এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ধর্ম, মৌলবাদ ও আমাদের ভবিষ্যৎ : কিছু যুক্তিবাদী চর্চা

    Debasis Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৬০৪৪০ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • ইসলাম সম্পর্কে আলাদা করে দু-চার কথা

    মৌলবাদ নিয়ে এই ধরনের একটা লেখায় যদি কেউ ঘোষণা করেন যে, এইবার ইসলাম নিয়ে আলাদা করে কিছু বলা হবে, তখন পাঠকের সে নিয়ে একটা প্রত্যাশা তৈরি হতে পারে। কাজেই, এখানে গোড়াতেই সে ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে বলে রাখা দরকার, না হলে পাঠক হয়ত বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ হবেন। সম্ভাব্য প্রত্যাশাটি এই রকম যে, মৌলবাদের স্বরূপ নিয়ে যখন চর্চা হচ্ছে, এবং তার মধ্যেই আলাদা করে ইসলাম নিয়ে চর্চার ঘোষণা হচ্ছে, তখন নিশ্চয়ই দেশে দেশে ইসলামীয় মৌলবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যাবে এখানে, বিভিন্ন স্থান-কালে তার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ বিশেষ বৈচিত্র্যের উল্লেখ পাওয়া যাবে, এবং অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদের সঙ্গে তার মিল ও অমিল এবং তার কার্যকারণ ইত্যাদি বিষয়ক অনুসন্ধান ও তার ফলাফলও পাওয়া যাবে। হ্যাঁ, এখানে তা করতে পারলে ভালই হত, কিন্তু তার উপায় নেই। সেটা করতে গেলে আগে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধর্মের মৌলবাদের কার্যকলাপ নিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত আলোচনা সেরে রাখতে হত, তবেই তার প্রেক্ষিতে ইসলামীয় মৌলবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারত। দুঃখের বিষয়, সে পরিসর এখানে ছিল না, এখানে তো এতক্ষণ মৌলবাদ নিয়ে শুধু কতকগুলো অতি সাধারণ কথাই বলেছি। বলে রাখা দরকার, এখানে আমি সরাসরি সেইসব নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব না, যদিও যা আসলে বলব তার মধ্যে এ বিষয়ে আমার মতামত ও চিন্তাভাবনারও কিছু ইঙ্গিত হয়ত মিলবে। এখানে আমি মূলত কথা বলব ইসলাম ধর্ম ও সংশ্লিষ্ট মৌলবাদ প্রসঙ্গে আমাদের সমাজের মূলস্রোত ধ্যানধারণা নিয়ে, এবং তার ঠিক-বেঠিক নিয়েও। এ নিয়ে কথা বলব কারণ, আমার ধারণা, ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে যাঁরা ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লড়তে চান, তাঁদের এ বিষয়টি এড়িয়ে যাবার কোনও উপায় নেই।
     
    ওপরে বলেছি, যাঁরা ধার্মিক নন বরঞ্চ ‘ধর্ম’ জিনিসটার সমালোচক, তাঁদের মধ্যে ইসলাম নিয়ে দু রকমের ভাবনা বেশ পরিচিত। অনেকে মনে করেন, এই ‘মৌলবাদ’ সংক্রান্ত সমস্যাটা আসলে শুধুই ইসলামের সমস্যা, আর কারুরই নয় --- ধর্মের নামে ফতোয়াবাজি আর মারদাঙ্গা মূলত মুসলমানেরাই করছে। অন্যদের যদি আদৌ কিছু সমস্যা থেকেও থাকে, তো সেটা শুধু ইসলামি জঙ্গিপনার প্রতিক্রিয়া মাত্র। আবার, এ অবস্থানটি অন্য অনেকের দুশ্চিন্তারও কারণ। ইসলামি জঙ্গিপনার বিপদ স্বীকার করেও তাঁরা মনে করেন যে, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নির্দোষ ও নিরীহ আম মুসলমানের ঢালাও খলনায়কীকরণ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ছড়ানো হচ্ছে ঘৃণা বিদ্বেষ ও হিংস্রতা। প্রথম ভাবনাটি ভুল, কেন তার কিছু ব্যাখ্যা নিচে আছে।
     
    আর ওই দ্বিতীয় প্রকারের যে দুশ্চিন্তা, আমি এবং আমার মত অনেকেই যার শরিক, তার এক প্রতিনিধি-স্থানীয় দৃষ্টান্ত আমার হাতে এসেছে কয়েকদিন আগে, আমার এক তরুণ বন্ধুর সাথে ফেসবুকীয় কথোপকথনে। তিনি কে, সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক না, কিন্তু তিনি আমাকে যে সব প্রশ্ন করেছেন তা বোধহয় অতিশয় প্রাসঙ্গিক। এখানে সেগুলো হুবহু উদ্ধৃত করলে হয়ত আমাদের আলোচ্য প্রশ্নগুলোকে সুনির্দিষ্ট আকার দিতে সুবিধে হবে। অবশ্য, এখানে উদ্ধৃত প্রত্যেকটি প্রশ্নগুলোর সুনির্দিষ্ট ও নিষ্পত্তিমূলক উত্তর দেওয়া এ লেখার উদ্দেশ্য ততটা নয়, যতটা হল মূল প্রশ্নগুলোকে চিহ্নিত করার মাধ্যমে সমস্যাটাকে আরেকটু স্পষ্ট করে তোলা। নিচে রইল সেই তরুণ বন্ধুর দুশ্চিন্তা-জারিত প্রশ্নগুলো।
     
    দাদা,

    একটা বিষয় একটু বিস্তারিত জানতে চাই আপনার কাছে। আপনি যদি সময় করে একটু ডিটেইলসে উত্তর দেন, খুব উপকৃত হই। অনেকদিনই এটা আপনাকে জিজ্ঞেস করব করব ভেবেছি, কিন্তু করা হয়নি, কারণ বিষয়টা একটু সেন্সেটিভ, আর প্রশ্নটা একটু বিস্তারে করতে হবে।

    ছোটবেলা থেকেই (ক্লাস ওয়ান থেকে) আমি দেখে এসছি, আমার পরিমণ্ডলে শুধুমাত্র ধর্মে মুসলিম হওয়ার জন্য মানুষকে সন্দেহের চোখে, বিদ্বেষের চোখে দেখা হয়। ক্রিকেটে পাকিস্তান জিতলে "কীরে, খুব আনন্দ বল!" বলে টন্ট কাটা হয়, কেবল নাম দেখে বাড়িভাড়া দিতে অস্বীকার করা হয়, এমনকি মুসলিম ছাত্র ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করলেও "আশ্রম থেকে শেষে মুসলিম ফার্স্ট হবে" এরকম কথা খোদ টিচারের মুখেই শুনেছিআমি ঘটনাক্রমে মুসলিম পরিবারে জন্মাইনি, কিন্তু একদম ছোটবেলা থেকেই আমার মুসলিম বন্ধু বা প্রতিবেশীদের এভাবে সামাজিক হেট ক্যাম্পেনিং এর মুখে পড়াটা ভীষণ দুঃখজনক লাগে। এই খারাপ লাগাটা ক্লাস ওয়ান থেকেই শুরু হয়েছিল, তো তখন তো আমি ধর্ম ভাল না খারাপ, যুক্তিবাদ ভাল না খারাপ, এতকিছু তো বুঝতাম না।

    এখন মুসলিমবিদ্বেষকে যারা জাস্টিফাই করে, তাদের থেকে যে যুক্তিগুলো উঠে আসে, সেগুলো -

    ১) আর কোন ধর্মে আইসিস, তালিবান, বোকোহারামের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আছে?

    ২) "ওরা" (মুসলিমরা) সংখ্যায় বাড়লেই ইসলামিক রাষ্ট্র চায়, সংখ্যায় কমলেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চায়।

    ৩) সব ধর্মে সংস্কার হয়েছে, কিন্তু "ওরা" এখনও মধ্যযুগেই পড়ে আছে।

    ৪) সব ধর্মেই বহুবিবাহ বন্ধ হয়েছে, কিন্তু "ওদের ধর্মে" বহুবিবাহ আজও জায়েজ, ওদের ধর্মে নারীর অবস্থা সবচাইতে খারাপ।

    ৫) "ওরা" নিজেদের বাঙালি মনে করে না, মননে চিন্তনে আরব, ওদের কাছে ধর্মই সব।

    ৬) ধর্মের নামে মানুষ হত্যা "ওদের ধর্মের মত কোন ধর্মই করেনি।"

    ৭) "ওদের" বাড়াবাড়ির জন্যই বিজেপির মত দলের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ, হিন্দু মৌলবাদ ইসলামিক মৌলবাদের প্রতিক্রিয়ার ফসল।

    ইত্যাদি ইত্যাদি। আপাতত এই কটাই মনে পড়ছে।

    এখন আমার প্রশ্ন

    ১) মুসলিমবিদ্বেষীদের এই দাবিগুলো কি তথ্যগতভাবে সত্যি?

    ২) সত্যিই কি ইসলাম আর পাঁচটা ধর্মের থেকে ব্যতিক্রমী ভায়োলেন্ট? এখন তো যুক্তি, তথ্য, পরিসংখ্যানের বিভিন্ন মেথডলজি দিয়ে অনেক বিষয় কম্পারেটিভ স্টাডি করা যায়। "ইসলাম অন্য পাঁচটা ধর্মের থেকে ভায়োলেন্ট" - এই বিষয়টা কি যুক্তি, তথ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যায়? মানে আমার প্রশ্ন, দাবিটার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু?

    ৩) ধরে নিলাম, ইসলাম সবচাইতে ভায়োলেন্ট ধর্ম। কিন্তু তাতে করেই কি মুসলিমবিদ্বেষ জায়েজ হয়ে যায়?

    ৪) একজন নাস্তিক হিসাবে মুসলিম সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার হরণ করা হলে তার প্রতিবাদ করা কি অন্যায়?

    ৫) হিন্দু মৌলবাদ কি সত্যিই ইসলামিক মৌলবাদের প্রতিক্রিয়ার ফসল? ইসলামিক মৌলবাদ না থাকলে সত্যিই কি হিন্দু মৌলবাদ বলে কিছু থাকত না?

    ৬) আইসিস বা তালিবানের মত মুসলিম লিগ বা বর্তমানে মিমকে কি মৌলবাদী বলা যায়? নাকি "সাম্প্রদায়িক, কিন্তু মৌলবাদী নয়"-এমনটা বলা উচিত?

    আমার প্রশ্ন করার মূল কারণটা কিন্তু কোনভাবেই ইসলামকে ডিফেন্ড করা বা তার ভয়াবহতাকে লঘু করা নয়। আমিও ধর্মহীন সমাজের স্বপ্ন দেখি, সব ধর্মের মত ইসলামের অবসানও আশা করি।

    কিন্তু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত স্তরে ইসলামের সমালোচনাটা যেভাবে হয়, তার টোনটা ঠিক যুক্তিবাদের নয়, টোনটা বিদ্বেষের। এখন রিলিজিয়াস ক্রিটিসিজমকে ঢাল করে বুঝে বা না বুঝে অনেক প্রগতিশীল মানুষও বিদ্বেষের টোন ব্যবহার করছেন। এটা খুব আশঙ্কার।

    এখন, এই প্রশ্নগুলোর প্রত্যেকটাকে আলাদা করে উত্তর দেবার চেষ্টা না করে বরং এ প্রসঙ্গে কতকগুলো সাধারণ কথা ভেবেচিন্তে দেখি। তাতে করে সমাধান না আসুক, অন্তত সমস্যাটার চেহারাটা আরেকটু স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে পারে কিনা, দেখা যাক। হতে পারে, ভাবতে গিয়ে হয়ত ওপরের দু-একটা প্রশ্ন শেষতক বাদই পড়ে গেল, বা উল্টোভাবে, যে প্রশ্ন এখানে নেই তেমন কিছু এসে কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল।

