"
"আগে বাজারে গ্রাম থেকে বুড়িরা আসত, ডুমুর শাপলা থানকুনি সোনাখড়কে মাছ এইসব নিয়ে। সাকুল্যে হয়তো টাকা পাঁচেকের জিনিস। এখন আর ওদের দেখতে পাও? পাবেনা। পাবে কী করে? পুবে যে বিরাট জলাটা ছিল, ওই ঝোপঝাড় বিল সব হারিয়ে গিয়েছে। অথচ এককালে খাল দিয়ে গঙ্গার সঙ্গে যোগ ছিল। শীতকালে বালিহাঁস আসত। বাজারে পাওয়া যেত তার মাংস। কী সোয়াদ!
বলছিলেন আমাদের মেজকা। পক্ষাঘাতে দেহের বাঁদিকটা অকেজো হয়ে যাওয়ায় তিনি অবশ্য আর বাজারে যেতে পারতেন না। থাকতেন শহরতলীর পূর্বপ্রান্তে একটি পুরোনো সরকারি আবাসনে। অকৃতদার মানুষটি দীর্ঘকাল কমিউনিস্ট পার্টির হোলটাইমার ছিলেন। আমার বাবার কী এক দূরসম্পর্কের ভাই, আমরা মেজকা বলেই ডাকতাম।
ছেলেবেলায় সেইসব বুড়িদের আমিও দেখেছি। বাজারের পিছন দিকে, যেদিকটায় শুঁটকিমাছ আর কচ্ছপের ডিম পাওয়া যেত, সেখানে সার দিয়ে বসত ওরা। দাঁতে কালো মিশি, কারো বা গলায় তুলসির মালা আর কপালে রসকলি, বৃষ্টি আর রোদ থেকে বাঁচতে মাথায় ধরে থাকত বড়ো বড়ো কচুপাতা। ওরা সবাই হারিয়ে গিয়েছে। পুবদিকে বিস্তীর্ণ জলা পতিত অঞ্চলটাই হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে এখন ইটভাঁটা আর মহিষের খাটাল। ধোঁয়ায় কালো আকাশে উঁকি দেয় দূরে নতুন টাউনশিপের গগনচুম্বী রেখা।
সেবার সেপ্টেম্বরে যখন আমাদের অঞ্চল ভাসল, গঙ্গার জল ফুলে উঠে প্রথমে ঢুকে পড়েছিল পুবের ওই জলায়। দুর্ঘটনায় স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষের চেতনায় যেভাবে স্মৃতি ফিরে আসে, যেভাবে ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যকল্প আর ঘটনা খুঁজে নিতে থাকে পুরোনো যোগসূত্র, অনেকটা সেভাবেই হাজামজা খাল, বেদখল বিল, বদ্ধ স্থির জলাগুলো সব জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল, পরস্পরে জুড়ে যেতে লাগল ঝোপঝাড়ে ছাওয়া প্লাবনভূমির ওপর দিয়ে। আর পেছনদিক থেকে, অনেকটা গেরিলা হানার মতো, ঘিরে ফেলল আমাদের পুরোনো শহরতলি।
...
শুক্রবার ট্রান্সফর্মারের মাচায় জল উঠে আসায় আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎসংযোগ কেটে দেওয়া হল। বিকেলের মধ্যে পাড়াটা শুনশান হয়ে পড়ল। একা বাড়ি পাহারা দিচ্ছি আমি। একতলার বারান্দার চার আঙুল নীচে জল। হালকা আসবাবগুলো দোতলায় টেনে তোলা হয়েছে। নীচে দরজা আর মেঝের ফাঁকে খবরের কাগজ পাকিয়ে তার ওপর প্লাস্টিক জড়িয়ে প্যাকিং গুঁজছি আমি। আমার ঘরে যত পুরোনো কাগজ আছে তা দিয়ে এই পাড়ার সব বাড়িতে প্যাকিং দিতে পারি। মা বলেন, একদিন এই পুরোনো কাগজ চাপা পড়ে মারা যাবি তুই। যেদিন ইন্দিরা গান্ধী মারা গেলেন, যেদিন ভারত ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতল, যেদিন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস হল – এইসব, স—ব দিনের কাগজ আছে আমার কাছে। এখন সেগুলো দিয়ে আমি বাথরুমের নর্দমা, রান্নাঘরে নালার মুখ বন্ধ করি।
ওভাবে কি জল আটকানো যাবে? মেজকা শুনে বলেন। জল আর বাতাস, যতটা ডেলিকেট ঠিক ততটাই স্ট্রং। কেমন করে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন তৈরি হয়েছে জানো তো?
