সুজিত মিনজকে মারলো কে সে এক বিশাল ধাঁধাঁ। যে ঘরে তার আধপোড়া শরীর পাওয়া গেল সেটা বেদান্তের ক্যাম্পাসের একেবারে ভেতরে সিসিটিভি রুম হিসেবে ব্যবহার হয়। মৃতদেহের হাত পা লোহার তার দিয়ে বাঁধা ছিল। দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা হলে এরকমটি হবার কথা নয়। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য আন্দোলনকারীরাই তাকে মেরেছে। কিন্তু সুজিত মিনজ ডোঙারিয়াদের ঘরের লোক। স্বজাত। পেটের দায়ে বেদান্তে চুক্তিভিত্তিক চাকরি করতো। তাকে মেরে আন্দোলনকারীদের কী লাভ।
আসলে কর্পোরেটের ছলাকলার শেষ নেই। হাঁটু অব্দি রক্তের নদী ঠেলে প্রফিটের খোঁজ করতে, পথের কাঁটা ওপড়াতে তারা বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না। দু একটা সুজিতের মৃত্যু তাদের কাছে খুব দরকারি। কারণ সেই দায় আন্দোলনরত ডোঙারিয়া কন্ধদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায়। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম রিপোর্টে বিস্তারিত লিখেছে যে মূল গেট, যেখানে বিক্ষোভকারীরা জমায়েত হয়েছিল , সেখান থেকে ঐ সিসিটিভি রুমের দূরত্ব ১০০ মিটারেরও বেশি। আন্দোলনকারীরা সেখানে বিক্ষোভরত অবস্থায় গেলে রাস্তা এবং ঘরটিতে ভাঙচুরের চিনহ থাকতো। এসব না থাকলেও ২৭ জনের বিরুদ্ধে এফ আই আর করা আটকায়নি। এদের মধ্যে ছ' জনকে এরেস্ট করা হয়েছে, আরো ৩০০ জন অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে কেস করা হয়েছে।
দেওয়ালের ভেতর হাতপা বাঁধা সুজিত যখন পুড়ছে গেটের বাইরে দানি বাত্রাকে কুকুরের মতো পিটিয়ে মারছে পুলিশ। তারিখটা ঐ একই, ১৮ই মার্চ, ২০১৯। দানির অপরাধ, যখন বিক্ষোভ চলছিল তখন কারখানায় তার শিফট শুরু হবার সময়। গেটের কাছেই সে অপেক্ষা করছিল গোলমাল প্রশমিত হলেই কারখানায় ঢুকে পড়বে বলে।
এইখানে বলে রাখা ভালো দানি বা সুজিত বেদান্তের চাকরি ক'রে কোনো বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেনি। দশ বছর আগে যখন বেদান্ত ডোঙারিয়া কন্ধদের জমি কেড়ে নেয় তখন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সব ঘর থেকে একজন ক'রে চাকরি পাবে। স্কুল হবে, ফ্রি এডুকেশন, হাসপাতাল, আরো কতো কী ! হলো যখন দেখা গেল স্কুলে মাইনে দিতে হবে, সে মাইনে সময়ান্তরে চড়চড়িয়ে বাড়বে, হাসপাতালে ফ্রি বেড কখনোই খালি থাকে না আর গুটিকয়েক চাকরি পেলেও কেউ পার্মানেন্ট নয়। সবাই চুক্তিভুক্ত লেবার। ট্যাঁ ফোঁ করলেই চাকরি চলে যেতে পারে।
একে যদি বলা যায় কর্পোরেটের কল, তাহলে সে কলে ধরা পড়া ডোঙারিয়া কন্ধরা ইঁদুর নয়, তারা জঙ্গলের স্বাধীন চিতাবাঘ। চুপ ক'রে যাবার বদলে মার্চ থেকে আরো জোরদার আন্দোলন শুরু হলো। দাবী সনদে রইল স্থায়ী চাকরি, কাছের স্কুলে বাচ্চাদের ভর্তি, আর যারা জমি দিয়েছে সেই পরিবারগুলোর জন্য আরো চাকরি।
রক্ষক ভক্ষকে পরিণত হলে যে বিপদ মাথায় নেমে আসে ডোঙারিয়ারা আজ তার মুখোমুখি। রাষ্ট্র তার ভূমিসন্তানদের রক্ষা করার বদলে লেলিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্রপোষিত পেশিশক্তি। শুধু ডোঙারিয়ারা নয়, এই অঞ্চলের দলিতদেরও যদি মূল নিপীড়নকারীর কথা জিজ্ঞাসা করা যায়, উঠে আসবে সিকিউরিটি ফোর্স এবং CRPF এর কথা। যাদের কাজ ছিল রক্ষা করার তারাই নানাভাবে অত্যাচার করছে এই মাটির মানুষগুলিকে। এইজন্যই মানবাধিকার কর্মীদের মুখে বার বার এই অঞ্চল থেকে এই দুই বাহিনীকে প্রত্যাহার করবার দাবী শোনা গেছে।