অতিদূর পল্লীপ্রান্তে এক ফয়সালা বৃক্ষশাখায় পিন্টু মাস্টার ও বলহরি বসবাস করিত। তরুবর শাখাবহুল হইলেও নাতিদীর্ঘ – এই লইয়া, সার্কাস-পালানো বানর পিন্টু মাস্টারের আক্ষেপের অন্ত ছিল না। এদিকে বলহরি বয়সে অনুজ, তায় শিবস্থ প্রকৃতির। শীতের প্রহর হইতে প্রহর বাহিয়া, লাঙ্গুল বান্ধিয়া ট্রাপিজ দেখাইতো পিন্টু, বলহরি কোনও একটি নিম্নশাখে অবাক নয়নে বসিয়া খেলা দেখিত। এত কায়েদার লম্ফঝম্ফ তাহার চরিত্রের বিপ্রতীপ। হাত বাড়াইলে ফল, গ্রামে প্রবেশিলে বাগানের কলাটা-ফলসাটা করিয়া উভয়েরই একপ্রকার আমোদে কালাতিপাত হইতেছিল। বানরদের জীবনচর্যায় ইহার অধিক জটিলতা থাকে না, পাঠকমাত্রে অবগত আছেন।
পূর্বেই উল্লেখ, ফয়সালা বৃক্ষটি গেরামের সীমান্তে, অতএব সেই যে সন্ধ্যায় একদল গ্রামীণ জুটিয়া সলাপরামর্শ-তাসের আসর ইত্যাদি মচ্ছব করিত, তাহার আয়ু বড়জোর রাত্রি প্রথম প্রহর। একটি উস্কানো তেলের বাতি গাছের ডালে ঝুলাইয়া নিম্নে বৃত্তাকারে বসা চার-ছয় জন জোয়ান ছেলের দল; পিন্টু মাস্টার বহুবার উহাদের বাক্যালাপ শুনিয়াছে, তথাপি কয়টি কাগজের টুকরা লইয়া একদল সমত্থ পুরুষ কীসের এত উত্তেজিত, তাহা ঠাহর পায় নাই। খেলাধূলা করিতে হয়, গাছে চড়ো! মাটিতে বসিয়া দুর্বোধ্য বকবকম করিয়া ও কীসের খেলা! হায় মনুষ্যজাতি, বৃক্ষশাখায় লাঙ্গুল বান্ধিয়া ঝুলিবার আমোদ তোমাদের অধরা রহিয়া গেল! চ্ছো!
এইমত খানিক আত্মগরিমায় মটমট হইয়া, মানুষগুলি চলিয়া গেলে, দূর হইতে দূরে তাহাদের মৃদু বচসার শব্দ হারাইতে থাকিলে, ঘনান্ধকার পত্রশাখামধ্যে সঙ্গসুখে গুটিসুটি হইয়া দুই দোসরে ঘুমের দেশে ডুবিয়া যাইত। সখা-ভ্রাতা-মিত্র, এক কথায় পিন্টু মাস্টারের নিকট অত্যাগসহন বলিতে যাহা বুঝায়, বলহরি হইয়া উঠিয়াছিল তাহাই।
অবশ্য, এরকমই এক সন্ধ্যায়, পিন্টু তখন নূতন আশ্রয় লইয়াছে, গাছতলার বচসা কিছু উচ্চগ্রামে পহুঁছিয়াছিল। সে সন্ধ্যায় মানুষগুলি কাগজের টুকরা লইয়া খেলে নাই বেশিক্ষণ। উত্তপ্ত শব্দবিনিময়ের মাঝে কেহ একজন বলিয়াছিল “তবে একটা ফয়সালা হয়ে যাক!” অমনি সকলে লাফাইয়া উঠিল।
যেন ঘৃতাহুতি পড়িল নিভু আলস্যের হুতাশনে। সকলে খাড়াইয়া বলিতে লাগিল – “ফয়সালা”, “ফয়সালা”। অতঃপর তাহারা দ্রুতবেগে স্থান ত্যাগ করিল দল বান্ধিয়া। পিন্টু মাস্টার, ‘ভজহরি ভেজিটেবল সার্কাস’-পলাইয়াছে এই লইয়া তৃতীয়বার। তাহার সহিত বুদ্ধিতে বানরকুলে কেহ ধারে কাছে আসে না। অতএব পিন্টু বুঝিল, এই আশ্রয়দাত্রী বৃক্ষের নাম আজ হইতে হইল ফয়সালা বৃক্ষ।