    প্রথমেই বলা দরকার, অনেকে আধুনিক মৌলবাদী উত্থানকে মুসলমান জঙ্গি উত্থানের সঙ্গে এক করে দেখেন, যা মোটেই সঠিক নয়। বর্তমান পৃথিবীর প্রধান ধর্মীয় ধারাগুলোর সবকটির মধ্যেই মৌলবাদী উত্থান ঘটেছে, বিভিন্ন মাত্রা, ভঙ্গী ও ধরনে। আমেরিকায় খ্রিস্টান মৌলবাদীদের কথা আমরা জানি, জানি ইসরায়েলের ইহুদী মৌলবাদীদের কথা, জানি ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের কথা, এবং জানি এই ভারতেই আশির দশকে তেড়েফুঁড়ে ওঠা শিখ মৌলবাদীদের কথাও --- যাদের হাতে ভারতের এক প্রধানমন্ত্রী নিহত হয়েছিলেন। ‘অহিংসার ধর্ম’ বলে কথিত বৌদ্ধধর্মও এ প্রবণতার বাইরে নয় মোটেই। থাইল্যান্ড, বর্মা ও শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধ ধর্মের তরফেও জঙ্গি প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। আজ অনেকেরই হয়ত আর মনে নেই, দুহাজার এক সালের কুখ্যাত ‘নাইন ইলেভেন’-এর ঘটনার আগে পর্যন্ত সবচেয়ে বড় ধর্মীয় নাশকতার ঘটনা বলে ধরা হত উনিশশো পঁচানব্বই সালের দুটি ঘটনাকে। তার একটি ঘটেছিল আমেরিকার ওকলাহোমা সিটি-র ‘ট্রেড সেন্টার’-এ, যাতে বিস্ফোরক-ভর্তি ট্রাক দিয়ে ওই ভবনটিতে ধাক্কা মেরে প্রায় দেড়শো লোকের প্রাণনাশ করা হয়েছিল, এবং সেটা ঘটিয়েছিল কতিপয় খ্রিস্টান মৌলবাদী। অন্যটি ঘটেছিল জাপানে, যেখানে পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে বিষাক্ত সারিন গ্যাসের কৌটো ফাটিয়ে দেওয়া হয়, তাতে বিষাক্ত গ্যাসে সরাসরি যত না মারা যায় তার চেয়ে অনেক বেশি লোক মারা যায় এবং গুরুতরভাবে জখম হয় সুড়ঙ্গের ভেতরে আতঙ্কগ্রস্তদের দৌড়োদৌড়িতে পদপিষ্ট হয়ে --- এবং সেটা ঘটিয়েছিল কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের একটি ক্ষুদ্র উপগোষ্ঠী। আমরা বৌদ্ধধর্মটা অন্তত অহিংস বলে জানতাম, তাই না? তার দু বছর আগে উনিশশো তিরানব্বই সালে ভারতে সংঘটিত কুখ্যাত ‘বম্বে বিস্ফোরণ’ অবশ্যই একটি বৃহৎ নাশকতা, এবং সেটা ঘটিয়েছিল মুসলমান জঙ্গিরাই। কিন্তু, মুসলমান মৌলবাদীদের বক্তব্য অনুযায়ী, সেটা ছিল তার এক বছর আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া। বলা বাহুল্য, এই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাটিকেও আবার মুসলমানদের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া বলেই দেখানো হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেটা কোনও সাম্প্রতিক ‘অত্যাচার’-এর প্রতিক্রিয়া ছিল না। হিন্দু মৌলবাদীদের নিজেদের দাবি অনুযায়ীই, এটা নাকি মোগল সম্রাট বাবরের তরফে ঘটে যাওয়া পাঁচশ বছরের পুরোনো এক অন্যায়ের প্রতিকার মাত্র! এবং, এই বাবরি মসজিদের ধ্বংসও আবার এ দেশে ধর্মীয় নাশকতার প্রথম ঘটনা নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও নয়। এ দেশে আজ পর্যন্ত ধর্মীয় নাশকতার সবচেয়ে বড় ঘটনা বলে যদি কোনও বিশেষ ঘটনাকে ধরতেই হয়, তো সেটা সম্ভবত উনিশশো চুরাশি সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে হত্যা করার ঘটনা। সেটা মুসলমানেরা ঘটায়নি, ঘটিয়েছিল শিখ মৌলবাদীরা।

    ধর্মের সমালোচনা যে আধুনিক পৃথিবীর অন্যতম প্রধান কাজ, তাতে সন্দেহ নেই। সমালোচনা মানে সব ধর্মেরই সমালোচনা, ইসলামেরও।  কিন্তু, ইসলাম ধর্মের সমালোচনায় একটি ভুল আমরা প্রায়শই করে থাকি। আমরা বলি, ইসলাম ধর্ম (এবং সেইহেতু ওই ধর্মাবলম্বীরাও) তো হিংস্র হবারই কথা, কারণ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রে হিংসার উপাদান খুব বেশি আছে। হয়ত সত্যিই আছে, কিন্তু যুক্তিটা তা সত্ত্বেও ভুল, এবং দুটো দিক থেকেই ভুল। কারণ, প্রথমত, সব ধর্মশাস্ত্রেই হিংসার উপাদান কমবেশি আছে। এবং দ্বিতীয়ত, যে ধর্মের শাস্ত্রে হিংসার উপাদান কিছু কম আছে সে ধর্মগোষ্ঠীর মানুষের আচরণে হিংসা কম থাকবেই --- এ প্রত্যাশার ভিত্তিটাও বোধহয় খুব পোক্ত নয়।
     
    হিংস্রতার বর্ণনা ও তার নৈতিক সমর্থন হিন্দু শাস্ত্রগুলোতে কোরানের চেয়ে কিছু কম নেই। কম নেই বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টেও, যদিও, হয়ত বা সত্যিই কিছু কম আছে নিউ টেস্টামেন্টে।  আবার, শাস্ত্রগ্রন্থে হিংস্রতার বর্ণনা কম থাকলেই যে ধার্মিকেরা কিছু কম হিংস্র হবেন, এমন নিশ্চয়তাও পাওয়া কঠিন। যুদ্ধলিপ্সা, হত্যা এবং হিংস্রতায় যিনি প্রবাদপ্রতিম, সেই চেঙ্গিস খান কিন্তু মোটেই মুসলমান ছিলেন না, 'খান' পদবী দেখে যা-ই মনে হোক।  খ্রিস্টানরা ষোড়শ-সপ্তদশ শতক জুড়ে আমেরিকাতে স্থানীয় অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যেভাবে হত্যালীলা চালিয়েছে নিউ টেস্টামেন্টের যাবতীয় ক্ষমার বাণী সত্ত্বেও, তা ইতিহাসে বিরল। মধ্যযুগের শেষে এবং আধুনিক যুগের গোড়ায় 'ক্ষমাশীল' খ্রিস্টানদের ডাইনি পোড়ানোর হিড়িক দেখে আতঙ্কে শিউরে ওঠেন না, এমন কেউই কি আছেন এ যুগে? 'ইসলামিক স্টেট' তার ঘোষিত 'বিধর্মীদের' হত্যা করে হত্যার উদ্দেশ্যেই, বা প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে, এবং সেটা সারা জগতের লোককে ডেকে দেখানোর জন্যেও বটে। দেখ হে, আমরা কত ভয়ঙ্কর, কত বড় বীর, এই রকম একটা ভাব। কিন্তু মধ্যযুগের খ্রিস্টানরা ডাইনি মারত ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা দিয়ে, এবং যন্ত্রণা দেওয়াটাই সেখানে মূল উদ্দেশ্য, যাতে অকথ্য অত্যাচার করে তার মুখ থেকে অন্য আরেক ‘ডাইনি’-র নাম বার করে আনা যায়। এই কাজটির জন্য তারা বিচিত্র ও বীভৎস সব কলা-কৌশল ও যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিল। কাজেই, বিশেষ একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর ধর্মান্ধতা ও ধর্মীয় হিংস্রতার সঙ্গে তার শাস্ত্রীয় অনুমোদনের একটা সহজ সরল সম্পর্ক ধরে নেওয়াটা বোধহয় সব সময় খুব নিরাপদ নয়।

    মুসলমানদের হিংস্রতার মতই আরেকটি বাজে গল্প আছে মুসলমানদের জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ে। মুসলমানদের হুহু করে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে, এবং দ্রুত তারা হিন্দুদেরকে ছাপিয়ে গিয়ে গোটা দেশটাকে দখল করে ফেলবে, এই মিথ্যে আতঙ্কটা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রচারের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু, বহু মানুষই যা সরলমনে বিশ্বাস করেন। এখানে বলে নেওয়া দরকার, মুসলিম জনসংখ্যা যে বাড়ছে এবং তার হার যে হিন্দুদের চেয়ে এখন পর্যন্ত কিছু বেশিই বটে, এটা কিন্তু মিথ্যে নয়। মিথ্যে হল এই প্রচারটা যে, এইভাবে বাড়তে বাড়তে হিন্দুদের চেয়ে তাদের সংখ্যা নাকি বেশি হয়ে যাবে, এবং তারাই দেশটাকে গ্রাস করে ফেলবে। আসলে ঘটনা হল, সব ধর্মের জনসংখ্যাই বাড়ছে, এবং সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সব দেশেই সংখ্যাগুরুদের চেয়ে সামান্য একটু বেশি হয়, যদি সেখানে সংখ্যালঘু নিধন না চলে, এবং বিশেষত যদি সে সংখ্যালঘুরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া হয়। জনসংখ্যাবৃদ্ধির আসল যোগটা ধর্মের সঙ্গে নয়, অর্থনীতির সঙ্গে। হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যেও গরিবদের জনসংখ্যাবৃদ্ধি যদি আলাদা করে হিসেব করা হয় তো দেখা যাবে যে তা সচ্ছল হিন্দুদের চেয়ে অনেক বেশি। সম্পন্নরা ভাল রোজগার করতে চায়, ভালভাবে থাকতে চায়, এবং সন্তানের জীবনযাপনও যাতে সে রকমই হয়, সে ব্যবস্থা করতে চায়। তারা জানে যে সেটা করতে গেলে সন্তানকে উচ্চমানের শিক্ষাদীক্ষা দেওয়া দরকার, তার পেছনে ভাল করে যত্ন ও খরচাপাতি করা দরকার, এবং সেটা করার ক্ষমতাও তাদের আছে। ছেলেপুলে বেশি হলে তা সম্ভব নয়, এবং তাতে করে বাচ্চার মায়ের স্বাস্থ্যের বারোটা বাজবে, মা ঘরের বাইরে গিয়ে পেশাগত কাজকর্ম করে অর্থ উপার্জনও করতে পারবে না। ফলে, তারা বেশি সন্তান একদমই চায় না। উল্টোদিকে, গরিবরা এত কথা জানেও না আর তাদের সে ক্ষমতাও নেই। ফলে তারা যত বেশি সম্ভব সন্তান চায়, সেটা মায়ের স্বাস্থ্যহানি ও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে হলেও। গরিবরা জানে তাদের সন্তান দুধেভাতে থাকবে না, এবং শেষপর্যন্ত কোনও শ্রমসাধ্য কাজেই যোগ দেবে যাতে শিক্ষা বা 'স্কিল' সেভাবে লাগে না। ফলে, সন্তানের সংখ্যা বেশি হলে দুরবস্থা আর অযত্নের মধ্যেও হয়ত রোগভোগ মৃত্যু এড়িয়ে কেউ কেউ টিঁকে যাবে, আর পরিশ্রম করে পরিবারের আয় বাড়াতে পারবে, যৎসামান্য হলেও। অথচ এদেরই যখন অর্থনৈতিক উন্নতি হবে, তখন এরা মেয়েদেরকে পড়াশোনা শেখাতে চাইবে, ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সন্তানকে কেরানি-আমলা-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল এইসব বানাতে চাইবে, ফলে স্বল্পসংখ্যক সন্তান চাইবে, এবং মায়ের জীবন ও স্বাস্থ্যকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করবে। একটু ভাল করে খোঁজখবর করলেই জানা যাবে, অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঘটছে কিন্তু আসলে ঠিক তাইই, হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ক্ষেত্রেই। এবং, মুসলমানরা পিছিয়ে আছে বলেই তাদের অগ্রগতিও দ্রুততর। তাদের জন্মহারের বৃদ্ধি কমছে কিছু বেশি দ্রুতলয়ে। এভাবে চললে আর দেড় দুই দশক পরেই হয়ত হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সমান হয়ে যাবে, এবং মুসলমানদের ভারত দখলের কুৎসিত অশিক্ষিত গল্পতেও তখন আর কেউই পাত্তা দেবে না। ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি এই দিকেই।
     
    এখানে 'অগ্রগতি' বলতে জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কমিয়ে আনার কথা বুঝিয়েছি। মুসলমানদের ক্ষেত্রে এই কমিয়ে আনাটা হিন্দুদের চেয়ে বেশি হারে ঘটছে (বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া মানে জনসংখ্যা কমে যাওয়া নয় কিন্তু, এ হার কমতে কমতে শূন্যের নিচে নামলে তবেই জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে)। এই কমে আসাটা উন্নয়নের পরোক্ষ সূচক। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন বাদে যে হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার সমান হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।  পিছিয়ে আছে বলেই অগ্রগতি বেশি তাড়াতাড়ি হচ্ছে --- এ কথাটা হয়ত অনেককে বিস্মিত করতে পারে, কিন্তু কথাটা বলার কারণ আছে। নিশ্চয়ই জানেন, ভারত চিন ব্রাজিলের মত একটু এগিয়ে থাকা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ইউরোপ আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর থেকে বেশি। এর কারণ হচ্ছে, একবার উন্নত হয়ে গেলে একই গতিতে আরও আরও উন্নত হতে থাকাটা ক্রমশই আরও বেশি বেশি করে কঠিন হয়ে ওঠে, তাই উন্নয়নের প্রথম দিকে বৃদ্ধির যে গতি থাকে পরের দিকে আর তত গতি থাকে না। মুসলমানদের জনসংখ্যার ক্ষেত্রেও তাইই ঘটছে, এবং আরও ঘটবে (ও দুটোকে খুব নিখুঁতভাবে মেলানোর দরকার নেই, যদিও)।

