চোখের পলকে একটি বীজের অঙ্কুরোদ্গম হচ্ছে, মাটির মধ্যে চারিয়ে যাচ্ছে শেকড়, সবুজ ডাঁটি ফনা তুলছে, খুলে যাচ্ছে পাতা, ক্রমশ মাথা তুলে জেগে উঠছে একটি গাছ ... এই চলচ্ছবি দেখলে ছেলেবেলার মতো এখনও বিস্ময়ের ঘোর লাগে। যদিও জানি আসলে ক্যামেরার কারসাজি, টাইম-ল্যাপ্স টেকনিকে তোলা ... দীর্ঘ সময়কাল ধরে তোলা ছবির খুব দ্রুত ফাস্ট ফরোয়ার্ড। এভাবেই ধীরে ধীরে একটি গাছের মৃত্যু, ঘুণ কিম্বা উইপোকাদের হাতে তিলে তিলে ক্ষয় ও তারপর ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে পড়া টাইমল্যাপ্স ক্যামেরায় দেখলেও আতঙ্কের ঘোর লাগতে পারে। যেমন ব্যস্ত রাজপথে একটি উড়ালপুলের ভেঙে পড়া ...
কিন্তু ধরা যাক যদি এই বিপর্যয় অতীব শ্লো মোশানে দেখা যেত, মানে টাইমল্যাপ্সের ঠিক উল্টো? দেড় সেকেন্ডে একটি নির্মীয়মাণ উড়ালপুলের ভেঙে পড়া যদি প্রলম্বিত করে দেখানো যায় কয়েক মাস কিম্বা বছর ধরে, তাহলে ২৩জন মানুষের মৃত্যু আসলে কিছুই না। কয়েক মাস কিম্বা বছর ধরে এই শহরে দুষিত বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে ঢের বেশি মানুষ মরে ফুসফুসের রোগে কিম্বা ক্যান্সারে। এই যেমন এখন, বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে শ্বাসনালীর এক জটিল সংক্রমণে ভুগছেন এই শহরের অসংখ্য বিশেষত বয়স্ক মানুষ। খবরটা সেভাবে মিডিয়ার প্রচারে আসেনি যদিও। আমরা জানিনা, জানতে পারব না, এই সংক্রমণ ঠিক কতশত জন মানুষের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে। কারণ তা ঘটবে অলক্ষ্যে, বিচ্ছিন্ন সময়কালে, উড়ালপুলের নীচে জীবন্ত চাপা পড়ার মতো নাটকীয় টাইমল্যাপ্সে নয়। তাই আমরা আতঙ্কে শিউরে উঠব না, রেগে উঠব না, জবাবদিহি চাইব না শাসকের কাছে। তাছাড়া ততদিনে দুর্গাপুজো এসে যাবে, কিম্বা বিশ্বকাপ ক্রিকেট, অথবা বাইশে শ্রাবণ, কিম্বা বইমেলা।
ইতিমধ্যে আরও ঢের ঢের প্রলম্বিত বিপর্যয়ের মধ্যে বাঁচব আমরা, বেঁচে যাব, প্রশ্নহীন ক্রোধহীন।
হয়তো সেই বিপর্যয় কখনও টাইমল্যাপ্স হয়ে উঠতেও পারে। এই যেমন ধরা যাক, ক্রমশ দেশের ক্যান্সার-রাজধানী হয়ে ওঠা এই কলকাতায় নিত্য যে হাজারো বিষ খেয়ে আমরা বাঁচি (অথবা মরি), মাছে ফর্মালিন কিম্বা দুধে ডিটারজেন্ট নিয়ে কাগজে লেখা বেরোলে একটু আধটু চর্চাও করি ... কিন্তু ধরা যাক, এই শহরে প্রতিদিন হাজার হাজার খাবারের দোকানে বিরিয়ানি তন্দুরি চিকেন টিক্কা অমৃতি জিলিপি সস ও বিবিধ খাদ্যে নির্বিচারে মেশানো হয় যে মেটানিল ইয়োলো ও অন্যান্য রং, যার প্রায় প্রত্যেকটি প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে For industrial use only, যা বেশিরভাগই একটি বা দুটি কোম্পানির, ধরা যাক, ঈশ্বর না করুন, যদি একটি কোম্পানির মালে কোনোভাবে এসে পড়ে তীব্র প্রাণঘাতী রাসায়নিক, এবং একদিন যদি সকালে উঠে আমরা আবিস্কার করি আগের দিন বিরিয়ানি কাবাব রোল অমৃতি কিম্বা চাউমিনে সস খেয়েছিল যে কয়েক হাজার মানুষ...
