পীরজাদার রাজনৈতিক রূপান্তর ও বিবর্তনটার দিকে একবার চোখ মেলে দেখে নেওয়া যাক।
শওকত মোল্লা ভাল না খারাপ সেটা যে যার মত হিসেব করুন। কিন্তু শওকত মোল্লা একজন রাজনৈতিক কর্মী। আজ জিতেছে, কাল হেরে যাবে। আর সেই শওকত মোল্লা এই পীরজাদাকে পীরজাদা হিসেবে পাত্তা দেয় নি, তার বাহুবলিত্বের কনুই ধরে মুচড়ে দিয়েছিল। তারপরই পীরজাদার নেতা হওয়ার ইচ্ছা চাগাড় দিয়ে ওঠে। তার রাজনৈতিক ভাষণ শুরু হয় তার ওয়াজ মেহফিলেই! তার শুরুয়াতি রাজনৈতিক বক্তব্য কী ? “দাদাহুজুরের হাত ধরে জান্নাত যেতে চাও আর পীরজাদার আদেশে ভোট দেবে না?” হ্যাঁ, ঠিক শুনছেন। এটা কমরেড পীরজাদার প্রথম ফতোয়া। প্রথমে তিনি মমতারই দ্বারস্থ হন। বাদ সাধেন তাঁর চাচা ত্বহা সিদ্দিকী। পীর পরিবারের প্রত্যক্ষ রাজনীতি করায় আপত্তি তার। শওকত মোল্লা তো ছিলই।
এরপরের ঘটনাক্রম দেখার মত।
দিলীপ ঘোষ তাঁকে রাজনীতিতে প্রবেশের জন্য অভিনন্দন জানান, ওয়েসি ফুরফুরা আসেন, বলে যান যে তিনি এখানে মিমের সংগঠন বানাবেন না, আব্বাসের সঙ্গে থাকবেন। এবং কালাতিপাত না করে সিপিএম-কংগ্রেস তাঁর কাছে যায় কবুল-কবুল-কবুল বলতে! সুতরাং ধর্মও এল, জিরাফও এল, পীরজাদার কদমবোস করতে।
একটি বোধোদয় বিমানবাবুদের হয়েছে: যেন-তেন-প্রকারেণ-মমতাকে-হারানোর জন্য ২০১৬তে তারা যে ভোট পদ্মপুষ্পায়ঃ নমঃ করেছিল তা আর ফেরত আসছে না। তাই মমতারই ‘মুসলিম তোষণের’ কম্যুনিস্টিক সংস্করণ সৃষ্টি করার এই মহৎ প্রয়াস। মমতাকে মমতার খেলায় মাৎ দিতে হবে। বিমানদার নিজের সিদ্দিকুল্লা চাই। হ্যাঁ, বিমানবাবুরা জামায়েত উলেমায়ে হিন্দের পদাধিকারী বলে সিদ্দিকুল্লাকে সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি মনে করেন। পড়াশোনা করার জন্য বিখ্যাত কমরেডরা ‘জামায়েত উলেমায়ে হিন্দ’ শব্দবন্ধের মানে জানে না, সংস্থাটির ইতিহাস জানে না। চাড্ডিমান্য সংজ্ঞা অনুযায়ী দাড়ি আর টুপি ছাড়া সিদ্দিকুল্লার কোন নেড়েগুণ নাই। অধুনা রাজনৈতিকোচিত হার্মাদপনা, বাটপাড়ি অবশ্যই আছে। তবু, বিমানদা যখন বলেছেন, তখন সিদ্দিকুল্লা জামাতে উলেমায়ে হিন্দের পদাধিকার বলেই সাম্প্রদায়িক। তাই বিমানদার এককাঠি সরেস, নিরেট, একেবারে একটা আস্ত জ্যান্ত পীরজাদা চাই! উলেমায়ে হিন্দ বনাম স্বয়ং শ্রীমান পীরজাদা! ইহা ধ্রুপদী প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি।
আমাদের বিমানবাবুরা একটু বেশি উপরচালাক। আইএসএফ, সোরেন ইত্যাদি। কেবল রাজনীতি করে বলে বাঙালি নেতা বাঙালি জনতাকে শাকে ঢাকা দিয়ে পচা মাছ খাওয়ানোর সাহস করে!