    আমরা যারা এই বিষয়গুলোকে এইভাবে ভাবার চেষ্টা করি, তাদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আসে প্রায়শই, ফেসবুকে সে গর্জন রোজই শোনা যায়। এখন, এটা তো সত্যি কথাই যে, পশ্চিমবাংলার যুক্তিবাদীদের লেখালিখিতে, এবং যথারীতি আমার নিজের লেখাতেও, হিন্দু মৌলবাদের সমালোচনাই বেশি আসে, মুসলমান মৌলবাদের কথা বাস্তবিকই আসে অনেক কম। ঠিক এই অভিযোগটি সেক্যুলারদের প্রতি হিন্দু মৌলবাদীরা করে থাকেন নিয়মিতই (বস্তুত, প্রত্যেক ধর্মের মৌলবাদীরাই তাদের নিজস্ব গোষ্ঠী বা সমাজের সেক্যুলারদের প্রতি এই একই অভিযোগ করে থাকে)। কিন্তু একটু ভাবলে বুঝবেন, এটাই প্রত্যাশিত ও স্বাভাবিক। এবং, অন্যরকম কিছু হলেই বরং অত্যন্ত অস্বাভাবিক ও অসঙ্গত হত, এমন কি অন্যায়ও হত। কেন, তার একাধিক কারণ আছে। প্রথমত, এ দেশের রাষ্ট্র ও সমাজ যে মৌলবাদী হুমকিটির মুখোমুখি, সেটা তো হিন্দু মৌলবাদই, অন্য কোনও মৌলবাদ নয়। শিক্ষা-প্রশাসন-বিচারব্যবস্থার ধর্মীয়করণ, সংবিধানকে পাল্টে দেবার পরিকল্পনা, ভিন-ধর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, ধর্মের জিগির তুলে তার আড়ালে সরকারি সম্পত্তি পাচার --- এ সব তো মুসলমানরা করছে না, হিন্দুত্ববাদীরাই করছে। অতএব, তাদের মুখোশ খোলাটাই এখানে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। মুসলমান জঙ্গিরা নাশকতা ঘটালে তার মোকাবিলার জন্য পুলিশ-মিলিটারি আছে, কিন্তু নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসা মৌলবাদীদের রোখবার দায়িত্ব তো আর পুলিশ-মিলিটারি নেবে না, সেটা সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের কাজ। আমি যে দেশে এবং যে ধর্মীয় সমাজের মধ্যে বাস করি, সেখানে যারা অন্ধত্ব ও হিংস্রতা ছড়াচ্ছে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রকে বিনাশ করছে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোটাই তো আমার পক্ষে স্বাভাবিক, তাই না? বাংলাদেশি মুক্তমনারা যদি মুসলমান ধর্ম ছেড়ে হিন্দুদেরকে গালি দিতে থাকতেন, বা বার্ট্র্যান্ড রাসেল যদি 'হোয়াই আই অ্যাম নট আ ক্রিশ্চান' না লিখে 'হোয়াই আই অ্যাম নট আ হিন্দু' লিখে বসতেন, তাহলে যেমন উদ্ভট অসঙ্গত কাজ হত, এখানে আমরা হিন্দু ধর্ম ছেড়ে মুসলমান নিয়ে পড়লেও ঠিকই একই ব্যাপার হবে (যদিও বাংলাদেশি মুক্তমনারা ঠিক যা বলেন এবং যেভাবে বলেন, তার অনেক কিছুর সঙ্গেই আমার দ্বিমত আছে, তবে সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক না)। দ্বিতীয়ত, আমরা পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ মুক্তমনা যুক্তিবাদী নাস্তিকেরা হিন্দু সমাজে জন্মেছি বলেই সে সমাজ ও তার ধর্ম শাস্ত্র রীতিনীতি আচার বিচার এইসব অনেক বেশি জানি, ফলে সে ব্যাপারে আমাদের সমালোচনা অনেক বেশি নিরেট, নির্ভুল এবং অর্থবহ হয়, যা ভিনধর্মী সমাজে যারা জন্মেছে তারা পারবেনা। ঠিক একই কারণে, মুসলমান সমাজ ও ধর্ম সম্পর্কে মুসলমান সমাজে জন্মানো যুক্তিবাদীদের সমালোচনা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ও ফলপ্রসূ হয়। যদিও, এর মানে মোটেই এই নয় যে এক ধর্মে জন্মানো লোক অন্য ধর্মের সমালোচনা করতেই পারবেনা --- যে কোনও মানুষের যে কোনও ধর্মের সমালোচনা করার অধিকার আছে, এবং করা উচিত। তবে কিনা, নিজের সমাজের অন্ধত্ব অযুক্তি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথমে সোচ্চার হওয়াটা যে কোনও মানুষেরই ‘স্বাভাবিক’ অধিকার, কর্তব্যও বটে।
     
    আচ্ছা, তা সে যা-ই হোক, মোদ্দা কথাটা তাহলে কী দাঁড়াল --- মুসলমানেরা ধর্মান্ধতায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে, না পিছিয়ে? এসব ঠিকঠাক বলতে গেলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে পৃথিবীজোড়া সমীক্ষার নির্ভরযোগ্য ফলাফল চাই, না হলে সবটাই চায়ের দোকানের আড্ডা হয়ে যাবে। আপাতত আছে কি সে সব, আমাদের হাতে? সুখের বিষয়, সে সব আছে। এই কিছুদিন মাত্র আগেও সেভাবে ছিল না, কিন্তু এই একুশ শতকে বেশ ভালভাবেই আছে। বেশ কয়েকটি বিখ্যাত সংস্থা এখন মানুষের জীবনের নানা দিক নিয়ে প্রামাণ্য সমীক্ষা করে থাকে, তার মধ্যে ধর্মবিশ্বাসও পড়ে। এইসব সমীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে বড় বড় বিশেষজ্ঞরা নানা গভীর গবেষণাও করে থাকেন, এবং তাতে তেমন চমকপ্রদ কোনও ফলাফল পাওয়া গেলে সারা পৃথিবীর গণমাধ্যমে সে নিয়ে আলোড়ন উঠে যায়। এই রকমই একটি সংস্থা হল ‘উইন গ্যালাপ’। তারা সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের ধর্মবিশ্বাস নিয়ে এক বিখ্যাত সমীক্ষা চালিয়েছিল ২০১২ সালে, তাতে বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের প্রাবল্য, ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসা মানুষের সংখ্যা, এইসবের হিসেব ছিল। তাতে কি দেখা গেল? নিচে দেখে নিন ২০১২ সালের পৃথিবীজোড়া সমীক্ষার ফলাফল, সুন্দর করে সারণিতে সাজানো। এখানে পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে, নিজেকে বিশ্বাসী বলে দাবি করেন অথচ ধার্মিক বলে দাবি করেন না --- এমন মানুষের অনুপাত মুসলমানদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি। কারা কবে সমীক্ষাটি করেছে, এবং তা কোন নথিতে প্রকাশিত, সব তথ্যই পাবেন এখানে।
     
     
    এবার একটি ইসলামীয় দেশকে নিয়ে ভাবা যাক, যেখানে প্রায় সর্বাত্মক মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং ইসলামীয় রাষ্ট্র আছে। ধরুন, ইরান। এই  দেশটা সম্পর্কে আপনি কী জানেন? জানি, এ প্রশ্নের উত্তরে প্রায় সকলেই একই কথা বলবেন। ছিয়ানব্বই দশমিক পাঁচ শতাংশ (সরকারি সেন্সাসের তথ্য অনুযায়ী) মুসলমান অধ্যুষিত একটি ধর্মান্ধ দেশ, যার মধ্যে আবার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা শিয়া মুসলমানদের। কট্টর মৌলবাদীরা সেখানে দেশ চালায়, প্রশ্ন করলেই কোতল হতে হয়, মুক্তচিন্তা কল্পনাতীত। সম্প্রতি সেখানে হুলুস্থুলু ঘটে গিয়েছে, সে সব খবরাখবর আপনারা দেখেছেন। একটি মেয়েকে ইসলাম-সম্মত পোশাক না পরার অপরাধে সেখানে হত্যা করা হয়েছে, তাই নিয়ে প্রবল আন্দোলন হলে রাষ্ট্রের তরফে নেমে এসেছে দমন-পীড়ন, এবং সদ্য-সমাপ্ত ফুটবল বিশ্বকাপে সারা পৃথিবীর সামনে তার প্রতিবাদ করায় সে দেশের জাতীয় দলের এক খেলোয়াড়কে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। এখানে মৌলবাদের দাপটের ছবিটা একদমই স্পষ্ট, আবার গণমানুষের আপত্তিটাও খুব আবছা নয়।

    আসলে, এখানে ধর্মীয় রাষ্ট্রের দোর্দণ্ডপ্রতাপের তলাতেই লুকিয়ে আছে অন্য এক বাস্তবতা। নেদারল্যান্ডের একটি গবেষণা সংস্থা (GAMAAN), ইরানই যাদের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু, তারা ২০২০ সালে  ইরানে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে। সে সমীক্ষার ফলাফল যদি বিশ্বাস করতে হয়, তো সেখানে সাঁইত্রিশ শতাংশ মত লোক নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করেন (শিয়া-সুন্নি মিলিয়ে), যাঁরা কোনও ধর্মীয় পরিচয় দিতে রাজি নন তাঁরা বাইশ শতাংশ, যাঁরা পরিষ্কারভাবে নিজেকে নাস্তিক-অজ্ঞাবাদী-মানবতাবাদী এইসব বলে পরিচয় দেন তাঁরা সব মিলিয়ে প্রায় সতেরো শতাংশ, যাঁরা নিজেকে শুধুই 'স্পিরিচুয়াল' বলেন তাঁরা প্রায় সাত শতাংশ, এবং বাকিরা আরও নানা বিচিত্র ধর্মের মানুষ। নিচের ছবি দুটোয় সমীক্ষার ফলাফল এক নজরে পাওয়া যাবে। হ্যাঁ বন্ধু, একুশ শতকে পৃথিবী বদলাচ্ছে, এবং হয়ত বিশ শতকের চেয়েও দ্রুত গতিতে! এবং, ইসলামীয় দেশগুলো কোনওভাবেই এ প্রবণতার বাইরে নয়। নিচে সে সমীক্ষার ফলাফল দেখুন, চিত্রাকারে।
     
     
    ধর্ম, ঈশ্বর, স্বর্গ, নরক, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন, অবতার ইত্যাদি ধ্যানধারণা বিষয়ে ইরান-বাসীদের বিশ্বাস (বা অবিশ্বাস) ঠিক কী রকম, সে চিত্রও উঠে এসেছে সমীক্ষা থেকে। নিচে দেখুন।
     
     
     
    তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুসলমানদের ধর্মপ্রীতি নিয়ে আমাদের অধিকাংশের মধ্যে যেসব জনপ্রিয় ধ্যানধারণা আছে, তার সমর্থন এইসব সমীক্ষার ফলাফল থেকে মিলছে না মোটেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে ইঙ্গিত এখান থেকে আমরা পাচ্ছি, সেটা সামগ্রিক বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, নাকি একটা সম্পূর্ণ আলাদা উল্টোপাল্টা কিছু। সেটা বুঝতে গেলে বর্তমান শতকের বিগত কয়েকটি দশকে গোটা পৃথিবীর ধর্মবিশ্বাসের গতিপ্রকৃতি এক নজরে দেখে নেওয়া দরকার। এমনিতে সেটা একটু মুশকিল, কারণ, তার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থার করা অনেকগুলো সমীক্ষা-কর্ম খুঁটিয়ে দেখে সেগুলোর প্রাসঙ্গিক ফলাফলটুকু বেছে নিয়ে তুলনা করতে হবে। সেইজন্যে, আমি যতটা পেরেছি সেগুলোকে সাজিয়ে একটা মাত্র সারণিতে নিয়ে এসেছি, তাতে পাঠিকের কিছু সুবিধে হবার কথা। সেটা নিচে দিলাম, দেখুন। সারণির কোন সংখ্যাটি কোন সংস্থার করা কবেকার সমীক্ষায় পাওয়া গেছে, সেটা ওখানেই দেওয়া আছে। প্রথম সংখ্যাটি অবশ্য কোনও সংস্থার তরফে দেওয়া নয়। এটি দিয়েছিলেন সমাজতত্ত্ববিদ ফিলিপ জুকারম্যান, তখন পর্যন্ত প্রাপ্য সমস্ত টুকরো টুকরো সমীক্ষার ফলাফল এক জায়গায় করে।
     
     
     
     
    এবার নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের গতিপ্রকৃতি অন্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে খুব বেশি আলাদা নয়। আসলে, এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে, সব ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যেই ধর্মবিশ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে আসার যে প্রবণতা রয়েছে, মুসলমানরা কোনও মতেই সে প্রবণতার বাইরে নয় (অবশ্যই, এ হিসেব সামগ্রিক ও বৈশ্বিক, এবং অঞ্চল ও অন্যান্য পরিস্থিতি-ভেদে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে)।

    কেন এই জগৎজোড়া প্রবণতা? আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি বলবে, সবই যুগের হাওয়া। মানে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং গণতন্ত্র-মানবতাবাদ-যুক্তিবাদ এইসবের প্রভাবই এর কারণ। কথাটা সত্যি, কিন্তু সমাজবিদেরা এর চেয়েও বড় কারণ আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা আজ সুপ্রচুর তথ্য-যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, মানব সমাজের উন্নতির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক বিপ্রতীপ। দেশের মাথাপিছু আয় বাড়লে, সমাজকল্যাণে সরকার বেশি বেশি খরচা করলে, অর্থনৈতিক অসাম্য কমলে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের হাল ভাল হলে ধর্মের রমরমা কমতে থাকে (এখানে আর বিস্তারে যাব না, যদিও আগে এ নিয়ে আলোচনা করেছি এবং পরেও করব)। সমাজ-বিকাশের এই সাধারণ নিয়ম মুসলমান সমাজের ওপরে প্রযোজ্য হবে না, এমনটা  ভেবে নেওয়ার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। ইরানে যা ঘটছে, সেটা সমাজ-বিকাশের এই সাধারণ নিয়মের চাপেই। নেটে একটু খোঁজাখুঁজি করলেই দেখতে পাবেন, ইরানের মাথাপিছু উৎপাদন ভারতের প্রায় আটগুণ, বাজেটের শতাংশ হিসেবে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি খরচ প্রায় সাতগুণ এবং শিক্ষাখাতে তা দেড়গুণেরও বেশি, এবং নারী ও পুরুষ উভয়েরই আয়ু আমাদের থেকে ভাল (গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের দশা শোচনীয়, যদিও)। কাজেই, ইরানে মৌলবাদী রাজনীতি ও প্রশাসনের ওপর কেন গণ-অসন্তোষের চাপ আছে এবং পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে কেন তা ততটা নেই --- এইটা বুঝতে পারা খুব কঠিন না।

