“ ... সকালের যানজটহীন মহানগরের হৃৎকেন্দ্র ছাড়িয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস ধরে বাস ছোটে। পুবদিকে খোপকাটা সবুজ মাঠে নীচু হয়ে কাজ করছে নারীপুরুষ, বহুদূরে জঞ্জালের টিলার নীচে আবর্জনা খালাস করছে ডাম্পার ট্রাক, পিঁপড়ের মতো ছায়াবালকের দল, আকাশে চক্কর দিচ্ছে কাক চিল - মার্চের সকালের পাতলা কুয়াশামাখা আলোয় টার্নারের আঁকা ছবির মতো দীপ্যমান হয়ে আছে সবকিছু।
জানো অপু, এককালে এখানে রেলের লাইন পাতা ছিল। প্রতিদিন একটা ছোট্ট রেলগাড়ি কু ঝিক ঝিক করে এখানে আসত গোটা শহরের আবর্জনা বয়ে নিয়ে। আন্তর্জাতিক বাস্তুতন্ত্রের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে এই জলাভূমি, তবে তোমার স্বপ্নের কলকাতার ভ্রমণসূচিতে ছিল না চিড়িয়াখানা জাদুঘর কিংবা বায়স্কোপের মতো। যদি সেইসময় কখনো তুমি এখানে আসতে, তাহলে হয়তো দেখতে পেতে সেই কুঝিকঝিক রেলগাড়ির পেছনে ছুটছে অপু দুর্গার দল। এখনও তারা ছোটে, ডাম্পার ট্রাকের পিছু পিছু। জঞ্জালের পাহাড় থেকে কাচ প্লাস্টিক ধাতু কুড়িয়ে নেয় ওরা, তারপর সেই জঞ্জাল থেকে হয় জৈব সার। এছাড়া শহরবাসীর তরল বর্জ্য জমা হয় পুকুরে। পুকুর থেকে পুকুরে পরিস্রুত হতে হতে ময়লা কালো জল ক্রমশ স্বচ্ছ সুপেয় হয়ে ওঠে। আর এই ক্লেদ থেকে টন টন পুষ্টিকর মাছ আর সবজি ফলিয়ে শহরকে দুহাতে ফিরিয়ে দেয় কয়েক হাজার মানুষ, দেয় অক্সিজেন। এ এক অনন্যোপম বাস্তুতন্ত্র, যার জুড়ি বিশ্বে আর কোনো শহরে নেই। এক আশ্চর্য বিজ্ঞান, এই নিরক্ষর মানুষগুলোর হাতে সৃষ্টি, যা ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে নেই, আড়বেলিয়ার হেডমাস্টারমশাইয়ের আলমারিতেও নেই।“
ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে নেই, তাহলে উদ্ধৃতির লেখক চরিত্র কোথা থেকে জানল এর কথা?
আজও ই এম বাইপাস দিয়ে যাবার সময় অপুর সেই বিখ্যাত বিস্ময় পেড়ে ফেলে আমায়। এমন নাটকীয় দৃশ্যপট কলকাতা শহরে আর কোথায়ই বা আছে? একদিকে আকাশছোঁয়া ইমারতের সারি, আরেকদিকে ধু ধু সব্জির আবাদ, টোকা মাথায় চাষি, জল, রাতপাহারার মাচা। এ যেন ঠিক বাস্তব নয়, এক মেটাফোরের চিত্ররূপ, পরাবাস্তব শিল্পীর আঁকা – সনাতন গ্রামসভ্যতা গিলে নিতে ধেয়ে এসেছে দৈত্যাকার নগরায়ন, একটি বাঁধের মতো রাস্তার ধারে এসে থমকে রয়েছে। কোথাও কোথাও রাস্তা টপকে ছড়িয়ে গিয়েছে ওপারে, ইস্পাত কংক্রিটের দাঁত কড়মড় কড়মড় করে চিবোচ্ছে ভুট্টার খেত, মাছের পুকুর।
বছর পঁচিশ আগেও ছবিটা এত পরাবাস্তব ছিল না। জঞ্জালের উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো রাস্তা থেকে দেখা যেত হাতের কাছেই, কুড়ুনি বালকেরা, পরমা মোড়ের কাছে বাতাসে তীব্র দুর্গন্ধ নেমে আসত মশারির মতো। লোকে নাকে রুমাল চাপা দিত, গাড়ির কাচ তুলে দিত। এখনও অনেকেই দেয়, অভ্যাসবশে। তারও কিছুকাল আগে থেকে এই আশ্চর্য অঞ্চল ও তার মানুষগুলোর কথা জেনে আসছি একজন ভদ্রলোকের লেখা থেকে। আমি তখন ছাত্র, যদিও বিজ্ঞানের নয়। আমাকে টেনেছিল ঔপনিবেশিক মহানগরের এই তলপেট ও তার বর্জ্য ক্লেদ থেকে খাদ্য ফলানো একদল কুশলী মানুষের দেশজ বিজ্ঞানের কাহিনি। যেখানেই তাঁর লেখা দেখতে পেয়েছি, গোগ্রাসে পড়ে ফেলেছি। এভাবেই অনুষ্টুপ পত্রিকায় তাঁর একটি লেখা থেকে জেনেছিলাম এই ধাপা মানপুর মৌজার একটি গ্রামের কথা, যেখানকার অভাবতাড়িত মানুষ রাতের বেলা চুরি করতে বেরোয়। তবু বিশ হাজার মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয় এখানে। তাঁর লেখা পড়েই জেনেছি, এখানকার জঞ্জাল ঘেঁটে বত্রিশ রকমের সামগ্রী পাওয়া যায়, যা এক বিস্তৃত রিসাইক্লিং শিল্পের কাঁচামাল। এমন আরও অনেক বিচিত্র রোমাঞ্চকর সব তথ্য।
