এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ক্রিকেট মাঠের শব্দেরা

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৬ নভেম্বর ২০২৩ | ৬৭৯ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ক্রিকেট মাঠের শব্দেরা
    উপল মুখোপাধ্যায়

    এসব উচ্চারণকে কি বলবে বুঝতেই পারছে না সুবীর। এসবকে কোন অর্থবহ বলে মনে হয় নি তার। একি শুধু কথা, কথার কথা আর তার জড়ানো উচ্চারণ? সব শেষে কথাই শুধু পড়ে থাকে বলে কেনই বা মনে হচ্ছে তার? সে শুধু শুনছিল 'আই ল ল ল ল... লা, আই ল ল ল ল... লা আওয়াজ। সুজিত স্যার যা অনবরত বলে চলে তিনটি ক্রিকেট নেটকে কভার করতে করতে। আরো অনেক কিছু বলে, হিন্দী-বাংলা মিশিয়ে বলতেই থাকে সুজিত  স্যার। যখন বলে তখন সে একটা হাফ প্যান্ট পরে থাকে। ছিলার মতো তার চেহারাটা দ্রুত নড়াচাড়া করছিল তিনটে প্র্যাকটিস নেটকে যেন দুহাত দিয়ে আগলে রাখবে। আর আগলাতে না পারলে কথারা উপচে উপচে আসবে। এত দ্রুত কথাটা বেরোচ্ছে দেখে প্রথম প্রথম সুবীর বুঝতেই পারে নি। আসলে কে বলে।

    ক্রিকেট প্র্যাকটিস নেটের ছবিটা তো একদম জ্যামিতিক হওয়ারই কথা। সেখানে এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ্য ছেয়ে থাকছে। বড় বড় গাছের সারিতে  একটা গাছের ছায়ার তলায় টিনের ওপর লেখা আছে অজয় স্পোর্টিং ক্লাব। সেই ক্লাবও টিনের ছাউনি দিয়ে ঢাকা থাকে কারণ সেখানে ইঁট-সিমেন্ট- লোহার জবরদস্ত  ঘরবাড়ি করা বারণ। আর মাঠের সঙ্গে থেকে থেকে টিনের চালের ক্লাব ঘরেরাও একরকম গাছের মতোই হয়ে গেছে। ওপর থেকে বড়ো গাছের ছায়ার সঙ্গে সঙ্গে টিনের চালও বাড়তে বাড়তে মাঠের একদম কোল ঘেঁষে ছাওয়াই জোগাচ্ছে। হাওয়ারা গাছের তলা থেকে ওপর আর ওপর থেকে তলা এইরকম ঘুরতে ঘুরতে ক্লাবের টিনের ঘরটার ওপরও হাত বুলিয়ে দিতে থাকছে। আর আওয়াজ হচ্ছে খড়খড় খড়খড়। মাঝে মধ্যে কী যেন ওপর থেকে পড়ছে খটাং। সুবীর ভাবছিল কী পড়তে পারে ওপর থেকে? তখন তার চোখ আবার চলে গেল তিনটে নেটের কাজের নৈঃশব্দ্য ছেড়ে  লাগোয়া ক্লাব ঘরের টিনের চালের ওপর। আরো একটা আওয়াজ যেন হচ্ছে খটাং ট্যাং ট্যাং ট্যাং। কী একটা যেন গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে টিনের চালের ওপর আর কথার মতো করে ওপরের গাছের হাওয়ারা সে সব শুনিয়ে দিচ্ছে কানে কানে। সে ভাবে, ওখানে নেটের  আপিস - উঁচু করে মারা শটগুলো যদি ওই টিনের চালটার ওপর পড়ত তখন কী ভয়ংকর শোনাত শব্দগুলো। তবে এখানে এই নেট প্র্যাকটিস পুরোটাই হয় ক্লাব ঘরের টিনের চালের সামনে। ব্যাটসম্যান দাঁড়ায় চালের দিকে পেছন করে বোলার বল করতে মাঠের দিক থেকে ক্লাবের দিকে ছুটে আসে আর মারা বল টিনের চালের উল্টো দিকে মাঠের দূরে দূরে পড়ে। সেখানে গাছেরা বল পাহারা দেয় আর ছায়াও, নাকি লাল লাল বলগুলো ঠিকঠাক লাগার আনন্দে বুড়বাক হয়ে টিনের শরীরে আরো ব্যথা ধরালো আর চাল নিজেই  কথা বলে উঠল , ট্যাং খট খট খটাস খটাস। অথচ সে রকমই হত বঁড়শের ডগলাস গ্রাউন্ডে। সিকিউরিটি গার্ড বলেছিল, 'ওই যে টিনের চাল  দেখেছেন.....'-
    -              কই ?
    -              ওই তো লাল রঙ করা। দেখতে পাচ্ছেন ?
    -              হ্যাঁ।
    -              ওর ওপর পড়ত।
    -              কী ?
    -              সৌরভের শটগুলো ।
    -              শটগুলো ?
    -              আরে বলগুলো।
    -              আওয়াজ হতো না ?
    -              সে তো হতোই।
    -              তবে ?
    -              তবে কী ?
    -              বিচ্ছিরি আওয়াজ হতো তাই না ?
    -              লাল টিনের চালগুলো কত দূর দেখেছেন ?
    -              অনেক দূর।
    -              হ্যাঁ অনেক দূরে ওই টিনের চালগুলোর ওপর পড়তো তখন হয়ত চালের তলায় ফাদার ম্যাথিসন চেলো ধরেছেন ?
    -              আমি ম্যাথিসনকে  দেখেছি। বিরাট লম্বা ছিলেন, পাদরির আলখাল্লা পরা ম্যাথিসন – ট্রাক চালাচ্ছিলেন।
    -              ফাদার অক্সফোর্ড মিশনের অনাথ  ছেলেমেয়েদের চেলো শেখাতেন। অনন্ত মাকাল, বেহালা।
    -              জানি ফাদার ম্যাথিসন আর অনন্ত মাকাল ক্ল্যাসিক্যাল অর্কেস্ট্রার ক্লাস নিতেন। অক্সফোর্ড মিশনে। বাজনা শোনা যেত। লাল লাল রং করা টিনের চাল।
    -              ওই চালের ওপর সৌরভের শটগুলো পড়ত।
    -              লর্ডসে সৌরভের ছয়।
    -              ডগলাস গ্রাউন্ডে, বঁড়শেতে সৌরভের ছয় ঐ লাল টিনের চালের ওপর।