কলোরাডো নদী?
রাইট! কিন্তু আমাদের নদীটা কী কান্ড বাঁধিয়েছে বল দিকি?
একটু থেমে কব্জিতে চাপ দিয়ে কাঁধটা খাটের মাথার দিকে চাগিয়ে তোলেন। বাঁ দিকটা পড়ে যাবার পর থেকে মেজকার ডান হাত পেশল হয়ে উঠেছে, টেনিস খেলোয়াড়দের যেমন হয়। চোখ বন্ধ করে থাকেন কয়েক মুহূর্ত, তারপর অনেকটা স্বগতোক্তির ঢঙে বলে চলেন –
কাল রাত্তিরে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। কাগজে কদিন ধরেই পড়ছি গঙ্গা খাত বদলে ফারাক্কাকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়তে পারে। স্বপ্নে দেখলাম সেটাই সত্যি হয়েছে, আর একেবারে শুকিয়ে খটখটে হয়ে গিয়েছে আমাদের এই গঙ্গা। চারিদিকে শুধু বালি আর বালি, আর এদিক ওদিক হেলে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা নৌকো। তার মধ্যে বাস করছে মানুষ, এককালে সিএমডিএ-র পাইপের মধ্যে যেমন দেখা যেত।
আমি ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নটার আঁচ পাবার চেষ্টা করি। ঘরে মোমবাতি জ্বলছে, তার নরম আলোয় মেজকার মুখের একটা পাশ আলোকিত। বাঁদিকের ঠোঁট আর চোয়াল সামান্য বেঁকে গিয়েছে, তোবড়ানো মুখোশের মতো দেখায়। মাথার পেছনে জানলায় একটুকরো আকাশ দেখে যায়। শরতের আশ্চর্য বর্ণময় সূর্যাস্ত হচ্ছে, তার গায়ে চক্রাকারে উড়ছে কাক।
অনেকক্ষণ, যেন প্রায় এক যুগ পরে চোখ খোলেন মেজকা।
আচ্ছা, ধর সত্যিই যদি গঙ্গা খাত বদলায়, যদি ফিডার ক্যানালের জল পুরো শুকিয়ে যায়, এক্সপার্টরা যেমন বলছে আর কি, তাহলে তোমার কি মনে হয় মানুষ মরা গঙ্গার খাতে গিয়ে বাস করতে শুরু করবে?
কেমন আছন্ন শোনায় ওঁর গলার স্বর; এতক্ষণ যে দুঃস্বপ্নের ভেতরে ছিলেন, সেখান থেকে পুরোপুরি ফিরে এসেছেন বলে মনে হয়না।
সেটা তো হতেই পারে মেজকা, আমি বলি। বাগজোলায় টালিনালায় পচা খালের ওপর মাচা বেঁধে যদি মানুষ বছরের পর বছর বাস করতে পারে, তাহলে শুকনো নদীখাতে গিয়ে থাকতে শুরু করবে না কেন?
ঠিক বলেছ! কিন্তু খালগুলো সংস্কারের কি হল বল তো? একটা ঝুপড়িও সরাতে পারল? তিনদিন ধরে একটা শহরের বুকের মধ্যে থই থই করছে জল। ভাবা যায়?
বিক্ষুব্ধ মেজকা। পার্টির ভেতরে বাইরে তাঁর মতো নিস্ক্রিয় হয়ে আসা একদল কর্মীর গায়ে সেঁটে যায় এই তকমাঃ বিক্ষুব্ধ। সেই সময় ওঁর পার্টিতে চালু হয়েছে একটি বুলি – পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও আমাদের কর্তব্য। এই নিয়ে কর্মীসভা হচ্ছে। নেতাদের একাংশ আওড়াতে শুরু করেছে দেং জিয়াও পিং-এর সেই বিখ্যাত উক্তি – বেড়ালের রং সাদা নাকি কালো সেটা দেখা হবে না, যদি সেই বেড়াল ইঁদুর ধরতে পারে! চাঁদ ডুবে যাবার পর ইঁদুর ধরার সেই অদ্ভুত আঁধারে দল ছেড়েছিলেন মেজকা।
নানা কারণে আমার জীবন থেকেও দূরে সরে গিয়েছিলেন তিনি, একটা প্লাবন আমায় ফিরিয়ে দিল তাঁর কাছে। প্লাবনে পুরোনো যোগসূত্র জেগে ওঠে, শুকনো সোঁতা আর খালগুলো জুড়ে যায়, বদ্ধ জলায় প্রাণ ফেরে।
সেইসব বালিহাঁস আর সোনাখড়কে মাছের জন্য আর শোক করে কী হবে? আমি হেসে বলি। পুবের ওই জলাভূমিতে জবরদখল কলোনি হয়েছে কতকাল হল। আপনার পার্টিই বসিয়েছে।
আমার পার্টি?
