প্রকাশিত হল আরো একটি খোলা চিঠি।
-------------------------------------------------------------------
“স্কুলের ঝাঁপ ফেলে ১৯শে কালাদিবস” – আজ, অর্থাৎ ১৭ই সেপ্টেম্বর, আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় শিরোনাম।
সংসদ বাংলা অভিধানে “ঝাঁপ” শব্দের অর্থ – ১। আচ্ছাদন, ঢাকনি; ২। বাঁশ দরমা ইত্যাদির ঝুলানো কপাট (দোকানের ঝাঁপ ফেলা); ৩। তাঁতে টানার সুতোর যে ফাঁকের মধ্যে দিয়ে মাকু চলে।
যে কোনও ধরণের বনধ বা ধর্মঘট সম্পর্কে এই সংবাদ প্রতিষ্ঠানটির ঘোষিত মনোভাব আমরা জানি। বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনও একটি সংগঠনের এই ব্যাপারে ভিন্ন মনোভাব থাকতেই পারে। তার যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনাও চলতে পারে। কিন্তু অ্যাসোসিয়েশান অব ক্রিশ্চান স্কুলস-এর ডাকে রাজ্য জুড়ে কয়েকশো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে প্রতিবাদ জ্ঞাপনের সিদ্ধান্তকে “ঝাঁপ ফেলা” বলা? তাও প্রথম পাতায় সংবাদের শিরোনামে?
প্রতিটি শব্দের কিছু ব্যবহারিক চালু অর্থ আছে, কিছু প্রচ্ছন্ন ইশারাও আছে। এটা সংবাদ পরিবেশনের সঙ্গে যুক্ত মসীজীবীরা ভালই জানেন। অনেক সময় একটি শব্দ তার চালু অর্থকে পাশ কাটিয়ে পাঠকের অবচেতনে ঢুকে একটি ছবি তৈরি করে। বিদ্যালয়ের দরজাকে “ঝাঁপ” বললে তার ইশারা মাথার মধ্যে তাৎক্ষণিক যে ছবিটি তৈরি করে, সেটি একটি অস্থায়ী ঝুপড়ি দোকানের, শিক্ষক শিক্ষিকারাও তখন হয়ে যান দোকানদার। সেই ঝুপড়ি দোকানকে, তার কপট দোকানদারদের ওপর চড়াও হতে জনতাকে লেলিয়ে দিতে বড়জোর আর একটি ইশারার প্রয়োজন হয় মাত্র।
দমদমে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ঘটনার পর সংবাদ মাধ্যমের প্রোৎসাহী ভূমিকায় কয়েকটি সঠিক পদক্ষেপ হয়েছে, ভাঙচুরে যুক্তরা জনসমক্ষে উন্মোচিত হয়েছে, কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছে। ভাল কথা। কিন্তু সন্দেহ হয়, স্কুলটি দমদমে না হয়ে বিষ্ণুপুর কিম্বা দিনহাটায় হলে এই ভূমিকা দেখা যেত কি? বেশ কিছুকাল ধরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে স্কুল কলেজগুলিতে হিংসা ও নৈরাজ্যের ঘটনা ঘটে চলেছে। তার কণামাত্রই সংবাদে প্রকাশ পায়। এই যেমন দিন কয়েক আগে হলদিয়া সরকারি কলেজে ছাত্র বিক্ষোভে মধ্যরাত অবধি অভুক্ত অবস্থায় ঘেরাও হয়ে ছিলেন আমার একদল সহকর্মী বন্ধু। বলা বাহুল্য, সংবাদ মাধ্যমের কৃপা দৃষ্টি লাভ করেনি সেটি। সেই ঘটনার প্রসঙ্গে রাজ্যপালকে লেখা একটি খোলা চিঠি ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন এক সতীর্থ। তাঁর চিঠিতে রয়েছে এক গভীর হতাশার সুর, যা এই সময়ে বাজছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য উপেক্ষিত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকশিক্ষিকার মনে। এই পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যমের আরেকটু সক্রিয় ভূমিকা কাম্য।
আরেকটু দায়িত্ববান ভূমিকাও। বিগত আড়াই দশক ধরে এই রাজ্যে সরকারের ভ্রান্ত নীতি আর ব্যবসায়িক পুঁজির যুগলবন্দীতে সরকারি স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্রমশ পঙ্গু করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রমরমা হয়েছে। বলা বাহুল্য, তাতে পৌরহিত্য করেছে সংবাদমাধ্যমের একাংশ, সমাজের বিপুল অংশের মানুষের মধ্যে এই ব্যাপারে সহমত নির্মাণ করেছে। (তাতে পুরোহিতের ছাঁদার যোগান নিশ্চিত হয়েছে, সেটা বিজ্ঞাপনের পাতায় চোখ রাখলেই টের পাওয়া যায়।) মধ্যবিত্ত তো বটেই, নিম্ন আয়ের মানুষেরাও আজ এক প্রকার বাধ্য হয়েছেন এই বেসরকারি ব্যবস্থার কাছে যেতে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে দানা বেঁধে উঠছে অনিশ্চয়তা, স্নায়ুচাপ, ক্ষোভ।
দমদমে ক্রাইস্ট চার্চ স্কুলের ঘটনা এই জটিল পরিস্থিতির ইঙ্গিতবাহী। যে চা-দোকানি মেয়েকে সরকারি অবৈতনিক স্কুলে না পাঠিয়ে আয়ের সিংহভাগ খরচ করে পাড়ার নামজাদা মিশনারি প্রতিষ্ঠানে পড়তে পাঠাচ্ছেন, আর যে মাংসবিক্রেতা টাকার অভাবে ভাইঝিকে পাঠাতে পারলেন না, যে মধ্যবিত্ত গৃহবধূ স্কুলের দিদিমণির কাছে মেয়েকে টিউশন পড়তে পাঠিয়েছেন “স্পেশাল কোচিং” – এর আশায়, আর যে বস্ত্র ব্যবসায়ী ফি বছর স্কুলে মোটা টাকা ডোনেশান দেন মেয়েকে “স্পেশাল অ্যাটেনশন” -এর লোভে, যে অভিভাবক সেটা দিতে পারেন না, আর যে ছোকরা বিপিও কর্মচারী চোখ শানিয়েছে স্কুল ছুটির পর স্কার্টের নীচে কিশোরী হাঁটু দেখে ... এরা সকলেই ভেতরে এক-একটি কালো চোরা স্রোত পুষে অপেক্ষা করে থাকে, আর একদিন একটি মর্মান্তিক ঘটনা, সেই ঘটনাকে ঘিরে রটনা, এই সব স্রোতগুলোকে মিলিয়ে দেয়। আর সবাই ইটপাটকেল নিয়ে জড়ো হয় দিনভর লাইভ সম্প্রচারিত উন্মত্ত জনগণেশের পুজোয়।
এই উন্মাদ জনগণেশ এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে শক্তিমান দেবতা। সবার আরাধ্য। সংবাদমাধ্যমেরও।