    সুবীর একটুও চেলো কিংবা বেহালার আওয়াজ শুনতে পায়নি। সে জানে এখন অক্সফোর্ড মিশনের মাঠে ছোটদের ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়েছে। লিগের খেলা হয় কিনা কে জানে? বাইরে উঁচু পাঁচিল তুলে একটা সাহেবি স্কুল বানানোর কাজ চলছে  আর গেট বন্ধ থাকে। সেই গেট দিয়ে ট্রাক চালিয়ে সে ফাদার ম্যাথিসনকে ঢুকতে দেখছে তো দেখছেই আর কিছুতেই লাল রং করা টিনের চাল দেখতে পাচ্ছে না। সৌরভের উঁচু করে মারা, লম্বা লম্বা শটগুলো দেখতে পাচ্ছে না। তবু সেগুলো থেকে ছয় হচ্ছে আর কমের কোন রান হচ্ছে না। সৌরভের সব কটা শটই ম্যাক্সিমাম হচ্ছে কেন একথা ভাবতে ভাবতে আবার নেটের জ্যামিতিক নকশার দিকে চোখ চলে গেল তার। একবার চোখ চলে গেলে সে আর ফিরে আসে না। সেই চোখ তখন নিজেই দেখতে থাকে আর গুনতে থাকে কটা বোলার নেটে রান আপ শেষ করল। তিনটে নেটে অনেকগুলো বোলার আর তিনটেকে আগলে রেখেছে সুজিত স্যার। পরণে হাফ প্যান্ট। মে মাসের গরমে নিস্তেজ ওই পার্কটায় খালি ব্যাটে-বলের থাস থাস আওয়াজ হচ্ছে আর ফলো থ্রুর উফ উফ সংকেত। অনবরত কথা বলে সেই মাঠের - নেটের সবকিছু বজায়  রাখে কোচ। 

