পায়ে কাদা, জংলি চড়াই পথে জজসাহেব চলেছেন পাহাড়ের ওপর। তাঁর আগে পিছে চলেছে বন্দুকধারী কম্যান্ডোবাহিনী। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে, কাদায় পিছল পথ। সকলেরই পরনে রেনকোট, জজসাহেবেরও। তবু তাঁর মাথায় ছাতা ধরে আর্দালি, সাদা উর্দিতে লাল কোমরবন্ধ আঁটা। বর্ষায় সবুজ মরকতমণির মতো হয়ে আছে পাহাড় জঙ্গল। তার ভেতর দিয়ে টকটকে লাল কর্দমময় পথ; মাঝেমাঝেই ছোট ছোট নালা পার হতে হয়। পাহাড়ের ওপরের দিকে দু-দশ ঘরের ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন গ্রাম, মকাই মান্ডিয়ার খেত, কমলালেবু আনারসের বাগান। এমনই একটি গ্রামে চলেছেন জজসাহেব। গ্রামের নাম সিরকাপাদি - ৭ ঘর, ৩৯ মাথা। বেশ বড় গ্রাম বলা যায়।
জজসাহেব হুজুর হাকিম, সদর শহরে বিরাট কাছারিবাড়িতে বসেন। উঁচু মঞ্চে যখন প্রবেশ করেন, উকিল সাক্ষী সব তড়াক করে দাঁড়িয়ে ওঠে, আসামীরা বিড়বিড় করে ইষ্টনাম জপে, পেয়াদা লাঠি ঠুকে হাঁকার দেয় - চোপ্, আদালত চলছে! হুজুর গম্ভীর মুখে বিচার করেন, কাঠের হাতুড়ি ঠুকে বলেন ‘অর্ডার! অর্ডার!’, ফতোয়া দেন, কলমের খোঁচায় দেন ফাঁসি কিম্বা কারাদন্ড। সিরকাপাদির মানুষেরা অবশ্য এসব কখনও দেখেনি। শহরই দেখেনি তারা, কেউ কেউ জীবনে কখনও এই পাহাড় ছেড়ে যায়নি কোথাও। জজসাহেবও কোনোদিন এমন প্রত্যন্ত গ্রাম দেখেননি। পাহাড়ের নীচে লালবাতির গাড়ি ছেড়ে মোটরসাইকেলের পেছনে বসে খানিক দূর, তারপরে এই চড়াই জংলি পথে হাঁটা। এখানে অবশ্য তিনি কোনো ফতোয়া শোনাতে আসেননি; আসছেন ফতোয়া শুনতে। বিচারক চলেছেন বিচার শুনতে, পিছল জংলি পথে হেঁটে, পায়ে কাদা।
পায়ে কাদা, রাষ্ট্র চলেছে দেশের কাছে।
দেশ বলতে হাজার আটেক মানুষ। রাষ্ট্রের খাতায় তারা ডোঙ্গারিয়া কন্ধ, আদিম উপজাতি হিসাবে নথিভুক্ত। পৃথিবীতে কেবলমাত্র এই পাহাড়ের ওপরেই তারা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কিছু ডোম ও গৌড়া সম্প্রদায়ের তফশিলভুক্ত মানুষ। পাহাড়টির নাম নিয়মগিরি, পূর্বঘাট পর্বতমালার অংশ। ওড়িশার কলাহান্ডি আর রায়গাড়ার মতো দুই উষর খরাপ্রবণ জেলার মাঝে বিছিয়ে আছে চিরসবুজ রূপকথার মতো। এই পাহাড়ের মাথা থেকে অসংখ্য ঝর্ণা, দু-দুটি নদী। সেই জলে পুষ্ট হয়ে হাজার হাজার বছর ধরে তৈরি হয়েছে এক আশ্চর্য জীববৈচিত্র্য - অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির গাছপালা লতা ছত্রাক অর্কিড পশুপাখি সরীসৃপ কীটপতঙ্গে বোঝাই নোয়ার জাহাজ। মানুষগুলো এই জীববৈচিত্র্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানকার ফল কন্দ ভেষজ গাছগাছড়া আর ফসল ফলিয়ে জীবনধারণ করে, পাহাড় ও তার প্রকৃতিকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করে। দেবতার নাম নিয়মরাজা।
বছরভর পাহাড়ে জলধারণ করে রাখে যে উর্বর মাটি, তার আকর বক্সাইট, যা থেকে অ্যালুমিনিয়াম হয়। এই বক্সাইটের লোভে একদিন নিয়মগিরিতে এল বহুজাতিক খনি কোম্পানি বেদান্ত। এর পরের কাহিনি অনেকেরই জানা। ওড়িশা সরকারের মদতপুষ্ট বেদান্তর বিরুদ্ধে শুরু হল নিয়মগিরির মানুষের প্রতিরোধ আন্দোলন। বলা যেতে পারে, রাষ্ট্রের সঙ্গে দেশের প্রক্সি লড়াই।
এমন আগেও হয়েছে। এই লড়াইয়ের পরিণতি কী হয় সবারই জানা। আর সেটা জেনেই নিয়মগিরিতে বক্সাইট খাদানের জন্য পরিবেশ দপ্তরের ছাড়পত্র পাবার আগেই পাহাড়ের নীচে লাঞ্জিগড়ে অতিকায় রিফাইনারি ফেঁদে বসল বেদান্ত কোম্পানি। পাহাড়ের গা বেয়ে তুলে দিল কনভেয়ার বেল্টের খাঁচা; পাহাড়ের মাথা খামচে তোলা বক্সাইট গড়গড়িয়ে নেমে সোজা ঢুকে যাবে রিফাইনারির পেটে।
বেদান্তর অনেক টাকা। টাকা দিয়ে রাষ্ট্রের মাথা কেনা যায়, মিডিয়ার মুখ ঢেকে ফেলা যায় বিজ্ঞাপনে। আর গুটিকয় জংলি আনপড় উলুরিঝুলুরি মানুষকে বাগে আনা যাবে না?
