একটি বৃহৎ পরিবারে অনেকটা কনিষ্ঠতম হওয়ার সুবাদে প্রচুর স্বাধীনতা আর ছড়ানো নির্জন এক বাড়িতে বেড়ে উঠেছি আমি। চা ছাড়া অন্য নেশার চল ছিল না সেখানে। তবে কলেজজীবন থেকেই ইতস্তত মদ্যপানে রপ্ত হয়েছি (অবশ্যই নিজের টিউশানির পয়সায়)। আমাদের বাড়ির দোতলাটা ছিল আমার একান্ত সবান্ধব সাম্রাজ্য। একবার কী এক বিরল কারণে আমার মা দোতলায় উঠে একটি শূন্য হুইস্কির বোতল পেয়েছিলেন। রাতে খেতে বসার আগে বাবার আড়ালে ডেকে থমথমে মুখে আমার সরলা পুরনো প্রজন্মের মা বলেছিলেন – “হুইস্কি খাচ্ছিস, এবার দেখব কোনদিন মদও ধরেছিস!”
আমাকে যিনি বিয়ে করেন তাঁর বাড়িতে আবার চায়েরও পাট ছিল না। আমার এই “অফ- অ্যান্ড-অন” মদ্যপানের ব্যাপারে তাঁর একটা অসন্তোষ ছিল বিয়ের আগে থেকেই। সেটা কেটে যায় দার্জিলিঙে গিয়ে, যখন বাড়িওয়ালা নেপালী দাজু ও তাঁর স্ত্রী তরুণ দম্পতিকে নিজের ভাই-ভ্রাতৃবধূর মতো ভালবাসা দিয়ে আপন করে নেন, পরিবারে সামিল করে নেন। ঘরে গুড়াস (রডোডেনড্রন ফুলের মদ)তৈরি হলে, কিম্বা ভালো স্কচ উপহার পেলে ডেকে নিতেন, এবং ওঁদের ছোট ছেলেমেয়ে মা পিসি পরিবৃত হয়ে হাসি আড্ডায় কখন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে যেত রাতে। আমার মেয়েও এই পরিবেশে জন্মায় ও বড় হয়, আমাদের জনাকয় উজ্জ্বল বন্ধু-বন্ধুনিদের উষ্ণ সান্নিধ্যে। মদ সম্পর্কে আলাদা করে কোনও রহস্য তৈরি হয়নি তার মনে। একবার ছেলেবেলায় তার মাতামহকে গ্লাসে লিকার চা পান করতে দেখে সরল প্রশ্ন করেছিল - “দাদু তুমি রাম খাচ্ছ?”
শশুরমশাই বিষম–টিষম খেয়ে একশা।
সপরিবার বন্ধুবান্ধবের খোলামেলা পানভোজনের আসরে কাউকেই তেমন বেচাল হতে দেখিনি কখনও। যে পুরুষেরা মদ খেয়ে বেচাল হয়, বা বলা ভালো বেচাল হবে বলে মদ খায়, তারা সাধারণত পরিবার-বহির্ভূত একান্ত পুরুষ স্পেস খোঁজে। সমাজও মদের দোকানে জেলখানার গারদ বসিয়ে, পানশালায় নারীদের প্রবেশের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ঝুলিয়ে সেই স্পেস করে দেয়।
আমার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একটি মূল্যবান অংশ কেটেছে এইসব স্পেসে, মূলত সস্তা বাংলার ঠেকে। বলাবাহুল্য, আমার সাহিত্যানুরাগের বীজতলা ছিল সেগুলি। এছাড়াও সেখানে এমন সব শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি, যা অন্য কোথাও সম্ভবই ছিল না। তাঁরা বেশিরভাগই স্বাভাবিক সৎ্ সামাজিক সংসারী মানুষ, দায়িত্ববান পিতা ও স্বামী। অনেকেই প্রবীণ।
এতখানি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা করার কারণ একটাই - মদ্যপানে নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে কথাটা বলতে চাইছি, তার সঙ্গে আর যাই হোক কোনো নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব নেই আমার। এবং একটি শিল্পাঞ্চল-কেন্দ্রিক জনপদে বড় হবার সুবাদে মদ্যপানের অভ্যাস কীভাবে বিবিধ সামাজিক ব্যাধি, পুরুষতন্ত্র ও দারিদ্র্যের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে সেটা খুব কাছ থেকে দেখেছি। আইন করে মদ্যপান শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে দিলেই কারখানায় খাদানে শ্রমিক পুরুষেরা তাদের পুরো হপ্তার আয় নিয়ে ঘরে ফিরবে, আর বউ পেটাবে না, আরও সুবোধ এবং উৎপাদনক্ষম হয়ে উঠবে – এইধরণের মোটা সরলীকরণ আজগুবি গল্পের মতোই মনে হয়।
বরং এই সমস্যাগুলো অনেক বেশি ওতপ্রোত দারিদ্র্যজনিত বিচারবোধের জড়তার সঙ্গে (অতিসম্প্রতি অর্থনীতিতে এই নিয়ে কাজও হচ্ছে যতদূর জানি), সক্ষমতা ও বিকল্প জীবনধারার অভাবের সঙ্গে, নিরক্ষরতার সঙ্গে, জীবনের অনিশ্চয়তার সঙ্গে। এইসব অভাব ও অপ্রাপ্তি মানুষকে যেমন লাগামহীন নেশায় ঠেলে, তেমনই ভুয়ো চিটফান্ডেও ঠেলে। আরও কিছু কিছু সামাজিক ও মানসিক ব্যাধিতে ঠেলে। মদকে যত-দোষ–নন্দ-ঘোষ ঠাওরালে সস্তা হাততালি যেমন জোটে, আসল সমস্যা থেকেও চোখ ফিরিয়ে থাকা যায়।
হ্যাঁ, ছত্তিশগড়ে মদ্যপান নিবারণ নিয়ে সফল আন্দোলন করেছিলেন শঙ্কর গুহ নিয়োগী, যেজন্য তাঁর হত্যার পেছনে ভাঁটিখানার মালিকদের হাত ছিল। কিন্তু ওঁর সেই আন্দোলনের নাম ছিল ‘সংঘর্ষ আউর নির্মাণ’ ... নিবারণের পাশাপাশি স্কুল, হাসপাতাল, বিনোদনমঞ্চ ইত্যাদি তৈরিতে ব্রতী ছিলেন তিনি, অর্থাৎ মানুষের সক্ষমতা, বিকল্প জীবনধারার নির্মাণ। আমাদের রাষ্ট্রের জ্যাঠামশাইরা নিষিদ্ধকরণে খুব দড়ো, তা সেই বই হোক বা ফিল্ম। অথবা গোমাংস। তাঁদের নির্মাণ রাষ্ট্র নামক এক গভীর কুয়ো, যেখানে ব্যাঙের চাষ হয়।
মদে আইনি নিষেধাজ্ঞার অবাস্তবতা নিয়ে, তার ফলশ্রুতি প্রাণঘাতী চোলাই মদ নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছে ও হবে। আমার কেবল জানতে ইচ্ছে করে, এর ফলে বিহারের বিস্তীর্ণ আদিবাসী অঞ্চলে কী প্রভাব পড়বে?