    -              চল চল সব ফিল্ডিং চল।
    -              ওই উইকেটকিপার আযা।
    -              দেখ  উপর সে  ঘুমানা।
    -              এয়সে হাত ঘুমানা।
    -              তুমি তো ছুটলেই না বাবা।
    -              না ছুটে লেগ স্পিন করা যায় কিন্তু হেভি জোর লাগে কাঁধের।
    -              এয়সে খেলনা। এয়সে। ক্যা ব্যাট ঘুমাচ্ছে বাবা।
    -              বোঝা বাবা বোঝা ,তোর ইম্পর্টেন্স। উইকেটটা দামি আছে।
    -              উতো সহজে উইকেট ছাড়ছিস বাবা।
    -              আরো পা যাবে রে।
    -              ক্যা কর রহে হো। আউর থোড়া বেন্ড কর এয়সে। এয়সে।
    -              রান আপের শেষে জাম্প কর। ওটার ওপর দিয়ে লাফা।
    -              আরে ব্যাটকো অউর সুইং করানা পড়েগা।
    -              হ্যাঁ, ঠিক আছে। ওয়েল বোল্ড।
    -              এই তো, একটা বল পড়ল ঠিকঠাক।
    -              নিজেই বুঝবে বল ঠিক হল কিনা।
    -              এই কারা কারা প্যাড পরে বসে আছিস ছায়ায়।
    -              এক ঘন্টা নেট হলেই রেস্ট ?
    -              লাস্ট বল, নেক্সট ব্যাটসম্যান।
    -              অফ স্ট্যাম্পের বাইরের শট। মারতে মারতে শেখ বাবা।
    -              এই বল কো ছোড়না মৎ। কভার ড্রাইভ।
    -              অফ স্ট্যাম্পের বাইরে বল বুঝতে হবে। জিন্দেগি গুজর জায়েগি বাবা। গুজর জায়েগি জিন্দেগি।

    সুবীর উইকেটের পেছন থেকে দেখছে না, উইকেটের সামনে থেকে দেখছে না। তার সামনে প্র্যাক্টিস হচ্ছে, সে দর্শক। সে ছেলের সঙ্গে এসেছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফার্স্ট ইয়ার। যত না খেলতে তার চেয়ে গা ঘামাতে আসে। অক্সফোর্ড মিশনের মাঠ বন্ধ হলে এই স্বামীজী পার্কে  প্র্যাকটিসে এসেছে। কখনও সুবীর আসে ছেলের সঙ্গে। সে রোদের মধ্যে নেটের উল্টো দিকে পিঠ করে মাঠ দেখে। অনেকগুলো ক্লাবের একসঙ্গে প্র্যাকটিস চলে। নানা বয়সী ছেলে ও মেয়েরা  প্র্যাকটিসে আসে, গরমের মধ্যে অফ সিজনে ছেলেমেয়েরা আসে। ছেলেদের সংখ্যাই বেশি। মেয়েরা কম। কোন কোন  নেটে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে প্র্যাকটিস করে। দূর থেকে প্র্যাকটিস দেখতে তার অন্যরকম লাগে। দূরের প্র্যাকটিসে নেটের জাল দেখা যায়। কখনও  উইকেটের পেছনে থেকে ব্যাট করা দেখা যায়। অনেক দূর বলে ব্যাটসম্যানকেও ছোট লাগে। বোলারকেও ছোট ছোট দেখায়। দূরে ক্লাবগুলো বড়ো বড়ো জাল দিয়ে নিজেদের সীমানা আঁকিয়ে রেখেছে। ফলে উঁচু উঁচু শটগুলো কখনই সেই জাল টপকে আসতে পারে না। শুধু আওয়াজ শোনা যায় থাস থাস থাস থাস। শট যত ঠিকঠাক হবে ততো সুন্দর আওয়াজ হবে। সে আওয়াজ বোঝার জন্য চোখ বুজে ফেলছিল সুবীর। তার কানে গেল ব্যাটে-বলের সঠিক উচ্চারণগুলো পেছনের নেট থেকেই আসছে যেখানে তার ছেলে প্র্যাকটিসে এসেছে। সে চোখ খুলে ফেলতে সামনের সবুজ মাঠ দেখতে পেল। চোখ বন্ধ করার আগের থেকে ঐ মাঠটা খানিক আলাদা হয়ে গেছে কারণ এখানে রোদ -ছায়ার খেলা চলছে আর মাঝে মধ্যে ঝির ঝির অথবা খুব ঝেপে বৃষ্টি আসব আসব করছে অথচ আসছে না। সে বৃষ্টি এলেই তখন নেট প্র্যাকটিস বন্ধ হয়ে যাবে। এই ভেবে সে সামনের তিনটে নেটের প্র্যাকটিসের আওয়াজ শুনতে লাগল। ব্যাটে বলের আওয়াজে মন দিতে গিয়ে সুবীর অনেক দিনের শোনার অভ্যাসে ব্যাটের ঠিকঠাক জায়গায় আওয়াজ বুঝতে পারে। সে শোনে কম্পনের আওয়াজ। ব্যাটে বলে লেগে যে কম্পন হয় তা বলকে কাঁপায়। ব্যাটের আঘাতের জায়গাটা কাঁপিয়ে, ব্যাটসম্যানের  কবজি আর কনুইকে কাঁপিয়ে তারপর আওয়াজ হয়ে হাওয়ায় হাওয়ায় কানে এসে ধাক্কা মারে। সুবীর  বুঝতে পারছে ঠিকঠাক আওয়াজ হলে ব্যাটের সঠিক জায়গাটা—সুইট স্পটে বল লেগেই হয়েছে। সেটা যে মারছে তার কবজি আর কনুইতেও কম ধাক্কা লাগছে অন্য অনেক শটগুলোর তুলনায়। তারপর সেগুলো মাটি কামড়ে যাবে না আপিস - উঁচু উঁচু হয়ে পড়বে তা নির্ভর করছে ব্যাটসম্যানের ওপর কারণ সে ব্যাটের ঠিকঠাক অঞ্চলে  আঘাত করতে পেরেছে আর বোলারের কিছু করার নেই। সে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে বল চলে গেল।