ঈশ্বর না করুন, কিন্তু সেদিন প্রচণ্ড আতঙ্কে ক্রোধে জেগে উঠে আমরা জানতে পারব সরকারের ফুড অ্যাডাল্টারেশান সংক্রান্ত একটি দপ্তর আছে, অফিসার ইন্সপেক্টার আছে ... যেমন গতকাল দুপুরের পর জানতে পারলাম পুরসভার বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য একটি ফান্ড আছে। মানে থাকার কথা ছিল।
আমরা জেগে উঠব, রেগে উঠব, জবাবদিহি চাইব শাসকের কাছে, বর্তমান কিম্বা পূর্বতন, যদি সেই বিপর্যয়ের টাইমল্যাপ্স দুই শাসকের সময়কাল ব্যেপে হয়। তারপর ক্রমশ আমাদের ক্রোধের ভাষা, ব্যাকুলতার ভাষায় ফিরে আসবে কূট রাজনীতির ভাষা ... “বানারহাট চাবাগানে অনাহারে মৃতের তালিকা প্রকাশ করে বিধানসভায় বাউন্সার ঝাড়লেন বিরোধী দলনেতা!” ... কিম্বা, “বিধান রায় হাসপাতালে মৃত শিশুরা গর্ভে এসেছিল আগের জমানায় – ছক্কা হাঁকালেন মুখ্যমন্ত্রী!” ... ক্রমশ আমাদের রাজনীতির ভাষায় ঢুকে পড়বে ক্রিকেটের ভাষা, ক্রিকেট ধারাভাষ্যে নস্টালজিয়ার ভাষা।
আমাদের যে দাদা আছে, ইডেন আছে, ব্যোমকেশ ফেলুদা আছে, রেনেসাঁস আছে ... আমাদের বেঁচে থাকার সংস্কৃতি না থাক, শিল্পসংস্কৃতি আছে। আমাদের কলকাতা আছে (আহ্ কোলকাতা! গোটা রাজ্যটাই কোলকাতা কেন নয়?), সেখানে ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজে, আমাদের বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় বইমেলা আছে, তা সে হোক না শিক্ষায় রাজ্যের স্থান বারো কিম্বা তেরো ...
আর আমাদের এখানে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কারা যেন একটা মড়া ফেলে রেখে যায় রাস্তায়। পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়, আমার রাস্তার দিকের জানলা বন্ধ করে দিই। দমবন্ধ করে অপেক্ষা করি, কখন এলাকার লুম্পেন মস্তানটা আসবে চোলাইয়ের ঠেক ফেরত, লাশটার পায়ে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে ফেলে আসবে খাল পাড়ের ঝোপে। লাশের সদগতি হবে। তার জন্য অবশ্য গুনাগার দিতে হবে পাঁচ বছর ধরে। তা হোক, বাতাসে পচা দুর্গন্ধটা অন্তত কাটবে কিছুকাল। আমরা আবার জানলা খুলব, গান শুনব, চায়ের পেয়ালা হাতে কাগজ পড়ব, সন্তানকে হাট্টিমাটিমের গল্প শোনাতে শোনাতে ভাত খাইয়ে দেব রবিবার। ভাতের গরাস মুখে তুলে দেবার আগে আড়চোখে দেখে নেব তাতে লাশের চুল কিম্বা মাংসের কুচি লেগে আছে কী না।