    বলা প্রয়োজন, সমাজ-বিকাশজাত এই চাপের খেলা সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান উন্নত পশ্চিমী দেশগুলোতেও, বিশেষত এই একুশ শতকে। এই সেদিন পর্যন্ত আমেরিকা আর আয়ার্ল্যান্ডে ধর্মবিশ্বাসের প্রাবল্য ছিল অন্যান্য উন্নত দেশের চেয়ে অনেক বেশি। ধার্মিক সমাজবিদেরা তাই দেখিয়ে বলতেন, অর্থনৈতিক উন্নতি হলেই ধর্মের রমরমা কমবে, এটা হচ্ছে গিয়ে প্রগতিবাদীদের বানানো একটা মিথ্যে কথা। কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে ততই বিষয়টা জলের মত স্বচ্ছ হয়ে আসছে, এবং আপত্তি তোলবার পরিসর হয়ে আসছে অতিশয় সঙ্কুচিত। মার্কিন সমাজে ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনটা দেখতে পাবেন এক নজরেই, নিচের লেখচিত্রে। লক্ষ করে দেখুন, ১৯৫০ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত আমেরিকাতে যখন খ্রিস্টানরা এসে ঠেকেছে ৮৫ শতাংশ থেকে ৬৯-এ, এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা যখন মোটের ওপর একই আছে, তখন ধর্মহীনদের শতকরা অনুপাত গিয়ে ঠেকেছে শূন্য থেকে একুশে (অন্য কিছু সমীক্ষায় এটি প্রায় তিরিশ বলে দেখানো হয়েছে, যদিও)।
     
     
     
    আর, এই শতকের প্রথম দশকে আয়ার্ল্যান্ড-বাসীর ধর্মবিশ্বাসে যা ঘটেছে, সেটা দেখে নিন নিচের সারণিতে। আয়ার্ল্যান্ড হল গোঁড়া ক্যাথোলিক অধ্যুষিত একটি দেশ। একটা উন্নত পশ্চিমী দেশের পক্ষে অবিশ্বাস্যভাবে, এই সেদিন পর্যন্তও এই দেশটিতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল, এবং গর্ভপাতের দরকার পড়লে আইরিশ নারীদেরকে পার্শ্ববর্তী ব্রিটেনে গিয়ে হাজির হতে হত। তারপর উন্নত আধুনিক অর্থনীতির সঙ্গে রক্ষণশীল ধর্ম-সংস্কৃতির দীর্ঘ সংঘর্ষের ফলাফল তখনই সারা বিশ্বের নজরে এল, যখন দু হাজার আঠেরো সালে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হয়ে গেল (আয়ার্ল্যান্ড নিয়ে আমার আলাদা একটি লেখা ‘গুরুচণ্ডালি’-তে পাবেন)।
     
     
    বলা বাহুল্য, মোটের ওপর এই একই ঘটনা ঘটবার কথা মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও, এবং ঘটছেও তাইই। বেশ কয়েকটি ধর্ম-শাসিত রক্ষণশীল দেশে কমছে কঠোর ধর্মীয় বাধানিষেধ, বাড়ছে ধর্মহীনতা, এবং সাধারণ্যে কমছে ধর্মের প্রতি আনুগত্য, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই তা  এখনও স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান নয়। বিষয়টাকে যদি খুঁটিয়ে নজর করা হয়, তাহলে এমন অনেক কিছুই হয়ত জানা যাবে, যে ব্যাপারে আমরা আগে সচেতন ছিলাম না। যেমন, ইরান-ইরাক-আফগানিস্তান যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে ধর্মীয় রাষ্ট্র হয়ে গেল, এবং যেভাবে তুর্কি দেশটিতে ক্রমেই শক্ত হচ্ছে মৌলবাদের মুঠি আর টলমল করছে ধর্মনিরপেক্ষতার আসন, সে নিয়ে আমরা প্রায়শই দুশ্চিন্তিত হই। ঠিকই করি। কিন্তু, আমরা কখনই খেয়াল করে দেখিনা যে, এই ধরাধামে একান্নটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে একুশটিতে কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ সরকারই চলছে (সে ধর্মনিরপেক্ষতার দশা প্রায়শই আমাদের চেয়ে খুব একটা ভাল নয় যদিও, তবে সেটা তো অন্য চর্চা)। এবং, ধর্মনিরপেক্ষীকরণের প্রক্রিয়া এখনও চালু, সে তালিকায় এই সেদিনও যুক্ত হয়েছে সুদান।

    তবুও প্রশ্ন আসতেই পারে, এবং আসবেও, জানা কথা। ওপরে উদ্ধৃত আমার তরুণ বন্ধুর ভাষায়, সে প্রশ্নটা এ রকম --- “আর কোন ধর্মে আইসিস, তালিবান, বোকোহারামের মত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন আছে?”। সত্যিই তো, প্রশ্ন হতেই পারে। ওপরে ব্যাখ্যা করেছি (এবং পূর্ববর্তী পর্বগুলোতেও), মৌলবাদী উত্থান সব ধর্মেই হয়েছে, শুধু ইসলামে নয়। এবং, জঙ্গি ক্রিয়াকলাপও কম বেশি হয়েছে সব ধর্মের তরফেই। সেই সত্যে ভর করে আমি হয়ত তর্ক করতে পারতাম, অন্যান্য ধর্মের মৌলবাদের সঙ্গে ইসলামের তফাতটা তাহলে গুণগত নয়, নিছকই পরিমাণগত। এরা কম, ওরা কিছু বেশি, এটুকুই মাত্র। কিন্তু, এ তর্ক শেষতক দাঁড়াবে না। পাথরের নুড়ির সঙ্গে পাথরের টিলার গুণগত পার্থক্যকে স্রেফ পরিমাণের দোহাই দিয়ে নস্যাৎ করাটা বোধহয় খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। ইসলামীয় জঙ্গিপনার নিবিড়তা, ঘনত্ব, প্রচণ্ডতা এবং আন্তর্জাতিকতা, এ সবকে নিছক কম-বেশির ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব। যদি বলি, মধ্যপ্রাচ্যে একাধিক আধুনিক রাষ্ট্র থেকে খামচে নিয়ে একটা গোটা এবং আনকোরা নতুন ধর্মীয় রাষ্ট্র বানিয়ে তোলা, অনেকগুলো দেশে ধর্মনিরপেক্ষ সরকার উল্টে দিয়ে মৌলবাদী রাজত্ব কায়েম করা, প্রায় সবকটি মহাদেশে বড়সড় নাশকতা চালানোর মত সংগঠন তৈরি করতে পারা --- এত সব শুধুই জঙ্গিপনার কম-বেশির ব্যাপার, তার মধ্যে আলাদা করে বলার মত গুরুত্বপূর্ণ গুণগত বৈশিষ্ট্য কিছুই নেই --- তাহলে অবশ্যই বোকামি হবে, বাস্তবকে অস্বীকার করার বোকামি। কাজেই, জঙ্গিপনার এই ভয়ঙ্কর নিবিড়তা আর ব্যাপকতাকে ইসলামীয় মৌলবাদের একটি স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য বলে স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, সেটা মেনে নিলেও আসল সমস্যাটা রয়েই যায়। সব মুসলমানই তো আর মৌলবাদী জঙ্গি নন, তার এক অতি ক্ষুদ্র অংশই কেবল মৌলবাদী জঙ্গি। কাজেই, এই জঙ্গিপনাকে ইসলামীয় মৌলবাদের একটি স্বতন্ত্র গুণগত বৈশিষ্ট্য বলে মেনে নিলেও প্রশ্ন থাকে, ‘ইসলাম’ নামক ধর্মটির কোনও মৌল উপাদান থেকেই কি এই বৈশিষ্ট্যটি উৎসারিত হচ্ছে, নাকি, মুসলমান অধ্যুষিত সমাজ তথা রাষ্ট্রগুলোর  কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিই এ বৈশিষ্ট্যের নির্মাতা?
     
    কেউ কেউ এ প্রশ্নের উত্তর খুব দ্রুত দিয়ে ফেলতে ভালবাসেন। তাঁরা বলেন, এ বৈশিষ্ট্য অবশ্যই ‘ইসলাম’ নামক ধর্মটিরই মৌল উপাদান থেকে নিঃসৃত, কারণ, ইসলামীয় ধর্মশাস্ত্রে হিংসার অনুমোদন আছে। এ যুক্তিটি যে ভুল, সে আলোচনা ওপরে করেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এ প্রশ্নের উত্তর তবে কীভাবে খোঁজা যায়? আজকের দিনে বিজ্ঞানে, বিশেষত সমাজবিজ্ঞান ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে, এ ধরনের প্রশ্নের সমাধানের জন্য যা করা হয় তাকে বলে ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ এক্সপেরিমেন্ট’। সমাজের ওপর তো আর পরীক্ষা চলবে না, অতএব সেখানে দরকার ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ অবজার্ভেশন’ বা সুনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ। অর্থাৎ, পুরোপুরি একই রকম করে তৈরি (বা সংগ্রহ) করে রাখা দুটি ক্ষেত্রের মধ্যে একটিতে একটি সুনির্দিষ্ট নির্ধারক উপাদান যোগ করে (বা একটি সুনির্দিষ্ট নির্ধারক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে), এবং অপরটিতে তা না করে, শুধুমাত্র প্রথম ক্ষেত্রটিতে কোনও এক নির্দিষ্ট প্রত্যাশিত ফলাফল এলো কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা, যাতে ওই নির্দিষ্ট উপাদানটির (বা প্রক্রিয়াটির) সঙ্গে ওই ফলাফলটির কার্যকারণ সম্পর্ক সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। কোনও ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য যেমন একই ধরনের দু দল রুগির মধ্যে একদলকে সে ওষুধ দিয়ে এবং অন্যদলকে তা না দিয়ে পরীক্ষা করা হয় যে দ্বিতীয় দলের তুলনায় প্রথম দলের কিছু বেশি উপকার হল কিনা, এও তেমনি। মনে করুন প্রশ্ন উঠল যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামের যে মৌলবাদী উত্থান দেখা গেল, ইরাকের খনিজ তেল এবং আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানগত সামরিক গুরুত্ব না থাকলেও কি তা ঘটতে পারত, শুধুমাত্র ইসলামীয় শাস্ত্র, সমাজ ও সংস্কৃতির একান্ত নিজস্ব আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যের কারণেই? এ প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ উত্তর বেরিয়ে আসতে পারে একমাত্র সেই ধরনের পদ্ধতিতেই, অর্থাৎ, ‘কন্ট্রোল্‌ড্‌ অবজার্ভেশন’ বা সুনিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। যেখানে ইসলামের প্রবল প্রভাব আছে অথচ কোনও বড়সড় অর্থনৈতিক বা সামরিক লাভালাভের পরিস্থিতি নেই, সে রকম সমস্ত জায়গাতেও কি মৌলবাদী জঙ্গিপনার উদ্ভব ঘটেছে? আবার, যেখানে ওই ধরনের পরিস্থিতি আছে অথচ ইসলাম নেই, সে রকম কোনও জায়গাতেই কি জঙ্গি আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেনি? এই ধরনের অনুসন্ধান হয়ত আমাদেরকে এ ধরনের প্রশ্নের বস্তুনিষ্ঠ উত্তরের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ প্রসঙ্গে এ রকম গবেষণার কথা আমাদের জানা নেই।
     
    এই যে মুসলমান মৌলবাদের অস্তিত্বের কারণ হিসেবে ইসলামের আভ্যন্তরীণ কারণকে পুরোপুরিই দায়ী করা, ওপরের দুই অনুচ্ছেদে যার কথা বললাম, এর ঠিক উল্টো প্রবণতাটা হচ্ছে এর পেছনে ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ’ (বা আরও সাধারণভাবে ‘পশ্চিমী চক্রান্ত’) বা ওই জাতীয় ইসলাম-বহির্ভূত কোনও কিছুকে পুরোপুরি দায়ী করা (এবং সেইহেতু ইসলামীয় সমাজ ও সংস্কৃতির আভ্যন্তরীণ বৈশিষ্ট্যগুলোকে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বলে সাব্যস্ত করা)। মুসলিম মৌলবাদের উত্থানের পেছনে পাশ্চাত্য শক্তি, বিশেষত আমেরিকার ভুমিকা অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথেই আলোচনা করা উচিত। কিন্তু, বিশ শতকের পৃথিবীর ইতিহাসের সমস্ত ঘটনাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলিহেলনে ঘটছে, চোখ বুজে এইটা বলে দিলে আপাতদৃষ্টিতে হয়ত তাকে নিন্দা করা হয়, কিন্তু আসলে শেষ বিচারে তার ক্ষমতাকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেখা হয়। আমেরিকা (বা সাধারণভাবে ‘পশ্চিম’) মুসলমান দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, শুধু এটুকু বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না --- আসল প্রশ্ন হচ্ছে তারা তা পারল কী করে --- পৃথিবীর সব জায়গাতেই যে তারা যা চেয়েছে তাইই পেরেছে এমন তো আর নয়। মুসলমান সমাজ ও দেশগুলোর সুনির্দিষ্ট বিন্যাস ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি, বিকাশের সুনির্দিষ্ট অবস্থা, তাদের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংশ্লিষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তাদের তরফে নানা মতাদর্শ ও গোষ্ঠী-পরিচিতি নির্মাণের খেলা, এবং কখন ঠিক কোন তাড়নায় তারা কোন বৃহৎ শক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব বা শত্রুতার সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে, আর কোন বৃহৎ শক্তিই বা তাদেরকে সামলানো বা ব্যবহার করার জন্য ঠিক কী চাল চালছে --- এই সবের ভাল বিশ্লেষণ ছাড়া বিষয়টা ঠিকভাবে বোঝাই যাবে না। তাছাড়া, এই দেশগুলোতে 'সেক্যুলার' শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও প্রায়শই শাসকরা স্বৈরাচারি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে কেন, এবং, কেনই বা মৌলবাদীরা বারবার তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে জনগণের পাশে থাকার ভাণ করতে পারে, এটাও এ প্রসঙ্গে গভীরভাবে বোঝার বিষয়।  

    বলা বাহুল্য, এ সব প্রশ্নে যথার্থ ও যথেষ্ট বিশ্লেষণ এবং নিষ্পত্তিমূলক উত্তর এখনও আসেনি সমাজবিজ্ঞানীদের তরফ থেকে। যতদিন তা না আসে, ততদিন আমরা কী করতে পারি? ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারি, বিষয়টি সম্পর্কে ইতিমধ্যে যা জানা গেছে সে সব জানার চেষ্টা করতে পারি, যুক্তিসম্মত ও বস্তুনিষ্ঠ চিন্তার অভ্যাস করতে পারি …………… আর কিছু পারি কি?