    সুবীর একই বেঞ্চে বেশিক্ষণ বসে না। সে পার্কের অনেকগুলো সিমেন্টের বেঞ্চিতে ঘুরে ঘুরে বসে। অজয় স্পোর্টসের নেট প্র্যাকটিসের এলাকার ঠিক পাশে রাস্তা সেখানের একটা বেঞ্চে সে বসেছিল তারপর উঠে অন্য বেঞ্চিগুলোতে বসেছিল। অনেকটা ছায়া আর হাওয়ার খোঁজে সে ঘোরে। কখনও কোনদিন সে সিগারেট ধরিয়েছিল কি? এখানে সে নানা শব্দ -নৈঃশব্দ্যের  জন্য ছেলের সঙ্গে মাঝে মাঝে আসে। সে বাবা না দর্শক সে নিয়ে কথা হতেই পারে। কিন্তু সুবীর সব সময় ঠিক করতে পারে না। আজ, সে বুঝতে পারল অনেকেই তার মতো বসে বা দাঁড়িয়ে থাকছে। তারা কারা?

    একজনকে সে জিজ্ঞেস করায় উত্তর পেল, 'ট্রায়াল চলছে'। সুবীর বুঝল সেকেন্ড ডিভিশনের নানা ক্লাবের জন্য ট্রায়াল দিতে এসেছে অনেকে।  সুবীর ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে, 'আপনি কোথা থেকে আসছেন?'
    -              বেথুয়াডহরি।
    -              আপনার ছেলে কী করে? ব্যাট না বল?
    -              বল।
    -              কোন জন?
    -              ওই।
    -              আচ্ছা।
    ছেলেটির রান আপ দেখে সুবীর বলল, 'একটু গণ্ডগোল আছে।'
    -              কিসে?
    -              রান আপে। আর একটু ঠিক করলে আর একটু জোরে বল করতে পারবে।