হ্যাঁ, মানে আপনার ভূতপূর্ব পার্টি। ভূমিসংস্কার করে, যত পতিত নাবাল জমি খাস করে পাট্টা বিলি করেছে কারা?
মেজকা আপত্তিসূচক মাথা নাড়েন।
ওভাবে বোলো না। একটা হিস্টরিক নেসেসিটির সঙ্গে বিষয়টা গুলিয়ে ফেল না। সাতচল্লিশে দেশভাগের পর পাঞ্জাবে সম্পত্তি হস্তান্তর হল, আমাদের এখানে সেসব কিছুই হল না। সেই ইতিহাসটা তুমি হয়তো বইয়ের পাতায় পড়েছ, আমি দেখেছি। প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু আসছে। তারা থাকবে কোথায়? খাবে কী? নেহেরু বিধান রায়কে বললেন – লেট দেম স্টিয়ু ইন দেয়ার ওন জ্যুস! সরকার চোখে ঠুলি এঁটে বসে রইল। অসহায় বাস্তুহারা মানুষগুলোর পাশে রাষ্ট্র এসে দাঁড়ায়নি। কংগ্রেসও না। কমিউনিস্টরা এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষ নিজের উদ্যমে একটা নতুন জীবন গড়েপিটে নিয়েছে। এটা বড়ো কম কথা নয়। তার শরিক হয়েছিল আমাদের পার্টি।
মোমবাতির আলোয় মেজকার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কপালে বিনবিনে ঘাম জমেছে। কয়েক মুহূর্ত থেমে, দম নিয়ে ফের বলে যেতে থাকেন –
একাত্তরে বাংলাদেশ যুদ্ধের পর সেই ইতিহাসটা আবার রিপিট হল। দুর্ভাগা এই রাজ্য! এমনিতেই জমি বাড়ন্ত, ব্যবসাবাণিজ্য সব চলে যেতে শুরু করেছে তখন, কলকারখানাগুলো ধুঁকছে। তার ওপর এসে আছড়ে পড়ল এই বিপুল মানুষের ঢেউ। ফের একটা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে শামিল হওয়া। তারপরে তো ক্ষমতায় এল পার্টি। অপারেশান বর্গা হল। দশটা বছরে ভূমিহীনদের মধ্যে যত পাট্টা বিলি হয়েছে, স্বাধীনতার পর এতগুলো বছরে সারা দেশে আর কোথাও হয়েছে কি? খোঁজ নিয়ে দেখো। যদিও সেটা শেষ কথা নয়। সেটা হতে পারত একটা শুরু। হল না।
কিন্তু মেজকা, ভূমিসংস্কার করতে গিয়ে গ্রামের আসেপাশে সব পতিত নাবাল জলা জংলা জমিগুলোকে খাস করে নেওয়া হল। ওর মধ্যে কিন্তু নদীর প্লাবনভুমিও ছিল, বছরের পর বছর পড়ে থাকত ওড়কলমি শেয়াকুল বনডুমুরের ঝোপঝাড়ে ভরা। সবার জন্য অবারিত - গ্রামের আতুরি বুড়িরা পাতালকোঁড় হিঞ্চে-ব্রাহ্মী-গিমে শাক শাপলা তুলে নিয়ে বাজারে আসত। পুজোপার্বণে গরীবগুর্বো মেয়েবউরা তুলে আনত আকন্দকুঁড়ি ধুতরোর ফুল, দুর্ভিক্ষের সময় গেঁড়িগুগলি। পাঁচ-দশ বছরে একবার বড়োসড় বন্যা হলে জলে ভরে গিয়ে বসতিগুলোকে বাঁচাত, কিন্তু ...
দুর্ভিক্ষ! দুর্ভিক্ষ থেমেছে কি?
বন্ধ চোখের পাতা খুলে অদ্ভুত স্বরে প্রশ্ন করেন মেজকা, যেন এইমাত্র গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠলেন।"