২০২৩ সাল হিমালয়ের বিপর্যয়ের বছর। বিপর্যয় যেন পিছু ছাড়েনি। অক্টোবর মাসে ঘটেছিল সিকিমের হিমবাহ হ্রদ ভাঙনের ঘটনা এবং তার ফলে প্লাবিত হয়েছিল তিস্তা উপত্যকার বিস্তীর্ণ এলাকা। হিমবাহ হ্রদ ভাঙনের ঘটনা হিমালয়ে নতুন নয়। আমরা আগেও দেখেছি ২০১৩ সালে চোরাবাড়িতাল হিমবাহ সংলগ্ন গান্ধী সরোবর ভাঙনের ফলে কেদারনাথের হিমালয়ান সুনামি। কত হাজার প্রাণ হারিয়েছিল তার হিসেব নেই।
জলবায়ু পরিবর্তনকে এই বিপর্যয়ের জন্য সরাসরি দায়ী করা যেতে পারে। পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের সম্মুখভাগের অর্ধগলিত অংশে হ্রদ তৈরি হয় প্রাকৃতিকভাবে। এই হ্রদের তিন পাশের দেওয়াল নির্মিত হয় হিমবাহ বাহিত মোরেন দ্বারা। মোরেন শব্দটির অর্থ হল যে পাথর ও পলি হিমবাহ পাহাড় ক্ষইয়ে ভেঙে বয়ে নিয়ে আসে। এই মোরেন-এর মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বড় আকারের পাথর থাকে। সূক্ষ্ম দানার পলি খুবই কম। কারণ হিমবাহের গতি শ্লথ; ভেঙে আনলেও পাথর বেশিদূর বহন করে নিয়ে যায় না। ফলত ভেঙে আনা পাথরের টুকরো গড়িয়ে গড়িয়ে আরও ছোট আকারে ভেঙে এবং ক্ষয়ে সূক্ষ্ম হয়ে যাবার অবকাশ থাকে না। সেইজন্য সঞ্চিত মোরেনের পাথর ও পলির সহজে একসঙ্গে কঠিনায়ন ঘটে না এবং মোরেন দ্বারা হিমবাহের হ্রদের যে পাড় প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হয়, তার স্থিতিশীলতা খুব বেশি হয় না। সামান্য ভূমিকম্পের ফলেও এই পাড় ধসে গিয়ে হ্রদের জলে পাহাড়ের নিচের ঢাল প্লাবিত হয়ে যেতে পারে।
এই ভাঙন ত্বরান্বিত হতে পারে ঋতুবদলের সময়। বসন্ত এবং গ্রীষ্মের শুরুতে তুষারের গলন হলেও, যেসব পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ থাকে, সেখানকার তাপমাত্রা এতখানি নেমে যায় না সাধারণত যে হিমবাহের সম্মুখের হ্রদ ফুলে ফেঁপে উঠতে পারে। এই বিপদের আশঙ্কা অত্যধিক থাকে বর্ষায়। মেঘ ভাঙনের ফলে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরে তৈরি হয় বিপদ। এই হ্রদগুলিতে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি জল জমতে শুরু করলেই ভেঙে পড়তে পারে হ্রদের পাড়।
তবে হিমালয় অঞ্চলের হিমবাহগুলি যে একেবারেই আগের মত অবস্থাতে নেই, এই নির্মম সত্য গত বেশ কিছু বছরের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে। বিভিন্ন উপগ্রহ চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে ১৯৭৫ থেকে ২০০০ সালের মাঝের সময়ে যে হারে গলন ঘটেছিল হিমবাহগুলির, গত কয়েক বছরে গলনের হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে; গত শতাব্দীর তুলনায় এই গলনের হার প্রায় দ্বিগুণ। হিমালয়ের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের হিমবাহের সম্মুখভাগে নতুন নতুন হ্রদ তৈরি হচ্ছে হিমবাহের গলনের ফলে। বলা হচ্ছে যে যদি এই হারে এই অঞ্চলের হিমবাহগুলি গলতে থাকে, তাহলে খুব বেশি হলে আর মাত্র আশি বছরের মধ্যে হিমালয় পর্বত হিমবাহবিহীন হয়ে যাবে। হিন্দুকুশ হিমালয়ের হিমাবৃত অঞ্চলকে পৃথিবীর ‘তৃতীয় মেরু’ বলা হয়ে থাকে এবং এই মেরু নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে বিজ্ঞানীরা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ২০০০ সালের পর থেকে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে বছরে প্রায় ৪৫ সেন্টিমিটার করে গলে পিছিয়ে যাচ্ছে হিমবাহগুলি। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে এই হিমবাহগুলির উপরে।
আবার বিশ্ব উষ্ণায়নের উপরে মনুষ্যকৃত কর্মকাণ্ডের প্রভাব কতখানি, সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। পরিবেশবিদদের একটা বড় অংশের মত হল কলকারখানা, যানবাহন ইত্যাদি থেকে নির্গত ধোঁয়ার মধ্যে দ্রবীভূত কার্বন, সালফার ইত্যাদি শুধু যে পরিবেশ দূষিত করছে, তাই নয়, পৃথিবীর বায়ুস্তরের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে তুলছে। আবার একদল ভূতত্ত্ববিদের মতে বিশ্ব উষ্ণায়ন হল পৃথিবীর ভবিতব্য। অতীতে ৪.