কিন্তু হিসেবে একটা ভুল ছিল। নিয়মগিরির মাথায় বক্সাইটের খাদান হলে শুধু যে সেখানকার অনন্যোপম জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে তাই নয়, আস্ত একটি উপজাতি মুছে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে। রাষ্ট্রের খাতায় প্রিমিটিভ ট্রাইবাল গ্রুপ, ডোঙ্গারিয়া কন্ধদের আশ্চর্য সুন্দর জীবনধারা, তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে নাচ গান শিল্প কৃষিশৈলির নকশিকাঁথা শত শত বছর ধরে হয়েছে এই পাহাড়ের জাজিমে। নিয়মগিরির সঙ্গে তাদের সম্পর্কটা জলের সাথে মাছের মতোই।
নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে মানুষ যখন চিৎকার করে ওঠে, যখন সেই চিৎকারে শামিল হয় আরো কিছু মানুষ, তখন তা কখনও, কোনও এক ব্যতিক্রমী মুহূর্তে, বধির রাষ্ট্রের কানেও যে গিয়ে পৌঁছতে পারে সেটা দেখা গেল। নিয়মগিরির মাথায় বক্সাইট খাদানে নিষেধাজ্ঞা জারি করল কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক। প্রত্যাশামতেই বেদান্ত আদালতে গেল। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যা রায় দিল তা অপ্রত্যাশিত এবং অভূতপূর্ব, আক্ষরিক অর্থেই। নিয়মগিরির সঙ্গে সেখানকার অধিবাসীদের ধর্মীয় ভাবাবেগ জড়িত, সুপ্রিম কোর্ট জানাল, তাই খনিটা হবে কী না সেটা ঠিক করবে ওখানকার গ্রামের মানুষ। প্রতিটি গ্রামে গ্রামসভার আয়োজন করবে রাজ্যের পঞ্চায়েত দপ্তর, পরিদর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকবে একজন জেলা স্তরের বিচারপতি।
সেই গ্রামসভায় মানুষের বিচার শুনতেই চলেছেন জজসাহেব, বৃষ্টিভেজা পাহাড়ি পথে চড়াই ভেঙে, পায়ে কাদা। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন দৃশ্য এর আগে কে কবে দেখেছে?