    ভদ্রলোক কিছু বললেন না। এবার সুবীর আশপাশে এরকম আরো অনেককে চিনতে পারল। বুঝল তারা বহু দূর দূর থেকে এসেছেন। এঁদের  সকলের ছেলেই কি বল করে? সকলেই কি বেথুয়াডহরির ছেলেটির মতো লম্বা? নেটে সুবীর এবার অনেক লম্বা ছেলেকে দেখতে পেল যা আগে সে খেয়াল করেনি কিন্তু তারা সবাই যে জোরে বল করছে না, অনেকেই স্পিন করছে। এরকম ভেবে সুবীর বুঝতে পারছে এভাবে কোন সিদ্ধান্তে আসা খুব মুশকিল। সে একটা বল আসতে দেখল যেটা সে ঠিক করতে পারছিল না অফ স্ট্যাম্পে না অফ স্টাম্পের বাইরে যাবে। বোলার কোন দিকে তাকিয়েছিল, তার মনে পড়ল না। ফলো থ্রুর সময়, বলটা ছাড়ার সময়, হাতটা কোন অ্যাঙ্গেলে ভেঙেছিল এসব বোঝার চেষ্টা করছিল সুবীর – তারপর সে বুঝতে পারল এটা ব্যাটসম্যানের ব্যাপার। তার ব্যাপার নয়। এমনকি তার ছেলেরও ব্যাপার নয়, কারণ সেও ব্যাটসম্যান নয়। সে বল অনিশ্চয়তার করিডোরে পড়ে কোথা থেকে কোথায় যাবে এ বোঝা তার কর্ম নয় – সে বড়ো জোর একজন দর্শক। সেই দর্শক হিসেবে  ঠিক করতে পারে না বলটা অফ স্টাম্পে না অফ স্টাম্পের বাইরে দিয়ে চলে যাবে। বড়ো জোর দেখতে পারে স্টাম্পটা ঠিক থাকবে না ওকে নিয়ে যাবে বলটা। কিপারের হাতে যাবার আগে ব্যাটে ছুঁয়ে যাবে নাকি না-ছুয়ে যাবে। বড্ড জোর এটা দেখার জন্য সুবীর অজয় স্পোর্টস ক্লাবের প্র্যাকটিস নেটের সামনে সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে থাকে। আর ব্যাট বলের আওয়াজ হয় থাস থাস থাস থাস। ফলো থ্রুর সময় - বা ছাড়ার মুহূর্তে  শেষ জোর দিতে দিতে বোলার শ্বাস ছাড়ে উফ উফ উফ উফ। এসব সুবীরকে ছেয়ে থাকে, ক্রমশ আরো বেশি বেশি করে।

    'একটু উঠবেন। আমার মাথাটা ঘুরছে।' ভদ্রলোক বললেন। প্রখর রোদ উঠেছিল আর মেঘেরা চলে গিয়ে বৃষ্টি কবে হবে ঠিক নেই। ওনাকে ধরাধরি করে সিমেন্টের বেঞ্চিতে শোয়ানো হল। সামনের তিনটে নেটে যথারীতি প্র্যাকটিস চলছে। বাড়ি আসানসোল। ছেলেকে সেকেন্ড ডিভিশনের ট্রায়ালে নেওয়াতে  এসেছেন। সুবীর ভাবল ইনি দর্শক নন। ইনি কেউ নন নাকি বাবা – এক সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়নের বাবা। 'সেই রাতে বেরিয়েছি তো। একটু অম্বলের ধাত  আছে। মাথাটা ঘুরেছে।' সুবীরের সামনে এক গোটা স্টেডিয়াম ভেসে ওঠে – সেখানে ভর্তি দর্শক। তালে তালে চিৎকার করছে আর চ্যাম্পিয়ন কোন দিকে দেখছে না। সে কি কিছু ভাবে নাকি ভাবেই না বলে সে চ্যাম্পিয়ন। তার সারা গায়ে ব্র্যান্ডের লোগো। সে সব লোগোরা তাকিয়ে রয়েছে। লোগোর ওপর একটু ধুলো পড়েছিল কোথা থেকে চ্যাম্পিয়ন সেটায় আঙুল দিয়ে টোকা মারে – লোগো ঝকঝকে করে । সবাই চ্যাম্পিওনের দিকেও তাকায় – সুবীরও।                                                                                                                                     
    সুবীর জিজ্ঞেস করে, 'ছেলে কী করে, বল না ব্যাট?'
    -              দুটোই।
    -              খালি পেটে আছেন অনেকক্ষণ?
    -              না না, চা-টা খেয়েছি।
    -              বেরোলেন কয়টায়?
    -              বারোটায় যোধপুরে এলাম।আসানসোল থেকে।
    -              রাতে?         
    -              হ্যাঁ। হাওড়ায় পাঁচটা।
    -              লেট ছিল।
    -              ছিল, অল্প।
    আসানসোলের ভদ্রলোক খানিকক্ষণ শুয়ে থাকেন, তখন তার চারপাশে উৎকন্ঠিত মুখেরা। জলটলও দেওয়া হয়েছিল। উঠে বসে তিনি ছেলেকে ডাকেন নাম ধরে। সুবীর দেখল রোদে পুড়ে কালো হয়ে ঘেমে নেয়ে ছিপছিপে এক সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন এগিয়ে আসছে। তার ট্রাউজারে লাল লাল দাগ। ঘষে  রক্ত বার করতে হয় বলের কারণ  বলেরও রক্ত হয়। আর সে রক্ত ঘামের সঙ্গে মিশে টপটপ  গড়িয়ে আসতে থাকে।                  
                                                                                                                                                                                                             