    হ্যাঁ, পারি বোধহয়। মন থেকে অকারণ সন্দেহ ঘৃণা হিংসা বিদ্বেষ এইসব চিহ্নিত করে তা বর্জন করার অনুশীলনটা চালিয়ে যেতে পারি।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৫ ডিসেম্বর ২০২২ | ৬০৪৪০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Debasis Bhattacharya | ০৪ মার্চ ২০২৩ ০০:৪৮516959
  • এই রে, কোথায় না কোথায় কীসব পাচারের চক্রান্ত চলছে। সিবিআই চলে আসবে য্যা! 
  • &/ | 151.14.***.*** | ০৪ মার্চ ২০২৩ ০২:৫৬516960
  • আছে, আছে, সম্পর্ক আছে। :-)
  • Debasis Bhattacharya | ০৪ মার্চ ২০২৩ ১২:৩৫516968
  • আছে, আছে, আমাদের টেলিপ্যাথির জোর আছে!
  • &/ | 151.14.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ০১:১৬516989
  • একটু ডাইভার্জ করি। আচ্ছা, ১৯৮০ কি ১৯৮১ থেকে ২০০০ ---মোটামুটি এই সময়টা, এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষাই বলুন, বিজ্ঞানচেতনাই বলুন, অসাম্প্রদায়িকতার চর্চাই বলুন, এমনকি সাধারণ মধ্যবিত্ত থেকে নিতান্ত দরিদ্র মানুষের আত্মমর্যাদাবৃদ্ধির চর্চা(অন্যায় সুযোগ নেবো না, খয়রাতি নেবো না, পরিশ্রম করে অর্জন করে খাবো)---এসব যেভাবে হয়েছে, তার পরবর্তীকালে সেটা টানতে যে পারা গেল না সেটা কি অনিবার্য ছিল? মানে কিছুকাল আগে কেউ বললেন এর পরে দুনিয়ার দরজা খুলে গেল, বহু অপর্চুনিটি এল। তাহলে তো শিক্ষাদীক্ষা, বিজ্ঞানচেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা --এইসব বেড়ে ওঠার কথা ছিল! কিন্তু বাস্তবে উল্টোপথের দিকে এরকম ঠেলা খেল কেন? এইরকম এত কুসংস্কার, এত জাতপাত হিন্দুমুসলমান, অজস্র অনলাইন অফলাইন গ্রুপে গ্রুপে রোয়াকে রোয়াকে এইসব নিয়েই দিনরাত গুলজার চলছে ---এইরকম একটা জিনিস কী করে সম্ভব হয় ওই অতখানি সাধনার যুগের পরে?
  • Debasis Bhattacharya | ০৫ মার্চ ২০২৩ ০৩:৪৮516990
  • এ নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। তবে, এর আগেই কিছু প্রশ্ন ছিল কারুর কারুর। 'আধুনিকরা খোঁজে'-র প্রশ্নের উত্তর দ্রুত দেওয়াটা জরুরি মনে হওয়ায় সেগুলোকে মুলতুবি রেখেছিলাম। এখন বোধহয় আগে সেগুলোর উত্তর দিয়ে নেওয়াটা উচিত হবে। 
  • Debasis Bhattacharya | ০৫ মার্চ ২০২৩ ০৩:৫১516991
  • যদ্দুর মনে পড়ে, প্রশ্নগুলো করেছিলেন আপনি নিজে, guru, এবং 'রাধার কানাই'। শেষোক্ত জন অবশ্য প্রশ্ন প্রত্যাহার করেছেন ইতিমধ্যে। 
  • &/ | 151.14.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ০৪:১৫516992
  • হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে তো অবশ্যই। যখন আপনার ইচ্ছে হবে, সময়-সুযোগ হবে, তখনই। এ তো বাঁধাবাঁধি কোনো বিতর্কসভা নয়, খোলামেলা আলোচনা ও আলাপের প্ল্যাটফর্ম। আড়ালহীন কমুনিটি। আগের প্রশ্নের উত্তর পরে, পরের প্রশ্নের উত্তর আগে হলেও কিছুই ক্ষতি নেই। মাঝে মাঝে আড্ডা চুটকি হাসিতামাশা এইসব হলেও কোনো বাধা নেই। হওয়াই বরং দরকার। নাহলে আমাদের এক বন্ধুর ভাষায়, 'পুরোটাই খাঁচা' হয়ে যাবে। :-)
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 113.2.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ০৪:৪৬516993
  • বেশ কয়েকদিন আসতে পারিনি। তাই অনেক কিছুই উত্তরে বলা হয়ে ওঠেনি। 
     
    দেবাশিসবাবু আপনি আমার প্রস্তুতি নিয়ে হতাশ হতেই পারেন। তা যথার্থও বটে। আমি যে সর্ব অর্থে ভীষণ প্রস্তুত সে দাবি একবারও করতে পারি না। তবে কিছুটা হতাশা অন্যদিক থেকেও জমতে পারে। যেমন আমি সত্যিই শ্রদ্ধা করি আপনাকে এবং আপনাদের মতো মানুষদের যাঁরা নিরলস প্রয়াস চালাচ্ছেন সমাজটাকে ঠিক করার জন্য। সেখান থেকে আমিও সত্যিই ভাবিনি যে আপনার যুক্তিতে নিও ম্যালথুসিয়ান তত্ত্বের মান্যতা থাকবে। (এ ব্যাপারে আমি ভুল প্রমাণিত হলেই খুশি হবো) যাক সে ব্যাপারে পরে বিস্তারিত আসবো। একটু সময় দিন। কারণ সত্যিই আমার একেবারেই সময় হচ্ছে না। তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। 
     
    তবে এর মধ্যেও এটুকূ বলা প্রয়োজন। অন্তত দুটি ব্যাপারে। প্রথমত আপনি বলেছেন 'রেস' আধুনিক নির্মাণ নয়, অতি প্রাচীন ব্যাপার এবং দ্বিতীয়ত দারিদ্র্য ও অসাম্যের মতো ডিটেনশন ক্যাম্প পুঁজিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। আমি কিন্তু উল্টোটাই বলবো। আপনি যদিও আমাদের বা আমার ইতিহাস পাঠকে বোকা পাঠ বলে দাগিয়ে দিয়েছেন, তবুও বোঝানোর একটা চেষ্টা করবো।   
     
    আগে একটু ভ্যান্তারা করে নিতেই হবে। (ওতে বিজেপিকে দায়মুক্ত করার প্রশ্নটাও ঢুকে আছে।) আমার মতে বিজেপি একটি ফ্যাসিস্ট ক্যাপিটালিস্ট পার্টি এবং আজকের ভারতবর্ষ একটি ফ্যাসিস্ট রেজিমের শুরুর পর্যায়। আমরা যদি মার্ক্সের কথামতো পুঁজিবাদকে এমন একটা ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিই, যে ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে টিঁকে থাকে উৎপাদনের যাবতীয় উপায় ও উপাদানের একচ্ছত্র ব্যক্তিমালিকানা ও ওয়েজ লেবারের ওপরে; তবে এটাও মেনে নিতে হবেই যে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা আসলে শ্রেণীবিভক্ত, যাকে কম বেশি শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তখন সবার আগে যে প্রশ্নটা আসে তা হলো ফ্যাসিবাদ কোন বিশেষ শ্রেণীটির ইন্টারেস্ট রক্ষা করে এবং কোন সামাজিক শ্রেণী থেকে তা উদ্ভুত হয়। উত্তরে যা দেখা যায় তা হল ফ্যাসিবাদ এই শ্রেণীসংগ্রামের চরিত্রটিকেই গুলিয়ে বিকৃত করে তোলে, ফলে সাধারণ জনতা নিজের ইন্টারেস্টের বিরুদ্ধেই আচরণ করতে শুরু করে এবং অজ্ঞানেই তারা তাদের ইন্টারেস্ট রক্ষায় নিজেদের অপচয় করে ফেলে যারা সেই সময়ের কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি লাভ করে চলেছে। এমন কি যেখানে ফ্যাসিস্টরা পূর্ণ ক্ষমতায় নেই, সেখানেও তারা সাধারণের দৃষ্টিতে তার আসল শত্রুর চেহারা গুলিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এবং একই সঙ্গে তারা সাধারণের দৃষ্টিতে অতি জাতীয়তাবাদ বা রেসিয়াল হোমোজেনিটির আধিপত্য ভরে দিতে সক্ষম হয়। ফলে শ্রেণিসংগ্রাম থেকে বিচ্যুত জনতা এক কল্পিত শত্রুকে আসল শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার ভুলটি করতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটি ঘটতে থাকে কখনো 'রেস, কখনো ধর্ম, কখনো জাতীয়তাবাদ -- এইসবের কাঁধে ভর দিয়ে। আর আর শত্রুতার অভিমুখটি থাকে বিভিন্ন কল্পিত শত্রু অর্থাৎ বিভিন্ন 'অপর'-এর দিকে; কখনো ইহুদি, কখনো উদ্বাস্তু, কখনো মুসলমান, কখনো হিস্পানিক ইত্যাদি। এই ব্যাপার ধীরে ধীরে চুড়ান্ত চেহারা পায় যখন ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতায় আসে। ফলত ফ্যাসিবাদের উত্থান শ্রেণীঘৃনাকে সম্পূর্ণ মিসলিড করে। সবচেয়ে সুবিধে তাতে কার ঘটে? এই জন্যই পুঁজিবাদ যখনি সংকটে পড়ে, সাধারণত ফ্যাসিবাদ তখন পূর্বের কর্তৃত্ববাদী পুঁজিবাদী শ্রেণী ও ব্যবস্থাটিকে সংকট থেকে উদ্ধার করে এবং পুনরায় মজবুত করে। পুঁজিবাদের সবচেয়ে হিংস্র রূপটিও তখন আত্মপ্রকাশ করে। এই রূপটির সহায়ক হিসেবে হিটলারের ক্ষেত্রে 'রেস'-এর ধারণা যে কারণে প্রয়োজন ছিল, ভারতের ক্ষেত্রে মনুবাদ-ও সেইভাবেই দরকারি।  বিজেপির বিষয়টা আশা করি বোঝাতে পারলাম। আরো পরিষ্কার হবে। একটু সামির আমিনকে উদ্ধৃত করা যাক -- 
    (1) The fascism of the major “developed” capitalist powers that aspired to become dominant hegemonic powers in the world, or at least in the regional, capitalist system.
    Nazism is the model of this type of fascism. Germany became a major industrial power beginning in the 1870s and a competitor of the hegemonic powers of the era (Great Britain and, secondarily, France) and of the country that aspired to become hegemonic (the United States). After the 1918 defeat, it had to deal with the consequences of its failure to achieve its hegemonic aspirations. Hitler clearly formulated his plan: to establish over Europe, including Russia and maybe beyond, the hegemonic domination of “Germany,” i.e., the capitalism of the monopolies that had supported the rise of Nazism. He was disposed to accept a compromise with his major opponents: Europe and Russia would be given to him, China to Japan, the rest of Asia and Africa to Great Britain, and the Americas to the United States. His error was in thinking that such a compromise was possible: Great Britain and the United States did not accept it, while Japan, in contrast, supported it.
     
    এবার আসি ডিটেনশন ক্যাম্পের প্রসঙ্গে। একটু আপনার উদ্ধৃতি ব্যবহার করি -- 
    আরেকটু পরিষ্কার করি, এখানে একটা কাণ্ডজ্ঞানের সমস্যাও আছে। যদি বলতেন, পুঁজিবাদ থাকলে দারিদ্র্য এবং অসাম্য থাকবেই, ক্ষমতায় যে-ই থাকুক --- তো সেটা মেনে নিতে অসুবিধে একটু কম হত। কিন্তু, যদি ডিটেনশন ক্যাম্প-কে দারিদ্র্য আর অসাম্যের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে পুঁজিবাদের অপরিহার্য উপাদান করে তোলেন, তাহলে কাণ্ডজ্ঞান তো আপত্তি জানাবেই! 
     