বর্তমান ভারতে খাদের কিনারে এসে দাঁড়ানো জনজাতি মানুষের জীবনধারা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হল মদ (এবং মাংস, বিভিন্ন পশুর), যা ঘরে প্রস্তুত হয় বিভিন্ন ধরণের ফুল বীজ ও শস্য থেকে। সেসব প্রস্তুতের ঋতু, পদ্ধতি প্রকরণ ভিন্ন, অ্যালকোহলের মাত্রাও ভিন্ন। জানতে ইচ্ছে করে, এই আইনের ফলে বনবাসী গ্রামগুলোর শান্তি কীভাবে চুরমার হবে আবগারি নাকাদারদের হাতে? বিগত কুড়ি বছরেরও বেশি এমন অসংখ্য গ্রাম দেখেছি, থেকেছি, কাছে যাবার চেষ্টা করেছি ... দুর্লঙ্ঘ্য সামাজিক শ্রেণীগত বাধা ডিঙিয়ে যতটা যাওয়া যায়।
ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘকাল মদ নিষিদ্ধ সম্ভবত গুজরাটে। সেখানকার প্রায় ১৫% আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনধারায় সংস্কৃতিতে এর কী দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, সেই নিয়ে কোনও কাজ হয়েছে কী না জানিনা। তবে ২০০২ সালের দাঙ্গার হিংসালীলায় জনজাতির মানুষদের সামিল করা গিয়েছিল, সেটা জানি।
বিহারে কী হবে কে জানে? হয়তো সরেজমিনে আর জানা হয়ে উঠবে না আমার। সন্ধ্যার পর নিজের ঘরে বসে স্বজন বন্ধুদের মেধাবী সাহচর্যে, কিম্বা একাকী গান শুনতে শুনতে বই পড়তে পড়তে, মানুষ কী করবে কী খাবে, সেটা ঠিক করে দেয় যে রাজ্যের সরকার, সেই রাজ্যে আর যাবার রুচি নেই।
...
নীচে মহুয়া ফুলের ছবিটা গত সপ্তাহে সম্বলপুরের কাছে ডেব্রিগড়ের জঙ্গলে তোলা। এই সময় সারাদিন টুপটাপ ঝরা ফুলে ফুলে বিছিয়ে আছে মাইল মাইল মহুয়ার বন, মাটি দেখা যায় না। স্থানীয় জনজাতির মানুষেরা ঝুড়ি বোঝাই করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে দেখলাম। এই ফুল টনটনে রোদে শুকিয়ে পাতনক্রিয়ায় তৈরি হবে স্বাদু মদ, যার স্থানীয় নাম ইরপি বা মেল।
নিয়মগিরির এক প্রবীণ কন্ধ একবার আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, স্বর্গ কি বল তো? আর নরক? তারপর নিজেই উত্তরটা দিয়েছিলেনঃ
স্বর্গ হল মাইল মাইল মহুয়ার বন, খালি মহুয়ার বন। আর নরক হল মাইল মাইল মহুয়ার বন, খালি মহুয়ার বন, কেবল সেই বনে আছে এক লাঠিধারী ফরেস্টার।
তাঁর কথা মনে পড়ল মধু রামনাথের এই বইটা পড়তে পড়তে –Woodsmoke and Leafcups: Autobiographical Footnotes to the Anthropologyof the Durwa People. আমার মতো শখের পর্যটক সেজে নয়, বস্তারের এক জংলি আদিবাসী গ্রামে তিরিশ বছর কাটিয়েছেন এই উদ্ভিদবিদ লেখক। এখনও সেখানেই থাকেন। তাঁর এই দিনলিপির পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছে ঘরে প্রস্তুত নানান ধরণের মদ ও তার পানের আচারের সঙ্গে কী নিবিড় সম্পৃক্ত দারোয়াদের নিত্যকার জীবনছন্দ। আর ফুটে উঠেছে তাদের এক আশ্চর্য জীবনদর্শন, যা আমার খুব প্রিয় বুদ্ধের একটি বাণী ধার করে নিয়ে বললে –
In the end only three things matter: how much you have loved, how gently you have lived, and how gracefully you have let go of things not meant for you।