    দর্শক সুবীর তাকিয়ে তাকিয়ে বলের রক্ত ও ঘাম দেখে। ভিড়ের মধ্যেও নিস্তব্ধ স্বামীজী পার্কে তখন ব্যাট ঘোরানোর ছবি, ব্যাটে বলে না হওয়ার ছবি বা হওয়ার ছবি সেকেন্ডে অনেক অনেক ফ্রেম তৈরি করছে। দর্শকেরও সুবিধা আছে, সে চ্যাম্পিওনের থেকে অনেক জিনিস বেশি দেখতে পায়। সুবীর দেখল বঁড়শের অক্সফোর্ড মিশনের মাঠ ডগলাস গ্রাউন্ডের উঁচু গেটটা খোলা। আর দূরে লাল লাল  টিনের চালের ওপর একটার পর একটা আপিস শটগুলো পড়ছে, ট্যাং ট্যাং ট্যাং ট্যাং ট্যাং আর সেখান থেকে বেজে বেজে উঠছে কখন চেলো, কখনও বেহালার সুর। উঁচু করে মারা সেই শটগুলো সবই কি সৌরভের মারা? এই ভেবে সুবীর নেটের পেছনে মাঠের ধারে টিনের চালের দিকে আবারও তাকাল। যেখানে বল পড়ার সম্ভাবনা একদমই নেই বললেই হয়। কোন চ্যাম্পিয়নের উঁচু করে মারা আপিস শট এই অজয় স্পোর্টিং ক্লাবঘরের টিনের চালে না পড়লেও বড় বড় গাছের কোল ঘেঁষে তাদের ছায়ায় থাকা ওই নেটটার  সব সে শুনতে পাচ্ছে থাস থাস থাস থাস থাস ...... উফ উফ উফ উফ উফ, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বামীজী পার্কের এই সবুজ টিনের চালও সম্পূর্ণ অকারণে শব্দ করে উঠল – টাং খট খট খরখর টাং খটাস। সব ছাপিয়ে আওয়াজ আসছে 'আই ল ল ল ল লা,  আই ল ল ল ল লা,  আই ল ল ল ল লা। -- সুজিত স্যার।

    দিন ঢলে রাত হয় আবার সূর্যেরা আসে, আলোরা। সারা বছরই এমন হবে এটা সবাই জানে, সুবীরও জেনে ছিল। মাঠে বসিয়ে রাখা শব্দের রূপেদের দিকে সে তাকিয়ে ছিল তাদের দেখা যায় না শোনা যায় বলে স্থির তাকিয়ে থাকতে হয়। ক্রিকেট মাঠের শব্দেরা ঘিরে ধরছিল তাকে, ঘিরে ধরছিল।
     
    নতুন শতক পত্রিকায়  প্ৰকাশিত 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ইন্দ্রাণী | ১৬ নভেম্বর ২০২৩ ১১:২৯526131
  • অসম্ভব ভালো লেগেছে। অভিনবত্ব সবরকমে। শব্দের রূপ তো বটেই। চলনে, দৃশ্য, শব্দ নৈঃশব্দের ব‍্যবহারে, ক্রিকেট মাঠের শব্দরা পাঠককে ঘিরে নেবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন