লেখক আগে এই লেখাটি লিখেছিলেন। রইলো আরো কিছু কথা।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পূর্বঘাট পর্বতমালায় এক আশ্চর্য পাহাড়, সেখানে শত শত বছর ধরে বসবাস করছে এক বর্ণময় “আদিম” জনজাতি। ওই পাহাড় তাদের দেবতা, অন্নদাতাও। একদিন এল এক মহাশক্তিধর খনি কোম্পানি, খাদান খোঁড়ার তোড়জোড় শুরু করল পাহাড়ের মাথায়। জনজাতির মানুষেরা বাধা দিল, শুরু হল লড়াই – টিকে থাকার, ওই পাহাড়ের অতুলনীয় জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার। একুশ শতকের ভারতবর্ষে এ যেন এক ঘটমান রূপকথা।
এই রূপকথার টানে গিয়েছিলাম নিয়মগিরিতে, ২০১০ সালের নভেম্বরে। ফেরার পথে ভবানীপাটনায় (কলাহান্ডির জেলা সদর) পরিচয় হল প্রবীণ গান্ধিবাদী সাংবাদিক জীবননাথ পাধির সঙ্গে। তিনি বললেন – “ ওড়িশার উপজাতি মানুষের বাঁচা-মরার হদিশ নিতে এত দূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন, দেখে সত্যি খুব ভাল লাগছে। কিন্তু কিছু মনে করবেন না, আপনি একটা কাহিনী মাঝখান থেকে পড়তে শুরু করেছেন। নিয়মগিরিতে উন্নয়নের নামে পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে লড়াই দেখলেন, সেটা এই রাজ্যে শুরু হয়েছিল তিরিশ বছর আগে, গন্ধমার্দন পাহাড়ে। বালকো-র (BALCO) বক্সাইট খনির বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল স্থানীয় জনজাতির মানুষ। যদি গল্পের শুরুটা পড়তে চান তো সেখানে যান একবার। সেই সময়কার মানুষদের কেউ কেউ এখনও বেঁচে আছে, পাহাড়টাও আছে।“
রামায়ণের গন্ধমার্দন বিশল্যকরণীর পাহাড়, যা হনুমান হিমালয় থেকে উপড়ে নিয়ে উড়ে গিয়েছিল লঙ্কায়। বাস্তবের গন্ধমার্দন পূর্বঘাট পর্বতমালার একটি শিরা, বরগড় আর বোলাঙ্গির জেলার সীমান্তে, সম্বলপুর থেকে ১৬৪ কিলোমিটার দূরে। দেড় শতাধিক ঝর্ণা আছে এই পাহাড়ে। নিয়মগিরির মতো চাষবাস বা মানুষের বসতি নেই, তার বদলে রয়েছে গভীর ক্রান্তীয় অরণ্য – প্রায় ২২ হাজার প্রজাতির অ্যাঞ্জিওস্পার্ম বা পুষ্পল উদ্ভিদ, যার মধ্যে কয়েকশো প্রজাতি দুস্প্রাপ্য ওষধি গুণসম্পন্ন। আর রয়েছে দুটি প্রাচীন মন্দির; একটি শিবের, অন্যটি নৃসিংহনাথ বিষ্ণুর। নৃসিংহনাথ মন্দিরটি ছশো বছরের পুরনো, স্থানীয় হিন্দু ও জনজাতির মানুষের পবিত্র তীর্থস্থান। এছাড়া রয়েছে হাজার বছর আগের এক বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ, যার বর্ণনা আছে হিউ এন সাঙের বৃত্তান্তে। এও এক ঘটমান রূপকথা, যার সাম্প্রতিকতম অধ্যায়টি লেখা হয়েছে মাত্র তিন দশক আগে, স্থানীয় আদিবাসীদের সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। স্বাধীন ভারতে পরিবেশবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে গন্ধমার্দন একটি সার্থক ও ব্যতিক্রমী অধ্যায়।
নিয়মগিরির গল্পের শিকড়বাকড়ের সন্ধানে এরপর গিয়েছি গন্ধমার্দনে, দর্শন পেয়েছি এক বিনঝল নারীরঃ নিরক্ষর এক বৃদ্ধা, তিরিশ বছর আগে পুলিশ সুপারের জিপের সামনে দুটি চাকার নীচে শুইয়ে দিয়েছিলেন কোলের দুই শিশুকে।
- নিজের বাচ্চার প্রাণের মায়া নেই তোমার? পুলিশকর্তা বলেছিল।
- এই পাহাড়ের জলে আমাদের চাষ হয়, বনের গাছগাছড়ায় অসুখ সারে, ওখানে আমাদের দেবতা নরসিংনাথ থাকেন। পাহাড়ে খাদান হলে আমরা সবাই মরব। আর আমি মরলে তো আমার বাচ্চারাও মরবে। তাই ওদের কথা ভেবেই এটা করছি। চালাও, চালিয়ে দাও! বলেছিলেন সেই নারী।
বক্সাইটের সন্ধানে গন্ধমার্দনের মাথায় ব্লাস্টিং হয়, প্রাচীন মন্দিরে চিড় ধরে, প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। স্থানীয় কন্ধ আর বিনঝলরা রাতারাতি পাহাড়ে বালকো-র ট্রাক যাবার রাস্তায় পাথর পুঁতে মন্দির বানিয়ে পুজো শুরু করে দেয়। নাম হয় বালকো-খাই দেবীর মন্দির। সেই মন্দির আজও আছে। রোজ সকালবেলায় এক আদিবাসী রমণী এসে বাবুই ঘাসের ঝাড়ু দিয়ে ঝাঁট দিয়ে যায়। কখনও কেউ এসে লাল সুতো জড়িয়ে দিয়ে যায় অবয়বহীন পাথরে। এছাড়া সারাদিন নির্জন পড়ে থাকে। পুরনো একটা মেহগনি গাছ থেকে বাদামি পাতার বৃষ্টি ঝরে।