    উত্তরে এখনো বলবো যে আপনার কান্ডজ্ঞান যতই আপত্তি জানাক, ডিটেনশন ক্যাম্পের ধারণা একটি পুঁজিবাদী প্রকল্প এবং একই সঙ্গে তা নেহাতই একটি আধুনিক নির্মাণ। আউশভিৎসের হিটলারি আতঙ্কের সময়ই শুধু নয়, অনেক আগে থেকে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অনুষঙ্গ হিসেবে ডিটেনশন ক্যাম্পের প্রচলন। এই আধুনিক প্রকল্পটি প্রথম চালু হয়েছিল ১৮৯৫ সালে ঔপনিবেশিক কিউবায়। যখন স্বাধীনতাকামী কিউবার বিদ্রোহী জনতা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিলো তখন কিউবার গভর্নর জেনারেল আর্সেনিয়ো মার্টিনেজ কাম্পোস স্পেনের প্রাইম মিনিস্টারকে একটি চিঠিতে প্রস্তাবনা করেন --  ... the only path to victory lay in inflicting new cruelties on civilians and fighters alike. To isolate rebels from the peasants who sometimes fed or sheltered them, it would be necessary to relocate hundreds of thousands of rural inhabitants into Spanish-held cities behind barbed wire, এই স্ট্রাটেজির নাম হয়েছিল  reconcentración.তবে মার্টিনেজ এই নৃশংসতার দায়ভার নিতে চাননি। তার বদলে স্পেন থেকে এই প্রকল্প কার্যকর করতে পাঠানো হয়েছিল ভ্যালেরিয়ানো ওয়েলারকে, যাকে কিউবার জনতা 'দ্য বুচার' বলে চিনতো। এরপর ১৯০০ সালে বহু মানুষের সাধের ব্রিটিশ সভ্যতাকৃত বোঅর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। তারপর ১৯০৪ সালে জার্মানদের তৈরী হেরেরো ও নামাদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। এই উদাহরণ অর্থাৎ সিভিলিয়ানদের জন্য ডিটেনশন ক্যাম্পের উদাহরণ আধুনিক যুগের আগে দিতে পারবেন? আর এই সবই ঘটেছে সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক পুঁজির নৃশংসতায়। আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে। লেনিনের ওই বক্তব্যটি তো আমাদের কারোর অজানা থাকার নয় -- সাম্রাজ্যবাদ হলো পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়। তাহলে কোথায় মানতে অসুবিধে হচ্ছে যে অসাম্য ও দারিদ্র্যের মতো ডিটেনশন ক্যাম্প-ও পুঁজিবাদের একটি ভয়ঙ্কর বিষফল! এভাবে কি পুঁজিবাদের নৃশংসতা ঢাকা যায়? 
     
    এবারে আসি 'রেস'-এর প্রসঙ্গে। আপনি বলেই দিয়েছেন এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। হতে পারে। তবে যা যা জানি বলে নিজে ভাবি তা একটু নির্লজ্জের মতো ঝালিয়ে নিই। না মশাই, রেস যা দেখছি আধুনিক একটি ব্যাপার। মানে যাকে রেস বলে জানি। এবং আপনিও জানেন বুফোঁ-ব্লুমেনবাক-লিনিয়াস-বের্নিয়ারের হাত ঘুরে ডারউইনবাদ হয়ে ইউজেনিক্স অবধি হিউমান-সায়েন্সের গতিপথ। আমার চেয়ে তো বটেই, অনেকের চেয়ে বেশি জানেন। তবে কিইবা বলবো! যেটা এখানে বলবো সেটা হলো রেস-এর ধারণাটি প্রাচীনকাল থেকেই আছে এই বয়ান রেখে আধুনিকতাকে দায়মুক্ত করার চেষ্টাটা আমার ধারণায় ঠিক নয়। মনুবাদী কাস্টিসমকে নিশ্চই টানবেন না। এটুকু আশা করতেই পারি। আধুনিকতার আলোয় আলোকিত পুঁজিবাদকে আড়াল করতে গিয়ে এক ধরণের একাডেমিক এই তত্ত্ব দেন। আধুনিকতার সূর্যোদয় ভীষণভাবেই ইউরোপেরই বিষয়। তাই প্রাচীন যুগ বলতে টেনে আনা হয় গ্রীকযুগকে। কিন্তু গ্রীকসভ্যতায় রেস-এর এই আধুনিক ধারণা ছিলই না। a genos বলতে সাধারণত নোবল পরিবারগুলিকে বোঝানো হতো। তা মোটেই জাতিগত বা বায়োলোজিক্যালি বোঝানো হতো না। গ্রিকরা তাদের নিজেদের কখনো 'হোয়াইট' হিসেবে ভাবেনি। টিম হুইটমারশ বলছেন -- Greeks simply didn’t think of the world as starkly divided along racial lines into black and white: that’s a strange aberration of the modern, Western world, a product of many different historical forces, but in particular the transatlantic slave trade and the cruder aspects of 19th-century racial theory.  
    প্রকৃতপক্ষে গ্রিকরা তাদের নায়কদের বরাবর কল্পনা করে এসেছে মাল্টিএথনিক পরিচয়ে। মিশরীয় দানাউস আর্গোস-র রাজা হয়েছিলেন। তাঁর মেয়ে হাইপারমেষ্ট্রার বংশজাত ছিল সবচেয়ে মহান গ্রিক নায়ক হেরাক্লেস বা হারকিউলিস। পার্সিউস ইথিওপিয়ান এন্ড্রোমিডাকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁদের সন্তানেরা ব্রোঞ্জ যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রিক রাজ্য মাইসিনি-র প্রতিষ্ঠা করেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে লেখা হেরোডোটাস-এর বই লেখার উদ্দেশ্য ছিল to, “preserve the fame of the important and remarkable achievements produced by both Greeks and non-Greeks” এঁকেই ইতিহাস লেখকদের পিতা হয়ে থাকে। তাঁর লেখাতেই আছে -- ইথিওপিয়ানরা পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা এবং সুন্দরতম মানুষ। ইতিহাসবিদ পিটার ফার্ব-এর মতে গ্রিক সাহিত্য, স্থাপত্য, মিথলজিতে কালোদের সর্বত্র সমানভাবে দেখা হয়েছে। এছাড়া পনেরশ শতকের আগে দাসত্ব কোথাও চামড়ার রঙের নিরিখে বা বংশানুক্রমে চালু ছিল না। আরো উদাহরণ দিতে পারতাম। থাক। আসল কথা হলো 'রেস'-এর আধুনিক ইউরোপকৃত ধারণাটি হলো আধুনিক বিজ্ঞানের থেকে ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদের কাছে আসা সেই মহার্ঘ্য উপহার যা দিয়ে অইউরোপীয় মানুষদের বংশানুক্রমিক দাসে পরিণত করার প্রক্রিয়াটিকে, আরো বড় করে দেখলে অইউরোপীয় ভুখন্ডগুলিকে দাসত্বের শৃঙ্খলে অবদমিত করার প্রক্রিয়াটিকে জাস্টিফাই করে নেওয়া গিয়েছিলো। আপনি কত সহজে বলছেন -- 
    জাতিবাদ আর বর্ণবাদ বহু প্রাচীন বস্তু, উনিশ শতকে বিজ্ঞানের নতুন হাতিয়ার পেয়ে তাকে 'জাস্টিফাই' করার চেষ্টা হয়েছিল মাত্র, এবং তার ফলে প্রথমে রমরমিয়ে বেড়ে উঠলেও পরবর্তীকালে তা দীর্ঘমেয়াদি বৈজ্ঞানিক বিচারের আওতায় চলে আসে, এবং অনিবার্যভাবে শেষতক এক বৌদ্ধিক লজ্জা বলে সাব্যস্ত হয়। বলা বাহুল্য, বিজ্ঞান না থাকলে এইটা কোনওদিনই সম্ভব হত না। 
     
    দক্ষিণ আমেরিকার ৯০ শতাংশ জনসংখ্যা বিলুপ্ত হয়ে গেল কয়েক বছরে; প্রায় এক লপ্তে ১২ মিলিয়ন আফ্রিকান দাস হিসেবে চালান হয়ে গেলো আর আমরা কত সহজে এসব নিয়ে নিই। 
    যাক বোকা পাঠকের হ্যাজ একটু বড় হয়ে গেল। অনেকের মতে গরুর রচনা। তাই সই। আবার সময় পেলে জনসংখ্যা নিয়েও বলতে আসবো। মুক্তচিন্তার আশা পূরণ করা গেল না। :-)
     
  • &/ | 151.14.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ০৫:০০516994
  • তাহলে প্রাচীন গ্রীসে, রোমে দাসদের সরবরাহ কোথা থেকে আসত? ওই সমাজগুলো ভীষণভাবে দাসের শ্রমশক্তির উপরে নির্ভরশীল ছিল। দাসরাই প্রভুর জমিতে চাষবাসের কাজ থেকে আরম্ভ করে প্রভুর বাড়িতে প্রভুগণের স্নানের জল গরম করা, রান্নাবান্না করা, অন্যান্য গৃহকর্ম করা, প্রভুগণের চরণসেবা, অন্যান্য পরিচর্যা - সবই করত। রাস্তাঘাট তৈরীর যে বিশাল বিশাল প্রোজেক্ট রোমান আমলের, যার জন্য ইতিহাসে বিখ্যাত তাঁরা, সেইসব রাস্তাঘাট তৈরী হয়েছে মূলতঃ ক্রীতদাসদের শ্রমে।
  • &/ | 151.14.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ০৫:০৫516995
  • আর রোমান আমলের ওই বীভৎস শো, গ্ল্যাডিয়েটরদের সঙ্গে বন্যপশুর লড়াই, সেইসব গ্ল্যাডিয়েটররাও তো ক্রীতদাসই ছিল। এরা বাধ্য হত মরণপণ লড়াই করে মরতে, আর রোমান 'অভিজাত'রা গ্যালারিতে বসে দেখতেন।
    এইসব সবই কিন্তু তথাকথিত 'বিজ্ঞান-হাতিয়ারযুক্ত ঔপনিবেশিক' যুগের চেয়ে অনেক অনেক আগের কথা।
  • Amit | 118.208.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ০৬:৩৭516997
  • আর যারা এই যুগের যাবতীয় সমস্যার পেছনে একমাত্তর আধুনিক বিজ্ঞানের দোষ খুঁজে পাচ্ছেন, সেটার বিরুদ্ধে লড়াই কি তেনারা তীর ধনুক নিয়ে করবার প্ল্যান করছেন ? বিপ্লবের আশায় বসে বসে দরজার হাতলে যে মরচে পড়ে গেলো , তাও সে এসে দরজায় টোকা দিল না। 
     
    আর যদি বেশি দেরিই হয়ে গিয়ে থাকে , আর কিছু করার নেই , তাহলে আর বেশি ভেবে কি হবে ? আগে পাঁচটা এক্সটিংশন ইভেন্ট তো হোয়েছে। ছ নম্বর টাও হবে। অনন্তকাল ধরে কি আর লাইফ একই ফর্মে থাকবে ?
  • আধুনিকতার খোঁজে | 113.2.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ১১:৩০516999
  • &/
    আপনি আমার লেখাটা ভালো করে পড়েননি। দাসত্ব ছিল। প্রাচীন পৃথিবীর সর্বত্র। কিন্তু তা বংশানুক্রমিক ছিল না। রক্তের সূত্রে দাসের সন্তানরা দাসই -- এই ব্যাপারটা ছিল না। এ ছাড়াও আগে দাসত্ব আমৃত্যু ছিল না। দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়াও সম্ভব ছিল। কিন্তু সায়েন্টিফিক ক্ল্যাসিফিকেশনের খোপে ঢুকিয়ে কালোদের অবমানব হিসেবে দেখিয়ে বংশানুক্রমিক চ্যাটেল স্লেভারির সামাজিক লাইসেন্স তৈরী করা, না মশাই এ ছিল না। 
  • রাধার কানাই | 115.187.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ১২:০১517000
  • @আধুনিকতাৰ খোঁজে 
    আমি বেশি সময় পাচ্ছি না ফাঁকে ফাঁকে আসছি। বড় ডিটেল মন্তব্য তিনচারদিন পর করব। আপনার মন্তব্যগুলো খুবই সুচিন্তিত যথারীতি সমৃদ্ধ হচ্ছি , সেজন্য ধন্যবাদ। তবে , আপনারসঙ্গে আংশিক সহমত। কেন সেটা পরে ব্যাখ্যা করব। 
     
    তবে একটাছোট কথা বলছি 
    দাসত্ব ছিল। প্রাচীন পৃথিবীর সর্বত্র। কিন্তু তা বংশানুক্রমিক ছিল না। রক্তের সূত্রে দাসের সন্তানরা দাসই -- এই ব্যাপারটা ছিল না।
     
    দাসব্যৱস্থাৰ ক্ষেত্র হয়ত তাইই , কিন্তু প্রাচীন ভারতে কাসটিজম কিন্তু বহু আগে থেকেই বংশানুক্রমিক হয়ে পড়েছিল , আর সেটা পৰৱৰ্তী বৈদিক যুগ থেকেই। আধুনিকতার বহু আগেই। 
     
    বংশাণুক্রমিক শোষণের বিষয়টা তথাকথিত আধুনিকতার বহু আগেরই। 
     
    ( তবে আপনি সময়মত আলোচনা প্লিজ চালিয়ে যান , অপনার অলোচনা থেকে অনেক কিছু  জানতে পারছি।  )
  • রাধার কানাই | 115.187.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ১২:০২517001
  • দাসব্যৱস্থাৰ ক্ষেত্র ---> দাসব্যাবস্থার ক্ষেত্রে 
  • আধুনিকতার খোঁজে | 113.2.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ১২:১৭517002
  • আধুনিকতার খোঁজে  | 113.21.76.150 | ০৫ মার্চ ২০২৩ ০৪:৪৬
    এই লেখায় আমার অজ্ঞাতেই দুটো লাইন উড়ে গেছিলো। খেয়াল করিনি। অনুরোধ করবো এভাবে পড়তে। 
     
