গল্পটা ফার্স্ট পার্সনে । যে ওপরে শুয়ে শুনছে, নিচের বার্থে তিনজনকে গপ্পো করতে। পুরো সময়টা নাক অবধি কম্বল মুড়ি দিয়ে মটকা মেরে পড়ে থাকবে। মুত্তেও উঠবে না। নিচে তিনটে দামড়া লোক বসে বসে রসিয়ে একটা আজগুবি আড্ডা জুড়বে : এরমধ্যে একজন মনোরোগবিশেষজ্ঞ , একজন ডিভোর্স লইয়ার আরেকজন পশুর ডাক্তার। প্রথমে সাইকায়াট্রিস্ট শুরু করবে একজন রোগীর গল্প, যে স্বপ্নে দ্যাখে , তার পোষা কুকুরকে একটা ঘরে একা রেখে গিয়ে সময়মত ফিরতে ভুলে যাচ্ছে , নানান কিছুতে জড়িয়ে পড়ছে , আর প্রতিবার ঘরে ফিরে দেখছে যে তার কুকুরের মরণাপন্ন অবস্থা। কিছুদিন বাদ বাদ এই একই স্বপ্ন সে দেখেই চলেছে। প্রচন্ড গিল্ট ফিলিং। ডিপ্রেশন। ইত্যাদি। সে চায় ডাক্তারবাবু স্বপ্নে ঢুকে তার কুকুরের দায়িত্ব নিন। তার দাবি অসুখ সরানো নয়।
এটুকু শুনে লইয়ার বলে : কী কান্ড।
এবার কুকুরের ডাক্তার বলে, তার এক ক্লায়েন্ট একটা কুকুর পুষে রোজ বাড়ি ফিরতে দেরি হতো কারখানায় আটকে গিয়ে। তাৱপর সে। তারপর কুকুরটা ।
পুরোটা ওপরের টায়ার থেকে শুনি।
:: শট রেডি। ট্রেনটা কাটিয়ে দিন দাদা ::
- তো লোকটাকে আপনি চিনতেন ?
অন্ধকার। বাদাম খাচ্ছি। গেলাশ ফাঁকা । এদের একটা ছেলে আচে পোতোঁন , ডাকলুম পোতোঁন পোতোঁন , হেলেদুলে এসে বলে ভোদকা তো আর নেইই, হুইস্কি দি ?
সালা !
বাগানের ইদিকে, লাইট্টা কাটা। ভালোই একদিক দিয়ে। ওদিকে আলোর মধ্যে তিনজনের হুল্লোর !
- লোকটাকে আপনি চিনতেন?
মুখে বসন্তের দাগ , মাথার ডাক্তার , রসিয়ে কেচ্ছা জুড়েছে পেটে পড়তেই : না চিনতাম না। কিকরে চিনবো ? তখন সবে ট্রান্সফার হইছি। একদিন দুপুরে হাজির। দিব্যি আপিসবন্ত মানুষ। বলে কীনা একটা কুকুরকে স্বপন দেখছে রোজ ।
- কুকুর ? যা শ্লা ট্যাকা নয় মেয়েছেলে নয় শেষে কুকুর !
খিঁচিয়ে উঠলো খাটো , নীল ব্লেজার। তারপর নিজের ই হিউমারে মুগধ হয়ে সবাইকে মদ ঢেলে দিতে লাগলো। ডাক্তার বলে চলেছে : হ্যাঁ মাইরি কুকুর। স্বপ্নে দেখে, একটা বাড়ির মধ্যে ও এক পেল্লাই পোষা কুকুর নিয়ে থাকে।
- কোন ব্রিড?
গলদাচোখো মুখ খোলে ! মদ সরিয়ে বেছে বেছে বাদাম খাচ্ছিলো ডাক্তারের পাশেই বসে। মুখ খুললেও চোখ তোলেনা সে। নীল ব্লেজারের বিরক্তি দেখতে পায়না। ডাক্তার আবার ধরে নেয় : সে তো মনে নেই , আপনি থাকলে নিশ্চই চিনতেন , সে যাগ্গে , স্বপ্নটা হলো : সে দেখে যে একা বাড়িতে কুকুরকে রেখে সে বাড়ি ফিরতে ভুলে গ্যাছে। অনেক অনেক দূরেএএ চলে গ্যাছে।
- আঁ , আর কুত্তা টা ? নীল ব্লেজার গপ্পো খুঁজে পায় । বা নেহাতই ধরতাই দিতে।
- সেটাই তো ব্যাপার! স্বপ্ন দ্যাখে যে, ভুলে গিয়ে কুকুরটাকে একা রেখে সে কখনো পাঁচদিন কখনো একমাস বাদে ফিরছে , আর কুকুরটা ঘরে হেগে মুতে না খেয়ে হাড় বেড়িয়ে এক কোণে পড়ে আছে। তারপর স্বপ্ন ভেঙে যায়। এই হলো কেস। পুরো সিরিয়াস কন্ডিশন ! একী! আপনি নিজে ভেটেনারিসাজ্জেন হয়ে হাসছেন ? ??