এইসব জীবন্ত গল্পগুলো নিয়ে ফিরে এসে একটি বই লিখেছিলাম বছর দুয়েক আগে, নাম – “সত্যি রূপকথা ঃ সভ্যতা, উন্নয়ন ও ওড়িশার এক উপজাতির জীবনসংগ্রাম”। কিন্তু তারপরেও গল্পগুলো তাড়া করে ফিরছে আমায়, তার কারণ তারা লেখা হয়ে চলেছে আজও, স্থানীয় মানুষের হাতে। সন্দেহ নেই, আজকের এই অদ্ভুত আঁধারময় সময়ের উজ্জ্বলতম ইতিহাস লেখা হচ্ছে। ( দেশের মিডিয়া আশ্চর্য নীরব, কিন্তু আজকের সংযোগ প্রযুক্তির যুগে তার হালহদিশ রাখা কিছু কঠিন নয় আর।)
সেই সূত্রেই গুরুচণ্ডালীর সম্পাদকের নির্দেশমত লিখে ফেললাম “রূপকথার নটেগাছ মুড়োয় না”। মন্তব্যের সুতোয় পাঠকেরা সমর্থনে সমালোচনায় আমায় অনুপ্রাণিত কৃতজ্ঞ করেছেন, ফেসবুকে বার্তাও পাঠিয়েছেন। সব্বাইকে ধন্যবাদ। কেউ কেউ হয়তো মনে করেছেন লেখাটি ধারাবাহিক, চলবে। কিন্তু সত্যি বলতে কি, এই বিষয়ে নতুন কিছু বলার মতো রসদ আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমেনি। এতদূর থেকে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণাত্মক কিছু লেখা হয়তো যায়, কিন্তু আমার মনে হয় নিয়মগিরির (কিম্বা গন্ধমার্দনের) কাহিনির অনুপম বিশিষ্টতা ধরা যায় কেবলমাত্র তার দৃশ্য শব্দ গন্ধের ভেতর দিয়ে। “সত্যি রূপকথা” বইতে সেই চেষ্টাই করেছি। একদল মেধাবী নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক ও তথ্যচিত্রনির্মাতা কাজ করে চলেছেন নিরলস। উৎসাহীরা Save Niyamgiri নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে তার কিছু হদিশ পাবেন, নিয়মগিরির চিত্ররূপময় পৃথিবীর একটা আভাস পাবেন।
বর্ণ গন্ধ ধ্বনির এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রেক্ষাপটটা জরুরি। না হলে সব উন্নয়ন বিতর্কই শেষ পর্যন্ত মাথা কোটে অসার নাগরিক তাত্ত্বিকতার আবর্তে, “কিছু পেতে গেলে কিছু হারাতেই হয়” জাতীয় বুলিতে। যারা পাচ্ছে, তাদের যে কিছুই হারাতে হচ্ছে না, আর যারা হারাচ্ছে তারা যে পাচ্ছে না কিছুই – আবহমান এই নির্মম সত্যিটা খোদাই হয়ে থাকে একটি যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে, একটি নীরব চোখের ভাষায়, একটি ঠোঁটের কুঞ্চনে। তেমন এক মুখের সামনে এসে মুখোমুখি বসতে হয়। ঠিক তেমনই একটি পাহাড়ের মাথায় এক স্বচ্ছ শীত অপরাহ্ণে, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বনটিয়ার ঝাঁক আর কাঠঠোকরার ঠক ঠক শব্দে, আর্দ্র বনজ গন্ধে তিরতিরে ঝর্নার ধ্বনিতে, প্রতিভাত হয় ধর্মস্থানের সংজ্ঞা। পুরাণকথার নায়কের আঁতুড়ঘরের হালহদিশ নিয়ে যখন দেশ পোড়ে, সাম্প্রদায়িকতার দাঁতনখ শানিয়ে ওঠে, তখন এক কন্ধ রমণীর বাচন – “ তুমো মন্দির ইটা বালি রে তিয়ারি, আমো মন্দির গাছা লতা পাথরো ঝরনা জন্তু রে!” - ঝোড়ো হাওয়ার মতো আমাদের সনাতন দেবালয়ের পোড়ো দরজাটা সমূলে নাড়িয়ে দেয়।
সেই দরজায় প্রবল করাঘাত হয়ে চলেছে - নিয়মগিরি থেকে নন্দীগ্রাম, কলিঙ্গনগর থেকে কুডনকুলমে। সাড়া না দেবার জন্য অন্ধ বধির রাষ্ট্রকে খেসারত দিতেই হবে, দিতে হচ্ছে নিত্যদিন। ইতিহাস লেখা হয়ে চলেছে। এই লেখাটি লিখতে লিখতেই জানতে পারলাম, নিয়মগিরিতে জরপা গ্রামে আজ, ১৯ শে আগস্ট ২০১৩ দুপুরবেলা, দ্বাদশ এবং শেষ গ্রামসভা তাদের রায় জানিয়েছে – না! খনি চাই না!
নিয়মগিরির গল্পের একটি অধ্যায় শেষ হল। নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। আমার এই গল্প অবশ্য এখানেই শেষ।