বেদান্তর নুন খেয়ে ওড়িশা সরকার চেষ্টার ত্রুটি করেনি। নিয়মগিরির ওপর একশোটিরও বেশি গ্রাম, কিন্তু গ্রামসভা হচ্ছে মাত্র বারোটি গ্রামে। তবু অনেকদিন ধরে নানারকম চোখরাঙানি শাসানি আর প্রলোভন সত্ত্বেও প্রতিটি গ্রামেই মানুষ সমস্বরে বলেছে - না! খনি চাই না! খনি হলে নিয়মগিরি বাঁচবে না। নিয়মগিরি ছাড়া আমরাও বাঁচব না।
- তোমাদের মন্দির ইটবালি দিয়ে তৈরি, আমাদের মন্দির গাছ লতাপাতা পাথর ঝরণা জন্তু দিয়ে, বলেছে সিরকাপাদি গ্রামের ওঝানি। নিয়মগিরি আমাদের মন্দির।
সিরকাপাদি, কেসরপাদি, তাদিঝোলা, ফুলডুমের, কুনাকাদু, বাটুদি, পালবেরি, ইজুরপা .... এখনও পর্যন্ত নটি গ্রামসভার মানুষ তাদের বিচার জানিয়েছে।
- খনি বানিয়ে আমাদের নিয়মগিরি থেকে সরাবে সরকার কোম্পানি, ইটের খুপরিতে রাখবে, কিন্তু এই জঙ্গলের চিতা ভালুক হরিণ পাখিদের রাখবে কোথায়? বলেছে ইজুরপা গ্রামের সত্তরোর্ধ লাবণ্য কাটা। লাবণ্য ডোম সম্প্রদায়ের।
- আদিবাসী পাইক গৌড়া হরিজন ব্রাহ্মণ, নিয়মগিরি কোনও তফাৎ করে না। সকলেই ঝরণার জল পান করে, গরু চরায় ঘাসজমিতে। বলেছে পালবেরি গ্রামের গাতা মাঝি।
আমরা রেড ইন্ডিয়ান কুলপতি চিফ সিয়্যাটলের সেই বিখ্যাত ভাষণ পড়েছি ইতিহাস বইয়ের পাতায়। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে এক আগ্রাসী রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলেছিল এক মহাদেশ। আর বিগত দু সপ্তাহ ধরে এক প্রতিস্পর্ধী ইতিহাস লেখা হয়ে চলেছে এই দেশেরই বুকের মাঝে অন্য এক দেশে।
নিয়মগিরি সুরক্ষা আন্দোলনের লড়াকু বন্ধুদের মারফৎ এই ইজুরপা সেরকাপাদি ফুলডুমেরের আধোচেনা অচেনা মানুষের কথাগুলো শুনতে শুনতে এক বাঙালির মনে পড়ে যায় কুমুটি মাঝির কথা। নিয়মগিরির চিরসবুজ রূপকথার টানে বছর তিনেক আগে গিয়ে পড়েছিল সে। পাহাড়ের মাথায় খাদানের জন্য চিহ্নিত পবিত্র বনভূমিতে তাকে নিয়ে গিয়েছিলেন আন্দোলনের পুরোধা বর্ষীয়ান কুমুটি মাঝি। টেস্টিং সাইটের গর্ত থেকে লাল মাটি দু হাতে তুলে নিয়ে বলেছিলেন:
- নিয়মগিরি আমাদের দেবতা। এই মাটি তার মাংস। দেখ, নিয়মরাজার রক্তে লাল হয়ে আছে।
শীতের বিকেল। নিয়মগিরির মাথায় ঘাসজমি, লতাগুল্মের ঝোপ, জলা। ধারের দিকে আমলকি অর্জুন পিয়াশালের বন থেকে রোদ সরে এসেছিল, মাটির ভেষজ ভাপ উঠছিল। টি টি করে ডাকতে ডাকতে বনটিয়ার ঝাঁক উড়ে গিয়েছিল মাথার ওপর দিয়ে। সামান্য থেমে কুমুটি মাঝি ফের বলেছিলেন:
-দুনিয়ার সেরা ইঞ্জিনিয়ারেরা বসে এমন একটা জায়গা বানিয়ে দিতে পারবে? এখানে যে জড়িবুটি হয়, তাই খেয়ে আমাদের বাপদাদা পরদাদারা বেঁচেছে, আমরা বাঁচছি, আমাদের ছেলেপুলে নাতিপুতি বাঁচবে। কিন্তুই খাদান হলে? যা বক্সাইট আছে সেটা তুলে ফেলতে নাকি পঁচিশ বছর লাগবে। তারপরে কী হবে? পঁচিশ বছরের জন্য কশো বছর বন্ধক রাখব আমি?
কুমুটি মাঝির গলায় ছিল অনাগত প্রজন্মের ভার। অস্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছিল তাঁর মুখে। পায়ের কাছে গর্তগুলো চেয়েছিল অক্ষিবিহীন কোটরের মতো। বনে কোথাও একটা কাঠঠোকরা ঠক ঠক করে শব্দ করছিল।
আপাতত ভবিষ্যৎ বন্ধক রাখতে হবে না কুমুটি মাঝিদের। তবে, "তারপর তারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিল" - রূপকথার এই শেষ লাইন লেখার সময় আসেনি এখনও। নিয়মগিরি পাহাড়ের নীচে লাঞ্জিগড়ে রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার রিফাইনারি, তার জঠরে খিদে, পাহাড়ের গা বেয়ে কনভেয়ার বেল্ট করিডোর পড়ে আছে অজগরের মতো। ইতিমধ্যে রব উঠেছে:
খনি নাহি তো ফ্যাক্টরি নাহি, বেদান্ত কোম্পানি রহিবা কাঁহি!
গল্প এখনও ফুরোয়নি।