আমরা বাঙালি, সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের বড় বড়াই। কিন্তু সংস্কৃতি বলতে আমরা শুধুই বুঝি সাহিত্য সিনেমা আর গান। নিত্য বেঁচে থাকার সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। তাই শহরের পিঠের দিকে এই যে আশ্চর্য অঞ্চল, তা ঢেকে যাচ্ছে বিস্মৃতির কংক্রিটে। বিগত প্রায় চার দশক ধরে এই অঞ্চলের যিনি নিরলস ভাষ্যকার, তিনিও তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি। যদিও যতদূর জানি জাতিসঙ্ঘের বিরল খেতাব তিনি পেয়েছেন, তাঁকে নিয়ে গার্ডিয়ান পত্রিকায় লেখা বেরোয়, কিন্তু এই শহর তাঁকে যোগ্য সম্মান দিয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই।
অবশ্য তাতে তাঁর কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। কারণ তিনি নিশ্চিতভাবেই জানেন, আজ থেকে কয়েক দশক পরে যখন পূর্ব কলকাতার এই জলাভুমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, যখন এই শহরটাও আর বাসযোগ্য থাকবেনা, তখন ঠাঁইনাড়া মানুষ তাঁর লেখা পড়ে জানবে এই আশ্চর্য বাস্তুতন্ত্রের কাহিনি। এও এক সত্যি রূপকথা।
সত্যিই কি তাই হবে? সত্যিই কি আন্তর্জাতিক রামসর স্বীকৃতি পাওয়া এই জলাভূমি সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে?
আমি জানি না। আমি কেবল স্বপ্ন দেখতে পারি।
আমি স্বপ্ন দেখি, তাঁকে মাথায় রেখে গড়ে উঠেছে একটি আন্তর্জাতিক মানের ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট, যেখানে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নিয়ে হাতেকলমে গবেষণা করছে ছাত্রছাত্রীরা। দেশ বিদেশের বিভিন্ন শহর থেকে প্রতিনিধি দল আসছে এই মডেল রূপায়ণের জন্য। রাজ্যের নানান প্রান্ত থেকে স্কুলের ছেলেমেয়েরা আসছে শিক্ষামূলক ভ্রমণে ।
আমি স্বপ্ন দেখি, এই জলাভূমি মুক্ত রাখার জন্য এক বিশাল মিছিল, যাতে পা মিলিয়েছে সেই তরুণ প্রজন্ম যারা সেদিন ক্যাম্পাস মুক্ত রাখার জন্য পথে নেমেছিল।
এবারের বইমেলার থিম কান্ট্রি হয়েছে রাস্তার অন্য পারে পূর্বকলকাতার জলাভূমি, আমি স্বপ্ন দেখি, বিশাল মাল্টিমিডিয়া প্যাভিলিয়ান। হাতুড়ি ঠুকে মেলার উদ্বোধন করছেন জলাভূমির একনিষ্ঠ ভাষ্যকার।
কলকাতার নতুন লোগোয় হাওড়া ব্রিজ, ভিক্টোরিয়া আর শহিদ মিনারের বদলে এখন থেকে জলজমিনের ছবি।
আমি স্বপ্ন দেখি, সামনের বছর সেরার সেরা বাঙালি পুরস্কার পাচ্ছে ধাপা মৌজার কৃষি ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায়। বাইপাসের ট্রাফিক থামিয়ে দিয়েছে পুলিশ, যাতে মানুষগুলো নির্বিঘ্নে পায়ে হেঁটে সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে আসতে পারেন। আলোঝলমল প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চে সারি দিয়ে উঠছে অতজন নারী পুরুষ। নীচে দর্শকাসনে সুবেশ সুধীজনেদের হাত অনবধানে চলে যায় সুগন্ধি রুমালে। পরক্ষণেই জিভ কেটে তালি পড়ে হাতে।
জানি এসবই বেচাল স্বপ্ন, খোয়াবনামা। এসবের জন্য দায়ী যে মানুষটি, তাঁর নাম ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, কিন্তু আশা রাখি তিনি এই বাচালতা মার্জনা করবেন।
-----------------------------------------------
*ওপরের উদ্ধৃতিটি লেখকের সাম্প্রতিক বই ‘অপুর দেশঃ একটি আত্মকাহিনি’ থেকে।