গলদাচোখো হাসি মেরে চোঁ করে গিলে নেয় পেগটা। আরে , এ-তো স্বপ্ন ! এসব আপনার এরিয়া, বলুন তাপ্পর কী ! আমার তো কুকুরের বাচ্ছা বিক্কিরি আর গরুর ডেলিভারি করিয়েই লাইফ গেলো স্যার , হ্যা হ্যা। ডাক্তারিই হলো না। তা আবার স্বপ্নের ডাক্তারি ।
- এতো মৈলা ঝঞ্ঝাটে না গিয়ে কুত্তাটাকে ছেড়ে দিলেই পারে ! নীল ব্লেজার আবার খিঁচরনো মুডে।
- আরে ছেড়ে দিতেই তো আমার কাছে এসেছিলো , মানে ওই আর কি । ডাক্তার পেগে চুমুক দেওয়ার আগে।
- আরে মশাই এইতো বললেন স্বপ্নের কুকুর , তার আবার ছেড়ে দেওয়া কী ? ! গলদাচোখো এবার বাতাসে হাত ভাসিয়ে থিম হয়ে থাকে খানিক। নেশা ভালোই চড়েছে। কী শুনতে কী !
নীল ব্লেজার হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে ওয়েটারকে ডাকতে থাকে। ছিলি ফিশ বোলা থা না ? ছিলি ফিশ ! কাহিকো নেই দিয়া ? বুলাও ম্যানেজার কো !
সেলোফেন লাগানো আলোর মধ্যে দিয়ে পোতোঁন আমার সামনে এসে দাঁড়ায় , ছিলি ফিশ রেডি না হওয়ার দুঃখে তাকে যে খুব মুহ্যমান দেখায় তা নয়।
-কাল সকালে দেখছি। এখন হুস্কি হোক যা হোক কিছু দাও ! হ্যাঁ স্যার , বলে পোতোঁন চলে যায়। কাল কি থেকে যাবো ? এদের এখানে ছ' দিন হয়ে গেলো এসছি। কাল অবধি হিসাব চুকতা। তাও সালা নেশার টাইমে এসে জিগেস করা চাই। থেকে যাবো। ধুর্ধুর। একটু ভদকা নেই। ধুউর। কেন যে এলুম।
ডাক্তারের কাঁধে গায়ে থাবড়ে থাবড়ে নীল ব্লেজার বসে পরে। হ্যাঁ , তারপর আপনার কুত্তার স্বপ্ন , কী হলো স্যার !
ডাক্তার একটু গা ঝাড়া দেন। সোজা হয়ে বসেন। সে আর বলবেন না ! কাউন্সেলিং -ওষুধ সব ফেইল। এমনিতে তো দিব্যি সুস্থ লোক। শুধু বলে , স্যার আমার কোনো রোগ নেই , কুকুরটাকে আপনি এডপ্ট করে নিন স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে। তাহলেই ও আর কষ্ট পাবে না ! ভাবুন কাণ্ড !! শেষে শিলিগুড়ি সদরে এক ডাক্তারকে রেফার করে দিয়ে বাঁচলুম !
- কুকুরকেই দেখতো বলছেন ? অন্য কেও নয় ? নীল ব্লেজার প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় যেন সদ্য বই থেকে উঠে আসা নবরতন গোয়েন্দাকারি। সিগারেটে এমনকি টান ও দিয়ে ফেলে একটা, চিবিয়ে, মাঝারি করে।
- হ্যাঁ কুকুর। ভিভিড বর্ণনা। না খেয়ে ঘরে আটকে থাকা একটা কুকুর। উঠে দাঁড়াতে পারতো না , যখন লোকটা বাড়ি চিনে ফিরে আসতো। ডিহাইড্রেশনে ভুগে , চোখ বেড়িয়ে উফফ মশাই , এই পেশায় অনেক রকম স্বপ্নের কথা শুনেছি রোগীদের মুখে , কিন্তু এটা শুনলেই অদ্ভুত কষ্ট হতো। আমার ও কম বয়েসে একটা কুকুর ছিল বলে কিনা জানিনা। আর আমার ও, ওর মতোই কুকুরের নাম ছিল রেশমা।
পোতোঁন গ্লাস নাবিয়ে রাখার আগে অন্ধকার টেবিল থেকে ঝেড়েঝুড়ে কীসব ফেলে চারপাশের ঘাসে। এদের তো সামনে পেগ মাপার সীন নেই কি আর বলা যাবে। ওদিকে চিলিতে কাঠি দেয়নি বলে নীল ব্লেযার আবার খ্যাঁকাচ্ছে। গোলাপি আলোয় বাদামি স্যস মেখে উলঙ্গ পড়ে একপাল ফিশ কিউব । বাদাম দিতে বলি আবার। স্যার , বাল্ব-টা চেন্ করে দেব ? না। খেদিয়ে দি পোতোঁন কে।
নীল ব্লেজার আবার উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়েই দুটো তিনটে ফিশ চিলি মুখে নেয় খুঁটে খুঁটে। দাঁড়িয়েই প্যান্টের চেন খুলতে খুলতে , থপ থপ করে পা ফেলে আমার অন্ধকারে এসে দুলতে থাকে । ছরছর করে মুতে দেয়।
তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘোষণার মতো বলে : আপনি স্যার যা কুত্তাকাহিনী শোনালেন এর চে বেটার গপ্পো আছে আমার কাছে। সেইম প্লট। লোকটার নাম আমার মনে নেই , তবে ওর বৌ এসেছিলো। ডিভোর্স লইয়ার আছে না আপনাদের মিশন পল্লীতে , আরে সত্যব্রত জানা , হ্যাঁ ওর ই রেফারেন্স। বাপের বাড়ি মালদার। বর নাকি দিনের পর দিন বাড়ি ফেরেনা। আপিস থেকে ছুটি নিয়ে কোথায় যায় বলে যায়না। মাগি কেস-ও নেই। বলে নাকি বাড়ির কথা পুরো ভুলে যায় বাইরে বেরোলে। পার্কে গিয়ে বসে থাকে। আলমোরা চলে যায়। পুরো আউলা কেস হে হে হে।
বসে , মাছের থেকে একটা কাঠি তুলে দাঁত খোঁচাতে থাকে মালবাজারের দুঁদে উকিল নিতাই ঘোষাল।নীল ব্লেজার-টা টেনে দুবার করে বোতাম আটকানোর চেষ্টা করে। পারে না। উল্টে নিজের বুক থাবড়াতে থাকে ছন্দে ছন্দে !
ডাক্তার বলেন : এটা কী হলো আপনি আমার গপ্পে জাস্ট কুকুরটাকে মানুষ করে দিয়ে নিজের গপ্পো বানিয়ে নিলেন ? নতুন কিছু ছাড়ুন না ! আর আপনার গপ্পে ,
তোবড়ান প্লাস্টিক থেকে গেলাশে জল মেশান ডাক্তার ,
- বেটার টা কী ?
- ঐযে ডিভোর্স ! পুরো এলামনি আদায় করে তবে ছেড়েছি বাছাধন কে ! আপনার মতো বল পাস্ করে দিই নি হুঁ ! কী যেন নাম মহিলার , হ্যাঁ রেশমা !
- এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে ! ডাক্তার এর গলায় উত্তেজনা : আপনি আমার গল্পের কুকুরের নামটা অবধি টুকে দিলেন ! নায়িকার একটা নতুন নাম দিন্না মশাই।
গলদাচোখো হেসে ওঠে হঠাৎ ! আপনারা মাইরি , আপনাদের নেশা হয়ে গেছে। শেষে কিনা এর কুকুর তার বৌ তার এলামনাই হে হে হে হে
সবাই একসঙ্গে নানাকিছু বলার চেষ্টা করে বাতাসে হাত নেড়ে।
ডাক্তার গলা তুলে ডাকে, ওয়েটার! পোতোঁন আমার মদ ঢালছিলো। মাইরি অন্ধকারেও একফোঁটা চলকায়না ছোকরার। নীল ব্লেজার হেঁকে বলে :আরও খাবো ! দু পেগ করে দাও। পোতোঁন চুপচাপ টেবিল পরিষ্কার করতে থাকে। আমি সেঁটে বসি। মাতালের দল ফাটবে কখন। মুত পেয়েছে।
এমনিতে জানেন , গলদাচোখের গলা বেশ কনভিন্সিং শোনায়। কুকুর পুষে দেখাশোনা করতে না পারা কিন্তু বেশ কমন ব্যাপার। এই ভেটেনারি পেশায় তো কম দেখলুম না। এইতো আমার ভাই এর এক বন্ধু একবার একটা জার্মান শেফার্ড নিলো , একবছর ঘুরতে আমায় এসে বলে , কাওকে দেখে দিন : এডাপশনে দেব। কেন ? না বাড়িতে কেও দেখার নেই , অপিস থেকে ফিরে রোজ দেখে কুকুরটার চোখে জল , অপিস যাওয়ার সময় মোজা লুকিয়ে রাখে কুকুরে। নাথিং সিরিয়াস। কিন্তু দিয়ে দিলো। অবশ্য যারা নিয়েছে বুঝলেন , খুবই আদরে রেখেছে আর বাড়ি ভর্তি লোক।
- জার্মান মানে ওই , ডাক্তার একটু কথা হাতরান , ওই এলসিসি না কি যেন নাম ওদের...
- এবার আবার বলবেন না যে আপনার স্বপ্নের কুকুরটা এলসিসিএন ছিল !
গলদাচোখোর কথায় বাতাস থেমে যায়। পরমুহূর্তেই সমবেত মাতালের ঠা ঠা হাসিতে কেঁপে ওঠে আনন্দ বিহার লজ। ওপরের বার্থে ঠায় শুয়ে থাকে সে। কম্বল টেনে নেয়। মুত্তেও ওঠেনা। ঘুমায়না। ঘুমুলেই ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।