৯১ সালের ভোটে আমি স্কুলে পড়ি। ভোটের পরের দিন সকালে কাকুর সঙ্গে রাস্তায় বের হয়েছিলেম। আমাদের পাড়ার যে স্কুলে ভোট হয়, সেই স্কুলের বাইরে রাস্তার উপর দুতিনটি কাগজ পড়ে ছিল। ধুলো-বালি মাখা। সেখান থেকে একটি কাগজ কাকু হাতে তুলে নিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ সেটির দিকে তাকিয়ে থেকে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়েছিল কাকুর মুখ দিয়ে। জিজ্ঞাসা করেছিলেম, 'কি কাগজ?' কাকু জানিয়েছিলেন ব্যালেট পেপার। আনন্দে রাস্তা থেকে আরেকটি তুলে নিয়েছিলেম হাতে। এর আগে কোনদিন ব্যালট পেপার দেখি নি। বড়রা ভোট দেন। তাদের মুখে ব্যাল্ট পেপারের কথা শুনি। তাই জিনিসটি হাতে নিয়ে দেখার লোভ আর সামলাতে পারিনি। উল্টে পাল্টে দেখতে শুরু করি। কাকু কাগজটি ফলে দিতে বলতেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল পকেটে করে নিয়ে আসি। তারপর ঐ কাগজটি আবার রাস্তায় ফেলে দিয়ে হাঁটা শুরু করেছিলেন।
সেদিন প্রথম ব্যালট পেপার দেখে আনন্দ হয়েছিল। মনে মনে নিজেকে একটু বড় ভাবতে শুরু করি। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করেছিলেম আমি ব্যালট পেপার দেখেছি। যেটাতে ভোট দেয়, বুঝিয়ে বলেছিলাম বন্ধুদের। একটু বড় হবার পর বুঝতে পেরেছি ব্যালট পেপার রাস্তায় পড়ে থাকার জিনিস না। আর ব্যালট রাস্তায় এসে পড়ে থাকলে বুঝতে হবে দেশের সামনে বড় বিপদ। যেভাবে মন্দিরের বিগ্রহ রাস্তায় পাশে পড়ে থাকে না। তেমনি ব্যালট পেপারও নির্বাচন কেন্দ্র থেকে বাইরে এসে পড়লে ভালো দেখায় না।
১৯৯১ সালে সেবার ত্রিপুরার পশ্চিম আসন থেকে জয়ী হয়েছিলেন সন্তোষ মোহন দেব। তিনি নাকি রেকর্ড ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। প্রায় চার লাখ ৩০ হাজার ভোটে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। রেকর্ডের নমুনা ছিল এই রকম, মোট যা ভোট পড়েছিল তার ৮৩.৪৭ শতাংশ পেয়েছিলেন সন্তোষ মোহন দেব। সেবার নির্বাচনে মোট প্রার্থী ছিলেন দশজন। সন্তোষ মোহন দেব ছাড়া বাকি নয় প্রার্থী কেউ ছয় শতাংশের বেশি ভোট পান নি। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের মানিক সরকার সেবার ছয় শতাংশের সাম্নায় বেশি ভোট পেয়েছিলেন। সেদিন এই ছিল ত্রিপুরার পশ্চিম আসনের লোকসভা ভোটের চিত্র। সেই ভোটের হিসেব মেলাতে নির্বাচন কমিশনের দুদিন সময় লেগেছিল। এমন মারাত্মক ভোট নিয়ে যদিও অনেক কংগ্রেস কর্মী আজো লজ্জা পান।
গত তিন দশকে এমন মারাত্মক ভোট আর দেখেনি ত্রিপুরা। এরপরও ত্রিপুরায় বহু ভোট হয়েছে। অনেক ভোট নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ উঠেছে। জঙ্গীদের বন্দুকের নলের নিচে ভোট হতেও দেখেছে ত্রিপুরার মানুষ। ২০০০ সালে ত্রিপুরা স্বশাসিত জিলা পরিষদের ভোটে কিছু কিছু অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদীরা নিজেরাই ভোট করেছিল। ভোটের আগে সিপিএম প্রার্থীর পরিবারের লোকজনদের, এমনকি সিপিএম নেতাদের সেবার অপহরণ করেছিল জঙ্গীরা। কিন্তু এ ধরনের আতঙ্ক কায়েম হলেও তা সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে নি। অন্য অংশে মানুষ প্রতিবাদী হয়ে নিজের মত নিজে প্রকাশ করেছিলেন। কখনো কখনো সিপিএমের দিকে ভোটে সন্ত্রাস ছড়ানোর অভিযোগ এনেছে বিরোধীরা। তাও কিছু কিছু পকেটে। কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতা তাদের এলাকায় জোর করিয়ে ভোট করিয়ে জয়ী হয়েছেন ত্রিপুরায়। কিন্তু রাজ্যের ইতিহাসে তারা কেউ একবারের বেশি স্থায়ী হন নি। পাঁচ বছর পরেই মানুষ তাদের বিদায় দিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে বৃহস্পতিবারের লোকসভার পশ্চিম আসনের ভোট ত্রিপুরাতে। একদম শহর থেকে গ্রাম। গ্রাম থেকে পাহাড়। সর্বত্র রিগিং'এর অভিযোগ উঠেছে। জোর করে ভোট দিতে দেয়া হয় নি। প্রকাশ্যে এসেছে ভোটে প্রহসনের ছবি। বিধায়করা নিজেরা পুলিসের উপর চাপ প্রয়োগ করেছেন তাদেরকে জায়গা ছেড়ে দেবার জন্য। মাথা নিচু করে সেই উর্দিধারী দাঁড়িয়ে রয়েছেন শাসক দলের বিধায়কের সামনে, এ ধরনের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মহিলাদের রাস্তা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে দুষ্কৃতীরা। ভোটের আগের রাত থেকেই গোটা লোকসভা আসনের সর্বত্র সন্ত্রস্ত করা হয়েছে সাধারন মানুষকে। এমন ধারার ভোট ত্রিপুরার মানুষ কোনদিন দেখেন নি।
সেদিন রাস্তায় ব্যালট পেপার দেখে অবাক হয়েছিলাম। আজ আগরতলার রাস্তার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানে পাড়ার আড্ডায় শুধু ভোট দেবার গল্প। কিভাবে আটাকানো হয়েছে, ভোট দিতে যাবার সময় কি বলে দেয়া হয়েছে, ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে কিভাবে তাদের উপর নজর রাখা হয়েছে শুধু তা নিয়েই আলোচনা চলছে।
এক বছর আগে গণতন্ত্রের কথা বলে ত্রিপুরার মসনদে বসা দলটি নিজেরাই বুঝতে পারলেন না তারা কতবড় সর্বনাশ করে ফেলেছেন। নিজেদের যাচাই করার যে সুযোগ তারা পেয়েছিলেন তা তারা হারিয়েছেন। অন্যদিকে মানুষকে এক বছরেই তারা বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন গণতন্ত্রের কথা স্রেফ একটা ভাঁওতা তাদের কাছে।
৯১ সালের ভোটের পর ত্রিপুরা থেকে সন্তোষ মোহন দেব একটা অন্য নাম নিয়ে ফিরেছিলেন। ত্রিপুরার মানুষ এখনো তাকে সেই নামেই চেনেন। সন্তোষ মোহন হয়ে গিয়েছিলেন 'সন্ত্রাস মোহন'। এবারের ত্রিপুরার নির্বাচন শাসক দলকে কি পরিচয় দেয় তাই এখন দেখার।