সে রাত্রে গ্রাম হইতে দীর্ঘক্ষণ মনুষ্যকণ্ঠে হৈ চৈ ভাসিয়া আসিতেছিল। কে জানে, অস্থিরমতি মানবজাতি, হয়তো বৃক্ষের নামকরণ বাকি সকলের পছন্দ হয় নাই।
অতিদূর পল্লীটি এমনিতে শান্ত, কতকটা বৈচিত্র্যের অভাবেই। সিনেমা হল ও থানা নিদেন সাত মাইল দূর। ভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষজন অবিকল সরকারি বিজ্ঞপ্তির ঢঙে পড়শীবৎসল না হইলেও, বহুদিন ধরিয়া ঝুট ঝামেলা নিজেদের মধ্যেই মিটাইয়া একপ্রকার শান্তিতে বহমান। যদিচ কিছুকাল হৈল সদর হইতে রঙ-বেরঙা পতাকা আসিয়া গ্রামের কালীতলায় কয়েকদফা সভা করিয়া গিয়াছে। কে বা কাহারা বুড়ি কালীর থানে অপকর্ম করিয়াছিল শেষাবধি জানা যায় নাই। খানিক গুমোট বাতাস অতিদূরের শান্ত পরিবেশটিতে ঢুকিয়া অম্লত্বের মাত্রা কিছু বাড়াইয়া তুলিয়াছে। তথাপি, পাঠক নড়িয়া চড়িয়া, পুনহ নিশ্চিন্ত বসুন, আকাঙ্খিত ঝঞ্ঝাবাত্যা বহে নাই।
তবে বাদানুবাদের আঁচ ফয়সালা বৃক্ষের নিম্নে সান্ধ্য-আড্ডার পরিবেশকে মাঘের কুয়াশার ন্যায় ঘিরিতেছিল। পিন্টু মাস্টার বিচক্ষণ হইলেও শউরে বানর যতই হউক। পল্লিবৃন্দের রহন সহন তাহার বোধগম্যতার খানিক বাহির দিয়া যায়। অথ যেমতি, এক দিবস সন্ধ্যায় উহারা ফয়সালা বৃক্ষের নামকরণ অনুষ্ঠানটি পুনরাভিনয় করিল। পিন্টু ভাবিয়াই পাইল না, একই বৃক্ষের একই নাম বারংবার রাখা কেন? মূর্খ মনুষ্যজাতি, মাত্র কয়দিনেই কেমনে ইহারা সব ভুলিয়া যায়!
কিন্তু, পরসন্ধ্যায়, তাহাদের অনুষ্ঠান শুধুই নামকরণে সীমাবদ্ধ রহিল না। এবং লাঠি ঠুকিয়া উত্তেজনা প্রকাশের বহরে, নিম্নশাখে ঝুলানো তেলের বাতিটি ছিটকাইয়া গিয়া পড়িল কৌতূহলী শ্রোতা বলহরির গায়ে। বলহরি বেচারা এত দুরূহ নামকরণ অনুষ্ঠানের কিছুই বুঝিতো না, অকস্মাৎ উত্তপ্ত তৈল ও অগ্নিসংযোগে উন্মাদের ন্যায় ঊর্দ্ধশাখে উঠিয়া নিজেকে বাঁচাইবার চেষ্টা পাইতে লাগিল। শীতের হাওয়ায় ও শুষ্ক পত্রের সংস্পর্শে, যেন এক অগ্নিবলয়ে মোড়া ট্রাপিজ খেলোয়াড় ফয়সালা বৃক্ষের শাখা হইতে শাখায় উল্লম্ফনক্রীড়া দেখাইতেছে! এ জিনিস পিন্টু সার্কাসে দেখিয়াছে, কিন্তু এ খেলা যে সে খেলা নয় – তাহা আপৎকালে বুঝিয়াও কিছু করা তাহার পক্ষে সম্ভব হইলো না। একটি জ্বলন্ত আগুনের গোলা হইয়া বলহরি খসিয়া পড়িল মাটির উপর। মানুষগুলি দৌড় দিয়া পলাইল। মাঘসন্ধ্যার অন্ধকারে, দগ্ধকাষ্ঠরূপ মাংসের স্তুপ ঘিরিয়া পিন্টু মাস্টারনাম্নী বানর কিছুকাল নিঃশব্দ বসিয়া রহিল, খ্যাক খ্যাক আওয়াজ করিল, বৃক্ষশাখে চড়িয়া নিষ্ফল আন্দোলন করিল ও পুনরায় নাবিয়া নিঃশব্দ বসিয়া রহিল, খ্যাক খ্যাক আওয়াজ করিল, বলহরির মৃতদেহের পাশ ঘিরিয়া ঘিরিয়া ক্রোধে ধূলা-মাটি গড়া দিল খানিক। একটি রাতচরা পক্ষী ভিন্ন কোথাও হইতে কোনো শব্দ আসিল না।
পোড়া বুকের নিকট দুইটি পোড়া কাঠি হাত জড়ো করিয়া বানর বলহরির শরীর কাৎ করা ডোঙ্গার ন্যায়, ঘন শীতল আঁধারে থামিয়া রহিল।
পরদিবস প্রাতঃ। চক্কোত্তি মহাশয় দাঁতন করিতেছিলেন।
বেচারাম তেলী ও পশ্চিমপাড়ার ঘোষেদের মেজ তরফ সাতসকালে আসিয়া বাংলা ঘরের ধাপিতে গুঞ্জনরত। চক্কোত্তি মহৎকর্ম সারিয়া ফিরিলে উহাদের কোনো পরামর্শ থাকিবে। হেনকালে, টিউকলতলার নিমগাছের দিক হইতে কেহ চিক্কুর দিয়া উঠিল: ফয়সালা হয়ে যাক!!
চক্কোত্তি ভাবিলেন, তেলীর পো। বেটার সকাল সকাল মাথা গরম। তেলী ও ঘোষ ভাবিলো: দক্ষিণপাড়ার এত সাহস? তিনজনেই এদিক ওদিক দেখিলেন। ঠাহর হইল না।
বাস্তবিক, এ আমাদের পিন্টু মাস্টার। এই একটি বাক্যই সে শিখিয়াছিল এবং বলহরির শোকে আকুল হইয়া সকাল হইতে গ্রামের গাছে গাছে ঝুলিয়া ঝুলিয়া এই বাক্যটিই বলিয়া বেড়াইতেছিল।
গ্রামের পশ্চিমে ঘোষেদের, তাহার পার্শ্বেই বিশ্বাস কয় ঘর। মোটামুটি উত্তর ঘেঁষে বামুনপাড়া। এদানি, নানা জাতের বিবাহসম্বন্ধে, আগেকার পশ্টো দাগ খতিয়ান আর নাই। তবে, দখিন ঘেঁষে যে কবরখানা, আর তাহার হাতায় পদ্মপুকুর – সেদিক ধরিয়া অদৃশ্য একটা বোঝাবুঝির দাগ চলিয়া গিয়াছে। ওপাড়ার মানুষগুলিও কালীতলার দিকে অনুরূপ বোঝাবুঝি মানিয়া চলে। শুধু, মাঝে একটি শুখা জমিন ও পরিত্যক্ত আমবাগান, হোথায় বখা ছোকড়ারা নেশা-ভাং করিয়া থাকে। দুই-চারিটি লাশ গুমের কাহিনীও শুনা যায় বটে। পিন্টু এ-ডাল, ও-ডাল বাহিয়া সেই পোড়ো আমবাগানে ফুঁকিয়া বেড়াইতে লাগিল: “ফয়সালা হয়ে যাক!!” নিজ কণ্ঠে অবিকল মনুষ্যের স্বর শুনিয়া তাহার বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। কেমনে তাহার বানর মস্তিষ্কে কুলাইয়াছিল, যে ইহার মধ্যেই প্রাণপ্রিয় বলহরির অকস্মাৎ মৃত্যুর সংকেত লুক্কায়িত রহিয়াছে। বা হয়তো কিছুই তাহার বোধগম্য হয় নাই।
আমবাগানে জটলাকারী নেশাখোরগণ কিন্তু দৈববাণী শুনিবার উন্মাদনায় জাগিয়া উঠিল। দুইটি তাড়িখোর পরস্পরকে দায়িত্ব অর্পণ করিল – ফয়সালা করিয়া ফেলিতে এবং একে অপরকে উদ্যমহীন দেখিয়া প্রবল দোষারোপ করিতে লাগিল। বাকি তিনজন ‘হোক্ হোক্ শালা আজ!’ বলিয়া দ্রুত ও অবিন্যস্ত পদে দক্ষিণের অভিমুখে দৌড়িল।
জ্বলন্ত বলহরির শরীর পিন্টু মাস্টারের বোধবুদ্ধি লোপ করিয়া দিয়াছিল। ফলত, ইস্কুলবাড়ির পার্শ্বে পিয়ারাগাছের পাকা ফল তাহাকে রুচিল না, পিয়ারা ছিঁড়িয়া এদিক ওদিক ফেলিল খানিক, অতঃপর হাঁকিয়া উঠিল: “ফয়সালা হয়ে যাক!!”
ক্রমে, কালীর থানে, ঘোষপাড়ার পুকুরঘাটে, কবরখানার শুষ্ক বাতাসে একটিই বাক্য আনাচে-কানাচে ঘুরিতে থাকিল। ঘর হৈতে গেরস্থ বাহিরিল, ঈশান ও অন্ধকোণ হতে শাবল, লাঠিগোছা। কী ঘটিয়াছে একে অন্যকে জিজ্ঞাসিয়া যখন পশ্টো হৈল না, সকলেই আপনার মতো করিয়া বুঝিয়া লইল, যে, বড় কঠিন সময় উপস্থিত, একটা ফয়সালা ভিন্ন গতি নাই।
আম্রকুঞ্জের নেশাড়ুরা কিন্তু বসিয়া থাহে নাই। কী করিতে হইবে? উহারা জানিত। শুধু দক্ষিণ পাড়ার ধানের গোলায় অগ্নিসংযোগ উত্তর পলাইবার পথটি তাহাদের ঠাহর ছিল না। এবং মালিক মোমিন সাহেব ঘটনাস্থলে আসিয়া সামাল দিবার পূর্বেই, বছিরুদ্দির দাওখান ঝলসাইয়া উঠিল। ফয়সালার গায়েবি স্বর সেও সকাল হইতে বারপাঁচেক শুনিয়াছে বৈকি!
চক্কোত্তি অন্দরমহল তালা দিয়া দিয়াছিল। দক্ষিণপাড়ার ছোকরারা শেষে দরোজা ভাঙ্গিতে না পারিয়া তৈলে বস্ত্রখণ্ড ভিজাইয়া অগ্নিসহযোগে ভিতরবাটীতে ছুঁড়িতে লাগিল। ঘোষেদের একটা পুরানো পাইপগান ছিল। ইতোমধ্যে উহার নল ফাটিয়া মেজঘোষ অর্ধেক জখম হইলেন, বাকি অর্ধেক দক্ষিণপাড়ার লাঠির ঘায়ে। বামুনপাড়া, বিশ্বাসপাড়ায় বাড়িগুলি জ্বলিতেছিল। দক্ষিণেও আগুনের লেলিহান শিখা, শিশুর ক্রন্দন, কৃপাপ্রার্থী মাতৃজাতির জোড়হস্ত উপেক্ষা করিয়া শুধু একটিই বাক্য দুইদল আক্রমণকারীর মুখে: “আজ শালা ফয়সালা হয়ে যাক!”
অগ্নিকাণ্ড ছড়াইয়া পড়িলে, পিন্টু মাস্টার, ভয়ে হৌক বা পুনহলব্ধ উপস্থিতবুদ্ধির বশে লোকালয় ছাড়িয়া বৃক্ষের আশ্রয়ে ফিরিয়া যায়। আশ্রয়টির পত্র ও শাখাসকল গত রাত্রিতেই জ্বলিয়া গিয়াছিল। বলহরির দগ্ধ দেহাংশ শিবা ও কুক্কুরে টানিয়া লইয়াছে। শুধু কৃষ্ণবর্ণ পোড়া কয়টি আঙ্গুল সহ একটি আধেক চিবানো হাত টুটিয়া পড়িয়া – ফয়সালা গাছতলায়। পিন্টু মাস্টার তাকে ঘিরিয়া মাটিতে আঁচড় কাটিল খানিক। খানিক তাকাইয়া রহিল অতিদূর পল্লীর দিকে। মনুষ্যকন্ঠ বিশেষ শ্রুত হয় না, কেবল ধূম্রজাল ও উত্তর দক্ষিণ জুড়িয়া লেলিহান জিহ্বারূপ অগ্নিবলয়। ফয়সালার।