এবার এই কাবিননামার দেনমোহরের হিসেবটা দেখা যাক। ওয়েসি মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, বিহারে কী করেছে সেটা রাজনীতির ক্লাসের শেষ বেঞ্চের শিক্ষানবিশরাও জানে। একটা উদাহরণ দিই। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ। মুসলমান আবাদি ২৭ শতাংশ। রামপুর, মুজফফরনগর, মোরাদাবাদের মতো লোকসভা আছে, যেখানে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মুসলমান ভোটার। ২০১৩ পর্যন্ত সেখানে আধ ডজন মুসলিম সাংসদ আর ডজন দুই মুসলিম বিধায়ক ছিলেন, এসপি/বিএসপি/কংগ্রেস থেকে। ২০১৪ তে সেখানে কোন মুসলমান সাংসদ তো দুর, কোন অমুসলিম অ-বিজেপি নেই। মনে করিয়ে দিই, ২০১৩-তে মুজফ্ফরনগরে দাঙ্গার সূচনা হয় পাকিস্তানের এক ভিডিও উত্তর প্রদেশের বলে হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে। কাজটি করে সঙ্গীত সোম, বর্তমান বিজেপি বিধায়ক। আর হ্যাঁ, ২০১৪-র ভোটে ওয়েসি মিয়া উত্তর প্রদেশে ভোটে লড়েন। বলাই বাহুল্য ওয়েসি এইসব মুসলমান অধ্যুষিত এলাকাতেই প্রার্থী দিয়েছিলেন। এখন, আব্বাস সিদ্দিকী কোন আসনে প্রার্থী দেবেন, তা কি বলে দিতে হবে? কমরেড বিমান বসুরা তাঁকে অমুসলিম অধ্যুষিত, অন্তত তপশিলি আসন ছাড়ছেন নাকি?
আসামে আজমল মিয়ার মুসলমান পরিচয় ভিত্তিক রাজনীতির পরিণতি কারোর অজানা নয়। আসামে মুসলমান আবাদি ৩৩ শতাংশ। বিজেপি একক নিরঙ্কুশ এবং হিমন্ত বিশ্বশর্মা ঢাক গুড়গুড় না করে বলে দিয়েছে মুসলমান ভোট তার দরকার নেই।
এই হল এই হালাল সোনালী কাবিনের সোনার মোহর ভর্তি দেনমোহরের থোলো! বাঙালি মুসলমান, চিল্লাইয়া কন, আমীন।
******
ভোটের পাটিগণিতটা একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। আব্বাস মুসলমান অধ্যুষিত সিটে প্রার্থী দেবে।
তৃণমূল, বিজেপি, জোট(আব্বাস) ত্রিমুখী লড়াই। আব্বাস সিপিএমের ফেবল্ড ৭%পাবে? এই ভোটেরও একভাগ কেবল আব্বাসের কারণে বিজেপিতে যাবে।
অন্যদিকে কংগ্রেস ভোটের একাংশও বিজেপির দিকে ঝুঁকবে। বিশেষত অধীর-গড়ে তাঁর ভোটের একটা বড় ভাগ কার্তিক ঠাকুরের আশীর্বাদরূপে আসে। আব্বাস তাঁর মুরীদের ভোট পাবেন। খুব বেশি হলে ৫/৭ শতাংশ মুসলমান ভোট। এটা দুই ২৪ পরগনায়, অধীর-গড় ও অন্যত্র আরো কম। গত নির্বাচনে তাঁদের সিংহভাগ মমতাকেই ভোট দিয়েছিল। আইএসএফের একটা প্রার্থীও জিতবে? মনে হয় না। সুতরাং এইসব সিটে পালাবদল হলে বিজেপিই জিতবে। তবু বিমানদার এই আঁতাত কেন চাই? আদিবাসী ও নমঃশূদ্র হয় ঘাসফুলে চরছে নয় হিন্দুত্বে দীক্ষিত হয়ে গেছে। মুসলমানরা আর ‘বিজেপি চলে আসবে’ বললে মজছে না, তারা ৩৪ বছরের খতিয়ানে নিজেদের দেনাপাওনা খুঁজছে। তাই সিদ্দিকুল্লার অ্যান্টিবায়োটিক চাই বিমানদার। একেবারে আস্ত জ্যান্ত একটা কমরেড পীরজাদা!
নাকের বদলে নরুণ। টাক ডুমা ডুম ডুম। দুই কুকুরের হাড্ডাহাড্ডিতে হাড্ডি শেয়ালেই খাক।
কে এই আব্বাস সিদ্দিকী? আব্বাস সিদ্দিকী ফুরফুরা সিলসিলার অভিষিক্ত পীরজাদা। বেশ বিখ্যাত। তার ল্যাঙ্গোয়েজ, বডি ল্যঙ্গোয়েজ, অমুসলিমবিদ্বেষ, নারীবিদ্বেষ রীতিমত হিংসে করার মত। সুফি ইসলামের মানবতাবাদের নামগন্ধ তাতে কিছু নেই। পারিবারিক পরিবেশে শোনার মত নয়, পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডায় উদ্ধৃতি যোগ্যও নয়। জনসমাবেশে গ্রহণযোগ্য উচ্চারণে বাংলা বলতে পারেন না! হ্যাঁ, এখানে জন্মানো, বড় হওয়া, বাঙালি মুসলমান পরিবারের মাদ্রাসা যাওয়া সন্তান ঠিক করে বাংলা বলতে পারে না।
একই ব্যক্তির সাথে একই বাক্যে তুই-তুমি-আপনি/নেবে-লেবে’তে যুগপৎ আনায়াস, রুথলেস, বিরাট কোহলির পৃথিবীর বিভিন্ন পিচে ব্যাটিংয়ের মত যেন!
he displays that streak of extra theatricality in public speaking that jumps over the boundary of acting & lands in the domain of idiocy, dumbness , amply adorned with his legendary semantic somersaults.
ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিতে বর্ণিত মন্দাবুদ্ধির অন্যতম লক্ষণ এটি। অবশ্য অধুনা প্রধানমন্ত্রী সম্বন্ধেও আমাদের পরিচিত ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্ট আশিস নন্দী একই কথা বলেছেন প্রায় তিন দশক আগে।
ইউটিউব ভরে পড়ে আছে। যার ইচ্ছা দেখতে পারেন।
এবং ক্লিপগুলি নিয়ে আপনার পরিচিত কোন ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাতেও পারেন।
এখন, হঠাৎ করে এহেন আব্বাস সিদ্দিকীকে নিয়ে পড়লাম কেন? আমি পড়ছি না, পড়েছেন আব্বাস সিদ্দিকী, যেভাবে এক টেম্পেরামেন্টাল মন্দাবুদ্ধি পড়তে পারেন। যেটা হওয়ার কথা নয়। একই ধর্মের মানুষ হলেও এই প্রাণীটি ৯০ শতাংশ বাঙালি মুসলমানের সামাজিক, পারিবারিক,রাজনৈতিক পরিসরে ছিলেন না। হ্যাঁ, আড়াই কোটির ১০ শতাংশ ২৫লাখ। একটু বেশিই রাখলাম পীরজাদার ভাগায়,খুব বেশি হলে এর আধা হবে। এ হেন কমরেড পীরজাদা হুট করে খুঁটি ছেঁড়া হোঁৎকা বলদের মত ঢুকে পড়েছে মুসলমান ভোটের সবুজ মাঠে।
ভুল বললাম, খুঁটিছেঁড়া নয়, খুঁটি থেকে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। লঞ্চ করা হয়েছে বলা যায়! তাকে রাজনৈতিক রাখালেরা চরাচ্ছে। মুসলমান ভোটের মাঠে। দিলীপ ঘোষ, ওয়েসির শুভেচ্ছাপ্রাপ্ত, বিমান বসু, অধীর চৌধুরী এই পীরজাদাকে রাজনীতিতে অভিষিক্ত করেন ব্রিগেডে। তাকে সাবআলটার্ন ভয়েস বলা হচ্ছে। ব্রিগেডে তার নারায়ে তকবীর না-বলার মধ্যে দেশি লেনিনরা সর্বহারা বিপ্লবের অঙ্কুরোদ্গম শুঁকছে। এই পীরজাদাই দরকার হলে রক্ত দিয়ে দেশের “স্বাধীনতা করবে!” মুসলিম অভিনেত্রীর পেশা ও অমুসলিম জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার কারণে সর্বসমক্ষে ‘চাবকে চামড়া তুলে’ সর্বহারার বিপ্লব সমাধা করবে।
সোস্যাল, প্রিন্ট, অডিও-ভিস্যুয়াল মিডিয়ায় কমরেড ভাইজান পড়ানো হচ্ছে সাবআলটার্ন অল্প-অর্ধ-অশিক্ষিত গরিব মুসলমানদের। সবচেয়ে বিষাক্ত শ্রেণিশিক্ষক হচ্ছে কতিপয় তথাকথিত মেকলেশিক্ষিত লেনিনপ্রসূত সেলিমেরা। এইসবই ঐশী, স্বতঃস্ফুর্ত ভাববে কিন্তু ঐ ১০/১৫ লাখ মুরীদ। এই গোয়েবলসিয়ান, সঙ্ঘী খুড়োর কল বাকিদেরও যত সম্ভব যথাসম্ভব মুরীদিকরণের শুভ উদ্যোগ নিয়েছে।
রাজনীতিতে আমরা যেভাবে নেতাজী-নেহরু-আজাদ পেয়েছি, শ্যামাপ্রসাদ-জিন্নাহ কিন্তু আমরা সেভাবে পাইনি। আবার শ্যামা-জিন্নাহ যেভাবে পেয়েছি মোদী-যোগী-ওয়েসি সেইভাবেই পেয়েছি। নেতাজী যদি মায়ের হাতের পলান্ন হয় শ্যামা হল পাড়ারই/বাড়িরই নর্মদার নোংরা পাঁক। এই আব্বাস সিদ্দিকীও সেই নর্দমা থেকেই, ধর্মান্ধতার পাঁক থেকেই, মুসলমান সমাজের নর্দমার!
এই খেলার প্রথম খেলোয়াড় এঁরা নন, মমতা সেটাও খেলে রেখেছেন পীরজাদার চাচাকে দিয়ে। এঁরা অগ্রবর্তী সংস্করণ এনেছেন। ত্বহা পীর পরিবারের হলেও পীর নয়; এঁরা একেবারে অভিষিক্ত পীরজাদা এনেছেন।
মুসলমান বাঙালি, তোমারই নর্দমা থেকে নোংরা পাঁক তোমারই থালায় পলান্ন বলে রাখছে ওরা। সম্প্রদায়ের অযোগ্যতম লোকেদের থেকে একজনকে সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক অভিভাবক বানানোর কমিয়নিষ্টকারী বিপ্লব থেকে নিজেদের বাঁচাতে না পারলে সেটা আত্মহত্যা হবে।
'বামেরা যদি তিনোর ভোট ভাঙাতে পারে তাহলে বিজেপির লাভ, আর বামেরা যদি বিজেপির ভোট ভাঙাতে পারে তাহলে তিনোর লাভ।'
100% একমত। এবং এই কারণেই আতংকিত ছিলাম যখন বামেরা ৮০% তিনো বিরোধিতা করছিল আর ২০% বিজেপি। এখন এই নো ভোট টু বিজেপি ক্যাম্পেনের চাপ তৈরী হওয়ার পরে ব্যাপারটা ৫০-৫০ র কাছাকাছি এসেছে। আপাতত এতেই চলবে। মানে কাজ চালিয়ে নিতে হবে। বামেরা বিজেপি থেকে ভোট ভাঙাক সেটাই চাই। তবে তিনো থেকে ভাঙাতে চাইলেও তাদের দোষ দেওয়া যায় না। তাদের অধিকার আছে সব দল থেকে নিজের দিকে ভোট ভাঙিয়ে আনার। কিন্তু যতদিন অব্দি ইচ্ছেটা শুধু তিনোদের থেকে ভোট ভাঙিয়ে আনার ইচ্ছে ছিল, বা থাকবে, ততদিন নো ভোট টু বিজেপি ক্যাম্পেনের প্রাসঙ্গিকতা থাকবে।