বারাসাতের কামদুনি গ্রামটিতে গণধর্ষণ আর হত্যা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর, কলকাতার কিছু রাজনৈতিক কর্মী, আর অন্যান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের আন্দোলনের সংহতিতে গ্রামটিতে গিয়েছিলাম গত ১৬ জুন। মমতার কামদুনি সফরের ঠিক একদিন আগে। নিচের লেখায় তারই একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ ধরা থাকলঃ
আমি এর আগে কোন ধর্ষিতার পরিবারের মুখোমুখি হইনি। তাই যখন মধ্যমগ্রাম স্টেশন থেকে ‘ম্যাজিক’ করে আমরা রওনা দিলাম কামদুনি গ্রামের দিকে, ঠিক তখন আমার মনে হল — ঠিক কী বলব সেই মেয়েটির বাবার কিংবা ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে, যে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলার আগে দুই পায়ের উরু ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে ঠিক ৯ দিন আগে? যে কোন কথা, এমনকি সহানুভূতির কথাও কি অতিরিক্ত হয়ে যাবে না সেখানে? কিম্বা সেইসব গ্রামবাসীদের কাছেই বা আমরা কতটা গ্রহণীয় হব, যাদের চেনা মেয়েটি, যার সঙ্গে তাদের অনেকে বড় হয়ে উঠেছে, একসঙ্গে খেলা করেছে, গল্প করেছে প্রাণ খুলে, এক একদিন কিংবা হয়তো একটু অভিমানী ঝগড়াও, সে একদিন ফিরে এলো বস্তাবন্দী লাশ হয়ে? এরকম ভাবতে ভাবতেই পৌছলাম কামদুনি গ্রামটাতে।
কোনো কারণে গ্রামটা তখন সাংবাদিক আর মিডিয়া ভ্যানএ ভর্তি ছিল না। প্রাক্তন ও বর্তমান শাসকদলের রাজনৈতিক নেতানেত্রীর ভিড় ছিল না, যে নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধেই আছে সরাসরি যৌন হেনস্থা কিংবা নারী নির্যাতন করার কিংবা তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ। আশ্চর্য ভাবেই সেদিন গ্রামটা ছিল তুলনায় নিশ্চুপ। ছিলেন দু’একজন সাংবাদিক আর কলকাতা থেকে দেখা করতে আসা নাট্যকর্মীদের একটি ছোট দল।
আরো নিশ্চুপ ছিল মেয়েটির বাড়ি। বাবা এলেন দেখা করতে, ভায়েরাও, সবারই চোখ মুখে এক ধরনের বিহ্বলভাব। ‘শোকে পাথর হয়ে যাওয়া’, ক্লিশে হয়ে যাওয়া এই বাংলা বাক্যবন্ধের মানে যেন আরও খানিকটা স্পষ্ট করে বুঝতে পারলাম। সেই মুহূর্তে খুব বেশি কিছু বলার ছিল না। প্রথামাফিক সমবেদনা জানানোও হলো। সামান্য দুচার কথাও বলা হলো। তারপর আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম সবাই...
কিন্তু কামদুনি তো শুধু শোকের, শুধু যন্ত্রণার নাম নয়, আজ কামদুনি মানে প্রতিবাদ, কামদুনি মানে রাষ্ট্রের গালে একটা বড় থাপ্পড়। গোটা সমাজ জুড়ে চলতে থাকা (বাড়তে থাকা?) যৌন-হিংসার প্রবণতার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ না নিয়ে, বরং সুযোগ পেলে ধর্ষণ আর যৌন-হিংসার মাধ্যমে মানুষের প্রতিবাদের টুঁটি টিপে ধরতে চায় যে রাষ্ট্র— সেই ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দিতে চায় চাকরি আর টাকার প্রলোভন দেখিয়ে। ব্যবস্থাটার জন্য ওটাই একমাত্র “ড্যামেজ কন্ট্রোল মেকানিজম”।আর তাই কামদুনির মানুষদের ক্ষোভের স্বতস্ফূর্ত বিস্ফোরণটা এতো গুরুত্বপূর্ণ। ঐ মুহূর্তটায় তারা একটা জোরালো ‘না’ বলেছেন টাকার থলেকে, রিফিউজ করেছেন রাষ্ট্রের প্রলেপ লাগানোর কৌশলকে। তার কিছুটা পরিচয় পেলাম গ্রামের বাকিদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে। তাদের কারো সঙ্গে কথা হলো বাড়ির উঠোনে, কারো সঙ্গে কলতলায়, ক্লাবের সামনে, রাস্তার মোড়-এ, যেসব জায়গার কোথাও কোথাও হয়তো সেই মেয়েটির স্পর্শ আজো লেগে আছে। সেই সংলাপেরই কিছু টুকরো এরকম—
“এ আজকের ঘটনা নয় , অনেক দিন ধরেই চলছে”
“এই রাস্তায় কোন গাড়ি চলেনা , স্কুলে পড়তে গেলে বাচ্চাদের কম করে আধ ঘন্টা হেঁটে যেতে হয়”
“রাস্তায় আলো নেই অনেক জায়গায়, আলো চাই”
“মেয়েরা তো স্কুল কলেজে যেতে ভয় পাচ্ছে, এরকম চললে তো মেয়েদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে”
“আমরা শেষ দেখে ছাড়ব, টাকা-চাকরি কিছুই নিইনি, নেবও না”
“দিদি যদি আসে তাহলে তাঁকে অনেক কথা শুনতে হবে”
“যেখানে হয়েছে ঘটনাটা সেখানকার পাঁচিলটা ভেঙ্গে দিতে হবে, জায়গাটা সমাজবিরোধীদের আড্ডা, সরকার না ভাঙ্গলে আমরাই ভেঙ্গে দেবো”
“এরকম ঘটনা কিন্তু আগেই ঘটেছে, এ পাড়ারই একজন বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করে দুষ্কৃতিরা, কিন্তু ২০০০টাকা পেয়ে তিনি আর পুলিশে অভিযোগ জানাননি। কিন্তু আর এরকম হবে না”
“আমরা ১৮ তারিখ পর্যন্ত সময় দিয়েছি, তারপর যা করার করবো”
“আমরা চাই আন্দোলনটা ছড়িয়ে পড়ুক সব জায়গায়, আপনারা যদি কলকাতায় কিছু করেন আমাদের ডাকবেন আমরা সবাই মিলে যাবো”
আবার এর মাঝেই শোনা গেল একটু অন্য স্বরও যেটা বেশ চিন্তার বিষয়
“আমরা চারিদিক থেকে ঘিরে বসে আছি, অন্য ধর্মের লোকেরা সীমান্ত পেরিয়ে আসছে, তাদের হাতে আক্রান্ত আমাদের মা বোনেরা”
যখন জিগ্গেস করা হলো কেন মনে হচ্ছে এই কথা, উত্তরে শোনা গেলো আবার একই কথার পুনরাবৃত্তি—
“আমরা চারিদিক থেকে ঘিরে বসে আছি, অন্য ধর্মের লোকেরা.........”
চোখমুখ দেখেও বোঝা গেলো কথাগুলো মুখস্ত করানো হয়েছে , এখনো আত্মস্থ হয়েনি ........
পরিচিত লোকেদের কাছ থেকে শোনা গেল হিন্দু সংহতি মঞ্চ দুদিন আগেই একটা সভা করেছে বারাসাতে , গ্রামে ঢুকে নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছে, প্রচারপত্র বিলি চলছে, পোস্টারও মেরেছে।
এ এক ভয়াবহ বিপদ, যে স্পর্ধায় কামদুনির মানুষ ক্ষতিপূরণের টাকা অস্বীকার করেছে, সেই সাহসেই, আন্দোলনের পক্ষে বিপদজনক এই প্রবনতার বিরুদ্ধেও লড়বেন আশা করা যায়।
সবার শেষে একটা মিছিল বেরোলো। মিছিলটা শুরু হলো জনা চল্লিশ আমাদের মতো “বহিরাগত” মানুষ নিয়ে, আর শেষ হলো শ’দেড়েক মানুষের মিলিত ক্রোধ, শোক আর প্রতিবাদে। মিছিলের ভেতরে থাকা গ্রামের মানুষরা ডাক দিয়ে, হাত ধরে ডেকে নিয়ে এলেন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্য গ্রামবাসীকে— “আরে এই মিছিলে তো আসতেই হবে”। এও একটা অন্য মিছিলের অভিজ্ঞতা।
ফিরে আসার সময় একটা কথা মনে হচ্ছিলো। আমরা কজন বহিরাগত যদি আজ থেকে দুমাস আগে কামদুনি গ্রামে গিয়ে একটা মিছিল করতাম তাহলে কী হত? তাও আবার ধর্ষণের মতো একটা স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে? একটা ঘটনা, তার প্রতিবাদ, আন্দোলন কতটা পরিবর্তন করে দিতে পারে দৃশ্যপট? কীভাবে একজন হতদরিদ্র বাবা চাকরি আর ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব অস্বীকার করে রাষ্ট্রের গালে সপাটে থাপ্পড় কষান? কী করে পান এই স্পর্ধা? কী করে স্পর্ধা পান কামদুনি গ্রামের সাধারণ বাসিন্দারা ক্ষমতার রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, হয়তো সাময়িকভাবে হলেও? নিশ্চই তার একাধিক কারণ আছে। কিন্তু আমার মনে হলো দিল্লির দামিনীর ঘটনাটি আর তার পর দেশ জোড়া প্রতিবাদও কি তার একটা কারণ নয়? আর এইভাবেই কি দিল্লির দামিনী আর কামদুনির অপরাজিতা, মৃত্যুর পরে হলেও, একে অপরের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা পড়ে যান?
আমাদের কামদুনি সফরের কিছু ছবি --
সঙ্গে রইল আমাদের কামদুনি সফরকে ঘিরে তোলা একটা ছোট্ট ভিডিও --
http://www.youtube.com/