৬ লক্ষ কোটি বছর আগে পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি বহুবার পৃথিবীর এই জ্বর এসেছে, অর্থাৎ উষ্ণায়ন ঘটেছে, মহাপ্লাবন ঘটেছে, তারপর জ্বর নেমে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে ঘটেছে হিমায়ন। অর্থাৎ এসেছে হিমযুগ। পৃথিবীর শরীরের পক্ষে এসব একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে তখন মানুষ আসেনি পৃথিবীতে। ফলে এই উষ্ণায়ন, প্লাবন, হিমযুগ সেভাবে ভোগ করেনি মানুষের সভ্যতা। তবে মহাপ্লাবন ইত্যাদির গল্প যুগ যুগ ধরে নানা দেশের রূপকথা, ধর্মগ্রন্থ, লোককথায় পাওয়া যায়। ফলে মহাপ্লাবন হয়তো মানুষের পৃথিবীতে আগমনের পরেও বহুবার ঘটেছে। কিন্তু এই উষ্ণায়ন এবং হিমায়ন বিষয়ক প্রমাণ কিন্তু পৃথিবীর পাথরে পাথরে পাওয়া যায়। সেইজন্য এই উষ্ণায়নে মানুষের সেরকম কিছু দোষ নেই, ও তো হবেই… এরকম কথাও বলছেন একদল ভূতাত্ত্বিক। কিন্তু মানুষের কৃতকর্মের ফলেই হোক, আর পৃথিবীর ভবিতব্যই হোক, উষ্ণায়ন যে ঘটছে, এই কথা অস্বীকার করবার জো নেই এবং এই উষ্ণায়ন হিমালয়ের হিমবাহগুলির গলে গলে পিছিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী।
হিমালয়ের হিমবাহগুলি থেকে যেসব নদ নদীর উৎপত্তি হয়েছে, সেগুলি এশিয়ার সর্বমোট ১৬টি দেশের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে। ২ লক্ষ কোটি মানুষের জীবন জীবিকা, জনপদ এই নদ নদীগুলির উপরে প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। হিমবাহের অতিরিক্ত গলনের ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে নদীতে দেখা দেবে ভয়াবহ প্লাবন। সামুদ্রিক জলস্তর বৃদ্ধি পাবে। সেই বিপদের কথা এখানে বিশদে বলছি না। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা যে ২০৫০ সাল অবধি এই প্লাবনের বিপদ পিছু ছাড়বে না হিমালয়ের হিমবাহ থেকে উদ্ভূত নদীগুলিকে। এই সময় অবধি যদি নদীগুলির পাড়ে গড়ে ওঠা এশিয়া মহাদেশের জনপদগুলি টিকে থাকে, তাহলে হিমবাহ পিছিয়ে যাবার দ্বিতীয় ধাপে তৈরি হবে খরা। এই আশঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া একটু মুশকিল, কারণ নদীগুলিতে প্লাবনের মাত্রাধিক্য বার বার পরিলক্ষিত হচ্ছে।
উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু অঞ্চলেও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে হিমাবৃত অঞ্চল হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু হিমালয়ের এই তৃতীয় মেরুর হিমবাহ ক্ষয় এবং হিমাবৃত অঞ্চল হ্রাসের হার অস্বাভাবিক বেশি, যা পরিবেশবিদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ বাড়িয়ে তুলছে। তবে এই আশঙ্কার পাশাপাশি সাম্প্রতিক একটি গবেষণা কিছুটা আশার বার্তা শুনিয়েছে। আসলে প্রকৃতি যেকোনো অসুখ থেকে সেরে উঠবার জন্য নিজস্ব শরীরে কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এও হয়তো সেরকম কিছু ঘটে যাচ্ছে।
আসলে বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একটা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে হিমালয় পর্বতের হিমবাহগুলি। গত বছর ডিসেম্বরে নেচার জিওসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা দাবি করছে যে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে হিমবাহ সংলগ্ন বায়ুতলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেক বেশি তাপের আদানপ্রদান ঘটছে। এই তাপের আদানপ্রদানের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য হিমবাহ সংলগ্ন বায়ুস্তরের উপরের বায়ুস্তর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি শীতল হয়ে যাচ্ছে। এই শীতল ভারি বাতাস পাহাড়ের উচ্চতর অংশ থেকে নিচের ঢালে বয়ে আসছে এবং পাহাড়ের নিচের অংশের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। ফলে গ্রীষ্মকালে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে যখন হিমবাহের গলন বাড়ছে, তখন গ্রীষ্মের গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম থাকছে। তবে এই তাপমাত্রার হ্রাসের সামগ্রিক প্রভাব হিমবাহের গলন কমিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট, এই কথা এখনই বলা যাবে না। আরও অনেক জায়গায় পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন, আরও অনেক দিন, আরও ঋতুবদলের তাপমাত্রা মেপে দেখবার প্রয়োজন আছে। এমনও হতে পারে যে বিশ্বের সামগ্রিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রিত থাকলেও হিমবাহগুলির গলন একেবারেই রোধ করা গেল না। তবে উষ্ণায়ন যদি এখনও হ্রাস পায়, তবুও হিমবাহের একটা বড় অংশের গলন আটকানো সম্ভব হবে না।