনেছ?
: ব্যাঙ্ক? ব্যাঙ্ক কেনো যাবো??
ধরা পড়ে যায় অনিকেত। একে ভোম্বলের বই কিনে আনতে ভুলে গেছে, তারওপর খাবার টেবিলে বসে নিজের জগতে ডুবে গেছিলো হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে।
এই নিয়ে কত -তম- বার যেনো। সীমা কি সব রেকর্ড রাখে!
ভোম্বল নিজের ঘরে আলো জ্বালিয়ে রাখে আজকাল। সারারাত কিনা, অনিকেত কখনো দেখেনি । দাঁত মেজে, স্ট্রাইপড পাজামা গলিয়ে, পাশে শোবার সময় খেয়াল হয় সীমাও একই সেটের কিছু পরনে। কী যেনো বলে এটাকে । সীমার মোবাইলে ভিডিও পাল্টাতে থাকে। সাউন্ড কমানো। দেয়ালের দিকে ফিরে অনিকেত। দূরে কোথাও অনন্ত তাসাপার্টি লেগেছে যেন। দেয়ালে আলো-আলো ছায়া।
রাত তখন ক'টা! সীমা জল খেতে হাত বাড়িয়েছিল । অনিকেত তো পড়ে আর মরা হয়ে ঘুমায়। সে ভূতের মতো বসে আছে কেন বিছানার ধারে। পাশ ফিরে শোয় সীমা। একটু ঘড়ঘড় করে গলার কাছটা।
। দীর্ঘশ্বাস। অনিকেত বসেই ছিল। যেন অনেককাল।
সীমার গলার শব্দেই ঘাড় ফেরায় -
: আচ্ছা, আমরা কি সব শুটিং -এর জামাকাপড় পরে
আছি? !
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।