    আপনি কত সহজে বলছেন -- 
    জাতিবাদ আর বর্ণবাদ বহু প্রাচীন বস্তু, উনিশ শতকে বিজ্ঞানের নতুন হাতিয়ার পেয়ে তাকে 'জাস্টিফাই' করার চেষ্টা হয়েছিল মাত্র, এবং তার ফলে প্রথমে রমরমিয়ে বেড়ে উঠলেও পরবর্তীকালে তা দীর্ঘমেয়াদি বৈজ্ঞানিক বিচারের আওতায় চলে আসে, এবং অনিবার্যভাবে শেষতক এক বৌদ্ধিক লজ্জা বলে সাব্যস্ত হয়। বলা বাহুল্য, বিজ্ঞান না থাকলে এইটা কোনওদিনই সম্ভব হত না। 
     
    চেষ্টা হয়েছিল মাত্র -- এই বয়ানে বিষয়টা কি লঘু হয়ে যায় না? আর মানবতাবাদী বিজ্ঞান যে ওই ভয়ংকর তত্ত্বকে অসার প্রমান করতে পেরেছে তার পেছনে ২য় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পোস্ট মডার্ন যুগের প্রবল মানবতাবাদী আন্দোলন, ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলন, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার এইসবের প্রভাবের কথা না উল্লেখ করলে কী করে চলবে? আপনি বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে বলুন, বিজ্ঞানের দার্শনিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করুন। কিন্তু আধুনিক যুগের আধুনিক বিজ্ঞানের অপকর্মের পচা মাছ শাক দিয়ে ঢাকবেন কেন? 
  • আধুনিকতার খোঁজে | 113.2.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ১২:২১517003
  • রাধার কানাই 
    বংশানুক্রমিক শোষণ ছিল মনুবাদী বর্ণ ব্যবস্থায়। এ সবারই জানা। তবে সেটা ইউরোপীয় রেসিজম নয়। কাস্টিজম। এখানে রেস-এর ধারণা ও আধুনিকতা ও আধুনিক বিজ্ঞানের সম্পর্ক বুঝতে গেলে ইউরোপীয় ভূখণ্ডের প্রাচীন ইতিহাসই প্রযোজ্য। 
  • আধুনিকতার খোঁজে | 113.2.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ১২:৩১517004
  • রাধার কানাই 
    আপনার কম্প্লিমেন্টের জন্য ধন্যবাদ। তবে আমার কাজের নেচারটাই এমন অন্যদিকের যে খুব মুশকিল হয় ধারাবাহিকতা মেন্টেন করা। আর যেহেতু ওরকম ভাবে চর্চায় নেই তাই পুরোনো পড়াশোনা আবার ঝালাতে হয়। কিছুই লাইন বাই লাইন মনে থাকে না। সেটাও চাপের। তও চেষ্টা করি। :-)
  • হারামি ছেলে | 115.187.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ১৯:২১517014
  • ঠিকই বলেছেন আধুনিকতার খোঁজে। 
    দেবাশিসবাবুদের চোখে শুধু ধর্মীয় মৌলবাদ পড়ে , বিজ্ঞান মৌলবাদকে খুব সুচারুভাবে এড়িয়ে যান উনি। 
  • আধুনিকতার খোঁজে | 45.25.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ২২:৪০517021
  • আরেকটা কথা ছেড়ে গিয়েছি। হয়তো কয়েকদিন আবার ডুব দিতে হতে পারে। তাই বলে যাই। হিন্দুত্বের প্রসঙ্গে আপনাকে আঘাত করার কোনোই অভিপ্রায় আমার ছিল না। হয়তো আমি আরো অনেকের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছি। আমি আপনারা শব্দটি ব্যবহার করলেও সেটি ঠিক হয়নি। এই জেনারেলাইজেশনের জন্য আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী। আপনার ৪নং-এর লেখাটা পড়েছি। নি:সন্দেহে খুবই ভালো লেখা। আমি অনেকাংশেই একমত। এখানেই রঞ্জন রায় মশাইয়ের সাভারকারের ওপর একটা লেখা পড়েছিলাম। খুবই মূল্যবান লেখা। 
    তবুও আমার কিছু বক্তব্য রয়েছে। প্রথমত আমি সাভারকারের ব্যাপারে সম্ভবত নাস্তিক বলেছিলাম। আমি তাহলে ভুলই ছিলাম। যদিও মুসলমানদের প্রতি প্রচন্ড অসূয়া ছাড়া সাভারকারের ধর্মপ্রাণতার ব্যাপারে এখনো কিছুটা হলেও আমি সন্দিহান। অবশ্য এটা আমার কাছে জরুরি বিষয় নয়। একটা মানুষ নাস্তিক বা ধর্মহীন হলেও সে যে সাম্প্রদায়িক হবে না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। হিটলার-গবেষক এলান বুলক বলেছেন, হিটলার 'গড' বা 'কনসায়েন্স' কোনোটাই মানতেন না। হিটলারের মতে ক্রিশ্চিয়ানিটি ছিল স্লেভদের ধর্ম হিসেবে উপযুক্ত। হিটলারের ধারণায় -- Christianity was a religion fit only for slaves; he detested its ethics in particular. Its teaching, he declared, was a rebellion against the natural law of selection by struggle and the survival of the fittest. (যা পুঁজিবাদী নৈতিকতার খুবই কাছাকাছি) তো আমার মতে শুধুমাত্র নাস্তিক অথবা ধর্মহীন হলেই হবে না। আসলে অসাম্প্রদায়িক প্লুরালিটিতে বিশ্বাস রাখতে গেলে নৈতিকতার দর্শন দরকার। ধর্মের যেমন নিজস্ব নৈতিকতার বয়ান আছে তেমনি পুঁজিবাদের নিজস্ব নৈতিকতার বয়ান আছে। এও দেখি না যে বিজ্ঞান নিজে নিজের কোনো  নৈতিকতার বয়ান নির্মাণে খুব একটা সফল। প্রায়ই তা পুঁজিবাদী নৈতিকতাকেই পরিপুষ্ট করে তোলে। যেটা নেই তা হলো একটি তৃতীয় নৈতিকতার রেফারেন্স। একটা উদাহরণ ব্যবহার করতে চাই  --  আমার পরিবারের কিছু মানুষ নোয়াখালীর দাঙ্গার বলি হয়েছিলেন। আমার বাবা (তখন তিন বছরের মাতৃহারা শিশু), ঠাকুরদা কোনোরকমে লুকিয়ে প্রাণরক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তা স্বত্তেও আমার ঠাকুরদা মানবতায় আস্থা হারাননি। কোনোদিনই তিনি বিন্দুমাত্র সাম্প্রদায়িক হোয়ে ওঠেননি। না তিনি মোটেই শিক্ষিত ছিলেন না। এমনকি আমৃত্যু দেশ ছেড়ে এপারে আসেননি। অপরদিকে আমি অনেক শিক্ষিত নাস্তিক মানুষকেও আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী হেজেমনির শিকার হতে দেখেছি। তো আমার মতে সাভারকার নাস্তিক হলেও তার সাম্প্রদায়িক হতে কোনো বাধা ছিল না। আর তিনি যে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ধারণায় প্রভূত পরিমানে অনুপ্রাণিত ছিলেন সেটা বোধহয় অস্বীকার করা সম্ভব না। রঞ্জন রায় মহাশয় ও আপনার থেকে এব্যাপারে মতামত জানার অভিপ্রায় থাকলো।      
  • আধুনিকতার খোঁজে | 45.25.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ২২:৫০517023
    • Amit | 118.208.220.254 | ০৫ মার্চ ২০২৩ ০৬:৩৭516997
    • আর যারা এই যুগের যাবতীয় সমস্যার পেছনে একমাত্তর আধুনিক বিজ্ঞানের দোষ খুঁজে পাচ্ছেন, সেটার বিরুদ্ধে লড়াই কি তেনারা তীর ধনুক নিয়ে করবার প্ল্যান করছেন ? বিপ্লবের আশায় বসে বসে দরজার হাতলে যে মরচে পড়ে গেলো , তাও সে এসে দরজায় টোকা দিল না। 
       
      আর যদি বেশি দেরিই হয়ে গিয়ে থাকে , আর কিছু করার নেই , তাহলে আর বেশি ভেবে কি হবে ? আগে পাঁচটা এক্সটিংশন ইভেন্ট তো হোয়েছে। ছ নম্বর টাও হবে। অনন্তকাল ধরে কি আর লাইফ একই ফর্মে থাকবে ?
    তীর-ধনুক নিয়ে পড়েছেন মানে আবার ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান। না বারবার জবাব দেওয়ার অত সময় নেই। আর আধুনিক বিজ্ঞান এমন সব আধুনিক জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছে যে হাতলে আর মরচে ধরার ভয় থাকবে না। তারপর নিশ্চিন্তে বিপ্লববাবুর আশায় বসে থাকুন। 
     
    না, আপনি যখন আছেন আর ভাববো কেন। কাল থেকেই ডোডোপাখি হয়ে যাওয়ার আনন্দে ছয় নম্বর এক্সটিংশনের ওয়েলকাম পার্টি দেব। 
  • Debasis Bhattacharya | ০৫ মার্চ ২০২৩ ২২:৫২517024
  • আধুনিকতার খোঁজে,
     
    এইই সব, নাকি আরও কিছু বলবেন? সময় নিয়েই বলুন, আমার কিন্তু একদমই তাড়া নেই! 
  • আধুনিকতার খোঁজে | 45.25.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ২২:৫৫517026
  • দেবাশিসবাবু 
    আপাতত এই। আজ একটু ঘুমাতে হবে। কাল থেকে আবার। :-) জনসংখ্যার ব্যাপারটা পরে বলি? 
  • আধুনিকতার খোঁজে | 45.25.***.*** | ০৫ মার্চ ২০২৩ ২২:৫৬517027
  • কাল থেকে আবার গাধার খাটুনি। 
  • Debasis Bhattacharya | ০৬ মার্চ ২০২৩ ০১:২৬517036
  • আপনি পুরো বলে নিন, যা বলবার। তারপর আমি বলব। সময় নিন, সমস্যা কী? ইতিমধ্যে বরং অন্যদের মন্তব্য/প্রশ্ন নিয়ে কথা বলি একটু। 
  • Amit | 121.2.***.*** | ০৬ মার্চ ২০২৩ ০৫:০০517037
  • দেবাশিস বাবু গুছিয়ে উত্তর দেবেন নিশ্চয়। কিন্তু আধুনিকতার খোঁজে র পোস্ট গুলোতে আবেগ যতটা ওভারফ্লোয়িঙ  হচ্ছে , যুক্তি ততটা পাচ্ছিনা। ওনার মতে কাস্ট এবং রেস্ পুরো আলাদা কনসেপ্ট এন্ড রেস্ কনসেপ্ট টার যাবতীয় দায়িত্ব আধুনিক বিজ্ঞানের। এই লজিক এর ভিত্তি টা কোথায় ? রেস্ বলতে কি বর্ণভেদ ? না জাতিভেদ ? সেটা হিন্দুদের কাস্ট সিস্টেম এর থেকে কোনদিকে এবং কেন আলাদা ? আজকের ইউরোপে ​​​​​​​যে ​​​​​​​দেশগুলো ​​​​​​​দেখা ​​​​​​​যায় তারা ​​​​​​​কি ​​​​​​​অনন্তকাল ​​​​​​​ধরে ​​​​​​​এক ​​​​​​​আছে ? অনেকের ​​​​​​​মধ্যেই ​​​​​​​ইন্টারনাল ​​​​​​​রিফ্ট ​​​​​​​দেখলে ​​​​​​​ভারত ​​​​​​​পাকিস্তান ​​​​​​​লজ্জা ​​​​​​​পাবে। ​​​​​​​যুগোস্লাভিয়া ​​​​​​​চারটে ​​​​​​​দেশে ​​​​​​​ভেঙে ​​​​​​​গেছে। ​​​​​​ক্যাটালোনিয়া / ​স্পেন ​​​​​​​অথবা মাসেডোনিয়া / গ্রিস ​​​​​​​বহু দেশের ​​​​​​​মধ্যে স্ট্রাইফ  চলতেই ​​​​​​​থাকছে। ​​​​​​​ওনার তথাকথিত ​​​​​​​রেস্ ​​​​​​​কনসেপ্ট ​​​​​​​দিয়ে ​​​​​​​কি ​​​​​​​এগুলো সব ​​​​​​​এক্সপ্লেন ​​​​​​​করা ​​​​​​​যায় ? নাকি ​​​​​​​এসব ​​​​​​​আধুনিক বিজ্ঞানের ​​​​​​​জন্যে ​​​​​​​হয়েছে ​​​​​​​আজকে ? 
     
    কোন ​​​​​​​সিস্টেমে ​​​​​​​দেশ ​​​​​​​রা ​​​​​​​মুক্তি ​​​​​​​পেয়ে ​​​​​​​অভিজাত ​​​​​​​সম্প্রদায়ের ​​​​​​​পাশাপাশি ​​​​​​​বসতে ​​​​​​​পারতো ? সেতো ​​​​​​​মনুবাদীরাও ​​​​​​​বলে থাকে ​​​​​​​বর্ণভেদ ​​​​​​​আসলে ​​​​​​​কর্মফল- ভালো কাজ করলে নাকি নিচুজাতেরাও ওপরে আসতে পারে। ​​​​​​​তো ​​​​​​​শুদ্দুরের ​​​​​​​পৈতে ​​​​​​​হয়েছে ​​​​​​​দেখেছেন ​​​​​​​নাকি ​​​​​​​কোথাও নিজের চোখে ? এসব ​​​​​​​ডিস্ক্রিমিনেশন ​​​​​​​করতে ​​​​​​​বা মানুষকে বংশের পর বংশ ধরে ক্রীতদাস বানিয়ে রাখতে ইন্ডিয়ার আধুনিক ​​​​​​​বিজ্ঞানের ​​​​​​​সাহায্য ​​​​​​​লেগেছিলো ​​​​​​​নাকি ? 
     