দানিকে পিটিয়ে মেরেছে বেদান্তের সিকিউরিটি পার্সোনেল এবং কুখ্যাত ওড়িশা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স (OISF)। গোলমালে সে কোনভাবে মাঝখানে পড়ে যায় এবং বেদম পিটুনি থেকে বাঁচতে সংলগ্ন পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু তার আগেই সে এতটা আহত হয়েছিলো যে সাঁতার কেটে নিজেকে বাঁচানোর মতো শক্তি তার আর অবশিষ্ট ছিলো না। যারা তার এই সলিল সমাধি স্বচক্ষে দেখেছিল, তারা সিকিউরিটিকে বার বার উদ্ধারের কথা বলা সত্বেও কোনো কাজ হয়নি। শেষে যখন জল থেকে তোলা হয় তার বহু আগেই দানির শ্বাসরুদ্ধ হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের প্রথম প্রতিক্রিয়া দানি মদ্যপ অবস্থায় জলে পড়ে যায় এবং তার মৃত্যু হয়। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা সকলেই ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিমকে জানিয়েছে বাঁচার জন্য জলে ঝাঁপ দেবার আগে কিভাবে দানিকে নির্মম লাঠিপেটা করা হয়েছিল। এই মৃত্যুতে অভিযুক্তদের ধরপাকড় তো দূরের কথা, জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। সুজিতের মৃত্যুর একেবারে বিপরীতে দাঁড়িয়ে দানির মৃত্যু, যদিও সংশ্লিষ্ট মহলের ধারণা দুজনেরই ঘাতক একই ষড়যন্ত্রী।
আগের কিস্তিতেই উল্লেখ করা হয়েছিল ২০১৩ সালে কিভাবে এই অঞ্চলের সমস্ত গ্রামসভা ঐক্যবদ্ধভাবে বেদান্তের ১২০০০ কোটি টাকার বক্সাইট মাইনিং প্রজেক্টকে ঘাড়ধাক্কা দেবার কথা জানিয়েছিল। তাদের জোর ছিল দেশের আইন যার বলে আদিবাসী অধ্যুষিত বনাঞ্চলগুলোতে গ্রামসভার সিদ্ধান্তই শেষকথা। এর সঙ্গে ছিল সুপ্রিম কোর্টের সায়। কিন্তু আইনি অনুমোদন না থাকা সত্বেও বেদান্ত তার থাবার নীচেই চেপে রেখেছে নিয়মগিরিকে। রিফাইনারি চলছে। এই অঞ্চলে বক্সাইট উত্তোলন নতুনভাবে না হলেও অন্য পাহাড় থেকে নিষ্কাশিত বক্সাইট আসছে লাঞ্জাগড়ের রিফাইনারিতে। এতো ক্ষমতা বেদান্তের যে ওড়িশা মাইনিং কর্পোরেশন এখন সুপ্রিম কোর্টকে বলছে ২০১৩ সালের গ্রামসভার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হোক।
এরই সঙ্গে চালানো হচ্ছে সম্ভব অসম্ভব সবরকম দমন পীড়ন। হাট থেকে মাওবাদী সন্দেহে নিরপরাধকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আকছার। আন্দোলনে যোগ দেবার অপরাধে বা খুনের মিথ্যে অভিযোগে আটকে রাখা এবং পুলিশ কাস্টডিতে অভিযুক্তের মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় কোন বিরল ঘটনা নয়। যেমনভাবে মার্চমাসে কারখানা গেটের সামনে উল্লিখিত গোলমালের জন্য মে মাসে পট্টনায়েক হরিজনকে তুলে নিয়ে যায় লোকাল পুলিশ। কিছুদিন পর খবর আসে পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসার সময় কিডনির অসুখে তার মৃত্যু হয়েছে। সাজোয়ান পট্টনায়েকের পরিজন ও মানবাধিকার কর্মীদের দাবী তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।
ফলে নিয়মগিরি অঞ্চলে এখন বেনিয়মই নিয়ম। রোজ নতুন নতুন টেনসনের জন্ম হচ্ছে কর্পোরেট ও আদিবাসীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বে। যেমন পট্টনায়েকের মৃত্যুর পর নতুন আন্দোলন শুরু হয় এবং পুলিশ এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে।
দেশের অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় যে দেশের সরকারের কাছে কর্পোরেটের আর্থিক দায়ভার লাঘব করা , সে দেশে এই ডেভিড গলিয়াথের অসম যুদ্ধের ফলাফল কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কর্পোরেট মুনাফার পর মুনাফা বাড়াবে, আদিবাসী তার জমি জঙ্গল হারিয়ে শহরের ফুটপাথে ভিক্ষা করবে। স্বপ্নে আসবে বংশধারা নদীর ঢেউয়ের শব্দ, নিয়মগিরির চূড়ার কুয়াশায় ডোঙারিয়া কন্ধদের দেবতা নিয়ম রাজার হারিয়ে যাওয়া অবয়ব। বাস্তবে এক এক করে হারিয়ে যাবে এদেশের সমস্ত খনিজসমৃদ্ধ পাহাড়-পর্বত। সঙ্গে মধুক্ষরা নদীঝর্ণা, সবুজ বন, সরল প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ।
সেই উষর মরুভূমির দিকে গোটা দেশের যাত্রা দ্রুততর হোক !