    গায়ের রং সাদা হলেও ইউরোপে একগাদা জাতির মধ্যে মারামারি কাটাকাটি আছে আধুনিক বিজ্ঞানের বহু আগের থেকে। কালো বা কম সাদা হলেও আফ্রিকার বা আরবের বিভিন্ন ট্রাইবের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি কবে ছিলোনা ? বা আধুনিক বিজ্ঞানের আগে সব শান্তিকল্যাণ ছিল ?  ইন্ডিয়াতে প্রাচীনকাল থেকে যেসব যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে তাতে কি হাজারে হাজারে প্রাণহানি হয়নি ? প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগ অবধি পুরো ইতিহাসটাই তো যুদ্ধের ইতিহাস। কলিঙ্গ যুদ্ধের রক্তারক্তি দেখে অশোক নাকি অহিংস বৌদ্ধ হয়ে গ্যালেন গল্প আছে - তো তিনি কাস্ট হিসেবে যুদ্ধ করছিলেন ?নাকি রেস্ হিসেবে ? হিসেব আছে ? যুক্তিটাও দিয়ে দেবেন সঙ্গে। চেঙ্গিস খানের মঙ্গোল সৈন্যরা যখন  গোটা  চীন অর্ধেক এশিয়া-ইউরোপ উজাড় করে দিয়েছিলো তখন তারা কি হিসেবে যুদ্ধ করছিলো ?রেস্ না কাস্ট না অন্য কিছু ? তখনকার  পপুলেশন এর হিসেবে মোঙ্গলদের ডেথ টোল গুনলে তো আজকে নাজিদের নিরীহ মনে হবে। তাদের কি  এটম বোম্ব ছিল ? 
     
    হ্যা , একসাথে একলাখ মানুষ মারার টেকনোলজি আসেনি। সে গাছ থেকে নামার পর মানুষ পাথর ঠুকে ঠুকে আগুন জ্বালাতো। এবার তার হিসেবে দেশলাই বা  মশাল টাও একটা বিরাট টেকনো লিপ। এবারে সেই দেশলাই দিয়ে কে রান্না করলো আর কে পাশের পাড়ায় খড়ের গাদায় আগুন দিলো - তার দায়িত্ব টা কি যে দেশলাই বানিয়েছে তার ? 
     
    চিরকাল রাজাগজারা মিলিটারি টেকনোলজি তে ইনভেষ্ট করেছে যাতে প্রতিবেশী দের মেরে তাড়িয়ে নিজের রাজত্ব বাড়ানো যায়। সেই হিসেবে ক্রসবো বানানো বা দামাস্কাস স্টিল দিয়ে তলোয়ার বানানো সবই এটম ব্যোমের প্রিকার্সের। অগেরটা না এলে পরেরটা আসতো না।  একদল যখন সাধারণ ধনুক বানিয়েছে , আর একদল ক্রসবো বানিয়েছে তার জবাবে। গ্রিকরা ইনফ্লেমেবল টার এ ডোবানো কাপড় আগুন জ্বালিয়ে তীরে লাগিয়ে ছুড়ে মারতো যাতে ম্যাক্সিমাম ড্যামেজ করা যায়। আর্কিমিদিস তো কনকেভ মিরর দিয়ে শত্রু জাহাজে আগুন লাগিয়ে দেওয়া আবিষ্কার করেছিলেন। উদ্দেশ্য একই। মিলিটাৰিলি বাকিদের থেকে এগিয়ে থাকা। তখনকার হিসেবে সেটাই বাকিদের থেকে এগিয়ে থাকা আধুনিক বিজ্ঞান। এটা একটা কন্টিনিউস জার্নি। নট এ ডেস্টিনেশন। 
     
    ১২-১৩ সেঞ্চুরিতে চীনের মেরিন ফোর্স ইউরোপের থেকে অনেক এডভান্সড ছিল। অনেক বড়ো সাইজের জাহাজ বানাতে পারতো। মিং ডিনাসটিতে হেং হি নামে একজন এডমিরাল একটা বড়ো এক্সপেডিশন ফোর্স নিয়ে কলম্বাসের বহু আগে আমেরিকায় পৌঁছেছিল। তারপর নিজেদের ইন্টারনাল পলিটিক্স এ আটকে গিয়ে আর এক্সপোরেশন করেনি। তারপর সেই দৈ কলম্বাস নামক নেপো এসে মেরে দিলো। এবার চীনারা আমেরিকা অধিকার করে উঠতে পারলে তারা সেখানকার নেটিভ আমেরিকান দের দুধে ভাতে রাখতো কিনা নাকি আরো তাড়াতাড়ি মেরে সাবাড় করতো সেটা ধর্মতলার মোড়ে যারা টিয়াপাখি নিয়ে বসে থাকে তারা ছাড়া আর কেও বলতে পারবে বলে তো মনে হয়না। 
     
    আজকে স্টিম ইঞ্জিন , লং রেঞ্জ কামান , সুতোর কল ইউরোপের বদলে চীন জাপান বা আরব এ আবিষ্কার হলে তারা যে  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো একই এক্সপ্লয়টেশন স্টাইলে  গ্লোবাল এম্পায়ার বানাতে চেষ্টা করতো কিনা সেটা কেও বলতে পারে ? পারেনি-তাই করেনি বা  করে উঠতে পারেনি- যেভাবেই দেখা যাক। সেসব মাসির গোঁফ গজালে সে মামা হতো কিনা তার মতোই অবান্তর আলোচনা । 
     
  • &/ | 107.77.***.*** | ০৬ মার্চ ২০২৩ ০৫:৩৯517038
  • আন্দামান দখল করার পর জাপানিরা যা করেছিল শোনা যায়,  সাম্রাজ্য হলে আর দেখতে হত না ---
  • লাকু | 115.187.***.*** | ০৬ মার্চ ২০২৩ ১২:০৮517043
  • কিন্তু আধুনিকতার খোঁজে র পোস্ট গুলোতে আবেগ যতটা ওভারফ্লোয়িঙ  হচ্ছে , যুক্তি ততটা পাচ্ছিনা।
     
    পাবেন না , এটাই ​​​​​​​স্বাভাবিক , কারণ ​​​​​​​ওঁর ​​​​​​​কথাগুলোর ​​​​​​​যুক্তি ​​​​​​​বুঝতে ​​​​​​​হলে ​​​​​​​ঘটে  ​​​​​​​কিছু ​​​​​​​থাকতে ​​​​​​​হয় 
  • Debasis Bhattacharya | ০৬ মার্চ ২০২৩ ১৫:৩৫517046
  • কথা হতে থাকুক, আমার বক্তব্য আমি পরে বিস্তারিত বলছি। ইতিমধ্যে সবাই, যদি মন চায়, তো এইটা পড়ে নিতে পারেন।
     
     
    এই লেখাটির বক্তব্য হচ্ছে, বর্ণবাদের ধারণাটা অবশ্যই প্রাগাধুনিক, তবে প্রাচীন নয়, মধ্যযুগের পরের দিকের (ইউরোপের কথাই হচ্ছে, বলা বাহুল্য)। 
     
    ধারণাটির শিকড় যে প্রাচীনই, মধ্যযুগীয় নয় --- সে ব্যাখ্যা পরে দেব। কিন্তু, এটি যে অন্তত মধ্যযুগীয়, আধুনিকতা এর জন্মদাতা নয়, সেটা আগে দেখে নিন। 
  • &/ | 151.14.***.*** | ০৭ মার্চ ২০২৩ ০০:১৩517051
  • প্রাচীনযুগে দাসপ্রথা বংশানুক্রমিক ছিল না, এটাই বা আ খোঁ কীভাবে বলছেন? যেখানে খোলা বাজারে গরু ভেড়া কেনাবেচার মতন দাস কেনাবেচা হত, একেবারে আইনানুগ অবস্থায়, জাস্ট জিনিসপত্র কেনাবেচার মতন, সেখানে এইসব দাসদের সন্তান হলে তাদের মুক্ত করে দিয়ে স্বাধীন মানুষের মতন ট্রীট করা হত, এটা আদৌ সম্ভব নাকি? আ খোঁ কি বলতে চাইছেন সেরকমই হত? এর সপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ দিতে পারবেন? নাকি সবটাই সেই গত শতকের চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের প্রোপাগান্ডা?
  • আধুনিকতার খোঁজে | 122.162.***.*** | ০৭ মার্চ ২০২৩ ০০:৫৭517052
  • এটি বহুপঠিত। আইবেরিয়া মুরদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সময় আন্টি-মুর মানসিকতা এবং ১৫শ শতকের একেবারে শেষপ্রান্তে ও মডার্নিটি-র সূচনায় এন্টি-সেমিটিজম প্রবল হয়ে ওঠে। কিন্তু তাকে মোটেই আধুনিকতা যে সায়েন্টিফিক রেসিজম-এর জন্ম দিয়েছে তার সঙ্গে তুলনা করা চলেনা। যেমন সেই সময় স্পেনের marranos রা। এই স্পেনীয় ইহুদিরা ব্যাপ্টাইজড হয়েছিল। কিন্তু গোঁড়া খ্রিস্টানরা তাদের কখনোই মেনে নেয়নি তারা রক্তের দিক থেকে পিওর ছিল না বলে। যেমন এখনো আরবরা বাঙালি মুসলমানকে মুসলমান বলে সমমর্যাদা দেয় না। এটাকে বুফোঁ-লিনিয়াস-ব্লুমেনবাক কৃত রেসিজম-এর ধারনা থেকে কতটা আলাদা সেটা আপনি ভালো করেই জানেন। হিউম্যানিটিকে বায়োলজিক্যাল ক্লাসিফিকেশনের খোপে খোপে আলাদা করে সাদা চামড়ার ইউরোপীয়রাই যে বায়োলোজিক্যালি সবার শ্রেষ্ঠ এই প্রমান করার চেষ্টা; আপনি দেখিয়ে দিন ১৭৪৯-এর আগে কে করেছে! এমনকি আপনার উল্লেখিত প্রবন্ধেও সায়েন্টিফিক রেসিজম যে মডার্ন একটি বিষয় সেটা কিন্তু ঢাকতে পারেনি। আমি ভেবেছিলাম আপনি তো এ সবই জানেন তাহলে মডার্নিটি-র এই অন্ধকার বিষয়টিকে আলোচনা করবো না। এখন দেখছি সবাইকে জানাতে তাও করতে হবে। (কিন্তু আমি ​​​​​​​একটা ​​​​​​​জিনিস ​​​​​​​বুঝতে ​​​​​​​পারি ​​​​​​​না, এটা ​​​​​​​বলতে ​​​​​​​অসুবিধে ​​​​​​​কোথায় ​​​​​​​যে ​​​​​​​মডার্নিটি-তে ​​​​​​​এই ​​​​​​​অন্ধকার ​​​​​​​মানবতাবিরোধী ​​​​​​​বিষয়গুলোও ​​​​​​​মিশে ​​​​​​​ছিল। মডার্নিটি ইউরোসেন্ট্রিক ছিল। ​​​​​​​এগুলো ​​​​​​​আমরা ​​​​​​​নিতে ​​​​​​​চাই ​​​​​​​না। ​​​​​​​ডাইলেক্টিক্যালি ​​​​​​​দেখলেই ​​​​​​​তো ​​​​​​​হয়। তাতে কি সমস্যা হয়?) 
     
    আমার একেবারেই সময় ​​​​​​​নেই। ​​​​​​​কিন্তু ​​​​​​​আপাতত যার কথা আলোচনা করছি সেই ​​​​​​​'রেস'-এর মূল ​​​​​​​পাঁচটি ​​​​​​​ক্রাইটেরিয়া ​​​​​​​কি ​​​​​​​হয় ​​​​​​​তা ​​​​​​​এখানে ​​​​​​​রেখে ​​​​​​​গেলাম ​​​​​​​সবার ​​​​​​​জন্য। ​​​​​​​(রাধার কানাই এবং অমিতবাবুর ​​​​​​​জন্য-ও; ​​​​​​​মনুবাদী ​​​​​​​জাতিভেদপ্রথা ​​​​​​​ও ​​​​​​​ইউরোপীয় ​​​​​​​রেস-এর ​​​​​​​পার্থক্যটা ​​​​​​​যাতে ​​​​​​​বোঝা ​​​​​​​যায়। ​​​​​​​তবে ​​​​​​​দুটিই ​​​​​​​ভয়ঙ্কর ​​​​​​​মানবতাবিরোধী ​​​​​​​তাতে ​​​​​​​কোনো ​​​​​​​সন্দেহ ​​​​​​​নেই।)
     
    (1) Races reflect some type of biological foundation; (2) This biological foundation generates discrete racial groupings, such that all and only all members of one race share a set of biological characteristics that are not shared by members of other races; (3) This biological foundation is inherited from generation to generation, allowing observers to identify an individual’s race through her ancestry or genealogy; (4) Genealogical investigation should identify each race’s geographic origin, typically in Africa, Europe, Asia, or North and South America; and (5) This inherited racial biological foundation manifests itself primarily in physical phenotypes, such as skin color, eye shape, hair texture, and bone structure, and perhaps also behavioral phenotypes, such as intelligence or delinquency.
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন